নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
চৌদ্দ
এখন দিবসের প্রথম প্রহর। ঋষ্যশৃঙ্গ তুলসীতলা থেকে অনেকটা দূরত্বে নিমীলিত চোখে ধ্যান করছে, সম্মুখে প্রজ্বলিত অগ্নি। ঘৃতস্নাত চন্দন কাষ্ঠ জ্বলছে বাতাসে সুবাস ছড়িয়ে। মহর্ষি বিভাণ্ডক আশ্রমে নেই, তিনি ফল এবং কাষ্ঠ সংগ্রহ করতে গেছেন অরণ্যে। সকাল থেকেই বানর শাবকটির দেখা নেই আজ, দক্ষিণ দিকের পথের পাশে একে অন্যের গা ঘেঁষে বসে আছে দুটি মৃগ। নিত্যদিনের মতোই পাখপাখালি কিচির-মিচির করছে আশ্রমলগ্ন বৃক্ষরাজির শাখায়। চিত্তের অস্থিরতা কাটানোর জন্য পিতার পরামর্শে ঋষ্যশৃঙ্গ পূর্বের চেয়ে অধিক সময়ব্যাপী ধ্যান করে এখন। তবু চিত্তের স্থিরতা পুরোপুরি আসে নি। ধ্যানের মাঝে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে ওঠে দেবপুত্রের ন্যায় সেই তাপসের মুখ, ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে অনুভব করে তার গাত্রের সুগন্ধ, তার সান্নিধ্য পাবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হয়ে ওঠে, তার সঙ্গে আলিঙ্গন এবং চুম্বনব্রত পালন করার জন্য গাত্রাভ্যন্তরে যেন তপ্ত স্রোত প্রবাহিত হয়! হৃদয়পটে সেই তাপসের মুখচ্ছবি ভেসে উঠলেই মুহূর্তের জন্য সে হাত অগ্নিতে প্রবেশ করায়, শরীরিক কষ্ট অনুভব করে তাপসকে ভুলে চিত্ত শান্ত রাখার চেষ্টা করে।
ঋষ্যশৃঙ্গ গভীর ধ্যানে হারিয়ে গেছে এখন, অনেক চেষ্টায় একটি বিন্দুতে স্থির করতে পেরেছে তার চিত্ত। বিন্দুটি ঐ দূর আকাশের অগণিত নক্ষত্রমণ্ডলীর মাঝে। বিন্দুটি ক্রমশ যেন আরো উজ্জ্বল আর নিকটবর্তী হয়ে তার কপালের দুই ভ্রু’র মধ্যবর্তী স্থানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে। তার শরীরও এখন শাল্মলী তুলার ন্যায় হালকা লাগছে, যেনবা বাতাসে ভাসছে! এখন যেন সে এই আশ্রমে নেই; পাখপাখালির কলকাকলি, বাতাসের শব্দ, ঘৃতমিশ্রিত চন্দন কাষ্ঠ পোড়ার শব্দ ইত্যাদি কোনো কিছুর সঙ্গেই তার সম্পর্ক কিংবা সংযোগ নেই; যেনবা ছিল না কোনো কালে! তার সকল সম্পর্ক এখন ঐ উজ্জ্বল বিন্দুটির সাথে, ক্রমশ দূরত্ব ঘুচিয়ে বিন্দুটি বড়ো হতে হতে প্রকাণ্ড নক্ষত্রে রূপান্তরিত হলো আর একাত্ম হয়ে সে মিশে গেল নক্ষত্রের সঙ্গে, এই পৃথিবীতে যেনবা তার আর কোনো দৃশ্যমান অস্তিত্ত্ব নেই! সে এবং নক্ষত্র মিলেমিশে একাকার।
হঠাৎ নূপুরের ঝমর ঝমর শব্দ! শব্দ ক্রমশ কাছে আসছে পূর্বদিকের পথ ধরে, সেই সঙ্গে সুমধুর কণ্ঠে গীতের সুর! শব্দ এবং গীতের সুর যতো কাছে আসছে ততো যেন তার নক্ষত্রঘোর কাটছে। নক্ষত্র তার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে আর উজ্জ্বলতা কমে গিয়ে নক্ষত্র পুনরায় রূপান্তরিত হচ্ছে অনুজ্জ্বল বিন্দুতে। নক্ষত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্রমান্বয়ে তার চিত্ত জাগতিক বিষয়ে সজাগ হয়ে উঠতেই চিত্ত শাসন করার চেষ্টা করলো সে। না, এ তাপস নয়; পূর্বের ন্যায় এও তার চিত্তের বিভ্রম, মায়া! বিচলিত চিত্তকে স্থির করতে সে শরীরকে কষ্ট দেবার জন্য নিমীলিত চোখেই অগ্নিতে হাত বাড়িয়ে দিলো। আর তখনই কেউ ছুটে এসে তার হাত ধরে অগ্নির বাইরে এনে বললো, ‘তপোধন, এ কী আপনি করছেন! নিজের হাত অগ্নিতে দগ্ধ করছেন!’
সেই চেনা স্বর, সেই চেনা গন্ধ, সেই চেনা স্পর্শ! চোখ খুললো ঋষ্যশৃঙ্গ, তার বাঁ কাঁধের কাছে শবরীর মনোহর মুখশ্রী। বিস্ময় ভরা কণ্ঠে ঋষ্যশৃঙ্গ বললো, ‘তাপস, আপনি! সত্যিই আপনি না কি মায়া?’
‘সত্যিই আমি!’
‘পিতাশ্রী বলেছেন যে আপনি রাক্ষস, মায়ারূপ ধারণ করে এসে আমার তপশ্চর্যা নষ্ট করাই আপনার উদ্দেশ্য।’
‘আমাকে না দেখে ভুল বলেছেন আপনার পিতাশ্রী। আমি রাক্ষস নই তপোধন, মায়ারূপ ধারণ করতেও জানি না। আমি আপনার মতোই একজন তপস্বী, শুধু আমার ব্রত আপনার ব্রত’র থেকে ভিন্ন।’
ঋষ্যশৃঙ্গ শবরীর হাত স্পর্শ করে বললো, ‘এখন আমি বিশ্বাস করছি আপনি মায়া নন, আপনিই তাপস। জানেন, আমি ধ্যানের মধ্যে বহুবার আপনাকে দেখেছি, ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে আপনাকে দেখেছি। কিন্তু তা ছিল আপনার মায়ারূপ। আমি হাত দিয়ে স্পর্শ করতে গেলেই অদৃশ্য হয়ে গেছে সেই মায়ারূপ!’
‘এইতো আমি আপনাকে স্পর্শ করে আছি। যা অলীক, যা মায়া, তা কী কখনো মানুষকে স্পর্শ করতে পারে!’
‘জানেন তাপস, যখন আপনার মায়ারূপ দেখি তখন আমার চিত্ত অস্থির হয়, গাত্রাভ্যন্তরে যেন ঝড় ওঠে আপনার সঙ্গে রতিব্রত পালনের জন্য। আমাদের ব্রত’র চেয়ে আপনার ব্রত’র শক্তি অনেক বেশি। আপনি আমার আহার কেড়েছেন, নিদ্রা কেড়েছেন, কোনো কার্যেই আমার মন বসে না, কেবল আপনার কথা মনে পড়ে। আমি আপনার বিরহে কাতর হয়ে আছি তাপস।’
‘আমিও আপনার বিরহে কাতর হয়ে আছি তপোধন। আপনাকে দেখার জন্য আমার চিত্ত চঞ্চল হয়েছে বলেই আমি ছুটে এসেছি। আপনি মঙ্গলময় আছেন তো?’
‘আপনার বিরহকাতরতা ব্যতিত আমি মঙ্গলময় আছি। তাপস, আপনার গাত্রে এক অদ্ভুত অলৌকিক শক্তি আছে, আপনাকে স্পর্শ করামাত্র যা আমার গাত্র দগ্ধ করে। এই দেখুন আমার গাত্রের রোম জেগে উঠেছে। দয়া করে সেদিনের ন্যায় আপনি আমার সাথে আলিঙ্গনব্রত এবং চুম্বনব্রত পালন করে আমাকে সুখী করুন।’
‘নিশ্চয় তপোধন, আপনাকে রতিব্রত শিক্ষা দেওয়া আমার পরম ধর্ম।’
শবরী ঋষ্যশৃঙ্গের হাত ধরে তাকে কুশাসন থেকে টেনে তুললো। ঋষ্যশৃঙ্গ শবরীর কেশ থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত অবলোকন করতে লাগলো। শবরী আজ পড়েছে কাঁচা-হলুদ রঙের অধিবাস ও বাস, একই রঙের উত্তরীয়। হলুদ পুষ্পালংকারে সজ্জিত দেহ। তবে আজ তার কেশ উন্মুক্ত নয়, সুদৃশ্য খোঁপা করে হলুদ পুষ্পমাল্যে শোভিত। শবরী ঋষ্যশৃঙ্গের শরীর থেকে উত্তরীয় ভূমিতে ফেলে তার কণ্ঠ মণিবন্ধে আবদ্ধ করে বললো, ‘তপোধন, আজ আপনি প্রথম আমাকে আলিঙ্গন এবং চুম্বন করুন, দেখি কেমন আত্মস্থ করেছেন আমার শিক্ষা!’
বলে মৃদু হাসলো শবরী, আর গতদিন সে যেভাবে ঋষ্যশৃঙ্গকে আলিঙ্গন এবং চুম্বন করেছিল তার অনুকরণে ঋষ্যশৃঙ্গও তাকে চুম্বন এবং আলিঙ্গন করলো। আলিঙ্গনে আবদ্ধ শবরী নিমীলিত চোখে ঋষ্যশৃঙ্গের আদর গ্রহণ করতে করতে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ‘আপনি ভীষণ মনোযোগী শিষ্য তপোধন, কিছুই ভোলেন দেখছি! আমি দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি, একদিন আপনি নিশ্চয় রতিব্রতে সিদ্ধিলাভ করতে পারবেন!’
ঋষ্যশৃঙ্গও একইভাবে বললো, ‘আমি সিদ্ধিলাভ করলে তার কৃতিত্ব আপনার। আপনার আশির্বাদ আমার ওপর বর্ষিত হোক।’
‘নিশ্চয় তপোধন, আমি আশির্বাদ করি, আপনি সিদ্ধিলাভ করুন।’
ঋষ্যশৃঙ্গ শবরীর গ্রীবায় চুম্বন করে বললো, ‘তাপস, আপনার বিরহ আমাকে ভীষণ পীড়া দেয়। আমি প্রত্যহ আপনার সঙ্গে রতিব্রত পালন করতে চাই। কিন্তু আমি আপনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করি পিতাশ্রী তা চান না। এমনিভাবে পিতাশ্রীর অগোচরে আপনি প্রত্যহ আসবেন তো তাপস?’
আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে শবরী ঋষ্যশৃঙ্গের দুই কাঁধে হাত আর চোখে চোখ রেখে বললো, ‘কিন্তু আমাকে যে আমার আশ্রমে ফিরে যেতে হবে। আপনিই আমার সঙ্গে চলুন তপোধন। নদীর পারে আমার মনোরম ভ্রাম্যমান আশ্রম আছে, আমরা তাতে আরোহণ করে ত্রিযোজনব্যাপী পর্বত ছাড়িয়ে আমাদের আশ্রমে যাব। সেখানে আপনার পিতার ভয় থাকবে না, আমরা নির্বিঘ্নে রতিব্রত পালন করতে পারবো। সেখানে আমার চেয়েও মহৎ তপস্বী আছেন, আপনি তার সঙ্গেও রতিব্রত পালন করতে পারবেন। তিনি রতিব্রত’র আরো গূঢ় কৌশল আপনাকে শেখাবেন। যাবেন আপনি?’
‘কিন্তু পিতাশ্রী?’
‘আপনার পিতাশ্রী এখানে থাকবেন। কিছুদিন তপশ্চর্যার পর আপনি আবার এখানে ফিরে আসবেন। যাবেন?’
‘যাব। পিতার শেখানো তপশ্চর্যার চেয়ে, আপনার তপশ্চর্যা আমাকে অধিক সুখী করেছে। আমি আপনার সঙ্গেই যাব তাপস, আপনার সঙ্গেই তপশ্চর্যা পালন করবো।’
‘তাহলে চলুন, আজই।’
‘আজই!’
‘হ্যাঁ আজই, তপশ্চর্যায় কার্যে বিলম্ব করতে নেই।’
‘বেশ, তবে চলুন, পিতাশ্রী আসার পূর্বেই আমরা আশ্রম ত্যাগ করি। পিতাশ্রী আমাকে আপনার সঙ্গে যেতে দেবেন না।’
শবরী অতুল আনন্দে ঋষ্যশৃঙ্গের ওষ্ঠে চুম্বন করে বললো, ‘চলুন, তবে আর দেরি নয় তপোধন।’
দুজন হাতে হাত রেখে পা বাড়ালো পথের দিকে, পিছনে রইলো পড়ে প্রজ্বলিত অগ্নিযজ্ঞ, ঘৃতস্নাত চন্দন কাষ্ঠ একইভাবে সুগন্ধি আর ধোঁয়া ছড়াতে লাগলো বাতাসে।
শবরী ঋষ্যশৃঙ্গ’র হাত ধরে আশ্রমের পথ ধরে দৌড়তে লাগলো। কোকিলের অনুকরণে ডেকে শবরীকে সতর্ক করার জন্য অরণ্যের বৃক্ষ-লতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা শ্যাম দুজনকে আসতে দেখে বুঝতে পারলো যে কার্যসিদ্ধি হয়েছে, সে তরণীতে ফেরার উদ্দেশ্যে দক্ষিণদিকে দৌড়তে লাগলো যাতে মুনিকুমার এখনই তাকে দেখতে না পায়।
শবরী ঋষ্যশঙ্গকে নিয়ে আশ্রমের পথ পেরিয়ে, ঝিরি অতিক্রম করে অরণ্যের ঘাস-লতা-পাতার ভেতর দিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলো। অপথ হলেও শবরীর চেনা, আগের বার এপথেই তরণীতে ফিরেছিল সে আর শ্যাম। দৌড়ে এবং দ্রুত হেঁটে হাঁপিয়ে উঠেছে দুজনই। একটু জিড়োনোর জন্য একটা আমলক বৃক্ষের নিচে দাঁড়ালো তারা, শবরী দাঁড়ালো আমলক বৃক্ষে পিঠ ঠেকিয়ে। চতুর্দিকে গা ছমছমে ছায়াচ্ছন্ন পরিবেশ; রৌদ্রের প্রবেশপথ রুদ্ধ রেখেছে নিবিড় বৃক্ষরাজির ঘন পল্লব। শবরীর স্পন্দিত স্তন যুগলে দৃষ্টি রেখে ঋষ্যশৃঙ্গ বললো, ‘আপনার কষ্ট হচ্ছে তাপস?’
শবরী সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঋষ্যশৃঙ্গের ডান হাত নিয়ে নিজের স্পন্দিত স্তনযুগলের ওপর রেখে মৃদু হেসে বললো, ‘আপনি এখানে হাত রাখুন তাপস, আমার সকল কষ্ট দূর হয়ে যাবে!’
ঋষ্যশৃঙ্গ সত্যি সত্যিই শবরীর স্তনযুগলে হাতের আলতো পরশ বুলাতে লাগলো তার কষ্ট লাঘব হবে ভেবে! শবরী অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো ঋষ্যশৃঙ্গের মুখশ্রীর দিকে, ঋষ্যশৃঙ্গের মুখশ্রী আর দৃষ্টিতে অকপট সরলতার আদিম বসতি। শবরীর অন্তরাত্মা যেন বলে উঠলো, নির্বোধের মতো তুমি কেন এই তপোধনকে রাজকুমারীর হাতে তুলে দিতে চাইছো, এই অমূল্য ধনের মূল্য কী সে বুঝবে! তার চেয়ে এই অরণ্যেই কোথাও কুটীর বেঁধে দুজনে অতিবাহিত করো সারাটি জীবন। এমন নিষ্কলুষ পুরুষের সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করার চেয়ে সুখের আর কী হতে পারে!
শবরীর অন্তস্তলে এখন চলছে অন্তর্কলহ। সে কি নিজের অন্তরাত্মার আহ্বানে সাড়া দেবে নাকি পালন করবে তার দায়িত্ব? কিছুতেই তার মন চাইছে না ঋষ্যশৃঙ্গকে রাজকুমারীর হাতে তুলে দিতে। রাজকুমারী নিশ্চয় এই দুর্লভ একতাল কাদামাটির মূল্য বুঝবে না অথবা রাজকুমারীর হাতে পড়ে এই কাদামাটি বিনষ্ট হবে। ঋষ্যশৃঙ্গ পুরুষ, কিন্তু পুরুষের জীবনাচার সম্পর্কে সে অজ্ঞাত। মদ্যপান, বহুগামিতা, বালাৎকার, প্রতারণা, নারী ও সম্পদ লুণ্ঠন, স্ত্রী প্রহার, যুদ্ধ, হত্যা, বহুবিধ শোষণ এবং নির্যাতন, চৌর্যবৃত্তি প্রভৃতি সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। তাই এই দুর্গম অরণ্যে পুরুষের মন্দ স্বভাবের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে সে এই কাদামাটির তাল দিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো গড়ে নিতে পারবে এক মানবিক মানুষ, যাকে সে কেবল শিক্ষা দেবে প্রেম আর ভালবাসার পাঠ! দেখাবে সাম্য ও সুন্দরের পথ। তারপর ঋষ্যশৃঙ্গের ঔরস গর্ভে ধারণ করে একদিন সে সন্তানের জন্ম দেবে, সেই সন্তানও হবে তার পিতার ন্যায় মানবিক।
কিন্তু সে যদি ঋষ্যশৃঙ্গকে রাজকুমারীর হাতে তুলে দেয়, তবে রাজচরিত্র ক্রমশ গ্রাস করবে আজকের এই কাদামাটির তুল্য ঋষ্যশৃঙ্গকে, সে নিশ্চয় আয়ত্ত করবে পুরুষের মন্দ স্বভাব। তাই ঋষ্যশৃঙ্গ’র বিরহ তাকে যতো পীড়া দেবে, ঠিক ততোটাই পীড়া দেবে যদি কখনো ঋষ্যশৃঙ্গ’র মানবিক স্খলনের কথা তার কানে আসে। ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণ করার অপরাধ তাকে কুরে কুরে খাবে, কখনোই সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। কিন্তু বৃষ্টি, প্রজাবৃন্দ, রাজ্য! বৃষ্টি না হলে প্রজাবৃন্দের কষ্ট দীর্ঘস্থায়ী হবে, মানুষের জীবন আরো বিপন্ন হবে আর মানুষ না থাকলে একদিন ধ্বংস হবে অঙ্গরাজ্য। দ্বিধা, দ্ধিধার বাণে জর্জরিত শবরীর চিত্ত! তবু তাকে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। হয় ঋষ্যশৃঙ্গ তার হবে, নয়তো রাজকুমারীর। হয় জীবনভর বিপুল সুখ, মানসিক প্রশান্তি, অতল প্রেম, ভালবাসাপূর্ণ পরিমিত কাম; নয়তো সারাজীবনের জন্য অসুখী চিত্ত, দুঃসহ বিরহ, ভালবাসাহীন অপরিমিত কাম। যে কোনো একটি পথ বেছে নিতে হবে তাকে। শবরী দু-হাতে ঋষ্যশৃঙ্গ’র মুখমণ্ডল স্পর্শ করলো, তার মনে হলো- আহা, এমন মায়ায় ভরা মুখখানা, এই মুখের দিকে চেয়ে থেকেই সে কাটিয়ে দিতে পারে সহস্র বৎসর! সে ঋষ্যশৃঙ্গ’র কপালে চুম্বন করলো, তারপর আলিঙ্গন করে ওর গ্রীবায় নাক গুঁজে শরীরের ঘ্রাণ শুকতে লাগলো।
আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করার পর অবশেষে প্রজাবৃন্দের মঙ্গলের কথা ভেবে নিজের চিত্ত শাসন করে ঋষ্যশৃঙ্গকে রাজকুমারীর হাতে তুলে দেবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্থির করতেই শবরীর অন্তরাত্মা যেন কেঁদে উঠলো! অন্তরের গোপন কান্না নিবারণের চেষ্টা করলো না সে। কাঁদুক অন্তরাত্মা, তবু ঋষ্যশৃঙ্গকে চম্পানগরীতে নিতেই হবে। রাজ্যের বৃহত্তর স্বার্থে ত্যাগ করতে হবে তার ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থ। যদিও তার নিজের স্বার্থ তার কাছে কোনোভাবে ক্ষুদ্র নয়, বৃহৎ; কিন্তু রাজ্যের কাছে তা ক্ষুদ্র। তাই রাজ্যের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে তাকে এই ত্যাগ করতেই হবে। রাজকুমারীর হাতে তুলে দিতে হবে তার প্রিয় এই তপোধনকে।
সে ঋষ্যশৃঙ্গ’র হাত ধরে চেয়ে রইলো চোখের দিকে, তার অন্তরের হাহাকার অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়লো অধর বেয়ে, একফোঁটা পতিত হলো ঋষ্যশৃঙ্গের হাতে। ঋষ্যশৃঙ্গ ব্যথিত হয়ে তাকালো শবরীর অশ্রুসিক্ত আঁখির দিকে, বললো, ‘তাপস, নিজের অজ্ঞাতে আমি কি আপনাকে কোনো কষ্ট দিয়েছি?’
শবরী মৃদু মাথা নেড়ে বললো, ‘না, তপোধন, আপনি আমাকে কোনো কষ্ট দেন নি। কষ্ট কী করে দিতে হয় সে তো আপনি জানেনই না।’
‘তবে আপনি কাঁদছেন কেন?’
‘আমি সুখে কাঁদছি তপোধন, জীবনে আপনাকে দেখতে পাবার সুখে, আপনার নিবিড় সান্নিধ্য পাবার সুখে।’
ঋষ্যশৃঙ্গ শবরীর অধরের অশ্রু মুছে দিয়ে বললো, ‘আপনার সান্নিধ্য পেয়েও আমি সুখী হয়েছি। আমি চিরকাল আপনার সঙ্গে রতিব্রত পালন করতে করো।’
শবরীর কান্না যেন এবার জলোচ্ছ্বাসের মতো আছড়ে পড়তে চাইছে! জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ দিতেই সে ঋষ্যশৃঙ্গ’র মাথাটা কাছে টেনে তার ওষ্ঠে গভীর চুম্বন করলো, বক্ষে জড়িয়ে ধরলো ঋষ্যশৃঙ্গের মাথা। দীর্ঘস্থায়ী আলিঙ্গনের পর আবার যাত্রা শুরু করলো তারা। তাদের এই ভালবাসার সাক্ষী হয়ে রইলো আমলক বৃক্ষের শাখায় আরোহণ করা এক বানর দম্পত্তি আর কিছু পাখি।
শবরী ঋষ্যশৃঙ্গ’র কোমর জড়িয়ে ধরে হাঁটতে লাগলো। যতোই তারা তরণীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে, ততোই যেন শবরীর ভেতরটা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। একবার তরণীতে আরোহণ করলেই সে আর নিবিড়ভাবে ঋষ্যশৃঙ্গকে কাছে পাবে না। আর চম্পানগরীতে পৌঁছনোর পর ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে তার এই সম্পর্ক চিরদিনের মতো ছিন্ন হবে। তাই তরণীতে পৌঁছবার আগে যতোটুকু সময় ঋষ্যশৃঙ্গকে একান্তে পাওয়া যায়, যতোটুকু সময় সে ওর গভীর স্পর্শ-চুম্বন আর আলিঙ্গন পেতে চায়, এই সময়টুকুই হয়ে থাকবে তার জীবনের মধুময় স্মৃতির সঞ্চয়। এই সঞ্চয় হয়তো তাকে বিরহকাতর করবে, অশ্রু ঝরাবে তার দু-চোখ থেকে; তবু সেই বিরহ আর অশ্রু বিসর্জনে থাকবে এক ব্যাখ্যাতীত আনন্দ।
ঝোপ-ঝাড় মাড়িয়ে দুজনে কিছুদূর এগোচ্ছে আবার থমকে দাঁড়াচ্ছে, শবরী যোগিনীর মতো অপলক চোখে তাকিয়ে থাকছে ঋষ্যশৃঙ্গের দিকে, উন্মাদিনীর মতো চুম্বন করছে ওর সারা মুখশ্রীতে, বক্ষে চেপে ধরছে মাথা; বনের পশুপাখি তাকিয়ে দেখছে এই যুগল নর-নারীর প্রেম।
হাঁটতে হাঁটতে একসময় দুজনে গিয়ে দাঁড়ালো তরণী কাছে। তরণীর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই উৎফুল্ল চিত্তে ছুটে এসে শবরীকে জড়িয়ে ধরলো উমা আর সুলোচনা। যুবতীর উচ্ছ্বাসে গিরিকা বরণডালা নিয়ে এসে বরণ করলেন দুজনকে, তারপর স্নেহ চুম্বনে সিক্ত করলেন কন্যার কপাল। ঋষ্যশৃঙ্গ অসীম বিস্ময়ে নিরবে অবলোকন করলো সকল আনুষ্ঠানিকতা।
দাঁড়িরাও ভীষণ খুশি। তাদের খুশির রেশেই তরণী দারুণ গতিতে এগিয়ে চললো কৌশিকী নদীর ভাটির দিকে।
কৌশিকী নদীর পশ্চিম তীর ঘেঁষে চলছে তরণী। শয্যায় বসে বাতায়ন দিয়ে নদীর পারের দিকে তাকিয়ে আছে ঋষ্যশৃঙ্গ, ঘন অরণ্য পিছনে ফেলে তরণী জনপদের মুখে প্রবেশ করতেই নদীপারের শ্মশানে পনের-কুড়িজন মানুষ এবং জলন্ত চিতা দেখে বিস্ময়ে সে-দিকে তাকিয়ে রইলো সে, আর তার পাশে বসে নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে শবরীও। দাউ দাউ করে জ্বলছে চিতার অগ্নি, মৃতদেহ তরণী থেকে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। দুজন মানুষ বাঁশ দিয়ে মাঝে মাঝে খোঁচানোয় জলন্ত চিতা থেকে অগ্নির ঊর্ধ্বমুখী সোনালি ফুলকি কিছুদূর উঠে মিলিয়ে গেলেও কুণ্ডলী পাকানো কালো ধোঁয়ার যাত্রা আকাশমুখী; বাতাসে আশপাশেও ছড়াচ্ছে ধোঁয়া আর মৃতদেহ পোড়া কটু গন্ধ। অন্যান্য শ্মশানবন্ধুরা অদূরে বৃক্ষতলায় কেউ দাঁড়িয়ে, কেউবা বসে আছে; হয়তো তারা কেউ অধিক শোকে নীবর, কেউ-বা মৃতের অতীতের স্মৃতিচারণায় মুখর। তাদের সবার পরনে শুভ্র বাস, কারো ঊর্ধ্বাঙ্গে অধিবাস, কারো-বা উদোম শরীর। কারো কারো মাথায় গোল করে বাঁধা একখণ্ড বস্ত্র, তাও শুভ্র। ঋষ্যশৃঙ্গ এতো মানুষ যেমনি কোনোদিন দেখে নি, তেমনি দেখে নি মৃতদেহ দাহ করা। বিস্ময় আর কৌতুহলে সে শবরীকে প্রশ্ন করলো, ‘তাপস, ওই ঋষিগণ এতো বৃহৎ অগ্নি প্রজ্বলন করে কী যজ্ঞ করছেন? উনারা কি অগ্নিদেবের অর্চনা করছেন?’
প্রশ্ন শুনে শবরী দৃষ্টি সংকুচিত করে আনলো ঋষ্যশৃঙ্গের মুখে, ‘উনারা ঋষি নন তপোধন, সাধারণ মানুষ। মৃতদেহ দাহ করছেন।’
‘মৃতদেহ দাহ করছেন! একেই বুঝি চিতা বলে? আমি পিতার মুখে চিতায় মৃতদেহ দাহ করার কথা শুনেছি বটে।’
‘হ্যাঁ, এটাই চিতা।’
ঋষ্যশৃঙ্গ অগ্নিতে দৃষ্টি রেখে হাত জোড় করে প্রণাম জানিয়ে বললো, ‘মৃতের আত্মার শান্তি হোক।’
ক্রমশ চিতার সঙ্গে তরণীর দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একেবারে চোখের আড়ালে চলে না যাওয়া পর্যন্ত বিস্ময়ভরা চোখে সে-দিকে তাকিয়ে রইলো ঋষ্যশৃঙ্গ।
একজন কৃষ্ণবর্ণ তরুণ বৈঠা বেয়ে ছোট্ট তরণী নিয়ে যাচ্ছে উজানের দিকে, পাটাতনে উপবিষ্ট এক তরুণী মাতা তার বাম স্তন উন্মোচন করে কোলের ছোট্ট শিশুকে দুগ্ধ পান করাচ্ছে। বাঁ-হাত দিয়ে স্তন ধরে স্তনবৃন্ত চুষছে শিশুটি। ঋষ্যশৃঙ্গ কয়েক মুহূর্ত মাতা এবং সন্তানের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘তাপস দেখুন, আপনার ন্যায় বক্ষ আর জটাধারী একজন তাপসের সঙ্গে মানবশাবক চুম্বনব্রত পালন করছে।’
শবরী তরণীর মাতা ও শিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘উনি কোনো তাপস নন তপোধন, উনি ওই মানবশিশুর মাতা। আর মানবশিশু চুম্বনব্রত পালন করছে না, মাতৃদুগ্ধ পান করছে।’
‘মৃগ আর বানরশাবকের ন্যায় মানবশাবক দুগ্ধ পান করছে?’
‘হ্যাঁ। উনি একজন মাতা এবং নারী।’
‘নারী?’
‘হুম, উনি নারী, আমিও নারী; আমি পুরুষ নই।’
‘আপনি পুরুষ নন!’
‘না, আমি পুরুষ নই, আমি নারী। নারী এবং পুরুষ একত্রে রতিব্রত পালন করলে পুরুষের ঔরস ধারণ করে নারী গর্ভবতী হয়, তারপর সন্তান জন্ম দেয়। নারী-ই সকল পুরুষের জন্মদাত্রী।’
‘কিন্তু পিতাশ্রী আমাকে বলেছেন যে, আমার মাতা ছিলেন এক মায়ামৃগ।’
‘অসত্য বলেছেন আপনার পিতাশ্রী।’
‘আমার পিতাশ্রী কখনো অসত্য বলেন না।’
‘মৃগ’র গর্ভে কখনো মানবশিশুর জন্ম হয় না তপোধন। আপনার জন্ম সম্পর্কে আমি যখন শুনেছিলাম, কিছুটা সন্দেহ থাকলেও তখন তা বিশ্বাস করেছিলাম। একথাও বিশ্বাস করেছিলাম আপনি মৃগযোনিজ বলে আপনার মাথায় একটি শৃঙ্গ বিদ্যমান। কিন্তু আপনাকে দেখার পর আমার সমস্ত ভ্রান্তি দূর হয়েছে। নিশ্চয় আপনি কোনো নারীর গর্ভজাত। আপনার পিতা কোনো কারণে আপনার কাছে সত্য লুকিয়েছেন।’
‘আপনি সত্যবচন বলছেন?’
‘নিশ্চয়, এই সত্যবচন আমার নয়, জগতের চিরায়ত সত্যবচন।’
‘তাপস…’
ঋষ্যশৃঙ্গের শব্দের মুখে বাঁধ দিলো শবরী, সৃষ্টি হলো না নতুন বাক্যের স্রোতধারা, ‘উঁহু, আর তাপস নয় তপোধন, আপনি আমায় প্রেয়সী বলে সম্বোধন করবেন।’
‘প্রেয়সী?’
‘হুম, পুরুষ তার প্রিয় নারীকে প্রেয়সী বলে সম্বোধন করে থাকে, আর প্রেয়সীকে কেউ আপনি বলে না, তুমি বলে। আমিও আপনাকে তুমি বলবো।’
‘বেশ তাই বলবো; প্রেয়সী, আমি যদি নারীর গর্ভজাত হই, তবে আমার মাতাশ্রী কোথায়?’
‘হয়তোবা তোমার মাতাশ্রী পরলোক গমন করেছেন অথবা তিনি এখনো ধরাধামের কোখাও না কোথাও বিচরণ করছেন, তোমার পিতা নিশ্চয় জানেন।’
ঋষ্যশৃঙ্গ মৌন হয়ে তাকিয়ে রইলো জনপদের দিকে, হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়লো দুজন ডুলিবাহকের ওপর, তাদের কাঁধের ডুলির মধ্যে রয়েছে একজন মানুষ। সে কৌতুহলী বালকের মতো প্রশ্ন করলো শবরীকে, ‘প্রেয়সী উনারা কী বহন করছেন?’
‘ওটাকে ডুলি বলে। বৃদ্ধ কিংবা অসুস্থ মানুষকে ডুলিতে বহন করা হয়।’
আরোহীকে নিয়ে ডুলিবাহক দুজন চোখের আড়ালে চলে গেলেও ঋষ্যশৃঙ্গ তাকিয়ে রইলো নদীপারের দিকে। আলাপনা আঁকা সুন্দর সুন্দর মাটির ঘর, মাটির উনুনে নারীদের রুটি সেঁকা কিংবা অন্য ব্যঞ্জন রন্ধন করা, নদীতে স্নানরত নারী-পুরুষ এবং শিশুদের হুটোপুটি, নদী থেকে জল সংগ্রহ করে কাঁখে কলসি কিংবা মাথায় ঘড়া বয়ে নিয়ে নারী-পুরুষের গৃহে ফেরা, নদীর জলে ভাসতে থাকা মৃত গবাদীপশুর পাঁজরের ওপর বসে খুবলে খুবলে মাংসাহার রত শকুন প্রভৃতি দেখে ঋষ্যশৃঙ্গ একের পর এক বালকের ন্যায় প্রশ্ন করলো আর শবরীও যত্নের সঙ্গে স্নেহবাক্যে তার সকল প্রশ্নের উত্তর দিলো। শবরী প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ভাবলো, ঋষ্যশৃঙ্গের শাস্ত্রজ্ঞান হয়তো অগাধ, কিন্তু তার বাস্তবজ্ঞান বড়ই কম। তার অগাধ শাস্ত্রজ্ঞানের সঙ্গে যখন বাস্তবজ্ঞানের সমন্বয় ঘটবে তখনই হয়তো সে হয়ে উঠবে দারুণ এক পুরুষ, যদি না পুরুষের প্রচলিত দোষগুলো তাকে স্পর্শ করে।
তরণীতে নিয়ে আসার পর নিজহাতে সাজিমাটি দিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গ’র শরীর মার্জন করে তাকে স্নান করিয়েছে শবরী; রাজআজ্ঞা অমান্য করে পরিয়েছে ঘৃতবর্ণের নতুন হালকা পরিচ্ছদ, যা তাকে রাতে শয়নের সময় পরানোর কথা। রাজআজ্ঞা অনুযায়ী ঋষ্যশৃঙ্গকে তরণীতে তুলেই স্নান করিয়ে বহুমূল্য ভারী রাজপরিচ্ছদ, রত্নখচিত সুবর্ণমাল্য এবং অঙ্গুরীয় পরিয়ে তার সঙ্গে রাজপুত্রের ন্যায় সম্ভ্রমপূর্ণ আচরণ করার কথা। শবরী সে-সব অমান্য করেছে, প্রত্যাখান করেছে গিরিকার অনুরোধও। কেননা ঐ গুরুগম্ভীর রাজপরিচ্ছদে ঋষ্যশৃঙ্গকে তার কাছে মনে হবে দূরের মানুষ; তাই আগামীকাল চম্পানগরীর ঘাটে তরণী নোঙর করার আগ মুহূর্তে তাকে রাজপরিচ্ছদ পরাতে চায় সে, আর এই সময়টুকু নিজের মতো করে সাজিয়ে নিজের করে রাখতে চায় ঋষ্যশৃঙ্গকে।
এখনো শবরীর চিত্তের এক অংশ বলছে, এই তপোধনকে নিয়ে পালিয়ে যাও অরণ্যে অথবা দুজনে একসঙ্গে জলে ডুবে মরো; আরেক অংশ বলছে, রাজ্যের মানুষের কথা ভেবে তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করো!
ঋষ্যশৃঙ্গ আবার প্রশ্ন করলো, ‘প্রেয়সী, তোমাদের আশ্রমের দাঁড়িদের গাত্র কৃষ্ণবর্ণ, আবার দেখ নদীপারের ওই মানুষদের গাত্রও কৃষ্ণবর্ণ। আমাদের গাত্র গৌরবর্ণ আর ওদের গাত্র কৃষ্ণবর্ণ কেন?’
‘ঈশ্বর মানুষকে এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। কারো গাত্র গৌরবর্ণ আবার কারো গাত্র কৃষ্ণবর্ণ।’
‘আমার বোধগোম্য হচ্ছে না ঈশ্বর মানুষকে কেন এভাবে ভিন্ন বর্ণে সৃষ্টি করলেন। এ সম্বন্ধে শাস্ত্রেও আমি কখনো পড়ি নি। প্রেয়সী, দেখ দেখ নদীতে স্নানরত ওই নারীর গাত্রও ঘন কৃষ্ণবর্ণ!’
শবরী নদীর ঘাটে স্নানরত একজন মানুষের দিকে তাকালো, তারপর মৃদু হেসে বললো, ‘উনি নারী নন তপোধন, হাতে এবং গলায় অলংকার পরিধান করলেও উনি একজন পুরুষ।’
নদীর বুক থেকে দৃষ্টি গুটিয়ে শবরীর মুখে রেখে প্রশ্ন ছুড়লো ঋষ্যশৃঙ্গ, ‘প্রেয়সী, আমি নারী-পুরুষের প্রভেদ বুঝতে পারছি না। নারী এবং পুরুষে প্রভেদ কী? নারী নিকটে থাকলে কি পুরুষকে তীব্র আকর্ষণ আর দূরে থাকলে তীব্র বিরহকাতর করে?’
শবরী ঋষ্যশৃঙ্গ’র ডানহাতটি তুলে নিজের মুখশ্রীতে ঘষতে ঘষতে মৃদু হাসলো। ঋষ্যশৃঙ্গ শবরীর চোখে চোখ রেখে বালকের ন্যায় পুনরায় প্রশ্নটি করলে শবরী শয্যা থেকে নেমে কপাট বন্ধ করে ঋষ্যশৃঙ্গ’র কাছে এসে দাঁড়ালো। ঋষ্যশৃঙ্গ’র হাত ধরে তাকে শয্যা থেকে নামিয়ে নিজহাতে খুলে দিলো তার শরীরের সকল পরিচ্ছদ। ঋষ্যশৃঙ্গ বললো, ‘প্রেয়সী এ কী করছো?’
শবরী লাস্যময়ী হাসি হাসলো, ‘তোমাকে নারী পুরুষের প্রভেদ চেনাবো!’
কয়েক মুহূর্ত নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো একে অন্যের চোখের দিকে, শবরীর মনে হলো ঋষ্যশৃঙ্গ’র চোখ দুটি যেন মায়া সরোবর, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ওখানে হৃদয় হাবুডুবু খায়, ডুবে যায়! ঋষ্যশৃঙ্গ শবরীর কপালে চুম্বন করে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো। শবরী জীবনে অনেক উদোম শরীরের কামুক পুরুষের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু এই নির্জন কক্ষে প্রেমে-কামে অনভিজ্ঞ নগ্ন শরীরের ঋষ্যশৃঙ্গ’র আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে তার মনে হলো আলিঙ্গনের এমন সুখ সে কোনোদিন পায় নি, এই সুখ অন্যরকম, অনন্য! কিছুক্ষণ পর আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে পুনরায় একে অন্যের চোখে চোখ রাখলো, ঋষ্যশৃঙ্গ বললো, ‘প্রেয়সী, চৈত্র মাসের পাত্রস্থ ঘৃতের ন্যায় কোমল তোমার গাত্র!’
শবরী হেসে বললো, ‘নারী এবং পুরুষের প্রভেদ প্রথমত শরীরে।’
শবরী ঋষ্যশৃঙ্গ’র কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে এসে নিজের শরীরের সকল পরিচ্ছদ খুলে ফেলে নগ্ন দুই বাহু ঊর্ধ্বে তুলে নৃত্যের ভঙ্গিতে খুব ধীরে ঘুরতে লাগলো, বাতায়ন ভেদ করে আসা আলো লেহন করতে লাগলো তার শরীরের চতুর্পাশ্ব। ঋষ্যশৃঙ্গ বিস্ময়ে দৃষ্টি বুলাতে লাগলো ঘূর্ণায়মান শবরীর কেশকবরী থেকে পা পর্যন্ত, শবরী দু-হাত ঊর্ধ্বে রেখে স্থির হলে ঋষ্যশৃঙ্গ’র অনুসন্ধিৎসু-বিস্ময় দৃষ্টি নিবিষ্ট হলো তার যোনিতে!
শবরী দূরত্ব ঘুচিয়ে কাছে গিয়ে চোখে চোখ রেখে ঋষ্যশৃঙ্গ’র ডানহাতটি নিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরে বললো, ‘দ্বিতীয়ত চিত্তে। এই দুটো প্রভেদই নারী এবং পুরুষের অন্যসকল প্রভেদের সুতিকাগার। আর কেবল নারীই পুরুষকে আকর্ষণ করে না, পুরুষও নারীকে আকর্ষণ করে; নারীর শূন্যতায় পুরুষ যেমনি বিরহকাতর হয়, তেমনি পুরুষের শূন্যতাও নারীকে বিরহকাতর করে।’
বন্ধ কপাটে শব্দ হলো, শোনা গেল গিরিকার কণ্ঠস্বর।
(চলবে....)
১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১১:২৩
মিশু মিলন বলেছেন: আমি যখন বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখকদের বই পড়ি, তখন মনে হয় আমি কী ছাই-পাশ লিখছি! এগারো-বারো বছর বয়স থেকে লেখা শুরু, দুই যুগ ধরে আমি লিখছি, এখনো শিখছি, রপ্ত করছি। আরো অনেক পথ পেরোতে হবে। আপনাদের উৎসাহ সেই পথ পেরোতে নিশ্চিত সাহায্য করবে। ভাল থাকবেন।
২| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:৫০
আনমোনা বলেছেন: পর্ব বারোতে দেখলাম কন্যারা রাক্ষসদের হাতে বন্দী। তারপরে কিভাবে মুক্তি পেলো, সেটা বললেননা?
১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১১:২৪
মিশু মিলন বলেছেন: সামনে সেই রহস্য উন্মোচিত হবে। ধন্যবাদ।
৩| ১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১:০৭
রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর লেখা। মুগ্ধ হয়ে পড়ছি।
নূপুরের শব্দ আমার ভীষন প্রিয়। বেশিক্ষন শুনলে নেশা ধরে যায়।
১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১১:২৫
মিশু মিলন বলেছেন: নূপুরের শব্দ আমারও ভীষণ প্রিয়! ধন্যবাদ।
৪| ২০ শে অক্টোবর, ২০২০ ভোর ৬:২০
ডঃ এম এ আলী বলেছেন:
পাঠে ভাল লাগল ।
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম ।
শেষ পর্ব দেখার পরে নাগরী উপন্যাসটি
নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করব।
শুভেচ্ছা রইল
২০ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:০২
মিশু মিলন বলেছেন: অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম আপনার পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানার জন্য। ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ৮:৩৮
শুভ_ঢাকা বলেছেন: ব্রিলিয়েন্ট! কি করে এমন ভাষা রপ্ত করলেন। কত বৎসর অপস্যার পর তা অর্জন করেছেন। জানতে চায় মন। আখ্যানের শেষে যে কি চমক আছে তা এক ঈশ্বরই জানেন।