নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

রানি

১২ ই এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৪:৪০

কিছু মানুষকে রানি ভীষণ ভালবাসে, আবার কিছু মানুষের ওপর ওর বড্ড রাগ। এই মানুষ জাতটার চরিত্র বড়ো বিচিত্র মনে হয় রানির; কেউ ওকে আর ওর বাচ্চাদের আদর করে ভাত খাওয়ায়, কেউ দোকান থেকে পাউরুটি কিংবা বিস্কুট কিনে খাওয়ায়, মাংসের দোকানের মধ্যবয়সী কসাই লোকটা রোজই নাড়ি কিংবা ছোট্ট মাংসের টুকরো খেতে দেয়; আবার কেউ অকারণে রানিকে আর রানির বাচ্চাদেরকে মারে, কেউ পথ চলতে চলতে ওদের পেটে লাথি ঝাড়ে, কেউ ঢিল ছুড়ে মারে গায়ে, কেউ গামলার গরম জল ছুড়ে গা পুড়িয়ে দেয়, কেউ লাঠি দিয়ে আঘাত করে, আরো নৃশংস স্বভাবের কেউ কেউ ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপও মারে!

একজন বাউল ওদেরকে প্রায়ই ভাত খাওয়ান, তিনিই ওর নাম দিয়েছেন রানি, প্রথম প্রথম রানি বুঝতে পরত না যে তাকে রানি বলে ডাকছেন তিনি, পরে রানি বুঝে গেছে যে বাউল তাকেই রানি বলে ডাকছেন। এখন রানি বলে ডাকলেই সে ছুটে যায় বাউলের কাছে, হাত-পায়ের গন্ধ শোকে, চাটেও। বাউল আসা-যাওয়ার পথে অন্যদের অনুরোধে প্রায়ই চায়ের দোকানে বসে দোতারা বাজিয়ে গান করেন। সারাদিন গাড়ির হর্ন, রিক্সার বেল, অসংখ্য মানুষের হাউ-কাউ আর খিস্তি-খেউড় শোনা একঘেয়ে কান দুটো যখন বাউলের গান শোনে, তখন কিছু বুঝুক বা না বুঝুক রানি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে বাউলের দিকে, ওর ভাল লাগে, অন্যরকম অনুভূতি হয়।

গেল ভাদ্র মাসে বাউণ্ডুলে স্বভাবের একটা মরদ কুকুর এসেছিল মহল্লায়, বেশ স্বাস্থ্যবান আর দেখতেও সুন্দর, সাদা আর বাদামী তার গায়ের রঙ, রানির সাথে বেশ ভাব-ভালবাসা হয়েছিল, কিছুদিন ছিল একসাথে, তারপর একদিন কোথায় যে চলে গেল! নাকি কোনো মানুষ মেরে ফেলল? জানে না রানি। তবে মেরে ফেলাটা অস্বাভাবিক নয়, কোনো কোনো মানুষ বড়ো হিংস্র স্বভাবের হয়, ওরা নিজেরাই নিজেদের মেয়ে ফেলে, আর সে-তো ছিল রাস্তার কুকুর। কেউ কেউ খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়েও মেরে ফেলে, তা জানে রানি। রানির মাকে সেভাবেই কেউ মেরেছিল! যন্ত্রণায় মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে, মুখ দিয়ে ফ্যানা উঠে, চোখের জল ঝরিয়ে মা তার মরে যায় তারই চোখের সামনে।

বাউণ্ডুলেটা নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার পর রানির খুব মন খারাপ হয়েছিল, তারপর রানির মন ভাল হয় তখন, যখন সে নিজের ভেতরে নতুন প্রাণের অস্তিত্ব টের পায়! রানির সে কী খুশি, ওর শরীরের ভেতরে নতুন প্রাণগুলো ক্রমশ বড়ো হচ্ছিল, যত বড়ো হচ্ছিল, রানির চলাফেরার গতি তত শ্লথ হচ্ছিল, হেলে-দুলে হাঁটত রানি। বাউল লোকটা বুঝেছিল যে রানির বাচ্চা হবে, তাই ওকে বেশি বেশি খাওয়াত তখন। রানি জায়গা খুঁজতে শুরু করে যে কোথায় বাচ্চার জন্ম দেবে সে। বাজারটার ভেতরে কিংবা রাস্তায় বাচ্চা জন্ম দেবার জন্য নিরাপদ মনে করে না সে। রানি জায়গা খুঁজতে থাকে এদিকে-সেদিকে, শেষ পর্যন্ত গলিটার ভেতরের দিকে নতুন বাড়ি নির্মাণ করা হবে বলে যে পুরোনো বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়েছে সেই খালি জায়গা বাচ্চা জন্ম দেবার জন্য নির্বাচন করে রানি। বাজারে, চায়ের দোকানে কিংবা আশপাশে খুঁটে খুঁটে খায় রানি; আর এসে বিশ্রাম করে নতুন নির্বাচন করা জায়গাটিতে। কার্তিক মাসের মাঝামাঝি রেশমের কাপড়ের ছোট্ট পুটলির মতো চারটে বাচ্চা হয় রানির। রানির সে কী আনন্দ! চেটে চেটে আদর করে বাচ্চাগুলোর গা পরিষ্কার করে ফেলে। এরই মধ্যে শীত পড়তে শুরু করায় শীতল বাতাসে বাচ্চাগুলো শীতে কুঁই কুঁই করতে শুরু করে। খোলা জায়গাটাতে খুব বাতাস লাগে। রানি দিনের বেলায় ছেড়া ন্যাতা, পলিথিন, কাজজের ঠোঙা মুখে করে এনে মাটিতে বিছিয়ে তার ওপর বাচ্চাগুলোকে রাখে, যাতে শীত একটু কম লাগে। কয়েকদিন পর বাচ্চাগুলো একটু হাঁটা শিখলে রানি ওদেরকে নিয়ে একটা বাড়ির সদর দরজার পাশে এমন জায়গায় আশ্রয় নেয় যাতে বাচ্চাদের গায়ে বাতাস না লাগে। কিন্তু সকাল হতেই সেই বাড়ির মালিক লাঠি হাতে তেড়ে আসে ওদেরকে তাড়ানোর জন্য! রানি বাচ্চাগুলোকে নিয়ে অন্য একটা বাড়ির সামনে আশ্রয় নেয়, সেই বাড়িওয়ালাও একইভাবে তাড়িয়ে দেয়। মনের দুঃখে রানি বাচ্চাগুলোকে নিয়ে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে।

বাচ্চাগুলো হেলে-দুলে হাঁটে, নিজেদের মধ্যে খেলা করে, একে অন্যের গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে; রানি মুগ্ধ মায়ের চোখে তাকিয়ে থাকে, ওর মাতৃহৃদয় অতুল আনন্দে দোল খায়, ওর চোখের কোনে আনন্দ অশ্রু জমে ওঠে।

বাচ্চাগুলো বেশ বড়ো হয়, ওরা মায়ের সাথে বেরিয়ে পড়ে খাবারের সন্ধানে, বাজারে, হোটেলের ময়লার গাদায় খুঁটে খুঁটে খাবার খায়। চায়ের দোকানের কোনো কোনো খরিদ্দার ওদের দিকে একটা-দুটো পাউরুটি ছুড়ে দেয়। ভাত খাওয়ান বাউল, বাচ্চাগুলো বাউলকে খুব ভালবেসে ফেলেছে, বাউলকে দেখলেই ওরা ছুটে গিয়ে বাউলের পা আঁকড়ে ধরে, লাফিয়ে গায়ে উঠতে চায়, গা-পা চাটে। ভাত ছাড়াও বাউল মাঝে মাঝে পাউরুটি কিনেও টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে খাওয়ান বাচ্চাদেরকে।

একদিন বিকেলে রাস্তার পাশে গুটিশুটি মেরে বসে আছে রানি, আর ওর বাচ্চারা খেলছে, খেলার ধরন অনেকটা মানুষের কুস্তি লড়ার মতন! খেলার পর ওরা হয়ত ক্ষুধার্ত ছিল, চারটে বাচ্চা হুড়োহুড়ি করে মায়ের কাছে এসে দুধ পান করছিল। দুধ পান শেষে একটা বাচ্চা সবে মায়ের কাছ থেকে একটু সরেছে, হঠাৎ একটা প্রাইভেটকার বেপরোয়া গতিতে বাচ্চাটাকে চাকায় পিষে দিয়ে একই গতিতে ধাবিত হয় সামনের দিকে। রানি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছিল প্রাইভেট কারটির দিকে, ঘেউ ঘেউ করতে করতে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু এর বেশি আর কি করার সাধ্য ওর আছে!

ফিরে আসে রানি সদ্য খুন হওয়া বাচ্চাটির কাছে, অন্য তিনটি বাচ্চা তখন মরা বাচ্চাটির মুখ শুকছে, পেটের কাছ থেকে পিছনদিকটা একদম পিষে গেছে রাস্তার সঙ্গে! রানিও এসে মৃত বাচ্চাটির মুখ শুকতে থাকে, চাটেও, নিশ্চিতভাবে কাঁদেও। আবার একটা প্রাইভেট কার পাশ দিয়ে যাবার সময় রানি ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে যায়, ঘেউ ঘেউ করে, কামড়াতে চায় প্রাইভেট কারটিকে, কিন্তু পারে না। আবার ফিরে এসে মৃত বাচ্চার গন্ধ শোকে। ওর মাতৃহৃদয় হাহাকার করে বাচ্চাটির জন্য। বাচ্চাটিকে সামনে নিয়ে বসে থাকে, অনেকক্ষণ পর পর চোখের পলক ফেলে, ওর চোখ থেকে গড়িয়ে নামে জল।

সেদিন থেকে রানি প্রাইভেট কারসহ অন্যান্য গাড়ির ওপর বেশ ক্ষিপ্ত, গাড়ি দেখলেই ধেয়ে যেত ঘেউ ঘেউ করতে করতে, ও হয়ত বোঝাতে চাইত তোমরা দেখে-শুনে আস্তে গাড়ি চালাও, আমার বাচ্চাদেরকে পিষে মেরো না!

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে লকডাউন শুরু হলে, প্রথম দিকে তবু কিছু গাড়ি চলত, রানি তখনও ঘেউ ঘেউ করত গাড়ি দেখলে, কিন্তু এখন সারাদিনে দুটো-তিনটে গাড়ি যায়-আসে মহল্লায়, রানি দেখেও চুপ করে থাকে, নড়ে না। রানির বাচ্চারা এখন বেশ বড় হয়েছে, ওরা এখন আর দুধ খায় না, ওরা এটা-সেটা খুঁটে খায়, কিন্তু ওদের পেট ভরে না। ক্ষুধার জ্বালায় বাচ্চারা আর আগের মত খেলোধুলা করে না। বাচ্চাদের জন্য রানির কষ্ট হয়। রানি মন খারাপ করে বসে বসে কেবলই ভাবে-মানুষের কী হলো! চায়ের দোকান বন্ধ, সেখানে আর বিচিত্র মানুষের আড্ডা বসে না, অন্যান্য দোকানগুলো বন্ধু, মাংসের দোকান বন্ধ, মহল্লার রাস্তা খা খা করে, সকালে দু-চারজন মানুষ বাজারে এলেও দুপুরে একেবারে সুনসান বাজার। সেই যে কবে ছেলে-মেয়ে নিয়ে মহল্লা থেকে কোথায় গেলেন বাউল, তারপর থেকে আর তার দেখা নেই। লন্ড্রীর যে লোকটা মাঝে মাঝে ওকে আর ওর বাচ্চাদের বিস্কুট খাওয়াত, সেও নেই, লন্ড্রী বন্ধ। মুড়ির দোকানে যে লোকটি মাঝে মাঝে এক-দুই মুঠো মুড়ি দিত, সেও আর দোকানের ঝাঁপ তোলে না। মানুষেরা আর আগের মত রাস্তায় বের হয় না, বাজারে যায় না, দৌড়-ঝাপ করে না, ঝগড়া-গণ্ডগোলও করে না! কী হলো মানুষের, ও মানুষ তোমরা কথা কও না ক্যান? কী হয়েছে তোমাদের? রানির চোখে-মুখে আরো কত প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না রানি। নিশ্চয় কিছু হয়েছে মানুষের, ইলে হঠাৎ তারা এমন বদলে যাবে কেন! রানি যেন বলতে চায় মানুষেরা ভাল থাকলে যে আমরাও ভাল থাকি, মানুষেরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খেলে যে আমরাও খেতে পাই। আর এখন মানুষেরা বাইরে বেরোয় না বলে তাদের পেটেও ক্ষুধা থাকে, বাচ্চাগুলো পাঁজরের হাড় বেরিয়ে গেছে! রানির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামে মানুষের জন্য। রানি অপেক্ষায় থাকে আবার কবে বসবে মানুষের হাট!

ঢাকা।
এপ্রিল, ২০২০

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৮:৪২

নেওয়াজ আলি বলেছেন: অসাধারণ  লেখা। শুভেচ্ছা । দোয়া করবেন।

১২ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৮:৫২

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.