নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

মৌনতার জমিনেই প্রলম্বিত হয় সেলিম আল দীনের ছায়ারা

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:২৫

আমার নানা-নানির দুই মেয়ে, আমার মা আর রাবেয়া খালা; মা বড়, রাবেয়া খালা ছোট। মা দেখতে সুশ্রী আর খালা সেইরকম সুন্দরী! খালা লম্বায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি, টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ, সুন্দর মুখশ্রী। খালার বয়স এখন একান্ন, কিন্তু এখনো চমৎকার শরীরের গড়ন। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর আমার মায়ের বিয়ে হয়ে যায়, বিয়ের পর মা আর লেখাপড়া করেননি, মা এখন গৃহিনী। খালা মাস্টার্স পাস, তিনি এখন একটি নামী বেসরকারী কলেজের শিক্ষক। নানা-নানির যেহেতু কোনো ছেলে নেই, তাই তারা তাদের দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিজের বাড়িতেই রেখে দিয়েছেন। চারতলা বাড়ি নানার। আমরা নানা-নানির সঙ্গে দুইতলায় থাকি, আর খালা তার পরিবার নিয়ে থাকে তিনতলায়, একতলা আর চারতলা ভাড়া দেওয়া। আমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা আড়ালে আমার বাবা আর খালুকে ঘরজামাই বলে কটাক্ষ করে। করুক, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। একটা ছেলে যদি বিয়ের পর বউ নিয়ে নিজের বাবার বাড়িতে থাকতে পারে, একটা মেয়ে কেন তার বর নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকতে পারবে না? তাছাড়া মা আর খালা না দেখলে নানা-নানিকে দেখবে কে? তাদের এখন বয়স হয়েছে।

আমরা দুই ভাইবোন; আমি বড়, ভাই ছোট। আমি বাংলায় অনার্স করছি, তৃতীয় বর্ষ; আর আমার ভাই ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। খালার দুই মেয়ে, রিয়া আর প্রিয়া। রিয়া ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্রী, আর প্রিয়া পড়ে ক্লাস নাইনে।

রাবেয়া খালা শিক্ষক মানুষ, সেটা তিনি তার হাব-ভাবে সর্বদাই প্রকাশ করে থাকেন। আমাদের দুই পরিবারের সবাই খালাকে একটু ভয় পায়, শুধু আমি ছাড়া। নানান বিষয়ে খালার সঙ্গে আমার মতবিরোধ হয়, আমি তার মুখে মুখে কথা বলি, তর্কও করি। ইদানিং খালা আমাকে দেখতে পারেন না, সেটা তিনি মুখে না বললেও আমি বুঝি। খালা এখন হিজাব পরেন, তার দুই মেয়েকেও হিজাব পরতে বাধ্য করেছেন। খালা আমাকেও হিজাব পরতে বলেছেন, চোখ রাঙিয়েছেন, বাঁকা কথা শুনিয়েছেন, আমার বাবা-মায়ের কাছে নালিশ করেছেন। কিন্তু আমি তার কথা মতো হিজাব পরি না। মাথায় একটা বস্তা নিয়ে ঘুরতে আমার ভাল লাগে না! খালা বলেন, ‘এই যে এখন এতো ধর্ষণ হয় এতে মেয়েদেরও দায় আছে! মেয়েদের উচিত শালীন পোশাক পরে, চুল ঢেকে বাইরে যাওয়া। সেজেগুজে চুল খুলে ছেলেদের সামনে দিয়ে গেলে ছেলেরা তো মেয়েদের দেখে উতলা হবেই! বোরকা বা হিজাব পরা থাকলে ছেলেরা সেই মেয়ের দিকে সম্ভ্রমের চোখে তাকায়।’

আমি আমার কলেজ শিক্ষক খালার কথা শুনে কিছুটা অবাক হই, একজন শিক্ষিত নারী এভাবে ভাবতে পারেন! খালাকে বলি, ‘খালা, কুমিল্লায় তনুকে ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হলো তোমার মনে আছে? ও কিন্তু হিজাব পরেই বাইরে গিয়েছিল। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে হিজাব বা বোরকা পরা অনেক মেয়েকেই ধর্ষণ করা হয়। আবার দ্যাখো, পশ্চিমা দেশের অমুসলিমরা বোরকা বা হিজাব পরে না, তবু ওদের দেশে ধর্ষণের ঘটনা খুব বেশি ঘটে না। শোনো খালা, যে ধর্ষক, সে সুযোগ পেলে বোরকা কেন, মেয়েদের শরীরে লোহার বর্ম পরিয়ে দিলেও ধর্ষণের চেষ্টা করবে!’

খালা আমাকে ধমকান, ‘সব ব্যাপারে তর্ক করাই তোর স্বভাব।’
এরপর মাকে বলেন, ‘বুবু, তোমার মেয়েকে সামলাও, নইলে এই মেয়ের কপালে বহুত কষ্ট আছে। এতো বাড় ভাল না!’

আমার ছেলে বন্ধুরা বেশ কয়েকবার আমাদের বাড়িতে এসেছে। প্রথমবার দুটো মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে তিনটে ছেলে বন্ধু আমাদের বাসায় আসে। আমার খালাতো বোন দুটোও তখন আমাদের বাসায় ছিল। আমার বন্ধুরা চলে যাবার পর খালাতো বোনদের মুখে শুনে খালা আমাদের বাসায় এসে ইচ্ছে মতো বকাবকি করেন আমার বাবা আর মাকে। এমন কি নানা-নানিকেও বাদ দেন না। খালার ধারণা আমি কোনো একটা কেলেঙ্কারি বাধিয়ে সবার মুখ পুড়িয়ে তারপর শান্ত হবো!

খালা মাকে বলেন, ‘কোন আক্কেলে তোমরা বাড়িতে ছেলে অ্যালাউ করো বুবু? আর একটা মেয়ের ছেলেবন্ধু থাকবে কেন? বনানীতে কী কাণ্ড ঘটে গেল, তারপরও তোমাদের হুশ হবে না?’

বনানী, মানে ওই রেইনট্রি হোটেলের ঘটনা। নিজের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দুজন মেয়েবন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে এনে তাদেরকে ধর্ষণ করেছিল আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে শাফাত আহমদ আর তার সহযোগীরা। এই ঘটনায় আমার খালা মেয়েদুটিরই দোষ খুঁজে পেয়েছিল, কেন ওরা ছেলেবন্ধুদের ডাকে হোটেলে গিয়েছিল? ছেলেতে-মেয়েতে কখনো বন্ধুত্ব হয়!

এমনকি রূপার ব্যাপারটা নিয়েও খালার সাথে আমার মতবিরোধ হয়। জাকিয়া সুলতানা রূপা, বগুড়া থেকে যাচ্ছিল ময়মনসিংহ। পথেই রাত হয়ে যায়, অন্য যাত্রীরা বিভিন্ন জায়গায় নেমে পড়ায়, শেষ পর্যন্ত সে ছিল বাসের একমাত্র যাত্রী। আর এই সুযোগটাই নেয় বাসের ড্রাইভার-কনডাকটর-হেলপার। চলন্ত বাসে তারা রূপাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে মৃতদেহ ফেলে যায় টাঙ্গাইলের মধুপুরের পঁচিশমাইল এলাকায়।

খালা বলেন, ‘একটা মেয়ে কোনো পুরুষ ছাড়া এক জেলা থেকে আরেক জেলায় কেন যাবে? তাও আবার রাতেরবেলা!’

এই একবিংশ শতাব্দীতে আমরা একটা মেয়ের একা চলার মতো নিরাপদ সমাজ তৈরি করতে পারিনি, সেই ত্রুটি খালার চোখে ধরা না পড়লেও রূপার একা যাতায়াতের মধ্যে খালা ত্রুটি খুঁজে পান।

খালার সাথে আমার সর্বশেষ মতবিরোধ হয়- # মি টু আন্দোলন নিয়ে। # মি টু হলো যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক আন্দোলনের নাম। ১৯৯৭ সালে আফ্রো-আমেরিকান নারী টারানা বার্ক ১৩ বছরের এক কিশোরীর মুখে তার ওপর ঘটা যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতার কথা শোনেন, হয়তো তখন থেকেই তিনি নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা ভাবতে থাকেন। ২০০৬ সালে টারানা বার্ক যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে তার আন্দোলনের নাম রাখেন-মি টু। শুরুতে তার এই আন্দোলনকে অনেকেই পাত্তা দেয়নি। হলিউডের প্রযোজক হারভে উইনস্টনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের একাধিক অভিযোগ উঠলে ২০১৭ সালের অক্টোবরে হলিউড অভিনেত্রী আলিসা মিলানো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে হ্যাশট্যাগ দিয়ে মি টু লিখে শেয়ার করলে বিশ্বব্যাপী হইচই শুরু হয়। হলিউডের আরো অনেক বিখ্যাত প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে। ২০১৮ সালে # মি টু আন্দোলনের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে বলিউডে। বলিউডের পর এই ঢেউ আছড়ে পড়ে বাংলাদেশে, বাংলাদেশের বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করা নারীরা মুখ খুলতে শুরু করেন। সেই ধারাবাহিকতায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নাটক ও নাট্যতত্ত্ব’ বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মুখ খোলেন তারই ছাত্রী মুশফিকা লাইজু। মুশফিকা লাইজু ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নাটক ও নাট্যতত্ত্ব’ বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। তার অভিযোগ-সেলিম আল দীন ‘ইলিয়াড ও ওডিসি’র টেক্সটবুক আনার জন্য তাকে বাসায় যেতে বলেন। লাইজু এক বিকেলে সেলিম আল দীনের বাসায় যান এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারেন বাসায় সেলিম আল দীন ছাড়া আর কেউ নেই। সেলিম আল দীনের কথাবার্তায় অন্য ইঙ্গিতের আভাস পেয়ে লাইজু উঠতে যান আর তখনই সেলিম আল দীন তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে থাকেন এবং তার ওভারকোর্টের বোতাম খোলার চেষ্টা করেন। লাইজু কোনোক্রমে নিজেকে ছাড়িয়ে সেখান থেকে চলে আসেন।

বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়েছে দাবানলের মতো! সঙ্গত কারণেই বিষয়টি রাবেয়া খালার দৃষ্টি এড়ায়নি। ঘটনাটি জেনেই রাবেয়া খালার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, ‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ, একজন সম্মানিত শিক্ষক, একজন বিখ্যাত নাট্যকারের বিরুদ্ধে এমন মিথ্যাচার!’

আমি বলি, ‘মুশফিকা লাইজু কেন মিথ্যাচার করবেন খালা?’
‘বিখ্যাত মানুষের নামের সাথে নিজেকে জড়িয়ে বিখ্যাত হবার জন্য, ফেসবুকে মানুষের সহানুভূতি পাবার জন্য, ভাইরাল হবার জন্য!’

খালার কথা শুনে আমি একটুও অবাক হই না, লাইজু’র বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর অনেক শিক্ষিত মানুষই এমন ভাবনা ভাবছে। সেলিম আল দীন যেহেতু শিক্ষক ছিলেন, তাই তার অনেক ছাত্র-ছাত্রী বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করছে, ছাত্রের বাইরেও তার অনুগত শিষ্য-পোষ্য আছে। তাদের একটা অংশ সেলিম আল দীনকে দেবতা বানিয়ে তার পক্ষে ছাফাই গাইছে, অর্থাৎ একজন নারী নিপীড়কের পক্ষে ছাফাই!
আমি খালাকে বলি, ‘খালা, মুশফিকা লাইজু একজন বিবাহিত নারী। তার স্বামী-সন্তান আছে, আত্মীয়-স্বজন আছে, সমাজ আছে। এই একবিংশ শতাব্দীতেও আমাদের সমাজে এই ধরনের ঘটনা প্রকাশ পেলে কেউ কেউ ভিকটিমকে নিয়ে গালগল্প করে আচারের স্বাদ পায়, আর অভিযুক্ত পায় পৌরুষের মর্যাদা! কর্মক্ষেত্র এবং সমাজের মানুষ ভিকটিমকে নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করে। লাইজুর নিশ্চয় সন্তান আছে, তাদের কোনো কোনো সহপাঠী এই বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কানাকানি করতে পারে, বলতে পারে-এই জানিস অমুকের মাকে না সেলিম আল দীন জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলেন! এতোসব প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্ভাবনা সত্ত্বেও লাইজু শুধুমাত্র বিখ্যাত বা ভাইরাল হবার জন্য কেন মিথ্যা কথা বলবেন? ফেসবুকে ভাইরাল হলে লাইজু’র কী লাভ হবে?’

‘তাহলে তখন চুপ থেকে এতোদিন পর মুখ খুললো কেন?’
‘একত্রিশ বছর আগে একটা অল্প বয়সী মেয়ের পক্ষে এই বিষয়টা নিয়ে লড়াই করা সম্ভব ছিল না খালা, যেখানে আজকের সমাজের অনেকেই লাইজু’র বিপক্ষে কথা বলছে। এতোদিন কোনো প্ল্যাটফর্ম ছিল না, এখন # মি টু আন্দোলনের একটা প্ল্যাটফর্ম হয়েছে। নিপীড়িত নারীরা একে একে মুখ খুলছেন, মুখ খুলছেন এই ভরসায় যে সমাজের কিছু মানুষের সমর্থন তারা পাচ্ছেন।’

‘কী প্রমাণ আছে যে সেলিম আল দীন লাইজুকে যৌন নিপীড়ন করেছিলেন?’

আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত আমার খালার কথাটা কাঠমোল্লাদের মতো শোনায়! শরিয়া আইন অনুযায়ী কোনো ধর্ষিত নারী যদি বিচার চায় তবে তাকে চারজন সাক্ষী হাজির করতে হয়, অন্যথায় ব্যাভিচারের দায়ে সেই নারীকে শাস্তি পেতে হয়! এই সাক্ষী-প্রমাণের দাবী যে শুধু আমার খালাই তুলেছেন তা নয়, সেলিম আল দীনকে পীরের আসনে বাসানো তার কিছু মুরিদও বলেছে, ‘সেলিম আল দীন যে মুশফিকা লাইজুকে যৌন নিপীড়ন করেছেন, তার কোনো সাক্ষী-প্রমাণ আছে?’

কী হাস্যকর যুক্তি! যৌন নিপীড়ক কখনো সাক্ষী-প্রমাণ রেখে যৌন নিপীড়ন করে? এ কোন সমাজে এসে পড়লাম আমরা? শিক্ষক, সাহিত্যিক, নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক, সাহিত্য সম্পাদকের মুখেও এমন কথা শুনতে হয়! আমরা কি পতনের চূড়ান্ত সীমায় এসে পড়েছি? সমাজের সর্বক্ষেত্র পতনোন্মুখ হলেও কেবলমাত্র যদি বুদ্ধিজীবিরা সঠিক পথে থাকে, তাহলে ওই পতনোন্মুখ সমাজ আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে সভ্যতার শিখরে পৌঁছতে পারে। আমাদের সেই সম্ভাবনাও ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সেদিন বুঝি আর বেশি দূরে নয়, যেদিন এই সমাজের শিক্ষিত মানুষেরা ধর্ষকের পক্ষেও মিছিল-মানববন্ধন করবে!

আমার এক বড় ভাই থিয়েটার করেন। তার মুখে আমাদের নাটকের জগতের অনেক রথী-মহারথীর সর্ম্পকে অনেক কথা শুনেছি। গ্রাম বা মফস্বল শহর থেকে যেসব মেয়েরা ঢাকায় এসে থিয়েটার করতে যায়, এদের অনেককেই অনেক বড় স্বপ্ন দেখিয়ে, সরল মেয়েগুলিকে ফুসলিয়ে বিছানায় নিয়ে যায় নাট্যজগতের কিছু রথী-মহারথী। তারপর সেই মেয়ে একসময় বুঝতে পারে যে তাকে দেখানো স্বপ্ন আসলে আলেয়া! নাট্যজগত তো বটেই, অন্য মাধ্যমের অনেক মানুষই এসব জানে। এই নিয়ে রসালো গাল-গল্প করে নিজেদের মধ্যে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা কোথাও এসব নিয়ে লেখে না। এই নাট্যরথীরা গিরীশচন্দ্র গোষের নাট্য প্রতিভার ছিটেফোটা রপ্ত করতে না পারলেও তাঁর রতিক্রীড়ার প্রতিভা ভালই রপ্ত করেছে! কিন্তু গিরীশ চন্দ্র ঘোষ রতিক্রীড়া করতেন যৌনকর্মীদের সঙ্গে, যাদের কেউ কেউ অভিনয়ও করতেন। গিরীশ চন্দ্র ঘোষের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের কোনো অভিযোগ নেই বা তিনি কোনো ভদ্রঘরের মেয়েকে মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে তাকে বিছানায় নিয়ে গেছেন এমন কথাও শোনা যায়নি।

সেলিম আল দীন সম্পর্কে অনেক কথা আমি আগেই শুনেছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নাটক ও নাট্যতত্ত্ব’ বিভাগের বেশ দুর্নাম আছে এই ব্যাপারে। ফার্স্ট ক্লাস পাবার লোভ দেখিয়ে সেলিম আল দীন তার কোনো কোনো ছাত্রীকে বিছানায় নেবার চেষ্টা করতেন একথা নাট্য জগতের অনেকেরই জানা।

যাইহোক, রাবেয়া খালা কিছুতেই মেনে নেননি যে সেলিম আল দীন যৌন নিপীড়ক ছিলেন।

কয়েকদিন আগে বিকেলে আমি আমাদের বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নামছি, দেখি আমার খালাতো বোন রিয়া উঠে আসছে। ওকে কেমন বিচলিত মনে হয়। আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। আমি ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলি, ‘কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে তোর? বল আমাকে?’

কান্নার দমকে ও কথা বলতে পারে না। আমি ওকে বলি, ‘শান্ত হ রিয়া, কী হয়েছে আমাকে বল।’
বেশ কিছুক্ষণ পর ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে, ‘ইকবাল স্যার আমাকে…।’

আর বলতে পারে না রিয়া। আমিও আর শুনতে চাই না, যা বোঝার বুঝে যাই। রিয়ার মুখেই শুনেছি-ইকবাল স্যার ওর স্কুলের শিক্ষক, তার একটা কোচিং সেন্টার আছে, সেখানেই কোচিং করে রিয়া। রিয়াকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসি। মা আর নানি ওকে কাঁদতে দেখে বলে, ‘কী হয়েছে ওর?’

‘পরে বলবো।’ বলে আমি রিয়াকে আমার ঘরে নিয়ে যাই, দরজা বন্ধ করে দিই। রিয়া আমার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে অবিরাম কাঁদতে থাকে, কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জানায় ইকবাল স্যার ওকে তার রুমে ডেকে নিয়ে কী অসভ্য আচরণ করেছে।

নানি গিয়ে বোধ হয় খালাকে খবর দেয় যে রিয়া কাঁদছে। খালা এসে দরজায় নক করে, আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিই, খালা ঘরে ঢুকে উকিলের ঢঙে প্রশ্ন ছুড়ে দিলে আমি তাকে এক বাক্যে ঘটনাটা বলি। খালার চোখে জল চিক চিক করে ওঠে। মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পড়েন। কিছুক্ষণ পর আমি বলি, ‘আমরা মামলা করবো খালা?’

খালা তার ভেঙে পড়া ভাবটা সহজেই কাটিয়ে ওঠেন, ‘খবরদার, ওকথা মুখেও আনবি না! লোক জানাজানি হলে সমাজে মুখ দেখাতে পারবো? ওকে বিয়ে দিতে পারবো? তোর কাছে হাতজোড় করছি, তুই এসব কথা ছড়াস না। আমাদের মুখে চুনকালি মাখাস না।’

একটু পর খালা রিয়াকে নিয়ে চলে যায়। আমি ঠায় বসে থাকি, বসেই থাকি। আমার মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে সেলিম আল দীনের মুখ। ইকবাল স্যারকে আমি কখনো দেখিনি। সেলিম আল দীনকে দেখেছি। সেলিম আল দীনের পাশে, তার ছায়ার মতো মনে হয় ইকবাল স্যারকে।

রাবেয়া খালা প্রতিবাদ না করে মৌনতার পথ বেছে নিয়েছেন, তিনি জানেন না যে তাদের মৌনতার জমিনেই প্রলম্বিত হয় সেলিম আল দীনের ছায়ারা, বাড়ায় তাদের অসংযত নষ্ট হাত। সূর্যের আলোয় ছায়ার অস্তিত্ব থাকে না, আগুনের শিখা লকলকিয়ে উঠলে যেমনি ছায়া ম্লান হয়ে যায়; তেমনি সেলিম আল দীনদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রজ্বলিত মশাল উঁচিয়ে ধরতে হয়, যাতে সেলিম আল দীনরা তাদের লালসার হাত গুটিয়ে রাখে। আর প্রলম্বিত হবার পরিবর্তে নিজের সীমার মধ্যে সংযত থাকে সেলিম আল দীনের ছায়ারা।

ঢাকা।
নভেম্বর, ২০১৮

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:২৮

করুণাধারা বলেছেন: আপনার লেখা বরাবরই ভালো হয়, এটাও হয়েছে। ভালো লাগলো সেলিম আল দীনের সম্পর্কিত লেখার অংশ। সকলেই জানে ঘটনার সত্যতা, তবু চেপে যেতে বলে এই কারণে, মৃত মানুষের কুৎসা গাইতে নেই....... এমন যদি হয় তাহলে এসব ঘটনা বাড়তেই থাকবে.........

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:১০

মিশু মিলন বলেছেন: সকলেই জানে ঘটনার সত্যতা, তবু চেপে যেতে বলে এই কারণে, মৃত মানুষের কুৎসা গাইতে নেই....... এমন যদি হয় তাহলে এসব ঘটনা বাড়তেই থাকবে........

একদম ঠিক বলেছেন। অনেক ধন্যবাদ।

২| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:০৬

রাজীব নুর বলেছেন: স্বকৃত নোমান ভাই দারুন প্রতিবাদ করেছেন।

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:১৫

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে। নোমানের লেখাটি আমি পড়েছি, পীরের অন্ধ মুরিদের মতো চিন্তাভাবনা তার। তিনি নারী নিপীড়নের সাক্ষী-প্রমাণ চেয়েছেন, একদম মওলানাদের মতো কথা! মওলানারাও ধর্ষণের চারজন সাক্ষী চায়!

৩| ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:০৯

ইসিয়াক বলেছেন: নানা রঙের দুনিয়া.....।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.