নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

জতুগৃহ

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:৪৪

গভীর রাত্রে দরজা-জানালা বন্ধ ক্লাসরুমের পশ্চিমদিকের একটা টেবিলে মোমবাতি জ্বলছে, শিখায় তেমন দুলুনি নেই, মোমবাতির মোলায়েম আলোয় দেখা যাচ্ছে পাঁচজন মানুষকে। প্রিজাইডিং অফিসার বিজয় চেয়ারে বসে টেবিলে কনুইয়ের ভর রেখে দু-হাতে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে আছেন, বয়স সাতচল্লিশ, দাড়ি কামানো ফর্সা ঝকঝকে চেহারা, ইন করে পরা ফুল হাতা শার্টের ওপর জলপাই রঙের হাফহাতা সোয়েটার। প্রায় কাছাকাছি বয়সের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার অনিমেষ দাস দুটো বেঞ্চ জোড়া লাগিয়ে মাথার নিচে ব্যাগ রেখে শুয়ে আছেন, গলা থেকে পা পর্যন্ত কালো চাদরে ঢাকা, মাথায় উলের কালো টুপি, মুখে দাড়ি নেই তবে গোঁফ আছে, বেশ স্ফীত ভুঁড়িটা চাদর ঠেলে উঠছে আর নামছে। শোবার প্রস্তুতি নিয়েও বেঞ্চে বসে আছে পোলিং অফিসার খলিল উল্লাহ, তার মুুখে ঘন কালো লম্বা সুন্নতি দাড়ি, মাথায় সোনালি রঙের জরির কাজ করা নামাজি টুপি, গায়ে পাঞ্জাবির ওপর উলের ফুলহাতা সোয়েটার, টাকনুর ওপর পর্যন্ত পায়জামা। এই তিনজনের পাহারাদার হিসেবে আছে একজন পুলিশ আর একজন আনসার সদস্য। বছর চল্লিশের পুলিশ সদস্য হাফিজ চুপচাপ বসে আছে। আর ইউনিফর্মের ওপরে কালো রঙের জ্যাকেট পরা আনসার সদস্য বছর ত্রিশের ইকবাল বেঞ্চে বসে দেয়ালে পিঠ আর মাথা ঠেকিয়ে দুই ঊরুর মাঝখানে রাখা লাঠির মাথায় দুই হাত রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। নির্বাচন পরিচালনার জন্য আরো কয়েকজন কর্মী আসবে ভোরবেলায়।

রুমের পূর্বদিকের মেঝেতে রাখা কিছু ব্যালট বাক্স আর ব্যালটের বস্তা। বস্তা থেকে কিছু ব্যালট বের করে টেবিলে রাখা। টেবিলে আরো রাখা আছে সীল, স্ট্যাম্প প্যাড, ছবিসহ ভোটার তালিকা, অমোচনীয় কালির কলম, সাদা কাগজ, কার্বন কাগজ, ছুরি ইত্যাদি নির্বাচনী সরঞ্জাম। রুমের উত্তরদিকের দিকের একটি টেবিল গোলাপী কাপড় দিয়ে ঘেরা, ভোটারদের ভোট দেবার গোপন স্থান।

ঘণ্টাখানেক আগে বিদ্যুৎ চলে গেছে, এসব এলাকায় রাতেরবেলা বিদ্যুৎ গেলে আর সহজে আসে না। ইকবাল হঠাৎ হাতের লাঠিটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে রেখে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ালো, তারপর দরজার দিকে হাঁটতে লাগলো। তার পায়ের শব্দে বিজয় মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন, ‘কোথায় যান?’
‘স্যার, টয়লেটে যাব’
খলিল বিরক্তির স্বরে বললো, ‘আপনার কি ডায়াবেটিস আছে নাকি, এতো ঘন ঘন বাইরে যান? রাতেরবেলা দরজা খোলা নিরাপদ না।’
‘কী করবো স্যার, তলপেটে চাপ দিছে যে!’
বিজয় বললেন, ‘যান, বেশি দেরি করবেন না।’

দরজা খুলে চলে গেল ইকবাল। খলিল বললো, ‘স্যার, এই ব্যাটা আমাদের পাহারা দিতে এসে তো উল্টো বিপদে ফেলে দেবে!’

কিছু বললেন না বিজয়। আসবার সময় রিটার্নিং কর্মকর্তা তাদেরকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘আপনারা যে ভোট কেন্দ্রে যাচ্ছেন, সেটি মোটামুটি ঝুঁকিপূর্ণ। ওখানে সরকারী দল এবং বিরোধী দল কেউ কারো চেয়ে কম না। রাতে খাবার জন্য রুটি-টুটি কিনে নিয়ে যাবেন। সন্ধ্যার আগে কেন্দ্রে ঢুকে দরজা-জানালা লাগিয়ে দেবেন।’

সঙ্গত কারণেই হাফিজ আর ইকবাল ব্যতিত বাকি তিনজনের মধ্যে একটা আশঙ্কা বিরাজ করছে। যদিও বেঞ্চে শোবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে এখন নাক ডাকতে শুরু করেছেন অনিমেষ। ঘুম আসছে না বলে বসে আছেন বিজয়। আর বেঞ্চে শোবার আয়োজন করেও অনিমেষের নাক ডাকা, মশার কাপড় আর ঝিঁঝিপোকার ডাকের ওপর বিরক্ত হয়ে গোমড়া মুখে বসে আছে খলিল। ঘরের দু-দিকে দুটো কয়েল জ্বলছে, তবু মশার কামড় থেকে নিস্তার নেই। বিরক্ত কণ্ঠে খলিল বললো, ‘ধুর, যেমন নাক ডাকার শব্দ, তেমন মশার কামড়! তার ওপর আবার ঝিঁঝির ডাক, এর মধ্যে ঘুমানো যায়!’

বিকেলে যখন তারা এই ঘরে আসে তখন জানালা খোলা ছিল, জানালা বন্ধ করতে গিয়ে খলিল দেখেছে স্কুলের পিছনে বেতের ঝাড় আর লতা-পাতার ঘন ঝোপ। একটু থেমে আবার বললো, ‘স্কুল ভবনের পিছনে কেউ এমন জঙ্গল করে রাখে, ঝিঁঝির ডাকে তো কানে তালা লেগে যাচ্ছে!’

বিজয় বললেন, ‘সব বন-জঙ্গল ছাফ করে মানুষ ঘর-বাড়ি বানাচ্ছে, ঝিঁঝিঝপোকারা যাবে কোথায় বলেন তো? প্রকৃতি ধ্বংস না করে মানুষকে প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস করার অভ্যাস করতে হবে।’
‘স্যার আপনি কি জীববিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন, নাকি উদ্ভিদ বিজ্ঞানের?’
‘কোনোটাই না। জীব কিংবা উদ্ভিদপ্রেমী হতে হলে কাউকে জীববিজ্ঞান কিংবা উদ্ভিদবিজ্ঞানের ছাত্র হতে হয় না। আমার বিষয় ছিল ইতিহাস।’
‘ইসলামের ইতিহাস?’
‘না, শুধু ইতিহাস।’
‘স্যার, যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’
‘করেন।’
‘আপনার নামের আগে-পিছে কিছু নাই? আপনি হিন্দু না মুসলমান?’
‘আমি মানুষ।’
‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি আপনি মানুষ, কিন্তু হিন্দু মানুষ না মুসলমান মানুষ?’
‘আমি হিন্দু-মুসলমান যাই-ই হই, তাতে আপনার লাভ-ক্ষতি তো কিছু নাই, তাই না?’
‘না স্যার, লাভ-ক্ষতির বিষয় না। একসাথে আছি তাই কৌতুহলবশত জিজ্ঞেস করলাম।’
খলিলের উদ্দেশ্য জানার কৌতুহল হলো বিজয়ের, বললেন, ‘আমি মুসলমান পরিবারের সন্তান।’
‘তাই বলেন স্যার, আপনার চেহারা দেখে আমারও তাই মনে হতেছিল।’

‘মুখে সুন্নতি দাড়ি না থাকলে বা আপনার মতো ধর্মীয় পোশাক পরা না থাকলে একজন মানুষের চেহারা দেখে বোঝা যায় সে হিন্দু না মুসলমান?’
‘যায় স্যার, মুসলমানদের চেহারার মধ্যে, চালচলনে একটা তেজি ব্যাপার থাকে, যা আপনার চেহারায় আছে। আর ওই হিন্দুটারে দ্যাখেন, কেমন ম্যাদামারা চেহারা! একটা কথা স্যার, আপনার বিজয় নাম ছাড়াও নিশ্চয় ইসলামী কোনো নাম আছে?’
‘ইসলামী ঠিক নয়, আরবী নাম আছে-সিরাজুল।’

‘ওইটাই ইসলামী নাম স্যার। আরবী নাম যা, ইসলামী নামও তাই। আরবী নামটা বলেন না কেন? আরবী নাম বলায় সোয়াব আছে, হিন্দুয়ানী নামে নেই, বিজয় তো একটা হিন্দুয়ানী নাম। আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা মুসলমান, সেইটা গর্বের সঙ্গে বলা উচিত।’
‘তাই যদি বলেন তাহলে আপনার ওই মোহাম্মদ খলিল উল্লাহ নামটাও তো পৌত্তলিক।’
‘আস্তাকফিরুল্লাহ, গুনাহগারের মতো কথা বলবেন না স্যার।’
‘আমি সত্য কথা বলছি, ইতিহাসের কথা। আরবে যখন মোহাম্মদ জন্মগ্রহণ করেন তার আগে থেকেই পৌত্তলিক ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের নাম ছিল মোহাম্মদ। মোহাম্মদের সময়েও অনেকের নাম মোহাম্মদ ছিল। আরবের পৌত্তলিক সংস্কৃতির অনেক কিছুই পরে ইসলামিক সংস্কৃতি হয়ে গেছে। এইসব ইতিহাস আপনাকে বলে বোঝানো যাবে না।’

আধো আলো-আধো ছায়ায় বিজয় খলিলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, খুলিলও তাকিয়ে রইলো।

তারপর বিজয় বললেন, ‘দ্যাখেন, ধর্ম যা-ই পালন করেন না কেন, নিজের মাতৃভাষাকে অপমান করবেন না। বিজয় একটা বাংলা শব্দ। ধর্ম দিয়ে শব্দের জাত নির্ণয় করা উচিত না। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভের তিনদিন পর আমার জন্ম হয়েছিল বলে বাবা আমার নাম রেখেছিলেন বিজয়।’
‘আপনিও স্যার ওই মুক্তিযুদ্ধের গল্পে বিশ্বাস করেন?’
‘করবো না কেন? মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বলেই না আমাদের দেশটা স্বাধীন হয়েছে।’
‘ঘোড়ার ডিমের স্বাধীনতা স্যার! দেশটা জাহান্নামী হয়ে গেছে। পাকিস্তান থাকলে দেশের আজ এই অবস্থা হতো না!’
‘শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, রাজনীতিতে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমরা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক ভাল অবস্থায় আছি খলিল সাহেব। শুনুন, অতীতে আপনাদের পূর্ব-পুরুষরা ভুল করেছে, আপনাদের সুযোগ আছে সেই ভুল শোধরাবার। পাকিস্তানপ্রীতি ভুলে নিজের দেশটাকে ভালবাসতে শিখুন।’

‘দেশটাকে তখনই ভালবাসবো স্যার, যখন দেশটায় পুরোপুরি ইসলামী শাসন কয়েম হবে। দেশটা এখন শাসন করতেছে ভারতের দালাল সরকার, তার ওপর প্রধানমন্ত্রী একজন মহিলা। ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম। একবার রাসূলুল্লাহ যখন শুনলেন যে পারস্যে রাষ্ট্রপ্রধানের কন্যাকে পারস্যবাসী বাদশাহ বানিয়েছে, তখন তিনি ব্যথিত হলেন এবং বললেন, “যে জাতি নিজেদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারের দায়িত্বসমূহ কোনো নারীর ওপর সোপর্দ করে সে জাতি কখনোই প্রকৃত কল্যাণ এবং সার্থকতা লাভ করতে পারেন না।” ভারতের দালাল এই মহিলাকে সমর্থন করা মানে নবী রাসূলের বিরুদ্ধাচার করা। তবে একদিন এইদেশে ইসলামী শাসন কায়েম হবে।’
‘আপনাদের সেই আশা কোনোদিনও পূরণ হবে না।’
‘ইনশাল্লাহ হবে স্যার। দিনদিন ইসলামী দলগুলোর ভোট বাড়ছে।
‘খলিল সাহেব, অনেক রাত হলো আপনি ঘুমান।’
‘ঘুমাবো কেমনে স্যার, একে তো ঝিঁঝির ডাক, তার ওপর এই মালাউনের বাচ্চার নাক ডাকার শব্দ!’
‘আহ খলিল সাহেব, উনি শুনলে কষ্ট পাবেন। কাউকে মালাউনের বাচ্চা বলতে হয় না।’
‘মালাউনের বাচ্চাকে মালাউনের বাচ্চাই বলতে হয় স্যার।’
‘আপনার নবী রাসূলও কিন্তু মালাউনের বাচ্চা ছিলেন!’
‘আস্তাকফিরুল্লাহ, আল্লাহ আপনার গুনাহ মাফ করুন।’
‘আপনার চমকে উঠার কিছু নাই। যা সত্যি আমি তাই বললাম। আপনার নবী রাসূলের বাবা-মা পৌত্তলিক মালাউন ছিলেন, আপনার রাসূলও চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত মালাউন ছিলেন।’
খলিল দু-হাতে কান ঢেকে বললো, ‘আল্লাহ মাফ করুন, এসব শুনাও গুনাহ। আমি বুঝতে পেরেছি স্যার, আপনি একজন নাস্তিক।’
‘খলিল সাহেব আপনি ঘুমান। আমিও ঘুমাবো।’

এই সময় ইকবাল টয়লেট থেকে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আবার আগের জায়গায় বসে পড়লো। খলিল শুয়ে পড়লো। বিজয় বসেই রইলেন। এখন কেবল ঝিঁঝিপোকার ডাক আর অনিমেষ দাসের নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কাছেই কোথাও হয়তো বাঁশঝাড় আছে, শালিকের ঝাঁক কিচির-মিচির করে উঠলো। মুহূর্তের জন্য অনিমেষ দাস মুখে অদ্ভুত শব্দ করেই আবার একনাগাড়ে নাক ডাকতে লাগলেন।

বেশ কিছুক্ষণ পর বারান্দার গেটে একনাগাড়ে বেশ জোরে শব্দ হলো। চমকে উঠলেন বিজয়, ঘুমের ঘোর কাটিয়ে সোজা হয়ে বসলো হাফিজ আর ইকবাল, ধড়মড় করে উঠে বসলো খলিল, অনিমেষ দাসও উঠে বসে চাপা স্বরে বললেন, ‘শব্দ কিসের?’
বাইরে কারো কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘ভাইসাব, ঘুমাইছেন নাকি আপনারা?’

ভিতর থেকে কেউ সাড়া দিলেন না। হাফিজ উঠে বন্ধ জানালার কাছে গেল। এবার বাইরে থেকে কয়েকজন সমস্বরে ডাকতে লাগলো আর গেটে শব্দ করতে লাগলো। একজন বললো, ‘ভাইসাব, ভয় পায়েন না। রাতে আপনারা খাইছেন?’
হাফিজ বিজয়ের দিকে তাকিয়ে চাপাস্বরে বললো, ‘স্যার, সাড়া দেব?’

বিজয় ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে হাত দিয়ে ইশারা করলো কিছু না বলার জন্য। বিজয় নিজেও জানালার কাছে উঠে গিয়ে দাঁড়ালেন।
বাইরের লোকগুলো শব্দ করছে আর একইভাবে ডেকেই চলেছে। বিজয় হাফিজকে শিখিয়ে দিলেন, ‘বলো, আপনারা কারা?’
হাফিজ শেখানো বুলি আওড়ালো, ‘আপনারা কারা?’
একজনের গলা শোনা গেল, ‘আমরা বিরোধী দলের কর্মী। রাততিরি আপনারা খাইছেন?’
ইকবাল বললো, ‘হ খাইছি।’

বাইরে থেকে এবার আরেকজন বললো, ‘শোনেন আমাগের পাশের কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আর পোলিং অফিসাররে কুপাইছে শালারা। তারা এখন হাসপাতালে ভর্তি। আমরা আপনাগের পাহারা দিবার আইছি, দরজা খোলেন।'
কোপানোর কথা শুনে বিজয়ের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। খলিল আর অনিমেষ মুখ চাওয়া-চায়ি করতে লাগলেন।
হাফিজ বললো, ‘কারা কুপাইছে?’
‘সরকারের গুণ্ডারা! ভাইসাব, আপনাগের কোনো ভয় নাই, আমরা আছি। দরজা খোলেন।'

বিজয়ের শিখিয়ে দেওয়া কথা বললো হাফিজ, 'আমাদের কাছে গেটের চাবি নাই। স্কুলের দারোয়ান সকালে এসে গেট খুলবে।'

চাবি অবশ্য তাদের কাছে একটা আছে। তবু মিথ্যে বললো। এবার বাইরের লোকগুলো নিজেদের মধ্যে নিচুস্বরে কথা বলতে লাগলো। বিজয়ের ধারণা এরা যদি সত্যি সত্যিই বিরোধীদলের লােক হয় তাহেল এরা ব্যালট লুঠ করতে এসেছে, আর যদি সরকারি দলের লোক হয় তাহলে ব্যালটে সিল মারতে এসেছে। কিছুক্ষণ পর বাইরে থেকে আবার একজন বললো, 'ভাই, আপনাগের কিছু লাগবে?'
বিজয় না সূচক ঘাড় নাড়লেন, হাফিজ বললো, ‘না কিছু লাগবে না।’
‘আচ্ছা, আপনারা সবাধানে থাকবেন।’

চলে গেল লোকগুলো। সত্যিই কি কুপিয়েছে, নাকি লোকগুলো তাদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়ে গেল? কয়েক মুহূর্ত থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে বিজয় আবার চেয়ারে এসে বসলেন। হাফিজ আর ইকবালও আগের জায়গায় ফিরে গেল। কিছুক্ষণ পর সহকারী রিটার্নিং অফিসারের ফোন নম্বর ভেসে উঠলো বিজয়ের ফোনে। বিজয় ফোন রিসিভ করলেন, ‘হ্যালো...’
‘হ্যালো, আপনারা ঠিক আছেন তো?’
‘হ্যাঁ স্যার, ঠিক আছি। কেন কিছু হয়েছে?’
‘আপনাদের পাশের কেন্দ্রে আক্রমণ হয়েছে। শোনেন কোনোভাবেও দরজা খুলবেন না।’
‘যদি তালা ভেঙে ঘরে ঢোকে?’
‘তেমন চেষ্টা করলে আমাদের ফোন করবেন।’
‘আপনাদের ফোন করলে কী হবে, ততোক্ষণে যা ঘটবার ঘটে যাবে। স্যার আপনারা আরো পুলিশ পাঠান।’
‘আমরা থানায় যোগাযোগ করেছি। সকালের আগে তারা আর পুলিশ পাঠাতে পারবে না। ঠিক আছে রাখছি, ভয় পাবেন না। সাবধানে থাকবেন।’
‘আচ্ছা, স্যার।’

ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিলেন সহকারী রিটার্নিং অফিসার। ফোন কাটার পর বিজয় লক্ষ্য করলেন অনিমেষ দাস একটা পোটলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বিড়বিড় করছেন, আসলে মালা জপছেন, ইস্কনের ভক্তরা যেমনি জপেন। আর ডান হাতে তজবি ধরে ঠোঁট নাড়ছে খলিল। এই বিপদাশঙ্কার মধ্যেও বিজয়ের হাসি পেল দুজনের অবস্থা দেখে। বিপদের আঁচ পেয়ে দুজনই তাদের ঈশ্বর এবং আল্লাহকে ডাকতে শুরু করেছে!

অনিমেষ দাস বললেন, ‘স্যার, আমাদের ওপর যদি হামলা হয়?’
‘হামলা হবে কেন? ওই যে মালা জপছেন, আপনার ঈশ্বর আপনাকে রক্ষা করবেন না?’
খলিল বললো, ‘স্যার, বিপদের সময়ও আপনি আল্লারে ডাকেন না?’
‘না। কারণ আমি জানি বিপদ হলে আপনার আল্লাহ এবং অনিমেষ বাবুর ঈশ্বর কেউই আমাদের বাঁচাতে পারবে না। মানুষকে বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে কেবল তার বুদ্ধি।’

‘স্যার আপনি নাস্তিক। নাস্তিকদের চেয়ে হিন্দুরাও ভাল!’

বিজয় হো হো করে হেসে উঠলেন। এজন্য লোকে বলে বিপদে পড়লে বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খায়! বিজয়ের আচমকা হাসি শুনে অন্যরা কিছুটা চমকে উঠলো।

আবার কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটলো ঝিঁঝিগীত শুনে। মোটর সাইকেলের শব্দ শোনা গেলে কান খাড়া করলেন বিজয়। জপমালা আর তজবির দানায় হাত থেমে গেল অনিশেষ আর খলিলের, হাফিজ আর ইকবাল কান খাড়া করে সোজা হয়ে বসলো। মোটর সাইকেলের শব্দ ক্রমশ কাছে আসছে। স্কুল ভবনের সামনে ছোট্ট একটা মাঠ, মাঠের পরেই রাস্তা। কাছে এসে আবার দূরে চলে গেল মোটর সাইকেলের শব্দ, পশ্চিমদিক থেকে রাস্তা ধরে পূর্বদিকে চলে গেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন সবাই। খলিল মুখে উচ্চারণ করলো, ‘সুভাহানআল্লাহ!’

কিছুক্ষণ পর আবারও মোটর সাইকেলের শব্দ শোনা গেল, এবার একটা নয়, অনেকগুলো মোটর সাইকেলের শব্দ। গজরাতে গজরাতে চলে গেল মোটর সাইকেলগুলো। বিজয় ভাবলেন, নিশ্চয় সরকার অথবা বিরোধী পার্টির লোক। এরা আজ রাতে ঘুমাবে না নাকি?

ইকবাল বললো, ‘স্যার, ভোটাভুটির যা অবস্থা এহন, প্রত্যেক কেন্দ্রে কমছে কম বিশজন করে পুলিশ আর আনসার দেওয়া উচিত। এহন কোনো পার্টির লোক আক্রমণ করলি আমরা ক্যা, আমাগের বাপেরও সাধ্য নাই আপনাগের বাঁচায়!’

‘বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে এগারোশো জন মানুষের জন্য একজন পুলিশ, সব কেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেবার মতো পুলিশ সরকারের নেই।'

সকলেই কিছুক্ষণ মৌন থাকার পর, অনিমেষ বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তিন মেয়ের একটারও বিয়ে হয়নি, ছেলে দুটোও নাবালোক। এখন যদি এখানে কোপ খেয়ে মরি ওদের কী হবে বলেন তো স্যার?’
বিজয় বললেন, ‘আপনার ঈশ্বর নিশ্চয় দেখবেন।’
‘তা তিনি দেখবেন, তবু চিন্তা হয় জানেন।’
‘কেন ঈশ্বরের ওপর আপনার আস্থা নেই?’
‘তা থাকবে না কেন? নিশ্চয় আছে।’
‘তাহলে আর অতো ভাবছেন কেন? আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, আপনি কোপ খেয়ে মরলেও আপনার ছেলেমেয়েদের ঈশ্বরই দেখবেন। পাঁচ ছেলেমেয়ে আপনার?’
‘হ্যাঁ।’
আপনি তো পরিবার-পরিকল্পনা অফিসে চাকরি করেন?’
‘হ্যাঁ, স্যার।’
‘নিজে পরিবার-পরিকল্পনা অফিসে চাকরি করার পরেও অপরিকল্পিতভাবে এতোগুলো ছেলেমেয়ের জন্ম দিলেন?’
‘কী করবো বলেন স্যার, ভাগবান শ্রীকৃষ্ণ দিলেন!’

বিজয়ের হাসি পেল, বড় অদ্ভুত লোক এরা; ভগবানই এদের ছেলেমেয়ে দেয়, ভগবানই এদের ছেলেমেয়েকে দ্যাখে; তারপরও এরা স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করে, ছেলেমেয়েদের খাইয়ে-পরিয়ে মানুষ করার জন্য সারাজীবন খেটে মরে!

বিজয়ের মাথায় হঠাৎ নিজের সংসারের ভাবনা ঢুকে পড়লো। তিনি বাদে সংসারে চারজন মানুষ-মা, স্ত্রী শীলা আর ছেলে-মেয়ে। হঠাৎ তার কিছু হয়ে গেলে শীলা পারবে না সংসারটা সামলাতে? শীলা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, নিশ্চয় পারবে, তবে কষ্ট হবে। এখনকার মতো স্বচ্ছলতা হয়তো তখন থাকবে না। শিলারও নির্বাচনে দায়িত্ব পড়েছে, তাদের পাশের গ্রামের ভোটকেন্দ্রে। এটাই বড় স্বস্তির যে শিলা সকালে ভোটকেন্দ্র যাবে।

এরপর বিজয়ের মনে পড়লো বনানীর কথা, বনানী তার পুরোনো প্রেমিকা। নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল, দুই পরিবারেরও আপত্তি ছিল তাদের বিয়েতে। সে চাকরি পাবার আগেই বনানীর বিয়ে হয়ে যায়। বনানী এখন সুখে নেই, স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হয় না, দুই মেয়ে বনানীর; মেয়ে দুটির জন্য স্বামীর সঙ্গে থেকে জীবনটা পার করে দিচ্ছেন কোনোক্রমে। বনানীই তাকে প্রথম ফোন করেছিলেন, বছর পাঁচেক আগে। তারপর থেকে নিয়মিত কথা হয়। বনানী থাকেন রাজবাড়ী শহরে, দুজনে দেখা করেছেন অনেকবার। বনানী একদিন আফসোস করে বলেছিলেন, ‘আবার যদি আমরা আগের দিনে ফিরে যেতে পারতাম!’

আর ফেরা সম্ভব নয়, তা তারা দুজনেই জানেন। তবু তারা ফোনে কথা বলেন, দেখা করেন, একে অন্যের হাত ধরে বসে থাকেন পার্কে কিংবা পদ্মার পারে, ডুবে থাকেন নিষ্কাম প্রেমে! অসুখী সংসার যাপনে বনানীর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ হৃদয়ে সান্ত্বনা আর ভালবাসার প্রলেপ বুলান।

হঠাৎ বিদ্যুৎ এসে পড়লো। ইকবাল উঠে মোমবাতিটা নিভিয়ে পুনরায় তার জায়গায় গিয়ে বসলো। অনিমেষ বললেন, ‘স্যার, আপনি ঘুমাবেন না?’
‘হ্যাঁ, আমিও একটু গড়িয়ে নেব। কাল সারাদিন যা ধকল যাবে!’

অনিমেষ কৃষ্ণপুটলিটা একটা বেঞ্চে রেখে শুয়ে পড়লেন। খলিলও মাথার টুপি আর তজবিটা পাঞ্জাবির পকেটে রেখে পুনরায় শুয়ে পড়লো। বিজয় চেয়ার ছেড়ে উঠে একটা বেঞ্চে শুয়ে হাফিজ আর ইকবালের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনারা আর জেগে থেকে কী করবেন, বাতিটা নিভিয়ে আপনিও শুয়ে পড়ুন।’

বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লো হাফিজ আর ইকবাল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার নাক ডাকতে শুরু করলেন অনিমেষ। বিজয় ভাবতে লাগলেন অনিমেষ বাবুর কথা, লোকটা একটু আগেই ছেলেমেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা করছিলেন, আবার এরই মধ্যে ঘুমিয়ে নাক ডাকতে শুরু করেছেন। এধরনের লোকেরা হয়তো সুখী হয়, দুশ্চিন্তা বেশিক্ষণ এদেরকে কাবু করতে পারে না, এরা দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটায় না। অথচ যতোক্ষণ জেগে থাকে দুশ্চিন্তা এবং অলৌকিক ঈশ্বর ভক্তির প্রকাশটা এদেরই বেশি!

ঝিঁঝিপোকা ডাকার শব্দ আর অনিমেষ বাবুর নাক ডাকার শব্দ ব্যতিত আর কোনো শব্দ নেই। ক্লান্তিতে বিজয়ের চোখেও ঘুম নেমে এলো। তবে গভীর ঘুম নয়, হালকা। এই হালকা ঘুমের মাঝেই তিনি এলোমেলো কী সব স্বপ্ন দেখলেন। ঘণ্টা দুয়েক এভাবেই গভীর-অগভীর ঘুমে কেটে গেল সবার।

হঠাৎ আবার শব্দ হলো বারান্দার গ্রীলে, সঙ্গে অনেক মানুষের গুঞ্জন ভেসে এলো কানে। ঘুম ভেঙে গেল বিজয়ের। বাইরে থেকে কেউ একজন বললো, ‘গেট খোলেন।’

খলিল, হাফিজ আর ইকবাল জেগে উঠে বসেছে বেঞ্চে। কিন্তু গাঢ় অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। খলিল আতঙ্কিত হয়ে বিজয়কে জাগানোর উদ্দেশে মোবাইলের আলো জ্বেলে দেখলো বিজয় আগে থেকেই বসে আছেন।

বিজয় নিচু স্বরে বললেন, ‘আলো বন্ধ করেন।’

ওদিকে বাইরে থেকে ডেকেই চলেছে লোকগুলো, সেই সঙ্গে লাঠি দিয়ে গ্রিলে আঘাত করছে।

হাফিজ নিচুস্বরে বললো, ‘কী করি বলেন তো স্যার?’
‘বলেন, আমাদের কাছে চাবি নাই। চাবি স্কুলের দারোয়ানের কাছে। আচ্ছা, আপনি থাকেন, আমি বলি।’

বিজয় জানালা না খুলে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কারা আপনারা?’
‘আমরা সরকারী দলের লোক। দরজা খোলেন।’
‘আমাদের কাছে তো চাবি নেই। চাবি স্কুলের দারোয়ানের কাছে, সে সকালে আসবে।’

লোকগুলোর ভেতর থেকে নেতা গোছের একজন অন্য একজনকে বললো, ‘এই বাইক টান দিয়ে যা, শালার পুত হাবিবরে তুলে নিয়ে আয়।’

হাবিব এই স্কুলের দারোয়ান।
বিজয় ফোন করে সহকারি রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সব জানালে তিনি জানালেন, 'দরজা খুলে দিন। ওরা যা বলে শুনুন, বাধা দেবার দরকার নেই।'

মিনিট বিশেক পর স্কুলের দারোয়ানকে নিয়ে এসে গেট খুলে বারান্দায় উঠে এলো সরকারি দলের পরিচয় দেওয়া লোকগুলো, দরজা খুলতে বললো তারা। বিজয়ের নির্দেশে ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দরজা খুলে দিলো হাফিজ। দরজা খুলতেই সাত-আটজন তরুণ রুমে ঢুকলো। তাদের কারো হাতে লোহার রড, কারো হাসে পিস্তল, কারো হাতে ছুরি!

বিজয় ঘাবড়ে গেছেন, তবু মাথা ঠাণ্ডা করে বললেন, 'আপনারা যা ইচ্ছে করুন, আমরা আপনাদের বাধা দেব না। কিন্তু দয়া করে কারো গায়ে হাত দেবেন না।'

মধ্য ত্রিশের এক তরুণ, তার হাতে কিছু নেই, সে বিজয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডশেক করার জন্য, বিজয়ও হাত বাড়িয়ে দিলেন। বিজয়ের হাত ধরেই তরুণ বললো, ‘আপনারা ভয় পাবেন না। আমরা সরকারি দলের লোক। আপনারা আমাদের কাজে বাঁধা না দিলে আমরাও আপনাদের কিছু বলবো না।'

‘কী করতে চান আপনারা?’ বললো বিজয়।

অন্য একজন বললো, ‘আপনার লোকদেরকে কালি আর প‌্যাড দিতে বলুন আর চুপ করে দেখে যান আমরা কী করি।’
বিজয় বললেন, 'ওই দেখুন কালি আর প‌্যাড টেবিলেই রাখা আছে।'

নেতৃত্বদানকারী মধ্য ত্রিশের তরুণ এবার তার সঙ্গীদের উদ্দেশে বললো, ‘ওনারা ভদ্রলোক, আমাদের কাজে বাধা দেবেন না। তোরা কাজ শুরু কর।’

নির্দেশ পেয়ে অন্য তরুণেরা ব্যালট নিয়ে সরকারি দলের প্রতীকে সিল মেরে ভাঁজ করে ব্যালটবাক্সে রাখতে লাগলো। নেতৃত্বদানকারী তরুণ কোনো কাজে হাত দিলো না। সে বিজয়, অনিমেষ এবং খলিলের সাথে গল্প করতে লাগলো, তাদের বাড়ি কোথায়, কে কী করেন এসব জানলো প্রশ্ন করে করে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে বিজয়কে সিগারেটের অফার দিলে তিনি জানালেন, ‘আমি সিগারেট খাই না।’

এরপর তরুণ সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে লাগলো আর তাদের সরকার দেশের কী কী উন্নয়ন করেছে সেসবের বিবরণ দেবার পর উপসংহার টানলো, ‘দেখুন গণতন্ত্রের স্বার্থে, দেশের উন্নয়নের স্বার্থে এবারো আমাদের সরকার ক্ষমতায় আসা দরকার।’

ছবিসহ ভোটার তালিকা দেখে একজন টিক চিহ্ন দিতে লাগলো আর অন্যরা ব্যালটে সিল মারাতে লাগলো। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী চললো তাদের ব্যালট পেপারে সিল মারার কাজ। দুটি বাদে প্রায় সবগুলো ব্যালটবাক্সে কিছু কিছু করে রাখলো সিল মারা ব্যালট। তারপর চলে যাবার সময় নেতৃত্বদানকারী তরুণ আবার হাত বাড়িয়ে দিলো বিজয়ের দিকে। বিজয়ের হাতে হাত রেখে বললো, ‘সকালে আমাদের এজেন্ট আসবে। ব্যালটপেপারগুলো যেন ওভাবেই থাকে। কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করলে আমাদের কাছে খবর চলে যাবে। তখন কী হবে বুঝতেই পারছেন। আসি।’

তরুণদল চলে গেলে দরজা লাগিয়ে দিলো ইকবাল। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সকলে। বিজয় গিয়ে আবার চেয়ারে বসলেন, ফোন করে সব জানালেন সহকারি রিটার্নিং কর্মকর্তাকে। রিটার্নিং কর্মকর্তা জানালেন, ‘সিল মারা ব্যালট যেভাবে আছে সেভাবেই থাক। মনে করুন ওগুলো ভোট দেওয়া ব্যালট। ওরা যেখানে শেষ করে গেছে কাল সকালে আপনারা সেখান থেকেই শুরু করবেন।’

ফোন রেখে দিলে খলিল বললো, ‘স্যার সিল মারা ব্যালট কি ওভাবেই থাকবে?’
‘ওপর থেকে তেমনই নির্দেশ এসেছে।’
‘এটা অন্যায় স্যার।’
‘এছাড়া আমাদের কিছু করার নেই! জীবন আর চাকরি বাঁচাতে গেলে এই অন্যায় মেনে নিতে হবে।’

আর কোনো কথা বললো না খলিল। কয়েক মুহূর্তের নীরবতা, তারপর অনিমেষ বললেন, ‘এতো জতুগৃহে এসে পড়লাম!’
বিজয় বললেন, ‘বিদুরের পাঠানো খনক সুড়ঙ্গ খুঁড়ে জতুগৃৃহ থেকে যুধিষ্ঠিরদের উদ্ধার করেছিল, আমাদের উদ্ধার করারও কেউ নেই। কাল ভোট গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই জতুগৃহেই থাকতেই হবে। এই সময়ে যে-কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে।’

‘যুধিষ্ঠির কে স্যার? সাদ্দামের মতো কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন?’ উত্তরের অপেক্ষায় বিজয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো খলিল।

এই বিপদের মধ্যেও হেসে ফেললেন বিজয়, ‘আপনি মহাকাব্য মহাভারতের নাম শুনেছেন?’
‘শুনেছি। মালা.....হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থের নাম মহাভারত।’
‘পড়েছেন?’
‘আস্তাকফিরুল্লাহ! ওসব কিতাব পড়া গুনাহ!’
‘তাহলে যুধিষ্ঠির কে ছিলেন তাও আপনার জানার দরকার নেই, গুনাহ হতে পারে।’
‘আপনি এসব কিতাব পড়েন স্যার?’
‘পড়ি। আমি বেদ-বাইবেল, কোরাণ-পুরাণ, রামায়ণ-মহাভারত, ত্রিপিঠক সব পড়ি।’
‘আস্তাগফিরুল্লাহ, আল্লাহ মাফ করুন!’

খলিল আরো কিছু বলতে যাবার আগেই আবার একাধিক মোটর সাইকেলের শব্দ শুনে কান খাড়া করলো সবাই। গজরাতে গজরাতে দূরে চলে গেল মোটর সাইকেলগুলো। লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লো অনিমেষ, খলিল, হাফিজ এবং ইকবাল। বিজয় চেয়ারে বসেই রইলেন, তার ঘুম আসছে না। কেন যেন বারবার মনে পড়ছে বনানীর কথা। তার মনের মধ্যে একটি প্রশ্ন জাগলো, তিনি যদি আজ রাতে কোনো কোনো দূর্ঘটনায় মরে যান তাহলে কে বেশি আঘাত পাবে, শীলা না বনানী? ভাবনায় মগ্ন থেকে উত্তরও খুঁজে পেলেন নিজেই। দুজনেই আঘাত পাবেন, দুজনের আঘাতের ধরন হয়তো ভিন্ন। এখন কি বনানীকে একটা ফোন করবেন? বিজয়, মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে একটু ঘাটাঘাটি করলেন। বনানীর নম্বরে ডায়াল করেও আবার কেটে দিলেন। না থাক, বনানী নিশ্চয় তার স্বামীর পাশে ঘুমাচ্ছে এখন। মোবাইলে হেডফোন লাগিয়ে গান চালালেন তিনি। চালালেন কৃষ্ণা চট্টপাধ্যায়ের গাওয়া অতুল প্রসাদের গান-
‘পাগলা, মনটারে তুই বাঁধ।
কেন রে তুই যেথা সেথা পরিস প্রাণে ফাঁদ...’
গানের কথা আর সুরে ডুব দিয়ে চোখ বুজে রইলেন তিনি।
‘কতই পেলি ভালবাসা
তবু না তোর মেটে আশা
এবার তুই একলা ঘরে নয়ন ভরে কাঁদ।’
শেষ তিনটি লাইনে কৃষ্ণা চট্টপাধ্যায়ের সঙ্গে গলা মেলালেন তিনিও। মনটাকে তিনি বাঁধতে চান। কিন্তু মন কি বাঁধা মানে? শীলার আঁচলে বাঁধা থেকে বারে বারে মন ছুটে যেতে চায় বনানীর ছায়ায়।

রাতে সরকারি দলের কর্মীবাহিনী ভোট দেবার কাজ যেখানে শেষ করে গিয়েছিল, সকালে সেখান থেকেই ভোট গ্রহণের কাজ শুরু করেছেন বিজয়। ভেতরে সরকারি দলের একজন পোলিং এজেন্ট থাকলেও বিরোধী দলের কোনো পোলিং এজেন্ট নেই। বিরোধী দলের একজন পোলিং এজেন্ট এসেছিল, কিন্তু তাকে ভোটগ্রহণ কক্ষে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি।

সকালে আরো পুলিশ এবং আনসার সদস্য এসেছে তাদের এবং ভোটারদের নিরাপত্তা দেবার জন্য। বিরোধী পক্ষের যাদের ভোট রাতেই দিয়ে গেছে সরকারি দলের সমর্থকরা, তারা ভোট দিতে না পেরে বাইরে গিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। বিজয় পুলিশ সদস্যদের পাঠিয়ে বাইরের খবর নিচ্ছেন কিচ্ছুক্ষণ পরপর। যেহেতু অনেকেই ভোট দিতে পারেনি, তাই গণ্ডগোল হবার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দুপুর দুটো পর্যন্ত কোনো ঝামেলা ছাড়াই চললো ভোটগ্রহণ। বিপত্তি বাঁধলো দুপুর দুটোর পর। সরকার সমর্থক একদল কর্মী রাস্তা দিয়ে স্লোগান দিতে দিতে স্কুলের মাঠে নেমে পড়লো, তারা এমন হইহুল্লোর শুরু করলো যে লাইনে দাঁড়ানো ভোটাররা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে লাগলো মারামারি বাঁধার আশঙ্কায়। অল্প সংখ্যক পুলিশ আর আনসার সদস্য কোনোভাবেই এতো মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। সমর্থকদের একটা দল বাইরে হইহুল্লোরে ব্যস্ত, আরেকটা দল সোজা চলে এলো ভোটকেন্দ্রের ভেতরে; তাদের সকলেরই বুকে এবং হাতে সরকারি দলের প্রতীক সমৃদ্ধ ব্যাজ। কেউই তাদের বাঁধা দিলো না, মানে দিতে সাহস পেলো না। তারা এসে প্রথমেই সরকারি দলের পোলিং এজেন্টকে বের করে দিলো! বিজয় ভাবলেন, কালরাতে নিজেদের প্রতীকে এতো ভোট দিয়ে গেল, তবু সাধ মেটেনি! বিজয় তার কর্মীদের নিয়ে একদিকে সরে গেলেন। তরুণ দল ব্যালট নিয়ে সিল মারতে লাগলো। কী আশ্চর্য, এদের বুকে এবং হাতে সরকারি দলের প্রতীক সমৃদ্ধ ব্যাজ অথচ এরা সিল মারছে বিরোধী দলের প্রতীকে!

বিজয় এই দলটির চতুরতায় বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন ওদের দিকে; রাতে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা নিজেদের প্রতীকে সিল মেলে গেল, এখন বিরোধীদল ছদ্মবেশে এসে তাদের প্রতীকে ছিল মারছে! কারা জিতবে? বিজয়ের মনে হলো, যারাই জিতুক, হেরে গেল জনগণ, হেরে গেল গণতন্ত্র! ওরা কি নিজেদের প্রতীকে সিল মাছে নাকি গণতন্ত্রের কবর খুঁড়ছে?


ঢাকা
২০১৮।



মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৩২

মোঃ খুরশীদ আলম বলেছেন: “যে যায় লংকায় সে হয় হনুমান
কারে কি যে বলি ভাই
সকলে সমান। ”
অনেক ভাল লাগল আপনার বাস্তব ভিত্তিক অভিজ্ঞতার উপস্থাপনা। ভাল থাকবেন।

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৫২

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ। আপনিও ভাল থাকবেন।

২| ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:০৫

রাজীব নুর বলেছেন: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আপনি বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর সোনারবাংলা আপনার হাত দিয়েই সমৃদ্ধ হবে। আপনি সুস্থ থাকুন। আপনাকে শ্রদ্ধা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.