নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
দুই
অঙ্গরাজ্যের এই বিপর্যয়ের মধ্যেও ঐতিহ্য মেনে এবারও চম্পানগরীতে হচ্ছে সমন উৎসব। নগরীর পূর্বদিকে গঙ্গাপাড়ের বিশাল উন্মুক্ত মাঠে প্রতিবছরই সমন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সারা অঙ্গরাজ্য থেকে সুদক্ষ শস্ত্রজীবী, অশ্বারোহী, ক্রীড়াবিদ, রথী, ধনুর্বেত্তাগণ একত্রিত হন নৈপুণ্য প্রদর্শণের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য; নট-নটীগণ, নর্তক-নর্তকীগণ তাদের কলানৈপূণ্য প্রদর্শন করতে আসেন, গায়কেরা সংগীত পরিবেশন আর কবিগণ আসেন তাদের শ্রেষ্ঠ কবিতাটি পাঠ করতে। বিজয়ীদেরকে পুষ্পমাল্য দিয়ে বরণ করে পুরস্কৃত করা হয়। সমন উৎসবের একটি প্রধান আকর্ষণ হলো অবিবাহিত পাত্র-পাত্রীরা আসে নিজেদের পছন্দের জীবনসঙ্গী নির্বাচন করতে। সারাবছর বহু সংখ্যক অবিবাহিত পাত্র-পাত্রী অপেক্ষায় থাকে সমন উৎসবের জন্য। দিবারাত্রি চলে উৎসব। অসংখ্য দর্শক আসে উৎসব উপভোগ করতে। নগরের গণিকাগণ আসে উৎসব উপভোগ এবং বাড়তি কিছু কড়ি রোজগারের আশায়। নানারকম পণ্যের পসরা সজিয়ে বসে দোকানিরা। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবৎ অনাবৃষ্টি আর অনাবাদের কারণে সমন উৎসবের আনন্দে অনেকটাই ভাটা পড়েছে, ঐতিহ্য মেনে উৎসব হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আগের মতো লোক সমাগম যেমনি হয় না, তেমনি নেই প্রাণোচ্ছল ভাবটিও।
সদ্য যৌবনে পা দেওয়া রাজকুমারী শান্তা প্রতিবারের মতো এবারও তার সখী রাধা, মেধা, অদ্রিকা, মেনকা আর অম্বিকাকে নিয়ে সমন উৎসবে এসেছে। শিবিকায় চড়ে এলেও উৎসবের মাঠে নেমে এখন তারা ঘুরে ঘুরে দেখছে ক্রীড়া। তাদের পাহাড়াদার হিসেবে পিছে পিছে ঘুরছে কয়েকজন সশস্ত্র প্রহরী। সেই সূর্যোদয়ের পর থেকে শুরু হয়েছে ক্রীড়া, দিনভর চলছে, বিজয়ীদের নিয়ে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস-উন্মাদনায় মাতছে সমর্থকেরা। এখন অপরাহ্ণ, আজকের দিনের শেষ ক্রীড়া অশ্বদৌড়, প্রতিযোগীরা সব প্রস্তত হয়ে আছে, অপেক্ষা করছে ঘণ্টা বাজার, ঘণ্টা বাজলেই শুরু হবে অশ্বদৌড়। অঙ্গরাজ্যে অনেক দক্ষ অশ্বদৌড়বিদ আছেন; তাদের মধ্যে বিরোচন, অম্বরীশ, বামদেব আর কমলাক্ষ অন্যতম। গত সাত-আট বছর ধরে এদের মধ্য থেকেই কেউ না কেউ বিজয়ী হয়। অশ্বদৌড় প্রতিযোগিতা যে স্থানে হচ্ছে তার চারপাশে মোটা দড়ি দিয়ে ঘেরা, দড়ির বাইরে উত্তর-দক্ষিণে সমর্থকেরা দাঁড়িয়ে অশ্বদৌড়বিদদের নামে চিৎকার আর হইহল্লা করছে। উত্তর দিকে দাঁড়িয়েছে রাজকুমারী শান্তা আর তার সখিরা, অশ্বদৌড়বিদদের নিয়ে বাজি ধরছে তারা।
মেনকা বললো, ‘এবার অম্বরীশ জিতবে দেখো তোমরা।’
শান্তা বললো, ‘হ্যাঁ, পিছিয়ে পড়ার দিক থেকে প্রথম হবে তোমার অম্বরীশ!’
শব্দ করে হেসে উঠলো রাধা আর মেধা। রাধা বললো, ‘আমার মন বলছে কমলাক্ষ জিতবে। গতবার সে-ই জিতেছে।’
শান্তা বললো, ‘এবার বিরোচনের ধারে-কাছে কেউ থাকবে না আমি বলে রাখছি।’
অদ্রিকা বললো, ‘সখি, বাজিতে তুমি হেরে গেলে কিন্তু আমাদের সবাইকে মিঠাই খাওয়াতে হবে।’
শান্তা হেসে বললো, ‘আর তুমি হেরে গেলে আমাদের সবাইকে মিঠাই খাওয়াবে।’
ওরা এভাবেই প্রতিবার বাজি ধরে হাসি-ঠাট্টা করে, কিন্তু বাজিতে যে-ই জিতুক বা হারুক, রাজকুমারী শান্তাই সবাইকে মিঠাই খাওয়ায়।
ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ধুলো উড়িয়ে শুরু হলো অশ্বদৌড়, দড়ির দু-পাশের দর্শকরা এখন ছুটছে সামনের দিকে, কে জেতে তা দেখার জন্য, কিন্তু অশ্বের সঙ্গে তারা দৌড়ে পারবে কেন, তারা পৌঁছনোর অনেক আগেই শেষ হবে অশ্বদৌড়, তখন হয়তো বিজয়ীদের পুষ্পমাল্য দিয়ে বরণ করে নেওয়া হবে। শান্তা এবং তার সখিরা দাঁড়িয়েছে উত্তরদিকে অশ্বদৌড় যে-দিকটায় শেষ হবে সেই দিকে। ওরা ধেয়ে আসা অশ্বারোহীর দিকে তাকিয়ে আছে, একেকটা অশ্ব যেন এখন ইন্দ্রদেবের অস্ত্র-বজ্র! কে জিতবে? বিরোচন, কমলাক্ষ, বামদেব, অম্বরীশ না কি অন্য কেউ? চার-পাঁচজনের দূরত্ব এতো কম যে দেখে বলা কঠিন কে জিতবে। দর্শকেরা প্রচণ্ড উত্তেজনা আর কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে ক্ষিপ্র অশ্ব আর আরোহীর দিকে। অবশেষে বেশ কয়েকজন অশ্বদৌড়বিদ প্রায় একই সঙ্গে সীমান্ত দড়ি অতিক্রম করলো, শান্তারা বুঝতে পারলো না যে কে জিতেছে, অধীর অপেক্ষায় রইলো বিজয়ীর নাম জানানোর জন্য। কিছুক্ষণ পরই ঢেঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা করা হলো, ‘এবারের শ্রেষ্ঠ অশ্বদৌড়বিদ-পুরোচন!’
পুরোচন! পুরোচন? কে এই পুরোচন যে বিরোচন, কমলাক্ষ, বামদেব, অম্বরীশদের মতো প্রখ্যাত অশ্বদৌড়বিদদের হারিয়ে বিজয়ী হলো? নতুন বিজয়ী পুরোচনকে দেখার জন্য দর্শকেরা কৌতুহলী হয়ে উঠলো। অল্পক্ষণ পরই পুষ্পমাল্য গলায় অশ্বপৃষ্ঠে আরোহী পুরোচনকে দেখা গেল, তার অশ্বের চারপাশে তাকে সম্মান জানিয়ে এগিয়ে চলেছে বাদকদল আর পুরোচন দর্শকদের অভিবাদনের সাড়া দিচ্ছেন হাত নেড়ে। অল্প বয়সের তেজোদীপ্ত আর্য যুবক পুরোচন, বয়স কুড়ি-একুশের মতো হবে। লম্বা গড়নের চিকন দেহসৌষ্টব।
মেধা বললো, ‘ধুর ছাই বাজিতে আমরা সবাই হেরে গেলাম!’
অম্বিকা বললো, ‘এই পুরোচনটা আবার কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলো!’
রাধা বললো, ‘ওভাবে বোলো না সখি, নতুন বিজয়ীকেও স্বাগত জানানো উচিত। চিরকাল কী পুরোনোরাই জায়গা দখল করে রাখবে! নিজ যোগ্যতায়ই বিজয়ী হয়েছেন পুরোচন। ওকে অভিনন্দন!’
শান্তা বললো, ‘তোমার সুন্দর চিন্তার জন্য ধন্যবাদ সখি, এজন্যই তুমি স্বতন্ত্র, অনন্য।’
সখির মুখে প্রশংসা বাক্য শুনে হাসলো রাধা। বাদকদল বেষ্টিত পুরোচন মাঠের উত্তর দিক থেকে দর্শকদের অভিবাদনের সাড়া দিতে দিতে চলে গেল দক্ষিণ দিকে।
শান্তা বললো, ‘চলো সখিগণ, আমরা এখন অন্যদিকে যাই।’
রাধা বললো, ‘হ্যাঁ, তাই চলো। আমাকে তো আবার একটু পরে সাজঘরে চলে যেতে হবে।’
ওরা মেলার মাঠে এলোমেলোভাবে ঘুরতে লাগলো, কোথাও দাঁড়িয়ে কিছু খেলো, কোথাও দাঁড়িয়ে কিছু কিনলো। শান্তা তার সকল সখিকে মধুপুরীর ঐতিহ্যবাহী তামার চুড়ি কিনে উপহার দিলো। তারপর ওরা ঘুরতে ঘুরতে এলো সমন উৎসবের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থানে, যেখানে নানা বয়সের পাত্রপাত্রীরা নিজেদের পছন্দমতো জীবনসঙ্গী নির্বাচন করে। নিজেদের জন্য পাত্র খোঁজা নয়, কেবল সুসজ্জিত পাত্র-পাত্রী দেখাই ওদের উদ্দেশ্য। অষ্টাদশ বছরের যুবক যেমনি সুসজ্জিত হয়ে এসেছে তার পছন্দের পাত্রীর খোঁজে, তেমনি ষাট বছরের অবিবাহিত বৃদ্ধাও এসেছেন তার পছন্দের পাত্রের সন্ধানে।
মেনকা দুষ্টুমি করে শান্তাকে বললো, ‘সমন উৎসব থেকে এবার সুন্দর একটা বীরপুরুষ পাত্র দেখে তোমার বিবাহের সম্বন্ধটা আমরা পাকা করে ফেলি সখি!’
উত্তর দিলো রাধা, ‘তোমার কি বুদ্ধি লোপ পেয়েছে সখি মেনকা? সখি শান্তার যোগ্য পাত্র এখানে আছে বুঝি! সখি শান্তার বিবাহের জন্য আয়োজন করা হবে স্বয়ম্বর সভার, সমগ্র রাজপুরী সজ্জিত করা হবে, দূর-দূরান্তের নানা রাজ্য থেকে রাজপুত্র আর রাজারা আসবেন স্বয়ম্বর সভায়, তাদের মধ্য থেকে সুযোগ্য রাজা কিংবা রাজপুত্রকে আমাদের সখি নিজেই নির্বাচিত করবে। তারপর মহাসমারহে হবে বিবাহ উৎসব!’
অদ্রিকা বললো, ‘সখি মেনকা, সখি শান্তা নয়, আমরা বরং তোমার জন্য একজন পাত্র খুঁজে দেখি, কী বলো?’
মেনকা বললো, ‘না সখি, তার দরকার নেই।’
অদ্রিকা আবার বললো, ‘কেন তুমি কি আমাজুর হয়ে থাকতে চাও?’
‘না সখি, আমি আমাজুর হয়েও থাকতে চাই না। তাহলে শেষ বয়সে কে আমার দেখাশোনা করবে? পিতৃগৃহে সুখে-শান্তিতে আর তোমাদের সঙ্গে হেসে-খেলে আরো কয়েকটি বছর কাটাতে চাই। তারপর বিবাহ করবো।’
অম্বিকা বললো, ‘আমার এক মাসিমা বিবাহ করেননি, আমাজুর হয়ে আছেন। তিনি খুব ভালো গীত গাইতে পারেন।’
অদ্রিকা বললো, ‘আমার এক আত্মীয়াও আমাজুর থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু গতবছর তার কী খেয়াল হলো সমন উৎসবে এলেন, আর সাতান্ন বছর বয়সে চল্লিশ বছরের একজন পুরুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পছন্দ করে বিবাহ করলেন।’
মেধা বললো, ‘আমার অতো দেরি সইবে না বাপু, ভাবছি শীঘ্রই বিবাহ করবো!’
রাধা মৃদু হেসে বললো, ‘তোমার যৌবন যে বাঁধ মানছে না সখি, তা আমরা তোমাকে দেখেই বুঝতে পারি!’
‘কেবল আমার? তোমার যৌবনও যে উছলে পড়ছে সখি! তোমারও জন্যও একটা বর খুঁজে দেখি!’
হঠাৎ রাধার দু-চোখে উদাসীনতা ভর করলো, ‘যদি সেই সুযোগ থাকতো, তবে আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হতো না সখি। সত্যি সখি, আমারও ইচ্ছে করে কোনো পুরুষের পত্নী হতে, সংসার করতে, সন্তান জন্ম দিতে।’
শান্তা বললো, ‘দুঃখ কোরো না সখি, তোমার যা আছে, তাও অনেকের নেই। একজন জন্মান্ধ মানুষের কষ্টের কথা চিন্তা করে দেখ, এমন সুন্দর বর্ণিল ভূ-মণ্ডল সে দেখতে পায় না; একজন বোধ-বুদ্ধিহীন মানুষের কথা চিন্তা করে দেখ, মানুষ হয়ে জন্মেও সে কেমন সহায় হয়ে অন্যের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। আর তোমার গুণের কী শেষ আছে সখি! তুমি গীত গাইতে পারো, বাদ্য বাজাতে পারো, রন্ধন করতে পরো। আর তুমি অঙ্গরাজ্যের শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী। যা পেয়েছ, তাই নিয়েই আনন্দে বাঁচো সখি!’
রাধা ডান হাত দিয়ে শান্তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বললো, ‘তোমাদের মতো সুহৃদ পেয়ে আমি আনন্দেই আছি সখি, আমি ভাল আছি।’
রাধা বৃহন্নলা, বয়সে শান্তার চেয়ে দু-তিন বছরের বড়ো হলেও শান্তা তাকে সখির মর্যাদা দিয়েছে তার বহুবিধ গুণ এবং সরস বাকচাতুর্যের জন্য। সে নানাবিধ বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানে, নৃত্য-গীতেও দক্ষ। শান্তার অন্যান্য সখিরাও মোটামুটি নৃত্য-গীতে পারদর্শী। কিন্তু রাধার সঙ্গে কারো তুলনা চলে না, রাধা অনন্য।
কখনো গল্পে আর কখনো হাসি-ঠাট্টায় ওদের বেলা বয়ে যায়, সন্ধ্যায় শুরু হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নৃত্য, গীত, কবিতা পাঠের প্রতিযোগিতা। নৃত্য প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে রাধা। গতবছর এবং তার আগেরবার সমন উৎসবের নৃত্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সে শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী নির্বাচিত হয়েছে। এবারো সে জোর প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে।
রাধা বললো, ‘সখি তোমরা এখনো ঘুরে বেড়াও। আরো পরে নৃত্যের আসরে এসো। আমি সাজঘরে গেলাম, আমার সাজতে অনেক সময় লাগবে।’
শান্তা বললো, ‘বেশ যাও, তোমার জন্য শুভকামনা রইলো সখি।’
সকল সখি-ই শুভকামনা জানিয়ে রাধার সঙ্গে আলিঙ্গন করলো।
রাধা সাজঘরে এসে দেখলো সেখানে অনেক নৃত্যশিল্পী, সকলেই সাজতে শুরু করেছে। রূপসজ্জাকারীরা ব্যস্ত হাতে সাজাচ্ছেন নৃত্যশিল্পীদের। রাধা পোশাক বদলে নৃত্যের পোশাক পরার জন্য সাজঘরের ভেতরের কাপড়ে ঘেরা ছোট্ট অন্দরে ঢুকলো।
সমন উৎসব উপলক্ষে খোলা আকাশের নিচে কাষ্ঠ আর বাঁশ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে অস্থায়ী চতুরস্র নৃত্যশালা। নৃত্যশালার দুটি অংশ, সামনের আলোকোজ্জ্বল অংশে অনুষ্ঠিত হবে নৃত্য আর পিছনের অংশ নেপথ্যগৃহ বা সাজঘর, যেখানে এখন নৃত্যশিল্পীরা সাজসজ্জা করে নৃত্যের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। চতুর্পাশ্বে লম্বা দীপাধারের ওপরে রাখা মোমবাতি আর মোটা সলতের তৈল-প্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল নৃত্যশালা। নৃত্যশালার তিনদিকে ভূমিতে উপবিষ্ট দর্শকেরা অপেক্ষা করছেন নৃত্যানুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য। শান্তা তার সখিদের নিয়ে একেবারে সামনের দিকে উপবেশন করেছে।
ঘণ্টা বাজলে ঘোষক নাম ঘোষণা করতেই একজন পুরুষ নৃত্যশিল্পী নৃত্যশালায় প্রবেশ করে নৃত্য পরিবেশন আরম্ভ করলেন। এরপর রাজ্যের নানা স্থান থেকে আসা নৃত্যশিল্পীরা একের পর এক নৃত্যশালায় প্রবেশ করে পুরাকলের নানা কাহিনী অবলম্বনে তাদের নৃত্যনৈপুণ্য প্রদর্শন করে প্রস্থান করতে লাগলেন। নৃত্য প্রতিযোগিতায় নারী, পুরুষ, বৃহন্নলা সকল লিঙ্গের মানুষই অংশগ্রহণ করেছেন। তবে অধিকাংশই গণিকা ও বৃহন্নলা, কিছু সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েও আছেন। নৃত্যশিল্পীরা সারা বছর সমন উৎসবের অপেক্ষায় থাকেন তাদের নৃত্যনৈপুণ্য প্রদর্শনের জন্য, ফলে বছরব্যাপী তারা অনুশীলন করেছেন, প্রত্যেকেই প্রস্তুত হয়ে এসেছেন, সকলেই নিজের সাধ্যের শতভাগ উজার করে নৃত্য পরিবেশন করছেন। মনোমুগ্ধকর তাদের সাজ-সজ্জা, অপূর্ব দেহবল্লরী, কখনো আশ্চর্য ক্ষিপ্রতা আবার কখনো মন্থরতায় অভূতপূর্ব দক্ষতায় শরীর এবং মুখাবয়বে বিবিধ রসের প্রকাশে পুরাকালের নানা কাহিনী ফুটিয়ে তুলছেন।
রাজকুমারী শান্তা এবং তার সখিরা তো বটেই, অনেক দর্শকও এতোক্ষণ যার নৃত্য দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল, তীরের বেগে সেই রাধা নৃত্যশালায় প্রবেশ করলো তীর-ধনুক হাতে, মাথায় বস্ত্রের শিরোভূষণ, যেন এক পৌরুষদীপ্ত শিকারী সে, মৃগ তাড়া করছে! আশ্চর্য, হঠাৎ তীর-ধনুক ফেলে দিয়ে মাথার শিরোভূষণের ভাঁজ খুলে বস্ত্রে রূপান্তরিত করলো, তারপর সেই পৌরুষদীপ্ত পুরুষ হাতের বস্ত্রখানি মাথার ঘোঙট হিসেবে পরিধান করে চলার ভঙ্গি এবং হাতের মুদ্রায় পরিবর্তন এনে নারীতে রূপান্তরিত হলো! নারী এখন বর চাইছে? পুরুষ রূপ ফিরে পাবার বর? কার কাছে? পরক্ষণেই নারীবেশ পরিবর্তন করে বাঁ পা তুলে নটরাজ ভঙ্গিতে কেবল ডান পায়ে ভর করে দাঁড়ায় রাধা, দর্শকেরা বুঝে যায় যে দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে বর চেয়েছে নারী। কিন্তু দেবাদিদেব মহাদেব তাকে অন্য বর চাইতে বলছেন।
আশাহত নারীরূপী রাধা এবার দেবী পার্বতীর কাছে বর চাইছে, শরীরী ভাষা এবং হাতের মুদ্রায় প্রকাশ করলো যেন সে একমাস নারীরূপে এবং একমাস পুরুষরূপে জীবন অতিবাহিত করতে পারে। দেবী পার্বতী তার মনোবাঞ্ছা পূরণ করলেন। তারপর রাধা নারীরূপে এমনভাবে নৃত্য করতে লাগলো, যেন সে সখিদের সঙ্গে সরোবরে অবগাহন করছে, সরোবরে অবগাহরত একজন পুরুষের সৌন্ধর্যে মুগ্ধ হয়ে জলে আলোড়ন তুলতে লাগলো।
জ্ঞানী দর্শকেররা এরই মধ্যে বুঝে গেছে যে পুরাকালের রাজা ইলের আখ্যান অবলম্বনে নৃত্য করছে রাধা। পুরাকালে বাহ্লিকদেশে ইল নামে একজন ধার্মিক রাজা ছিলেন, একদা তিনি তার অনুচরবর্গদের নিয়ে মৃগয়ায় গিয়েছিলেন। মৃগ শিকার করতে করতে একসময় তিনি কার্তিকেয়র জন্মস্থানে উপস্থিত হন, সেখানে মহাদেব এবং দেবী পার্বতী ক্রীড়া করছিলেন। দেবী পার্বতীর মনোরঞ্জনের জন্য ভগবান ঋষভধ্বজ তখন সেখানে স্ত্রীরূপে অবস্থান করছিলেন এবং সেই অরণ্যে তখন যতো প্রাণি ছিল সবাই স্ত্রীত্ব পেয়েছিল। রাজা ইল এবং তার অনুচরবর্গগণ সকলেই স্ত্রীত্বলাভ করলে দুঃখিত ইল মহাদেবের কাছে বর প্রার্থণা করলেন। মহাদেব বললেন, ‘তুমি পুরুষত্ব ব্যতিত অন্য বর চাও।’ ইল তখন পার্বতীর কাছে বর প্রার্থণা করলে পার্বতী তাকে বললেন, ‘রুদ্র তোমায় অর্ধ বর দিয়েছেন, অপর অর্ধ বর আমি দিচ্ছি।’ ইল তখন প্রার্থণা করলেন, ‘দেবী, আমি যেন একমাস নারীরূপে এবং পরমাস পুরুষরূপ পাই।’ পার্বতী বললেন, ‘তাই হবে, তুমি যখন পুরুষরূপে থাকবে তখন স্ত্রীভাব তোমার মনে থাকবে না, আবার যখন স্ত্রীরূপে থাকে তখন পুরুষভাব মনে থাকবে না।’ এভাবে রাজা একমাস পুরুষরূপে ইল এবং একমাস নারীরূপে ইলা হয়ে বাস করতে লাগলেন।
স্ত্রীরূপী ইলা একদিন অরণ্যে বিচরণ করতে করতে দেখলেন সরোবরের মধ্যে আশ্চর্য সুন্দর এক পুরুষ তপস্যা করছেন, তিনি সেই পুরুষের সৌন্ধর্যে মুগ্ধ হয়ে জলে আলোড়ন তুলে তার তপস্যা ভাঙলেন। সেই পুরুষ চন্দ্রপুত্র বুধ, তিনিও ইলার সৌন্ধর্যে মুগ্ধ হলেন। দুজন দুজনকে কামনা করলেন, একসঙ্গে বিহার করলেন এবং মিলনের আনন্দে নিমজ্জিত হয়ে রইলেন।
এই আখ্যান আরো দীর্ঘ কিন্তু রাধা তার নৃত্য এখানেই শেষ করলো, কল্পিত বুধকে আবর্তন করে নৃত্য করতে করতে শরীরী ভাষা এবং হাত-পায়ের মু্দ্রায় শৃঙ্গার রসের এবং মুখে পরিতৃপ্তির প্রকাশ ঘটিয়ে নৃত্যশালা থেকে প্রস্থান করলো।
অন্য দর্শকদের সঙ্গে শান্তা এবং তার সখিরাও করতালির মাধ্যমে অভিবাদন জানালো রাধাকে। রাধার পরে আরো কয়েকজন নৃত্যশিল্পী নৃত্য প্রদর্শন করলেন, তারাও অসাধারণ নৃত্যশৈলীর মাধ্যমে পুরাকালের নানা আখ্যান ফুটিয়ে তুললেন।
অবশেষে এলো বিজয়ীর নাম ঘোষণার সেই মহেন্দ্রক্ষণ। উপবিষ্ট দর্শকেরা কৌতুহলী এবং উত্তেজিত, এবার কে হবেন অঙ্গরাজ্যের শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী? গত দুইবছরের ন্যায় রাধা না কি অন্য কেউ?
অন্যদের চেয়ে রাজকুমারী শান্তা এবং মেধা, অদ্রিকা, মেনকা, অম্বিকা একটু বেশিই উত্তেজিত, তারা মনে মনে ভগবান বিষ্ণুর কাছে প্রার্থণা করতে লাগলো যাতে এবারও তাদের সখি রাধা শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পীর মর্যাদা পায়।
বাদকদল বাদ্য বাজালেন, তারপর নেপথ্যগৃহ থেকে ঘোষক এলেন নৃত্যশালায়, সকলের দৃষ্টি এখন ঘোষকের দিকে, ঘোষক ঘোষণা করলেন-‘এবারের সমন উৎসবে অঙ্গরাজ্যের শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী নির্বাচিত হয়েছেন-শবরী!’
(চলবে.......।)
১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১:১৬
মিশু মিলন বলেছেন: সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
২| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ ভোর ৫:২৪
আনমোনা বলেছেন: ভালো লাগছে। পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করছি।
প্রথমে মনে হয়েছিল ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি আর রাজকুমারী শান্তার গল্প। কিন্তু এখন ধারনা করছি রাধাই প্রধান চরিত্র। দেখি কি হয়।
২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:৫১
মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ সঙ্গে থাকার জন্য।
৩| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:২০
ডঃ এম এ আলী বলেছেন:
সমন উৎসবটা এখনো চালু থাকলে মন্দ হতোনা ।
অনেক অবিবাহিত যুবক যুবতি, আবাল বৃদ্ধ বনিতা
নারী পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ
পেতো । অধীর আগ্রহ নিয়ে পরের পর্ব দেখতে
গেলাম ।
শুভেচ্ছা রইল
১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১১:৪৫
মিশু মিলন বলেছেন: হ্যাঁ, সমন উৎসবটা থাকলে বেশ হতো। ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১১:০০
রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর লিখেছে।