নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
নৃপতি বেণ, পুরাণের একজন প্রতিনায়ক এবং সনাতন ধর্মবিশ্বাসী যেসব মানুষ তাঁর সম্পর্কে জানেন, তাদের কাছে তিনি ঘৃণিত এক চরিত্র। কিন্তু কেন তিনি ঘৃণিত? কী তাঁর অপরাধ? তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে ঈশ্বরের আরাধনা কিংবা দেবতাদেরকে উৎসর্গ করে যজ্ঞ করলে কোনো ফল লাভ হয় না, প্রকৃতি ঈশ্বর কিংবা দেবপতি ইন্দ্র বা অন্য কোনো দেবতার নিয়ন্ত্রণে নয়; ঝড়, অতিবৃষ্টি কিংবা অনাবৃষ্টি, ভূমিকম্প, দাবানল ইত্যাদি দূর্যোগ প্রকৃতির আপন খেয়ালেই হয়; এসবের ওপরে কারো হাত নেই। একারণে দেবতা এবং ব্রাহ্মণদের অনুশাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে তিনি তাঁর ‘ব্রহ্মাবর্ত’ নামক সাম্রাজ্য শাসন করতে চেয়েছিলেন। আর এজন্য তিনি ব্রহ্মাবর্তের মানুষের জন্য ক্ষতিকর মনুর বিধানসমূহ, বেদ, যজ্ঞ ইত্যাদি নিষিদ্ধ করেছিলেন; যা ছিল দেবতা ও ব্রাহ্মণদের জীবিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত। দেবতাদের নির্দেশে এবং ব্রাহ্মণদের তত্ত্বাবধানে সারা বৎসর ব্রহ্মাবর্তে অশ্বমেধ, কারীরী ইষ্টি, পুণ্ডরীক, সর্প ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার যজ্ঞ করা হতো; এসব যজ্ঞের হব্যি পেতেন দেবতা এবং ব্রাহ্মণগণ। এছাড়াও দেবতা এবং ব্রাহ্মণদেরকে সাধারণ মানুষের নিকট থেকে প্রাপ্ত করের ভাগ দিতে হতো। ফলে বেণ বিদ্রোহ করে মানুষের স্বার্থবিরোধী মনুর বিধানসমূহ এবং সকল প্রকার যজ্ঞ নিষিদ্ধ করায় ক্ষতিগ্রস্ত হন দেবতা ও ব্রাহ্মণরা। তারা বেণকে বিদ্রোহের পথ থেকে সরে আসার নির্দেশ দিলেও বেণ তা মান্য করেননি। ফলে দেবতা এবং ব্রাহ্মণরা নৃপতির পদ থেকে বেণকে উৎখাত করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। সেই সমাজে দেবতা এবং ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নৃপতি হিসেবে দীর্ঘদিন টিকে থাকার মতো যথেষ্ট শক্তি হয়ত বেণের ছিল না; এছাড়া দেবতা এবং ব্রাহ্মণরা ঈশ্বর, পরকাল, শাস্ত্র ইত্যাদির ভয় দেখিয়ে কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করে বেণের বিরুদ্ধে খেপিয়েও তোলে। ফলে স্বাধীনভাবে সাম্রাজ্য শাসন করা বেণের জন্য ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে।
কালের আবর্তে নৃপতি বেণের শাসনকালের অনেক অনেক শতাব্দী পরে মানুষ যখন উপলব্ধি করে যে, এইসব বৃহৎ যজ্ঞ করে সত্যিই কোনো ফল লাভ হয় না, তখন ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে যজ্ঞ। মনুর বিধানেও আজকের সমাজ-দেশ পরিচালিত হয় না। যার অর্থ এই দাঁড়ায় যে- নৃপতি বেণ তাঁর সমকালের চেয়ে চিন্তায়, দর্শনে ও কর্মে অনেক এগিয়ে ছিলেন; তিনি কোনো ভুল কিংবা অপরাধ করেননি। তারপরও বেণ পুরাণে প্রতিনায়ক হয়েই আছেন এবং আজকের সমাজের মানুষ পুরাণ পড়ে তাঁকে ঘৃণা করে। সুদীর্ঘকাল যাবৎ বেণের নামটি ঘৃণিতভাবে বন্দী হয়ে আছে শাস্ত্রের কারাগারে, বন্দী করেছেন তৎকালীন শাস্ত্রকারগণ। বেণের সম্পর্কে জানার পর অনেক চিন্তা-ভাবনা করে আমার এই উপলব্ধি হয়েছে যে- বেণ নিরপরাধ, সাহসী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক চরিত্র। প্রতিনায়ক নয়, বেণ তাঁর সময়ের নায়ক। বর্তমান কালের একজন লেখক হিসেবে আমি দায়বোধ করেছি শাস্ত্রের কারাগার থেকে বেণকে মুক্তি দেবার জন্য; সেই দায়বোধ থেকেই লিখেছি উপন্যাস-‘দেবদ্রোহ।’
এই আখ্যান ইতিহাস নয়; পুরাণ থেকে কেবল বীজটি নিয়ে বেণকে কাণ্ডারী করে তৎকালীন সময়ের মানুষ, প্রকৃতি, ধর্ম ও সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, দণ্ডনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়সমূহ নিয়ে আমি ভাসিয়েছি আমার কল্পনার ভেলা।
এই ২০২২ সালে বসে আমি আর্য-অনার্য বিতর্ক উসকে দিতে চাইনি, জাতিগত বিভাজন করাটাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কেননা হাজার হাজার বছর ধরে আর্য-অনার্য রক্তের সংমিশ্রণ যেমনি হয়েছে, তেমনি হয়েছে ধর্ম ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বর্তমানে যে ধর্ম ও সংস্কৃতি পালন করে তা নিখাঁদ আর্য কিংবা নিখাঁদ অনার্য ধর্ম ও সংস্কৃতি নয়, অনেক জাতি-গোষ্ঠীর মিলিত ধর্ম ও সংস্কৃতি। আমি কেবল শাস্ত্রের কারাগার থেকে নৃপতি বেণকে মুক্তি দিতে চেয়েছি, এবার পাঠকের পালা।
মিশু মিলন
এক
বসন্ত-পূর্ণিমার রাত্রে মশাল আর পশুর চর্বি দিয়ে জ্বালানো মৃৎ-প্রদীপের উজ্জ্বল আলোয় চতুর্দিকের দর্শকের মাঝখানে পশমী চামড়ার গালিচা বিছানো মঞ্চে কাড়া-নাকাড়াসহ নানা প্রকার বাদ্যের তালে নৃত্য করতে থাকে চন্দ্র বংশের যুবক-যুবতী কবিশ আর ভুবনা। মৃদু বাতাসে মশাল আর প্রদীপের শিখা ঈষৎ কাপে আর আলোও যেন নৃত্য করে শ্মশ্রুমুণ্ডিত সুদর্শন কবিশ এবং সুন্দরী ভুবনার গৌরবর্ণ মুখমণ্ডল ও অঙ্গে। কবিশের প্রায় লোমহীন সুগঠিত উর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত আর পরনে বাঘের পশমী চামড়ার বাস, গলায় এবং বাহুতে পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষ ফলের মালা; ভুবনার উর্ধ্বাঙ্গে কৃষ্ণসার মৃগের পশমী চামড়ার নিবি আর পরনে বাস, গলায় শুভ্র পুষ্পমালা, দুই হাতে লালচে বাদামী রঙের এক ধরনের বন্য লতা দিয়ে তৈরি চুড়ি। দুজনেরই মেদহীন লম্বা সুঠাম শরীর; কবিশের লম্বা সোনালি কেশ একেবারে মাথার ওপরদিকে চূড়োখোঁপা বেঁধে রুদ্রাক্ষের মালা জড়ানো, আর ভুবনার কেশ মাথার পিছন দিকে বিশেষ ধরনের খোঁপা বেঁধে তাতে শুভ্র পুষ্পের মালা জড়িয়ে শোভাবর্ধন করা হয়েছে। দুজনের পায়ে বাঁধা ছোট জাতের এক প্রকার সামুদ্রিক শামুকের মালা, যা নৃত্য করার সময় শ্রুতিমধুর নিনাদ তোলে। দুজনই খুব পরিশ্রমী আর নৃত্যানুরাগী, ওদের নিপুণ নৃত্যের খ্যাতি ব্রহ্মাবর্ত ছাড়িয়ে স্বর্গেও পৌঁছে গেছে! স্বয়ং দেবী সরস্বতী ঋষিদের মুখে ওদের নৃত্যনৈপুণ্যের কথা শুনে প্রশংসা বার্তা আর উপহার পাঠিয়ে দিয়েছেন ঋষিদের হাতে। ওদের দুজনকে দেখে আর দেবী সরস্বতীর প্রশংসা বার্তা এবং উপহার পাঠানোর কথা শুনে ব্রহ্মাবর্তের অনেক বালক-বালিকা এবং কিশোর-কিশোরী নৃত্যের প্রতি দারুণ উৎসাহী হয়ে উঠেছে। এখন বিভিন্ন গোত্রের নানা উৎসবে নৃত্য করার জন্য ওদের দুজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ওরা দুজন যমজ ভ্রাতা-ভগিনী; দুজনে একই সঙ্গে বেড়ে উঠেছে- ছুটোছুটি, ক্রীড়া, হাস্য, মারামারি-কান্না, মান-অভিমান করে। এখন অবশ্য ওরা একে-অপরের জীবনের সঙ্গী, গত হেমন্তের আগের হেমন্তে ওরা বিবাহ করেছে।
কখনো মঞ্চে নৃত্যরত কবিশ-ভুবনা আবার কখনো সমবেত দর্শকের দিকে দৃষ্টি ঘুরতে থাকে সাতাশ বৎসর বয়সী মাখনের ন্যায় গৌরবর্ণ, দীর্ঘাঙ্গ ও সুঠাম গড়নের যুবক, স্বায়ম্ভূব মনুর বংশধর মানবদের প্রথম নৃপতি- বেণের। নৃপতি, নৃপতি; ব্রহ্মাবর্তের নৃপতি! ব্রহ্মাবর্তের এই পর্বতশ্রেণি, ভূমি, অরণ্য ও বৃক্ষরাজি, নদী, সরোবর, ঝরনা, পশু-পাখি এবং বিভিন্ন বংশের মানবরা এখন তাঁর অধীনে! তিনি নৃপতি আর সবাই এখন তাঁর প্রজা, আজ থেকে প্রজাদের মঙ্গল-অমঙ্গল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব তাঁর, প্রজাদের ন্যায়-অন্যায়ের বিচারের ভার এখন তাঁর ওপর, দুষ্টকে দমন আর শিষ্টকে পালন করা এখন তাঁর কর্তব্য! প্রজারা যাতে এখন থেকে নির্বিঘ্নে পশুচারণ, বন্য পশু শিকার এবং ফসলের চাষ করতে পারে সেই দিকে তাকে খেয়াল রাখতে হবে। দেবপতি ইন্দ্রের মনোস্কামনা পূর্ণ করতে পবিত্র সরস্বতী নদীর অন্তত পাহাড়ী অংশের তীর থেকে অনার্য কিরাত, পণি, নিষাদ, অজ, শিগ্রু, বানর, নাগ, যক্ষ, রাক্ষস, পিশাচ প্রভৃতি গোষ্ঠীকে উৎখাত করে তাদের ভূমি ও বসতি দখল এবং তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে এখন থেকে তাকেই কৌশলী সিদ্ধান্ত নিতে হবে আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানব বীরদেরকে নেতৃত্ব দিতে হবে! এমনকি দেব ও বেদবিরোধী আর্য দস্যু ও দানবদের বিরুদ্ধে দেবতাদের যুদ্ধ হলে সেই যুদ্ধেও অস্ত্রহাতে দেবতাদের পক্ষে তাঁকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে! এসব ভাবলে কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হয় বেণের!
মানবদের মধ্যে এখন সবচেয়ে ক্ষমতাধর পদের নাম- নৃপতি। দেবগণ চাক্ষুস মনুকে অপসারণের পর বিবস্বানপুত্র বৈবস্বতকে যখন মনু নির্বাচিত করেন তখন বৈবস্বত ছিলেন মধ্যবয়সী, এখন তিনি প্রবীণ। পূর্বে মানবদের শাসনকার্যে মনু-ই ছিলেন সর্বেসর্বা, এখন শাসনকার্য পরিচালনার জন্য নৃপতি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে, মনু এখন একটি সাম্মানিক উপদেষ্টা পদ, তিনি মানবদের মঙ্গল-অমঙ্গলের বিষয়ে নৃপতিকে জ্ঞান ও পরামর্শ দেবেন। তবে ব্রহ্মাবর্তের শাসনকার্যের কোনো কোনো ক্ষেত্রে এবং সামাজিক রীতিনীতির অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে কেবল নৃপতি একা নন, মনু এবং দেবগণের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি ব্রাহ্মণ পুরোহিতদেরও খুব শক্ত ভূমিকা থাকবে।
দেবগণ, ঋষিগণ, পুরোহিতগণ এবং বর্তমান মনু বৈবস্বত’র আশির্বাদপুষ্ট ও সকলের মনোনীত নৃপতি- বেণ; তার সম্মানে স্বয়ং দেবপতি ইন্দ্র উপহার এবং শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন; কিছুক্ষণ পরই যে শুভেচ্ছা বার্তা সমবেত মানবদেরকে পাঠ করে শোনাবেন স্বর্গ থেকে আসা দেবপতির দূত- কল্পক। এ যেন সত্যি নয়, স্বপ্ন! বেণ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন তাঁর পূর্বপুরুষদের, তাঁরা ছিলেন বলেই তিনি বর্তমান আছেন আর আজ ব্রহ্মাবর্তের নৃপতি হতে পেরেছেন।
সপ্তদ্বীপ নিয়ে গঠিত ধরিত্রী, এই সপ্তদ্বীপের গুরুত্বপূর্ণ একটি দ্বীপ- জম্মু। জম্মুদ্বীপের আবার নয়টি বর্ষ- ভারত বর্ষ, কিম্পুরুষ বা হৈমাবত বর্ষ, হরি বর্ষ, ইলাবৃত বর্ষ, কেতুমাল বর্ষ, ভদ্রাশ্ব বর্ষ, শ্বেত বর্ষ, হৈরণ্যক বা হিরন্ময় বর্ষ এবং ঐরাবত বর্ষ; বর্ষগুলি ধনুকাকারে অবস্থিত। অনেক অনেক সপ্তর্ষিকাল আগে মহাসমুদ্র ফুঁড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল মহাপর্বত হিমালয় এবং হেমকূট, নিষধ, নীল, শ্বেত, শৃঙ্গবান পর্বত; আর এই পর্বতগুলিকে ঘিরে যোজন যোজন অঞ্চল জুড়ে থাকা অজস্র পর্বতশ্রেণি। এই পর্বতশ্রেণির কিছু পর্বত তখন সম্পূর্ণ জল-প্লাবিত ছিল আর কিছু অর্ধ প্লাবিত। তারপর কেটে গেছে বহু সপ্তর্ষিকাল; হয়েছে বহু প্রাকৃতিক দূর্যোগ- নিরন্তর বৃষ্টি হয়েছে, ঝড় হয়েছে আর ভূমিকম্প নাড়িয়ে দিয়েছে পর্বতশ্রেণিকে, ওলোট-পালোট করে দিয়েছে পর্বতশ্রেণির গঠন। শত-সহস্র দূর্যোগের পরও ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো মাথা তুলে আজও দাঁড়িয়ে আছে তুষারাবৃত হিমালয় এবং অন্য পর্বতগুলি। হিমালয় পর্বতের দক্ষিণে ভারত বর্ষ, উত্তরে হৈমাবত বর্ষ; হেমকূট পর্বতের উত্তরে হরি বর্ষ, নিষধ পর্বতের উত্তরে ইলাবৃত বর্ষ, নীল পর্বতের উত্তরে শ্বেত বর্ষ, শ্বেত পর্বতের উত্তরে হৈরণ্যক বর্ষ এবং তারপর ঐরাবত বর্ষ।
পর্বতশ্রেণির শীর্ষাঞ্চল থেকে অপেক্ষাকৃত যে সমস্ত নিন্মাঞ্চল বৎসরের ছয় মাস তুষারাবৃত থাকে কিংবা আরো নিন্মাঞ্চলে যে-সব পর্বতশ্রেণিতে দুই-তিন মাস তুষারপাত হয় অথবা তার চেয়েও নিন্মাঞ্চলে যেখানে কখনোই তুষারপাত হয় না, কালক্রমে সেইসব পর্বতের শৈলভূমিতে প্রাণের সঞ্চার হয়, প্রাণের সঞ্চার হয়ত পূর্বেই হয়েছিল যখন এই সুবিশাল শৈলভূমি সমুদ্রতলায় ছিল, পরবর্তীকালে হয়ত কেবল বিবর্তিত হয়। এই সব পর্বতশ্রেণির প্রস্তরময় ভূমি বহু সপ্তর্ষিকাল সমুদ্রতলায় জলমগ্ন থাকায় তাতে হয়ত শ্যাওলা কিংবা অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ জন্মেছিল, জল ফুঁড়ে সমুদ্রতল থেকে পর্বতচূড়ায় উঠে আসার পর সেই জলজ শ্যাওলা কিংবা নানা গোত্রের উদ্ভিদ থেকেই হয়ত কালে কালে জন্ম নেয় নানা প্রজাতির লতাগুল্ম আর বৃক্ষরাজি। গড়ে ওঠে খাদ্যচক্র আর ক্রমশ প্রাণির বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। বহু সপ্তর্ষিকাল পরে জম্মুদ্বীপের পর্বতগুলির মধ্যে মধ্যে অবস্থিত এইসব বর্ষগুলোতে গড়ে ওঠে নানা জাতি-গোষ্ঠীর বসতি। জম্মুদ্বীপ এবং নয়টি বর্ষের নামকরণ হয় আরো অনেক পরে, তখন ভারত বর্ষের নাম ছিল অজনাভ বর্ষ।
এক সপ্তর্ষিকালের অধিক কাল পূর্বে গোত্রপতির নেতৃত্বে নারী-পুরুষ সম্মিলিত একদল আর্য তাদের পালিত পশুর দল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল অনেক অনেক যোজন দূরের এক ভূ-খণ্ড থেকে; বহু বৎসর ধরে তারা বহু যোজন পথ অতিক্রম করে কখনো পর্বতে কখনোবা সবুজ সমতলে অস্থায়ী বসতি গড়তে গড়তে আর বারবার ত্যাগ করতে করতে মরুভমি মাড়িয়ে-পর্বতশ্রেণি ডিঙিয়ে হিমালয় পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত অজনাভ বর্ষের উত্তরাঞ্চলের এমন এক পর্বতে স্থিত হয়, যে পর্বতের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শীতল জলধারার নদী আর পর্বতটি বৎরের পাঁচ মাস তুষারাবৃত থাকে। এখান থেকে পর্বতশ্রেণি যত উত্তর-পূর্বদিকে গেছে, সেখানকার শৈলভূমি তত অধিককাল তুষারাবৃত থাকে, আর উচ্চতার একটা পর্যায় থেকে সারা বৎসরই তুষারাবৃত থাকে, হিমশীতল সেখানকার আবহাওয়া, বসতি গড়ার অনুপোযুক্ত। কে জানে সেই কোন দূর ভূ-খণ্ড থেকে পায়ে হেঁটে এই পর্বত পর্যন্ত পৌঁছতে আর্যদের কত প্রজন্ম লেগেছিল আর কতবার গোত্রপতির পদ শূন্য হয়ে আবার পূরণ হয়েছিল! আর্যরা যে গোত্রপতির নেতৃত্বে অজনাভ বর্ষে বসতি গড়ে তোলে তার নাম ছিল ব্রহ্মা, আর্যরা তাকেই আদিপিতার স্বীকৃতি দিয়েছে। ব্রহ্মা যে পর্বতে সর্ব প্রথম বসতি স্থাপন করেন, তিনি সেই পর্বতের নাম দেন স্বর্গ; স্বর্গের পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ জলের নদীর নাম দেন অলকানন্দা, উদ্যানের নাম দেন নন্দনকানন। আর্যদের গাত্রবর্ণ গৌর আর শরীরের গড়ন বেশ লম্বা, নারী-পুরুষ উভয়েরই মাথায় দীর্ঘ সোনালি কেশ, নীলাভ চোখ। তখন কেবল আর্যরাই নয়, আর্যদের এখানে আসার আগে থেকেই আরো অনেক জাতি-গোষ্ঠী হিমালয় অঞ্চলের এইসব পর্বতশ্রেণিতে বসতি গড়ে বাস করত; এদের মধ্যে অনার্য কৃষ্ণবর্ণের বিভিন্ন জাতি যেমনি ছিল, তেমনি ছিল গৌরবর্ণের শক্তিশালী জনগোষ্ঠীও, তবে আগে-পরে সকলেই অন্য ভূ-খণ্ড থেকে এই অজনাভ বর্ষে এসে বসতি গড়েছিল।
আর্যরা চাইছিল দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করতে; কেননা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে কখনো কখনো তাদের সংঘাত হত ভূমির অধিকার নিয়ে, গবাদীপশু নিয়ে, পশু চরানোর চারণভূমি নিয়ে। কিন্তু সংঘাতে জয়লাভ করার মতো পর্যাপ্ত জনসংখ্যা তখন তাদের ছিল না। তাছাড়া সংঘাতে কিংবা অসুখ-বিসুখে প্রাণ ক্ষয় হত, মহামারীতে প্রাণ নাশ হত, একারণে তারা বংশবৃদ্ধিতে মনোযোগ দিয়েছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং প্রতিপালনের লক্ষে আর্যদের গোত্রপতি ব্রহ্মা প্রজাপতি নামক একটি পদ সৃষ্টি করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনকে এই পদে বসান। এছাড়া ব্রহ্মা পূর্বেই বিভিন্ন বিষয়ে তাকে সহযোগিতা করার জন্য সাতটি পদ সৃষ্টি করে সাতজন ঋষিকে বসান সেই পদগুলোতে। এই সাতটি পদ হলো- পুলস্ত্য, পুলহ, অত্রি, অঙ্গিরা, ক্রতু, মরীচি ও বশিষ্ট। পুলস্ত্য এবং পুলহ’র দায়িত্ব ব্রহ্মাকে পরামর্শ দেওয়া, তাই তারা ব্রহ্মার কর্ণ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন; অঙ্গিরা ও ক্রতু’র দায়িত্ব সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা, তাই বলা হয়ে থাকে তাদের জন্ম ব্রহ্মার দুই চোখে; মরীচির দায়িত্ব সকল কার্য সম্পাদনের, তাই সাধারণ আর্যরা বলে থাকেন তার জন্ম ব্রহ্মার কাঁধে; বশিষ্ঠ’র কাজ মুখপাত্র হিসেবে সকল বিষয়ে ভাষ্য প্রদান করা, তাই বলা হয়ে থাকে তার জন্ম ব্রহ্মার জিহ্বা থেকে। এই সাতজনকে একত্রে সপ্তর্ষিমণ্ডল নামে ডাকা হয়, আর্যদের মধ্যে ব্রহ্মার পরেই সপ্তর্ষিমণ্ডলের অবস্থান এবং সর্বজন কর্তৃক শ্রদ্ধেয়। এছাড়াও পরবর্তীতে ব্রহ্মা নারদ নামে একটি পদ সৃষ্টি করেন, যার কাজ বীণা হাতে ব্রহ্মার এবং আর্য ধর্মের গুণগান করে বেড়ানো ও বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। তাই বলা হয় নারদের স্থান ব্রহ্মার কণ্ঠে। পরবর্তীকালে প্রথম ব্রহ্মার মৃত্যুর পরে গোত্রপতির পদটি তার সম্মানে তার নামেই রাখা হয়, অর্থাৎ আর্যদের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এবং সম্মানিত পদের নাম হয়- ব্রহ্মা।
স্বর্গে আর্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে তারা স্বর্গের বিস্তৃতি বাড়ানোয় মনোযোগ দেয়, আর এজন্য তারা স্বর্গের আশপাশের বিভিন্ন পর্বতে বসবাস করা কৃষ্ণবর্ণ জনগোষ্ঠী, যাদেরকে তারা অনার্য সম্বোধন করে, তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অনার্য জনগোষ্ঠীকে আর্যরা পরাজিত করে এবং ভূমি থেকে তাদেরকে উৎখাত করে সেই ভূমিকে তারা স্বর্গের অধিভূক্ত করে সেখানে বসতি গড়ে তোলে, ফলে আর্যদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রিয় বাসভূমি স্বর্গের পরিধিও বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে সমাজ পরিচালনায় কিছু কিছু নতুন নিয়ম-কানুন তৈরি হতে থাকে, সহজ সমাজের সরল আর্যদের যাত্রা শুরু হয় নিয়ম-কানুনের জটিল পথে।
স্বর্গে আর্যদের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে কিছুটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হলে বর্ষীয়ান, বিচক্ষণ এবং বুদ্ধিমান ব্রহ্মা ‘মনু’ নামক এক নতুন পদ সৃষ্টি করে তার পুত্র স্বায়ম্ভূবকে সেই পদে বসিয়ে স্বর্গ থেকে অনেকটা নিচের দিকে পবিত্র সরস্বতী নদীর পারের রসাতল নামক এক পর্বতশ্রেণিতে নতুন বসতি সৃষ্টির পরিকল্পনা করেন। কিন্তু স্বায়ম্ভূব স্বজনদের রেখে মনু’র দায়িত্ব নিয়ে রসাতলে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন, তখন ব্রহ্মা আর্যদের মঙ্গল এবং দ্রুত বিস্তারলাভের কথা বলে পুত্রকে অনেক বোঝান, স্বায়ম্ভূবের নেতৃত্বে রসাতলে যেতে আগ্রহী অনেক আর্যও তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে এবং বলে যে প্রজা হিসেবে তারা উৎপাদিত শস্যের ভাগ দেবে মনুকে, যুদ্ধবিগ্রহে জীবন উৎসর্গ করতেও কার্পণ্য করবে না। অবশেষে মনুর পদ গ্রহণ করতে সম্মত হন স্বায়ম্ভূব এবং এক শুভলগ্নে নারী-পুরুষ সম্বলিত আর্যদের একটি দল নিয়ে যাত্রা শুরু করেন রসাতলের উদ্দেশে।
স্বায়ম্ভূব মনু প্রজাদের নিয়ে সরস্বতী নদীর পারে অবস্থিত রসাতলে পৌঁছে জঙ্গলাকীর্ণ ভূমি পরিস্কার ও জলপূর্ণ ভূমি ভরাট করে বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন এবং আবাদী ভূমি তৈরি করেন, তিনি এই নতুন বসতিগুচ্ছের নাম দেন- ব্রহ্মাবর্ত, লোকমুখে মর্ত্য নামেও পরিচিত; আর ব্রহ্মাবর্তের যে বসতিতে মনুর বাসগৃহ, অর্থাৎ যেখান থেকে মনু সমগ্র ব্রহ্মাবর্তকে শাসন করবেন সেই বসতির নাম দেন- বহির্ষ্মতী। এই ব্রহ্মাবর্তের আর্যরা মনুর অনুসারী বলে মানব নামে পরিচিতি লাভ করে।
স্বায়ম্ভূব ব্রহ্মাবর্তের মনু নির্বাচিত হলেও স্বর্গের সঙ্গে তার এবং অন্যান্য আর্যদের নিয়মিত যোগাযোগ এবং যাতায়াত বজায় থাকে, পালিত পশু এবং উৎপাদিত ফসলের ভাগ কর হিসেবে নিয়মিত স্বর্গে পাঠাতে হয়। স্বর্গ এবং ব্রহ্মাবর্তের আর্যদের মধ্যে বিবাহ সম্বন্ধ, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে স্বর্গ ও ব্রহ্মাবর্তের মধ্যে নিয়মিত আসা-যাওয়া চলতে থাকে।
স্বায়ম্ভূব মনু এবং তার স্ত্রী শতরূপার পাঁচ সন্তান; দুই পুত্র উত্তানপাদ ও প্রিয়ব্রত এবং তিন কন্যা দেবহুতি, আকুতি ও প্রসূতি। তারা কেউ কেউ স্বর্গেই থাকে আবার কেউ ব্রহ্মাবর্তে চলে আসেন। স্বায়ম্ভূব মনুর কনিষ্ঠ পুত্র প্রিয়ব্রতই সপ্তদ্বীপের এই গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপের নাম রাখেন- জম্মুদ্বীপ। প্রিয়ব্রত’র পুত্র আগ্নীধ্র স্বর্গের এক অপ্সরাকে বিবাহ করলে তাদের নয়টি পুত্র হয়। নাভি, কিম্পুরুষ, হরি, ইলাবৃত, রম্যক, কুরু, হিরন্ময়, ভদ্রাশ্ব ও কেতুমাল নামে এই নয় পুত্রের মধ্যে ছয় পুত্রের নামে জম্মুদ্বীপের ছয় বর্ষের নামকরণ হয়; অবশিষ্ট অজনাভ বর্ষের নামকরণ নাভির পৌত্র ভরতের নামে হয়- ভারত বর্ষ।
কালক্রমে স্বায়ম্ভূব মনুর বংশধররা স্বর্গ ও ব্রহ্মাবর্ত ছাড়াও অতল, বিতল, সুতলসহ নানা স্থানে বংশ বিস্তার এবং নেতৃত্ব দান করেন। কেবল অনার্যদের সঙ্গেই নয়, নেতৃত্ব নিয়ে সংঘাত হয় আর্যদের নিজেদের মধ্যেও। স্বায়ম্ভূব মনুর কন্যা প্রসূতির বিবাহ হয় দক্ষের সঙ্গে, দক্ষ এবং প্রসূতির কন্যার পুত্রদের মধ্যে স্বর্গভূমির নেতৃত্ব নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। বিশেষত দিতি, অদিতি এবং দনুর পুত্রদের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ হয়; দিতির পুত্ররা পরিচিতি লাভ করে দৈত্য নামে, অদিতির পুত্ররা আদিত্য বা দেবতা নামে, দনুর পুত্ররা দানব নামে। যুদ্ধে অদিতির পুত্র দেবতাদের কাছে পরাজিত হয় দিতির পুত্র দৈত্য এবং দনুর পুত্র দানবরা। পরাজিত হয়ে তারা স্বর্গভূমি থেকে বিতাড়িত হয়; বিতাড়িত হয়ে তারা অতল, বিতল, সুতলের দিকে আশ্রয় নেয়। ব্রহ্মার গড়া স্বর্গভূমির এক আর্যযোষ্ঠী চারটি গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যায় - দেবতা, মানব, দৈত্য ও দানব। চারটি গোষ্ঠীতে ভাগ হলেও দেবতা এবং মানবরা একটি জোট, তারা একে অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়ায়। আর দৈত্য ও দানবরা অপর জোট, তারাও একে অপরের বিপদে পাশে দাঁড়ায়। এই দুই জোটে অনেকবার যুদ্ধ হয়েছে, কখনো দেবতা আর মানবরা জয়লাভ করেছে, আবার কখনো দৈত্য ও দানবরা জয়লাভ করেছে।
ব্রহ্মাবর্তের মানবরা স্বর্গের অধীনস্থ, এতদিন দেবপতি ইন্দ্র ব্রহ্মাবর্তের মঙ্গল-অমঙ্গল বিষয়ে পরামর্শ দিতেন মনুকে, আর মনুর নির্দেশ অনুযায়ী গোত্রপতিগণ নিজ নিজ গোত্রের নেতৃত্ব দিতেন। এবারই প্রথম স্বর্গ থেকে নির্দেশনা আসে নৃপতি পদ সৃষ্টির, আর সেই নৃপতি নির্বাচিত হন অঙ্গপুত্র- বেণ।
(চলবে.....)
২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ৯:১১
মিশু মিলন বলেছেন: হুম, এই উপন্যাসের জন্যই বিরতি নিয়েছিলাম। ধন্যবাদ।
২| ০৯ ই অক্টোবর, ২০২২ বিকাল ৪:২৯
নিমো বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন। অবশ্য এসব লেখা বর্তমানে এই ব্লগে পাত্তা পাবে না।
০৯ ই অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:২৭
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ৮:৪৯
শেরজা তপন বলেছেন: অনেকদিন বাদে ব্লগে দেখলাম আপনাকে।
~লেখা পড়া হয়নি- সময় করে পড়ে নেব।