নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
আমি কৃষ্ণ, কৃষ্ণকুমার বিশ্বাস; কয়েদি নম্বর ৭১৮। কৃষ্ণ আমার ভাল নাম, ডাকনাম কানাই। ওই যে মথুরার অত্যাচারী রাজা কংসের বোন-ভগ্নীপতি দেবকী আর বসুদেবের অষ্টম সন্তান শ্রীকৃষ্ণ, মানুষ যাকে ভগবান বলে পূজা করে, তার মতোই আমার গায়ের রঙটি কালো বলে, তার নামেই দাদু আমার নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ। ওই শ্রী-টা কেন যেন বাদ দিয়েছেন। দিয়ে ভালই করেছেন, নামের শুরুতে অমন ঢাউস একটা শ্রী বনেদী বাড়ির সদর দরজার মতো লাগে! ওসব শ্রী-টিরি শ্রীকৃষ্ণের মতো বড় মানুষদের মানায়, আমার মতো অতি সাধারণ মানুষের নয়। এই যা, শ্রীকৃষ্ণকে মানুষ বলে ফেললাম? তিনি না ভগবান! আচ্ছা, শ্রীকৃষ্ণ মানুষ না ভগবান? সত্যি বলছি, সেই ছেলেবেলা থেকে তারুণ্যের অনেক বছর পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান ভেবে পূজা করার পরও আজ এই কয়েদখানায় বসে শ্রীকৃষ্ণকে মানুষ বলেই মনে হয় আমার, ওসব অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ভগবান-টগবান নয়! একটা কুকুরের প্রতিও মনিবের দরদ থাকে, কুকুরটা বিপদে পড়লে মনিব তাকে রক্ষা করে। তারপর শুনুন গোপনে বলি, আমাদের কয়েদখানায় যাবৎজীবন সাজাপ্রাপ্ত একটা জাঁদরেল কয়েদী আছে, নাম ওসমান আলী; ইয়া লম্বা আর তাগড়া স্বাস্থ্য। অন্য কয়েদীরা ওকে ভয় পায়। সুমন নামের একুশ-বাইশ বছরের এক কয়েদী ওসমানকে ওস্তাদ বলে ডাকে, ওস্তাদকে খুব সেবাযত্ন করে। সুমনের বয়স একুশ-বাইশ হলে কী হবে, দেখে মনে হয় সবে কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিয়েছে, গায়ের রঙ শ্যামলা, দেখতে বেশ সুন্দর। সুমন ওসমানের মাথা টিপে দেয়, অঙ্গমর্দন করে দেয়। গভীর রাতে ওসমান সুমনকে জড়িয়ে ধরে বউয়ের মতো আদর করে, চুমু খায়, গাঁড় মারে। আর এর বিনিময়ে ওসমান সুমনকে নিরাপত্তা দেয়। অন্য কোনো কয়েদী সুমনকে দিয়ে কোনো কাজ করানো তো দূরের কথা, ওর সঙ্গে সামান্য খারাপ ব্যবহার করারও সাহস পায় না। একবার নতুন আসা এক কয়েদী সুমনের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে ওসমান তাকে আচ্ছা মতো ঠেঙিয়েছিল। আমিও তো শ্রীকৃষ্ণনাম করতাম, শ্রীকৃষ্ণের মহিমা প্রচার করতাম, নিজেকে সঁপেছিলাম শ্রীকৃষ্ণের পায়ে। শুনেছি পুরাকালে ভক্ত কোনো দেবতাকে পূজা করলে কখনো কখনো অন্য দেবতা ঈর্ষান্বিত হয়ে ওই ভক্তকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করতেন, কিন্তু পূজ্য দেবতা ভক্তকে রক্ষা করতেন। তা শ্রীকুষ্ণ যদি ভগবানের অবতারই হয়ে থাকবেন, তাহলে আমাকে কেন বিপদ থেকে রক্ষা করলেন না?
থাকগে সে-সব কথা, আমি আমার কথা বলি। ছেলেবেলায় ঠাকুমা আমাকে আদর করে কানাই নামে ডাকতে শুরু করেন। শেষে ঠাকুমার দেখাদেখি অন্যরাও এই নামে ডাকতে থাকেন। সবার কাছে কানাই নামেই আমি বেশি পরিচিত। স্কুলের দুষ্টু ছেলেগুলো, মাঝে মাঝেই আমাকে কানু বলে ডাকতো। আমি নিষেধ করতাম, ওরা শুনতো না। ক্রিকেট খেলার সময় বলটা দু-পায়ের ফাঁক দিয়ে চলে গেলেই কেউ চেঁচিয়ে উঠতো, ‘এই কানু, ধরতে পারলিনে তো!’ ফুটবল খেলার সময় কে না চায় গোল দিতে? আমিও চাইতাম। কিন্তু বলটা গোলপোস্টের বাইরে দিয়ে গেলেই কেউ না কেউ হাঁক পেড়ে উঠতো, ‘এই শালা কানু, সহজ গোলটা দিতে পারলিনে।’ আরে শালা দে না গোল দে! গোল দেওয়া অতো সোজা না। পাঁচ-দশটা শর্ট নিতে পারলে তবেই একটা-দুটো গোল পাওয়া যায়। আমি শালা স্ট্রাইকার, ডিফেন্সে দাঁড়িয়ে খুব সহজেই বলা যায়, ‘গোল দিতে পারলিনে কানু!’
এই কানু নামটা শুনলে আমার মাথায় খুন চেপে যেতো। তবু ওরা আমাকে ওই নামেই ক্ষ্যাপাতো। আমি রেগে গেলে আরো বেশি করে ক্ষ্যাপাতো। যেগুলো গায়ে-গতরে আমার চেয়ে বড় সেগুলোকে মুখে গালাগালি করতাম। কিন্তু যেগুলো আমার চেয়ে ছোট সেগুলোকে মাঝে মাঝে ধরে এমন প্যাঁদানি দিতাম যে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে বাবা-মায়ের কাছে নালিশ করতো। বড় হয়ে জেনেছি যে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণকেও কানু বলে ডাকতো কেউ কেউ। তা ডাকুক, আমি ওই নামটা শুনতে চাইনে।
আমার কয়েদী সঙ্গীরা, মাঝে মাঝেই আমাকে প্রশ্ন করে, ‘এই ব্যাটা তুই কী করে কয়েদখানায় এলি বলতো? চুরি, ডাকাতি, খুন না ধর্ষণ?’
ছিঃ ছিঃ ছিঃ! ধর্ষণ করবো আমি? আমি শ্রীকৃষ্ণভক্ত ছিলাম, খুব বেশি হলে আমি না হয় লীলা করতে পারি, তাই বলে ধর্ষণ! কয়েদখানায় এসে এও আমাকে শুনতে হলো! আমি মনে মনে বলি, আরে শালারা আমাকে তোদের মতো ভাবিসনে, আমি সংযম করতে জানি। সত্যি বলছি, আমার বউয়ের সঙ্গে বিয়ের আগে প্রেম করেছি পাক্কা সাড়ে তিন বছর, কিন্তু কোনোদিন তার সঙ্গে শোয়ার আব্দার করিনি; বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছি, চুলের গন্ধ শুকেছি, চুমু খেয়েছি। এইটুকু না করলে কোনো শালার বিটা চুতমারানির প্রেমিকা থাকবে শুনি, ফুঁটে যাবে, ঝুলে যাবে অন্য কোনো পুরুষের গলায়!
বিয়ের পর মাঝরাতে শরীর জাগলে বউকে আদর করতে গেলে বউ যদি বলেছে, ‘আজ আমার শরীরটা ভাল লাগছে না গো, আজ বাদ দাও।’
আমার শরীরের মধ্যে তখন হয়তো রক্ত টগবগ করে ফুটছে, তবু বউয়ের ওপর আর জোর খাটাইনি। চুপি চুপি উঠে টয়লেটে গিয়ে আত্মরতির মাধ্যমে রক্তের টগবগানি থামিয়েছি। বউ আমার বুঝতেও পারেনি। আর সেই আমি কি না করবো ধর্ষণ!
চুরি আমি করেছি সেই ছেলেবেলায় বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে- এর গাছের আম, ওর গাছের জাম কিংবা ডাব। তা বলুন দেখি ছেলেবেলায় অমন একটু-আধটু চুরি কে না করেছে?
ডাকাতি করার মতো মনের জোর আমার কোনোকালেই ছিল না। আর ডাকাতি করতে যাব কোন দুঃখে? দুটো ডাল-ভাত খেয়েই আমি সুখে ছিলাম। আমার অতো বেশি নাই নাই, চাই চাই ছিল না।
অন্য কয়েদিরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার কাছ থেকে কথা বের করতে চায়, জানতে চায় আমার অতীতের ইতিহাস। আমি চুপ করে থাকি। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে কেউ কেউ বিরক্ত হয়। ষণ্ডামার্কা ওসমান আলী আমাকে বলে, ‘চুতমারানির ব্যাটা কথা বলছিসনে কেন? গাঁড় মেরে তোর মুখ দিয়ে কথা বের করবো!’
তবুও আমি চুপ করে থাকি। কী বলবো? কার বিরুদ্ধে বলবো? কোথা থেকে শুরু করবো? আমার সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। ভাবছি আজ বলবো, সব কথা বলবো। বুকের কথা মুখে বলে মনটাকে একটু হালকা করবো। কিন্তু কোথা থেকে যে বলা শুরু করি!
আমার মা, খুব ভাল লক্ষ্মীবউ বানাতে পারতেন। ভাবছেন মানুষ আবার লক্ষ্মীবউ বানায় কী করে? কোজাগরি পূর্ণিমায়, লক্ষ্মীপূজার দিন, মা ঘরের মধ্যে বাস্তুখামের গোড়ায় সুন্দর করে লক্ষ্মীবউ বানাতেন।
প্রথমে বাস্তুখামের কাছের মাটিতে গোলাকার আলপনা আঁকতেন। একটা জামবাটিতে আঁতপ চলের গুঁড়া জলে গুলিয়ে ছোট্ট এক টুকরো ন্যাকড়া চালের গুলানো গুঁড়ায় ভিজিয়ে হাতে রাখতেন আর আঙুলের ডগা দিয়ে নিপুণভাবে আলপনা আঁকতেন মাটিতে। কী সুন্দর আঁলপনা আঁকতেন মা-নানান রকম ফুল, লতা-পাতা, এমন কী পশু-পাখিও আঁকতে পারতেন! মায়ের হাতের আলপনা ছিল এক দারুণ শিল্পকর্ম!
মা বাস্তুখামের কাছের গোলাকার আলপনার ওখান থেকে জোড়া জোড়া পা আঁকতে শুরু করতেন, ঘর বারান্দা হয়ে সেই জোড়া জোড়া পা আঁকা শেষ হতো উঠোনে গিয়ে। ছেলেবেলায় আমি জোড়া জোড়া পা আঁকা দেখে মাকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘মা, এ কার পা?’
মা বলতেন, ‘মা-লক্ষ্মীর পা।’
‘মা-লক্ষ্মীর পা আঁকলে কী হয়?’
‘মা-লক্ষ্মী এই পায়ের ওপর দিয়ে হাঁটে ঘরে আসে আসনে বসে, পূজো নেয়, তারপর আমাগের ঘরের ধানের মাচায় সারাবছর থাহে মা-লক্ষ্মী।’
বাস্তুখামের গোড়ার গোলাকার আলপনার ওপর লক্ষ্মীর আসন বসাতেন মা। আমাদের কয়েকটা কাঠের টুল ছিল, মা তারই একটাকে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে আলপনা এঁকে বাস্তুখামের গোড়ার ওই গোলাকার আলপনার ওপর বসাতেন। তারপর বেতের আধলা ভর্তি এক আধলা ধান রাখতেন টুলের ওপর, আধলাতেও আলপনা আঁকতেন। আধলার ধানের মধ্যে কাঁচা টাকা, কড়ি, আরো কী কী যেন রাখতেন। তারপর মাপ মতো একটা পাটকাঠি ভেঙে আধলার ধানের মধ্যে পুঁতে দিতেন আর পাঠকাঠির মাথায় রাখতেন বেতের ছোট সের। এরপর কাপড় পরাতেন। সুন্দর করে সামনের দিকে কুচি দিতেন, মাথায় ঘোমটা দিতেন। মনে হতো সত্যি সত্যি একটা বউ বসে আছে! আমাদের পাড়ায় আমার মায়ের মতো লক্ষ্মীবউ আর কেউ বানাতে পারতেন না। কারো বউ এমন চিকন গড়নের হতো না, মনে হতো কাপড়ের পুটলি। নিজের মা বলে আমি বাড়িয়ে বলছি না, পাড়ার লোকেও আমার মায়ের লক্ষ্মীবউ বানানোর প্রশংসা করতো। বলতো, ‘কানাই’র বউটাতো সুন্দর অইচে, কানাই’র মায়ের মতো বউ আর কেউ বানাবার পারে না।’
আমার মা ঠোঁট টিপে গর্বের হাসি হাসতেন। গর্বভরে পড়শিদের উদ্দেশে বলতেন, ‘আমার কানাই’র জন্যেও এমন সুন্দর বউ ঘরে আনবো, পাড়ার সেরা বউ অবি আমার কানাই’র বউ!’
অনাগত দিনের অজ্ঞাত বউয়ের কথা শুনে আমি লজ্জা পেতাম, লজ্জায় লক্ষ্মীবউয়ের দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতাম। ছেলেবেলায় নিজের বউয়ের কথা শুনে লজ্জা লাগে না বুঝি!
লক্ষ্মীপূজার রাতে মা সবাইকে খিচুরি আর নিরামিষ প্রসাদ খাওয়াতেন। পাড়ার লোক দল বেঁধে আমাদের বাড়িতে আসতো, ঘরে গিয়ে মায়ের লক্ষ্মীবউ দেখে প্রশংসা করতো আর প্রসাদ খেয়ে গাল-গল্প করে খুশি মনে বাড়ি যেতো। মা মানুষকে খাওয়াতে খুব ভালবাসতেন। আমাদের খুব বেশি টাকা-পয়সা ছিল না, কিন্তু মানুষকে খাওয়ানোর মন ছিল।
আমার বাবা পোস্ট অফিসের ডাকপিয়ন ছিলেন। বাবা চাইতেন আমিও তার মতো কোনো সরকারি চাকরি করি। কিন্তু লেখাপড়ায় আমার খুব বেশি মনোযোগ ছিল না। পাস করে যেতাম আর কী! ছেলেবেলায় খোল বাজাতে শিখেছি আমাদের পাড়ার রাধানাথ দাদুর কাছে। রাধানাথ দাদু কীর্তনের দলে খোল বাজাতেন। আমিও ভালই শিখে গেলাম খোল বাজাতে। গ্রামে কারো বাড়িতে নারায়ণ পূজা হলে, হরিসভা হলে বা কেউ মরে গেলে শ্মশানযাত্রার গানের সঙ্গে খোল বাজাতে আমার ডাক পড়তো। উচ্চ মাধ্যমিকে থাকার সময় বাবা মারা গেলেন, আমি কোনোমতে পড়াশুনা করে উচ্চ মাধ্যমিক দিলাম, পাসও করে গেলাম। কিন্তু আমার মন আর পড়ার দিকে ঝুঁকলো না, তাছাড়া সংসারে তখন রোজগারেরও দরকার ছিল। আমি ঢুকে গেলাম কীর্তনের দলে। নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে কীর্তন করে বেড়াতাম। শীতকালে বায়না থাকতো বেশি, সারাটা শীতকাল তো বাইরে বাইরেই কাটাতাম, বাড়িতে থাকার সময় পেতাম না। পাঁচ-ছয় বছর এমনি করে হাসি-আনন্দে কেটে গেল।
ওই কীর্তন করতে গিয়েই শিখার সঙ্গে আমার আলাপ। শিখার বাড়ি রাজবাড়ীর কালুখালী। কীর্তন করতে গিয়েছিলাম ওদের গ্রামে। আমাদের থাকার জায়গা করা হয়েছিল ওদের বাড়িতে। ছিপছিপে গড়নের তেইশ-চব্বিশ বছরের যুবতী শিখা। শ্যামলা গায়ের রঙ। দেখতে যে খুব সুন্দরী তা নয়, তবে চেহারায় একটা মায়া মায়া ভাব। আমাদেরকে খুব আদর-যত্ন করেছিল ওরা। আমরাও খোলা মনে ওদের বাড়ির মানুষের সঙ্গে কথা বলতাম। প্রথম আলাপেই আমার মনে হয়েছিল শিখার মনে কোনো অহংকার নেই।
মা তখন আমার জন্য নানা জায়গায় পাত্রীর খোঁজ করছেন, মনে হলো আমার বউ হিসেবে শিখা মন্দ হবে না। শিখা গৃহকর্মেও নিপুণ। আমার মা তো গৃহকর্মে নিপুণ মেয়েই খুঁজছেন। শিখা যখন আমাদের খেতে দিতো কিংবা উঠোনে হাঁটতো, আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতাম। কে জানে শিখা আমার চোখ দেখে কিছু বুঝেছিল কিনা, কেমন যেন মিটিমিটি হাসতো আমায় দেখে। নাকি আমারই অমন মনে হতো কে জানে!
দ্বিতীয় দিনে জানলাম শিখা ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ে চাকরি করে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিবাহিত মহিলাদেরকে যৌনজ্ঞান দেয়, কন্ডম আর জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল বিলি করে। ও চাকরি করে শুনে আমি একটু দমে গেলাম, চাকরি করা মেয়ে কি আমাকে বিয়ে করবে? আর ওর বাড়ির লোকই কি আমার সঙ্গে ওকে বিয়ে দেবে?
কিন্তু প্রেমে পড়ে আমি তখন বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণবনে গেছি, কিসের ভয়, কিসের কী! বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন গরুর রাখাল, সখের বংশীবাদক, বড় হয়েছিলেন গোয়ালার ঘরে। আর আমি কৃষ্ণ তো গরুর রাখাল নই, কীর্তনের দলের পেশাদার খোলবাদক, আয়-রোজগারও ভাল, মানুষ সম্মান করে, শ্রীকৃষ্ণপ্রেমে গদগদ হয়ে চৈতন্যভাবের মানুষেরা কীর্তনের আসরে কিংবা আসরের বাইরেও বুকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করে। আমার বাবাও শ্রীকৃষ্ণ’র পাতানো বাবা নন্দষোষের মতো হাটে-বাজারে দুধ-দই বেচতেন না কিংবা শ্রীকৃষ্ণের ঔরস পিতার মতো কারাগারে বন্দীও ছিলেন না। আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন, সাইকেলে চড়ে গ্রামে গ্রামে চিঠি বিলি করতেন। নিঃসন্দেহে বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণের তুলনায় আমার সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান অনেকটাই উত্তম। আমার চেয়ে নিন্ম অবস্থানে থেকে কয়েদী-গোয়ালাপুত্র শ্রীকৃষ্ণ যদি বিবাহিত রাধার মন জয় করতে পারে, তো তার চেয়ে উত্তম অবস্থানে থেকে আমি ডাকপিয়নপুত্র কৃষ্ণ অবিবাহিত শিখার মন জয় করতে পারবো না!
পারতে আমাকে হবেই। আর না পেরেই বা উপায় কী, আমার ভাবনায় তখন কেবলই শিখা; শয়নে শিখা, স্বপনে শিখা, কীর্তনের আসরেও শিখা! যেখানেই কীর্তন করতে যেতাম, কীর্তনের আসরে খোল বাজানোর সময় মনে হতো এখানেই ভক্তবৃন্দের মধ্যে কোথাও শিখা বসে আছে, আমাকে দেখছে। আমি জানতাম যে শিখা নেই, তবু অলীক এক শিখা এসে উপস্থিত হতো কীর্তনের আসরে। আর আমি সেই অলীক শিখাকে মুগ্ধ করতে মন-প্রাণ উজার করে খোল বাজাতাম। নেচে-নেচে বাজাতাম, হেলে-দুলে বাজাতাম, লাফিয়ে-লাফিয়ে বাজাতাম!
তখন শীতকাল, একের পর এক কীর্তনের বায়না। দেশের দক্ষিণ থেকে উত্তর, পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত ছুটছি কখনো বাসে-কখনো ট্রেনে; আর আমার সাথে সাথে ছুটছে অশরীরি শিখা! কী সৌভাগ্য আমার, আবার বায়না পেলাম কালুখালীর এক গ্রামে। আমার বুকের ভেতর উথাল-পাথাল আনন্দ, যে করেই হোক একবার শিখার সঙ্গে দেখা করবোই। গেলাম কীর্তন গাইতে। খোঁজ নিয়ে জানলাম আমরা যে গ্রামে কীর্তন করছি সেখান থেকে শিখার অফিস ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে, ওই এলাকার সবাই শিখাকে চেনে। হোক ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে, তবু আমি যাবোই। সেদিন আমাদের কীর্তন গাওয়ার পালা ছিল ভোরবেলায়, কীর্তন গেয়ে সাত-সকালে স্নান করে খেয়ে একজনের কাছ থেকে একটা সাইকেল চেয়ে নিয়ে ছুট লাগালাম শিখার অফিসের দিকে! প্রেমে পড়েছেন কখনো? প্রেমে না পড়লে এই আবেগের গভীরতা অনুভব করা যাবে না। আমি সাইকেলে ছুটছি, ছুটছি, ছুটছি; না না, যেন উড়ছি, উড়ছি, উড়ছি....!
খুঁজতে খুঁজতে ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের সাদামাটা অফিসটা পেয়ে যেন স্বর্গের অমরাবতী দেখছি এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম! বুকে তখন কাঁপন শুরু হয়েছে। যাবো? কিন্তু গিয়ে কী বলবো? কিভাবে বলবো? অফিসে তো অন্য লোকও আছে, তাদের সামনে তো মনের কথা বলা সম্ভব নয়। আড়ালে ডেকে নিয়ে বলতে হবে। কিন্তু অন্যরা কী ভাববে? ধুর ছাই, লোকে যা ভাবে ভাবুক, আমি যাবই। বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণ কি অতো কিছু ভেবেছিলেন? লোকলজ্জা-কলঙ্কের ভয় পেলে কি তিনি বিবাহিত রাধার মন পেতেন? যমুনার ঘাটে কি কদমতলায় রাত-বিরেতে রাধার নিবিড় সান্নিধ্য পেতেন? কক্ষনো নয়। আমি থোরাই-কেয়ার করি লোকলজ্জার ভয়!
অফিসে গিয়ে শুনলাম কিছুক্ষণ আগেই শিখা গ্রামে বেরিয়ে পড়েছে। কোন গ্রামের দিকে গেছে জেনে নিলাম। এরপর লোকের কাছে শুনে শুনে ছুটলাম সেই গ্রামের দিকে। পাকা রাস্তা ছেড়ে ঢুকলাম মাটির রাস্তায়। ভাগ্য ভাল, মিনিট দশেকের মধ্যেই শিখাকে পেয়ে গেলাম। পিছন থেকে দেখেই আমি তাকে চিনতে পারলাম। দেখি, সে রাস্তা ধরে জোর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে, আবার বুকে কাঁপন শুরু হলো, কী বলবো? কী করে বলবো? শিখা যদি আমার প্রেম প্রত্যাখান করে?
শিখারও তো পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে, শিখার কোনো মনের মানুষ থাকতে পারে কিংবা এমনও হতে পারে যে পারিবারিকভাবে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, আর না থাকলেও আমার মতো কীর্তনের দলের খোলবাদকের প্রেম সে প্রত্যাখান করতেই পারে। শিখা যদি আমাকে প্রত্যাখান করে তো আমি কী করবো? শ্রীকৃষ্ণ যেমনি পরবর্তী জীবনে রাধার প্রেম ভুলে রুক্সিনীকে হরণ করে অসুর বিবাহ করেছিলেন, আমিও কি তেমনিভাবে শিখাকে তুলে নিয়ে গিয়ে অসুর বিবাহ করবো? না, না, আমি তা পারবো না। আমি অমন ধাতের মানুষই নই। আর এখন কি আর সেই যুগ আছে? শ্রীকৃষ্ণ রাধাকে যেভাবে জ্বালাতন করেছিলেন, এখনকার দিন হলে তার নামে ইভটিজিংয়ের মামলা হতো; কিংবা যেভাবে রুক্সিনীকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন, এখনকার দিন হলে নারী অপহরণের দায়ে নির্ঘাত জেল হতো। আমি ওসবের মধ্যে নেই, শিখার কাছে প্রেম প্রার্থনা করবো, একবারে প্রেম না পেলে বারবার প্রেম প্রার্থনা করবো, তাতেও না পেলে খোলের বোলে ফোটাবো বিরহের ফুল!
বীর-পুরুষের মতো অতোটা পথ অতিক্রম করে গিয়ে শেষবেলায় আমার হাত-পা কাঁপছিল, মনে হচ্ছিল সাইকেল থেকে পড়ে যাব! গলা শুকিয়ে আসছিল। নিজেকে ধমক দিলাম এই বলে যে শ্রীকৃষ্ণ রাধার মন জয় করেছিলেন, তোকেও পারতে হবে। আমি সাইকেলের গতি কমিয়ে শিখার বরাবর গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আরে আপনি, কেমন আছেন?’
এমন ভাব করলাম যেন হঠাৎ করেই দেখা। আমি সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম। ও আমার দিকে তাকালো। মৃদু হেসে বললো, ‘ভাল।’
বললাম, ‘আমায় চিনতে পেরেছেন?’
‘চিনবো না কেন? আপনি আমাদের গ্রামের কীর্তনে কী চমৎকার খোল বাজিয়েছিলেন!’
শিখার মুখে খোল বাজানোর প্রশংসা শুনে আমার বুকে পদাবলী কীর্তনের বোল ফুটে উঠলো যেন! ও আবার বললো, ‘আপনি ভাল আছেন?’
‘হ্যাঁ, ভাল আছি।’
‘এদিকে আবার কোথাও কীর্তন করতে এসেছেন?’
‘হ্যাঁ, রতনদিয়া।’
‘আপনাদের জীবন বেশ, নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে কীর্তন করে বেড়ান, কতো কিছু দেখতে পান।’
শিখা নিজেই কথা বলার মঞ্চ তৈরি করে দিলো আর আমিও যাত্রাদলের বিবেকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হলাম, ‘তা ঠিকই বলেছেন। দেশের প্রায় পঞ্চাশটি জেলায় কীর্তন করেছি। ছোট্ট এই জীবনে বহু মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। মানুষ ভালবেসে বুকে ঠাঁই দিয়েছে। ওই যে লালন সাঁইজির ভাষায় মানুষসঙ্গ বলতে যা বোঝায়, তা আমাদের হয়। আমার এই ছোট্ট জীবনে অনেক রকম মানুষের সঙ্গলাভ এক পরম প্রাপ্তি।’
ও আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। আমরা পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম। আমি আসল কথাগুলো কিভাবে বলবো তা ভাবতে লাগলাম, মনের মধ্যে কথা সাজাতে লাগলাম। আমি কথা সাজাই আর কথা পিছলে পড়ে যায়, আমি কথা সাজাই আর কথা পিছলে পড়ে মনের অতলে হারিয়ে যায়; কী মুশকিল!
শেষে দ্বিধার ভেলায় দুলতে দুলতে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলাম দুটো মাত্র শব্দ, ‘বলছিলাম কী...।’
‘বলুন।’
‘ওই... নমিতা, নমিতাকে আপনি চিনবেন না। বিধবা, বয়স একান্ন-বায়ান্ন। খুব সাদাসিদে গ্রাম্য মহিলা। নমিতার বর সরকারি চাকরি করতেন, পোস্ট অফিসের ডাকপিয়ন ছিলেন। নমিতা তার ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। আমি তো নানা জায়গায় কীর্তন করে বেড়াই, এজন্য নমিতা আমাকে বলে রেখেছেন আমি যদি ভাল কোনো পাত্রীর সন্ধান পাই তবে তাকে যেন জানাই। আপনাকে দেখে মনে হলো পাত্রী হিসেবে আপনি খুব ভাল; বিনয়ী, মিষ্টভাষী, গৃহকর্মে নিপুণ, অতিথি আপ্যায়নে নিবেদিত প্রাণ।’
‘বাব্বা, তিনদিন আমাদের বাড়িতে থেকে, আমাকে দেখে এতোকিছু বুঝে ফেলেছেন?’
‘দেখুন, আমরা তো অগণিত মানুষের সঙ্গে মিশি, কিছুটা হলেও মানুষ চিনতে পারি। আপনি যদি অনুমতি দেন তো আমি নমিতাকে আপনার কথা বলতে পারি।’
‘কে এই নমিতা? বাড়ি কোথায়?’
‘বাড়ি ফরিদপুরে, আমাদের গ্রামে। স্বর্গীয় অতুল চন্দ্র বিশ্বাসের স্ত্রী।’
‘আপনার আত্মীয়?’
‘তার চেয়েও বেশি, আমার মা।’
আমার কথা শুনে শিখার সে কী হাসি! হাসি থামতেই চায় না, পারলে হাসতে হাসতে ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে! হাসতে হাসতে ওর চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেল। আমি তখন মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওকে দেখছি আর ভাবছি শ্রীকৃষ্ণের প্রস্তাব শুনে রাধাও কি এমন করে হেসেছিলেন? নিশ্চয় নয়, বিবাহিত রাধার মুখে হাসি ফোটাতে শ্রীকৃষ্ণের বেগ পেতে হয়েছিল। এরপর যদি শিখা আমাকে প্রত্যাখানও করে, তবু আমি যে ওর মুখের হাসি দেখতে পেয়েছি, তাই-বা কম কী! আমি কিছুতেই শিখার হাসির অর্থ উদ্ধার করতে পারলাম না। এ কি তাচ্ছিল্যের হাসি, কৌতুকের হাসি, নাকি আনন্দের হাসি? আমি কেবল দাঁড়িয়ে মুগ্ধচোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। হাসির দমক একটু কমলে ও আবার হাঁটতে শুরু করলো, আমিও ওকে অনুসরণ করলাম।
বললাম, ‘আমি নমিতাকে কী বলবো?’
‘কিছু বলার দরকার নেই।’
‘কেন?’
‘আমি তো এখন বিয়ে করবো না। আমার দাদা এখনো পড়ছে, পড়া শেষ করে ও চাকরি পেলে তারপর আমি বিয়ে করবো।’
‘বেশ আমি তাহলে মাকে আরো কয়েকটা বছর অপেক্ষা করতে বলি?’
‘দেখুন, বিয়েটা তো কেবল আমার একার সিদ্ধান্তের বিষয় নয়, আমার পরিবারেরও তো পছন্দ-অপছন্দ আছে।’
‘আমি মাকে আপনাদের বাড়িতে পাঠাবো?’
‘না না, তার কোনো দরকার নেই। আরো দু-তিন বছরের আগে আমি বিয়ে করতে পারবো না।’
‘বেশ, দু-তিন বছর পরই আমার মা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আপনাদের বাড়িতে যাবে।’
‘আমি ভেবে দেখি। আপনি এখন আসুন। আমি এখন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে যাব। বোঝেন তো মহিলাদের নিয়ে আমার কাজ। আপনি আমার সঙ্গে গেলে তারা লজ্জা পাবে আর লোকেও নানা কথা বলবে।’
‘ঠিক আছে, আমি তাহলে আজ আসি। কিন্তু মাঝে মাঝেই আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবো।’
ও হ্যাঁ বা না কিছুই বললো না। মৃদু হেসে শুধু বললো, ‘আসি।’
বলেই বড় রাস্তা থেকে ছোট একটা রাস্তায় ঢুকে পড়লো। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম যতোক্ষণ না সে চোখের আড়ালে চলে গেল। আড়ালে যাবার আগে সেও একবার পিছন পানে চাইলো, আমি তার চোখ স্পষ্টভাবে দেখতে না পেলেও আমার মনে হলো তার ওই তাকানোতে সম্মতির ভাব আছে।
এরপর আরো দু-বার গেলাম তার সঙ্গে দেখা করতে। তৃতীয়বারে তার সম্মতি পেলাম, মানে আমি তার হৃদয় জয় করতে পারলাম। আহা, মনে হলো জীবন কতো সুখের! বাইরে থেকে শিখাকে একটু শক্ত মনে হলেও আসলে ওর ভেতরটা তুলতুলে নরম। রোজ ফোনে কথা হতো, তবু আমাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে যেতো। আমার তো পাখির মতো জীবন, আজ এই জেলায় তো কাল আরেক জেলায় কীর্তন। তবু সময় পেলেই আমি তার কাছে ছুটে যেতাম। সারাটা দিন দু-জনে একসাথে কাটাবার পর ও ভেজা ভেজা চোখে আমাকে বিদায় দিতো। ওকে ছেড়ে আসতে আমারও তখন খুব কষ্ট হতো। আমি শুধু দিন গুনতাম যে কবে ওর দাদার পড়া শেষ হবে, কবে চাকরি পাবে। একবার রাজবাড়ী শহরে গেলাম কীর্তন করতে। ও শুনেই বললো, ‘আমি আসবো তোমার সঙ্গে দেখা করতে, কীর্তনও শুনবো।’
সেদিন আমাদের কীর্তনের সময় ছিল দুপুর দুটোয়। তার আগেই শিখার আসার কথা। আসরে ঢোকার ঘণ্টা দেড়েক আগে ওর সঙ্গে কথা হলে জানালো, ‘আমি এখনই রওনা করবো। ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব।’
ঘণ্টা খানেক পর আবার ফোন দিলাম, রিং হলো, কিন্তু ও ফোন ধরলো না। আসরে ঢোকার আগে আরো কয়েকবার রিং দিলাম, কিন্তু ফোন ধরলো না। আমি আসরে ঢুকলাম, কিন্তু আমার মন পড়ে রইলো শিখার কাছে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রইলো ভক্তবৃন্দের মাঝে। ভক্তবৃন্দের মাঝে কতো তরুণীকে দেখলাম, কিন্তু আমার শিখাকে দেখতে পেলাম না। ভীষণ মন খারাপ হলো আমার।
দুই ঘণ্টা পর আসর থেকে বেরিয়ে আবার ফোন দিলাম শিখাকে। ধরলো একজন পুরুষ লোক। বললাম, ‘আপনি কে? শিখা কোথায়?’
বললো, ‘আমি শিখার দাদা। শিখা অ্যাকসিডেন্ট করেছে।’
আমার বুকের মধ্যে যেন কেউ পাথর ছুড়ে মারলো! বললাম, ‘কিভাবে অ্যাকসিডেন্ট করেছে? শিখা এখন কোথায়?’
‘আমরা হাসপাতালে। এখান থেকে এখনই শিখাকে ঢাকা নিয়ে যেতে হবে।’
‘শিখা বাঁচবে তো?’
‘এখন কথা বলার সময় নাই।’
শিখার দাদা ফোন কেটে দিলো। আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। কিভাবে অ্যাকসিডেন্ট করলো শিখা? শিখা বাঁচবে তো? নিশ্চয় কীর্তন শুনতে আসার পথে অ্যাকসিডেন্ট করেছে। অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করলাম। মনে হলো আমার জন্যই শিখা অ্যাকসিডেন্ট করেছে। ভেতরটা ব্যথায় দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল তখনই ছুটে যাই শিখার কাছে।
সেদিন রাতেই শিখার দাদাকে আবার ফোন করে বিস্তারিত জানতে পারলাম, শিখা কীর্তন শোনার জন্য বাড়ি থেকে রওনা করেছিল, ট্রেনে উঠার সময় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল। শিখা প্রাণে বেঁচে গেলেও ওর ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কাটা পড়ে। হায় ভাগবান শ্রীকৃষ্ণ, আমি তো সারাক্ষণ তোমার নাম জপ করি, তোমার গুণকীর্তন করি, শিখা তো তোমার নাম সংকীর্তন শুনতেই আসছিল, তবে তুমি আমার শিখার এমন ক্ষতি করলে কেন? কোন অপরাধে তুমি আমাকে এমন শাস্তি দিলে?
আমি ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে গেলাম শিখাকে দেখতে। আমাকে দেখে ও হাউ-মাউ করে কাঁদতে লাগলো, আমার মনে হলো শিখাকে জড়িয়ে ধরে আমি ওর মতো চিৎকার করে কাঁদি। কিন্তু ওর বাড়ির লোকের সামনে খুব কষ্টে নিজেকে সংযত রাখলাম, কিন্তু চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। খুলে না বললেও আমাদের সম্পর্কের বিষয়টি ওদের বাড়ির মানুষ বুঝে ফেললো। কীর্তনের বায়না থাকায় দু-দিন পর আমি ভগ্ন হৃদয়ে ঢাকা থেকে ফিরে এলাম। শিখা আরো কিছুদিন হাসপাতালে ছিল, তারপর ওকে বাড়িতে আনলে আমি আবার দেখতে গেলাম।
শিখা সুস্থ হলে মাস কয়েক পর একদিন মাকে বললাম, ‘মা, আমি একজনকে পছন্দ করি, সেও আমাকে পছন্দ করে। তোমার সম্মতি দিলে আমরা বিয়ে করবার চাই।’
মা শুধু বললেন, ‘স্বজাতি?’
‘হুম।’
মা শুনে খুব খুশি হলেন। আমরা নমশূদ্র, তাই মা চাইতেন আমি যেন নমশূদ্র ভিন্ন অন্য কোনো উচ্চবর্ণের মেয়েকে বিয়ে না করি। মায়ের ধারণা, উচ্চবর্ণের সঙ্গে নমশূদ্র ছেলে-মেয়ের বিয়ে হলে আত্মীয়তা ঘনিষ্ঠ হয় না। মায়ের এই ধারণার কারণ, আমার জ্যাঠতুতো বোন এবং আমাদের গ্রামের আরো কিছু ছেলেমেয়ের বিয়ে। আমার জ্যাঠতুতো বোন ভালবেসে বিয়ে করেছে এক কায়স্থ ছেলেকে। তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা অনেকবার তাকে বলেছে, ‘চাঁড়ালের বাচ্চা’।
কোনো বিষয়ে মতের মিল না হলে ওর স্বামীও ওকে বলে, ‘তোমার চাঁড়ালপনা স্বভাব আর গেল না!’
উচ্চবর্ণের হিন্দুরা আমাদেরকে চাঁড়াল বলে-চাঁড়ালপাড়া, চাঁড়ালের বাড়ি, চাঁড়ালের বাচ্চা ইত্যাদি। এমনকি নিজেদের মধ্যে গণ্ডগোল হলেও একে অপরকে চাঁড়ালের বাচ্চা বলে গালি দেয়! কারো বাড়ি একটু অপরিচ্ছন্ন হলেই বলে, অমুকের বাড়ি চাঁড়ালের বাড়ির মতো!
উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কথা আর ব্যবহারে মনে হয়, নমশূদ্ররা কোনো ইতরপ্রাণি, তাদের বাসস্থল সর্বদা নোংরা থাকে। অথচ কীর্তনের আসরে এরাই আবার আমাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে!
কেবল আমার জ্যাঠতুতো বোন নয়, অন্য আরো কয়েকজনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ফলে আত্মীয়তার সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতার সর পড়েনি। এজন্যই মায়ের চাওয়া ছিল আমি যেন নমশূদ্র মেয়ে বিয়ে করি।
কিন্তু যখন শিখার দূর্ঘটনার ব্যাপারটি মাকে খুলে বললাম, তখন মা গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, ‘জানে-শুনে খুঁড়া মিয়ার সাথে আমি তোর বিয়ে দেব না।’
বললাম, ‘মা, আমার জন্যেই ও খুঁড়া অইচে। ও কীর্তন শুনবার আসার পথে অ্যাকসিডেন্ট করছিল।’
‘তা হোক, খুঁড়া মিয়ার সাথে তোর বিয়ে দিলি সমাজে আমার মুখ থাকপি! খুঁড়া মিয়ারে আমি আমার ঘরের বউ করবো না।’
মা তার সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন, শত চেষ্টা করেও মাকে বোঝাতে পারলাম না। শেষমেষ আমিও মাকে বলে দিলাম, ‘তাইলে আমি বিয়েই করবো না। বিয়ে যদি করতিই হয় শিখারেই করবো।’
মাসের পর মাস আমাদের মা-ছেলের মধ্যে এক নীরব দ্বন্দ্ব চলতে লাগলো। মা মাঝে মাঝে আমাকে লোভ দেখাতেন, ‘অমুক জায়গায় এট্টা ভাল মিয়া আছে, মিয়ার বাবার টাহা-পয়সা আছে, দিনা-পাওনা ভাল দিবার চায়।’
মা এসব কথা তুললেই আমি উঠে অন্যদিকে চলে যেতাম, আর মা কাঁদতেন। আরো দুটো বছর কেটে গেল, প্রায়ই আমি শিখাকে দেখতে যেতাম। যে শিখা দুই পায়ে হাঁটতো, সেই শিখাকে ক্র্যাচে ভর দিয়ে এক পায়ে হাঁটতে দেখে আমার বুকটা ফেটে যেতো, কিন্তু আমি শিখার সামনে শক্ত থাকতাম যাতে শিখা মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে। ওদের বাড়িতে গেলেই ওর বাবা-মা আমাকে বিয়ের কথা বলতো। আমি কেবল তাদের কাছে সময় চাইতাম, কিন্তু বলতাম না যে আমার মা চায় না আমি শিখাকে বিয়ে করি।
শেষ পর্যন্ত আমার জেদের কাছে মাকে হারতে হলো। মা যখন দেখলেন যে আমি শিখাকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করবো না, প্রয়োজনে চিরকুমার থাকবো, তখন মা আমাদের বিয়েতে রাজি হলেন। এক মাঘ মাসের শীতের রাতে শিখা আমাদের বাড়িতে এলো বউ হয়ে। আমাদের বিয়ে হলো, কিন্তু আমার মনের শান্তিও উবে গেল। আমার মা বিবাহকার্যের সবকিছুই পালন করলেন ঠিকই, তবে তার আশ্চর্য রকমের শীতল ব্যবহার আমার দৃষ্টি এড়ালো না। কেমন মন মরা হয়ে রইলেন মা। আসলে স্বপ্নভঙ্গ হওয়ায় মা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। ওই যে লক্ষ্মীবউ বানানোর সময় মা গর্বভরে সকলকে বলতেন, ‘আমার কানাই’র জন্য এমন সুন্দর বউ আনবো, আমার কানাই’র বউ হবি পাড়ার সেরা বউ’, অথচ তার আদরের কানাই’র বউ হলো এক পা হারানো একটা মেয়ে! এই ব্যাপারটা মা মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না। সারাজীবন লক্ষ্মীবউ বানিয়ে বিজয়ী হওয়া মা পাড়ার অন্য মহিলাদের কাছে নিজেকে পরাজিত ভাবতে লাগলেন। পরাজিত ভেবে মা নিজেকে গুটিয়ে রাখতেন আমার আর শিখার কাছ থেকে। এটা নিয়ে পাড়ার লোকেও হাসাহাসি করতো, বলতো, ‘কানাই’র মা কইতো না কানাই’র বউ হবি পাড়ার সেরা বউ, এমন সেরা বউ হইছে যে বউয়ের এট্টা পাও-ই নাই!’
কারো না কারো মাধ্যমে এইসব কথা মায়ের কানে আসতো। আর কানে এলেই মা শিখার কাজকর্মের খুঁত ধরতেন, ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করতেন। প্রথমদিকে চাকরির জন্য শিখাকে অধিকাংশ সময় বাবার বাড়িতেই থাকতে হতো। কিছুদিন পর শিখা বদলী হয়ে এলো আমাদের উপজেলায়। সে তখন আমাদের বাড়ি থেকেই অফিস করতো। আর একসঙ্গে থাকায় প্রায়ই মা আর শিখার মধ্যে ঝগড়া হতো।
শিখার জন্য পাড়ার নারীদের কাছে পরাজয় হয়েছে ভেবে মা যেমনি শিখাকে মেনে নিতে পারছিলেন না, তেমনি শিখাও মায়ের ব্যবহারে সন্তুষ্ট ছিল না। আমাদের পাড়ায় কিছু মানুষ মাকে উসকে দিতো, এরা আগুনে ঘি ঢালতো, রগড় দেখতো। এরা মাকে এক রকম কথা বলতো, শিখাকে আরেক রকম। বউ-শাশুড়ির সম্পর্কটা এরা আরো বিষিয়ে তুলেছিল।
শিখা গর্ভবতী হলে পাড়ার কেউ কেউ মাকে বলতো, ‘খুঁড়া বউয়ের প্যাটে খুঁড়া বাচ্চা হবার সম্ভাবনাই বেশি।’
আচ্ছা বলেন, একটা মেয়ের পা ট্রেনে কাটা পড়েছে, তাই বলে তার পেটের বাচ্চাও কি খোঁড়া হবে? এমন আজগুবি কথা মানুষ মানুষকে বলে?
অথচ পাড়ার লোকে আমার মাকে এইসব বলতো। আর আমার সাদাসিধা মা লোকের এইসব কথা বিশ্বাস করতেন, মায়ের চোখে হয়তো এমন দৃশ্য ভাসতো যে তার নাতি-নাতনি খোঁড়া হয়েছে, তারা ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে চলছে অথবা তাদের মায়ের মতোই ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটছে! মা হয়তো এসব দৃশ্য কল্পনা করে স্থির থাকতে পারতেন না, তার কষ্ট হতো। আর তার কষ্ট ক্ষোভ হয়ে ঝরে পড়তো শিখার ওপর। দুজনে ঝগড়া লেগে যেতো।
দাদা গো, কখনো স্ত্রী আর মায়ের ঝগড়ার মধ্যে পড়েছেন? না পড়লে এর যন্ত্রণা বুঝবেন না। স্ত্রী আর মায়ের মধ্যে পড়ে আমার অবস্থা তখন জাঁতায় পেষা মটর ডাল!
আমি কীর্তন গেয়ে বাড়িতে ফিরলেই রাতের বেলা শুয়ে শুয়ে মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতো শিখা, আর শিখা অফিসে থাকলে ওর বিরুদ্ধে অভিযোগের ঝুড়ি খুলে বসতেন মা। আমি কোন পক্ষে যাব? আমি তো মাকে ভালবাসি, শিখাকেও। আমি তো দুজনের দোষ-ত্রুটির বিচার করতে চাইতাম না। আমি চাইতাম দুজনে মিলে-মিশে থাকুক। দুজনকেই বোঝাবার চেষ্টা করতাম। মাকে বোঝাতে গেলে মা ভাবতেন-আমি শিখার পক্ষে কথা বলছি, আবার শিখাকে বোঝাতে গেলে সে ভাবতো-আমি মায়ের হয়ে ওকালতি করছি! কী বিপদ!
লক্ষ্মীপূজা এলো, সেটা বিয়ের পর দ্বিতীয় লক্ষ্মীপূজা হলেও আমাদের বাড়িতে শিখার প্রথম লক্ষ্মীপূজা। আগের বছর লক্ষ্মীপূজায় শিখা ওর বাবার বাড়িতে ছিল, ও তখন ওখানেই চাকরি করতো, তাছাড়া ওর জ্বর হয়েছিল। আমাদের বাড়িতে শিখার প্রথম লক্ষ্মীপূজা, আমি বাড়িতেই ছিলাম, মা আর শিখার লক্ষ্মীপূজার প্রস্তুতি দেখে আমি বেশ খুশি ছিলাম। পাঁচ মাসের সন্তান পেটে নিয়েও শিখা পূজার কাজ করছিল। মা তখন বারান্দায় আলপনা আঁকছিলেন আর শিখা পূজার ঘরে কিছু একটা করছিল। আমি আমার ঘরেই ছিলাম। হঠাৎ আমাদের পাড়ার বিলাসের মায়ের গলা শুনতে পেলাম, ‘ও কিরে কানাই’র মা, ও কী কাণ্ড, তুই এক পাও আঁকতেছিস ক্যা?’
বিলাসের মায়ের প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম, মায়ের হতাশাপূর্ণ কণ্ঠ শুনতে পেলাম, ‘কী আর করবো তয়! মানষির বাড়ি লক্ষ্মী বউ আসে, তাই মানষি দুই পাও আঁকে। আর আমার বাড়ি তো আইচে এক পাওঅলা অলক্ষ্মী বউ। তাই এক পাও আঁকতেছি!’
মায়ের কথা শুনে আমি কী করবো বুঝতে পারছিলাম না, মায়ের ওপর কিছুটা অভিমান হলো, মনে হলো মা এই কাণ্ডটি না করলেই পারতেন। কিন্তু ওই যে বললাম আমার সাদাসিধা মা, লোকের উসকানিমূলক কথা বিশ্বাস করে আর বিলাস কি পলাশের মায়ের কাছে তার পরাজয় হয়েছে ভেবে কষ্ট পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে কখন কী কাণ্ড করে বসে তার ঠিক নেই! আমি শ্রীকৃষ্ণের কাছে আকুতি জানালাম, ‘হে শ্রীকৃষ্ণ, আজ এই লক্ষ্মীপূজার দিনে বাড়িতে যেন অশান্তি না হয়। শিখা যেন মায়ের কথা শুনতে না পায়, মায়ের আঁকা এক পায়ের আলপনা দেখতেও না পায়। শিখা দেখার আগেই আমি যে করেই হোক মায়ের হাতে-পায়ে ধরে আরেক পা আঁকাবো।’
আমি উঠে মায়ের কাছে যাবার আগেই জামবাটিতে কোনো কিছুর আঘাতে টুং আওয়াজ শুনতে পেলাম। তারপরই শুনতে পেলাম মায়ের আর্তচিৎকার, ‘আমার গায় হাত তুললি সর্বনাশী মাগি, তোর এক পাও তো খসেই পড়ছে, যেই হাত দিয়ে আমারে মারলি সেই হাতও খসে পড়বি!’
আমি দ্রুত ঘর থেকে বারান্দায় গিয়ে দেখলাম শিখা রণমূর্তির মতো বিস্ফারিত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে আর মা বাম হাত দিয়ে নিজের ডান হাত ধরে আছে। মায়ের ডান হাতের পাতার নুনছাল উঠে গেছে। নদীর ধারের ভেজা বালিতে একই জায়গায় বারবার পায়ের চাপ দিলে যেমনি মৃদু জলের আবাস পাওয়া যায়, তেমনি মায়ের নুনছাল ওঠা জায়গায় মৃদু রক্তের আভাস দেখতে পেলাম। মায়ের হাতে রক্ত দেখে আমি স্থির থাকতে পারলাম না। মা যতো অন্যায়-ই করুক তাই বলে শিখা তার গায়ে হাত তুলবে? এতো বড় সাহস শিখার! মা তখন কাঁদছে আর তার কপালকে দুষছে। আমার মাথাটা গরম হয়ে গেল, শিখার দিকে তেড়ে গেলাম, ‘শালির মাগি, তুই আমার মায়ের গায়ে হাত তুললি?’
বলেই আমি শিখার গলা ধরে ধাক্কা দিলাম। শিখা উল্টে পড়ে গেল সিঁড়ির ওপর, তারপর গড়িয়ে পড়লো উঠোনে। শিখা পড়েই রইলো, উঠলো না। বিলাসের মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘করলি কী হারামজাদা, পোয়াতি বউ!’
বলেই বিলাসের মা ভূপাতিত শিখার দিকে এগিয়ে গেল। একটু পর দেখি শিখার মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। আমি ভড়কে গেলাম, তাড়াতাড়ি গিয়ে ধরলাম শিখাকে। শিখার মাথাটা কোলে তুলে নিলাম। রক্তে ভেসে যেতে লাগলো আমার লুঙ্গি। মা’ও ছুটে এলো কাছে। আমি শিখাকে ডাকতে লাগলাম, শিখা কোনো সাড়া দিলো না। বিলাসের মা বললো, ‘তাড়াতাড়ি ভ্যান নিয়ে আয়, হাসপাতালে নিয়ে যা।’
শিখার মাথাটা মায়ের কোলে দিয়ে আমি দ্রুত ভ্যান নিয়ে এলাম, শিখাকে ভ্যানে তুলে নিয়ে গেলাম হাসপাতালে। হাসপাতালে শিখার চিকিৎসা চলতে লাগলো আর আমি বাইরে বসে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ডাকতে লাগলাম, ‘হে শ্রীকৃষ্ণ, সারাজীবন তো তোমাকেই ডেকে গেলাম, তোমার নাম সংকীর্তন করলাম, তোমার গুণগান গাইলাম, রাগের মাথায় একটা ভুল করে ফেলেছি, এখন তোমার কাছে ক্ষমা চইছি, শিখা সেরে উঠলে শিখার কাছেও ক্ষমা চাইবো, সত্যিই তুমি যদি ভগবান হও তবে আমার শিখাকে ভাল করে দাও।’
পরে বিলাসের মায়ের মুখে শুনেছি, শিখার ইচ্ছে ছিল না মায়ের হাতে আঘাত করার। মায়ের কথা শুনে ঘর থেকে বারান্দায় এসে শিখা এক পায়ের আলপনা আঁকা দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি, রেগে গিয়ে ক্র্যাচ দিয়ে চালের গুড়ার জামবাটিতে আঘাত করছিল, আর ওই সময় মাও হাত বাড়িয়েছিল চালের গুড়ার জামবাটিটা রক্ষার জন্য। দূর্ভাগ্যবশত ক্র্যাচের আঘাতটা প্রথমে মায়ের হাতে লাগে তারপর লাগে জামবাটিতে। আমারও ইচ্ছে ছিল না শিখাকে অতোটা জোরে ধাক্কা মারার, কিন্তু কিভাবে যে মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা, কিছুই যেন বুঝতে পারলাম না।
ফরিদপুর থেকে ডাক্তারের পরামর্শে অচেতন শিখাকে নিয়ে গেলাম ঢাকা মেডিকেলে; সেখানে একদিন, দুইদিন, তিনদিন গেল। আমি অপেক্ষায় রইলাম শিখার জ্ঞান ফেরার, শিখার চোখ খোলার। কিন্তু শিখার জ্ঞান ফিরলো না, শিখা আর কখনোই চোখ খুলে আমার দিকে চাইলো না।
ঢাকা।
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, ২০১৮।
১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ৯:০২
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
২| ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ২:১৮
রাজীব নুর বলেছেন: বিশাল পোষ্ট।
কিন্তু সুন্দর লেখা।
১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১০:৪৭
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা......
©somewhere in net ltd.
১| ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ৮:১১
মা.হাসান বলেছেন: অসাধারন লেখা।hats off