নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

জন্মান্তর (উপন্যাস: পর্ব-চৌদ্দ)

০৪ ঠা আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৪:০৬

আমি বেশ চমকে যাই! কী দুঃসাহস, সামান্য দূরত্বে মসজিদ-মাদ্রাসা, ওখানকার কেউ শুনতে পেলে একে আস্ত রাখবে! গানটি আমি আগে কখনো শুনিনি, লাইন দুটোর আগে-পরে কী আছে জানি না। কিন্তু সুরে সুরে এক সত্য এবং সাহসী উচ্চারণ শুনে আমি দাঁড়িয়ে যাই তার দিকে তাকিয়ে। বেশ সুরেলা গলা, নিশ্চয় গাওয়ার অভ্যাস আছে। লাইন দুটো দ্বিতীয়বার গাওয়ার সময় তিনি হঠাৎ চোখ খোলেন আর আমার চোখে চোখ পড়তেই গান থামিয়ে ধড়মর করে উঠে বসেন, বুঝিবা খানিকটা ভড়কে গিয়ে কিছুটা জড়োসরো হয়েই তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে।

তিনি যে কিছুটা ভয় পেয়েছেন তা তার চোখ-মুখ দেখেই বুঝি। তাকে আশ্বস্ত করতে মৃদু হেসে বলি, ‘ভাই থামলেন কেন? গাইতে থাকুন।’

তবু তিনি অবিশ্বাসী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন, হয়তো তিনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন না, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কেননা মানুষ বিশ্বাসী হয়ে এসেই তো চালিয়ে দেয় অবিশ্বাসের ছুরি! আমি ধারণা করি লোকটা নিশ্চয় হিন্দু সম্প্রদায়ের, রাস্তার ওপাশের হিন্দুপল্লীতে তার বাড়ি; আমাকে মুসলমান ভেবে ভয় পাচ্ছেন। তাকে অভয় দিয়ে বলি, ‘আপনি কি ভয় পাচ্ছেন? আমাকে ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। আপনার গান ভাল লাগছিল তাই দাঁড়িয়ে শুনছিলাম।’

তার মুখ কিছুটা উজ্জ্বল হলেও সন্দেহ পুরোপুরি যায় না। জিজ্ঞাসা করি, ‘কী নাম আপনার?’

‘আফজাল।’

এবার আমার বিস্মিত হবার পালা! মাঝারি গড়নের হালকা-পাতলা একজন মানুষ, মুখে চার-পাঁচদিন না কামানো খোঁচাখোঁচা দাড়ি, পরনে লুঙ্গি, গায়ে বহুবার ধোয়া সাদা-মাটা একটা চেক জামা, নৌকার ওপর চিৎ হয়ে দু-হাত মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে গান গাইছেন। দেখে মনে হয় না অ্যাকাডেমিক শিক্ষাও খুব বেশিদূর, তবে চোখে-মুখে বুদ্ধিদীপ্তির ছাপ আছে, আছে সারল্যও। এরকম একজন মানুষ অমুসলমান হলে তার মুখে ‘শোনো মাওলানা, মসজিদ ঘরে আল্লা থাকে না’ গানটি বেশি মানাতো এবং স্বাভাবিক মনে হতো। কিন্তু এর নাম যে আফজাল, একে নাস্তিক ভাবা অসম্ভব, নাম শুনে সাধারণভাবে একে মুসলমান ভেবে নেওয়াই স্বাভাবিক! যেখানে এই বয়সের এবং এই শ্রেণির অনেক মুসলমানকে রোজার দিনে টুপি পরা অবস্থায় দেখতেই আমার চোখ অভ্যস্ত, সেখানে রোজার দিনে তিনি কিনা গাইছেন ইসলাম বিরোধী গান! আফজাল সম্পর্কে দারুণ কৌতুহল জাগে আমার।

তাকে আরো সহজ করতে বলি, ‘আফজাল ভাই আপনার কণ্ঠটা বেশ সুরেলা আর ভরাট।’

প্রশংসা শুনে তার চোখে-মুখে লাজুক ভাব পরিস্ফুট হলেও ভেতরের সন্দেহ পুরোপুরি দূর না হওয়ায় তিনি বলেন, ‘আপনারে তো আগে দেকিনি?’

‘আমি প্রত্যেক শুক্রবার সকালে গার্ডেনে হাঁটতে এসে এখানে বসি।’

‘ও, আমি আজকাল এট্টু বেলা করে আসি, তাই বোধ হয় আপনারে দেকিনি। বাগানে হাঁটতি আসে একানে যারা বসে তারা প্রায় সকলেই আমার চেনা।’

‘আপনি কী করেন?’

‘এই যে ভাবের ঘাটের মাঝি!’

নাম জিজ্ঞাসা করলে মোহাম্মদ আফজাল না বলে শুধু আফজাল বললেন, পেশা জিজ্ঞাসা করলে জানালেন ভাবের ঘাটের মাঝি! কোনোটাই সহি ইসলামী উত্তর নয়!

‘আপনি আমাকে দেখে ভড়কে গেলেন কেন?’

‘ভাবলাম গান শুনে আপনি যদি রাগ করেন। কিছু মনে না করলি এট্টা কতা জিজ্ঞেস করি?’

‘হ্যাঁ করেন।’

‘আপনি হিন্দু না মোছলমান?’

‘আমি মানুষ।’

এবার তিনি উৎফুল্ল, ‘জয়গুরু, এতোদিনে একজন মানুষির দেকা পালাম এই ঘাটে। খালি হিন্দু-মোছনমান দেকতি দেকতি চোখ বড়ো কিলান্ত!’

আরে, এ যে অন্য মানুষ! রাস্তা-ঘাটে প্রতিনিয়ত যেসব আফজাল-তোফাজ্জল-মোফাজ্জল দেখি এতো তেমন নয়; ভিড়ের ভেতরে থাকলেও এ ভিড়ের লোকজন নয়, মানুষ।

‘আফজাল ভাই, আপনি যে গানটি গাইছিলেন, এটা কার লেখা?’

‘মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের লেখা।’

মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের গান আমি শুনেছি। বাংলাদেশে খুব কম মানুষই আছে যারা তার লেখা গান শোনেনি! রেডিও, টেলিভিশনে, মাইকে, হাট-বাজারের দোকানে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে; ঢাকা শহর থেকে শুরু করে অঁজো পাড়াগাঁয়েও শুনতে পাওয়া যায় তার লেখা ‘আমার ঘুম ভাঙাইয়া দিলো গো মরার কোকিলে’ গানটি। অধিকাংশ মানুষই হয়তো জানে না এই গানের গীতিকার কে, মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান নামটি মানুষের কাছে না পৌঁছালেও তার গান ঠিকই পৌঁছে গেছে। গানের এই এক দারুণ শক্তি! এ সময়ের শিল্পীরা রেডিও-টেলিভিশনে কিংবা মঞ্চে এই গানটি গাইতে গাইতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে! কিন্তু এরা কখনোই গায় না ‘শোনো মাওলানা, মসজিদ ঘরে আল্লাহ থাকে না’ গানটি!’ গাইলে শিল্পী যেমনি অসুবিধায় পড়বে, তেমনি টিকে থাকার সংকটে পড়বে ওই রেডিও বা টেলিভিশনও। ফলে রেডিও-টেলিভিশনে খণ্ডিত মাতাল রাজ্জাকের চর্চা হয়, যেমন হয় খণ্ডিত নজরুল কিংবা বেগম রোকেয়ার চর্চা। ভবিষ্যতে কি তসলিমা নাসরিনের গায়েও মুসলমান ট্যাগ লাগিয়ে তার সাহিত্যের খণ্ডিত অংশের চর্চা করবে মুমিনরা? তথাকথিত মডারেট বাঙালী মুসলমান সমাজে ইসলামের প্রকৃত এবং নির্মম সত্যের ওপর সমকালীন সমাজ-সভ্যতায় প্রতিষ্ঠিত ন্যায় সততার একটা আবরণ দিয়ে উপস্থাপন করা হয়; একটা মিথ্যা বা ভুল ইতিহাসকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কারার চেষ্টা, চর্চা ও প্রচার করা হয়; এর অসংখ্য প্রমাণ আছে। আমার বড়ো আপু কমার্সের ছাত্রী ছিল। ক্লাস নাইনের ‘ব্যবসায় শিক্ষা’ বইয়ে টাঙ্গাইলের দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহার সংক্ষিপ্ত জীবনী ছিল। বড়ো আপু যখন জোরে জোরে রণদাপ্রসাদ সাহার জীবনী পড়তো তখন আমরাও শুনতে পেতাম। আমার ছোট মনেও দারুণ প্রভাব ফেলেছিল সেই গল্প; কয়লা বিক্রি করে জীবন শুরু করা ছেলেটির একদিন ধনপতি হয়ে ওঠা, তারপর সমাজসেবা করা, বিভিন্ন দাতব্য এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা আর একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তার করুণ মৃত্যু। রণদাপ্রসাদ নামক অদেখা মানুষটির প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধা জন্মায় তখনই, মনে হয় বড়ো হয়ে যদি আমিও এমন হতে পারতাম! বড়ো আপুর পড়া শুনে বালকসুলভ কৌতুহল থেকেই একদিন চাচাকে রণদাপ্রসাদ সাহা সম্পর্কে এটা-ওটা প্রশ্ন করি। দু-একটা প্রশ্নের উত্তর দেবার পর চাচা বলেন, ‘রণদাপ্রসাদ তো হিন্দু, রণদাপ্রসাদের চেয়েও বড়ো একজন মুসলমান দানবীর ছিলেন; তার নাম হাতেম তাই, দানবীর হাতেম তাই।’ তারপর চাচা দানবীর হাতেম তাইয়ের গল্প শোনান আমাকে, পরে বইয়ে আমিও হাতেম তাইয়ের গল্প পড়েছি। আমি আরো বেশ কয়েকজনকে গদগদ হয়ে হাতেম তাইয়ের কথা বলতে শুনেছি। হাতেম তাই আজ মুসলমানদের গর্ব, বাংলাদেশের মুসলমান আজ বুক ফুলিয়ে একজন মুসলমান হাতেম তাইয়ের গল্প বলে; কিন্তু তারা এই সত্যটা বলে না যে স্বয়ং মুহাম্মদ হাতেম তাইয়ের গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ করে তাদের ধন-সম্পদ লুটপাট করেন আর জোরপূর্বক হাতেমের সন্তানদেরকে ধর্মান্তরিত করে মুসলমান বানান।

আমি আফজাল ভাইকে অনুরোধ করি, ‘আপনি পুরো গানটা গেয়ে শোনাবেন?’

‘শোনাবোনা ক্যান! আসেন, নৌকায় উঠে আসেন।’

আমি কেডস খুলতে গেলে তিনি বলেন, ‘জুতো খুলতি হবিনানে, অমনেই আসেন।’

নৌকায় উঠতে উঠতে বলি, ‘আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?’

‘কুষ্টিয়া।’

‘আপনি তো লালনের পড়শি!’

খুশির রোদ ঝিলিক দিয়ে উঠে তার চোখে-মুখে, ‘আমার পরম সৌভাগ্য যে সাঁইজির পূণ্যভূমিতে জন্ম নিতি পারিছি।’ বলেই দু-হাত এক করে বুঝিবা লালনের উদ্দেশে প্রণাম করে, ‘সব সাঁইয়ের কৃপা, জয়গুরু।’

‘আপনি লালন ফকিরের আখড়ায় গেছেন?’

‘কতো! দিন-রাত পড়ে থাকিছি, একনো যাই মাঝে মাঝে।’

‘শোনান দেখি গানটা।’

আফজাল ভাই মসজিদ-মাদ্রাসার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবেন, তারপর জানতে চান, ‘ভাইডির হাতে কী সময় আছে?’

‘হ্যাঁ, অফুরন্ত। কেন?’

‘তালি চলেন নৌকা নিয়ে দূরি যাই। আমি তো একা একা গুনগুন করে গাচ্ছিলাম, গান গলা খুলে না গালি না গায়ে জুত পাওয়া যায়, না শুনে মর্ম বুজা যায়! কিন্তু গলা খুলে যে গাব, ওই দ্যাহেন না…শুনলি ঘাড়ের ওপর এট্টা কোপ মারবিনি, দ্যাশগাঁয়ে যা শুরু অয়চে!’

চোখের ইশারায় মসজিদ-মাদ্রাসা দেখান তিনি। বলি, ‘আপনার তো ক্ষতি হবে, এর মধ্যে যদি খ্যাপ মিস হয়ে যায়?’

বাতাসের মুখের বকফুলের শুকনো পাতার মতো সে উড়িয়ে দেন আমার কথা, ‘ধুর! আফজাল ভাবের ঘাটের মাঝি ভাইডি, ওই খ্যাপখুপ নিয়ে ভাবিত নয়। জীবনের সবচেয়ে বড়ো খ্যাপই তো মানুষসঙ্গ; কিন্তু জানেন ভাইডি, আমরা নিত্যদিন লোভ-লালসার এতো ক্ষ্যাপ মারি যে জীবনের আসল খ্যাপ মারতি-ই ভুলে যাই! সাঁইজি বলেছেন-মানুষ ছেড়ে খ্যাপা রে তুই মূল হারবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’

মানুষসঙ্গ, মন্দ বলেননি তো! আমাদের নাগরিক জীবনে মানুষসঙ্গের বিলুপ্তি ঘটতে চলেছে, নাগরিক জীবনে এখন রমরমা চলছে অঙ্গসঙ্গ আর মেকি সৌজন্য! বুঝি যে আফজাল ভাই আবেগ-ভাবাবেগে ভরপুর অন্য এক মানুষ। বকফুল গাছের শিকড় থেকে নৌকার শিকল খুলে তিনি বৈঠা চালান জলের বুকে।

একটা খালি ভরা জাহাজ আমাদের সামনে দিয়ে চলে যায় গাবতলীর দিকে। আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে আনি আফজাল ভাইয়ের মুখে, ‘এখন তো এদিকটায় মানুষ আসা কমে গেছে, আয়-রোজগারও নিশ্চয় কমে গেছে, অসুবিধা হয় না?’

‘দুনিয়াডাই তো এট্টা অসুবিধার জায়গা! তয় যার চালানোর সেই-ই চালায়।’

আমি মনে মনে ভাবি উপরওয়ালার কথা বলছে, বেশিরভাগ মানুষই যেমন বলে। পরমুহূর্তেই খোলাসা হয় তার কথায়, ‘বউ-ই সংসার চালায়, বাড়িতে দর্জির কাজ করে সে। আমার আয়ে সংসারের কিছুই অয় না।’

আফজাল ভাইয়ের কিছু বাক্য এরই মধ্যে আমার ভেতরে নাড়া দিয়েছে-‘ভাবের ঘাটের মাঝি’, ‘জীবনের সবচেয়ে বড়ো খ্যাপই তো মানুষসঙ্গ’, ‘দুনিয়াডাই তো এট্টা অসুবিধার জায়গা’। বাক্যগুলোর মধ্যে একটা বৃহত্তর ব্যাপার আছে।

আমরা তুরাগ পেরিয়ে জলে ভাসা মাঠটাতে পৌঁছে যাই, মাঠে অথৈ জল। শুকনো মৌসুমে জল নেমে গেলে এখানে রবি শস্যের চাষ করা হয়। আরো কিছুদূর যাবার পর আফজাল ভাই বৈঠা রেখে নৌকার জল সেচার জন্য রাখা গামলাটা হাতে নিয়ে পাঁটাতনে এসে বসেন। তারপর গামলায় আঙুল ঠুকে গাইতে শুরু করেন-

আলেম গেছে জালেম হইয়া, কোরান পড়ে চণ্ডালে,

সতী-সাধুর ভাত জোটে না, সোনার হার বেশ্যার গলে।

মুখে মুখে সব মোসলমান কাজের বেলায় ঠনঠনা

শোনো মাওলানা, মসজিদ ঘরে আল্লাহ থাকে না।



যদি মক্কায় গেলে খোদা মিলতো নবী মিলতো মদিনায়,

দেশে ফিরে কেউ আইতো না হজ করিতে যারা যায়।

কেউ যায় টাকা গরমেনে, কেউ যায় দেশ ভ্রমণে,

ধনী যায় ধনের টানে আনিতে সোনাদানা

ওরে মাওলানা, মসজিদ ঘরে আল্লাহ থাকে না।



হজ করিতে মক্কায় গিয়া খরচ করলি যে টাকা

বলি, এই টাকা গরীবরে দিলে গরীব আর থাকে কেঠা?

তোর ঘরের ধন খায় পরে, দেশের লোক না খাইয়া মরে,

সত্য কথা বললে পরে দেশে থাকতে পারি না।

ওরে মাওলানা, মসজিদ ঘরে আল্লাহ থাকে না।



দ্বীনহীন রাজ্জাকে বলে, মানুষে মানুষ রতন

বলি, এই মানুষকে ভালোবাসো বেঁচে আছো যতোক্ষণ।

মানুষ চিনতে করিস ভুল তবে হারাবি দুই কূল

ওরে মূল কাটিয়া জল ঢালিলে ঐ গাছে ফুল ফোটে না

শোনো মাওলানা, মসজিদ ঘরে আল্লাহ থাকে না।



আফজাল ভাইয়ের মুখে গানটির মাঝখানের দুটো লাইন শুনে আমার ভেতরে যে আশার ফুল ফুটেছিল, গানটির প্রথম দুই লাইন শোনার পরই আশার সে ফুলটি মলিন হয়ে যায়! এক কলসি দুধের মধ্যে দুই ফোঁটা চনা পড়লে পুরো কলসির দুধ যেমনি নষ্ট হয়ে যায়, প্রথম দুটো লাইনও তেমনি পুরো গানটিকে নষ্ট করেছে, জোরালো ও সত্যনিষ্ঠ বক্তব্যকে খাটো করেছে। গানটি মানবতাকে জয় করতে পারেনি, মানবতার কথা বলতে চেয়েও পুরনো চিন্তার বাঁকেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। ‘মানুষ চিনতে করিস ভুল তবে হারাবি দুই কূল’ এই লাইনটি দ্বারা লোককবি মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান যা বোঝাতে চেয়েছেন ব্যক্তিগতভাবে আমি তার সাথেও একমত নই। কিন্তু এই লাইনটা গানটিকে কলঙ্কিত করেনি, যেটা করেছে প্রথম দুই লাইন। তবে আফজাল ভাই গানটি গেয়েছে ভাল। তার গায়কীর প্রশংসা করে বলি, ‘আপনি দারুণ গেয়েছেন আফজাল ভাই। কিন্তু গানটির দুটো লাইন আমাকে খুব আশাহত করেছে।’

প্রথম বাক্য শোনার পর তার মুখে যে রোদের আবির্ভাব হয়, দ্বিতীয় বাক্য শোনার পর তা ছায়াময় হয়ে যায়, ‘ক্যান? গানে তো সত্য কতাই বলেছে।’

‘হ্যাঁ মসজিদ, মক্কা, হজ, খোদা এসব নিয়ে যা বলেছে; তা সত্য। কিন্তু প্রথম লাইনে বলেছে, “আলেম গেছে জালেম হইয়া, কোরান পড়ে চণ্ডালে”। এখানে ‘চণ্ডালে’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে খারাপ অর্থে। তাতে চণ্ডালদেরকে হেয় করা হয়েছে, জাত্যাভিমান ফুটে উঠেছে। যতো মূল্যবান বা যে গ্রন্থই হোক তা পড়ার অধিকার পৃথিবীর সকল মানুষেরই আছে; হোক সে চণ্ডাল, মুচি, মেথর। আবার দ্বিতীয় লাইনে বলেছে, “সতী-সাধুর ভাত জোটে না, সোনার হার বেশ্যার গলে।” এখানেও বেশ্যা শব্দটি খারাপ বা মন্দ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। ছোট করা হয়েছে দেহোপজীবিনীদেরকে। আমাদের সমাজের অধিকাংশ দেহোপজীবিনী পরিস্থিতিরি চাপে পড়ে দুটো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য অথবা পুরুষের প্রতারণার শিকার হয়ে দেহ বিক্রি করতে বাধ্য হয়; তার দেহ বিক্রি করার জন্য দায়ী আমাদের এই রাষ্ট্র -সমাজ-মানুষ। আর দেহ বিক্রি করে বলেই যে সে মানুষ হিসেবে খারাপ তা নাও হতে পারে। সমাজের অন্যান্য পেশার মানুষের মধ্যেও যেমনি ভাল-মন্দ আছে, তেমনি এদের মধ্যেও তাই। তাই সমাজের আর পাঁচটা পেশার নারীদের মতোই সমাজ এবং রাষ্ট্রের সব কিছুতে এদেরও সামান অধিকার আছে, সোনার হার পরার অধিকার তো অবশ্যই। কিন্তু মাতাল রাজ্জাক দেহোপজীবিনীদের অধিকাররের প্রতি কটাক্ষ করেছেন, অসম্মান করেছেন তাদেরকে। চণ্ডাল এবং দেহোপজীবিনীদেরকে তিনি নিচু স্তরের খারাপ মানুষ হিসেবে চি‎হ্নিত করেছেন। আমি কী ভুল বললাম আফজাল ভাই?’

আফজাল ভাই কয়েক মুহূর্ত দম ধরে থেকে বলেন, ‘কতা সত্যি, আপনি ঠিকই বলিছেন। এমন করে তো ভাবি নাই।’

মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান একজন স্বশিক্ষিত লোক কবি-শিল্পী, অনেক গান তিনি রচনা করেছেন। একাত্তরে দেশপ্রেমের গান লিখেছেন, বেহালা বাজিয়ে গ্রামে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন। তিনি লেখাপড়া বেশি না জানলেনও গভীর নিমগ্নতায় পড়েছেন সমাজ, সমাজের বিশালতা-ক্ষুদ্রতা; সমাজের মানুষের উদারতা, ভণ্ডামী, বৈষম্য, কপট ধর্মপরায়ণতা ইত্যাদি। তার লেখায় এসব বাস্তবচিত্র উঠে এসেছে। কিন্তু সচেতন শিক্ষার অভাবে হোক বা তার অসচেতনতার কারণেই হোক সমাজের কিছু গোঁড়ামি এবং সংস্কার থেকে তিনি মুক্ত হতে পারেননি, বরং তা তিনি লালন করেছেন। ফলে একজন প্রতিবাদী-মানবতাবাদী লোককবি হয়েও সমাজের আর পাঁচজন আটপৌরে সংকীর্ণমনা মানুষের মতোই চণ্ডাল এবং দেহোপজীবিনীদেরকে খারাপ ভাবতে এবং তাদেরকে ঘৃণা করতে শিখেছেন। আবার ‘কোরান পড়ে চণ্ডালে’ এই বাক্যটির মাধ্যমে এটাও স্পষ্ট বোঝা যায় যে আর পাঁচজন ধার্মিক মুসলমানের মতো তিনিও কোরানকে উচ্চমার্গের পবিত্র ধর্মগ্রন্থই মনে করেন, ফলে বাক্যটির মধ্যে তার আক্ষেপও ধরা পড়ে। আমার ধারণা তিনি কখনোই কোরান পড়েননি অথবা পড়লেও ভাসা ভাসা, কোরান সম্বন্ধে গভীর উপলব্ধি তার ছিল না। তিনি যদি গভীরভাবে কোরান পড়তেন তাহলে হয় তিনি ধার্মিক হয়ে যেতেন এবং ওই গানটি তো বটেই ইসলামী গান ব্যতিত অন্য কোনো গানই লিখতেন না, আর না হয় তিনি কোরানকে ঘৃণা করতেন। কেবল তিনি নন, অনেক লোককবি, বাউল-ফকিরদের মধ্যেই এই ধরনের বিভ্রান্তি আছে।

নৌকা স্রোতের টানে একাই ভেসে যায়, জমে ওঠে আমাদের আড্ডাও। আফজাল ভাইকে বলি, ‘আফজাল ভাই, আপনার কথা শুনে বুঝেছি মুসলমান পরিচয়ের চাইতে মানুষ পরিচয়ই আপনার কাছে মূখ্য; তবু আপনার ব্যক্তিগত কিছু বিষয়ে জানতে চাই যদি কিছু মনে না করেন।’

‘না না, কী মনে করবো? আপনি বলেন কী জানতি চান।’

‘আপনি কী নামাজ পড়েন?’

‘না।’

‘ঈদের নামাজও না?

‘না।’

‘বাড়িতে ঈদ পালন করেন না?’

‘আগে করতাম, একন আর করি না।’

‘ভাবী?’

‘সেও তো আমারই মতো। আমরা হলাম গিরিহী বাউল। লতা দুডোর জন্যেই একজাগা পড়ে থাহে সংসার করতিছি।’

‘লতা মানে?’

‘ও, আপনি তো আবার এসব কতা বোজবেন না, বাউল-ফকিরি ভাষায় লতা মানে সন্তান। লতা দুডে বড় হলি ওগের বিয়ে দিয়ে সংসারের ভার ওগের হাতে বুজায়ে দিয়ে আমরা বুড়ো-বুড়ি গুরুর আখড়ায় চলে যাব, ভজন-সাধনে মন দেব।’

‘আমার গুরুর আখড়া কোথায়?’

‘মেহেরপুর।’

‘আচ্ছা, আপনি কি কোরান-হাদিস এগুলো বিশ্বাস করেন?’

‘আমরা তো শরিয়তী জীবন-যাপন করিনে, মাওলানাগের মতো দ্যাকনদারি ধর্মকর্মেও আমাগের আস্থা নাই। নামাজ বলেন আর রোজা, গানই আমাগের সব। তয় ছোটবেলার তে কোরান-হাদিসের প্রতি সব মুসলমান সন্তানের যেমন ভক্তিছোদ্ধা থাকে, আমারও তেমন ছিল। আপনারে খুলেই কই ঘটনাডা। বছর দুই আগে, ওই যেদিন মতিঝিল শাপলা চত্ত্বরের দখল নিছিল হেফাজতে ইসলাম। তার ভিতরে আমি শনির আখড়ায় ভায়রার বাসায় যায়ে আটকা পড়ে গেলাম। মতিঝিল-পল্টন এলাকা তকন রণক্ষেত্তর। তার ভিতরে শালী আমারে কোনোভাবইে ছাড়লো না, বউও ফোন করে আসতি নিষেধ করলো, তো থাকলাম আর টিভিতি দ্যাকলাম ওগের তাণ্ডব; আট থেইকে আশি, সব বয়সের মুছল্লিরা ভাঙচুর করতিছে, আগুন দেচ্ছে, কী না করতিছে; কী যে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়ছে তা নিশ্চয় আপনি দেকিছেন, নতুন করে আর কী কব!’

আমি আফজাল ভাইয়ের চোখের ভেতর দেখতে পাই মতিঝিল, পল্টন, বিজয়নগর, শান্তিনগর, বংশাল, গুলিস্থান, ফুলবাড়িয়াসহ আরো কিছু এলাকায় হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার উন্মত্ত কর্মী-সমর্থকদের দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আট-দশ ঘণ্টাব্যাপী সেই তাণ্ডব; যা ঘটানো হয় নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তি এবং ধর্ম অবমাননাকারীদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাসসহ ১৩ দফা দাবিতে আল্লামা আহমদ শফির ডাকে ‘ঢাকা অবরোধ’ কর্মসূচী পালনের নামে। সারা দেশের কওমি মাদ্রাসা থেকে তাদেরকে একত্রিত করা হয়। ‘আল্লাহু আকবর’ স্লোগানে মুখরিত করে তারা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে এগোয় মতিঝিলের দিকে, ককটেল-হাতবোমা ফাটায়, বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল ছোড়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে; মুহাম্মদের দীক্ষায় দীক্ষিত আল্লাহ’র জিহাদীরা পুলিশের জলকামান, টিয়ার গ্যাসের শেল কিংবা রাবার বুলেটকেও পরোয়া করে না; তারা তো জীবন দিতেও প্রস্তুত; তারা জেনেছে মরলে শহীদ, নিশ্চিত বেহেশ্ত; আর বেহেশ্ত মানেই তো বাহাত্তর হুরি, বালক গেলমান, মদের নহর, চাওয়ামাত্র ফলফলাদি আরো কতো কী! ইসলামের জন্য জিহাদ করতে করতে জীবন দেওয়ার চেয়ে পবিত্র কাজ একজন মুসলমানের জন্য আর কী হতে পারে! জিহাদে মৃত্যু মানেই বেহেশ্ত, এমন সুযোগও তো আর সচরাচর মেলে না। বেহেশ্তের নেশা তাদের রক্তের মধ্যে চলকে ওঠে, মরণের নেশা তাদের মগজের মধ্যে বিদ্যুতের মতো ঝলকায়, ধ্বংসের নেশায় তারা হিংস্র-উন্মত্ত হয়ে ওঠে। হাতের লাঠি এবং বাঁশ দিয়ে তারা শতশত যানবাহন ভাঙচুর করে, বায়তুল মোকাররম মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেটে হামলা চালিয়ে দোকানপাট ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে; বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির অফিস মুক্তিভবন, ট্রাফিক পুলিশের কার্যালয়সহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে; গাড়ি-মোটর সাইকেল পোড়ায়, ফুটপাতের রেলিং-ডিভাইডার ভাঙে, ঢিল ছুড়ে বিভিন্ন ভবনের গ্লাস ভাঙে, ফুটপাতের হকারদের শত শত দোকানের মালামাল আর তাদের বেঞ্চ-টুল-টেবিল-চৌকি রাস্তায় এনে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়; সমগ্র এলাকার বিভিন্ন রাস্তা থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উঠতে থাকে, রাতের অন্ধকার পালিয়ে যায় আগুনের লেলিহান শিখায়। নারী সাংবাদিকসহ অনেক সাংবাদিককে বেধরক পিটিয়ে তাদের ক্যামেরা ভাঙচুর করে, তাদের হাত থেকে রেহাই পায় না ডিভাইডারের গাছ এবং ল্যাম্পপোস্টও। যেন ইসলাম রক্ষার এক মহাযুদ্ধ! ভীত মানুষ ঘরে অবরুদ্ধ, জনজীবন বিপর্যস্ত; আমরা তো নয়ই, আমাদের আগের প্রজন্মও বোধ হয় ১৯৭১ ব্যতিত ঢাকায় এমন তাণ্ডব কখনো দ্যাখেনি।

আফজাল ভাই বলেই চলেন, ‘পরদিন ভোররাতেই তো র‌্যাব-পুলিশের লোকেরা হায়েনাগুলোরে শাপলা চত্ত্বর থেকে তাড়ায়ে দিলো। তারপর বেলা নয়টার দিকে আমি ভায়রার বাসা থেকে বের দিলাম। মতিঝিল দিয়ে বাস তখনও ঢুকতি পারতিছে না। আমি রাজধানী সুপার মার্কেটের কাছে নেমে হাঁটা শুরু করলাম। মনে হলো রাস্তা তো না যেন যুদ্ধ শ্যাষের কারবালা! রাস্তাভরা খালি ইট-পাটকেল, আগুনে পুড়া-ভাঙচুর করা ফুটপাতের দুকানপাট; পুড়া কাপড়-চোপড়, বইপুস্তক, পুড়া বাঁশ-কাঠ, পুড়া মোটর সাইকেল, বিল্ডিং আর গাড়ির ভাঙা কাঁচ, ভুর ভুরি ছাই, কী নেই সেকানে! অবলা গাছও ওগের হাত থকে রেহাই পায়নি, কিছু গাছ কাটেছে আর কিছু উপড়ায়ে ফ্যালেছে।’

আফজাল ভাইয়ের এই কথায় আমার মনে পড়ে মুহাম্মদ এবং তার শিষ্যদের দ্বারা মদিনার ইহুদি বানু নাদির গোত্রকে অবরোধের কথা। মুহাম্মদ এবং তার জিহাদী বাহিনী বানু নাদির গোত্রের বসতি চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে, এরপর তারা পামগাছ কেটে আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। অন্য কোনো উপায় না থাকায় শেষ পর্যন্ত বানু নাদির গোত্র নির্বাসনে যাবার শর্তে মুহাম্মদের কাছে আত্মসমর্পন করে এবং নির্বাসনে চলে যায়। মুহাম্মদ তাদের ফেলে যাওয়া ধনসম্পদ নিজে এবং জিহাদীদের মধ্যে ভাগ করে নেন।

আফজাল ভাই বলতেই থাকেন, ‘বাইতুল মোকাররম মসজিদের কাছে এসে সর্বস্ব হারানো ফুটপাতের দুকানদারগের বুক চাপড়ায়ে কান্দা দেকে চোখ ফাটে পানি চলে আসলো আমার। হায়রে মোছলমান! মোছলমান-মোছলমান নাকি ভাই ভাই, কোনো ভাই নাকি ভাইয়ের দুকান অমনে পুড়াতি পারে! আমি দেকি আর তাজ্জব বনে যাই; দুকানদাররা পুড়া-আধপুড়া কাপড়-চোপড়, বই-পুস্তক, নানারকম জিনিসপত্তর দুই হাতে তুলে মানষিরে দেকাতিছে আর হাউমাউ করে কাঁনতিছে। ভাইডি, আর এরপর যা দ্যাকলাম তা আমি স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবি নাই! দেকি কী পুড়া-আধপুড়া কুরান-হাদিসসহ নানান রকম ধর্মীয় বইপুস্তক! বুকের মইদ্যে য্যান ঘা লাগলো! এক দুকানদার আগুনে পুড়া কুরান-হাদিসের পাতা নিয়ে আহাজারি করতিছে আর মানুষরে দেকাতিছে, সাংবাদিকগের দেকাতিছে। আমার মুখি আর কোনো কতা নেই, আমি তাকায়ে দেকি কুরান-হাদিসের পুড়া পাতার আরবি অক্ষর; দেকি আর ভাবি এরা কেমন মোছলমান যে নিজেগের ধর্মগ্রন্থও আগুনে পুড়ায়ে ছাই করে দেয়! আমি কয়ডা পুড়া পাতা উল্টায়ে-পাল্টায়ে দেকি, তারপর ছাইয়ের গাদার মইদ্যে একখান কুরান পালাম, ওপরের মলাট আর দুই-তিন পাতা মাত্র পুড়িছে। ছাই-টাই ঝাড়ে-ঝুড়ে কুরানখান আর অর্ধেক পুড়া একখান সহি বোখারী শরীফ নিয়ে আসলাম। ভাবলাম, জীবনে তো টাকা দিয়ে কিনে কুরান-হাদিস পড়ি নাই, ফাউ পায়ে এট্টু পড়ে দেকি। কুরান-হাদিস দুইখান লালসালুতে মুড়াইয়ে যত্ন করে রাকে দিলাম ঘরে। মাঝে-মইদ্যে পাতা উল্টায়ে-পাল্টায়ে পড়তাম। ভাইডি বললি বিশ্বেস করবেন না, একদিন রাত্তিরি কিছু আয়াত পড়ার পর আমার কান দিয়ে য্যান ধুমো বাইর হতি লাগলো! নিজেরে বিশ্বাস করাতিই আমার কষ্ট হতিছিল যে এসব কতা কী কুরানে লেকা! কোনো ধর্মগ্রন্থে কি এসব কতা লেকা থাকতি পারে? সেই রাত্তিরি আমি ঘুমালাম না, খালি পড়তিই লাগলাম আর পড়তিই লাগলাম। হাদিসের কিছু পাতাও পড়ে দ্যাকলাম। কী সব ভয়ংকর কতা; আল্লাহ ইসলামে অবিশ্বাসীগেরে ঘাড়ের ওপর কোপ মারতি বলছে, অবিশ্বাসীগের ধনসম্পদ আর নারী লুঠ করতি বলছে! এমন ধারার আরো কতো কতা লেকা! অস্বীকের করবো না যে কিছু ভাল কতাও লেকা নাই, কিন্তু কী করবো আমি অমন ভাল কতা দিয়ে যদি আপনি মানুষ হয়ে নির্দোষী মানুষরে মারতি কন, ধন-সম্পদ-নারী লুঠ করতি কন! রাত অর্ধেকের বেশি পার হলি এট্টুখানি চোখ বুজলাম, তারপর ভোরবেলায় উঠে কাউরে কিছু না বলে লালসালু মুড়ানো কুরান আর হাদিসখান নিয়ে ঘরের থেকে বাইর হলাম। ঘাটে আসে নৌকা খুলে মাঝনদীতে আসলাম, তারপর কুরান-হাদিস ছুড়ে দিলাম নদীর পানিতে। য্যান বুক থেকে একটা পাথর নামায়ে হাঁফ ছাড়ে বাঁচলাম, দরকার নাই আমার অমন ধর্মগ্রন্থ, যে ধর্মগ্রন্থ মানুষ খুন করতি বলে! ঘরে কুরান-হাদিস রাখে আমি তো মরেও শান্তি পাতাম না, ছাওয়ালদুডো যদি ওই কুরান-হাদিস পড়ে খুনোখুনি শেখে! গান-বাজনা আর আধ্যাত্মিক সাধনা নিয়ে আছি বাইডি, তাই নিয়েই থাকতি চাই। উপরওয়ালা থাকলি আছে, না থাকলি নাই। কারো দুই পয়সা মারে খাই নাই, চুরি-চামারি করি নাই, কারো গলায় ছুরিও ধরি নাই; মরার পর যা হয় হবি, আমার মরণ বলে কোনো ভয়-ডরও নাই।’

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি আফজাল ভাইয়ের দিকে, তার লেখাপড়া বেশি নয়, আধ্যত্মিক চিন্তুা-ভাবনার মানুষ; কিন্তু কোরান-হাদিসের সহজ কথাটা সে সহজভাবেই বুঝেছে যা আমাদের তথাকথিত দেশ-বিদেশের ডিগ্রিধারী শিক্ষিতরাও বুঝতে পারে না কিংবা বুঝেও বুঝতে চায় না!

শ্রাবণের আকাশভরা মেঘ, জলের বুকে মেঘের চঞ্চল প্রতিবিম্ব; নৌকায় বসা আমরা স্রোতের বাইরের দুটি মানুষ, ভেসে চলেছি ভাটির দিকে। আধ্যাত্মিকতা আমার পথ নয়, আবার নাস্তিকতার পথও আফজাল ভাইয়ের নয়; তবু আমার মনে হয় যে আমরা কেউ কাউকে শারীরিক এবং মানসিক পীড়ন না করে একই নৌকায় এভাবে পাড়ি দিতে পারবো মহাকালের অনন্ত পথ, চলতে চলতে জলের বুকে একটা ঢ্যাপ পেলেও দু-জনে ভাগ করে খেতে পারবো।

শ্রাবণের সেই মেঘলা দিনটি থেকেই আফজাল ভাইয়ের সঙ্গে আমার সখ্যতার শুরু, এরপর বন্ধুত্ব আরো প্রগাঢ় হয়েছে, হয়েছে গভীর নৈকট্য। আপনির ব্যবধান ঘুচিয়ে আমরা একে অপরকে তুমি সম্বোধন করি। প্রায় প্রতি শুক্রবারেই আফজাল ভাইয়ের সঙ্গে এখানে কিছুক্ষণ আড্ডা দিই, নাস্তা করি, আবার আড্ডা দিই; তারপর বাসায় ফিরি। আর এখন কেবল আমার সঙ্গেই নয়; শাশ্বতীদি, পরাগদা এবং আবিরের সঙ্গেও আফজাল ভাইয়ের বন্ধত্বপূর্ণ তৈরি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

বেড়িবাঁধের ওপাশে আফজাল ভাইয়ের বাড়িতে আমি তিনবার গিয়েছি; প্রথমবার একা, দ্বিতীয়বার আবিরের সঙ্গে, তৃতীয়বার শাশ্বতীদি-পরাগদা-আবিরের সঙ্গে।

শ্বশুরবাড়ি হলেও ওটাই এখন তার নিজের বাড়ি; দুই কাঠা জমির ওপর ইটের গাঁথুনি দেওয়া টিনের দুটো ঘর, আরেকটা ছাপড়া; মাঝখানে এক চিলতে উঠোন। আফজাল ভাইয়ের শ্বশুর নেই, শাশুড়ি আছেন, তাদের সাথেই থাকেন। শ্বশুরের দুই মেয়ে; একজন তার স্ত্রী, আরেকজন বরের সাথে থাকে শনির আখড়ায়; মাসে এক-দুবার আসে বেড়াতে।

প্রথমবার বাড়িতে ঢোকার মুহূর্তের স্মৃতিটা দারুণ! আফজাল ভাইয়ের সাত বছর বয়সী বড়ো ছেলে স্কুল থেকে ফিরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্যান্ট খুলছিল, পাশেই ছিল সবে হাঁটতে এবং আধো আধো কথা বলতে শেখা ছোট ছেলে, সে বড়ো ভাইকে ন্যাংটা দেখে দু-পা এগিয়ে টপ করে টাকি মাছ ধরার মতো বড়ো ভাইয়ের শিশ্ন ধরে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বলে, ‘নুনু…নুনু…বাই নুনু…!’

বিয়ের আগে আফজাল ভাই ছিলেন কুষ্টিয়ায় তার নিজের বাড়িতে, সেখানেও তিনি নৌকা চালাতেন গড়াই নদীতে, মানুষ পারাপার করতেন। আয়-রোজগার মন্দ হতো না। তখন থেকেই তার যাতায়াত লালনের আখড়ায়, নানান জায়গা থেকে আগত বাউল-ফকিরদের সঙ্গে তখন থেকেই তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। প্রায়ই তার রাত ভোর হতো আখড়ায়, সন্ধের আগে ঘাটে নৌকা বেঁধে ছুটতেন আখড়ায়, কলকেয় টান দিয়ে বাউল-ফকিরদের সঙ্গে গান গাইতেন, তত্ত্বকথা শুনতেন, গভীররাতে ওখানেই ঘুমে এলিয়ে পড়তেন। সকালে দু-হাতে রক্তচক্ষু ডলতে ডলতে ফিরতেন ঘাটে। আফজাল ভাইয়ের ভাষায়, ‘সে যে কী সুখের দিন রে ছিল ভাইডি, তা তুমারে বলে বুজাতি পারবো না!’

আফজাল ভাইয়ের এই সুখে ছেদ পড়ে তখন, যখন গড়াই নদীতে ব্রিজ হয়। ব্রিজ হওয়ার পর খেয়া নৌকার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় আর বেকার আফজাল ভাইয়ের প্রয়োজন হয় অন্য কোনো কাজ জুটিয়ে দুটো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার। এলাকার পরিচিত একজন আফজাল ভাইকে ঢাকায় এনে ঢুকিয়ে দেয় মিরপুরের মাজার রোডের একটা স’মিলে কাঠ চেড়াইয়ের কাজে। খোলা হাওয়া গায়ে মেখে গড়াই নদীতে স্বাধীনভাবে নৌকা চালানো আফজাল ভাই হঠাৎ যেন বদ্ধ কুঠুরিতে ঢুকে পড়েন! খেয়াঘাটে রোজ কতো মানুষ দেখতে পেতেন তিনি, কতো মানুষের সাথে পরিচয় হতো, বৈঠা বাইতে বাইতে মানুষের কথায় কান পাততেন, বিচিত্র মানুষের বিচিত্র কথা, দূর-দূরান্তের কতো অদেখা মানুষের খবরও জানতে পারতেন মানুষের মাধ্যমে, প্রতিদিন নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় ভরপুর হতো তার জীবন! সেই মানুষ এসে পড়ে ঢাকা শহরের এক স’মিলে, কাঠ চেড়াইয়ের মতো ভীষণ শ্রমসাধ্য কাজে। রাস্তা দিয়ে কতো মানুষ আসতো-যেতো, কিন্তু তাদের দিকে তাকানোর ফুসরত তার কোথায়! খেয়াঘাটের মতো না তিনি তাদের কথা শুনতে পেতেন, না পারতেন নিজে বলতে। ভেতরটা ছটফটিয়ে মরতো। সন্ধ্যার দিকে কখনো-সখনো সময় পেলেই তিনি শাহ আলির মাজারে যেতেন, মাজারে বসে বসে মানুষ দেখতেন, আগ বাড়িয়ে কথা বলতেন তাদের সঙ্গে, মনে পড়তো লালনের মাজারের কথা, এ মাজার লালনের মাজারের মতো তার প্রাণের ক্ষুধা মিটাতে না পারলেও এসে বসে থাকতেন মানুষের সঙ্গ পাবার লোভে; আবার সময় পেলেই চলে যেতেন তুরাগের দিকে, তুরাগকে দেখে গড়াইয়ের কথা মনে পড়ে জল আসতো চোখে।

শিলাভাবী বিয়ের আগে বেড়িবাঁধ থেকে লেগুনায় উঠে স’মিলের সামনে নেমে গার্মেন্টেসে কাজ করতে যেতেন। হঠাৎ বাবা মারা যাবার পর তাকে গার্মেন্টস এ কাজ নিতে হয়েছিল। শিলাভাবীকে রোজ দেখতে দেখতেই ভাল লেগে যায় আফজাল ভাইয়ের; প্রথমে প্রেমের প্রস্তাব, তারপর প্রত্যাখান, এরপর লেগে থাকা এবং শেষ পর্যন্ত প্রণয়; চিরায়ত পন্থাতেই তাদের পরিণয়। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই আফজাল ভাই স’মিলের কাজ ছেড়ে নৌকা চালানো শুরু করেন, তখন নৌকা চালিয়ে ভাল রোজগার হতো তার। আর প্রথম সন্তান পেটে আসার পর শিলাভাবীও গার্মেন্টস এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে নিজে দর্জির কাজ করতে শুরু করেন।

এখন দু-জন থেকে চারজন হয়েছেন, সংসারের খরচ বেড়েছে; সংসারে বিলাসিতা না থাক, সুখের অভাব নেই। আফজাল ভাইয়ের সকল উদাসীনতা-উন্নাসিকতা শিলাভাবী ভালবেসে মেনে নিয়েছেন! শুধু কি মেনে নিয়েছেন? তিনি নিজেও ডুবেছেন তার ভাবসলিলে!

আফজাল ভাইকে ফোন দিই, ‘আফজাল ভাই কোথায় তুমি?’

‘ভাইডি, তুমি আসে পড়িছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘এইতো আমি একনই বাইর হচ্ছি। ঘুম থেকে উঠতি দেরি করে ফেলিছি। এট্টা ভাল খবর আছে।

‘কী খবর।’

‘বসো, আসে বলতিছি।’

‘ঠিক আছে আসো।’

কী ভাল খবর দেবে আফজাল ভাই? আমি মানুষ-প্রকৃতি আর তুরাগের বুকে ভেসে চলা ছোট জাহাজ, কার্গো লঞ্চ আর নৌকা দেখতে দেখতে তার এবং ভাল খবরের অপেক্ষায় থাকি।

(চলবে…..)


মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:২৬

তারেক ফাহিম বলেছেন: একটানে পুরোটা পড়ে শেষ করলাম।

আফজাল ভাইর বাচ্চা পিচ্চিটার কর্ম পড়ে হাসলাম (টাকি মাছ) :D

০৫ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:০৬

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ০৫ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১২:১২

রাজীব নুর বলেছেন: ভালো পোষ্ট। এটা আগামী বছর বইমেলাতে বের হবে?

০৫ ই আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:১২

মিশু মিলন বলেছেন: সব লেখকেরই চাওয়া থাকে তার অনেক শ্রম দিয়ে লেখা বইটি একদিন বই আকারে বের হবে। আমারও আছে। কিন্তু আমার এই উপন্যাস আমাদের এই রাষ্ট্র এবং সমাজের অনুকূলে নয়। অদূর ভবিষ্যতে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবার সম্ভাবনাও দেখি না। সংগত কারণেই কোনো প্রকাশক হয়তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই উপন্যাস প্রকাশ করতে চাইবে না। তবে আমি চেষ্টা করবো পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশ করা যায় কি না। যদিও সেখানেও প্রতিকূলতা রয়েছে। এরই মধ্যে একজন প্রকাশক ঝুঁকির কথা ভেবে উপন্যাসটি প্রকাশের ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.