নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

জন্মান্তর (উপন্যাস: পর্ব-পাঁচ)

১৭ ই জুলাই, ২০২০ বিকাল ৫:৩১

সেই রাতের ওই ঘটনার পর চাচা বেশ কয়েক মাস আমার সঙ্গে কথা বলেননি। তারপর থেকে কথা বলা শুরু করলেও আমার সঙ্গে তার আচরণ পাশের বাড়ির মুরুব্বির মতো! তবে সার্বক্ষণিক ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ যার মন, সে তো সুযোগ পেলে তার ধর্মীয় অনুশাসনের কথা তুলবেই। চাচাও তোলেন অনেক সময়, সরাসরি আমাকে কিছু না বললেও আমাকে শুনিয়ে বলেন; আমি এড়িয়ে চলি। তবে মাস ছয়েক আগে আমার বড় আপুর দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পর তার সঙ্গে এক নতুন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলাম। আপার দ্বিতীয় সন্তানটি ছেলে, ওর আকিকা হয়েছিল আমাদের বাড়িতেই। আকিকার আগের সন্ধ্যায় আমি ক্যাম্পাস থেকে ফিরে নিচের গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখি গ্রিলের সাথে বাঁধা বেশ তাগড়া দুটো খাসি ম্যা ম্যা করে ডাকছে। তারপর বাসায় ঢুকে দেখি মা, বড় আপু, ছোটো আপু, চাচা-চাচী, ফুফু, ফুফাতো বোন আফিয়া মালিহা, চাচাতো বোন আনতারা রাইদাহ আর সাবিহা সবাই আমাদের ড্রয়িং-ডাইনিংরুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। সকলের মধ্যমণি এবং আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু আমার ছোট্ট ভাগ্নে। আমি সাধারণত পারিবারিক এমন জটলা এড়িয়ে চলি। কিন্তু বাসায় ঢোকামাত্রই মালিহা বলে, ‘এইতো ভাইয়া এসে গেছে, দেখি ভাইয়ার কোন নামটা পছন্দ হয়।’

আমার ভাগ্নের জন্য কী নাম বাছাই করা হচ্ছে তা না শুনে আমি কীভাবে নিজের ঘরে যাই! ফলে আমি ড্রয়িংরুমের দিকে এগোই। মালিহার কোলে শুয়ে ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকায় ভাগ্নে। আমাদের পরিবারের এবং কাছের আত্মীয়দের বাড়ির নতুন অতিথির নাম সাধারণত আমার চাচাই রাখেন। নামকরণের ব্যাপারে সকলেই চাচার ওপর নির্ভর করেন আর ব্যাপারটা চাচা বেশ উপভোগ করেন, গর্ববোধও। ফলে আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ যে যথারীতি এবারও ভাগ্নের জন্য নাম বাছাই করেছেন চাচা। কয়েক মুহূর্ত ভাগ্নের হাসিমুখটা দেখে মালিহার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কী কী নাম?’

‘একটা হলো-ফাহিম আসাদ, আরেকটা- আহনাফ আবিদ; আমি, ছোট আপু, রাইদাহ আর সাবিহা পছন্দ করেছি আহনাফ আবিদ; মা, মামা আর মামীদের পছন্দ ফাহিম আসাদ। বড় আপু দুধভাত, কিছুই বলছে না। ভাইয়া প্লিজ তুমি আমাদের দিকে ভোট দাও।’

চাচাকে বরাবরই স্বৈরশাসক বলেই জানি, নাম রাখার ব্যাপারে তিনি হঠাৎ গণতান্ত্রিক হয়ে গেলেন কী কারণে কে জানে, নাকি নামদুটোর ব্যাপারে তিনি নিজেই দ্বিধায় ভুগছেন! রাইদাহ বলে, ‘বড়রা বুঝতেই পারছে না যে ফাহিম আসাদ কমন নাম!’

আমি জানতে চাই, ‘ফাহিম আসাদ মানে কী?’

এবার ওরা চাচার দিকে তাকায়, মানে ওরা জানে না, জানেন চাচা।

চাচা বলেন, ‘বুদ্ধিমান সিংহ।’

শোনামাত্র আমি হো হো করে হাসতে হাসতে মালিহার পাশের সোফায় বসে পড়ি। হাসির দমক কমলে দেখি, সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, রাগত চোখ দুটো আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে চাচা বলেন, ‘এতে হাসির কী হলো?’

হাসির রেশ তখনো আমার মুখে। বললাম, ‘বাহ্, হাসবো না! আমি সম্মানিত সিংহ, আমার ভাই ন্যায়বান সিংহ, আর আমাদের ভাগ্নে হবে বুদ্ধিমান সিংহ!’

‘এতে তো হাসির কিছু দেখছি না!’

আমি চাচার চোখে চোখ রাখি ‘আপনারাই তো বলেন, মানুষ হচ্ছে আশরাফুল মাকলুকাত, সৃষ্টির সেরা জীব; তো সেই সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে জন্মগ্রহণ করেও আমাদের পরিচিত হতে হচ্ছে একটা হিংস্র পশুর নামে, ব্যাপারটা হাস্যকর না!’

চাচা কিছুটা বিব্রত হলেও সহসাই আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, ‘এটা পবিত্র আরবি ভাষার নাম, হাস্যকৌতুকের বিষয় নয়। মুসলমান সন্তানের আরবি ভাষায় নাম রাখা সোয়াব।’

‘আপনি তো ফাহাদের নাম রেখেছেন আবরার ফাহাদ, মানে ন্যায়বান সিংহ। কিছুদিন আগে সৌদি আরব আবরার নামটি সহ মোট পঞ্চাশটি নাম নিষিদ্ধ করেছে। আপনি ধর্মপ্রাণ মুসলমান, আপনার ছেলেও ধর্মপ্রাণ মুসলমান, কিন্তু ফাহাদ এখন সৌদি আরবের নিষিদ্ধ ঘোষিত নাম নিয়ে জীবনযাপন করছে, এতে ওর গুনাহ হচ্ছে না? আপনার শ্বশুরের নামও তো নিষিদ্ধ, মোহাম্মদ কিবরিয়া। আপনার শ্বশুরও তো মহা ধর্মপ্রাণ মুসলমান, তার গুনাহ হচ্ছে না? আরবি ভাষার গু-ও আপনাদের কাছে পবিত্র, অমৃত; আর বাংলা ভাষার অমৃতও আপনাদের কাছে তেতো!’

‘বেয়াদবের মতো কথা বোলো না।’

‘বেয়াদবের মতো কথা বলছি কোথায়! এটাই সত্য। বাংলা ভাষায় এতো সুন্দর সুন্দর নাম থাকতে আরবি ভাষায় নাম রাখতে হবে কেন?’

‘আরবি নবীজির পবিত্র ভাষা, বাংলা তো হিন্দুদের ভাষা!’

হায়! যার পূর্বপুরুষ হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছে; বংশ পরম্পরায় হিন্দুদের রক্ত, জিন, সেল বহন করে চলেছে শরীরে; হিন্দুদের জমির শস্যদানা খেয়ে জীবনধারণ করছে; এসবে কোনো দোষ নেই, যতো দোষ ভাষার! যে ভাষার জন্য রফিক-সালাম-বরকতেরা জীবন দিয়েছেন, সেই ভাষার মানুষই কিনা বলছে বাংলা হিন্দুদের ভাষা; বাংলা এখনো বাঙালীর ভাষা হতে পারেনি!

‘বাংলা অপবিত্র ভাষা, এটা আপনাকে কে শিখিয়েছে?’

‘বাংলা হিন্দুদের ভাষা, এই ভাষায় মুসলমানদের নাম রাখা উচিত না। গুনাহ হতে পারে।’

‘আপনারা না বলেন যে সবকিছু আল্লাহ’র সৃষ্টি; সবকিছু যদি আল্লাহ’র সৃষ্টি হয়, তাহলে পৃথিবীর সব ভাষাই তো আল্লাহ’র সৃষ্টি। সেক্ষেত্রে কেবল আরবি নয়, পৃথিবীর সব ভাষাই তো পবিত্র; এমনকি বিলুপ্তপ্রায় যে ভাষাটিতে এখন মাত্র এক বা দু-জন মানুষ কথা বলে, সে ভাষাটিও পবিত্র! আর আরবি মুসলমানদের ভাষা এটা আপনাকে কে বলেছে?’

‘পবিত্র আরবি ভাষা নবীজির ভাষা, মুসলমানের ভাষা; এটা কে না জানে!’

‘মুহাম্মদ ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক সেটা সর্বজন বিদিত, কিন্তু তিনি যে আরবি ভাষারও প্রচলন করেছিলেন এমন কথা তো শুনিনি। কোরান-হাদিসে আছে কোথাও?’

‘ইসলাম সম্পর্কে না জেনে কথা বলাটা তোমার মতো গুনাহগার নাস্তিকদের অভ্যাস। আরবি মুসলমানদের ভাষা, পবিত্র কোরান আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে।’

‘কোরান আরবি ভাষায় বলা এবং লেখা হয়েছে, কিন্তু সেটা পৌত্তলিকদের ভাষা। পৌত্তলিকরা আরবি ভাষায় কথা বলতো, আরবি ভাষায় গান করতো, কবিতা লিখতো, আল্লাহ’র কাছে প্রার্থনাও করতো, এমনকি খিস্তি-খেউড়ও করতো। মুহাম্মদের জন্মের আগেই এই ভাষার উৎপত্তি; এমনকি ‘আল্লাহ’ শব্দের উৎপত্তি এবং ব্যবহারও মুহাম্মদের জন্মের বহু আগে থেকেই। পৌত্তলিকরাও তাদের সৃষ্টিকর্তাকে ‘আল্লাহ’ নামেই ডাকতো। মুহাম্মদের বাবা আবদুল্লাহ মুহাম্মদের আগে জন্মায়নি আর তার ধর্মও ইসলাম ছিল না, তিনি পৌত্তলিক-ই ছিলেন। আবদুল্লাহ শব্দের অর্থ আল্লাহ’র দাস। তাই একথা বলা অজ্ঞানতা যে আরবি মুসলমানদের ভাষা। আর কাবাঘর? সেটাও তো মুহাম্মদের জন্মের আগে থেকেই পৌত্তলিকদের তীর্থস্থান ছিল, সমগ্র আরবের মানুষ সেখানে তীর্থ করতে আসতো। তিনশো ষাটটি মূর্তি ছিল ওখানে যা মক্কা বিজয়ের সময় মুহাম্মদ ধ্বংস করেন। সুতরাং একথা বলার কোনো সুযোগ নেই যে আরবি মুসলমানদের ভাষা আর কাবাঘর মুসলমানদের তীর্থস্থান, দুটোই মুহাম্মদ দখল করেছে। আরবের বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং জাতির লোকাচার মুহাম্মদ গ্রহণ করেছে; যেগুলো সম্পর্কে প্রকৃত সত্য না জেনে আজকের বেশিরভাগ মুসলমান বিশ্বাস করে যে এসবের প্রবর্তক মুহাম্মদ। সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং মজার ব্যাপার হলো মুহাম্মদের মূর্তিপূজার বিরোধীতা সত্ত্বেও পৌত্তলিকদের তীর্থস্থানেই মুসলমানরা হজের নামে পাথর পূজা করে!’

চাচার মুখ যেন পাথরের চাঁই, চোখ অগ্নিকুণ্ড, আর কণ্ঠ বজ্রনাদ, ‘তুমি শয়তানের ভাষায় কথা বলছো। মুসলমানরা হিন্দুদের মতো পূজা করে না, মুসলমানরা করে ইবাদত।’

‘হিন্দুরা সরাসরি হাত মুখে তুলে খায়, আর আপনারা হাতটা মাথার চারপাশে ঘুরিয়ে এনে খান; কিন্তু উভয়ই খাওয়া। বাংলা ভাষায় যা পূজা, আরবি ভাষায় সেটাই ইবাদত।’

‘তোমার মতো শয়তানের কাছ থেকে আল্লাহ আর তার পবিত্র কাবাঘর সম্পর্কে ভুলপাঠ নিতে চাই না আমি।’

‘আমারও উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর কোনো ইচ্ছে নেই! আপনি বাংলাভাষাকে অপমান করেছেন, একজন বাংলাভাষা প্রেমিক বাঙালি হিসেবে এর প্রতিবাদ করাটা আমার নৈতিক দায়িত্ব। আপনারা পৌত্তলিকদের আল্লাহকে গ্রহণ করেছেন, পৌত্তলিকদের ভাষা গ্রহণ করেছেন, পৌত্তলিকদের বহু সংস্কৃতি এবং রীতি গ্রহণ করেছেন, পৌত্তলিকদের তীর্থস্থানে তীর্থ করতে যাচ্ছেন, আর নিজ ভাষা বাংলায় সন্তানের নাম রাখলেই আপনাদের সোয়াবে টান পড়ে, গুনাহ হয়! আমার ভাগ্নের নাম আমি বাংলায় রাখবো, কারো ইচ্ছে হলে ওকে সেই নামে ডাকবে, ইচ্ছে না হলে ডাকবে না; আমি একাই ডাকবো।’ বলেই আমি উঠে পড়ি।

আমি আমার ভাগ্নের নাম রেখেছি অয়ন। প্রথম প্রথম আমি একাই এই নামে ওকে ডাকতাম। এখন আমার বড় বড়আপু-দুলাভাই, ছোট আপু অয়ন নামেই ওকে ডাকে। ওই ন্যায়বান সিংহ, মানে ফহিম আসাদ নামটিও আছে কাগুজে নাম হিসেবে। কাগুজে নামটি আরবিতে না হলে তো সোয়াব হবে না!

আমার ধারণা চাচার প্রিয় পশু সিংহ, নইলে এমন নাম রাখবে কেন আমাদের? তাছাড়া সিংহকে বনের রাজা বলা হয়, আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে সিংহ ভীষণ শক্তিশালী পশু। আর কে না চায় তার বংশের ছেলে রাজার মতো হবে, খুব শক্তিশালী হবে; এজন্যই বোধহয় শক্তিশালী সিংহের নামে আমাদের নাম রেখেছেন। তবে আমাদের এই সিংহত্রয়ের মধ্যে সবচেয়ে বিপদের মধ্যে আছি আমি। মনে হয় না কোনো পশ্চিমা দেশ সহজে আমাকে ভিসা দেবে! এক ভয়ংকর ইসলামী সন্ত্রাসীর নামের একটা অংশ আর আমার নামের একটা অংশ এক-উসামা। আমজাদ উসামা, মানে সম্মানিত সিংহ! আমার চাচাতো ভাই আবরার ফাহাদের নামের অর্থ হলো- ন্যায়বান সিংহ!

মামা একটা বাংলা নাম রেখেছিলেন আমার-সবুজ; যদিও এই নামে আমাদের বাড়ির কেউ আমাকে ডাকে না। আমি সবুজের সঙ্গে আরেকটা শব্দ যোগ করে নিয়েছি-সমতল, সবুজ সমতল। এই নামেই আমি ফেসবুকিং-ব্লগিং করি। ক্যাম্পাসের সহপাঠী-বন্ধুরা আমাকে ‘সবুজ’ নামে ডাকে, তবে এর জন্য ওদেরকে খাওয়াতে হয়েছিল। ওরা তো প্রথম দিকে আমাকে উসামা বলে ডাকতো, কেউ কেউ দুষ্টমি করে লাদেন শব্দটাও যোগ করতো। একদিন ওদেরকে খাইয়ে অনেক অনুরোধ করে বলার পর ওরা ওইসব উসামা-লাদেনের পরিবর্তে সবুজ বলে ডাকতে শুরু করেছে। ফাস্ট ইয়ারের শুরুর দিকে একবার গ্রুপ অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার আগেরদিন আমার এক বান্ধবী হৃদিকা আমাকে বলে, ‘এই যে সম্মানিত সিংহ, তোমার নামের স্পেলিংটা কাগজে লিখে দাও।’

আমি তখনো আমার নামের অর্থ জানতাম না। বলি, ‘আমি আবার সম্মানিত সিংহ হলাম কবে থেকে?’

ও হেসে বলে, ‘কবে থেকে আবার, আকিকার দিন থেকে।’

‘মানে?’

ও তখন হাসি আরো প্রলম্বিত করে অন্য বন্ধুদের শুনিয়ে বলে, ‘ওরে এ দেখি বেআক্কেল গাধা, ভুল করে নাম রেখেছে সম্মানিত সিংহ!’

আমাকে নিয়ে অনেক হাসি-ঠাট্টার পর হৃদিকা ব্যাপারটা খোলাসা করে, আমার নামের অর্থ জানায়। সেদিনই ক্যাম্পাস থেকে ফিরে চাচার কাছ থেকে আমার সব ভাইবোনদের নামের অর্থ জেনে নিই, হাস্যকর আর বিরক্তিকর সব নাম। স্ববিরোধী নামও আছে, যেমন আমার চাচাতো বোনের নাম আনতারা রাইদাহ; মানে হলো-বীরাঙ্গনা নেত্রী! যে ধর্ম নারীকে গৃহবন্দী করে রাখার কথা বলে, যে ধর্ম স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে নারীকে পুরুষের অধীন থাকার কথা বলে, যে ধর্ম নারীকে পুরুষের যৌনদাসী করে রাখার কথা বলে, যে ধর্ম শিখিয়েছে নারী নেতৃত্ব হারাম, যে ধর্ম শিখিয়েছে নারীর নেতৃত্বে থাকার চেয়ে পুরুষের মরে যাওয়াই উত্তম; সেই ধর্মের এক নারীর নাম আনতারা রাইদাহ বা বীরাঙ্গনা নেত্রী! এটা ভীষণ স্ববিরোধী এবং কৌতুককর নাম! আমার চাচাতো বোন আনতারা রাইদাহ বোরকা পরে কেবল চোখ দুটো খোলা রেখে বাইরে যায়। বোরকা বীরাঙ্গনা নেত্রীর পোশাক বটে!

আমি ভাবছি আমার নামটি এফিডেভিট করে সবুজ সমতল করে নেব। একটা হিংস্র পশুর নামে আমার নাম, ভাবলেই অসহ্য লাগে!

নাস্তা খেয়ে চা বানিয়ে নিয়ে আমি নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কম্পিউটার চালু করি। ইউটিউবে রাকেশ চৌরাশিয়ার বাঁশি ছেড়ে হারিয়ে যাই নিজের ভাবরাজ্যের গহীনে। ক্লাস না থাকলে দিনটা আমি নিজের মতো করে উপভোগ করি, সারাদিন সুরের মধ্যে ডুবে থেকে পড়ি কিংবা ব্লগে লিখি। আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, ছাঁচে ঢালা প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার প্রতি আমার বিতৃষ্ণা চরম মাত্রায় পৌঁছে গেছে, তাই পরীক্ষার তোড়জোর না থাকলে ছুটির দিনে ক্লাসের পাঠ্যবই ছুঁয়েও দেখি না। আজকাল নন-ফিকশন বেশি পড়ছি, পুরোনো ফিকশনও পড়ছি। এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের বেশিরভাগ ফিকশন পড়ে আনন্দ পাই না। পড়তে পড়তে মনে হয় পাঠককে খুশি করার জন্য, জনপ্রিয়তা পাবার জন্য আপোস করে এসব লেখা হয়েছে। আজকাল অধিকাংশ লেখক জনবহুল তৈরি পথে হাঁটছে; কিন্তু যে পথটা জনবিরল, খানাখন্দ আর লতাগুল্মে ভরা সেই পথে কেউই পা বাড়াতে চাইছে না; অথচ সেটা একটা নতুন সম্ভাবনাময় পথ। ওই যে বিতর্ক এড়িয়ে সবার কাছে ভাল থাকার যে সুবিধাবাদী বাঙালী বুদ্ধিজীবি চরিত্র, সেটাই মাটি করছে নতুন সম্ভাবনাকে। বেশিরভাগ লেখক মিথ্যাটাকে মিথ্যা জেনেও তা উন্মোচন করতে চায় না, বরং জনপ্রিয়তার জন্য মিথ্যার ওপর একটা আরোপিত চটকদার প্রলেপ লাগায় এরা। অন্ধকার দেখেও সুচিন্তার আলো ফেলে না, প্রগতির পথে কোনো কালো পাথর থাকলেও এরা তাতে আঘাত না করে বা সরানোর চিন্তা না করে খাদে নেমে কোনোরকমে পাশ কাটিয়ে চলে যায়! এইসব বৃত্তবন্দী হৃদয়ের লেখা মুক্ত হৃদয়ের খোরাক মেটাতে পারে না।

সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তাই, ভারতে কিছু ভাল গান হলেও আমাদের এখানটা যেন নিষ্ফলা মরুভূমি! না গানের কথা মন টানে না সুর টানে কান! আজকাল লোকগান আর ক্লাসিক বেশি শুনছি। যন্ত্রসঙ্গীতের সুরের সঙ্গে মনটাকে উড়িয়ে দিয়ে নিজের মতো করে শব্দ বসিয়ে ভাবতে বেশ ভাল লাগে।

এই যা, আমার অর্ধেকটা চা আজকেও প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে! এরকম প্রায়ই হয় কল্পনার গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত হলে। যদিও বাসায় থাকলে আমি বেশ সময় নিয়েই চা পান করি, কেননা আমি কাপে চা পান করি না, পান করি মগে। সকাল-সন্ধ্যায় এক মগ আদা চা বানিয়ে আমি আমার রুমের দরজা বন্ধ করে নিজের জগতে ডুবে থাকি। অবশ্য এটা শুধু ছুটির দিনে, সকালে ক্লাস থাকলে চা পানের সময় কোথায়! তখন তো ঘুম থেকে উঠেই পড়িমরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ধরতে হয়, চা পান করি ক্যাম্পাসে গিয়ে।

প্রায় ঠাণ্ডা চায়ে চুমুক দিতেই বাবার উচ্চকণ্ঠ ভেসে আসে কানে। আবার কার ওপর চোটপাট করছেন, মা নাকি ছোটো আপু? নাকি খানিক বিরতি দিয়ে পুনরায় ব্যবসায়ীদের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করছেন? আমি বন্ধ দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই শুনতে পাই, ‘এগুলো মানুষ না, হিংস্র পশু! ইসলামের দুশমন, ইসলামের শত্রু! ইসলাম সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই, কতোগুলো মূর্খ কোরান বিকৃত করে মানুষ হত্যায় নেমেছে।’

এটুকু শুনেই আমি বুঝতে পারি যে ইসলামী জঙ্গিরা আবার কাউকে খুন করেছে, জঙ্গিদের হাতে কেউ খুন হলেই বাবা এসব কথা বলেন। তোতাপাখির মুখের শেখানো বুলির মতো এই কথাগুলোও মডারেট মুসলমানদের রপ্ত করা মুখের বুলি!

গত শতকের শেষভাগ থেকেই ইসলামী জঙ্গিরা তাদের শক্তি প্রদর্শন শুরু করে; ১৯৯৯ সালে তারা যশোর টাউন হল মাঠে উদীচী’র দ্বাদশ সম্মেলনের শেষদিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে, তারপর ২০০১ সালে পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে, ২০০২ সালে ময়মনসিংহের চারটি সিনেমা হলে বোমা হামলা করে, ২০০৫ সালে একযোগে তেষট্টি জেলায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এরপর থেকে তারা ধারাবাহিকভাবে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এবং প্রগতিশীল ব্যক্তিদের ওপর হামলা করে চলেছে। বহুবার বাউলদের আখড়ায় হামলা চালিয়ে তদেরকে মারধর করার পর চুল-দাড়ি কেটে দিয়েছে এবং আজো দিচ্ছে। আর ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কুখ্যাত রাজাকার কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবীতে প্রগতিশীল অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা শাহবাগে একত্রিত হয়ে গণজাগরণ মঞ্চ গঠন করলে, ফেব্রুয়ারি মাসেই গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজিব হায়দারকে হত্যার মাধ্যমে ইসলামী জঙ্গিরা তাদের নতুন হত্যা মিশন শুরু করে। রাজিবের পর অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নিলয় নীল সহ আরো কয়েকজন ব্লগারকে তারা হত্যা এবং হত্যার চেষ্টা করে। তবে কেবল ব্লগার হত্যায়-ই তারা সীমাবদ্ধ থাকেনি, একে একে তারা হত্যা করে প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষক, বাউল, সুফী সাধক, মাজারের খাদেম, হিন্দু পুরোহিত, খ্রিষ্টান যাজক, বৌদ্ধ ভিক্ষু, বিদেশী নাগরিক; মোটকথা তারা ইরাক-সিরিয়ার আইএস এর জিহাদী আদর্শে দীক্ষিত হয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, ভিন্ন মতাদর্শী মানুষ হত্যার মিশনে নামে।

‘এরা নাকি জিহাদী! জিহাদ করে ইসলাম কায়েক করবে, বিধর্মী হত্যা করে বেহেশতে যাবে, বেহেশতে যাওয়া এতো সোজা! নবীজি (সঃ) তোদের মানুষ হত্যা করতে বলেছেন! ইসলাম শান্তির ধর্ম, নবীজি (সঃ) শান্তির কথা বলেছেন। আহাম্মক-ইবলিশের দল কোরান বিকৃত করে ইসলামকে বিতর্কিত করে খুন-খারাবিতে মেতেছে।’

আমি বাবাকে দেখতে না পেলেও বাবার এই রাগান্বিত মুখমণ্ডল কল্পনা করতে পারি। চিতই পিঠার ছাঁচ থেকে যেমন বারবার একই রকম পিঠা তৈরি হয়, তেমনি আমার বাবার মতো আরো অসংখ্য মুসলমানের মুখ থেকে ইসলাম সম্পর্কে বারবার একই রকম কথা বের হয়! কথাগুলো এরকম- ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম; ইসলাম শান্তির কথা বলে, ধ্বংসের কথা নয়; ইসলাম মানবতায় বিশ্বাসী, ইসলাম জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করে না; জঙ্গিরা বিকৃত ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, ওরা সহি ইসলামের আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছে; জঙ্গিরা মুসলমান নয়, জঙ্গিদের কোনো ধর্ম নেই; ইসলাম ভিন্ন মতাবলম্বীদের সম্মান দিতে বলেছে, ইসলাম নারীদেরকে সম্মান দিতে বলেছে ইত্যাদি।’

দেশে ইসলামী জঙ্গিদের হাতে ভিন্ন ধর্মের কিংবা ভিন্ন মতাদর্শের কোনো মানুষ খুন হলেই উপরোক্ত কথাগুলো বলতে বলতে জিগির তোলে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে, মন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, কবি-কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পী, নাট্যকার-নাট্যনির্দেশক, নাট্যকর্মী, চিত্রপরিচালক, চিত্রকর, ভাস্কর, শিক্ষক, ছাত্র, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, খেলোয়াড়, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবি, বিজ্ঞানী, মাদ্রাসার কিছু হুজুর, মসজিদের কিছু ইমাম ইত্যাদি নানা শ্রেণি-পেশার মধ্যপন্থী মুসলমান। আমি ভাবি, এরা কি কখনও কোরান-হাদিস পড়েছেন? কেউ কেউ নিশ্চয় পড়েছেন, আবার কেউ কেউ পড়েননি। যিনি পড়েছেন তিনি উপরোক্ত কথাগুলো বলেন, আবার যিনি পড়েননি তিনিও উপরোক্ত কথাগুলো বলেন। বংশ পরম্পরায় এভাবেই চলে আসছে।

এই দেশের বেশিরভাই মানুষই অশিক্ষিত, তারা কোরান পড়েননি; এমনকি অনেক শিক্ষিত মানুষও কোরান-হাদিস তেমন পড়েননি; এরা ইসলাম ধর্ম সস্পর্কে যতোটুকু জেনেছেন তা পড়ে নয়, শুনে। জেনেছেন জুম্মাবারে খতিবের মুখের জ্বালাময়ী খুতবা শুনে, ইমাম কিংবা মাদ্রাসার হুজুরের কথা শুনে, কোরান-হাদিস পড়া পাড়ার কোনো মুরুব্বির মুখ থেকে আর ওয়াজ মাহফিলে মাওলানাদের মুখে পরমত বিদ্বেষী-বিধ্বংসী ওয়াজ শুনে! ফলে এরা যা শোনেন তাই বিশ্বাস করেন এবং বলেন, নিজেরা পড়ে কোরান-হাদিসের সত্য জানার সামর্থ্য বা তাগিদ এদের মধ্যে নেই। এদেরকেই বোধহয় বলে- ‘শুনে মুসলমান’!

কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী, বুদ্ধিজীবি থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি-পেশার যে সকল শিক্ষিত মধ্যপন্থী মুসলমান কোরান হাদিস পড়েছে বা পড়ে, তারা স্পষ্টভাবেই কোরান-হাদিসের অর্থ বোঝে, তারপরও তারা কোরান-হাদিসের প্রকৃত সত্য গোপন করে সচেতনভাবেই কোরান-হাদিসের অশান্ত-অসুস্থ আকাশে অবিরাম শান্তির পায়রা উড়ায়! এই মধ্যপন্থী মুসলমান দুই রকম চিন্তায় দুটি অংশে বিভক্ত- ছদ্ম মধ্যপন্থী এবং প্রকৃত মধ্যপন্থী। মধ্যপন্থার খোলসে চরমপন্থায় বিশ্বাসী ছদ্ম মধ্যপন্থীরা ছোটবেলায় মনের ভেতর প্রোথিত হওয়া কোরান-হাদিসের শিক্ষা উপেক্ষা করতে পারে না, প্রকাশ্যে শান্তির পায়রা উড়ালেও ভেতরে ভেতরে এরা জঙ্গিদের সমর্থক কেননা কোরান-হাদিস লব্দ বিশ্বাস তারা বুকে লালন করে; তবে এরা কখনোই অস্ত্রধারণ করে ময়দানে নামে না, এরা কেবলই জঙ্গিবাদের নীরব সমর্থক। আর প্রকৃত মধ্যপন্থীরা ভেতরে ভেতরে জঙ্গিবাদের সমর্থক নয়, তারা সত্যিই জঙ্গিবাদমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে; যদিও এদের অন্তরের গুপ্ত কোটরে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি কিছুটা বিদ্বেষ থাকে আর এরা চায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা মুসলমানদের পদানত হয়েই থাকুক, তবে তাদেরকে নির্যাতন করার কোনো প্রয়োজন নেই। কোরান-হাদিস পড়ে-বুঝেও এরা প্রতিনিয়ত নিজের সত্তার সঙ্গে, শিক্ষার সঙ্গে প্রতারণা করে ইসলামের আকাশে শান্তির পায়রা উড়িয়ে। বাংলাদেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবির মনোচারণা এই অংশে। এই কাজটি এরা করে সমাজে টিকে থাকার স্বার্থে। অন্য অনেক বিষয়ে এদের অগাধ জ্ঞান, বিস্তর পড়াশোনা, তত্ত্বের উপস্থাপন এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে নিপুণ; কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে বক্তৃতায় এবং গণমাধ্যমে তারা কথা বলেন অকাট মূর্খের মতো! অথচ এদের অনেকেই আবার ব্যক্তিগত আড্ডায়, ড্রয়িং রুম কিংবা ডাইনিং টেবিলের পারিবারিক আলোচনায় কোরান-হাদিস কিংবা ইসলামের ইতিহাসের প্রকৃত সত্য নিয়ে ঠিকই আলোচনা করেন; নিজের উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েকে সতর্ক করেন যাতে তারা ধর্মান্ধ না হয়, জঙ্গিবাদের প্রতি আকৃষ্ট না হয়।

কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমার বাবা মোটামুটি প্রকৃত মধ্যপন্থীর পর্যায়েই পড়ে, কিন্তু চাচা শতভাগ ছদ্ম মধ্যপন্থী।

দরজা খুলে হাতের মগটা ডাইনিং টেবিলে রেখে আমি ড্রয়িং রুমে গিয়ে বাবার মুখোমুখি সোফায় বসি যাতে বাবার মুখের অভিব্যক্তি দেখতে পাই। বসেই বলি, ‘কী হয়েছে বাবা?’

বাবা গম্ভীর মুখে বলেন, ‘জঙ্গিরা ঝিনাইদাহে একজন হিন্দু পুরোহিতকে হত্যা করেছে।’

‘বাহ্, রোজার প্রথম দিনেই হত্যার উদ্বোধন করে চাপাতিবাজরা সোয়াব কামিয়ে নিলো!’

বাবা আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় টিভির দিকে তাকান। আমি টিভির স্ক্রলে চোখ রাখি, ঝিনাইদাহে আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী নামে একজন পুরোহিতকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। গত পরশুদিনও নাটোরের মুদি দোকানদার সুনীল গোমেজকে কুপিয়ে হত্যা করেছে ইসলামী জঙ্গিরা। একের পর এক নিরীহ মানুষ খুন হচ্ছে, খুনিরা খুন করে পালিয়ে যাচ্ছে আর সরকারের স্টুপিড স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্যের শেষে আশার বাণী শুনিয়েই চলেছে, কিন্তু খুনিদের টিঁকিটিও ছুঁতে পারছে না র‌্যাব-পুলিশ।

বাবার উদ্দেশে বলি, ‘যখন জঙ্গিরা একের পর এক ব্লগার খুন করছিল, তখন তোমরা বলেছিলে ব্লগারা ইসলাম সম্পর্কে কটুক্তি করেছে, ব্লগারদের দোষত্রুটির বিশ্লেষণ করতে। এখন কী বলবে, সুনীল গোমেজ কিংবা আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী তো ইসলাম সম্পর্কে কটুক্তি করেননি; তবে তাদেরকে কেন খুন করলো ইসলামী জঙ্গিরা?’

বাবা আমার কথার শেষ অংশটুকু সম্পাদনা করে পুরোনো রেকর্ড বাজান, ‘ওরা ইসলামী জঙ্গি নয়, বিপথগামী জঙ্গি। ইসলাম মানুষ খুন করতে বলেনি। ইসলামের সঙ্গে ওদের কোনো সম্পর্ক নেই। ওরা মুসলমান নয়, ওরা জঙ্গি; জঙ্গিদের কোনো ধর্ম নেই!’

‘এটা তুমি ভুল বলছো বাবা, অবশ্যই ওদের ধর্ম আছে; ওদের ধর্ম ইসলাম, “আল্লাহু আকবর” বলেই ওরা ঘাড়ে চাপাতির কোপটা দেয়!’

‘আল্লাহু আকবর ব’লে মানুষ খুন করে বলেই ওরা মুসলমান নয়, কোরানের কোথাও আল্লাহ মানুষ খুন করতে বলেননি।’

‘আমি তোমাকে প্রচুর কোরানের আয়াত দেখাতে পারবো, যে আয়াতগুলোতে ইসলামে অবিশ্বাসী এবং বিধর্মীদেরকে হত্যা করার কথা বলা হয়েছে; আর হাদিস তো আরো বিধ্বংসী। তুমি দেখতে চাইলে আমি এখনই তোমাকে দেখাতে পারি।’

এবার বাবা খানিকটা অস্বস্তিতে, কিন্তু সহসাই অস্বস্তি কাটিয়ে বলেন, ‘বাংলা অনুবাদে কোরানের অনেক আয়াতেরই ভুল ব্যাখা করা হয়েছে। আরবি এমন একটা ভাষা যে অন্য ভাষায় তার অর্থ সঠিকভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।’

আমি মৃদু হেসে বলি, ‘বাবা, আমার ঘরে দুটো কোরান আছে। আমার কম্পিউটারে আরো দুটো কোরানের পিডিএফ ফাইল আছে। এই চারটে কোরান চারজন মানুষ অনুবাদ করেছেন; এদের মধ্যে তিনজন মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত। এই তিনজন মানুষ যে আরবি ভাষা ভালভাবে না জেনে কোরান অনুবাদ করেছেন আমার তা বিশ্বাস হয় না, এরা আরবি ভাষার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত, তাই এই ভাষাটা ভালমতো না জেনে এরা কোরান অনুবাদ করেছেন এটা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়। আর অন্যজন আমাদের দেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান; তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন, এরপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ইতিহাসে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর মতো একজন মানুষ কোরানের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং বিপদজনক গ্রন্থের ভুল ব্যাখ্যা করবেন এটা একেবারেই অসম্ভব। কোরানের ভুল ব্যাখ্যা করলে তিনি দেশে থাকতে পারতেন না এবং তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হতো না।’

বাবা ধমকের সুরে বলেন, ‘ধর্মের সুক্ষ্ণ তত্ত্ব কেবল বড়ো বড়ো আলেম-ওলামাই বুঝতে পারেন, যার-তার পক্ষে এসব বোঝা সম্ভব নয়। তোমার মতো বিপদগামী নাস্তিকদের স্বভাবই হলো ইসলাম ধর্মকে হেয় করা আর মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কথা বলা।’

আমার বাবার মতো মধ্যপন্থী মুসলমানরা কিছুতেই বুঝতে পারেন না অথবা বুঝতে চান না যে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেই ইসলামের জন্ম এবং বিস্তার হয়েছে। মুহাম্মদ কোরাইশদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছিলেন তাদের তিনশো ষাটটি মূর্তি ভেঙে এবং তাদেরকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে; ইহুদিদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছিলেন, আরবের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতি, রীতি-নীতি আর সংস্কৃতিতে আঘাত করেছিলেন। আমরা নাস্তিকেরা কলম দিয়ে ধর্মকে আঘাত করি; কখনোই কোনো ধার্মিককে শারীরিকভাবে আঘাত করি না, ধার্মিকদের ধর্মানুষ্ঠানে বাধা দিই না। কারণ আমরা ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করি যে অন্যদের বিরক্ত না করে মানুষের ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চয় আছে। আমরা কোনো প্রাচীর নই, আমরা উন্মুক্ত তেপান্তর। আমরা কেবল ধার্মিকের অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে বিজ্ঞান এবং যুক্তির আলো ফেলতে চাই। আমাদের আলো গ্রহণ করা বা না করা ব্যক্তির নিজস্ব স্বাধীনতা। কিন্তু মুহাম্মদ আরবের মানুষকে শারীরিকভাবে আঘাত করেছিলেন। হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর পরবর্তীতে মুহাম্মদের সাগরেদরা তার বিধ্বংসী মতবাদের প্রচার-প্রসারে সশস্ত্র আগ্রসন চালায়- অবশিষ্ট আরব, ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ওপর; একের পর এক নগরে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, বিপন্ন করে জনজীবন। মুসলমানদের অস্ত্রের মুখে কেউ হয় ধর্মান্তরিত, কেউবা অস্ত্রের আঘাতে হয় লোকান্তরিত, ধুলিস্যাৎ হয় মানবতা; অবলুপ্ত হয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ধর্ম, বিশ্বাস, সংস্কৃতি। কিন্তু এই সত্য কথাগুলো যদি আমি বাবাকে বলি তাহলে বাড়িতে যুদ্ধের আবহ তৈরি হবে, এমনিতেই আজ থেকে রোজা শুরু হওয়ায় এদের অন্তরে টগবগ করে ফুটছে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য!

ফলে আমি আর সেই ইতিহাস না তুলে শুধু বলি, ‘বাবা, ধার্মিকরাও কিন্তু নাস্তিকদের সমালোচনা করে, গালাগালি করে; কিন্তু নাস্তিকরা তার জবাব অস্ত্রের মাধ্যমে নয়, দেয় কলমের মাধ্যমে। পৃথিবীতে আরো অনেক ধর্মের সমালোচনা হয়, কিন্তু কোনো ধর্মের মানুষই মুসলমানদের মতো চাপাতি দিয়ে মানুষ হত্যা করে না।’

বাবা কিছু বলতে যাবে, এরই মধ্যে দাদী এসে হাজির, ‘অই তুই আমার পোলারে কী উল্টা-পাল্টা বুঝাস!’

আমি দাদীর উদ্দেশে বলি, ‘তোমার পোলারে আমি আর কী বুঝামু, ছোটবেলায় যা বুঝাইয়া দিছো তাতেই আর সব বুঝার রাস্তা বন্ধ! যাই, তোমার সাথে এখন আমার ঝগড়া করার ইচ্ছে নাই।’

আমি উঠে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াই দাদীর কথা শুনতে শুনতে, ‘আমার পোলা তর মতো নাস্তিক নি, ধর্ম-কর্ম নাই, সমাজ নাই, আত্মীয়-কুটুম নাই, যহন দোজখে যাবি তহন বুঝবি!’

দাদী বলতেই থাকেন। ঘরে এসে বারান্দায় চোখ পড়তেই দেখি রেলিংয়ে একটা কবুতর বসে ঘরের দিকে উঁকি-ঝুঁকি মারছে, নিশ্চয় আমাকে খুঁজছে! আমার পোষা কবুতর। আমি রান্নাঘরে গিয়ে বাটিতে কিছু চাল নিয়ে দরজা খুলে পা বাড়াই ছাদের উদ্দেশে্য।

এই কবুতর পোষা নিয়েও কী আমাকে কম লড়াই করতে হয়েছে! বছর তিনেক আগে বাবাকে কবুতর পোষার কথা বলতেই বাবা বলেন, ‘তোমার চাচা যদি অনুমতি দেয় তো পোষো, আমার কোনো আপত্তি নেই।’

চাচাকে বলতেই চাচার সাফ জবাব, ‘বাড়িতে কবুতর পোষা যাবে না। কবুতরের বিষ্ঠায় ছাদ নোংরা হবে, বারান্দার রেলিংয়েও উড়ে এসে বসবে, মলত্যাগ করবে। আর বাড়িতে পশুপাখির মলমূত্র ছড়ানো থাকলে সে বাড়িতে ফেরেশতা আসে না। অবশ্য সে-সব তোমার বোঝার কথা না।’

উহ, ফেরেশতা, ফেরেশতা, ফেরেশতা! উঠতে বসতে এদের মুখে শুধু ফেরেশতা। সারা পৃথিবীতে দেড়শো কোটির বেশি মুসলমানের কোটি কোটি বাড়ি, সে-সব বাড়িতে না গিয়ে এই বাড়িতেই যেন ফেরেশতা ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছে! আমি আর কবুতরের বিষয়ে কোনো কথা বলিনি। চুপচাপ একদিন ঘরসহ তিন জোড়া কবুতর কিনে নিয়ে আসি, ছাদের পশ্চিমদিকে খাড়া করি কবুতরের ঘর।

অফিস থেকে ফিরে আমার কবুতর কেনার কথা শুনে চাচা নিজের ঘরে আর ড্রয়িং রুমেই হম্বিতম্বি করেছিলেন, সে-সব আমার কানেও এসেছিল। এ বিষয়ে বাবা-মা কিংবা দাদীর সাথে তার কোনো আলাপ হয়েছিল কিনা আমি জানি না। তবে আমাকে আর চাচা কিছু বলেননি, বাবাও না। মা শুধু বলেছিলেন, ‘তোর চাচার আপত্তি সত্ত্বেও কবুতর আনতে গেলি ক্যান? তোরে তো কথা শুনতে অয় না, শুনতে অয় আমাগো।’

ব্যাস ওই পর্যন্তই। এই তিন বছরে আমার কবুতরের বহর বেড়েছে, এখন ত্রিশটার বেশি। এই তিন বছরে সত্যিই আমি বাড়িতে ফেরেশতা দেখিনি, যেমন দেখিনি তার আগেও!

আমি ছাদে উঠা মাত্র আমার হাতে বাটি দেখে কবুতরগুলো বাকবাকুম করতে করতে চঞ্চল হয়ে উঠে। ছাদের নিচু টুলটায় বসতেই ওরা ওদের ঘর আর রেলিং ছেড়ে নিচে নেমে আসে। আমি কিছু চাল ছড়িয়ে দিই আর কিছু নিই হাতের তালুতে। কিছু কবুতর ছাদের ছড়ানো চাল খুঁটে খায়, আর কিছু প্রায় আমার কোলের মধ্যে এসে হাত থেকে খায়। আমি হাত ক্রমশ কাছে টেনে আনি, কোলের কাছে নিয়ে খাওয়ালেও ওরা আমাকে ভয় পায় না। হাতের তালুতে ওদের ঠোঁটের ঠোক্কর আমি ভীষণ উপভোগ করি। কবুতরগুলোকে খাওয়াতে খাওয়াতে আমার একটা গল্প মনে আসে-

‘পড়ন্ত বিকেলে সদ্য ধান কাটা ক্ষেতে একদল কবুতর কণ্ঠে বাকবাকুম সুর তুলে নেচে নেচে ঝরে পড়া পাকা ধান খুঁটে খেতে থাকে। কখনো একে অন্যের সাথে খুনসুটি করে, কখনোবা কোনো দুষ্টু সঙ্গীর দুষ্টুমি থেকে রেহাই পেতে উড়ে গিয়ে বসে অন্য জায়গায়। আর এই ক্ষেতেই একাধিক ফাঁদ পেতে সামান্য তফাতে বসে থাকে এক নিষ্ঠুর শিকারি। নাচতে নাচতে খেতে খেতে একটা কবুতর হঠাৎ শিকারির ফাঁদে আটকা পড়ে ঝাপটাঝাপটি করতে থাকে। তা দেখে আতঙ্কিত অন্য কবুতরগুলো উড়ে দূরে গিয়ে পুনরায় খেতে আরম্ভ করে। তবে এবার তারা বেশ সতর্ক। এরই মধ্যে শিকারি দ্রুত ছুটে গিয়ে ফাঁদে আটকা পড়া কবুতরটাকে ধরে, তারপর হাতের ছুরি দিয়ে আড়াই পোচে কবুতরের গলাটা কেটে ফেলে। রক্তাক্ত কবুতরটি কিছুক্ষণ ঝাপটাঝাপটি করে শিকারির হাতের মধ্যে, অল্পক্ষণ পরই তার প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ায় চিরতরে থেমে যায় ডানার চপলতা।

এরই মধ্যে সতর্ক থাকা সত্ত্বেও ক্ষেতের অন্য প্রান্তে আরেকটি কবুতর ফাঁদে আটকা পড়ে। যথারীতি শিকারি ছুটে গিয়ে কবুতরটিকে ধরে একইভাবে জবাই করে। তারপর ক্ষেতের অন্য প্রান্তে আরেকটি…।

সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যটি অবলোকন করে একজন মানুষ। নৃত্য করতে করতে কবুতরদের ধান খুঁটে খাওয়া তিনি বেশ উপভোগ করছিলেন; আবার শিকারির হাতে কবুতরগুলোর জবাই হওয়াও দেখেন নীরবে দাঁড়িয়ে, তারপর কবুতরগুলো নৃত্য করতে করতে কী ভুল করেছিল সেই বিষয়ে তিনি ভাবতে থাকেন। এখন প্রশ্ন হলো মানুষটি কে?

উত্তর- একজন মডারেট বা মধ্যপন্থী মুসলমান।



(চলবে….)

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই জুলাই, ২০২০ রাত ৯:০২

রাজীব নুর বলেছেন: পোষ্টে ধর্ম নিয়ে অনেক কথা বলেছেন।
অনেকেই ধর্ম নিয়ে আপনার সাথে একমত হবেন না।

১৭ ই জুলাই, ২০২০ রাত ৯:৪৭

মিশু মিলন বলেছেন: একমত হবে না জেনেও লিখেছি। কাউকে না কাউকে সত্য উন্মোচন করতেই হয়।

২| ১৭ ই জুলাই, ২০২০ রাত ৯:২৬

নেওয়াজ আলি বলেছেন: ধর্মের বিপক্ষে লিখলে কি লাভ পান।

১৭ ই জুলাই, ২০২০ রাত ৯:৪৪

মিশু মিলন বলেছেন: লাভ-লোকসানের বিষয় নয়; অন্ধ বিশ্বাস, মিথ্যা আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লেখাই বিজ্ঞান মনস্ক এবং মানবিক মানুষের কাজ।

৩| ৩১ শে জুলাই, ২০২০ দুপুর ২:৫২

সাহাদাত উদরাজী বলেছেন: থেমে থেকে টেনে টেনে পড়লাম। কিছু বুঝেছি কিছু বুঝি নাই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.