নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলাদেশে অমুসলিম নির্যাতন ও উচ্ছেদ: অলীক জ্বীন নাকি বাস্তবের অমসৃণ জমিন?

২৫ শে জুলাই, ২০১৯ রাত ৮:০১

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে সমালোচিত, নিন্দিত এবং ঘৃণিত নাম বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা। গত ১৬ জুলাই ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার ১৬টি দেশের ২৭ ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রিয়া সাহাও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান। প্রিয়া সাহা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলেন-

‘Sir, I’m from Bangladesh… 37 million Hindus, Buddhists and Christians are disappeared. Please help us – for the Bangladeshi people. We want to stay in our country.

18 million people of minority groups in Bangladesh. My request is, please help us, we don’t want to leave our country, just help us stay. I’ve lost my home, they’ve burned my home, they (have) taken away my land, but no judgement (has) yet (been) taken please, please…’

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রিয়া সাহাকে প্রশ্ন করেন, ‘Who took the land and home?’

প্রিয়া সাহা জানান, ‘The Muslim fundamentalist groups. Always they’re getting the political shelter, always.’ তথ্যসূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন; ২০ জুলাই, ২০১৯।

এই বক্তব্যের কারণে আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামায়াত, জঙ্গি, ছদ্ম জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক, ছদ্ম সাম্প্রদায়িক, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, নাট্যকার-নাট্য নির্দেশক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা, বুদ্ধিজীবী,সাংবাদিক, ছাত্র, আমলা কিংবা কেরানি; নানা শ্রেণিপেশার অধিকাংশ মুসলমানের কণ্ঠ এখন বাঁশেরকেল্লার সুরে কোরাস গাইছে-প্রিয়া সাহা দেশদ্রোহী, তিনি ট্রাম্পের কাছে নালিশ করে দেশের সম্মান নষ্ট করেছেন, দেশকে অপমানিত করেছেন, তার বিচার হওয়া উচিত, রিমান্ডে নিয়ে ডিম থেরাপী দেওয়া উচিত ইত্যাদি।

একটা শ্রেণি ভদ্রস্থ ভাষায় এসব বলছেন। এর বাইরে কোটি কোটি মুসলিম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অশালীন ভাষায় প্রিয়া সাহা এবং তার পরিবারকে আক্রমণ করছে, প্রিয়া সাহাকে ধর্ষণ পর্যন্ত করতে চাইছে। তাদের আক্রমণ থেকে বাদ যাচ্ছে না হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষও, গোটা হিন্দু সম্প্রদায়কে গালাগালি করা হচ্ছে, হিন্দুদের নাকি লাই দিয়ে পা থেকে মাথায় তোলা হয়েছে, দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পোষা হচ্ছে, হিন্দুদের ইতরপ্রাণীর সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে ইত্যাদি।

হিন্দুরা কারা? হিন্দুরা আরব থেকে আসেনি, তারা ভূমিপুত্র, এই মাটির সন্তান। তাদের তো স্বাধীন থাকার কথা, তাদের তো কারো অধীনস্থ থাকার কথা নয়। আর যদি অধীনস্থ থাকার কথা আসে, সাপ কিংবা কুকুরের মতো তাদেরকে পোষ্য হিসেবে ভাবা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তারা নির্যাতিত-নিপীড়িত। প্রিয়া সাহা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি এই ধরনের আচরণ এবং ভাষা প্রয়োগ করে মুসলিমরা এই সত্যটি আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করছে যে তারা সত্যিই নিপীড়ক এবং হিন্দুদেরকে তারা নির্যাতন করে।

সারাবিশ্বের ১৬ টি দেশের ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার যে ২৭ জন মানুষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেছেন, তারা ট্রাম্পের সঙ্গে নৈশভোজ করতে যাননি। তারা নিজের এবং নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের নিপীড়নের কথা বলতে গিয়েছেন। আইএস জঙ্গি কর্তৃক ধর্ষণের শিকার নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ইরাকের মানবাধিকারকর্মী ইয়াজিদী সম্প্রদায়ের নাদিয়া মুরাদ তার এবং তার সম্প্রদায়ের ওপর ঘটা নির্যাতনের কথা ট্রাম্পকে বলেছেন। এছাড়াও পাকিস্তানী আহমদীয়া, জার্মান ইহুদি, চীন, ভিয়েতনামের প্রতিনিধিরা তাদের নির্যাতন ও নিপীড়নের কথা বলেছেন। আমার মনে হয় না কাউকেই প্রিয়া সাহার মতো সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এবার প্রিয়া সাহার বক্তব্যের প্রসঙ্গে আসি। প্রিয়া সাহার বক্তব্য থেকে আমরা চারটি বিষয় বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে পারি।

১. বাংলদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানদেরকে নির্যাতন করা হচ্ছে

২. বাংলাদেশ থেকে ৩৭ মিলিওন মানুষ অদৃশ্য, অর্থাৎ উচ্ছেদ বা দেশান্তরিত

৩. মুসলিম মৌলবাদীরা এই নির্যাতন এবং উচ্ছেদ করছে

৪. প্রিয়া সাহার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে

প্রিয়া সাহার বক্তব্যের চিহ্নিত এই চারটি বিষয় কি মিথ্যা? তিনি কি সত্যিই দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছেন ব্যক্তিস্বার্থে কিংবা কোনো বিদেশী শক্তির মদতে? তার বক্তব্যে কি কোনো সত্যই নেই? আসুন আমরা একটু তথ্য-উপাত্তসহ বিশ্লেষণ করে দেখি প্রিয়া সাহার বক্তব্যের সত্য-মিথ্যা।

১. বাংলদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানদেরকে নির্যাতন করা হয়

বাংলাদেশে কি সত্যিই হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানদেরকে নির্যাতন করা হয়, নাকি হয় না? আসুন দেখি বাংলাদেশের বিশিষ্টজনেরা কী বলেন-

২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি নাগরিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও’ রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ করো, আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াও’ শীর্ষক এক নাগরিক সভার আয়োজন করে। সেখানে সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘‌‌‌সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বন্ধে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে। নাগরিক সমাজকে সম্মিলিতভাবে নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বাংলাদেশ অনেক দূরে সরে এসেছে। সাম্প্রদায়িক নির্যাতন নতুন নতুন চেহারা নিচ্ছে। ২০০১ সালে নির্বাচন-উত্তর সহিংসতা নিয়ে সরকার যে কমিটি গঠন করেছিল, সেই কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী বলেন, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান আমরা সবাই বাঙালি, এই কথা শুধু পোস্টারেই থেকে গেল, বাস্তব হলো না।’

একই সভায় কবি সৈয়দ শামসুল হক বলেন, ‘নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেই অনেক সভা হয়, মানববন্ধন হয়, প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়, কিন্তু সংখ্যালঘুদের মনে সাহস জাগানো হয় না। সংখ্যালঘু নির্যাতনের পেছনে রাজনীতি, অর্থনীতিসহ কয়েকটি বিষয় কাজ করে।’

আয়োজক সংগঠনের অন্যতম আহ্বায়ক ডা. সারওয়ার আলী বলেন, ‘মূলত সম্পত্তি দখল ও ভোটব্যাংক ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করা হয়। যারা নির্যাতন করে তাদের বিচার হয় না। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বন্ধের পাশাপাশি বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেন, ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা প্রতিকারহীন পরাভব মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশকে হিন্দুদের জন্য ভয়ের জনপদ তৈরি করা হয়েছে। সামগ্রিক ঔদাসিন্য এবং একের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর সংস্কৃতি বাংলাদেশকে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে।’

তথ্যসূত্র: প্রথম আলো; ১৩ জানুয়ারি, ২০১৪।



২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিষ্টিটিউশনে ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি’র আয়োজনে ‘‌‌‌নির্বাচনকালে সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে আইনের সংস্কার’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত আলোচনা সভায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‌‘বর্তমান সরকারের সময় রাষ্ট্রীয় মদদে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়নি। তাই বলে আমি বলব না যে নির্যাতন হয়নি, হয়েছে ব্যক্তি স্বার্থে। এই নির্যাতন কিভাবে বন্ধ করা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যারা এই দেশে থেকে অন্য দেশের ভাবনা ভাবে তাদের বিষয়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে।’

স্বাগত বক্তব্যে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘নির্বাচন এলেই সংখ্যালঘু নির্যাতন হবে এটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। তাদের বিচার না হওয়াতে নির্যাতন করতে তারা ভয় পায় না। আর এই বিষয়গুলো সমাজ ও পাত্তা দেয় না। যার ফলে বছরের পর বছর মামলা চলে। সংখ্যালঘু বলে তাদের কি বেচে থাকার অধিকার নাই। আমরা চাই এমন ঘটনা আর সামনে না ঘটুক এবং আইন করে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেয়া হোক।’

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলেও আমাদের সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা নেই। নির্বাচনের আগে কোনো ঘটনা ঘটলে তার বিচার হয় না। নির্বাচনকালীন সময় সংখ্যালঘু নির্যাতন হয় তাহলে সন্ত্রাস দমন আইনে বিচার করতে হবে।’

তথ্যসূত্র: আমাদের সময়; ২০১৮।



২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর বেসরকারি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) এর আয়োজনে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বিশ্ব মানবাধিকার বনাম বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত। প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, ‘গত পাঁচ দশকে আনুমানিক ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী দেশান্তরিত হয়েছেন। সে হিসেবে গড়ে বছরে দেশ ছেড়েছেন ২ লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন। দেশে ৫০টিরও বেশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আদিবাসী পরিচয়ে সাংবিধানিক স্বীকৃতি মেলেনি। বাংলাদেশে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমছে। সত্তরের দশকে এ দেশে ২০ দশমিক ১ শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। ২০১১ সালে সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে।’

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তির অনেকগুলোর অগ্রগতি হলেও চুক্তির মূল বিষয় ভূমি অধিকারের অগ্রগতি নেই। শাস্তি যদি দৃশ্যমান না হয়, বিচারহীনতার ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বে আমরা প্রশংসিত হচ্ছি। কিন্তু সংখ্যালঘুদের বিতাড়নের চেষ্টা করে সেই দোষে দোষী হচ্ছি কি না।’

তথ্যসূত্র: প্রথম আলো; ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৭।



৯ জানুয়ারি ২০১৮ সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকার সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তো আরও আতঙ্কের মধ্যে থাকে। ভোট দিলেও তারা অত্যাচারিত হয়, না দিলেও।’

সুলতানা কামাল ব্যাতিত এই বুদ্ধিজীবীদের সকলেই আওয়ামীলীগ ঘরানার। যারা আওয়ামীলীগের নানা রকম অপকর্ম যেমন-ভোট ছিনতাই, গুম, বিচারবহির্ভুত খুন, চাঁদাবাজি,ব্যাংক লুণ্ঠ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে প্রায় নীরব থেকেছেন বা থাকেন এবং আওয়ামীলীগের কাছ থেকে নানা রকম নিয়েছেন বা নেন। কিন্তু সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে তারাও মুখ খুলেছেন। এরা কি মিথ্যা বলেছেন? যদি মিথ্য বলে থাকেন, তাহলে আওয়ামীলীগ সরকার কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি? করেনি এজন্যই যে বাংলাদেশে অমুসলিম নির্যাতনের ঘটনা দিনের আলোর মতোই সত্য।

আসুন এবার দেখি বাংলাদেশে অমুসলিম নির্যাতনের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী বলেছেন-

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যশোরের অভয়নগরের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর মুসলিম মৌলবাদীরা হামলা চালায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৩ জানুয়ারি নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় যশোরের অভয়নগর উপজেলার মালোপাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। বিকেলে যশোরের অভয়নগর উপজেলার শংকরপাশা মাধ্যমিক স্কুলের মাঠে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অভয়নগরের মানুষের অপরাধ কী? তারা ভোট দিতে গেছে। সেটা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। সেজন্য তাদের ওপর যে অত্যাচার, নির্যাতন চলেছে, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।’

প্রধানমন্ত্রী হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা এ মাটির সন্তান। আপনারা এই এলাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাববেন না। আপনারা মনে জোর নিয়ে, নিজেদের অধিকার নিয়ে বাঁচবেন।’

এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি মুখে বলেন যে কেউ ভোট দিতে যায়নি। তাহলে ভোট দিতে যাওয়ার অপরাধে এই জুলুম-নির্যাতন কেন?’

তথ্যসূত্র: প্রথম আলো; ২৩ জানুয়ারি, ২০১৪।



২০১৮ সালের ২০ জুলাই তৎকালীন স্বাস্থ্য মন্ত্রী এবং আওয়ামীলীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের মেলাঙ্গনে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে হিন্দুদের উদ্দেশে বলেন- ‘শেখ হাসিনা যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন আপনারা নিরাপদে থাকবেন। কারণ যে কোনো সমস্যা নিয়ে আপনারা আমাদের সাথে এসে কথা বলতে পারেন। আমরাও আপনাদের সকল ধরনের সহযোগিতা করে থাকি। দেশের জনগণ ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াবহতা দেখেছে— ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়লাভের পর তারা কীভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্মম অত্যচার ও নির্যাতন চালিয়েছে। দেশের মানুষ সেই ভয়াবহতা আর দেখতে চায় না। তাই আগামী নির্বাচনে দেশের মানুষ আবারও আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করবে।’

তথ্যসূত্র: প্রথম আলো; ২০ জুলাই ২০১৮



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং মোহাম্মদ নাসিমের বক্তব্যে প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশে অমুসলিমদের ওপর নির্যাতন হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অনেক আওয়ামীলীগ নেতা এবং বুদ্ধিজীবী বিএনপি-জামাতের ক্ষমতায় থাকার সময়ে অমুসলিম নির্যাতনের কথা বহু সভা-সমাবেশ বা সেমিনারে বলেছেন। দিনাজপুরের পূর্ণিমা শীলের গণধর্ষণের ঘটনাকে আওয়ামীলীগ রাজনৈতিক ইস্যু করে ফায়দা লুটেছে। ইন্টারনেটে সার্চ দিলেই সে-সব তথ্য পাওয়া যাবে।

সুতরাং ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানদের নির্যাতনের বিষয়ে প্রিয়া সাহা যা বলেছেন তা মিথ্যে নয়, সত্য।



২. বাংলাদেশ থেকে ৩৭ মিলিওন মানুষ অদৃশ্য, অর্থাৎ উচ্ছেদ বা দেশান্তরিত

প্রিয়া সাহা বলেছেন বাংলাদেশ থেকে ৩৭ মিলিওন মানুষ অদৃশ্য, অর্থাৎ উচ্ছেদ বা দেশান্তরিত। এই সংখ্যাটি নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ মানুষ যে দেশান্তরিত হয়েছে, এই সত্য কি অস্বীকার করা যাবে? আসুন একটু তথ্য-উপাত্ত দিয়ে মিলিয়ে দেখি-

২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাত ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তাতে দেখা যায় যে, প্রতিদিন গড়ে ৬৩২ জন হিন্দু দেশ ছাড়ছেন, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী দু-তিন দশকের মধ্যে দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়ে যাবে৷ গবেষণা প্রবন্ধটিতে আরো দেখা যায়- ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এক কোটি ১৩ লাখ হিন্দু দেশ ছেড়েছেন৷ বিভিন্ন সময়কালে প্রতিদিন গড়ে নিরুদ্দেশ হওয়া হিন্দুদের সংখ্যা সমান নয়, ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ – এই ৭ বছর প্রতিদিন নিরুদ্দেশ হয়েছেন ৭০৫ জন হিন্দু, ১৯৭১ থেকে ১৯৮১ – এই ১০ বছর নিরুদ্দেশের হার ৫২১ জন, ১৯৮১ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত প্রতিদিন নিরুদ্দেশ হন ৪৩৮ জন, ১৯৯১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত প্রতিদিন ৭৬৭ হিন্দু দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন আর ২০০১ থেকে ২০১২ পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৬৭৪ জন হিন্দু দেশ ছেড়েছেন৷ পুরোটার গড় করে তিনি ৬৩২ জনের হিসাব দাঁড় করিয়েছেন৷

তথ্যসূত্র: ডয়চে ভেলে; ১২ নভেম্বর, ২০১৮।



১৯৪৭ সালে দেশে মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ ছিল হিন্দুধর্মাবলম্বী৷ ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২২ ভাগ, ১৯৬১ সালের আদমশুমারিতে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৫ ভাগ, ১৯৭৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী হিন্দু ছিল ১৩ দশমিক ৫ ভাগ, ১৯৮১ সালের আদমশুমারিতে সেই সংখ্যা হয় ১২ দশমিক ১ ভাগ, ১৯৯১ সালে ১০ দশমিক ৫ ভাগ, ২০০১ সালে ৯ দশমিক ২ ভাগ আর ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৫ ভাগ হিন্দু৷

তথ্যসূত্র: ডয়চে ভেলে; ১২ নভেম্বর, ২০১৮।



উপরোক্ত তথ্যের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি যে বাংলাদেশে অমুসলিমদের সংখ্যা কমে গেছে। প্রিয়া সাহার তথ্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও এটাই সত্য যে বাংলাদেশ থেকে অমুসলিমদের উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সঠিক সংখ্যাটি হয়তো আবুল বারকাতের পরিসংখ্যানের চেয়েও বেশি।

৩. মুসলিম মৌলবাদীরা এই নির্যাতন এবং উচ্ছেদ করছে

বাংলাদেশে অমুসলিমদের ওপর হামলা করেছে কারা? এক মুহূর্ত না ভেবে বলা যায়-মুসলিমরা। আরও নির্দিষ্ট করে বলা যায় সুন্নি মুসলিমরা।

১৯৯২ সালে ভারতের অয্যোধ্যার বাবরি মসজিদে হিন্দু মৌলবাদীদের হামলার কারণে বাংলাদেশে হিন্দুদের ঘর-বাড়িতে হামলা-খুন-ধর্ষণ করেছিল বাংলাদেশের মৌলবাদী মুসলিমরা।

২০১২ সালে গুজব ছড়িয়ে কক্সবাজারের রামু, উখিয়া এবং আরো কয়েকটি জায়গায় বৌদ্ধদের মন্দির এবং বসতবাড়িতে হামলা চালিয়েছিল মুসলিম মৌলবাদীরা।

২০১৩ সালে ফেসবুকে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে পাবনার সাঁথিয়ায় হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বসতবাড়িতে হামলা চালিয়েছিল মুসলিম মৌলবাদীরা।

২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে রসরাজের নামে ফেসবুকে ফেক আইডি খুলে কারা পোস্ট করেছিল কিংবা কারা পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছিল নাসিরনগরের হিন্দুদের ওপর তা আজ আর কারো অজানা নয়, মুসলিমরা।

২০১৭ সালে ফেসবুকে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে রংপুরের ঠাকুরপাড়া গ্রামে হামলা চালিয়েছিল মুসলিম মৌলবাদীরা।

২০১৭ সালে রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলায় আদিবাসী পাহাড়ীদের ওপর হামলা এবং ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বাঙালী সেটেলার মুসলিমরা।

এগুলো হলো বড় ধরনের হামলা। এর বাইরেও প্রায় সারাবছরই অমুসলিমদের ওপর মুসলিম মৌলবাদীদের হামলা, খুন, ধর্ষণ, জমি দখল চলতে থাকে। পাহাড়ে সারা বছরই রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী এবং সেটেলার মুসলিমরা আদিবাসীদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালায়।

২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটিতে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের করা ‘বাংলাদেশের সংখ্যালঘু পরিস্থিতি-২০১৬’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সালে মোট ৭৭টি মন্দিরে হামলা-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে ১৫টি। ধর্ষণের শিকার হয় ১৭ জন। এ ছাড়া অপহৃত ২৮ ব্যক্তির সঙ্গে নিখোঁজ হয়েছে ২৪ জন। একই সঙ্গে বসতবাড়ি ও জমিজমা দখলের হাজার খানেক ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩ হাজারের মতো। তথ্যসূত্র: প্রথম আলো; ১৩ জানুয়ারি, ২০১৭।

২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট লিখিত বক্তব্যে জানায়,২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং হিন্দু মহাজোটের জেলা ও থানা পর্যায়ের নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ১৭৯২টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ব্যক্তি, পরিবার, প্রতিষ্ঠান ও মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যার সংখ্যা কমপক্ষে ৫০ হাজার। এছাড়া ২৭৩৪ দশমিক ৮১ একর ভূমি দখল হয়েছে।

অমুসলিমদের ওপর হামলা প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদার বক্তব্য,‘রক্ষণশীল হিসেবে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে শাসকশ্রেণি ও তাঁদের প্রতিনিধিরা জমিজমা দখলের আশায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলায় ইন্ধন জোগান এবং পৃষ্ঠপোষকতা করেন।’

৪. প্রিয়া সাহার নিজের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে

হ্যাঁ, প্রিয়া সাহার নিজ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে মিথ্যা বলেননি তিনি। তার বাড়িতে হামলার পর বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ বিভিন্ন জায়গায় মানববন্দন করে। সেই মানববন্ধনের নিউজ প্রকাশিত হয় বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে। ‌‘প্রিয়া সাহার বাড়িতে অগ্নি সংযোগ’ এই চারটি শব্দ গুগলে লিখে সার্চ দিয়ে এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করা যায়।

তাহলে প্রিয়া সাহা মিথ্যা বললেন কোথায়? প্রিয়া সাহা মিথ্যা বলেননি, তিনি সত্য বলেছেন, যে সত্যটি বাংলদেশের ক্ষমতাসীন শাসক, সাংবাদিক এবং নানা শ্রেণি-পেশার অধিকাংশ মুসলিম সবসময় লুকোতে চায়। অমুসলিমদের নির্যাতনের বিষয়টি লুকিয়ে তারা বাংলাদেশের গায়ে অসাম্প্রদায়িকতার এক মিথ্যে আলখাল্লা পরিয়ে রাখতে চায়। প্রিয়া সাহা এই মিথ্যে আলখাল্লা ধরে টান দিয়েছেন, তাতেই বাংলাদেশের নানা শ্রেণির তথাকথিত দেশপ্রেমিক মুসলিমরা চিৎকার শুরু করেছেন দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অজুহাতে, বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের সম্মান নষ্ট করার অপরাধে! কিন্তু কেন আজ এই পরিস্থিতি তৈরি হলো? স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক হতে চললো, এই পাঁচ দশকে বারবার সরকার পরিবর্তিত হয়েছে। তবু কেন কোনো সরকার অমুসলিম নির্যাতন বন্ধ করতে পারলো না? ধারাবাহিকভাবে যখন অমুসলিমদের ওপর হামলা চালানা হয়েছে, আজও হচ্ছে; তখন এই তথাকথিত দেশপ্রেমিক মুসলিমরা চুপ করে ছিল, আজও কোথাও অমুসলিমদের ওপর হামলা হলে খুব বেশি শোরগোল হয় না। একই ভাষার, একই সংস্কৃতির ভিন্ন ধর্মের কোনো পড়শি উগ্র মুসলিমের দ্বারা আক্রান্ত হলে তথাকথিত দেশপ্রেমিক মুসলিমরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে, অনেকে ব্যাপারটা উপভোগ করে, কিন্তু হাজার হাজার মাইল দূরের গাজা উপত্যকায় ইজরায়েলি সেনা একটা গুলি চালালেই এই তথাকথিত দেশপ্রেমিক মুসলিমদের হৃদয় বিদীর্ণ হয়, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়!

যখন গাজার কোনো মুসলিম পশ্চিমাদেশের নেতাদের কাছে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, যখন ভারতের কোনো মুসলিম পশ্চিমাদেশের নেতাদের কাছে হিন্দু মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় তখন মুসলিম বিশ্বে এবং বাংলাদেশে তারা বীরের মর্যাদা পায়, জাকির নায়েকের মতো উগ্র মুসলিম যখন ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলে কিংবা উগ্রবাদ ছড়ায় তখন বাংলাদেশে তার জয়জয়াকার করা হয়। কিন্তু প্রিয়া সাহা যখন ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশে দশকের পর দশক ধরে চলা অমুসলিম নির্যাতনের কথা বললো, তখন সে নিন্দিত-ঘৃণিত হলো তথাকথিত দেশপ্রেমিক মুসলিমদের কাছে।

অনেকেই বলছেন আমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বলা উচিত হয়নি, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রীকে বললে সংকটের সমাধান হয়? প্রধানমন্ত্রী জানেন না যে বাংলাদেশে অমুসলিমদের নির্যাতন ও উচ্ছেদ করা হয়? তিনি জানেন না যে তার দলের নেতাকর্মীদের একটা অংশ এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ষোল বছর বাংলাদেশ শাসন করেছেন, এখনো করছেন, কম সময় নয়। কিন্তু তিনি কি অমুসলিম নির্যাতন বন্ধ করতে পেরেছেন? পারেননি। বরং তার দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ আছে অমুসলিমদের বাড়ি-সম্পত্তি দখলের। আর বর্তমান সময়ে শরণার্থী সমস্যা কোনো আভ্যন্তরিণ বিষয় নয়, এটা আন্তর্জাতিক সমস্যা। মিয়ানমার থেকে দশ-বারো লক্ষ রোহিঙ্গা দেশান্তরিত হওয়া যেমনি আন্তর্জাতিক সমস্যা, তেমনি বাংলাদেশ থেকে কোটির অধিক অমুসলিম দেশান্তরিত হওয়াও আন্তির্জাতিক সমস্যা। স্বাধীনতার পর প্রায় পাঁচ দশকেও যখন বাংলাদেশে অমুসলিম নির্যাতন বন্ধ হয়নি, তখন সময় এসেছে বিষয়টি আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে ধরার। বাংলাদেশের অমুসলিম নির্যাতন সম্পর্কে সকল তথ্য এখন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতাদেরকে, জাতিসংঘকে এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাকে জানাতে হবে। কার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হলো বা না হলো তা দেখার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশে মুসলিমদের জন্য যা ভাবমূর্তির সংকট, অমুসলিমদের জন্য তা জীবন-মরণের।

বাংলাদেশের শাসক এবং তথাকথিত দেশপ্রেমিক মুসলিমরা চায় না তাদের অমুসলিম নির্যাতনের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে আসুক, তাহলে তাদের মেকি মানবতাবাদী চেহারার কঙ্কাল বেরিয়ে আসবে। দশ-বারো লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ এরই মধ্যে মেকি মানবতাবাদী সেজে বসে আছে। নিজের ঘরের মানুষকে নির্যাতন করে পরের মানুষের মাথায় হাত বুলানোর মধ্যে কোনো মানবতাবাদ নেই। বাংলাদেশ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে জানাতে চায় যে মিয়ানমার কতো খারাপ, মিয়ানমার তাদের দশ-বারো লাখ মুসলিম নাগরিককে তাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ নিজের দেশের অমুসলিমদের চুপিসারে দেশ ছাড়তে বাধ্য করছে। বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার, এই দুই দেশই নাগরিক উচ্ছেদ করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে এবং এখনো করছে। অথচ মিয়ানমার বিশ্ববাসীর কাছে ধিকৃত হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ হয়নি। এর কারণ বাংলাদেশের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং মিয়ানমারের মাথামোটা নীতি। মিয়ানমার একযোগে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়েছে, ফলে বিষয়টা বেশি ফোকাস হয়েছে। আর বাংলাদেশের নীতি হলো, বিচ্ছিন্নভাবে অমুসলিমদের ওপর আক্রমণ করো, জমিজমা দখল করো, চাঁদা দাবি করো, মেয়ে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করো; তাহলে এক সময় বাধ্য হয়েই অমুসলিমরা দেশ ছাড়বে। কেননা, অমুসলিমরা দূর্বল, চাপাতির বিরুদ্ধে রামদা ধরতে জানে না!

পাকিস্তান আমলের কথা বাদ-ই দিলাম স্বাধীন বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ দশক ধরে অমুসলিমদের ওপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে, কোনো অমুসলিম দেশ যদি মুসলিম দেশের ওপর এমন নির্যাতন চালাতো, তাহলে সেই মুসলিমদের মধ্যে অন্তত পাঁচটি জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হতো, যারা পাল্টা রক্তপাত ঘটাতো। বাংলাদেশের অমুসলিমরা সেই পথ বেছে নেয়নি, হয়তো তাদের তথাকথিত ঈশ্বর প্রদত্ত কোনো গ্রন্থ নেই বলে!

ব্যাপারটা এমন নয় যে প্রিয়া সাহা-ই প্রথম বাংলাদেশের কোনো বিষয় নিয়ে কোনো বিশ্ব নেতার কাছে নালিশ করেছেন। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আমলে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি উভয় দলই আন্তর্জাতিক স্তরে নালিশ করেছে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর অমুসলিম এবং আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন করে, সেই সময় ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরকে গ্রেফতার করা হয় বিএনপির নির্যাতনের বিষয়ে ডকুমেন্টারি বানিয়ে বিদেশীদের হাতে তুলে দেবার অভিযোগে। শাহরিয়ার কবির যখন বিএনপির নিপীড়নের বিষয়ে করা ডকুমেন্টারি বিদেশীদের কাছে তুলে দেন, তখন দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে উল্লেখ করে কোনো প্রতিবাদ করেনি আওয়ামীলীগ, বরং তাতে মদত দিয়েছে। প্রিয়া সাহা ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশের অমুসলিম নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরায় আওয়ামীলীগ এখন ভাবমূর্তি নিয়ে খুবই চিন্তিত, কেননা এখন তারা শাসকের ভূমিকায়। ক্ষমতায় থাকলে স্বৈরাচারী আর বিরোধী দলে থাকলে মানবতাবাদী! আসলে বাংলাদেশের সব শাসকই অমুসলিম নির্যাতনের বিষয়টি অস্বীকার করে, লুকিয়ে রাখতে চায়।

আওয়ামীলীগ বিরোধী দলে থাকার সময় বহুবার বহু দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তি এবং জাতিসংঘের কাছে নালিশ করেছে বিএনপি সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে। একইভাবে বিএনপিও আওয়ামীলীগ সরকারের গুম,খুন,দমন-পীড়ন সম্পর্কে নালিশ করেছে বিদেশীদের কাছে। ২০১৮ সালেও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জাতিসংঘে গিয়ে আওয়ামীলীগ সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে এসেছে।

তখন দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়নি? তখন কোথায় ছিলেন তথকাথিত দেশপ্রেমিক মুসলিমরা? আমি তথাকথিত দেশপ্রেমিক বলছি এজন্য যে এদের বিরাট অংশ আজও পাকিস্তানীদের প্রেমে বুঁদ হয়ে আছে পাকিস্তান কর্তৃক ত্রিশ লক্ষ মানুষ হত্যা এবং দুই লক্ষ নারীকে ধর্ষণ করার ইতিহাস জেনেও। এই তথাকথিত দেশপ্রেকিরা যখন নিজেদের গালে পাকিস্তানী পতাকা এঁকে স্টেডিয়ামে পাকিস্তানী পতাকা উড়ায় তখন দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় না, তখন আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয় না? মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা উড়ানো হয় না বা জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না জেনে যখন এই তথাকথিত দেশপ্রেমিকরা মাদ্রাসার এমন আচরণের পক্ষেই ছাফাই গায় তখন তাদের দেশপ্রেম প্রশ্নবিদ্ধ হয় না? জাতীয় পতাকার ওপর দাঁড়িয়ে কোনো অর্বাচীনকে নামাজ পড়তে দেখেও তাকে পবিত্র কাজ মনে করায় দেশপ্রেম প্রশ্নবিদ্ধ হয় না? এই তথাকথিত দেশপ্রেমিকদের বিরাট অংশই কিন্তু একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার চায়নি, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার চায়নি! অধিকাংশ মুসলিমের কাছে দেশপ্রেম নয়, ধর্মই প্রাধান্য পায় সবার আগে। এই যে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে সবাই, এর কারণ দেশপ্রেম নয়, ধর্ম।

প্রিয়া সাহা যেমনি বাংলাদেশে অমুসলিম নির্যাতনের কথা কোনো বিদেশী রাষ্ট্রনেতার কাছে জানিয়েছে, আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি-জামায়াত জোটও একে-অপরের বিরুদ্ধে বিদেশীদের কাছে নালিশ করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করতে বিএনপি-জামায়াত বিশ্বব্যাপী অপতৎপরতা চালিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য বন্ধ করার জন্য আওয়ামীলীগের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ এসেছে। তখন বিএনপি-জামায়াতকে সমর্থন করেছে দেশের কোটি কোটি মানুষ, তখন দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়নি? তখন হৃদয়ে দেশপ্রেমের ভাটা চলছিল?

১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানীদের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বিশ্ববাসীর কাছে নির্যাতন-নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরে সাহায্য চাইছিলেন, তখনও এই দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদকে দেশদ্রোহী বলেছিল, আর দেশদ্রোহী হিসেবে বঙ্গবন্ধু তো কারাগারেই ছিলেন।

কোনো গোষ্ঠীর ওপর ধারাবাহিকভাবে চলা অন্যায়, নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ করতে বিশ্ববাসীর সাহায্য চাওয়া দেশদ্রোহিতা নয়।এটাকে যদি দেশদ্রোহিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীনকেও দেশদ্রোহী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এই যে বাংলাদেশে সকল শ্রেণির অধিকাংশ মুসলিমদের মাঝে হঠাৎ সুনামির মতো দেশপ্রেম চাগাড় দিয়ে উঠেছে, অমুসলিম নির্যাতন ও উচ্ছেদের মতো একটি সত্যকে চাপা দিতে চাইছে সকলে, মিডিয়াগুলো সরকার এবং দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য সত্য চাপা দিয়ে (সত্য কি চাচা থাকে? সব তথ্য আছে অনলাইনে-ইউটিউবে) প্রিয়া সাহাকে মিথ্যাবাদী বানানোর চেষ্টা করছে, দিনশেষে এতে লাভবান হয়েছে এবং পুলক অনুভব করছে জামায়াত-হেফাজতসহ অতি উগ্র মুসলিম গোষ্ঠী, যারা বাংলাদেশেকে একটি ইসলামী রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্ন দ্যাখে। মধ্যপন্থী মুসলিমদের কাছ থেকে এরা এখন এই সার্টিফিকেট পেয়ে গেল যে বাংলাদেশে অমুসলিমদের নির্যাতন করা হয় না। এরা এখন বিপুল উদ্যমে অমুসলিমদের নির্যাতন ও উচ্ছেদ করবে, কেননা এরা জেনে গেছে যে এদের অপরাধ আড়াল করার জন্য রয়েছে বাংলাদেশের শাসক, মিডিয়া এবং কোটি কোটি মধ্যপন্থী মুসলিম। অমুসলিমদের জন্য বাংলাদেশের অমসৃণ জমিনে আরও খানা-খন্দ সৃষ্টি হবে!



ঢাকা।

জুলাই, ২০১৯

মন্তব্য ০ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.