নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নাগরী (উপন্যাস: পর্ব- আঠারো )

২৪ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৩:০৫

আঠারো

বিবাহের পর মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গ এবং রাজকুমারী শান্তা তিনরাত্রি উপরতি বা পরিহার অনুষ্ঠান পালন করেছে। এই তিনরাত্রি তারা যৌন সংসর্গ পরিহার করে মেঝের ওপর শয়ন করেছে। আজ পুষ্পশয্যার রাত্রি, আজ তারা যৌনমিলনে লিপ্ত হবে। তাই আজ আবার সন্ধ্যার পর থেকেই উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে চম্পানগরী, আজ যে বৃষ্টি নামবে! আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নানা বয়সের মানুষ পথে নেমে এসেছে, অনেকে নানা প্রকার বাদ্য বাজিয়ে নৃত্য-গীত করছে, অনেকে দল বেঁধে এসেছে নৃত্যগীত উপভোগ করতে! অনেক গীতের ভাষায় কেবলই বৃষ্টি আর শবরীর বন্দনা করা হয়েছে! নগরীর পথ যেন আজ হয়ে উঠেছে সমন উৎসবের মাঠ! যেন সকলেই পণ করেছে বৃষ্টিতে না ভিজে আজ আর কেউ গৃহে ফিরবে না! বহুদিন তাদের শরীর বৃষ্টির স্পর্শবিহীন, বৃষ্টির শীতল জলধারায় ভূমির ন্যায় তারাও শীতল হতে চায়। শৌণ্ডিকালয়গুলোতেও আজ উপচে পড়া ভিড়!

একজন তরুণ গায়ক মৃদু লয়ে নৃত্য আর গীত শেষ করতেই করতালি আর প্রশংসা বাক্যে মুখর হয়ে উঠলো শৌণ্ডিকালয়, প্রদীপের লালচে আভায় তরুণের মুখের তৃপ্তিমাখা হাসি কারো দৃষ্টিগোচর হলো, কারো-বা হলো না। গায়ক মাথা নত করে সকলকে অভিবাদন জানিয়ে বললো, ‘বন্ধুগণ, সুললিত ভাষায় এই গীতখানা রচনা করেছেন আমার অগ্রজ বন্ধু এবং পথপ্রদর্শক, মহান কবি, তিনি এখন আপনাদের মধ্যেই আছেন।’

কয়েকজন জড়ানো কণ্ঠে উল্লাস করে উঠলো, ‘সত্যিই! কে, কে সেই মহামান্য? তাকে দর্শন করে ধন্য হতে চাই!’

ভূমিতে পাতা কুশের আসনে উপবিষ্ট মদ্যপানরত মধ্য চল্লিশের একজন লোকের হাত ধরে তাকে টেনে তুললো গায়ক। লোকটার গাত্রে সস্তা মলিন পরিচ্ছদ, মাথার পাগড়িও যথেচ্ছ মলিন, একই রকম মলিন উত্তরীয়। নেশার প্রভাবে ঠিকমতো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। ডানদিকে ধনুকের মতো বাঁকা শরীরটাকে নিজের চেষ্টা এবং বন্ধুর সাহায্যে কোনোমতে সোজা করে হাত তুলে এবং কিঞ্চিৎ মাথা নত করে সকলের অভিবাদন গ্রহণ করলেন।

একজন তরুণ পানশৌণ্ড বললো, ‘অতি উত্তম গীত রচনা করেছেন মহামান্য কবি।’
তারপর গায়কের উদ্দেশে বললো, ‘আর দরাজ গলায় আপনি গেয়েছেনও চমৎকার!’

মধ্যবয়সী এক পানশৌণ্ড রসিকতা করলো, ‘মশাই, এমন গীত কী করে রচনা করলেন, কখনো কি শবরীর কামসুধা পান করেছেন?’

বলেই কালো দাঁত বের করে হাসতে লাগলো মধ্যবয়সী, তার হাসিকে সঙ্গ দিলো আরো কয়েকজনের হাসি। তারপর মধ্যবয়সী পানশৌণ্ডের দিকে আঙুল তুলে তাকিয়ে সম্মিলিত হাসি ছাপিয়ে অট্টহাস্য করে উঠলেন কবি। তার হাসি যেন থামতেই চায় না!

কোনোক্রমে হাসির রাশ টেনে সকলের উদ্দেশে বক্তৃতার ঢঙে বললেন, ‘ভ্রাতাগণ, দু-বার….মাত্র দু-বার আমি শবরীর দেহঝর্ণায় কামস্নান করেছি! অবশ্য তখন আমার অবস্থা এখনকার মতো কপর্দকহীন নয়, বেশ সচ্ছল ছিল। আমি তখন অভিজাত শৌণ্ডিকালয়ে গিয়ে মদ্যপান করতাম, অভিজাত গণিকালয়ে যেতাম। তখন আমার তরণী ঝড়ের কবলে পড়ে গঙ্গায় ডুবে যায় নি। আমারই চোখের সামনে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা গঙ্গাগর্ভে বিলীন হয়ে গেল। আমি অন্ধকারে কিছু করা তো দূরের কথা, তাদের দেখতেও পেলাম না। আমি কোনোরকমে সাঁতরে বেঁচে কূলে ফিরলাম, কিন্তু তারপর থেকে আজ অব্দি বেঁচে মরে আছি আমি।’

বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন কবি। প্রদীপের মৃদু আলোয় তার অশ্রু দৃষ্টিগোচর না হলেও উত্তরীয় হাতে নিয়ে ঘন ঘন চোখ মুছলেন তিনি। মদ্যপানরত উপবিষ্ট পানশৌণ্ডরা কেউ মন খারাপ করে কবির দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো, কেউবা মুখে ‘আহা আহা’ করলো। কবি পুনরায় বলতে শুরু করলেন, ‘আমার বাণিজ্যতরণী…’

তাকে থামিয়ে দিয়ে একজন প্রৌঢ় পানশৌণ্ড বললো, ‘ভ্রাতা, এই নিয়ে অন্তত কুড়িবার আপনার তরণী নিমজ্জনের কাহিনী শুনেছি।’
‘শুনেছেন?’

‘হ্যাঁ, শুনেছি তো। এখানকার সবাই শুনেছে। আপনি বরং শবরীর কথা যা বলছিলেন, তাই বলুন।’

‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ, শবরী…আহা-হা! কী অপূর্ব তার সৌন্ধর্য! স্বয়ং বিশ্বকর্মা যেন নিজহাতে তাকে সৃষ্টি করেছেন! ভ্রাতাগণ, শবরীর সৌন্ধর্যের কাছে স্বর্গের উর্বশী-মেনকা-রম্ভার সৌন্ধর্য নিতান্তই তুচ্ছ! পারিজাত পুষ্পের পাপড়ির ন্যায় মসৃণ তার ত্বক, সদ্যতোলা মাখনের ন্যায় গাত্রবর্ণ! আর গ্রহণলাগা চন্দ্রের ন্যায় তার অধরে একটা আশ্চর্য সুন্দর তিল! আমার ঘোর লেগে যেতো মশাই, তার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকালেই ওই চন্দ্রগ্রহণ সম্পূর্ণ গ্রাস করতো আমাকে! তবে আমি পেরেছিলাম…’

তার দীর্ঘ বিরতি দেখে একজন বললো, ‘কী পেরেছিলেন?’
‘আমি পেরেছিলাম… তাকে তুষ্ট করতে।’ কবির মুখে গর্বিত হাসি ফুটে উঠলো।
অন্যরা বাহবা দিয়ে বললো, ‘বাহ্ বাহ্! এই না হলে পুরুষ!’
উজ্জ্বল হয়ে উঠলো কবির মুখ, বললেন, ‘ভ্রাতাগণ, সে বলেছিল, আমার পৌরুষ নাকি ইন্দ্রদেবকেও হার মানায়!’
‘বাহ্ বাহ্…!’ রব উঠলো।

‘আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, তার অধরের ওই গ্রহণলাগা তিলের কথা আমি আজও ভুলতে পারি না। আমাকে আজও যেন ইঙ্গিতে ডাকে। কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার দরুন আমি এখন সেই মোহনীয় ডাকে সাড়া দিতে পারি না, শুনেছি তার প্রতি মুহূর্তের মূল্য এখন অনেক। আহা, কী আশ্চর্য সুন্দর তিল!’

বলতে বলতে পুনরায় কেঁদে ফেললেন কবি। শ্যাম আর সুকেতু শৌণ্ডিকালয়ের এককোনার দিকে বসে এতোক্ষণ পান করছিল আর গায়কের কণ্ঠে গীত অতঃপর কবির কথা শুনছিল। হঠাৎ শ্যাম উঠে গিয়ে কবির মুখোমুখি দাঁড়ালো। তার চোখে চোখ রেখে বললো, ‘শবরীর অধরে আশ্চর্য সুন্দর তিল?’

সফলভাবে জাদু শেষ করার পর জাদুকরের মুখে যেমনি গর্বিত ভাব ফুটে ওঠে, মুখে তেমনি ভাব ফুটিয়ে কবি বললেন, ‘তবে আর বলছি কী ভ্রাতা! স্মরণ হলে আমার চিত্ত আজও চঞ্চল হয়ে ওঠে; আমাকে ইঙ্গিতে ডাকে! আহা, আর কী পাব সেই জ্যোৎস্নামাখা রূপ দেখতে!’
বলে গর্বিত ভঙ্গিতে হাসলো কবি।

শ্যাম আবার বললো, ‘গ্রহণলাগা চন্দ্রের ন্যায় আশ্চর্য সুন্দর তিল?’
কবি বললেন, ‘নিশ্চয়।’
‘সেই গ্রহণলাগা চন্দ্রের ন্যায় আশ্চর্য তিল শবরীর মুখশ্রীর ডানদিকে না বামদিকে?’

কবি এবার নটশিল্পীর ন্যায় উচ্চকণ্ঠে বিলম্বিত স্বরে বললো, ‘সেই আশ্চর্য সুন্দর তিন, সেই আশ্চর্য সুন্দর তিল, সেই আশ্চর্য সুন্দর তিল শবরীর মুখশ্রীর ডানদিকে।’

বাক্য শেষ হওয়ামাত্র শ্যাম সজোরে বাম হাতের এক চড় কষলো কবির ডান গালে আর চেঁচিয়ে বললো ‘মিথ্যেবাদী কোথাকার!’
সঙ্গে সঙ্গে ককিয়ে উঠে কবি প্রথমে উপবিষ্ট এক পানশৌণ্ডের শরীরের ওপর পড়লো, তারপর সেখান থেকে গড়িয়ে পড়লো ভূমিতে। গায়ক শ্যামের দিকে তেড়ে আসতেই পিছন থেকে সুকেতু এসে গায়ককে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো কবির শরীরের ওপর, আর ভূপাতিত কবি পুনর্বার ব্যথায় ককিয়ে উঠলো!

আকস্মিক এই ঘটনায় পানশৌণ্ড, শৌণ্ডিক এবং পরিচারক সকলেই হতভম্ব! কিন্তু শ্যাম আর সুকেতুর রক্তাভ চোখের দিকে তাকিয়ে কেউই সাহস করে এগিয়ে এলো না, সকলেই মৌন হয়ে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো। সুকেতু কোমরের খুঁট থেকে চারটে কড়ি বের করে শৌণ্ডিকের সামনে ফেলে দিয়ে শ্যামের হাত ধরে শৌণ্ডিকালয় ত্যাগ করলো।

বাইরে এখন ম্রিয়মাণ জ্যোৎস্না। নগরের পথ ধরে শ্যাম আর সুকেতু হাঁটছে শবরীদের গণিকালয়ের উদ্দেশ্যে। সুকেতু উমার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে তরণীতে ফিরতে চায় না, তার প্রেমিক হৃদয় আজ ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠেছে প্রেমিকাকে দেখার জন্য! কখন রাত নেমেছে দুজনের কারোরই তা স্মরণে নেই। অপরাহ্ণে রাজবাড়ীর বিবাহভোজে গিয়েছিল তারা, পেট পুরে রাজকীয় আহার সেরে ফেরার পথে উমার সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে গিয়েছিল গণিকালয়ে, কিন্তু দ্বার বন্ধ দেখে হাঁটতে হাঁটতে গণিকালয়ের কাছের এক সস্তা শৌণ্ডিকালয়ে ঢুকেছিল। মদ্যপান করতে করতে কখন রাত নেমেছে দুজনের কেউই তা খেয়াল করে নি। এখন রাতের কোন প্রহর তাও তারা ঠাহর করতে পারছে না, পথে মানুষ বাদ্য বাজিয়ে নৃত্য-গীত করছে দেখে শ্যাম ভাবলো হবে হয়তো প্রথম কি দ্বিতীয় প্রহর। তবে যে প্রহরই হোক না কেন মানুষ আজ ঘুমোতে যায় নি শয্যায়, মানুষ জেগে আছে বৃষ্টি অপেক্ষায়, বৃষ্টিতে ভেজার অপেক্ষায়। আজ বৃষ্টি যেন এক উৎসবের নাম! মৃদু টল-টলায়মান পায়ে গল্প করতে করতে হাঁটতে লাগলো শ্যাম আর সুকেতু।

‘তুমি হঠাৎ অমন ক্ষেপে উঠলে কেন শ্যামদা?’ জানতে চাইলো সুকেতু।
‘ক্ষেপবো না, শবরীর নামে মিথ্যে কথা বললো যে! শালা বলে কিনা গ্রহণলাগা চাঁদের ন্যায় তিল, অথচ শবরীর মুখে তিলের ছিটেফোঁটাও নেই।’
‘আগে হয়তো ছিল।’
‘ঘোড়ার ডিম ছিল! ডাহা মিথ্যে কথা বলছিল, তোর বিশ্বাস হয় ও শবরীর শয্যায় উঠেছে, ওর মতো একটা উল্লুককে শবরী শয্যায় তুলবে?’
‘তবে গীতখানা ভালই রচনা করেছে, কি বলো?’
‘ভাল না ছাই! গীত লিখেছে, কে ওকে শবরীকে নিয়ে গীত লিখতে বলেছে! শালা, শবরীকে দেখেই নি, আবার গীত লিখেছে।’
‘তুমি ওর ওপর এখনো চটে আছো দেখছি!’
‘চটবো না, শালা মিথ্যেবাদী কোথাকার!’
‘এই দাঁড়াও, দাঁড়াও…।’
‘কেন?’

সুকেতু শ্যামের হাত ধরে দাঁড় করালো। তারপর শ্যামের দুই কাঁধে দুই হাত রেখে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমার চোখের দিকে তাকাও শ্যামদা।’
‘এইতো তাকিয়েছি, বল।’
‘তুমি শবরীকে ভালবাস, না?’
শ্যাম নীরবে আকাশের দিকে মুখ তুলে বললো, ‘ধুর!’

কোলাহলের ভেতর দিয়ে শ্যাম আর সুকেতু শবরীদের গণিকালয়ের দ্বারের সম্মুখে এসে দেখলো বেতের মোড়ায় বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন বৃদ্ধ দ্বাররক্ষী। তাদের পায়ের শব্দেও দ্বাররক্ষীর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, তিনি একইভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওরা বুঝতে পারছে না দ্বাররক্ষী জেগে আছে নাকি তাকিয়ে ঘুমানোই তার স্বভাব! সুকেতু কাছে গিয়ে বললো, ‘দাদু, দাদু…আমরা একটু ভেতরে যেতে চাই।’

দ্বাররক্ষী একবার তাদের দুজনের দিকে দৃষ্টি মেলে পুনরায় আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোন চুলো থেকে এলে হে তোমরা! নগরীর সকল মানুষ আজ গৃহ ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে নেমে এসেছে বৃষ্টিতে স্নান করার জন্য, আর তোমরা গৃহে সিঁধোতে চাইছো কামবারিতে ভেজার জন্য! কোথাকার মদনদেব হে তোমরা?’

সুকেতু রসিকতা করে বললো, ‘আজ্ঞে, আমি স্বয়ং মদনদেব, আর উনি আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা!’

দ্বাররক্ষী আকাশের দিক থেকে দৃষ্টি ফেরালেন সুকেতুর মুখে, ‘সে তোমরা মদনদেব হও আর মহাদেব, তাতে কোনো লাভ হবে না! আজ ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। কাল এসো।’

শ্যাম বললো, ‘দাদু, এ আপনাদের উমার নাগর। ক’দিন পরই উমার সঙ্গে ওর বিয়ে হবে।’

‘দেখো বাছা, রোজই তোমাদের মতো কেউ না কেউ এসে বলে আমি শবরীর নাগর, আমি বিশাখার দেবর, আমি সুলোচনার স্বামী। সব তোমাদের মতো মাতালদের প্রলাপ বুঝলে। এখন যাও ঝামেলা কোরো না, আমাকে মেঘ আসা দেখতে দাও।’

সুকেতু বললো, ‘দাদু, সত্যি বলছি, আমি উমাকে খুব ভালবাসি, উমাও আমাকে ভীষণ ভালবাসে। আমরা রাজবাড়ির তরণী দাঁড়ি, আমরাই তো তরণী বেয়ে ওদেরকে মহর্ষি বিভাণ্ডকের আশ্রমে নিয়ে গিয়েছিলাম। মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গ আমাদের তরণীতেই চম্পানগরীতে এসেছেন।’

‘মদনদেব আর তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা থেকে এক ঠেলায় তরণীর দাঁড়ি, একটু পর নিশ্চয় বলবে যে আমি ঋষ্যশৃঙ্গ আর তার সখা! আর ঝামেলা কোরো না, এখন যাও।’

শ্যাম বললো, ‘আপনার বিশ্বাস না হয়, আপনি ভেতরে গিয়ে উমাকে আমাদের নাম বলুন। আমার নাম শ্যাম আর ও সুকেতু।’

‘ভালয় ভালয় বলছি হে ছোকরারা, চলে যাও, নইলে লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে মাথা গুড়িয়ে দেব। স্বয়ং মহারাজ লোমপাদ এলেও আজ ভেতরে প্রবেশ করতে দেব না। মাতার কড়া আদেশ, আজ যেন কাউকেই ঢুকতে না দিই।’

অনেক অনুনয়-বিনয় করেও তারা দ্বাররক্ষীকে টলাতে পারলো না। শেষে সুকেতু বললো, ‘এতো আচ্ছা ঘাড়তেড়া বুড়ো! কী করবো শ্যামদা?’

‘ঢুকতে না দিলে আর কী করবো। আজ আর তরণীতে ফিরতে ইচ্ছে করছে না, বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে। চল, ওদিকের পরিত্যক্ত পান্থশালার সামনের চাতালে গিয়ে বসি। বৃষ্টি নামলে ভিজে ভোরবেলায় তরণীতে ফিরবো।’
‘বেশ, তবে তাই চলো।’
দ্বাররক্ষী এরই মধ্যে আবার আকাশে দৃষ্টি ফিরিয়েছেন, দৃষ্টি না নামিয়েই তিনি বললেন, ‘তাই যাও, হতভাগার দল!’
সুকেতু মুখ ঝাঁমটা দিলো, ‘চোপ, শালা নচ্ছার বুড়ো!’

গালি খেয়ে বুড়ো তাদের উদ্দেশে বকবক করতে লাগলো। কিন্তু ওরা আর পিছন ফিরলো না। হাঁটতে লাগলো পরিত্যক্ত পান্থশালার চাতালের দিকে।

পান্থশালার চাতালের ঘাসের ওপর বসলো দুজন, মাথাটা ভার ভার বোধ হওয়ায় ক্ষণকাল পরই ঘাসের ওপর পাশাপাশি শুয়ে পড়লো চিৎ হয়ে। শুয়ে দেখার ফলে ওদের মনে হচ্ছে আকাশটা বেশি দূরে চলে গেছে। পরিষ্কার আকাশে জ্বলজ্বল করছে অসংখ্য নক্ষত্র, আর পূর্ণিমার পর চন্দ্রের ঔজ্জ্বল্য কিছুটা ম্রিয়মাণ হলেও এখনো আকাশে ফুটে আছে পুষ্পের ন্যায় চন্দ্র। আকাশে মেঘ খুব সামান্য এবং তা বহু ওপরে। সুকেতু বললো, ‘শ্যামদা…।’

শরীরটা ভূমিতে ছেড়ে দেওয়ায় বেশ আরাম অনুভব করছে শ্যাম। নেশার প্রভাবে-আরামে সে চক্ষু মুদে আছে। সুকেতুর ডাকে চোখ বুজেই সে সাড়া দিলো, ‘হুম!’

‘বৃষ্টি হবে তো? আকাশে তো বৃষ্টি নামার মতো মেঘ দেখছি নে!’

শ্যাম চোখ খুলে দূরে ভাসা মেঘে দৃষ্টি রেখে বললো, ‘অমন অলুক্ষণে কথা বলিস নে সুকেতু, সারা রাজ্যের মানুষ আকাশের দিকে চেয়ে আছে বৃষ্টির আশায়; নিশ্চয় বৃষ্টি হবে। দেখছিস নে বাতাসে জোর নেই, তাই বোধ হয় মেঘ ভেসে আসতে দেরি হচ্ছে।’

‘ইস, উমার সঙ্গে যদি বৃষ্টিতে ভিজতে পারতাম!’
কিছুক্ষণ দুজনেই মৌন হয়ে রইলো। মৌনতা ভেঙে সুকেতু বরলো, ‘জানো শ্যামদা, যখনই মনে হয়, উমা অন্য একজন পুরুষের সঙ্গে একই শয্যায় আছে, আর সেই পুরুষ উমার শরীরটা ভোগ করছে, তখন আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, ধুর, শালার এই জীবনের কোনো মূল্য নেই, গঙ্গায় ঝাপিয়ে মরি!’

অস্থিরভাবে উঠে বসলো সুকেতু। শ্যাম কোনো কথা বললো না, নীরবে তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে, ওর দু-চোখে আকাশটা হঠাৎ ঝাপসা হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর সুকেতু বললো, ‘ঘুমিয়ে পড়লে না কি?’

ঘাড় ঘুরিয়ে শ্যামের মুখের দিকে তাকালো সে, শ্যাম ঘুমোয় নি দেখে বললো, ‘তুমি একটা পাথরের মূর্তি। নিজেকে প্রকাশ করো না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে গুমরে মরো। তুমি মুখে না বললেও আমি জানি, শবরীকে তুমি ভালবাসো। তোমার চোখ দেখে আমি আগেই বুঝেছি, উমাও আমাকে বলেছে সে-কথা।’

শ্যামের বুকের ওপর রাখা একটা হাত ধরে সুকেতু পুনরায় বললো, ‘সত্যি করে বলো আমায়, বলো তুমি শবীরকে ভালবাসো না?’
‘আমার ভালবাসায় শবরীর কিছু আসে যায় না সুকেতু, শবরীর মতো সুশ্রী কন্যাকে অনেক মানুষ ভালবাসবে সেটাই স্বাভাবিক। তা বলে শবরী কি সকলকেই মন দেবে? তাছাড়া আমি একজন কুশ্রী সামান্য নিষাদপুত্র, রাজতরণীর দাঁড়ি। আমি মাটিতে শুয়ে কেন ওই আকাশের নক্ষত্র ছুঁতে চাইবো?’

‘কেন উমা আমাকে ভালবাসে নি?’
‘বেসেছে, হয়তো উমা তোর মধ্যে এমন কিছু দেখেছে যা ওকে আকৃষ্ট করেছে। তাছাড়া আমি দেখেছি, শবরী মুনিকুমারকে মন দিয়েছে।’
‘ধুর! তা হয় নাকি?’
‘হয়, তাই হয়েছে। মুনিকুমারকে নিয়ে ফেরার সময় আমার চিত্ত এবং চোখ কেবলই শবরীকে পর্যবেক্ষণ করেছে। আমি শবরীকে দেখেই বুঝেছি সে মুনিকুমারকে ভালবেসে ফেলেছে।’
‘তোমার কথা যদি সত্যিও হয়, তা ছিল ক্ষণিকের ভালবাসা। মুনিকুমার এখন রাজজামাতা, শবরীর কথা তার মনেই থাকবে না।’
‘শবরীরা আমাদের জন্য নয় সুকেতু, সমাজের উঁচুতলার কড়িওয়ালা মানুষের জন্য ওদের জন্ম। আমাকে অলীক স্বপ্ন দেখাসনে।’
‘তাহলে উমা?’

‘কে জানে, উমা সাময়িক মোহে পড়ে তোকে কাছে টেনেছিলো কি না, যদি সত্যি সত্যিই উমা তোকে ভালবাসে তবে তা অঘটন! এমন সৌভাগ্যের অঘটন সবার জীবনে ঘটে না।’

সুকেতু আবার ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লো। কখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার কখনো নিমীলিত চোখে বৃষ্টির অপেক্ষায় আর বিরহপীড়িত গল্প-কথায় দুজনের সময় অতিবাহিত হতে লাগলো, তারপর একসময় অন্ধকার নেমে এলো চোখে, আর ঠোঁটে নৈঃশব্দ।


(চলবে.......)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:২১

রাজীব নুর বলেছেন: দেখতে দেখতে আঠারো পর্ব হয়ে গেল!


যাদু আমার খুব পছন্দ।

২৪ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:২৮

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ২৪ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:০৩

আনমোনা বলেছেন: হায়রে বৃষ্টি। সে কখন আসবে?

২৪ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:২৯

মিশু মিলন বলেছেন: অপেক্ষা করুন, আর দুই পর্ব আছে।

৩| ২৮ শে অক্টোবর, ২০২০ ভোর ৬:২১

ডঃ এম এ আলী বলেছেন:
ভাল লাগল । পরের পর্ব দেখতে গেলাম ।
শুভেচ্ছা রইল

২৮ শে অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ১:২৯

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.