নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নাগরী (উপন্যাস: পর্ব- নয়)

০৫ ই অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:২০

নয়

তরণী এখন গঙ্গা আর কৌশিকী নদীর মোহনায়; উত্তরদিক থেকে কৌশিকী এসে মিশেছে গঙ্গায়, আর গঙ্গা এখান থেকে এঁকে-বেঁকে পূর্বদিকের ভাটির রাজ্য বঙ্গের মধ্য দিয়ে গিয়ে লীন হয়েছে সমুদ্রে। রঘু তরণী ঘুরিয়েছে কৌশিকীর দিকে। গিরিকা ও তিনকন্যা ছাদে দাঁড়িয়ে নদীর সৌন্ধর্য দেখছে, আর গিরিকা কন্যাদের কৌতুহলী নানান প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। কৌশিকী নদীতে তরণী প্রবেশ করার পর গিরিকা করজোর কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। উমা জানতে চাইলো, ‘মাসি, এই নদীর নাম কী?’

‘কৌশিকী নদী। এতো শুধু নদী নয় রে, পূণ্যবতী সতী নারী!’
‘কেন?’
‘শোন সেই মাহাত্ম্য বলি তোদের, কুশবংশজাত ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রের জ্যেষ্ঠা ভগিনী ছিলেন সত্যবতী; তার স্বামী পূণ্যবান ঋচিক সশরীরে স্বর্গে গিয়েছিলেন।’

করজোর কপালে ঠেকিয়ে স্বর্গের উদ্দেশ্যে প্রণাম করলেন গিরিকা। তারপর আবার বললেন, ‘স্বামী স্বর্গে যাবার পর লোকহিতকামনায় সত্যবতী কৌশিকী নদী হয়ে হিমালয় থেকে প্রবাহিত হচ্ছেন।’

উমা অবিশ্বাসের সুরে বললো, ‘সত্যি বলছো মাসি?’
‘তবে মিথ্যে নাকি লো, তিনি তো আমাদের মতো পাতকিনী ছিলেন না, তিনি ছিলেন পূণ্যবতী! নিশ্চয় তপস্যাও করতেন। কতো বড়ো দরদী হলে নিজে নদী হয়ে জনসেবা করা যায় একবার ভাবতো, আর তোরা? এতো দেবার পরও অনুযোগ করিস মাসি এ দেয় না, ও দেয় না।’

উমার মনে এসেও ধমক খাওয়ার ভয়ে মুখে এলো না যে তুমিও তো আমাদের শরীর বেচা কড়ি কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নাও, এতোটুকুও তো ছাড় দাও না!

গঙ্গায় ভাটির দিকে তরণী বাইতে খুব বেশি কষ্ট হয় নি দাঁড়িদের, কিন্তু কৌশিকীর উজানে তরণী বাইতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সবার। গঙ্গার চেয়ে অর্ধেক গতিতে এগোচ্ছে তরণী। কৌশিকী নদীর বাম তীরের কাছাকাছি দিয়ে এগিয়ে চলেছে তরণী। নদীর পারে ঘন অরণ্য, অনাবাদী ভূমি, আর হঠাৎ হঠাৎ সুন্দর একেকটা জন্মন্; জন্মনের বিচিত্র মানুষ। রৌদ্রের তেজ বেড়ে যাওয়ায় সকলেই নিচে নেমে এসেছে। শবরী আর উমা নিজেদের কক্ষে এসে শয্যায় বসে বাতায়নে চোখ রেখে নদীপারের অচেনা ভূমি-অরণ্য-মানুষ প্রভৃতি অবলোকন করছে আর সে-সব নিয়ে গল্প করছে। দশ-এগারো বছরের এক বালক শিশ্ন বের করে নদীতে মূত্র বিসর্জন করছে, তা চোখে পড়তেই শবরী উমাকে দেখিয়ে বললো, ‘সখি দেখ দেখ, ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রের ভগিনীর গাত্রে মূত্র বিসর্জন করছে ওই বালক!’

শবরীর শেষ শব্দটি বাতাসে মিলাবার আগেই নদীর ঢেউ আর দাঁড়িদের বৈঠার জলকাটা শব্দ ছাপিয়ে অট্টহাস্য করে উঠলো উমা।

রৌদ্র তেতে উঠেছে, রৌদ্র তেজে এবং ক্ষুধায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে দাঁড়িরা। প্রাতঃভোজনের জন্য এক জন্মনের ঘাটে নদীর দিকে হেলে পড়া একটা অতিকায় বটবৃক্ষের কাছে তরণী নোঙর করলো রঘু। নিশ্চয় কোনো অনার্য জাতি বটবৃক্ষটিকে পূজা দেয়, বৃক্ষটিতে সিঁদূর মাখানো এবং নানান রঙের সুতো দিয়ে ঘেরা। নদীর পারে খুব কাছেই কোথাও হয়তো কোনো উৎসব হচ্ছে। ভেরী-মৃদঙ্গ-শঙ্খ আর উলুধ্বনি ভেসে আসছে কানে। ক্রমশ সেই শব্দ কাছে আসতে লাগলো এবং একসময় হই-হট্টগোল করতে করতে একদল মানুষ এগিয়ে এলো নদীর দিকে। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে একেবারে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যন্ত, নানান বয়সের অনেক নারী-পুরুষ। কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে, কেউ দু-হাতে ঊর্ধ্বে তুলে নৃত্য-গীত করছে; আর বেশিরভাগেরই মাথায়, হাতে কিংবা কাঁখে জলের কলসি নয়তো অন্যান্য ছোট মৃৎপাত্র। ঢাল বেয়ে নেমে তারা নদীর জলের কাছে এলো। কেউ কেউ আগন্তুকদের তরণীর দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালেও কোনো প্রশ্ন করলো না।

সকলেই বাদ্যের তালে নৃত্য করতে করতে নদীতে নেমে জলে ডুব দেবার পর যার যার কলসি নয়তো মৃৎপাত্রে জল ভরে আবার ফিরতে লাগলো, ভরা কলসি নিয়েও তাদের নৃত্যের তাল ভঙ্গ হলো না।

দাঁড়িরা আহারে ব্যস্ত, গিরিকা এবং তিনকন্যা সবে স্নান শেষ করেছে। তারা নৃত্য-গীত-বাদ্য শুনে কক্ষের বাইরে এসে দারুণ কৌতুহলে তাকিয়ে দেখছে গাঁয়ের এইসব উৎসবমুখর মানুষদেরকে। বাদ্যযন্ত্র সমেত অনেকে কিছুটা দূরে চলে গেলেও পিছিয়ে পড়া কেউ কেউ এখনও কলসিতে জল তুলছে নদী থেকে। গিরিকা একজন প্রৌঢ়াকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কী পার্বণ করছো গো?’

কোমর জলে দাঁড়িয়ে কলসিতে জল ভরতে ভরতে প্রৌঢ়া বললেন, ‘বরুণ দেবতার পূজা হবে। দেখছো না খরায় ছারখার হচ্ছে সবকিছু। তাকে তুষ্ট করতে হবে।’

কলসী কাঁখে নিয়ে প্রৌঢ়া পুনরায় বললেন, ‘তোমরা কারা গো? কোথা থেকে এসেছো? দেখে তো ঠাহর হচ্ছে তোমরা কোনো জন্মনের মানুষ নও।’

‘আমরা রাজধানী চম্পানগরী থেকে এসেছি।’
‘তোমরা চম্পানগরী থেকে এসেছো! তা পাপপুরীর সেই রাজার কোনো সংবাদ জানো? সেই ল‏ক্ষ্মীছাড়া আছে না মরেছে?’
‘মহারাজ মরবেন কেন! তাঁর সম্পর্কে এমন কথা কেন বলছো?’
‘বলছি কী আর সাধে, আঁটকুড়ে রাজা কোথা থেকে ধার করে একটা কন্যা এনে পালছে, নিজের কোনো ছানাপোনা নেই। নিশ্চয় তার কোনো পাপ আছে নইলে রাজ্যে এমন খরা আর দুর্ভিক্ষ হয়! রাজার দোষে আমরা প্রজারা কষ্ট পাচ্ছি। যাইগো, বরুণদেবকে শীতল করতে হবে।’

পর পর গোটা দুয়েক ডুব দিয়ে, ভরা কলসি কাঁখে তুলে থপ থপ করে পা ফেলতে ফেলতে চলে গেলেন প্রৌঢ়া। গিরিকা আর তিনকন্যারাও কক্ষে প্রবেশ করলো। কিছুক্ষণ পর রাঁধুনীরা তাদের আহার পৌঁছে দিলো কক্ষে।

নিচের কক্ষে আহার করতে বসেছে দাঁড়িরাও। দাঁড়িরা এবার বেশ খুশি চিত্তে আছে, কেননা তরণীর অতিথিরা যা আহার করছে, তাদেরকেও তাই আহার করতে দিচ্ছে। পঞ্চ ব্যঞ্জনে এতো সু-স্বাদু আহার তারা কখনোই করে না। তাছাড়া এবারের অতিথিরাও অন্যান্য বারের চেয়ে আলাদা, অতিথিরা তাদেরকে আপন করে নিয়েছে, তাদের সঙ্গে সহজভাবে মিশছে, কথা বলছে। যা তারা কখনোই কোনো আর্য পুরুষ বা নারীর কাছ থেকে পায় নি। ফলে এবার তারা শারীরিক এবং মানসিকভাবে অনেক উৎফুল্ল আছে, এই প্রথমবারের মতো দাঁড় বাওয়ার কাজ তারা উপভোগ করছে।

দাঁড়িদের মধ্যে সবার পরে আহার শেষ হলো রঘুর। আহারে রঘু সকলের চেয়ে একটু কুঁড়ে, তার সকল কাজেই ধীরগতি। আহার শেষে সে মৃৎ-কলকেয় গঞ্জিকা এবং নারিকেলের ছোবড়া ভরে আগুন জ্বাললো, হাত থেকে হাতে ঘুরতে লাগলো কলকে। কলকে টানা শেষ হলে রঘু সকলকে তাড়া দিয়ে তুললো, নিজে গিয়ে বসলো হালে আর অন্যরা যে যার জায়গায় গিয়ে দাঁড় টানতে শুরু করলো। সকলেরই পরনে মলিন বাস, আর রঘু ব্যতিত ঊর্ধ্বাঙ্গে অধিবাস। রঘুর উদোম শরীর। সুকেতুর ধানি রঙের অধিবাসটি কেবল নতুন, কয়েক মাস আগে সে মগধের এক হাট থেকে ক্রয় করেছিল। রৌদ্রদাহ থেকে মাথা বাঁচাতে সকলেরই মাথায় এক খণ্ড বস্ত্র পেঁচিয়ে পাগড়ির মতো করে বাঁধা।
ক্রমশ ওপর দিকে স্রোতের উজানে দাঁড় বাওয়া ভীষণ শ্রমসাধ্য কাজ, অল্পক্ষণের মধ্যেই আবার ঘামে ভিজে তাদের শরীর চপচপে হয়ে গেছে। সূর্যের প্রভায় চকচক করছে তাদের ঘর্মস্নাত কৃষ্ণবর্ণ সুঠাম বাহু। হাল ধরে বসে থাকার চেয়ে দাঁড় বাওয়া অধিক পরিশ্রমের কাজ। বর্ষাকালের কৌশিকীর ঢেউয়ের মতো ফুঁসছে দাঁড়িদের বাহু-বুক-পিঠের মাংসপেশি, গলা এবং হাতের শিরা। জুলপি, গলা, রোমশ বুক আর মেরুদণ্ডের খাঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনা স্বেদধারা।

জনপদ অনেক পিছনে ফেলে এসেছে, সামনে আর কোনো জনপদ নেই। এখন কৌশিকী নদীর দু-পারে কেবলই ঘন সবুজ বিজন অরণ্য আর ছোট-মাঝারি পাহাড়, পাহাড়ের ঝর্ণাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় আছে ঋষিদের আশ্রম। তরণী নদীর বাঁ তীরের কাছ দিয়ে যাওয়ায় বিচিত্র পাখপাখালির বৈচিত্র্যপূর্ণ ডাক ভেসে আসছে কানে। থেকে থেকে একটা দুটো বন্যপ্রাণীর দেখাও মিলছে। বাতায়নে বসে একদল কৃষ্ণসার মৃগ দেখে বিস্ময়ে-আনন্দে উমার গলা জড়িয়ে ধরলো শবরী। কিছু মৃগ ঘাস আহার করছে, আর কয়েকটি আহার ভুলে তাকিয়ে আছে তরণীর যাত্রীদের দিকে, হয়তো বিস্ময়ে কিংবা আশঙ্কায়। অনেক রাজা এবং রাজপুত্র সদলবলে এই অঞ্চলে মৃগ শিকার করতে আসে, তাই হয়তো অভিজ্ঞ মৃগরা তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে যে তরণীর যাত্রীরা শিকারী কি না। মৃগ শাবকেরা টাল খাওয়া পায়ে কখনো কচি ঘাসের ডগা ছিঁড়ছে আবার কখনো মায়ের গায়ের গন্ধ শুকছে নয়তো মায়ের মুখের কাছে মুখ নিয়ে জিভ দিয়ে চাটছে। উমা আর শবরী উৎফুল্ল চোখে-মুখে তাকিয়ে রইলো মৃগদলের দিকে। এমন বিস্ময়কর আর দূর্লভ দৃশ্য যে জীবনে দেখতে পাবে তা কখনো কল্পনাও করে নি ওরা।

উমা বললো, ‘সখি, আমি প্রথমে আসতে চাইছিলাম না। না এলে জীবন অপূর্ণ থেকে যেতো। নয়ন জুড়োনো দৃশ্য!’
শবরী বললো, ‘সুলোচনাকে ডাক না সখি। এমন দৃশ্য জীবনে বারবার দেখার সুযোগ হয় না।’
‘মাগী পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। গতর খাটুনি নেই কীসে এমন ঘুম আসছে কে জানে!’
‘তাড়াতাড়ি ডাক, নইলে দেখতে পাবে না যে।’
উমা সুলোচনাকে ডাকতে গেল এবং কিছুক্ষণ পর একাই ফিরে এলো।
শবরী বললো, ‘উঠেছে?’
উমা সুলোচনার প্রতি বিরক্ত হয়ে বললো, ‘না, মাগি উ আ করলো। তারপর আবার পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে।’
‘ওর যতো আগ্রহ কেবল কড়িওয়ালা নাগর, মূল্যবান পরিচ্ছদ আর অলংকারে। এছাড়া ভূ-মণ্ডলের আর কোনো কিছুর প্রতি ওর আগ্রহ নেই। দেখ দেখ সখি, ওই মৃগটা কেমন করে আরেকটার গলায় আদর আদর করছে, যেটাকে আদর করছে ওটা বোধ হয় মৃগী!’
‘হ্যাঁ, মৃগটাকে মদনদেব বাণ মেরেছেন, মৃগীটাকে এক জায়গায় তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না!’
‘মানুষই হোক আর মৃগ কিংবা অন্য জীবজন্তু, সকল পুরুষকেই মদনদেবের পঞ্চবাণ তাড়া করে অষ্টপ্রহর!’
এক সঙ্গে হেসে উঠলো দুজনই।

কতো যে বাহারি পুষ্পবৃক্ষ অরণ্যের শোভা বর্ধন করে আছে তার কোনো ঠিক নেই যেন! কোনোটা বড়ো, আবার কোনোটা খুবই ছোট। সব পুষ্পবৃক্ষের নামও জানে না তারা। সবুজ গাছপালার ভেতরে প্রস্ফুটিত হয়ে আছে রক্তবর্ণ, নীল, হলুদ, গোলাপী নানা রঙের নানা জাতের পুষ্প। দূর থেকে চোখে যেন রঞ্জন বুলিয়ে দিচ্ছে!

অসংখ্য বৃক্ষ, লতা-পাতা আর বাহারি পুষ্পের সৌন্ধর্য অবলোকন করতে করতে শবরী বললো, ‘সখি, এই অরণ্য আমার চিত্তহরণ করেছে। ভূমিতে পদস্পর্শ করার জন্য আমার আর তর সইছে না!’

তারপর নদীর পারে জলের দিকে ঝুঁকে থাকা অচেনা একথোকা হলুদ পুষ্প উমাকে দেখিয়ে আবার বললো, ‘ওই পুষ্পগুলো কী সুন্দর, তাই না? আমার ইচ্ছে করছে পুষ্পগুলো তুলে খোঁপায় পড়তে।’

উমা হেসে বললো, ‘শ্যাম নামের ওই দাঁড়িকে বলিস, এনে দেবে। কড়ি খরচ করে তোকে মণ্ডা এনে খাইয়েছে, আর এ তো অরণ্যের পুষ্প!’

‘যা! তুই খাসনি বুঝি মণ্ডা?’
‘খেয়েছি কিন্তু সে তো তোর জন্য এনেছে।’
এমন সময় তাদের সঙ্গে যোগ দিলো সুলোচনা। উমা তাকে দেখে বললো, ‘এলি কেন? আরেকটু ঘুমো যা।’
‘কাল রাতে আমার ভাল ঘুম হয় নি। শুধু আজে-বাজে স্বপ্ন দেখেছি। তাই বড্ড ঘুম পাচ্ছিল।’
‘থাক থাক আর বলিসনে, আমি হাসতে হাসতে জলে পড়ে যাব! এই দু-দিন নিদ্রা দিতে দিতে শরীরে মেদ জমিয়ে ফেলেছে আবার বলে কিনা রাতে ঘুম হয় নি!’

শবরী দুজনের উদ্দেশে বললো, ‘সখি, চল ছাদে যাই, এখান থেকে অরণ্যের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে আমার মন ভরছে না!’
সুলোচনা বললো, ‘ছাতে তো রৌদ্র।’
‘ছত্র আছে তো, আমরা ছত্রের নিচে থাকবো।’
‘তবে চল।’

গিরিকা বলে ওরা ছাদে উঠে এলো। ছাদে বেশ বড়ো একটি রাজছত্র রয়েছে খুঁটির সঙ্গে বাঁধা, ওরা তারই ছায়ায় এসে দাঁড়িয়ে নদী এবং অরণ্যের সৌন্ধর্য দেখেতে দেখতে গল্প করতে লাগলো। হঠাৎ অরণ্য থেকে অদ্ভুত এক শব্দ ভেসে এলে সুলোচনা চমকে শবরীকে জড়িয়ে ধরলো, ‘উঃ মাতা গো! কীসের শব্দ?’

শবরী সুলোচনাকে বাহুবদ্ধ করে বললো, ‘ভয় পাচ্ছিস কেন? অরণ্য থেকে জল সাঁতরে আমাদের খেতে আসবে নাকি!’

পর পর একই রকমের শব্দ হচ্ছে, কান খাড়া করে শবরী আর উমা অরণ্যের দিকে তাকিয়ে শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করলো। শবরীর বাহুমুক্ত হয়ে সুলোচনাও তাকালো অরণ্যের দিকে। কিন্তু শব্দ শোনা ছাড়া কোনো কিছুই চোখে পড়লো না।

শবরী তরণীর পিছন দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িদের কাছে জিজ্ঞাসা করলো, ‘ও দাঁড়ি, এ কি ব্যাঘ্রের ডাক?’

শবরীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো উমা আর সুলোচনাও। সুকেতু হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই রঘু গলা হাঁকলো, ‘ব্যাঘ্র নয় গো মাতা, হস্তীর ডাক। মস্ত বড়ো বড়ো হস্তী আছে এই অরণ্যে। একটা-দুটো নয়, দলে দলে!’

শবরীরা হস্তীর ডাক এই প্রথম শুনলেও চম্পানগরীতে রাজবাড়ীর মস্ত বড়ো হস্তী দেখেছে। কিন্তু সে তো পোষ মানানো হস্তী। তাই বুনো হস্তী দেখার ব্যাকুল বাসনায় ওরা অনবরত অরণ্যের দিকে উঁকি-ঝুকি মারতে লাগলো, কিন্তু গভীর অরণ্য ছেড়ে তাদের দৃষ্টির সীমায় এলো না হস্তীর দল, কেবল থেকে থেকে ডাকতে লাগলো।

শবরী আবার বললো, ‘ও দাঁড়ি, এই অরণ্যে আর কী কী জীবজন্তু আছে?’

এবারও রঘু খুব আন্তরিকভাবে নগর জীবনে অভ্যস্ত, অরণ্য এবং জন্মন্ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ কন্যার কৌতুহলী প্রশ্নের উত্তর দিলো, ‘জীবজন্তুর কী শেষ আছে মাতা! কতো রকম জীবজন্তু যে আছে, তার ঠিক নেই। আমিও সবগুলোর নাম বলতে পারবো না। তবে হস্তী, ব্যাঘ্র, ভাল্লুক, মৃগ, শুয়োর, মোষ, শৃগাল, বনবিড়াল, সজারু এসব আছে। অনেক রকমের সাপ আর পোকামাকড় আছে। বিশাল বড়ো বড়ো অজগর সাপ আছে, যেগুলো মৃগ-শৃগাল ভক্ষণ করতে পারে, এমনকি মানুষও ভক্ষণ করতে পারে!

বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠলো উমার, ‘অজগর সাপ মানুষও ভক্ষণ করতে পারে?’
‘হ্যাঁ। আর জলে আছে কুম্ভীর, কুম্ভীরও মানুষ ভক্ষণ করতে পারে।’
সুলোচনা যেন আবার চমকে উঠলো, ‘কুম্ভীর তরণীতে লাফিয়ে উঠবে না তো?’

সুলোচনার নির্বোধ প্রশ্নে শ্যাম আর সুকেতু ঠোঁট টিপে হাসলো। রঘুও মৃদু হেসে বললো, ‘না গো মাতা, কুম্ভীর এতো বড়ো তরণীতে উঠতে পারবে না। তবে জলে নামলে বিপদ হতে পারে।’

‘মাতা গো! আমি ভুলেও জলের কাছে যাব না!’ বললো সুলোচনা।
উমা হেসে বললো, ‘তোকে জোর করে জলে নামিয়ে স্নান করাবো।’
‘ইস্, জল বিনে মরে গেলেও আমি জলে নামবো না।’

গিরিকা তাম্বূল চিবোতে চিবোতে কক্ষের বাইরে এসে নিচ থেকেই কন্যাদের উদ্দেশে বললেন, ‘কী লো, কী দেখে তোরা এমন হল্লা করছিস?’

সুলোচনা বললো, ‘আমরা হস্তীর ডাক শুনেছি মাসি।’
গিরিকা কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, ‘তাতেই এই! আমি ভাবলাম তোরা বুঝি ব্যাঘ্র দেখেছিস!’
তারপর পিছনের দাঁড়িদের দিকে এগিয়ে গিয়ে রঘুর উদ্দেশে বললেন, ‘হ্যাঁ ভ্রাতা রঘু, মহর্ষি বিভাণ্ডকের আশ্রমের কাছে পৌঁছুতে আর কতোক্ষণ লাগবে?’

রঘু জানালো, ‘রাজপুরোহিত যে জায়গার কথা বলেছেন, মহর্ষি বিভাণ্ডকের আশ্রম যদি সেখানেই হয়, তাহলে আর বেশিক্ষণ লাগবে না ভগিনী, আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি।’

‘তুমি ঠিক ঠিক চিনতে পারবে তো জায়গাটা?’
‘নিশ্চয় পারবো। আমি আগেও এসেছি এ পথে।’
দূরে ঘন বৃক্ষরাজিতে ভরা সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়া দেখে শবরী বললো, ‘অতো উঁচু উঁচু বৃক্ষ!’
রঘু বললো, ‘ওটা ত্রিযোজন পাহাড় গো মাতা। ওখানে অনেক ঋষি ধ্যান করেন।’

গিরিকা পূর্বে পাহাড় দেখেছেন। তাছাড়া বয়সের কারণেও হয়তো তার কৌতুহল আর উচ্ছ্বাসের ঘোড়ার মুখে লাগাম পরানো। কিন্তু তিনকন্যার তা নয়; তাই ত্রিযোজন পাহাড় দেখে তাদের কৌতুহল, বিস্ময়, আনন্দ আর উচ্ছ্বাস প্রকাশিত হলো লাগামহীন মুক্ত ঘোড়ার মতো! এই জলযাত্রা একের পর এক তাদেরকে এমন বিস্ময় উপহার দিচ্ছে যা তাদের কাছে ছিল কল্পনাতীত! চম্পানগরীর এক ক্ষুদ্র গণিকালয়ের কুড়ির মতো জীবন এই উন্মুক্ত অরণ্য, নদী আর পাহাড় দেখে যেন পুষ্পের ন্যায় পাপড়ি মেলে প্রস্ফুটিত হয়ে জীবনের অকৃত্রিম সুবাস ছড়াচ্ছে!

দারুণ বাতাস বইছে, ত্রিযোজন পর্বত পিছনে ফেলে এলেও এখনো দৃষ্টিগোচর হচ্ছে পর্বতের চূড়া। এদিকটাতেও ছোট ছোট পাহাড় চোখে পড়ছে। পাহাড় আর ঘন অরণ্যের কারণে গরমের প্রভাব এদিকে বেশ কম। যতো উত্তরে এগোচ্ছে তরণী, বাতাস যেন ততোই স্বস্তি নিয়ে আসছে।

এখন দাঁড়িদের ভেতরেও কাজ করছে দারুণ কৌতুহল, কেননা আজ সকালে রঘু সবাইকে বলেছে তাদের এই জলযাত্রার আসল উদ্দেশ্য। তারা সকলেই বৃষ্টি চায়, রাজ্যের মঙ্গল চায়; তাই তারাও চায় এই গণিকারা বিজয়ী হোক; মুনিকুমারকে বশ করে একবার নিয়ে আসুক তরণীতে, তারপর দাঁড় বেয়ে হাওয়ার বেগে তরণী নিয়ে যাবে চম্পানগরীতে।

সূর্য যখন পশ্চিমাকাশে অনেকটা হেলে পড়লো, কৌশিকী নদীর জলে পড়লো বৃক্ষরাজির ছায়া, রঘু তখন তরণী নোঙর করলো কৌশিকীর পারে, যেখানে এক পাহাড়ি ঝিরি মিলেছে কৌশিকীর সাথে। যেন এক পাগলাটে চঞ্চল কিশোর প্রেমিক দূরের পাহাড় থেকে বয়ে আনা অর্ঘ্য আঁজলা উপুড় করে অকৃপণভাবে অর্পণ করছে, আর যৌবনবতী প্রেমিকা কৌশিকীও পরম স্নেহ-ভালবাসায় বুকে টেনে নিচ্ছে তার এই অসম প্রেমিকের অর্ঘ্য! কৌশিকীর বুকের ছন্দময় ঢেউয়ের শব্দ, বৃক্ষরাজির মর্মর ধ্বনি, পাখির কলকাকলি ছাপিয়ে নিনাদিত হচ্ছে এক অসম প্রেমন্মত্ত যুগলের মিলনের মধুর শব্দ! এখানেই কোথাও মহর্ষি বিভাণ্ডকের আশ্রম, রঘুকে তেমনটাই বর্ণনা করেছেন রাজপুরোহিত। ঝিরি থেকে উত্তরদিকে ঘাসের ভেতর দিয়ে একটা পায়ে চলা সরু পথ চলে গেছে আর তিনশো কদম দূরে নদীতে একখানা ছোট্ট তরণী ভাসতে দেখা যাচ্ছে। এই পায়ে চলা পথ আর তরণী-ই জানান দিচ্ছে এখানে মানুষ থাকার সম্ভাবনা। গিরিকার পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মহর্ষি বিভাণ্ডকের আশ্রম খুঁজে বের করার জন্য রঘু তরণী থেকে নেমে পড়লো ঝিরির উত্তরপাশে।

গিরিকা রঘুকে সতর্ক করলেন, ‘সাবধান ভ্রাতা, মহর্ষি বিভাণ্ডক এবং তার পুত্র তোমাকে যেন কিছুতেই দেখতে না পান। আশ্রমের কাছে যাবার দরকার নেই, তুমি শুধু নিশ্চিত হয়ে আসবে আশ্রমটা এখানেই কি-না।’

ঘাড় নাড়লো রঘু, ‘নিশ্চয় ভগিনী।’

গিরিকার নির্দেশে রাধুনী দুজন জলের মুটকি নিয়ে ব্যস্ত পায়ে তরণী থেকে নেমে ঝিরির স্বচ্ছ পানীয় জল সংগ্রহ করে নিয়ে এলো। শ্যাম এখন হাল ধরেছে, তার নেতৃত্বে রঘুর নির্দেশনা অনুযায়ী তরণী দ্রুত ফিরে যেতে লাগলো দক্ষিণের দিকে, এখানে তরণী থাকলে যে-কোনো সময় তা মহর্ষি বিভাণ্ডকের দৃষ্টিগোচর হতে পারে। নদীর একটা বাঁক পেরিয়ে শ্যাম এমন স্থানে তরণী নোঙর করলো যাতে কোনো কারণে ঝিরির অন্তে এসে দাঁড়ালেও মহর্ষি বিভাণ্ডক বা তার পুত্র তরণী দেখতে না পান। রঘু আশ্রমের সন্ধান নিয়ে নদীর পার ধরে হেঁটে এসে এখানে পৌঁছবে। বলাই নদীপারে নেমে একটা কদম গাছের সঙ্গে তরণীর লম্বা মোটা দড়ি বাঁধলো।

এখানে নদীর পারে বৃহৎ দুটো বৃক্ষ মরে পড়ে আছে ভূমিতে। হয়তো বহুদিন আগে ঝড়ে উপড়ে গিয়েছিল বৃক্ষদুটি। নদীর তীরের কাছাকাছি ঘাস কিংবা লতাগুল্মও বেশি বড়ো নয়, আর ছোট ছোট মরা বৃক্ষ এবং ডালপালা দেখে মনে হচ্ছে বর্ষার সময় নদীর কুল ছাপিয়ে অনেকটা উপরে ধাবিত হয় জল।

গিরিকা এতোক্ষণ কন্যাদের কক্ষের বাইরে বেরুতে নিষেধ করেছিলেন, এবার সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতেই বালিকার চপলতায় তরণী থেকে নিচে নামলো কন্যারা। চতুর্দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে শবরীর মনে হলো চম্পানগরী যদি ধরণীর শব্দমুখর মুখ হয় তবে এ স্থান নিঃসন্দেহে কাজলটানা চোখ! অরণ্য আর কৌশিকী যেন এখানে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জড়াজড়ি করে আছে। মনুষ্য কোলাহলহীন সুনসান নিসর্গ। যতোটুকু কোলাহল তা অরণ্যেরই অলংকার-নানান রকম পাখির সুমিষ্ট ডাক, ঝিঁঝির বাদ্য, বাতাসের শনশন আর কৌশিকীর বয়ে চলা চলাৎ ছলাৎ শব্দ! এই দিনের বেলাতেও ঝিঁঝির ডাকে কান রুদ্ধ হয়ে যাবার যোগার! তিনকন্যা তরণীর কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে এলো ঝড়ে উপড়ানো বৃক্ষের কাছে। এ স্থানে নাম না জানা কয়েক প্রজাতির পুষ্পবৃক্ষে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের পুষ্প প্রস্ফুটিত হয়ে সুবাস ছড়াচ্ছে। উমা এবং সুলোচনা হলুদ আর রক্তবর্ণ পুষ্প তুলে একে অন্যের কবরীতে পরিয়ে দিলো। শবরী কেশ বন্ধন করে নি, সে পুষ্প তুলে দু-হাতের আঁজলায় নিয়ে ঘ্রাণ শুকলো, তারপর আচমকা বালিকার চপলতায় পুষ্পগুলো ছুড়ে দিলে শূন্যে। হস্তমুক্ত পুষ্প তার কেশদাম, মুখশ্রী, শরীর ছুঁয়ে ভূমিকে লুটালো। আনন্দের আতিশয্যে তার উত্তরীয় ভূমিতে লুটিয়ে পড়লেও খেয়াল করলো না।

সুলোচনা বললো, ‘সখি, তুই কী পাগল হয়ে গেলি!’
শবরী হাস্যমুখে বললো, ‘পাগল হয়ে এই অরণ্যে জীবন অতিবাহিত করাও সুখ সখি!’
তারপর অরণ্যের দিকে তাকিয়ে কান পাতলো শবরী, চেনা পাখির কণ্ঠ শুনতে পেয়ে বললো, ‘সখি, তোরা শুনতে পাচ্ছিস? কোকিলের কণ্ঠ।’
উমা আর সুলোচনাও কান পেতে শুনে দুজনে প্রায় একসঙ্গে বললো, ‘হুম।’
উমা মৃদু লাফিয়ে ভূ-পতিত মরা বৃক্ষের ওপর বসে বললো, ‘আমাদের চম্পানগরীতে চারিদিকটা কেমন হালকা লাগে, আর এখানে চারপাশটা কেমন ভারী মনে হচ্ছে, কেমন গা ছমচমে পরিবেশ, তাই না?’

শবরী বললো, ‘এই ভারত্ব প্রকৃতির; অরণ্যের বৃক্ষ-লতা, পশুপাখির। চম্পানগরীর অরণ্য ধ্বংস করে আমরা গৃহ বানিয়েছি, তাই ওখানে প্রকৃতির ভারত্ব নষ্ট হয়েছে।’

তারপর কেশে আটকে থাকা ছোট্ট একটা পুষ্প হাতে নিয়ে ঘ্রাণ শুকে শবরী আবার বললো, ‘আমার দারুণ লাগছে! মনে হচ্ছে যদি এখানে কিছুকাল অতিবাহিত করতে পারতাম!’

উমা রসিকতা করে বললো, ‘দাঁড়ি বলছিলো যে ত্রিযোজন পর্বতে ঋষিরা থাকে, তুই বরং কোনো ঋষিকে বিবাহ করে এদিকেই থেকে যা।’
‘থাকতে পারলে মন্দ হয় না সখি, আমি ঢের পারবো থাকতে।’
সুলোচনা বললো, ‘যতো পুষ্প আর সৌন্ধর্যই থাকুক, আমি কখনোই এখানে বেশিদিন থাকতে পারবো না, হাঁপিয়ে উঠবো।’
হাতের পুষ্পটি পুনরায় কেশের জালে আটকে বললো শবরী, ‘যার হৃদয়ের সবটুকু গ্রাস করেছে বহুমূল্য সুবর্ণহার, সে কী করে পুষ্পমাল্যের মর্ম বুঝবে সখি!’
শবরীর কথায় হেসে উঠলো উমা, আর সুলোচনা যেন একটু অসন্তুষ্ট হলো। কিন্তু কিছুই খেয়াল করলো না শবরী। গভীর অরণ্যের দিকে দৃষ্টি ছুড়ে বললো, ‘তোরা গন্ধ পাচ্ছিস?’
উমা বললো, ‘হ্যাঁ, পুষ্পের গন্ধ।’
‘উহু, হলো না। পুষ্পের গন্ধ ছাড়াও আরো একটা গন্ধ আছে। অরণ্যের হৃদয়ের সুমিষ্ট গন্ধ! বৃক্ষ আর লতাগুল্মের আশ্চর্য গন্ধ!’
উমা বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ সখি, তুই ঠিক বলেছিস।’

শবরী ঈষৎ সামনে ঝুঁকে একগুচ্ছ বুনো পুষ্পের ঘ্রাণ শুকতে শুকতে কান পাতলো অরণ্যের হৃদয়ে, অসংখ্য পাখি সুমিষ্ট কণ্ঠে ডাকছে, আর সকল কণ্ঠ ছাপিয়ে থেকে থেকে ডেকে উঠছে কোকিল। চম্পানগরীতে কতোদিন কোকিলের ডাক শুনতে পায় নি সে! তাদের অলিন্দের কাঠগড়া কিংবা আঙিনার কাঁঠালবৃক্ষের শাখায় যে চড়ুই দম্পতি প্রেমময় খুনসুটি করতো, বসন্ত আর গ্রীষ্মে ডেকে ডেকে মন উতলা করে দিতো যে কোকিল, অলস মধ্যা‎‎হ্নে কানে ভেসে আসতো যে কাঠঠোকরার খর্জূর বৃক্ষে ঠোকরানোর শব্দ, বটের শাখায় বসে মিষ্টি সুরে ডাকতো যে ঘুঘু কিংবা নীলকণ্ঠ পাখি; তারা সব দুর্ভিক্ষ আর খরা কবলিত নগরী ছেড়ে বুঝি এই মায়াময় অরণ্যের কোলে আশ্রায় নিয়েছে! বহুদিন পর এতো পাখির সুমিষ্ট স্বর শুনে প্রাণ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে!

হঠাৎ নদীর অপর পারে তাকিয়ে থাকা সুলোচনার গোমরা মুখে দৃষ্টি পড়তেই শবরীর মনে হলো সুলোচনা তার কথায় অভিমান করেছে। সুলোচনাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে অধরে চুম্বন করে বললো, ‘মুখ গোমড়া করে আছিস কেন সখি, আমার কথায় অভিমান করেছিস?’

সুলোচনা কোনো কথা বললো না। শবরী আবার বললো, ‘বল, অভিমান করেছিস কি-না? না বললে ছাড়বো না।’

‘তুই অমন করে বললি কেন?’

এবার সুলোচনার কণ্ঠ মণিবন্ধে আবদ্ধ করে শবরী বললো, ‘আমি কখনো মিথ্যে বলি না সখি। আমার মাতার অনুচর হয়ে থাকতে থাকতে তুই তার মতোই কেবল সাজসজ্জা করে কড়ি গোনা আর অলংকারের পুঁটলি ভারী করতে শিখেছিস। আমার মাতাকে দেখ, কান পেতে মানুষের হৃদয়ের শব্দ শোনে না, মানুষের হৃদয় বুঝতে পারে না। পুষ্পের ঘ্রাণ পায় না, নদীর বুকের মায়াময় ধ্বনি শুনতে পায় না, ঠাণ্ডা লাগার ভয়ে বৃষ্টি কিংবা কুয়াশায় ভেজে না, জ্যোৎস্না আর অন্ধকার তার কাছে দুই-ই সমান। কেবল কড়ি আর অলংকার ছাড়া আর কিছু বুঝতে চায় না। দেখলি না, মহর্ষি বিভাণ্ডকের শাপের ভয়ে সমগ্র চম্পানগরীর একজন গণিকাও মুনিকুমারকে হরণ করে রাজধানীতে নিয়ে যাবার সাহস করলো না। কিন্তু আমার মাতা একবারও তার নিজের এবং আমাদের প্রাণের ভয় করলো না। আগ বাড়িয়ে সুযোগটা নিলো। প্রাণের চেয়েও তার কাছে কড়ি আর অলংকারের মূল্য অনেক বেশি। আমি তার হৃদয়ে কান পাতলে কেবল কড়ির ঝনঝন আর অলংকারের ঝমর ঝমর শব্দ শুনি! মাতার মমতার ছোঁয়া খুঁজে পাই না। ফলে আমার মাতা কখনো শান্তিতে থাকে না, সারাক্ষণ কীসের যেন অনিশ্চয়তায় ভোগে। এখন আমাকেও তার মতো করে গড়তে চায়, কিন্তু আমি কখনোই তার মতো হতে পারবো না। সখি, তোকেও অনুরোধ করছি, আমার মাতাকে অনুকরণ করিস না। আমি তোর ভালো’র জন্যই বলছি। তাহলে নিজের সুখ তো হারাবিই, আবার তোর যখন সন্তান হবে, তাদের সুখও হরণ করবি! আমার ওপর রাগ করিস না সখি, আমার লক্ষ্মী সখি, এবার একটু হাস!’

দু-হাতের আঙুলে সুলোচনার গাল ধরে টিপতে লাগলো শবরী। তার কাণ্ড দেখে হাসলো উমা। জোরাজুরিতে সুলোচনা মুচকি হাসতেই শবরী ওর গালে পুনরায় চুম্বন করে বললো, ‘এই তো আমার প্রাণের সখি হেসেছে!’

চোখে আদর বুলানোর মতো অপরা‎হ্ণের আলোয় প্রকৃতির সৌন্ধর্য অবলোকন করে চোখ ও চিত্তের মুগ্ধতার ঘোর কাটতে না কাটতেই অরণ্যে খপ করে অন্ধকার মুখ বাড়ায় অন্যরকম সৌন্ধর্য নিয়ে। এই অন্ধকার কারো কাছে দুঃস্বপ্নে দেখা ভয়ঙ্কর কোনো জন্তুর মতো, আবার কারো কাছে কোমল হৃদয়ের উন্মুক্ত কেশবতী কালো নারীর মতো! উন্মুক্ত নদীবক্ষে এখন চাঁদের আলো থাকলেও বৃক্ষের নিচে, ঝোপে-ঝাড়ে অন্ধকার নেমে এসেছে। অরণ্যের অতিকায় বৃক্ষ যেন নদীর জলে ঝুকে দেখছে নিজের প্রতিবিম্ব। গভীর অরণ্য থেকে ভেসে আসছে নানা রকম জীবজন্তু আর পাখ-পাখালির ডাক। কাছে-পিঠেই কোথাও শিয়াল ডাকচ্ছে একনাগাড়ে। আকাশে জ্বলছে অসংখ্য নক্ষত্র, আর অজস্র জোনাকিপোকা আলো জ্বেলে উড়ছে অরণ্যে, কিছু জোনাকিপোকা উড়তে উড়তে তরণীর উপরেও চলে আসছে, আবার ফিরে যাচ্ছে। তরণীর ছাদে হাঁটতে হাঁটতে অতি উচ্ছ্বাসে জোনাকিপোকা ধরতে গেল শবরী আর উমা, কিন্তু বারবারই তাদের আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল। উমা শেষ পর্যন্ত একটা ধরত পারলো। শবরী আবদার করলো, ‘সখি, জোনাকিপোকাটাকে আমার কেশে জড়িয়ে দে।’

উমা তার প্রিয় সখির খোলা কেশে জড়িয়ে দিলো জোনাকিপোকাটাকে, কেশের মধ্যে টিপ টিপ করে আলো জ্বালাতে লাগলো জোনাকিপোকাটা, তারপর হঠাৎ-ই উড়ে পালালো অরণ্যের দিকে।

অরণ্যে এমন রাত্রিবাসের অভিজ্ঞতা কন্যাদের যেমনি নতুন, তেমনি গিরিকারও। গিরিকা এর আগে নানা দেশের নিভৃত হাট কিংবা জন্মনের নদীর ঘাটে তরণীতে রাত্রিবাস করেছেন, কিন্তু জনপদ থেকে বহু দূরে এমন হৃদয় স্তব্ধ করা অরণ্যলগ্ন নদীবক্ষে তরণীতে কখনো রাত্রিবাস করার অভিজ্ঞতা তার হয় নি। এই রাত্রিবেলায় তার কাছে মনে হচ্ছে এতো অরণ্য নয়, যেন কোনো অতিকায় প্রাণীর গোপনাঙ্গ!

প্রত্যুষেই একে একে সকলে শয্যা থেকে উঠে পড়েছে। নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশ হলেও রাত্রে কারো কারো ঘুম ভালো হয়েছে, আবার কারো কারো গভীর রাত্রে আচমকা ঘুম ভেঙে গেছে কোনো প্রাণির অদ্ভুত ডাক শুনে। শ্যাম আর সুকেতু কাল রাতেও তরণীর গলুইয়ের দিকের খোলা জায়গায় ঘুমোতে চেয়েছিল, কিন্তু কোনো অঘটনের আশঙ্কায় রঘু তাদেরকে বাইরে ঘুমুতে দেয় নি। তারাও অন্য দাঁড়িদের সঙ্গে নিচে ঘুমিয়েছিল। বয়োজ্যেষ্ঠগণ যে শুধু পুরনো সংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস আঁকড়েই বাঁচে না, এসবের সঙ্গে তাদের কাছে বিস্তর অভিজ্ঞতাও থাকে, উত্তর প্রজন্ম বয়োজ্যোষ্ঠদের চিন্তা পুরোপুরি বাতিল না করে কেবল সংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসটুকু ঝেড়ে ফেললে সেই অভিজ্ঞতাটুকুই যে মহামূল্যবান হয়ে ওঠে, সকালে ঘুম থেকে উঠে নদীর পারে তরণীর আশপাশে ব্যাঘ্রের পায়ের ছাপ দেখে তা উপলব্ধি করেছে শ্যাম আর সুকেতু। রঘু অন্য দাঁড়িদের ডেকে দেখিয়েছে ব্যাঘ্রের পায়ের ছাপ, গিরিকা এবং তার তিন কন্যাও অবাক হয়ে গেছে ব্যাঘ্রের পায়ের ছাপ দেখে। গিরিকা করজোর কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ‘ভগবান বিষ্ণু রক্ষা করেছে, ভগবান বিষ্ণুর অসীম করুণা!’

ব্যঘ্রের পায়ের ছাপ দেখার পর রঘুর নির্দেশে দাঁড়িরা তরণী ওখান থেকে সরিয়ে আরো কিছুটা দক্ষিণে নিয়ে রাখলো যেখানে নদীর পারে বৃক্ষ-লতাগুল্ম কিছুটা কম।

রঘু কাল বিকেলে গিয়ে কিছুটা দূর মহর্ষি বিভাণ্ডকের আশ্রম দেখে এসেছে। যদিও সে আশ্রমের কাছে যায় নি, মহর্ষি বিভাণ্ডক এবং তার পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গকেও দেখতে পায় নি। তবে এটাই যে বিভাণ্ডকের আশ্রম এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত, কেননা রাজপুরোহিতের ভাষ্য মতে এখানে আর কোনো ঋষির আশ্রম থাকার কথা নয়, আশপাশে অন্য কোনো আশ্রম দেখতেও পায় নি সে, তাই ভুল হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

প্রাতঃরাশ সেরে শ্যামকে সঙ্গে নিয়ে রঘু প্রত্যুষেই মহর্ষি বিভাণ্ডককে পর্যবেক্ষণ করতে গেল নদীর পার দিয়ে হেঁটে। ঝিরি আর কৌশিকীর মিলনস্থল থেকে একটা পায়ে চলা সরু পথ চলে গেছে উত্তর দিকে, প্রায় দুশো কদম উত্তরে যাবার পর কৌশিকীর পার থেকে হাত দুয়েক চওড়া একটি পায়ে চলা পথ অরণ্যের ভেতরে প্রবেশ করেছে, সামান্য এঁকে-বেঁকে এই পথ শেষ হয়েছে হাজার কি বারোশো কদম দূরে বিভাণ্ডকের আশ্রমের আঙিনায়। আর নদীপারের উত্তরমুখী পথটি চলে গেছে আরো উত্তরে। সব পথ গতকাল পর্যবেক্ষণ করে গেছে রঘু।

অরণ্যের মধ্য দিয়ে পথ চলতে চলতে শ্যাম একবার হোঁচট খেলে রঘু তাকে সতর্ক করলো, ‘দেখে চল শ্যাম, হোঁচট খেয়ে কপাল কাটবি তো!’

মানুষের পায়ের শব্দ পেয়ে কিছুটা দূরের একটা ঝোঁপের আড়াল থেকে একটা গোখরো সাপ ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করে উঠলো। রঘু আর শ্যাম চলা থামিয়ে তাকালো ঝোপের দিকে, সাপটিকে দেখতে পেয়ে শ্যাম বললো, ‘কী তাগড়া দেখেছো তাত, একবার একটা ছোবল দিলে মাতার নাম মুখে নিতে নিতেই শেষ!’

আরো কিছুদূর হেঁটে ঝিরি আর কৌশিকীর মিলনস্থলে গিয়ে পৌঁছলো রঘু আর শ্যাম। সরু পথে উঠে রঘু বললো, ‘পা চালিয়ে চল, দ্রুত এই পথটুকু অতিক্রম করতে হবে, নইলে মহর্ষি বিভাণ্ডক এদিকে এলে তার দৃষ্টিতে পড়ে যেতে পারি।’

দ্রুত পা চালিয়ে বামদিকে আশ্রমে যাবার পথে প্রবেশ করলো দুজনে, কিছুদূর যাবার পর পথ ছেড়ে উত্তরদিকে একশো কদম দূরে অরণ্যের ভেতরের একটা স্থুলকায় পিপুল বৃক্ষ আর লতাগুল্মের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রইলো পথের দিকে চেয়ে। বড়ো বড়ো মশা পোঁ পোঁ শব্দ তুলে ঘুরতে লাগলো দুজনের চারপাশে, কামড়াতেও লাগলো দু-চারটা, নিঃশব্দে মশা তাড়াতে তাড়াতে দুজনে অপেক্ষা করতে লাগলো। অনেকক্ষণ লুকিয়ে থাকার পর তারা একজন ঋষিকে দেখতে পেলো, তিনি একটা ঝুড়ি হাতে নিয়ে আশ্রমের পথ ধরে এসে নদীর পারে দাঁড়ালেন, পূর্বদিকে কৌশিকীর অপর পারে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর উত্তরদিকের সরু পথে পা বাড়ালেন। রঘু আর শ্যামের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ইনি-ই মহর্ষি বিভাণ্ডক। বিভাণ্ডক অনেকটা দূরে চলে গেলে শ্যাম চুপি চুপি অরণ্যের ভেতর দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে দেখলো যে বিভাণ্ডক সরু পথ ছেড়ে অরণ্যের ভেতরে প্রবেশ করলেন। আর এগোলো না শ্যাম, ফিরে এলো পিপুল বৃক্ষের কাছে। দুজন অপেক্ষা করতে লাগলো বিভাণ্ডক কখন ফেরেন তা দেখার জন্য।

দ্বিপ্রহরের অন্তে বিভাণ্ডক ঝুড়ি মাথায় বয়ে যে পথে গিয়েছিলেন সেই পথ ধরেই ফিরে এলেন। তিনি বুঝতেই পারলেন না যে দুজন মানুষ তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। বিভাণ্ডক আশ্রমে ফেরার পর রঘু আর শ্যাম যখন তরণীর কাছে ফিরে এলো, তখন একটা আগর বৃক্ষের তলায় কন্যাদের সঙ্গে বসে গল্প করছেন গিরিকা। শ্যামের প্রচণ্ড ক্ষুধাবোধ হওয়ায় সে তরণীতে উঠলো আর রঘু গেল গিরিকাকে সমাচার জানাতে। রঘুর মুখে সকল বৃত্তান্ত শুনে গিরিকা বললেন, ‘মহর্ষি হয়তোবা রোজই ফল সংগ্রহ করতে যান আর এসময়ই মুনিকুমার আশ্রমে একা থাকেন। এই সুযোগটাই আমাদেরকে কাজে লাগাতে হবে। তোমরা কালও যাবে, যদি দেখো যে মহর্ষি ফল সংগ্রহ করতে গেছেন, তাহলে তৎক্ষণাৎ এসে তরণী নিয়ে গিয়ে নোঙর করবে আশ্রমের পথের কাছে। শবরী মুনিকুমারের কাছে যাবে আর আমরা ওর জন্য ওখানেই অপেক্ষা করবো।’

রঘু বললো, ‘ভগিনী, আমাদের ওখানে অপেক্ষা করা অনুচিত হবে। কেননা মহর্ষি কোনো কারণে সময়ের পূর্বেই ফিরে আসলে, আর আমাদের ওখানে দেখলে বিরক্ত হতে পারেন। তখন আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপও ভণ্ডুল হতে পারে।’

‘তোমার বুদ্ধি প্রশংসনীয় ভ্রাতা রঘু। কিন্তু শবরী আমার একমাত্র কন্যা, তাকে ওখানে একা ছেড়ে আসতে আমার মন চাইছে না।’
‘ভগিনী, আপনার পছন্দ হবে কিনা জানি না। তবে অনুমতি পেলে আমি একটা উপায় বলতে পারি।’
‘বলো, শুনি কী উপায়।’

‘ভগিনী, শ্যাম পশুপাখির কণ্ঠ নকল করে ডাকতে পারে। আমরা শবরী মাতার সঙ্গে ওকেও আশ্রমের পথে নামিয়ে দিতে পারি, শবরী মাতা আশ্রমে যাবেন আর ও আশ্রমের পথের পাশের লতা-গুল্মের ঝোপে লুকিয়ে থাকবে। মহর্ষি যদি সময়ের পূর্বেই ফিরে আসেন তবে ও মহর্ষিকে দেখামাত্র ঝোপের আড়াল থেকে পাখির কণ্ঠে ডেকে শবরী মাতাকে সতর্ক করবে। তৎক্ষণাৎ সতর্ক হয়ে শবরী মাতা আশ্রম ত্যাগ করে পায়ে চলা পথের পরিবর্তে আশ্রমের তিনশো কদম দক্ষিণের ঝিরিপথ দিয়ে নদীর পারে এসে শ্যামের সঙ্গে একত্রিত হবেন। শবরী মাতাকে পথ দেখিয়ে আমাদের কাছে নিয়ে আসবে শ্যাম। যদিও পাথুরে ঝিরিপথে হাঁটতে শবরী মাতার কিছুটা কষ্ট হবে। কিন্তু এটাই সবচেয়ে নিরাপদ পন্থা।’

গিরিকা উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘রঘু, তোমার বিচক্ষণতায় আমি অভিভূত হয়েছি! বিধিলিপির ফলে তুমি নিষাদকুলে জন্মে দাঁড়ির কাজ করছো বটে, কিন্তু তুমি আরো বড়ো কাজের যোগ্য। এই কৌশল অবলম্বন করে আমরা যদি সফল হই, তবে কেবল প্রশংসাই নয়, আমি তোমাকে আরো বড়ো উপহার দেব। রাজবাড়ীর কর্তাদের ধরে তোমাকে এর চেয়ে অধিক যোগ্য কাজে নিয়োগের ব্যবস্থা করবো।’

‘ভগিনী, এই কৌশলে যদি কোনো ফল লাভ হয় তবে তার কৃতিত্ব আমার নয়, শ্যামের। মহর্ষি বিভাণ্ডককে পর্যবেক্ষণ করার সময় শ্যামই আমাকে এই কৌশলের কথা বলেছে।’

গিরিকা চোখে-মুখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন, ‘বেশ, তবে কেবল শ্যাম নয়, তোমাদের সকলের মঙ্গলের চেষ্টাই আমি করবো।’
‘আপনার কল্যাণ হোক ভগিনী।’

গিরিকাকে নমস্কার করে বিলম্বিত মধ্যা‎হ্নভোজের জন্য তরণীতে উঠলো রঘু। আহার আর শুয়ে-বসে থাকা ছাড়া এখন দাঁড়িদের হাতে আর কোনো কাজ নেই। বলাই আর ললিত অবসর পেলেই পড়ে পড়ে ঘুমায়, ঘুমিয়ে ক্লান্তি দূর করে শরীর চাঙ্গা করে; এখনো ঘুমাচ্ছে। আহার শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর শ্যাম সুকেতুকে বললো, ‘চল দেখি অরণ্যের ভেতরে কিছু ফলমূল কুড়িয়ে পাই কি-না।’

সুকেতু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। তরণী থেকে নেমে দুজনকে অরণ্যের দিকে ধাবিত হতে দেখে রঘু বললো, ‘যাচ্ছিস কোথায়?’
ঘাড় ফিরিয়ে শ্যাম বললো, ‘এইতো অরণ্যের ওদিকটা একটু ঘুরে দেখি।’
সতর্ক করলো রঘু, ‘বেশি দূরে যাসনে আবার।’
‘চিন্তা ক’রো না তাত। বেশি দূরে যাব না।’

যাবার সময় দুজনই আড়চোখে একবার তাকালো গিরিকা এবং তিনকন্যার দিকে। উলুপী কিছুক্ষণ আগে ফল কেটে মৃৎপাত্রে সাজিয়ে রেখে গেছে ওদের মাঝে, সকলে ফলাহার করছে। শ্যামের সঙ্গে শবরীর চোখাচোখি হওয়ামাত্র শ্যাম দৃষ্টি নামিয়ে নিলো, তারপর সোজা পথে হেঁটে ওরা হারিয়ে গেল অরণ্যের মাঝে।

অরণ্যের রূপ যেন গণিকাদের রূপের মতোই রহস্যময়! সকালে এক রূপ, মধ্যা‎‎হ্নে এক রূপ, অপরা‎হ্ণে আর এক রূপ, গোধূলি কিংবা গভীর রাতেও ভিন্ন ভিন্ন রূপ! এখানে অরণ্যই যেন সূর্যকে শাসন করে! অরণ্যের স্থান বিশেষে বৃক্ষ এমন উঁচু আর ঘন যে সূর্যের আলো পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে না। সুকেতু দা নিয়ে এসেছে, একটা বৃক্ষের সরু লম্বা দুটো ডাল কেটে পাতা ছড়িয়ে একটা শ্যামকে দিলো, আরেকটা রাখলো নিজের হাতে। বলা তো যায় না, বাঘ-ভাল্লুক নয়তো সাপের মুখে যদি পড়ে! ওরা অরণ্যের গভীরের দিকে হাঁটছে তো হাঁটছেই, অরণ্য যেন ওদেরকে হাঁটার নেশা ধরিয়ে দিয়েছে! এতো বৃক্ষ আর লতা-গুল্ম ওরা জীবনে দেখে নি, নামও জানে না সব বৃক্ষ আর লতার। কোথাও কাঁঠালবৃক্ষে কাঁঠাল ধরেছে, কোথাও করমচাবৃক্ষে করমচা, কোথাও-বা বৈঁচিবৃক্ষে গাঢ় বেগুনি রঙের পক্ক বৈঁচি অরণ্যের শোভা বাড়িয়ে আছে। সুকেতু একটা বৈঁচিবৃক্ষের কাছে গিয়ে গোটাকতক পক্ক বৈঁচি মুখে পুড়ে বললো, ‘দাঁড়াও শ্যামদা, ওদের জন্য কিছু বৈঁচি তুলে নিই।’

‘ওদের জন্য তো তোর বেশ দরদ দেখছি!’ শ্যাম বললো।
‘তোমার চেয়ে বেশি নয়, এ বুনোফল, মাঙনা নিয়ে যাচ্ছি। আর তুমি তো গাঁটের কড়ি খরচ করে মণ্ডা খাইয়েছো।’
‘ধুর!’
‘ধুর বলছো কেন! পানশালা থেকে ফেরার পথে তোমার হাতে শালপাতার ঠোঙায় আমি মণ্ডা দেখেছি, আমার নেশা হয়েছিল স্বীকার করছি, তা বলে মণ্ডার ঠোঙা চিনবো না!’
‘নে কথা বাড়াস নে, বৈঁচি তোল।’

শ্যাম নিজেও হাত লাগালো বৈঁচি তুলতে। সুকেতু মস্তকে বাঁধা বস্তুখণ্ড খুলে তাতে গিঁট দিয়ে থলের মতো বানালো, দুজনে বৈঁচি তুলে তাতেই রাখলো। অনেকগুলো বৈঁচি তুলে আবার হাঁটতে শুরু করলো ওরা।

অনেকক্ষণ হাঁটার পর একটা গাববৃক্ষের নিচে এসে দাঁড়ালো ওরা, গাব অবশ্য নেই। তলায় অসংখ্য গাবের শুকনো খোলস আর আঁটি। গাববৃক্ষের অনতি দূরেই বেশ কয়েকটা জামরুল আর আম্রবৃক্ষ, ওরা সেদিকেই এগোলো। আম্র বৃক্ষগুলোর শাখায় বসে গোটা দশেক হনুমান পক্ক আম্র ভক্ষণ করছে, দুটো হনুমানের কোলে আবার ছোট্ট দুটো বাচ্চা। সবুজ রঙের অনেকগুলো টিয়াপাখি জামরুলবৃক্ষের শাখায়-শাখায় ঝুলে ভক্ষণ করছে জামরুল। ওদের রাজ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত আগন্তুকদের দেখে ওরা হয়তো কিছুটা বিরক্ত, হয়তো-বা খানিকটা ভীতও! হনুমানগুলো বিচিত্র স্বরে ডেকে কখনো নিজেরা একে অন্যের দিকে, আবার কখনো আগন্তুকদের দিকে তাকাচ্ছে আর এক ডাল থেকে আরেক ডালে যাচ্ছে।

শ্যাম বললো, ‘আম্রবৃক্ষে প্রচুর পক্ক আম্র আছে, কিন্তু হনুমানদের আম্র আমরা পাড়লে ওরা আবার আঁচড়ে-কামড়ে দেবে না তো!’
‘বলা যায় না, দিতেও পারে! ভয় পেয়ো না। আমি আম্রবৃক্ষে উঠছি, তুমি জামরুলবৃক্ষে ওঠো।’
‘ওই দুটো আম্রবৃক্ষে ওরা আছে থাকুক। তুই অন্য একটি বৃক্ষে ওঠ।’

শ্যামের কথা মতো সুকেতু অন্য একটি আম্রবৃক্ষে উঠলো। আর শ্যাম উঠলো জামরুল বৃক্ষে। টিয়াপাখিগুলো শ্যামকে জামরুল বৃক্ষে উঠতে দেখে কোনোটা এক শাখা থেকে উড়ে আরেক শাখায় গিয়ে বসলো, আবার কোনোটা শ্যামের দিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় জামরুল ভক্ষণে মনোযোগ দিলো। সব বৃক্ষে এতো ফল ধরেছে যে পশুপাখিও হয়তো ভক্ষণ করে শেষ করতে পারে না, তলায় অসংখ্য ফল পড়ে পচছে। আর অন্যদিকে দুর্ভিক্ষে মরছে অঙ্গরাজ্যের অসংখ্য মানুষ, সেখানে নিষ্ফল বৃক্ষ শুকিয়ে মরছে জলের অভাবে।

প্রচুর আম্র, জামরুল, জাম আর বৈঁচি বস্ত্রখণ্ডে বেঁধে একটা বাঁশ কেটে এনে তার মাঝখানে বাঁধলো সুকেতু, শ্যাম দুটো পক্ক কাঁঠাল আর এক কাঁদি পক্ক কদলী সংগ্রহ করে আনলে সেগুলোও বাঁশের সঙ্গে বাঁধলো সে। তারপর বাঁশখানা দুজনে কাঁধে বয়ে ফেরার পথ ধরলো।
হঠাৎ-ই অন্ধকার নামতে শুরু করেছে অরণ্যে, ওরা দ্রুত পা চালালো, অরণ্য পেরিয়ে ওরা যখন তরণীর কাছে পৌঁছলো তখনও নদীবক্ষে অন্ধকার নামে নি, কিন্তু অরণ্যে বেশ অন্ধকার, আর সে-কারণেই ওদের দেরি দেখে রঘু একটু বকাবকি করলো। তবে ওদের আনা ফল দেখে খুশি হলেন গিরিকা আর তার কন্যারা। সন্ধ্যায় তরণীর ছাদে বসে ফলাহার করলো সকলে।

রাত্রে গিরিকা নিজের কক্ষে কন্যাদের নিয়ে বসলেন তাদেরকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ, আদেশ-উপদেশ দিতে। শবরী কিভাবে যাবে, শ্যাম ওকে কিভাবে সতর্ক করবে, ঝিরিপথ দিয়ে কিভাবে সাবধানে হাঁটতে হবে প্রভৃতি বুঝিয়ে বললেন। শ্যাম জানিয়েছে যে মহর্ষিকে দেখলে সে কোকিলের স্বরে ডেকে শবরীকে সতর্ক করবে, আর ঝিরি এবং কৌশিকীর মিলনস্থলে সে শবরীর জন্য অপেক্ষা করবে। তিনকন্যাই আগ্রহভরে শুনছে গিরিকার কথা, কেননা শবরী ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রলোভিত করতে ব্যর্থ হলে তখন আসবে তাদের পালা। মাতার আদেশ-উপদেশ শুনতে শুনতে এই মুহূর্তে শবরীর মনের অবস্থা কী তা তার মুখ দেখে ঠিক বোঝা গেল না।

সুলোচনা হঠাৎ বলে উঠলো, ‘মাসি, আমরা তিনজনই যদি মুনিকুমারকে প্রলোভিত করতে ব্যর্থ হই, যদি মুনিকুমারকে ছাড়াই রাজধানীতে ফিরে যাই, তাহলে মহারাজ আমাদেরকে শাস্তি দেবেন না তো?’

‘শাস্তি দেবে কেন, আমরা তো সাধ্যমতো চেষ্টা করবোই! আর পারবি নে অমন অলুক্ষণে কথা বলছিস কেন লো! তোদের বয়সে আমি তাবড় তাবড় বণিক, ব্রা‏হ্মণ, রাজার অমাত্যদের এই শরীর আর মুখের কথা দিয়ে বশ করে রিপুর দাস বানিয়ে রাখতাম, তবু তো তাদের ঘরে গণ্ডায় গণ্ডায় পত্নী ছিল, অন্য গণিকালয়েও যাতায়াত ছিল। আর জীবনে কখনো নারীরূপ দর্শন করেন নি, গন্ধ-স্পর্শ পান নি, এমন আনাড়ি একজন মুনিকুমারকে যদি বশ করে আনতে না পারিস তো ধিক তোদের রূপ-যৌবনকে! ধিক তোদের যোনি আর কুচভারকে!’
তিনকন্যাই নীরবে মাথা নিচু করে রইলো।


(চলবে.......)




সহায়ক গ্রন্থ

১. বেদ -অনুবাদ: রমেশ চন্দ্র দত্ত
২. মনুসংহিতা -অনুবাদ: সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. রামায়ণ -মূল: বাল্মীকি; অনুবাদ: রাজশেখর বসু
৪. মহাভারত -মূল: কৃষ্ণদৈপায়ন ব্যাস; অনুবাদ: রাজশেখর বসু
৫. কামসূত্র -বাৎসায়ন
৬. কথা অমৃতসমান (দ্বিতীয় খণ্ড) -নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুরী
৭. দণ্ডনীতি -নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুরী
৮. জীবনীকোষ ভারতীয়-পৌরাণিক -শ্রীশশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার
৯. দেবলোকের যৌনজীবন -ডঃ অতুল সুর
১০. ভারতে বিবাহের ইতিহাস -ড: অতুল সুর
১১. প্রাচীন ভারতে শূদ্র -রামশরণ শর্মা
১২. প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস -ডাঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ
১৩. ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য -সুকুমারী ভট্টাচার্য



মন্তব্য ৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১২:০০

রাজীব নুর বলেছেন: পড়লাম। ভালো লাগলো।

আপনি বোধ হয় অন্য কারো পোষ্ট পড়েন না, মন্তব্যও করেন না। তাই হয়তো আপনার পোষ্টে কেউ আসে না।

০৬ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ২:৫৬

মিশু মিলন বলেছেন: একেবারে যে পড়ি না তা নয়। তবে আপনার কথাটাও মিথ্যে নয়। আসলে ইতিহাস বা পুরাণ বিষয়ক উপন্যাস লেখার কারণে আমাকে অনেক পড়তে হয়, তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে হয়, লিখতেও অনেক সময় ব্যয় হয়। আবার পেটের জন্য চাকরিও করতে হয়। এজন্য ব্লগে খুব বেশি পোস্ট পড়া হয় না। ধন্যবাদ।

২| ০৬ ই অক্টোবর, ২০২০ ভোর ৬:২৪

আনমোনা বলেছেন: খুব ভালো লাগছে। যেমন ভাষার গাথুনী, তেমনই সুন্দর ভাবে গল্পকে এগিয়ে নিয়েছেন। আসলেই এধরনের উপন্যাস লিখতে অনেক পড়াশুনা করতে হয়।
আমিও একটু অবাক হচ্ছি, এ ধারাবাহিকে তেমন কেউ আসছেনা কেন?

০৬ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১১:১৯

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ সঙ্গে থাকার জন্য।

৩| ১৯ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ২:০৭

ডঃ এম এ আলী বলেছেন:



এ পর্বে এসে মহর্ষি ভিবাগুক এর
আশ্রমের মন্ধান মিলল।
পরের পর্ব পাঠে চললাম ।

শুভেচ্ছা রইল

২০ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:৩৪

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.