নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমি, মা আর আমার শিউলি ফুল

২৫ শে এপ্রিল, ২০২২ রাত ১২:২৬

বর্ষাকালের শেষ বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে কামাল আতাতুর্ক সরণী ধরে হেঁটে কাকলীর দিকে আসছি, গুলশান লেকের ব্রিজের ওপর আসতেই আচমকা শুরু হয় বৃষ্টি, বড়ো বড়ো ফোঁটা, আমার আশপাশের পথচারীদের অনেকেই কাকভেজা হওয়া থেকে শরীরটাকে রক্ষা করতে দৌড়তে শুরু করে আশ্রয়ের খোঁজে, আমার সঙ্গে ছাতা থাকায় ফুটিয়ে মাথার ওপরে তুলে ধরতেই লক্ষ্য করি একটি মেয়ে ভিজতে ভিজতে জোরে হাঁটার চেষ্টা করছে, ব্রিজ পার হতে হতে তার সম্পূর্ণ শরীর ভিজে যাবে দেখে বলি, ‘আপনি ভিজে যাচ্ছেন, আমার ছাতার নিচে আসতে পারেন।’

মেয়েটা আমার দিকে তাকায়, প্রথম দেখায় আমার চেহারা-শরীর আর পোশাক দেখে হয়ত অনেকের মতো সেও ভাবে যে আমি ছেলে না মেয়ে! তারপর আমাকে নিরাপদ মনে করে মেয়েটি ছাতার নিচে এসে বলে, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’

বৃষ্টি পেয়ে লেকের পচা জলের উৎকট দুর্গন্ধ উথলে উঠায় ঘ্রাণেন্দ্রিয় বিব্রত ছিল, তারই ভেতর মেয়েটার শরীর থেকে পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ স্বস্তি হয়ে ঢোকে আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে, আমরা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে হাঁটতে হাঁটতে একটা বিল্ডিংয়ের নিচে এসে দাঁড়াই। ওমা নিচে কোথায়! ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক পরোক্ষে দারুণ ধোঁকা দেন আমাদেরকে এবং আরো বেশ কয়েকজনকে! মূল ভবন থেকে দেউড়ি একদম আলাদা, আমরা দেউড়িটাকে মূল ভবনের অংশ মনে করে আশ্রয় নিয়ে দেখি মাথার উপরে ফাঁকা! নিচে এসে না দাঁড়ালে বাইরে থেকে তা একেবারেই বোঝা যায় না। লোকজন সব ভবনের দিকে ঘেঁষে দাঁড়াতে থাকে, কিন্তু বৃষ্টির কিছুটা ছাঁট গায়ে লাগেই। আমি এই ধোঁকা না বুঝে ছাতা বন্ধ করার পর আবার খুলে মাথার উপর তুলে ধরে মেয়েটার দিকে একটু সরে দাঁড়াই, মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে সরে আসে আমার দিকে। ভবনের নিচতলার দরজায় গ্লাস, আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি বিশাল নিচতলায় দুটো সোফা পাতা, চেয়ার-টেবিল পাতা, চেয়ারে ও সোফায় বসে ইউনিফর্ম পরিহিত দারোয়ান এবং আরো কয়েকজন মোবাইল টিপছে আর হেসে হেসে কথা বলছে। এতবড় নিচতলা ফাঁকা পড়ে আছে, অথচ আমরা দশ-বারোজন নারী-পুরুষ এদিকে-সেদিকে সরে চেষ্টা করছি বৃষ্টি থেকে গা বাঁচাবার! আমার মতো সবাই তাকায় ভেতরে, কিন্তু কারো কিছু বলার নেই। কারণ আমরা জানি, হাজার অনুরোধ করলেও দারোয়ান দরজা খুলে দেবে না আমাদের জন্য, আর মানবতা দেখিয়ে দরজা খুলে দিলে ওর চাকরি থাকবে না, সেটা ও জানে। ঢাকা শহরের মানুষের হদয়টা এখন এমনই। আমি মজা করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার প্যারোডি করে বলি, ‘ভেতরে অ্যান্ড্রয়েট ফোন হাতে নির্দয় পুরুষেরা কত রকম আমোদে হাসছে, আমাদের দিকে তারা ফিরেও চাইছে না!’

মেয়েটা হালকা শব্দ করে হেসে ওঠে, অন্য লোকজন ওর দিকে তাকায় আর আমিও, ওর হাসিটা ভীষণ মিষ্টি আর বৃষ্টির ছাঁটের অজস্র চূর্ণ ওর সারা মুখমণ্ডল আর চুলে লেগে ওকে আরো রোমাঞ্চকর দেখায়! ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার চোখে ভেসে ওঠে দাদুবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে দেখা শরৎকালের সকালে তলায় পড়ে থাকা শিশিরস্নাত অজস্র শিউলি ফুল, যেন ছুঁলেই স্নিগ্ধ-কোমল পাপড়ি থেকে জলের ফোঁটা ঝরে পড়বে আর একটু অসতর্কভাবে স্পর্শ করলে পাপড়ি ভেঙে পড়বে! মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয় ও তেমনই একটি বৃন্তচ্যূত শিউলি ফুল!

বৃষ্টি থামবার কোনো লক্ষণই নেই, গুঁড়ি গুঁড়ি ছাঁট আমাদের শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে। আমাদের চারপাশের অন্য লোকেরা নানা বিষয়ে কথা বলছে, মুখ বন্ধ করে আর কতক্ষণ থাকবো, মেয়েটির উদ্দেশে বলি, ‘আপনার অফিস গুলশানেই?’

ও বৃষ্টি দেখছিল, প্রশ্ন শুনে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি একটা অফিসে ইন্টার্নি করছি।’
‘আচ্ছা।’

মেয়েটি নিমেষের জন্য সামনে তাকিয়ে আবার আমার দিকে দৃষ্টি ফেরায়, ‘আপনি কোথায় আছেন?’
‘আমি একটা বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কপি রাইটারের কাজ করি।’
‘বাহ, খুবই ভালো।’

আমরা আরো একথা-সেকথা বলি, বৃষ্টি থেমে গেলে কাকলী পর্যন্ত একসাথে হেঁটে ফুট ওভারব্রিজের কাছে এসে একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিই। ও ফার্মগেটের বাসে উঠার জন্য স্টপেজের দিকে এগিয়ে যায় আর আমি ফুট ওভারব্রিজে উঠি। ফুটওভারব্রিজে উঠে আমি বাস স্টপেজের দিকে তাকিয়ে দেখি ও দাঁড়িয়ে আছে বাসের অপেক্ষায়। আমিও দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। শিউলি ফুল যেমনি কিছুক্ষণ হাতে রাখার পর ফেলে দিলেও হাতে কিছুটা সৌরভ লেগে থাকে, তেমনি এই স্বল্প আলাপেই মেয়েটা যেন আমার হৃদয়ে মায়ার সৌরভ রেখে যায়। কিছুক্ষণ পর ও বাসে উঠে পড়ে, আমি দাঁড়িয়েই থাকি শিউলি ফুলের মায়ার সৌরভে!

দুই

‘আপু, বিজ্ঞাপনী সংস্থা সম্পর্কে অনেক খারাপ খারাপ কথা শুনি, ওখানে কাজ করতে তুমি কোনো প্রবলেম ফিল করো না?’

বনানীর একটি কফিশপে বসে আমার শিউলি ফুল কানিজ ফাতিমা এই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকায়। ও হ্যাঁ, সেই বৃষ্টিভেজা বিকেলের পর আমাদের আবারো রাস্তায় দেখা হয়, আমরা কাকলী পর্যন্ত গল্প করতে করতে আসি, একে অন্যের নাম জানা হয়, ফোন নম্বর আদান-প্রদান হয়। একদিন অফিসে কাজে ফাঁকে ফোন করে আমি ওকে কফি অফার করি, ও সানন্দে রাজি হয়ে যায়।
কফিতে চুমুক দিয়ে আমি ওর প্রশ্নের উত্তরে বলি, ‘শোনো, আমাদের দেশে সব সেক্টরেই মেয়েদের কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। নিজে ভালো থেকে লড়াই করতে হয়। কেউ হয়ত লড়াই করে টিকে থাকতে পারে, কেউ হয়ত পারে না, আবার কেউ আছে যে এই প্রতিবন্ধকতাকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে উপরে উঠার সিঁড়ি হিসেবে। আমি প্রথম যে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় জয়েন করেছিলাম, ছয় মাস পর সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে বেশ কিছুদিন বেকার ছিলাম। এক নারী সহকর্মী কাজে আমার সঙ্গে না পেরে আমাকে ঈর্ষা করত, প্রৌঢ় বসের সঙ্গে সে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছিল, সে বসের কাছে আমার নামে কান ভাঙানি দিত, অকারণে বস আমাকে বকাঝকা করত। ভালো স্ক্রিপ্ট করলেও বস খুঁত ধরত মেয়েটাকে খুশি করার জন্য! অপমান আর কত সহ্য হয়, একদিন বসের সামনে অফিসের আইডি কার্ড ছুড়ে দিয়ে চাকরি করব না জানিয়ে চলে এলাম। কয়েকদিন পর বস আমাকে ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করে রিকোয়েস্ট করেছিল চাকরিতে ফিরে যাবার জন্য, আমি যাইনি। সব সেক্টরেই ভালো-মন্দ আছে।’

‘তোমার পরিবার তোমাকে অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে, তাই না?’

‘আমার মা আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন, আর কেউ নয়। বাকিদের কাছ থেকে আমাকে স্বাধীনতা অর্জন করে নিতে হয়েছে।’

‘জানো আপু, আমাদের পরিবার খুব কনজারভেটিভ, বাপ-চাচারা মিলে অনেক বড়ো যৌথ পরিবার। আমাদের পরিবারের কোনো মেয়ে কখনো বোরকা ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হয় না, এই যে ঢাকা শহরে আমি বোরকা ছাড়া বাইরে চলাফেরা করি এটা তারা জানে না। আমি এখনো পাস করে বেরই হলাম না, অথচ এখনই আমাকে আমার চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু আমি আমার চাচাতো ভাইকে ঘৃণা করি।’

‘চাচাতো ভাইকে পছন্দ না হলে অন্য কাউকে করবে।’

‘না।’
আমি কিছু না বলে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। ও কয়েক নিমেষ নীরব থেকে বলে, ‘তোমায় বলব সব কথা, অন্য কোনোদিন, অন্য কোথাও বসে।’

দিনে দিনে আমাদের দুজনের সখ্যতা বাড়ে, প্রায়শই সন্ধে কাটে আলো-আঁধারি কফিশপে, আমি প্রায়ই আমার মায়ের কাছে ওর গল্প বলায় একদিন মা বলেন, ‘মেয়েটা হোস্টেলে থাকে, নিশ্চয় খাবার-দাবারের কষ্ট হয়, ওকে একদিন বাসায় নিয়ে আসিস।’

একদিন বাসায় নিয়ে এলে মা অনেক পদের রান্না করে নিজে কাছে বসে থেকে ওকে যত্ন করে খাওয়ান। এরপর থেকে প্রায়ই ওকে বাসায় নিয়ে আসি আর মা ওকে যত্ন করে খাওয়ান। আমরা সারারাত শুয়ে শুয়ে গল্প করে কাটাই। একরাতে কানিজ আমাকে জানায়- যে চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে ওকে বিয়ে দিতে চায়, সেই চাচাতো ভাই ওকে দু-বার ধর্ষণ করেছে, একবার ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়, আরেকবার নাইনে। সেই থেকেই চাচাতো ভাইকে সে ঘৃণা করে, ওকে বিয়ে করার কথা কল্পনাও করতে পারে না। এমনকি কোনো পুরুষকেই ও বিয়ে করতে চায় না। বিয়ের কথা উঠলেই ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে কামুক চাচাতো ভাইয়ের মুখ আর নিজের ধর্ষণ হবার বীভৎস দৃশ্য। ওর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে, ওর মনে হয় যে-ই ওর বর হবে –সেই ওর সঙ্গে অমন আচরণ করবে!

মা আর আমি, আমাদের দুজনের সংসার, বাবা চার বছর আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। আমার একমাত্র ভাই বিয়ে করে বউকে নিয়ে এই শহরেই থাকে। আমার বড়ো বোন এবং ছোট বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে, আমি মেজো। ভাই-বোনদের কারো সঙ্গেই আমার সম্পর্ক ভালো নয়, আর আমার কারণে মায়ের সঙ্গেও নয়। আমার বয়স ত্রিশ হলেও আমি এখনো বিয়ে করিনি, আর এটাই নাকি আমার ভাই-বোন এবং আত্মীয়-স্বজনের কাছে বেশ সম্মান হানিকর বিষয়! আত্মীয়-স্বজন এবং গ্রামের প্রতিবেশীরা অবশ্য বলে বেড়ায় আমার নাকি বিয়ে হয় না আমি দেখতে সুন্দরী নই বলে! আমি যে দেখতে সুন্দরী তা কেউ বলে না দিলেও আমি জানি, আমার গায়ের রঙ প্রায় কালো, হ্যাংলা গড়ন, স্তন যথেষ্ট স্ফীত নয়, বয়কাট চুল, জিন্স-জুতো-শার্ট পরি। এই ধরনের গড়ন এবং বেশভূষার মেয়েদের বয়স বেড়ে গেলেই আমাদের সমাজ ধরে নেয় যে মেয়েটার বিয়ে হয় না, অথচ মেয়েটা তো বিয়ে করতে অনিচ্ছুকও হতে পারে সেই ব্যাপারটি কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই নেয় না! সমাজ জানে যে আমার বিয়ে হয় না, আর আমার ভাইবোনেরা জানে যে আমি বিয়ে করি না। এই নিয়েই ভাইবোনদের সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব। আমি বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় এবং ঝগড়া হওয়ায় এক পর্যায়ে আমার বোন-ভগ্নীপতিরা আমাদের বাসায় আসা কমিয়ে দেয়, বড়োভাই মাকে জানিয়ে দেয় যে আমার সঙ্গে এক বাসায় তাদের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। আমি মাকে জানাই যে, ‘ঠিক আছে তোমরা থাকো, আমি আলাদা বাসা নিয়ে থাকবো, আমার অসুবিধা হবে না।’

মা আমার ভাইকে জানায়, ‘ও আলাদা বাসা নিয়া একা একা থাকবো, অফিস কইরা কহন রাধবো আর কহন খাইবো তার ঠিক নাই, আমি ওর লগেই যাই।’

বড়োভাই ভারী বোঝা নামানোর স্বস্তি নিয়ে জানায়, ‘তোমার যা ভালো মনে হয় তাই করো।’

সেই থেকেই আমার আর মায়ের আলাদা সংসার হয়। আমার মা, আশ্চর্য মা, একটিবারের জন্যও আমাকে বিয়ের জন্য জোর করেননি, কখনো জিজ্ঞেস করেননি তুই বিয়ে করবি না কেন? বরং লোকে আমার বিয়ের প্রসঙ্গ তুললে মা বলেন, ‘আমার দায়িত্ব আছিল ওরে বড়ো করার, করছি। অয় অহন বড়ো অইচে, অর জীবন, অয় ঠিক করব কহন বিয়া করব, নাকি করবই না। আমি জোর করুম ক্যান!’
আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই ক্লাস সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করা আমার মায়ের জীবনবোধ দেখে! আমার মা খুব সাদাসিধা, ঢাকা শহরে বাস করেও জীবনের জটিলতা-কুটিলতা বোঝেন না, ফেইসবুক-টুইটারের ব্যবহার জানেন না, বাইরের জগত সম্পর্কে খুব কমই জানেন। তবু আমার মা সমাজের ভিড়ের আর পাঁচজন নারীর মতো নন, এমনকি তাঁর নিজের গর্ভজাত বড়ো এবং ছোট কন্যার চেয়েও চিন্তার দিক থেকে তিনি অনেক এগিয়ে।

তিন

একদিন সকালে শোয়া থেকে বিছানায় উঠে বসেছি, সারারাত একটুও ঘুম হয়নি, অবুঝের মতো কেঁদেছি। অন্যদিন এতোক্ষণে আমার গোসল হয়ে যায়, অফিসে যাবার জন্য তৈরি হই, আর আজ আমার কোনো সারাশব্দ না পেয়ে দরজার পর্দা ঠেলে মা ঘরে আসেন। আমি চোখের জল মুছে ফেলি, আমার চেহারা দেখেই মা কিছু একটা আঁচ করেন। বলেন, ‘চোখ ফুইলা লাল অইয়া আছে, কানছস ক্যান, সারারাত তো মনে অয় ঘুমাস নাই!’

আমি নীরবে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি, মা কাছে এসে আমার পাশে বসে হাত ধরে বলেন, ‘কানিজের লগে ঝগড়া করছস?’
আমি দু-দিকে মাথা নাড়ি আর ভাবি যে মা অন্যকিছু না বলে কানিজের কথা বলল কেন!
‘তাইলে কানতাছস ক্যান, অর বিয়া ঠিক অইচে?’

প্রচণ্ড আমি কষ্টের মাঝেও বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি মায়ের দিকে, কানিজ একটা মেয়ে, ওর বিয়ে ঠিক হলে আমি কাঁদবো না মায়ের পক্ষে এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক। আমি মাকে বলেছি কানিজ আমার বন্ধু, ছোট বোনের মতো। মায়ের খারাপ লাগতে পারে কিংবা মা কষ্ট পেতে পারেন ভেবে আমি তাকে কখনোই বলিনি যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছাপিয়ে আমরা দুজন-দুজনকে ভালবাসি, আমাদের দুজনেরই কোনো পুরুষের প্রতি আকর্ষণ নেই, আমরা দুজন সারাজীবন একসঙ্গে থাকতে চাই। একদিন কানিজের সঙ্গে কথা না বললে আমার ভেতরটা শুকিয়ে যায়, তিনদিন কানিজকে না দেখলে উদাসীনতায় আমার দৃষ্টি ধূসর হয়ে যায়, কিন্তু মাকে তো আমি এসব কিছুই বুঝতে দিইনি। আমার ধারণা সমপ্রেম বিষয়ে মায়ের কোনো ধারণাই নেই, অথচ আমার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে মা আমাকে দুটো প্রশ্নই করেছে কানিজের বিষয়ে!

আমি নীরবে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে মা আবার বলেন, ‘অর বিয়া কবে?’

‘শুক্রবারে।’

আমার বিস্ময় আরো বহুগুণে বাড়িয়ে মা বলেন, ‘অরে আজই বাড়ি ছাইড়া চইলা ক, তর একলার রোজগারে আমাগো দুইজনের যহন চলে, তিনজনেও চলবো। অয় আইলে অয়ও ভালো থাকবো, আমরাও ভালো থাকবো।’

আমি মায়ের চোখে দেখতে পাই- আমি, মা আর আমার শিউলি ফুলের সুন্দর সুখের সংসার!


ঢাকা
মার্চ, ২০২২।


মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে এপ্রিল, ২০২২ রাত ১২:৫০

মোহাম্মদ গোফরান বলেছেন: ১ নং পড়ে ২ নং এবং ৩ নং পড়ার ইন্টারেস্ট জন্মেছে। পড়তে ভালো লেগেছে। ভালো লাগলো।

২৫ শে এপ্রিল, ২০২২ রাত ১২:৫৯

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

২| ২৫ শে এপ্রিল, ২০২২ সকাল ৯:১৩

প্রতিদিন বাংলা বলেছেন: লেখা ভালো ,বিষয় ভালো।
.....................
সংযত ও স্বাধীনতা
বাবা চাচা ভাই .... মা চাচী বোন
একপক্ষ অপরপক্ষের অমঙ্গল চায় না।

২৫ শে এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৪:১৬

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

৩| ২৫ শে এপ্রিল, ২০২২ সকাল ১০:১৯

কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন , কিন্তু সম প্রেম থেকে ওদের সরে আসতে হবে।

২৫ শে এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৪:১৭

মিশু মিলন বলেছেন: কেন?

৪| ২৫ শে এপ্রিল, ২০২২ রাত ১১:৩২

অধীতি বলেছেন: সমকালীন বিষয়। গল্পের বিষয় বস্তু চমৎকার। যার রুচিবোধ তার কাছে সুন্দর তবে সম প্রেমটা অস্বস্তিকর যদি যৌনতার দিক থেকে দেখি।

২৫ শে এপ্রিল, ২০২২ রাত ১১:৫৫

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ পড়ার জন্য।

একজন বিষমকামীর পক্ষে সমকামে লিপ্ত হওয়া অস্বস্তিকর, আবার একজন সমকামীর পক্ষেও বিষমকামে লিপ্ত হওয়া অস্বস্তিকর হবে সেটাই স্বাভাবিক।
তবে উভয় কামই যৌক্তিক, বিজ্ঞান তাই বলে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.