নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

জন্মান্তর (উপন্যাস: পর্ব-তেরো)

০২ রা আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৫:১১

সাত



ক্লাস নেই, ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে। সকালে উঠার তাড়া না থাকলেও দেহঘড়ি যথাসময়েই জাগিয়ে দিয়েছে। আলসেমি করে বিছানায় শুয়ে না থেকে সকালটা প্রাতঃভ্রমণ আর প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটানোর জন্য উঠে পড়ি। বেশিরভাগ ছুটির দিনেই প্রাতঃভ্রমণে যাই বোর্টানিক্যাল গার্ডেনে, বাসা থেকে রূপনগরের ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলে একুশ-বাইশ মিনিট লাগে।

ছয়টা দশ বাজে। বাবা বাদে বাকিরা সেহেরি খাওয়ার পর নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়েছে, বাবা নামাজ পড়ার পর আর ঘুমান না। আমি ট্রাউজার আর সাদা টি-শার্টটা পরে মানিব্যাগ থেকে শ’খানেক টাকা পকেটে নিয়ে ব্যাগে এক বোতল ঠান্ডা জল ঢুকাই, তারপর কেডস্ এ পা গলিয়ে ব্যাগটা পিঠে ফেলে বাবাকে দরজা লাগাতে বলে নিচে নামি।

জনশূন্য গলি, একটুও বাতাস নেই, ওপর থেকে নিচে নামতে নামতেই ঘমতে শুরু করেছি। সেই রোজার প্রথমদিন বিকেলে একটু বৃষ্টি হয়েছিল, তারপর থেকে আবার টানা খরা চলছে। রোজার প্রথমদিন বৃষ্টি হওয়ায় আমার মা আর মেজো ফুফু আলাপ করছিলেন আল্লাহ’র কুদরতের কথা নিয়ে। মা বলেন, ‘আল্লাহ মহান, আল্লাহ দরদী; নইলে এতোদিন বৃষ্টির দেখা নাই, আর রোজার প্রথম দিনেই রোজদারদের কষ্টের কথা চিন্তা কইরা তিনি উদার হস্তে পানিবর্ষণ করলেন। গরমে কষ্ট দিয়ে তিনি তার বান্দাগো পরীক্ষা নেন।’

মেজো ফুফু মায়ের কথায় সায় দেন, ‘আল্লাহ’র ঠিকই দয়া আছে, মানুষই তারে ডাকার মতো ডাকতে পারে না।’

মা ভবিষ্যৎবাণী করেন, ‘আর বেশি গরম পড়বো না দেইখো। আল্লাহ তার বান্দাগো আর কষ্ট দিবো না। বৃষ্টিও অইবো।’

রোজার দ্বিতীয় দিন সকাল থেকেই আবার সেই আগের মতো গরম পড়তে শুরু করেছে। ফ্যানের নিচে বসে থাকলেও গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝরে। দয়ালু আল্লাহ’র কুদরত বটে!

বাজাররোড ধরে উত্তরদিকে হাঁটতে শুরু করি। রোজার মাসের সকালবেলার রাস্তার চিত্র অন্য সময়ের চেয়ে ব্যতিক্রম। স্কুল-কলেজ বন্ধ, রান্নার ঝামেলা নেই বলে মানুষও একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে, রাস্তায়ও এর প্রভাব পড়ে। অন্য সময়ে গলিগুলোতে যারা প্রাতঃভ্রমণ করে এ মাসে তাদেরও দেখা যায় না। অন্য সময়ে রাস্তার পাশের ছোট ছোট হোটেলগুলো এতোক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, বাতাসে ভেসে আসে পরোটা, ডিমভাজা আর পোড়া তেলের মিশ্রিত গন্ধ; কিন্তু রমজান মাস হওয়ায় এখনো হোটেলগুলো খোলাই হয়নি।

বাজাররোড পেরিয়ে মিল্কভিটা রোডে পৌঁছে বাঁ-দিকের চলন্তিকা মোড়ের দিকে হাঁটতে থাকি। বেগম রোকেয়া সরণী থেকে শুরু হয়ে ৬নং এবং ৭ নং সেকশনকে বিভক্ত করে চলন্তিকা মোড়ের কাছে এসে ঈষৎ বেঁকে প্রশিকা মোড় হয়ে শের-এ-বাংলা ন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে মিরপুর রোডের ২ নং বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে শেষ হয়েছে মিল্কভিটা রোড। চলন্তিকা মোড় থেকে ৭ নং সেকশনের ভেতর দিয়ে যে এক লেনের রাস্তাটা চলে গেছে সেটার নামও মিল্কভিটা রোড। পণ্যের নামে রাস্তার নাম হয় কী করে বুঝি না! অথচ একাত্তর সালে এই মিরপুরেই কতো রক্তাক্ত-বিয়োগান্তক ঘটনার জন্ম হয়েছে, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা-বুদ্ধিজীবিদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, বদ্ধভূমিও আছে মিরপুরে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বা বুদ্ধিজীবিদের নামে মিরপুরে রাস্তার নামকরণ খুব বেশি চোখে না পড়লেও মিল্কভিটার নামে রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে!

চলন্তিকা মোড় থেকে ৭ নং সেকশনের এক লেনের মিল্কভিটা রোডে ঢুকতেই রাস্তায় দাঁড়ানো একটা পুলিশভ্যান চোখে পড়ে। পিছনে বসা চারজন পুলিশ বেঘোরে ঘুমোচ্ছে, চালকও ডানদিকে মাথা এলিয়ে দিয়ে অচেতন। জনগণকে রক্ষা করবে কী এরা? এখন তো নিজেদের রক্ষা করার অবস্থায়ও নেই! এখন যদি জঙ্গিরা এসে অতর্কিত হামলা চালায় তো জেগে উঠার পরিবর্তে মহাঘুমের দেশে পাড়ি দেবে এরা। আজকাল পুলিশ-সেনাবাহনীর সদস্যদের ওপর অতর্কিত হামলা করছে জঙ্গিরা। কিছুদিন আগে মিরপুর বেড়িবাঁধে পুলিশের অস্ত্র কেড়ে তাদের ওপর হামলা চালিয়ে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করে আর বাকিরা তাকে ফেলে যার যার জীবন নিয়ে পালায়। কচুক্ষেতে একজন সেনাসদস্যকে কুপিয়ে আহত করে। এরকম ঘটনা এখন হরহামেশাই ঘটছে। সেনা সদস্যদের চেয়ে বেশি বিপদে আছে পুলিশ কনস্টেবলরা। কারণ তাদেরকে বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় রাস্তায় ডিউটি করতে হয়, কিছু বুঝে উঠার আগেই মোটরবাইকে এসে হামলা করে পালিয়ে যায় জঙ্গিরা। কিন্তু এই ঘুমন্ত পুলিশদের দেখে কে বলবে যে দেশ এখন এক ক্রান্তিকাল পার করছে আর তারা নিজেরাও অবস্থান করছে বিপদসীমায়!

পরশুদিন সন্ধ্যায় দেখলাম ১৩ নম্বর সেকশনের রাস্তার মোড়ের একটা বেঞ্চে পাঁচজন পুলিশ বসে আছে আর একজন দাঁড়িয়ে। মেহগনি গাছের সঙ্গে অস্ত্র ঠেকিয়ে রেখে এই ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনই মোবাইল ঘাটছে। আড়চোখে দু-জনের মোবাইল স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখি তারা ফেসবুকিং করছে। এভাবেই তারা জঙ্গিদের আক্রমণের কাজটি আরো সহজ করে দিচ্ছে আর বিপন্ন করছে নিজেদের জীবন।

এদেরকে জাগিয়ে সতর্ক করাও বিপদ। নানা প্রশ্নে জর্জরিত করে কী প্যাঁচ লাগাবে কে জানে! আমি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকি তাদের দিকে; একজন তো রীতিমতো নাক ডাকছে, অন্য একজন তার পাশের জনের কাঁধে প্রেমিকের মতো মাথা এলিয়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে! পুলিশভ্যান পাশ কাটিয়ে আমি এগোই আমার পথে।

মিল্কভিটা রোড ছেড়ে বাঁ-দিকে রূপনগরের ৫ নং রোডে ঢুকে পড়ি, রাস্তার পাশের চায়ের দোকানগুলোতে যে ছোট ছোট জটলা চোখে পড়তো তা এখন নেই। আবাসিক মোড়ে এসে অফিসযাত্রী মানুষের কিছুটা ব্যস্ততা চোখে পড়ে, যাত্রীর অপেক্ষায় বাসগুলো থেকে থেকে গজরায়। মুদি দোকান, ফ্লেক্সিলোডের দোকানসহ কিছু দোকান খুলেছে। সাতসকালে যেসব দোকানে ক’দিন আগেও বাজতে দেখেছি হিন্দি কিংবা অন্য বাংলা গান, সেসব দোকান থেকেই এখন ভেসে আসছে ওয়াজ কিংবা ইসলামী গানের সুর; অধিকাংশ দোকানদারের মাথায়-ই টুপি, দোকানে একটা সহি আবহ সৃষ্টির প্রচেষ্টা!

আবাসিক মোড় থেকে ডানে এগিয়ে বাঁ-দিকের ২৩ নং রাস্তায় ঢুকে পড়ি, এমন পাকা রাস্তার চেয়ে মাটির রাস্তাও ভাল; পিচ নেই বললেই চলে, লাল ইটের বুক বেরিয়ে আছে; জায়গা বিশেষে গভীর প্রশস্ত গর্ত, বর্ষায় হাঁটুজল হয় এখানে, সামান্য বৃষ্টিতেও প্যান্ট গুটাতে হয়। পায়ের তলাটা বাদ দিলে এই রাস্তাটা আমার ভাল লাগে, সুনসান, গাছপালাও আছে বেশ। গলি ধরে এগোলেই বোর্টানিক্যাল গার্ডেনের আভাস অনুভব করা যায় শরীরে। রাস্তা লাগোয়া আলিশান মসজিদটা থেকে ভেসে আসা সুরে কান পাতি হাঁটতে হাঁটতেই, একজন হুজুর কোরান শরীফ পড়ছে। এই রাস্তার শেষ মাথায় রূপনগর খাল, খালের ওপর পুল, পুল পেরোলেই নিচু পথ ধরে মিনিট খানেক এগোলেই বোর্টানিক্যাল গার্ডেনের গেট। খালের এপাশে রাস্তার দু-দিকে দুটো মাদ্রাসা এবং এতিমখানা। বাঁ-দিকে বিল্ডিংয়ের নিচতলায়, জামিয়া আশরাফিয়া ঢাকা মাদ্রাসা ও এতিমখানা; আর ডানদিকে রাস্তার ঢালে নিচু জায়গায় ইটের গাঁথুনির ওপর টিনের ছাউনি দেওয়া নূরুল কুরআন মাদ্রাসা ও এতিমখানা। এখানে এসে বরাবরই আমি কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াই; ডানে-বায়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি দু-পাশের মাদ্রাসার ছেলেগুলোকে। ওরা সামনে-পিছনে মাথা এবং শরীর দুলিয়ে ওদের প্রিয় সহি কিতাব পড়ে। কওমি মাদ্রাসার বইয়ে সুক্ষ্ণভাবে সাম্প্রদায়িকতা, অন্যধর্মের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ এবং ধ্বংসাত্বক জিহাদী চেতনা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়; ক্লাসে পড়ানোর সময় হুজুররা এই বিষয়গুলো আরো বিশদে এবং খোলামেলাভাবে আলোচনা করে; ছোট থেকেই হুজুররা শিশুদের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় সাম্প্রদায়িকতার বিষ, অন্য ধর্মের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ ও ভিন্নমত নির্মূলের ফজিলত এবং প্রয়োজনে জিহাদের মাধ্যমে নিজের জীবন উৎসর্গ করার বীজমন্ত্র। মাদ্রাসায় অলিখিতভাবে জাতীয় সঙ্গীত নিষিদ্ধ, ছাত্ররা জাতীয় সঙ্গীতের দুটো লাইনও গাইতে পারে না; দেশের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে তারা প্রায় কিছুই জানে না, জানে ইতিহাস এবং সংস্কৃতিকে ঘৃণা করতে!

মাদ্রাসার বইয়ের বাইরে অন্য কোনো বই তাদের পড়তে দেওয়া হয় না, ইসলামী গানের বাইরে অন্য কোনো গান শুনতে দেওয়া হয় না, খবরের কাগজ পড়তে দেওয়া হয় না; সৃজন-মননের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে তাদেরকে গড়ে তোলা হয় মানুষরূপী বিশেষ ইতরপ্রাণি হিসেবে! এখন দেশের প্রতি তিনজন শিক্ষার্থীর একজন মাদ্রাসায় পড়ে, মানে এক তৃতীয়াংশ, যা বিপুল সংখ্যক জনশক্তির অপচয়। অথচ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলে এরা হতো দেশের সম্পদ, কিন্তু হয়ে উঠছে বিপদ!

একেকটি শিশু-কিশোরের দিকে তাকাই আর আমার বুক থেকে ঝরে পড়ে দীর্ঘশ্বাস। কী মায়ামাখা নিষ্পাপ ওদের চেহারা, কী সরল ওদের চাহনি, কী নিষ্ঠা ওদের পাঠে; অথচ উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সকল সম্ভাবনাকে গলা টিপে মেরে ওদের জীবনের কী বাজে অপচয় হয়! এমন সাদা পাতার মতো ওদের হৃদয়, এমন সুন্দর কোমল ওদের মুখ, এমন নরম ওদের হাত; অথচ ওই সাদা পাতা একদিন ভরে উঠবে বিদ্বেষ এবং হিংস্রতার কদর্য দাগে, ওই কোমল মুখে ফুটে উঠবে নিষ্ঠুরতার কঠোর-কঠিন রেখা, ওই নরম হাতের আঙুল আজ আদর বুলিয়ে চলেছে ভিনদেশী বর্ণমালার ওপর কিন্তু একটু পোক্ত হলেই ওই বর্ণমালার প্রভাবে আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরবে রক্তলোলুপ চাপাতি, মানুষ হত্যা করতে ওদের বুক একটুও কাঁপবে না!

ওদের দিকে তাকালে আমি এক অদ্ভুত ঘোরে ঢুকে আমার শৈশবে ফিরে যাই, আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ওদের প্রত্যেকের ভেতরে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। যেন আমার ছেড়ে আসা শৈশবের জরাজীর্ণ খোলসে ঢুকে বসে আছে ওরা, কিন্তু আমার মতো বেরিয়ে আসতে পারছে না। আমার জীবনও তো ওদেরই মতো বাজে খরচের খাতায় লেখা হয়েছিল, সারাটা জীবন হয়তো অপচয় হতো যেমনি হচ্ছে ওদের ওই বয়স্ক হুজুরের। আমাকে মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনের একটা আলিশান মাদ্রাসায় ভর্তি করে রেখে এসেছিলেন আমার চাচা। উহ্, সে কী দুঃসহ জীবন! টিভিতে কার্টুন দেখতে পারতাম না, ক্রিকেট খেলা দেখতে পারতাম না, গলির মধ্যে ক্রিকেট খেলতে পারতাম না, সাইকেল চালাতে পারতাম না, যখন-তখন আইসক্রিম কিংবা পছন্দের কোনো খাবার খেতে পারতাম না, মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে পারতাম না! ঘুমে চোখ খুলতে না চাইলেও ভোর চারটেয় জোর করে তুলে দিতো হুজুররা। হাতমুখ ধুয়ে, ওযু করে দল বেঁধে নামাজ পড়তাম। তারপর দল বেঁধেই পড়তে বসতাম। আমি ছোটবেলায় বেশ চুপচাপ ধরনের ছিলাম বিধায় চিৎকার করে সবার সঙ্গে পড়তে আমার খুব কষ্ট হতো, কানে যেন তালা লেগে যেতো। নিজের পড়ার কথা ভুলে আমি অন্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর সেই অপরাধে হুজুর আমার দু-হাতের তালুতে বেত দিয়ে বারি দিতো। আর পড়বো কী! প্যাচানো আরবি ভাষা সহজে আমার মাথায় ঢুকতো না, বারবার ভুলে যেতাম। একদিন ভোরবেলায় স্বপ্ন দেখেছিলাম যে আরবি বর্ণগুলো সাপ হয়ে আমাকে পেঁচিয়ে ধরে আমার মুখের কাছে জিভ নাড়ছে আমাকে খাবার জন্য, আর আমি সাপের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছি না। শেষে একসময় ‘মা’ বলে চিৎকার করে উঠি।

বাবা-মা আমাকে দেখতে গেলে আমি তাদের সঙ্গে বাসায় ফেরার জন্য কান্নাকাটি করতাম মাকে আঁকড়ে ধরে। মায়ের বোরকা কামড়ে-খাঁমচে ধরে কাঁদতাম; কিন্তু কোনো ফল হতো না, আমাকে রেখেই বাবা-মা ফিরে আসতেন। আমি কথা একটু কম বলতাম বলে কারো সঙ্গে আমার তেমন বন্ধুত্ব হয়নি, আমি কেবলই মুক্তির আশায় ছটফট করতাম কিন্তু মুক্তি মিলতো না।

বিকেলে যখন মাদ্রাসার ছেলেরা মাঠে হই-হুল্লোর করতো তখন আমি মনমরা হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমাকে একলা থাকতে দেখে হাফিজুদ্দিন হুজুর একদিন ডেকে বলে, ‘তুমি এমন মনমরা হইয়া থাকো কেন? যাও ওগো সাথে খেলা করো।’

আমি না-সূচক ঘাড় নাড়ি। একদিন হাফিজুদ্দিন হুজুর আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যান তার ঘরে। কোলে বসিয়ে আমার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘বাড়ির লাগি পরান দাপায়?’

‘আমি হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নাড়ি।’

‘আল্লাহ’র পথে থাকতে হলে এট্টু কষ্ট তো অইবোই। তয় যহন বেহেশতে যাইবা তহন আর কোনো কষ্ট থাকবো না। খালি সুখ আর সুখ। পরকালের সেই সুখ পাইতে অইলে ইহজগতে এই কষ্ট করন লাগবো। শোনো, তোমারে যদি কেউ কিচ্ছু কয়, কেউ যদি তোমারে মারে আমারে কইবা। আমি তারে চরম শাস্তি দিমু।’

আমি ঘাড় নাড়ি। হুজুর কেমন করে যেন আমার গায়ে হাত বুলায়, চুলে হাত বুলায়, মুখে আঙুল বুলায়। আমার পেটের কাছে হাত দিয়ে তার কোলের আরো কাছে টেনে নেয়।

‘বড়ো বালা পোলা তুমি। আরেকটু বড়ো অইলে তুমি অইবা আমার প্রিয় গেল…, সেবক অইবা সেবক। তোমার কিছু দরকার অইলে আমার কাছে চাইবা।’

আমি প্রশ্ন করি, ‘সেবক কী হুজুর?’

‘সেবক অইলো গিয়া হুজুরের প্রিয় বালক, হুজুর যা কইবে সেবকরে তাই শুনতে অইবে। হুজুরের সব কতা মাইন্য করলে সেবক বেহেশতে যাইতে পারবে। তুমি আমার সেবক অইলে বেহেশতে যাইতে পারবা। তারপর বেহেশতে যাইয়া তুমিও সেবক পাইবা, তাহারা তোমার সেবা করিবে।’

বলে আর আমার মাথায় মুখ ঘষে হুজুর। আমি মনে করি হুজুর আমাকে আদর করছে, আমার বাবা-মাও তো কোলে বসিয়ে আমাকে আদর করেন। হুজুরের গরম নিঃশ্বাস পড়ে আমার মাথায়, ঘাড়ে, গালে; তার বুক ঘনঘন ওঠা-নামা আর দুই ঊরু অস্বাভাবিক নড়াচড়া করে। হুজুর আমার পিঠের সাথে তার বুক আর কোলের সাথে পাছা চেপে ধরে। একহাত দিয়ে আমার মাথায় আদর বুলায় আরেক হাত আমার পাঞ্জাবির নিচে ঢুকিয়ে পেটে আদর করতে করতে গালে চুমু খেয়ে বলে, ‘বড়ো বালা পোলা তুমি, বড়ো সুন্দর পোলা। তোমারে বালা কইরা পড়া শিহামু, তুমি যা চাইবা আমি তোমারে তাই দিমু।’

একসময় হুজুর আরো জোরে তার শরীরের সঙ্গে আমাকে চেপে ধরে, তারপরই তার দুই ঊরু শান্ত হয়, তার বুকের ঘনঘন ওঠানামা ক্রমশ থিতিয়ে আসে, কিছুক্ষণ পর আমাকে তার কোল থেকে নামিয়ে শেষবারের মতো আমার কপালে চুমু খেয়ে বলে, ‘যাও, অহন খেলা করো গিয়া। বড়ো বালা পোলা। কুনো দরকার পড়লে আমার কাছে চইলা আইবা। আর তুমি যে আমার সেবক অইবা এই কতা কাউরে কইবা না, সেবক হওনের খবর কাউরে জানাইলে ফেরেশতা বেজার হন, সে আর বেহেশতে যাইতে পারে না।’

বলে আমার গাল টিপে দেয় হুজুর। আমি হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নেড়ে চলে আসি। এরপর আরো কয়েকদিন আমাকে এভাবে আদর করেছিল হুজুর। আমি তখন তার সেই আদরের মানে বুঝিনি, তবে এ ধরনের আদর আমার ভাল লাগতো না। বিশেষ করে হুজুর যখন আমার পাঞ্জাবির নিচে হাত ঢুকিয়ে বুকে-পেটে তার হাত ঘষতো আর আমার গালে চুমু খাওয়ার সময় হুজুরের তারের মতো শক্ত দাড়ির খোঁচা লাগতো মুখে, তখন খুব অস্বস্তি লাগতো।

এরপর একদিন রাতে আমি প্রসাব করতে বেরিয়ে দেখি সপ্তম শ্রেণির এক বড় ভাই ছাদের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সে সিঁড়ির রেলিংয়ের আড়ালে চলে যায়। আমার মনে প্রশ্ন জাগে, এতো রাতে কোথায় যায় সে? ছাদে? কিন্তু ছাদের গেটে তো তালা দেওয়া থাকে যাতে ছাত্ররা উঠতে না পারে! নাকি ছাদের গেট খুলে দিয়েছে কিন্তু আমি জানি না? ভাবতে ভাবতে আমি প্রসাবখানায় ঢুকে প্রসাব করি। বের হয়ে আবার তাকাই সিঁড়ির দিকে, তাকে দেখতে পাই না। নাকি ভুল দেখেছি আমি? কোনো জিন নাতো? হুজুররা তো বলে যে আমাদের চারপাশে গায়েবী জিন ঘুরে বেড়ায়! এমনটা হওয়া কি সম্ভব যে জিন বড়ো ভাইয়ের রূপ ধারণ করেছে? কী জানি! ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, আমি দ্রুত ঘরে এসে আমার বিছানায় শুয়ে পড়ি। অন্ধকারে অন্যদের দিকে তাকাই, সবাই ঘুমে অচেতন। আমি জিনকে ভুলে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করি, তবু মনের আয়নায় ভেসে ওঠে যে জিন বড়ো ভাইয়ের রূপ ধরে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে!

সেই ঘটনার পর থেকে মাঝরাতে প্রসাব চাপলে আমি চেপে রাখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু কতোক্ষণ আর চেপে রাখা যায়, আমাকে বের হতেই হতো। ভয়ে ভয়ে আমি বের হয়ে কোনো রকমে প্রসাব করেই প্রায় দৌড়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়তাম। কিছুদিন পর একরাত্রে আমি প্রসাব করতে উঠেছি, বারান্দায় পা রাখতেই দেখি সেই বড়ো ভাই তাদের ঘর থেকে বের হয়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছে। আমি আমার শরীরটা ঘরের ভেতরে নিয়ে এসে কেবল মুখটা বের করে উঁকি দিয়ে তাকে দেখতে থাকি। জিন হলে ঘর থেকে বের হবে কেন? ভয়ও লাগে আবার কৌতুহলও জাগে। বড়ো ভাই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে মিলিয়ে গেলে আমি বারান্দায় বের হয়ে আস্তে আস্তে পা ফেলে প্রসাবখানায় যাই। প্রসাবখানা থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াই। ওপরে উঠে দেখবো কী দেখবো না ভাবতে থাকি। বুকের মধ্যে ধুকপুক করে, তবু সাহস করে ধীর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকি। পিছনে তাকিয়ে দেখি কেউ আমাকে দেখছে কি না; না, কাউকে দেখতে পাই না। সিঁড়ির অর্ধেক উঠে ছাদের দরজার দিকে তাকিয়ে আমি তো অবাক, গেট খোলা! অথচ গেট লাগানো থাকে যাতে ছাত্ররা ছাদে উঠতে না পারে। আমি আবার ধীর পায়ে সিঁড়ির বাকি অর্ধেক উঠে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াই আর তখনই অস্পষ্ট নিচু গলার স্বর আমার কানে ভেসে আসে। আমি শরীরটা ভেতরে রেখে মুখ বাড়াই ছাদের দক্ষিণদিকে, হালকা চাঁদের আলোয় আমি প্রায় স্পষ্ট দেখতে পাই ছাদের ওপর পাতা একখানা কাপড়ের ওপর দু-জন মানুষের সম্পূর্ণ নগ্ন শরীর, একজনের শরীর বড়ো আর আরেকজনের ছোট; ছোট মানুষটা দুই হাঁটু আর দুই হাত ছাদে ঠেকিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঘাড় সামান্য উঁচু করে আছে আর হাঁটু মুড়ে বসার ভঙ্গিতে বড়ো মানুষটা দুই হাতে ছোট মানুষটার কোমর ধরে তার পাছার কাছে নিজের কোমর প্রবলভাবে নড়াচড়া করছে! হামাগুড়ি দেওয়া মানুষটা মুখ দিয়ে আস্তে আস্তে কেমন যেন শব্দ করছে, মানুষ ব্যথা পেলে যেমন শব্দ করে অনেকটা সে-রকম; আর বসার ভঙ্গিতে থাকা মানুষটা শব্দ করছে বেশি ঝাল খাওয়ার পর মানুষ যেমনি শোষায়, ঠিক তেমনি।

আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে হামাগুড়ি দেওয়া ছোট মানুষটা বড়ো ভাই। কিন্তু বড়ো মানুষটা কে? বড়ো মানুষটা হঠাৎ তাকে ছেড়ে দিয়ে চাপাস্বরে বলে, ‘চিৎ অইয়া শোও।’ স্বর শুনে আমি চমকে উঠি! বড়ো ভাই চিৎ হয়ে শুলে বড়ো মানুষটা তার শরীরের ওপর উপুড় হয়ে প্রায় শুয়ে পড়ে! বড়ো ভাইয়ের ছোট শরীর, অমন বড়ো একটি শরীরের চাপে সে ‘উরে মা…উহ্’ বলে নিচুস্বরে আর্তনাদ করে উঠতেই বড়ো মানুষটা তার মুখ চেপে ধরে বলে, ‘আস্তে, দাঁতে দাঁত চাইপ্পা ধইরা রাখো সোনার চান!’

তারপর আদুরে গলায় আবার বলে, ‘বড়ো বালা পোলা তুমি, আমার প্রিয় গেলমান, প্রিয় সেবক তুমি; নিশ্চয় তুমি বেহেশতে যাইবা!’

বড়ো ভাই তবে হুজুরের সেবক! সেবক শব্দের মানে কিছুটা আন্দাজ পেরে আমি শিউরে উঠি, হুজুর তো আমাকেও বলেছে যে আরেকটু বড়ো হলে সে আমাকে তার সেবক বানাবে! ঘেন্নায় আমার পেট গুলিয়ে উঠে। আমি প্রায় নিঃশব্দে যেমনি উঠেছিলাম তেমনি নেমে আসি বারান্দায়। তারপর দ্রুত ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ি, তাড়াতারি আবার ঘুমিয়ে পড়তে চাইলেও ঘুম আর আসতে চায় না। চোখের সামনে কেবলই ভাসতে থাকে হুজুর আর বড়ো ভাইয়ের ওই দৃশ্যটি। দৃশ্যটা সারাক্ষণ আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে। আমি মাদ্রাসা থেকে মুক্তি পাবার জন্য ছটফট করতে থাকি।

এরপর ঈদের ছুটিতে আমাকে বাড়িতে নিয়ে এলে আমি রীতিমতো চিৎকার আর কান্নাকাটি শুরু করি মাদ্রাসায় না যাবার জন্য। আমার কান্না দেখে মায়ের মন গলে, দাদারও। দাদা বাবাকে নির্দেশ দেন আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেবার জন্য। চাচা আপত্তি তোলেন এই বলে যে বংশের বড়ো ছেলে আল্লাহ’র পথে থাকুক। কিন্তু দাদা চাচার কথা কানে তোলেননি। এরপর আমাকে বিসিআইসি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। আমি এক দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পাই।

মাদ্রাসা ছেড়েছি অনেক বছর, কিন্তু বড়ো ভাই আর হুজুরের সেই দৃশ্যটি আমি আজও ভুলতে পারিনি। এখনো মাদ্রাসা দেখলেই সেই দৃশ্যটি আমার মনের ভেতরে চাগাড় দিয়ে ওঠে। বারো-তেরো বছরের কোনো মাদ্রাসা ছাত্রকে দেখলেই তার ভেতরে আমি সেই বড়ো ভাইকে দেখতে পাই, সাত-আট বছরের কোনো ছাত্রকে দেখলেই তার ভেতরে খুঁজে পাই নিজেকে। এখন সেই বড়ো ভাইও হয়তো হুজুর হয়েছে, হাফিজুদ্দিন হুজুরের মতো বেহেশতের লোভ দেখিয়ে সে-ও কি কোনো বালককে তার গেলমান বা সেবক বানিয়ে রেখেছে? কী জানি!

মাদ্রাসা দুটো অতিক্রম করে আমি রূপনগর খালের পুলের ওপর উঠি, ময়লা-পচা-কালো জল থেকে দূর্গন্ধ ভেসে আসে নাকে। পুলের বাঁ-দিকে একটা রুটি-পরোটার দোকান, এখন অবশ্য বন্ধ। ডানদিকে পাশাপাশি দুটো চায়ের দোকান; দুটো চায়ের দোকানেই সাতসকালে মানুষের জটলা থাকে, টেলিভিশনে ভারতীয় সিরিয়াল কিংবা বাংলা সিনেমা দেখার ফাঁকে ফাঁকে চা-সিগারেট সহযোগে চলে নানান রকম আলোচনা, এরা প্রাতঃভ্রমণকারী নয়, আশপাশের নিন্মবিত্ত মানুষ। এখন অবশ্য দুটো দোকানের চারটা বেঞ্চে মোটে তিনজন মানুষ, তিনজনের মাথায়ই টুপি। টেলিভিশন বন্ধ, দোকানের সামনে পর্দা দেওয়া, বেঞ্চে বসা একজনের মোবাইলে বাজছে ইসলামী গান-

‘আল্লাহ তুমি অপরূপ

না জানি কতো সুন্দর

তোমায় আমি সঁপেছি প্রাণ

সঁপেছি এই অন্তর…।’

আল্লাহ অপরূপ! কেমন তার রূপ? তবে যে মুমিন মুসলমানরা নিরাকার আল্লাহকে ডাকে, আলিশান মসজিদ বানালেও তাতে আল্লাহ’র কোনো আকার থাকে না! আমি দোকান থেকে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে পুলের ঢাল বেয়ে নেমে ইটের এবং মাটির রাস্তা ধরে পৌঁছে যাই বোটানিক্যাল গার্ডেনের গেটে। গেট বলতে চিড়িয়াখানা রোডের মাথার ১ নং কিংবা গড়ান চটবাড়ির দিকের ২ নং গেটের মতো নয়; এখানে দেয়ালের নিচের অংশে ইটের গাঁথুনি নেই। ওপরে দেয়াল, তার নিচ দিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়। সাড়ে ছয়টার দিকে রাস্তার পাশে চেয়ার পেতে চোয়াড়ে গোছের এক লোক বসে সামনের ছোট্ট টেবিলে রাখা টিকিটের ওপর সিগারেটের প্যাকেট আর মোবাইল চাপা দিয়ে, মাঝে মাঝে তার পরিবর্তে একজন বৃদ্ধকেও দেখা যায়।

গেটের কাছে পৌঁছতেই লতা-গুল্ম এবং গাছপালার মিলিত গন্ধ ভেসে আসে নাকে; গন্ধটা মনকে সজীব করে তোলে। মাথা নিচু করে গেটের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে পূর্বদিকের দুটো কৃষ্ণচূড়া গাছ, এই আষাঢ় মাসেও কয়েকটি শাখায় থোকা থোকা লাল ফুল নিয়ে গর্বিণী গাছটি ঈষৎ মাথা দুলিয়ে চলেছে। আমি অবশ্য অন্য প্রাতঃভ্রমণকারীদের মতো সোজা পিচঢালা পথে হাঁটি না, যদি না রাতে বৃষ্টি হয়। এই নাগরিক অরণ্যের ভেতরেও আরেকটা অরণ্য আছে, সেটার রূপ-রস-গন্ধ-স্বাদ নিতে নিতে যাই আমি। গেট থেকে একটু এগোলেই পিচঢালা সরু পথ ছেড়ে ডানদিকের বাঁকা লেকের ধার ঘেঁষে দু-পাশের নুয়ে থাকা লতা-গুল্মের ভেতর দিয়ে চলে গেছে একটা পায়ে চলা পথ, আমি লাল মাটির এই পথেই হাঁটি। পায়ে চলা পথটি কোথাও সরু আবার কোথাও বেশ চাওড়া, তবে অসমতল। বাঁকা লেকের ধার দিয়ে প্রচুর হিজলগাছ, হিজলগাছের প্রাণ বড় শক্ত, জলের তলায় কয়েকমাস থাকলেও মরে না; এজন্যই লেকের ধার দিয়ে হিজলগাছ লাগানো, কেননা বর্ষায় লেকের জল বেড়ে গেলে হিজলগাছের গোড়া তলিয়ে যায়। এখন ফুল ফোটার মৌসুম। হিজলের লম্বা লম্বা বোটায় অজস্র ফুল দোল খাচ্ছে হালকা বাতাসে, আর তলায় তো ঝরা ফুলের উৎসব! অজস্র ঝরাফুল ছেয়ে আছে লালমাটি, লতা-গুল্মের ঝোপ, ছোট ছোট সবুজ গাছের পাতা আর জলের ওপর। তিন ধরনের হিজল ফুল আছে এখানে; মাখন সাদা, গোলাপী আর লালচে। কোথাও লেকের পানির ওপর চিৎ-উপুড় হয়ে মৃদু ঢেউয়ের দোয়ায় দুলছে রাশিরাশি ফুল, আবার কোথাও লেকের কোনার দিকে পানির ওপর ভাসতে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সবুজ কচুরিপানার বিছানায় আয়েশি ভঙ্গিতে অচঞ্চল; তার-ই মধ্যে গাছের পাতা ভেদ করে ঢুকে পড়েছে লম্বা দু-এক ফালি রোদ। পায়ে চলা পথটি ছেড়ে লেকের ধার দিয়ে অসমতল মাটি আর গাছের শিকড়-বাকড়ের ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকি হিজল ফুলের সৌন্ধর্য অবলোকন করতে করতে; একেক জায়গায় ফুলের প্রাচুর্যে বিস্ময়ে পা থেমে যায় আমার; জড়াজড়ি করে থাকা মাখন সাদা, লালচে, আর গোলাপি ফুলের দৃষ্টি জুড়োনো সম্মিলিত সৌন্ধর্য আর রাশি রাশি ফুলের মাদকতাময় মিষ্টি গন্ধের সম্মোহন বাণে আমি ধরাশায়ী হই! গাড়ির শব্দ নেই, মানুষের কথা নেই; কেবল গাছগাছালিতে বিচরণরত বিচিত্র সব পাখির কণ্ঠস্বর, বসন্তকাল নয় তবু থেকে থেকে কানে আসে একটা-দুটো কোকিরের ডাক; আষাঢ়ের পরে আর কোকিলের ডাক শোনা যায় না, তখন ওরা কোথায় থাকে কে জানে। আমি বুক ভরে লম্বা শ্বাস নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভেতরে রেখে তারপর ত্যাগ করি তপ্ত নিশ্বাস, এভাবে বেশ কয়েকবার করি।

চারদিকে তাকালে কেবল গাছপালা আর লেকের জল এবং জলজ উদ্ভিদ চোখে পড়ে; মনে হয় যেন কোনো এক অপার্থিব জগতে এসে পড়েছি! সময়ের হিসেব লুপ্ত হয়, আমি যেন পাঁচ হাজার বছর আগের কোনো এক কিরাতপুত্র, তবে পৈত্রিক ধর্ম-কর্ম বর্জন করে পশু-পাখি শিকার করার বদলে তাদের সঙ্গে ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি, কল্পনা করি পশু-পাখির দল আমাকে দেখে পালিয়ে যাবার বদলে বিশ্বাস করে ভালবেসে কাছে আসছে, পশুরা গা ঘেঁষে বসছে আর পাখিরা ভালবেসে গান শোনাচ্ছে! একটা গুঁইসাপের চলার শব্দে আমার সম্মোহন লুপ্ত হয়, পশু কোথাও নেই, বৃক্ষশাখায় কেবল পাখির কলকাকলি। হালকা বাতাস এসে উস্কানি দেয় যৌবনে! নিঃসঙ্গতা চাগাড় দিয়ে উঠে হঠাৎ। ইচ্ছে করে তলা থেকে এক আঁজলা ফুল কুড়োই, কুড়িয়ে….! মনে পড়ে, ভীষণ মনে পড়ে…! কিন্তু কী করবো ফুল কুড়িয়ে? কোথায় রাখবো? ফুল কুড়োনোর ইচ্ছেটা মরে যায়। ফুলগুলো তলাতেই ভাল আছে, তলাতেই থাক। গুঁইসাপটা আমার দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে জলে ঝাঁপ দেয়, ওর জলে ঝাঁপ দেবার শব্দে চাপা পড়ে যায় আমার বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস! আমি আবার হাঁটতে শুরু করি।

রোজার কারণে গার্ডেন বলতে গেলে ফাঁকা, মাত্র পাঁচ-ছয়জন মানুষ চোখে পড়ে, অথচ অন্য সময়ে বহু মানুষ প্রাতঃভ্রমণে আসে, কোথাও দলবদ্ধভাবে ব্যায়াম করে, কোথাওবা খেলে ফুটবল। আজ একেবারেই সুনসান। আমি কিছুক্ষণ ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করি, তারপর বেঞ্চে বসে বিস্কুট খেয়ে জল পান করি। এরপর নির্জন অরণ্যে বেশ উচ্চস্বরে কবিতা আবৃত্তি করতে করতে হাঁটতে শুরু করি গড়ান চটবাড়ির শক্তিসাগর পুকুরপাড়ের উদ্দেশ্যে।

গোলাপ বাগানের কাছে এসে বেঞ্চে বসা একজনকে দেখতে পাই, লোকটা মুখ চেনা। মোবাইলে পুরনো দিনের বাংলা গান ছেড়ে তাকে হাঁটতে বা বসে থাকতে দেখেছি বহুদিন। অন্য সময়ে তার মাথায় টুপি না থাকলেও আজকে মাথায় সাদা টুপি পরা। বদলে গেছে মোবাইলের গানও-

‘আল্লাহ, ওগো আল্লাহ

ক্ষমা করে দাও

মাফ করে দাও

যতোদিন এই জীবনবীণা বাজিবে

সুপথে চালাও মাফ করে দাও।’

আমি মনে মনে হাসি, বেচারা, জীবনে এমন কী অপরাধ করেছে যার জন্য এতো মাফ চাওয়া!

গার্ডেনের গড়ান চটবাড়ির গেট দিয়ে বেরিয়ে বেড়িবাঁধের রাস্তায় উঠে দাঁড়াই, দু-দিক থেকেই গাড়ি যায়-আসে। গাড়ি এলে আসতেই থাকে, একপাশ ফাঁকা হয় তো আরেক পাশ থেকে আসে পিঁপড়ার সারির মতো গাড়ি, এরই মধ্যে একটু ফাঁক পেলেই দু-দিকে সতর্ক চোখ রেখে রাস্তা পার হতে হয়। বেড়িবাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে ফুটওভারব্রিজ খুবই প্রয়োজন। এই রাস্তায় প্রায়ই অ্যাকসিডেন্ট হয়, পনেরদিন আগেও রাস্তার ওপাশের শক্তি সাগর পুকুরের পাড়ে একটা ট্রাক উল্টে গিয়েছিল। স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের আমলে নির্মিত হয়েছে এই বেড়িবাঁধ। তারপর অনেকবার সংসদ নির্বাচন হয়েছে, সরকার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু কোনো সরকারই এক লেনের এই রাস্তাটিকে আরো চওড়া এবং একাধিক লেন করার কথা ভাবেনি, অথচ এটি ভীষণ ব্যস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তা। গাড়ির চাপ একটু বাড়লেই বিভিন্ন পয়েন্টে জ্যাম লেগে যায়। রাস্তাটা দুই লেন হলে অ্যাকসিডেন্ট যেমন কমবে, তেমনি মিরপুর থেকে অফিসযাত্রীরা কম সময়ে এবং নিরাপদে উত্তরা, চন্দ্রা, শফিপুর, জিরানিতে যাতায়াত করতে পারবে।

একটু ফাঁকা হতেই আমি রাস্তা পার হয়ে ঢাল বেয়ে নিচের দিকে হাঁটতে শুরু করি, আমার ডানদিকে শক্তি সাগর পুকুর আর বামদিকে দুটো দোকান। রাস্তার ঢাল লাগোয়া পরোটা, সিঙ্গারা, পুরির দোকান; দোকানের সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে পাটকাঠি আর তাঁবুর ছাউনি দিয়ে কয়েকটি বেঞ্চ আর টেবিল পাতা; দোকানের পিছনে আলাদা একটা ছাপড়া রান্না করার জন্য; যেখানে সিঙ্গারা এবং নাস্তার তরকারি রান্না করে দোকানদারের স্ত্রী। দোকানদার বেঞ্চে আর তার স্ত্রী দোকানে বসে আছে, রোজার কারণে কোনো খরিদ্দার না থাকায় তাদের কোনো ব্যস্ততা নেই। এই দোকানের পরেই আরেকটি দোকান, চা-বিস্কুট-সিগারেটের; প্রাতঃভ্রমণকারীদের উপস্থিতি না থাকার কারণেই হয়তো এখনো খোলেনি। আমি এই দোকান দুটো পেরিয়ে পরিত্যাক্ত একটি দোকানের চাঙায় কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে বসি। ঘামে একেবারে নেয়ে উঠেছি। এখন দারুণ আরাম লাগছে তুরাগ নদীর বুক পেরিয়ে আসা অবাধ হাওয়ায়।

শক্তিসাগর পুকুরের পাড় আর তার নিচের এই ঢালু জমিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সব মিলিয়ে আট-দশটি দোকান ছিল আগে। এখন চালু আছে মাত্র দুটি; কয়েকটি দোকানঘর ভেঙে নিয়ে গেলেও পরিত্যক্ত তিনটে ঘর আর তার সামনের কয়েকটি চাঙা এখনো রয়ে গেছে, উইপোকায় খাচ্ছে বাঁশ-কাঠ। শক্তিসাগর পুকুর আর তার পাড়ের সার্ধশতবর্ষী বটগাছকে কেন্দ্র করে জায়গাটা ছোটোখাটো একটা পর্যটন কেন্দ্রের রূপ নিতে শুরু করেছিল, কিন্তু মুকুরেই তা বিনষ্ট করেছে প্রশাসন। রোজকার যান্ত্রিক জীবনযাপনের চাপে ক্লিষ্ট মানুষ ছুটির দিনগুলোতে বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু ভিন্ন স্বাদ নিতে এখানে আসতো, অনেকে সার্ধশতবর্ষী বটগাছ দেখতে আসতো। কেবল ছুটির দিনগুলোতে নয়, অন্যান্য দিনগুলোতেও আসতো ছাত্র-ছাত্রী এবং ভ্রমণ পিপাসু মানুষেরা। কিছুটা গ্রাম্য পরিবেশে টঙ দোকানে বসে চা পান করতে করতে আড্ডা দিতো, মন চাইলে নৌকায় চড়ে তুরাগের বুকেও ঘুরতো। দর্শনার্থীদের জন্য ছই দেওয়া অনেকগুলো ডিঙ্গিনৌকা ছিল; সেই নৌকাগুলোর বেশিরভাগই এখন ছইহীন, চিৎ-উপুড় হয়ে পড়ে আছে ডাঙায়। এখন সচল আছে কেবল জেলেদের মাছ ধরা দুটো নৌকা, যা সব সময় এখানে থাকেও না; আর গার্ডেন লাগোয়া রাস্তার ওপাশের মহল্লার মানুষের নিত্যদিনের কাজ যেমন ঘাস কিংবা কচুরিপানা সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত দুটো নৌকা; আর একটা নৌকা আছে আফজাল ভাইয়ের, সেটাও ছইহীন। আফজাল ভাই একটা ছাতা আর বৈঠা নিয়ে বসে থাকে, কখনো নৌকাভ্রমণে ইচ্ছুক কোনো ভ্রমণপিপাসু বা প্রেমিকযুগল এলে তাদেরকে নৌকায় ঘুরিয়ে আনে। কদাচিৎ পুলিশ এলে আস্তে করে কেটে পড়ে। এখন অবশ্য সে নেই, তার নৌকাটি মাটির গভীরে পুঁতে রাখা লোহার শিকের সঙ্গে শিকল বেঁধে তালা দিয়ে রাখা।

দর্শনার্থীদের ভিড় বুঝে আশপাশে বেড়িবাঁধ সংলগ্ন কয়েকটি পার্ক এবং রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছিল; যার কয়েকটি এখনো আছে; আর কয়েকটি বন্ধ হয়ে গেছে দর্শনার্থীর অভাবে। ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা মোটরবাইক নিয়ে যারা আসতো বা সংখ্যায় কম হলেও এখনো যারা আসে, তারা পার্কে কিংবা রেস্টুরেন্টে সময় কাটাতো বা এখনো কাটায়। শোনা যায় পার্ক এবং রেস্টুরেন্টগুলোর মালিকেরা বিত্তবান এবং প্রভাবশালী, পুলিশ তাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পায়, যে কারণে ওগুলো টিকে আছে। কিন্তু যারা রিক্সায় এসে নদীর পারে বসতো, নৌকায় ঘরতে ঘুরতে কিংবা টঙ দোকানে বসে চা খেতে খেতে গল্প করতো, পুলিশ তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করতো; এখনো করে। কেবল হয়রানি নয় প্রতারণাও করে। শাহ্ আলী থানার পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তারা রিক্সায় আসা তরুণ-তরুণীদের পথেই আটকে দেয়, থানায় আটকানোর ভয় দেখিয়ে টাকা-পয়সা নিয়ে রিক্সা ফিরিয়ে দেয়; কখনো কখনো থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে তাদের মুক্তি দেয়। ফলে এই ধরনের হয়রানি-প্রতারণার ভয়ে দর্শনার্থীরা এখন বলতে গেলে আসেই না। পুলিশি হয়রানির ব্যাপারটা না জেনে এখনো যারা আসে তাদের মধ্যেও কেউ কেউ হয়তো হয়রানি বা প্রতারণার শিকার হয়। এই এলাকা নিয়ে পুলিশের অভিযোগ যে এখানে অসামাজিক-অবৈধ কার্যকলাপ হয়। অসামাজিক বা অবৈধ কার্যকলাপ বলতে যা তুলে ধরা হয় তা হলো- যুবক-যুবতীরা এদিকে এসে নদীর ধারের বিভিন্ন খোলা জায়গায় কিংবা নৌকায় ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে। নৌকায় বা খোলা জায়গায় কতোটা ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা সম্ভব? কোনো প্রেমিকযুগল যদি একজন আরেকজনের হাত ধরে গল্প করে, একে অন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন বোনে, একজন আরেকজনের কাঁধে কি বুকে মাথা রেখে কথায় কি মৌনতায় সময় পার করে কিংবা একে অন্যের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে পান করে চুম্বনসুধা, তা কী অপরাধ? এগুলো কি অসামাজিক সম্পর্ক কিংবা সমাজের মানুষ এইসব সম্পর্কে আবদ্ধ নয়? সমাজের মানুষও তো তার প্রিয়জনের ঠোঁটে চুম্বন করে। এই যুবক-যুবতীরাও তো সমাজেরই মানুষ। আর অবৈধ সম্পর্ক? কেউতো কাউকে বাড়ি থেকে জোর করে তুলে এখানে নিয়ে এসে তার ঠোঁটে চুমু খেতো না, তারা আসতো স্বেচ্ছায়। স্বেচ্ছায় কেউ সম্পর্কে জড়ালে সেই সম্পর্ক কী করে অবৈধ হয়? এখানে মুক্ত পরিবেশে তারুণ্যের প্রেমের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু খোদ ঢাকা শহরেই শতশত হোটেল-অ্যাপার্টমেন্টে পুলিশি ছত্রছায়ায় জমজমাট মাদক এবং দেহব্যবসা চলছে!

পুলিশের এই ধরনের হয়রানি বা তোলাবাজি যে এখন এখানেই চলে তা নয়, স্বীকৃত পর্যটন এলাকাতেও এসব চলে। আমার এক সহপাঠী কিছুদিন আগে ওর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে কুয়াকাটা গিয়েছিল ঘুরতে। সন্ধ্যায় বিচ থেকে ফেরার সময় পুলিশ ওদেরকে ধরে। জানতে চায় ওরা বিবাহিত কি না। ওরা হ্যাঁ বলার পরও সম্ভবত ওদের বয়সের কারণে পুলিশের সন্দেহ হয়, সেজন্য ওরা যে বিবাহিত তার প্রমাণ দেখাতে বলে। বিবাহের নথিপত্র নিয়ে তো আর কেউ ঘুরতে যায় না, তাই পুলিশ ওদের বাড়িতে ফোন করে অবিভাবকের সাথে কথা বলতে চায়। শেষ পর্যন্ত পুলিশকে পাঁচশো টাকা দিয়ে ছাড়া পায় ওরা।

যে দেশে তরুণদের প্রেমের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, সে দেশে তরুণরা জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ সহ নানা ধরনের অপরাধমুলক কর্মকাণ্ডে তো জড়াবেই। সুস্থ এবং অপরাধমুক্ত সমাজের জন্য চাই তারুণদের নির্বিঘ্ন প্রেমের অধিকার। আমাদের দেশে গলিতে-গলিতে মসজিদ, অথচ কারাগারে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা; পুরাতন কারাগার ভেঙে নতুন কারাগার নির্মাণের পরও ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ অপরাধী রাখতে হয়! আর নেদারল্যান্ডে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরাও চুটিয়ে প্রেম করে, মানুষ প্রকাশ্যে চুমু খেতে পারে; অথচ অপরাধীর অভাবে নেদারল্যান্ডের কারাগারগুলো বন্ধ করে দিতে হচ্ছে!

এই যে এখানে তারুণ্যের প্রেমের অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়েছে, এর পিছনে অন্য কালো হাতের প্রভাব থাকার সম্ভাবনাও প্রবল। কারণ প্রেম ব্যাপারটাই তাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই শক্তিসাগর পুকুরপাড়ের সার্ধশতবর্ষী বটবৃক্ষটিকে অনেক আগে থেকেই হিন্দুরা পূজা করে। আর এই শক্তিসাগর পুকুর এবং প্রাচীন বটবৃক্ষের সৌন্ধর্য ম্লান করে বটবৃক্ষটির খুব কাছেই নির্মাণ করা হয়েছে একটি দ্বিতল ভবনের মসজিদ ও মাদ্রাসা; নিচতলায় বায়তুল আমান হামিদিয়া জামে মসজিদ, দোতলায় মাবিয়া ইক্করা হাফিজিয়া নূরানি মাদ্রাসা ও এতিমখানা। এই স্থানটির খুব কাছে মুসলিম বসতি নেই, মুসলিম বসতি এখান থেকে পায়ে হেঁটে অন্তত ছয়-সাত মিনিটের দূরত্বে। তদুপরি শক্তিসাগর পুকুরের পূর্বপাড়ে রাস্তার সাথে আগে থেকেই একটি মসজিদ আছে, মসজিদটি ছোট, পুকুরের জায়গায় অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে বটগাছের কাছে আরো একটি মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার; প্রথমত হিন্দুদের পূজায় ব্যাঘাত ঘটানো এবং বন্ধ করা, দ্বিতীয়ত তারুণ্যের প্রেমের জোয়ারে স্থায়ী বাঁধ দেওয়া। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তুরাগ এবং গার্ডেনের জায়গা দখল করে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে; কেননা বাংলাদেশে এটা একটা পরিচিত দৃশ্য যে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সরকারি খাস জমি, নদী, খেলার মাঠ এসব দখল করে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই গড়ে তোলে মসজিদ এবং মাদ্রাসা। ধর্ম যেহেতু একটি স্পর্শকাতর বিষয় তাই সরকারী জায়গা দখল করে ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ চুপ থাকে এই জন্য যে বাধা দিতে গেলে যদি এলাকার লোকজন প্রতিরোধ করে, সরকারের গায়ে ধর্মবিরোধী তকমা লেগে যায়! আর অবৈধভাবে জায়গা দখল করে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করলে যেহেতু পার পাওয়া যায়, সরকারের দায়িত্বশীল মহলও এসব বিষয়ে মাথা ঘামায় না; এই সুযোগটাই নেয় ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। বাংলাদেশে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণের টাকা জিনে যোগায়, মধ্যপ্রাচ্যের জিন; সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার ইত্যাদি দেশের সহি জিন! মধ্যপ্রাচ্যের জিনের টাকায় বাংলাদেশের জিনভক্ত মুমিন ভৃত্যরা যত্র-তত্র ভূমি দখল করে গড়ে তোলে মসজিদ এবং মাদ্রাসা; নিবিড়ভাবে চাষ হয় জঙ্গিবাদের, ফলনও আশাতীত! আজকাল জিনভক্ত মুমিন ভৃত্যরা টার্গেট করছে নির্জন নদীর পার সহ এমন সব জায়গা যেখানে বিনোদন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে বা উঠছে বা গড়ে উঠার সম্ভাবনা আছে। এমন সব জায়গায় মসজিদ বা মাদ্রাসা নির্মাণ করে বিনোদন কেন্দ্রকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিচ্ছে। উদ্দেশ্যও থাকে তাই যাতে বেশরিয়তী বিনোদন কেন্দ্রগুলো বিকশিত হতে না পারে। এরা যে ভূমি দখল করে কেবল মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করে তাই নয়, মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ এদের প্রাথমিক প্রক্রিয়া, এরপর আশপাশের জমি দখল করে ঈদগাহ বানায়, কালক্রমে সেই ঈদগাহ হয়ে ওঠে বাজার। আর মধ্যপ্রাচ্যের জিনদের পাঠানো টাকার সাথে বাজারের দোকান ভাড়ার টাকা যোগ হওয়ার পর একতলা বা দোতলা মসজিদ-মাদ্রাসা ধাই ধাই করে বেড়ে বহুতল হয়, তখন বহুতলের একতলা-দোতলা সুপার মার্কেট হিসেবে ভাড়া দিয়ে মসজিদ-মাদ্রাসার কার্যক্রম চালানো হয় ওপরের তলাগুলোতে। তখন কোনো কারণে মধ্যপ্রাচ্যের জিনের টাকা পাঠানো বন্ধ হলেও তেমন অসুবিধা হয় না, দোকান ভাড়ার টাকায়-ই চলতে পারে মসজিদ-মাদ্রাসা এবং জঙ্গি কার্যক্রম। যেমনটা হয়েছে আমাদের মহল্লার মসজিদ-মাদ্রাসার ক্ষেত্রে; ঈদগাহ এখন মাছ-মুরগী আর সবজির বাজার, আর মসজিদের একতলা-দোতলা সুপার মার্কেট।

তবে এখানকার এই মসজিদ এবং মাদ্রাসাটি জমি দখল করে নয়, নিজের জায়গাতেই নির্মাণ করেছে; ভবন নির্মাণ এবং মাদ্রাসা চালানোর খরচ মধ্যপ্রাচ্যের জিনের থেকে প্রাপ্ত হবার সম্ভাবনাই বেশি। আর নিজের জায়গায় ভবন নির্মাণ করলেও এরই মধ্যে ভবনের সামনের গার্ডেনের কিছু জায়গা দখল করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো জায়গা যে দখল করবে সে ব্যাপারে এখনই নিশ্চিত থাকা যায়, কেননা এই মসজিদ থেকে বেরোতে হয় গার্ডেন অথবা তুরাগের জায়গা দিয়ে, বেড়িবাঁধে উঠার জন্য মসজিদের নিজস্ব কোনো রাস্তা নেই। সতরাং ভবিষ্যতে জায়গা দখল করে এখানেও তথাকথিত ঈদগাহ এবং মার্কেট নির্মাণের সম্ভাবনা প্রবল।

মসজিদ-মাদ্রাসা ভবনটি যে ব্যক্তিগত জায়গায় নির্মিত সেটা আমি জেনেছি এক জেলের কাছ থেকে। প্রৌঢ় জেলের নাম ইয়াসিন মিয়া, বটগাছের নিচে বসে বিশ্রাম করছিলেন। একথা-সেকথার পর তাকে জিজ্ঞাসা করি, ‘এখানে তো কেউ খুব একটা নামাজ পড়তে আসে না, আশপাশে কোনো মুসলমানের বাড়িও নেই; তাহলে এখানে মসজিদ নির্মাণ করলো কেন?’

‘হাউস জাগছে তাই করছে। ট্যাহা থাকলে মানুষ সোনার জামা পিন্দে, আর এতো মসজিদ!’

‘মসজিদ কি নিজের জায়গায় করছে না জায়গা দখল করে?’

‘নিজের জায়গায়-ই করছে।’ এরপর মুহূর্তের জন্য আকাশের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে এবং দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে, ‘তয় হ্যার বিচার আছে না? বিচারও করছে!’

‘কিসের বিচার?’

‘আল্লাহ কন আর ভগবান কন, সে তো একজনই, আমরা তারে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাহি; সেই একজনের বিচার। এই যে দ্যাকতাছেন বটগাছ, এই বটগাছরে হিন্দুরা বহুকাল আগে থেইকাই ত্যাল-সিঁন্দুর-ধান-দূর্বা দিয়া পূজা করে। এইহানে যে মসজিদ বানাইছে, মসজিদ বানানোর আগে হ্যারে স্বপ্ন দ্যাহাইছিল, হ্যায় যাতে এইহানে মসজিদ না বানায়।’

‘কে স্বপ্নে দেখাইছিল?

‘বুঝতাছেন না?’ আবারো আকাশের দিকে তর্জনী তোলে, ‘ঐ যে, উপরে একজন আছেন তেনায়। স্বপ্ন দ্যাহানোর পরও হ্যায় কতা হুনে নাই, মসজিদ বানাইবার লাগছে; তারপর আবারো হ্যারে স্বপ্ন দ্যাহাইছে মসজিদ বানান বন্ধ করনের লাইগ্যা। হ্যায় কুনো কতাই কানে নেয় নাইক্যা, গায়ের জোরে মসজিদ বানাইছে। কয়দিন পরই হ্যায় মরছে। আর তার মরণের কিছুদিন বাদেই মরছে তার এট্টা পোলা।’

‘কী বলেন! এসব সত্যি?’

‘মিছা কতা কইলে বাপের জন্মই না! কাছে-কিনারের মানুষরে জিগায় দ্যাহেন যে মসজিদ বানানোর পর হ্যারা বাপ-বেটায় মরছে কিনা? হুনেন হিন্দু হোক, মুসলমান হোক আর খিরিশটান; কারো ধর্মরে হেলা করতে নাই। যার যার ধর্ম তার তার, আর সবার উপরে তেনার বিচার।’

ইয়াসিন মিয়া এরপর তার জীবনে দেখা এরকম আরো অলৌকিক ঘটনার কথা বলতে থাকে। আমি আর তাকে বলি না যে, চাচা, আমি রোজ রোজ আপনার আল্লাহ আর ভগবানের বিরুদ্ধে লিখি; কই আল্লাহ বা ভগবান আমাকে তো মারে না! তাছাড়া ভারতবর্ষের মাটিতে বহু মন্দির ভেঙে মুসলমানরা মসজিদ আর খানকাহ নির্মাণ করেছে, দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেব মসজিদে উঠার সিঁড়ির ধাপের নিচে রেখেছিল বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, যাতে মুসল্লিরা তা মাড়িয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে পারে। এখনো সে-সব মসজিদের অনেকগুলোই বহাল তবিয়তে টিকে আছে এবং মুসল্লিরা নামাজ পড়ছে। স্বয়ং মুহাম্মদ কাবাঘরের মূর্তি ভাঙায় অংশ নিয়েছিলেন, কাবাঘরে পূজিত কাঠের ঘুঘুটি তিনি ভেঙেছিলেন; পৃথিবীতে এখনো মুহাম্মদের ধর্ম টিকে আছে আর কাবাঘর এখনো মুসলমানের দখলে, কোটি কোটি মুসল্লি সেখানে হজ করতে যায়। কোরাইশ কিংবা হিন্দুদের ঈশ্বর রেগে গিয়ে মুসমানদের মসজিদ ধ্বংস করেননি বা পৃথিবী থেকে মুসলমানদের নিশ্চিহ্নও করেননি!

ইয়াসিন মিয়াকে বলে আঘাত দিতে চাই না যে চাচা পৃথিবীটা ঈশ্বরের নয়; মগজের ধার এবং পেশিশক্তি বেশি যার, পৃথিবীটাও তার; অতএব এই মসজিদও এখানে টিকে যাবে, এবং ভবিষ্যতে আশপাশে বসতি গড়ে উঠলে জমজমাট ধর্ম ব্যবসাও হবে।

যে লোক মসজিদ নির্মাণ করেছে, সে আর তার ছেলে হয়তো প্রকৃতির নিয়মেই মারা গেছে; হয়তো অসুস্থ ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ এটাকে হিন্দুদের পূজিত বটবৃক্ষের কাছে মসজিদ নির্মাণের শাস্তি হিসেবে দেখেছে, এমনকি মুসলমানরাও! হয়তো যুগে যুগে বিশ্বাসী মানুষদের দ্বারা এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে মিথ আর তা মুখে মুখে ছড়িয়েছে মানুষের মধ্যে, এক প্রজন্ম থেকে আরে প্রজন্মে!

এখানকার বন্ধ হয়ে যাওয়া টঙ দোকানগুলোর মালিক এবং নৌকার মাঝিরা ছিল দরিদ্র, হয়তো দোকান আর নৌকাই ছিল তাদের রুটিরুজির একমাত্র মাধ্যম। দোকান আর নৌকা চালানো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে নিশ্চয় তারা বিপদে পড়েছিল। তারা কে কোথায় আছে জানি না। জানি কেবল একজনের কথা, পুলিশি হয়রানির সম্ভাবনা আর অল্প রোজগার সত্ত্বেও যে এখনো পেশা পরিবর্তন করেননি। কখনো নৌকায় শুয়ে-বসে, আবার কখনোবা ছাতা আর বৈঠা নৌকায় রেখে এসে বটতলার নিচের একটা বাঁধানো বেঁদিতে কিংবা এই পরিত্যক্ত দোকানের চাঙায় বসে নৌকাভ্রমণেচ্ছু দর্শনার্থী অথবা প্রেমিকযুগলের জন্য অপেক্ষা করেন। মানুষ পেলে গল্প করেন, আবার কখনো গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠেন, ‘নদী ভরা ঢেউ বোঝো না তো কেউ, কেন মায়ার তরী বাউ বাউ বাউ রে’ অথবা ‘নড়ে নড়ে হাতের কাছে, খুঁজলে জনমভর মেলে না, কে কথা কয়রে দেখা দেয় না’। তিনি কিছু খুঁজে পান বা না পান আমি খুঁজে পেয়েছি তাকে। গেল বর্ষার আগের বর্ষায় তার সঙ্গে আমার পরিচয় এখানেই। সেদিন ছিল শ্রাবণের মেঘলা দিন। বর্ষার জল বেড়ে শক্তিসাগর পুকুরের পাড়ের কাছে এসে পড়েছিল। আমি পাড় ধরে এগোচ্ছিলাম বটগাছতলার উদ্দেশ্যে। বড়ো বকফুল গাছটির কাছে আসতেই চোখে পড়ে গাছের শিকড়ে বাঁধা ঢেউয়ের দোলায় দোলায়িত নৌকায় শুয়ে মাথার নিচে দু-হাত রেখে বছর চল্লিশের একজন মানুষ চোখ বুজে গাইছেন-

‘মুখে মুখে সব মুসলমান কাজের বেলায় ঠনঠনা

শোনো মাওলানা, মসজিদ ঘরে আল্লাহ থাকে না।’



(চলবে…….)


মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:৫১

রাজীব নুর বলেছেন: আপনি একজন আধুনিক মানুষ। আপনার মধ্যে কোনো কুসংস্কার নেই। তাই আপনার লেখা উন্নত।

০২ রা আগস্ট, ২০২০ রাত ৯:৪৯

মিশু মিলন বলেছেন: জানি না কতোটুকু আধুনিক হয়ে উঠতে পেরেছি। তবে চেষ্টা করি কু-সংস্কার মুক্ত থাকতে। আমি যা লিখি, সেটাই বিশ্বাস করি এবং সেটাই মেনে চলতে চেষ্টা করি। ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.