নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
শ্মশানে মড়া পুড়িয়ে শেষ বিকেলে গ্রামে ফিরে নদীতে একটা ডুব দিয়ে ভেজা শরীরে অতনু জয়তিদের বাড়িলগ্ন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে জানালায় তাকায়, ঠিক ডুব দিয়ে উঠে আসার সময় যা ভেবেছিল তাই- জানালার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছে জয়তি রাস্তার দিকে তাকিয়ে! পশ্চিম আকাশের নিস্তেজ সূর্যের আলোয় অতনু জয়তির চোখে-মুখে দেখতে পায় সদ্য পিতৃহারা শোকের মন্থর আষাঢ়ে মেঘ। অতনু জানালা বরাবর এসে রাস্তায় দাঁড়ায় জয়তির দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে, কিন্তু জয়তির দিক থেকে দৃষ্টি নামিয়ে রাখে মাটিতে, জানালা থেকে তার দূরত্ব হাত দশেকের। ঠিক অপরাধবোধ নয়, তবে একটা অস্বস্তিবোধ হচ্ছে অতনুর, সকালে জয়িতার বাবার মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকে। দিন পনের আগে, অর্থাৎ কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণের কারণে সারাদেশে লকডাউন ঘোষণার দু-দিন আগে সে যখন ঢাকা থেকে বাড়িতে আসছিল, তখন গ্রামের রাস্তায় জয়তির বাবা প্রদীপ্ত রায়ের সঙ্গে দেখা, অতনু কুশল জিজ্ঞেস করলে শুকনো কাশির মত উত্তর দিয়েছিলেন প্রদীপ্ত। জয়তির সঙ্গে অতনুর প্রেম এবং তা জানার পর থেকে প্রদীপ্ত অতনুকে দেখতেন জেলফেরত দাগী আসামী দেখার মতন! অতনুর অপরাধ- সে সরকারি চাকরিজীবী নয়, সংবাদপত্রের একজন সাংবাদিক; এর চেয়ে বড় অপরাধ সে কবি! প্রদীপ্ত মনে করতেন কবিরা সংসারী হয় না, সংসারে থেকেও তাদের মন বাইরুম বাইরুম করে, চূড়ান্ত বাউণ্ডুলে! তিনি সরকারী চাকরিজীবী পাত্র ব্যতিত মেয়ের বিয়ে দিতে চাননি, তিনি নিজে ছিলেন সরকারি প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক, জয়তিও সরকারী প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, তাই প্রদীপ্ত’র চাহিদা ছিল তার জামাতা হবে নিদেনপক্ষে একজন সরকারি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। জয়তি বাড়িতে জানিয়েছিল যে সে অতনুকে ভালাবাসে এবং তাকেই বিয়ে করতে চায়, প্রদীপ্ত মেয়ের এই আবদার নাকচ করে দিয়েছিলেন। অতনুও পারতপক্ষে প্রদীপ্ত’র মুখোমুখি হতে চাইত না, দূর থেকে প্রদীপ্তকে দেখলে সে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করত। কিন্তু সেদিন রাস্তার মোড়টা ঘুরতেই একেবারে মুখোমুখি দেখা হয়েছিল।
এখন জানালার ওপাশে বসে থাকা জয়তির সামনে দাঁড়িয়ে অতনুর অস্বস্তির কারণ- সেদিন প্রদীপ্ত’র সঙ্গে দেখা হবার পরপরই তার মনের মধ্যে বুদ্বুদের মত ভেসে উঠেছিল এই কথাটি যে কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে, এই মানুষটি মারা গেলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়, তার আর জয়তির বিয়েতে আর কোনো বাঁধা থাকে না!
ব্যাপারটা এমন নয় যে সচেতনভাবেই এসব ভেবেছিল অতনু, এমনিতেই হঠাৎ মাথায় এসেছিল কথাটি। পুকুরে যে এত বুদ্বুদ ওঠে, তা তো পুকুরের নিজের ইচ্ছায় নয়; মাছে ঘাই মারে, জলের তলায় কচ্ছপ বা অন্য কিছু নড়ে ওঠে বলেই তো পুকুরে বুদ্বুদ ওঠে, পুকুরের তো কোনো দোষ নেই। তাহলে তার মাথায় হঠাৎ এই কথাটি কেন এলো? ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ হলে ভাবত-নিশ্চয় ঈশ্বর তার মাথায় এই ভাবনাটি ঢুকিয়েছে! কিন্তু অতনু ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, ওসব অলৌকিক আপদে বিশ্বাস নেই তার!
এই ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম ঘটেছে তা নয়, প্রথম ঘটে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৯৯৯ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলার সময়, অতনু তখন ষোল বছরের কিশোর, পাগলের মত ক্রিকেট ভালবাসত আর যত্রতত্র ক্রিকেট খেলত। বিশ্বকাপে ভারতকে সমর্থন করত সে। সে-বারই প্রথম বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলে, বাংলাদেশের কাছে তখন বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়াটাই বড় কথা, বিশ্বকাপ জয়ের আশা কল্পনাতীত। একদিন বিকেলে ক্রিকেট খেলতে খেলতে অতনুর মাথায় হঠাৎ আসে-বিশ্বকাপ খেলার সময় যদি শচীনের বাবা-মা কেউ মরে যায়, তাহলে তো ভারতের সর্বনাশ, শচীন তো আর খেলতে পারবে না! কিন্তু কী অদ্ভুত কাণ্ড এক-দুদিন পরই সে শোনে যে শচীনের বাবা মারা গেছেন, আর শচীন খেলা ফেলে ভারতে ফিরে আসছেন। স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল অতনু, অপরাধবোধে ভুগছিল সে-কেন এমন ভাবনা মাথায় এলো! শচীনবিহীন পরের ম্যাচ আন্ডারডগ জিম্বাবুয়ের সাথে খেলে হেরে যায় ভারত, আর সেই হারের জেরেই বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ে যায় তারা। ভারত বাদ পড়ায় অতনুর মনোকষ্ট দ্বিগুণ হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একবার ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল, স্নান-খাওয়া সেরে ক্লান্ত শরীরে মায়ের কাছে শুতেই পাশের বাড়ি থেকে খোল-করতাল-গানের আওয়াজ ভেসে আসে। প্রতিবেশিরা হরিসভার আয়োজন করেছিল, অর্থাৎ ঈশ্বরের নামে গান-বাজনা হবে মধ্যরাত পর্যন্ত। ওর হঠাৎ কী মনে হওয়ায় মাকে বলেছিল যে এখন বৃষ্টি হলে ভাল হত, গান-বাজনা বন্ধ হত, একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম! কী অদ্ভুত ব্যাপার, আকাশে মেঘ ছিল কি না তাও জানত না অতনু, হঠাৎ কী খেয়াল হয়েছিল, তাই বলেছিল, একটু পরই আউলা বাতাস আর বৃষ্টি শুরু হয়, হরিসভার লোকজন দৌড়ে যে যার বাড়িতে চলে যায়, পণ্ড হয় হরিসভা; সে রাতে বেশ বৃষ্টি হয়। অতনু’র মা ধর্মপরায়ণ, ছেলের চাওয়া পূরণ হওয়ায় তিনি বেশ অবাক হয়েছিলেন, হয়ত মনে মনে খুশিও হয়েছিলেন! অতনু মাকে জানিয়েছিল যে ঈশ্বর বলে কিছু নেই, থাকলে এখন বৃষ্টি হত না, কেননা লোকগুলো তো ঈশ্বরেরই গুণ-কীর্তন করছিল, অথচ ওদের ঈশ্বরবন্দনা পণ্ড হয়ে একজন নাস্তিকের চাওয়া পূরণ হলো!
এই ধরনের ঘটনা পরে আরো ঘটেছে, অতনু নিজেই হতবাক হয়ে যায় যখন তার মনে বুদ্বুদের মত ভেসে ওঠা কথাগুলো সত্যি হয়ে যায়! ব্যাপারটা অলৌকিক বা এতে ঈশ্বর নামক মহাশক্তির কোনো হাত আছে তাও মনে করে না অতনু, তবু মাঝে মাঝে এমন হয়, যেমনটা ঘটে গেল জয়তির বাবার ক্ষেত্রে!
এখন পিতৃশোকগ্রস্ত জয়তির দিকে তাকাতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে অতনুর, যেন জয়তি বইয়ের পাতার অক্ষরের মত তার হৃদয়ের এই গোপন কথা পড়ে ফেলছে, যেন জয়তি ওর পিতার মৃত্যুর জন্য তাকেই দায়ী করবে, তাদের ভালবাসার ইতি ঘটবে আজই!
অতনু চুপচাপ জানালার দিকে এগিয়ে যায়, গরাদের ওপাশে দাঁড়িয়ে জয়তি তাকিয়ে আছে তার দিকে, দুজনের মাঝে হাত তিনেকের ব্যবধান। অস্বস্তি নিয়েই জয়তির মুখের দিকে তাকায় অতনু, জয়তির বিধ্বস্ত চেহারা দেখে ওর বুকের তেপান্তর খা খা করে! ইচ্ছে করে গরাদে রাখা জয়তির হাতখানা ধরতে, ইচ্ছে করে বলতে যে আমি তোমাদের পাশে আছি, কিন্তু ইচ্ছে অবদমন করে সে, প্রশাসন জানিয়েছে যে জয়তিদের হোম কায়ারেন্টিনে থাকতে হবে। প্রশাসন জয়তিদের বাড়ি লকডাউন করেছে, ওদের বাড়ির আঙিনায় ঢোকার সদর দরজায় বাঁশ বেঁধে আটটে দিয়েছে যাতে ভেতরের মানুষ বাইরে এবং বাইরের মানুষ ভেতরে যেতে না পারে। আর কাগজে লিখে রেখেছে-লকডাউন।
গ্রামের মানুষের বিশ্বাস- জয়তির বাবা কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এটা সত্য যে তিনি জ্বর, কাশি এবং শ্বাসকষ্টে ভুগে মারা গেছেন, যেগুলো কোভিড-১৯ ভাইরাসের এর উপসর্গ। কিন্তু মানুষের বিশ্বাস অনুমানের ভিত্তিতে, পরীক্ষিত নয়; সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে একটা মেডিকেল টিম এসে নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে গেছে, পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে যে তিনি কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন কি না। যেহেতু জয়তির বাবার মধ্যে কোভিড-১৯ ভাইরাসের উপসর্গ ছিল তাই লাশ বাড়িতে বেশিক্ষণ না রেখে তাড়াতাড়ি দাহ করতে নিয়ে যেতে হয়েছে। জয়তির বাবার শেষযাত্রায় শ্মশানযাত্রী হয়েছিল মাত্র আটজন-জয়তির ছোট ভাই জয়ন্ত, দুই কাকা আর তাদের দুই ছেলে, জয়তির একজন পিসতুতো দাদা, একজন মাসতুতো ভাই আর অতনু। অর্থাৎ সাতজন জয়তিদের নিকটাত্মীয় আর একজন সম্ভাব্য আত্মীয়। অথচ এই গ্রামসহ আশপাশের গ্রামে জয়তির বাবার অসংখ্য গুণগ্রাহী এবং প্রক্তন ছাত্র রয়েছে। সারা গ্রামের মানুষকে শ্মশানযাত্রায় আমন্ত্রণ জানালেও কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে কোনো গ্রামবাসী আসেনি। প্রৌঢ় একজন ব্যক্তি মারা গেছেন অথচ শ্মশানযাত্রায় খোল-করতাল বাজেনি, শ্মশানযাত্রার গান হয়নি, এমন দৃশ্য এই গ্রামে কেউ কোনোদিন দ্যাখেনি।
জয়তির চোখ থেকে জল ঝরছে, ব্যথিত প্রেমিক অতনু তাকিয়ে আছে জয়তির দিকে। খুবই নিচু এবং ক্লান্ত স্বরে জয়তি বলে, ‘শেষ?’
অতনু’র মুখ থেকে কোনো কথা বের হয় না, সে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে। জয়তি ডুকরে কেঁদে ওঠে, ওড়না দাঁতে চাপে, তারপর কাঁদতে কাঁদতে গরাদে মাথা রাখে। অতনু অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকে, সান্ত্বনা দেবার ভাষা তার মুখে আসে না। বেশ কিছুক্ষণ পর জয়তির কান্নার দমক কমে, ওড়না দিয়ে গালের অশ্রুরেখা মুছে অতনু’র মুখের দিকে তাকায়।
অতনু নিচু স্বরে বলে, ‘আমি আসি।’
জয়তি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে। জয়তিকে ছেড়ে অতনুর যেতে করে না, কিন্তু ভেজা পোশাকে কতক্ষণই বা দাঁড়িয়ে থাকবে! তাছাড়া বাড়ির ভেতরে গিয়ে জয়তির হাতটা শক্ত করে ধরে বোঝাবে যে আমি তোমার পাশে আছি, জয়তিকে জড়িয়ে ধরে বুকের উষ্ণতার পরশ আর মাথায় হাত বুলিয়ে শোক ভোলানোর চেষ্টা করবে সে উপায়ও নেই। ওদের বাড়ি লকডাউন করা, আর জয়তির বাবা যদি সত্যি সত্যি কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, আর তার থেকে যদি জয়িতাও….! আর ভাবতে পারে না অতনু, ভাবতেও চায় না, পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করে। নির্জন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অকস্যাৎ ওর মাথায় জন্ম হয় কবিতার পংক্তির-
এমন নিরানন্দ পৃথিবী কে কবে দেখেছে- যেখানে প্রেমিকার ওষ্ঠযুগলে মারণাস্ত্র,
মেঘের আদরের মতন অমন স্তন যুগলে প্রশান্তির বদলে মৃত্যুর আতঙ্ক!
১৬ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১:০৯
মিশু মিলন বলেছেন: হুম। ধন্যবাদ।
২| ১৫ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৯:১২
রাজীব নুর বলেছেন: ভালো লিখেছেন।
১৬ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১:০৯
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
৩| ১৫ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৯:১৪
নেওয়াজ আলি বলেছেন: মনোরম
১৬ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১:০৯
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ১৫ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ৯:১০
বিডি ট্রাভেলার গাইড বলেছেন: করোনা এখন এক আতংকের নাম।