নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব-দুই)

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ বিকাল ৪:৩৩

বৃক্ষের গুঁড়ি কেটে বিশেষভাবে তৈরি সিংহাসনে উপবিষ্ট নৃপতি বেণ, অন্য পাঁচজন আর্য তরুণের মতো তিনিও দাড়ি-গোঁফ রাখতে পছন্দ করেন না, দাড়ি-গোঁফ কামানো চকচকে মুখমণ্ডল তাঁর, কাঁধ সমান লম্বা ঘন সোনালি কেশ। অঙ্গে নীলগাইয়ের নীলাভ আভাযুক্ত ধূসর রঙের ঐতিহ্যবাহী পশমি চামড়ার নিবি, পরনে নীলগাইয়ের গাঢ় ধূসর রঙের পশমী চামড়ার বাস, কাঁধে উত্তরীয় আর মাথায় উষ্ণীব। পা থেকে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত আবৃত গরুর ধূসর পশমী চামড়ার পাদুকায়। নীলগাইয়ের পশমী চামড়ার পোশাক ও উষ্ণীব নৃপতি বেণকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন দেবপতি ইন্দ্র। প্রভাতে পবিত্র সপ্তসিন্ধু অর্থাৎ সিন্ধু, বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, ইরাবতী, বিপাশা, শতদ্রু ও সরস্বতী নদী থেকে বয়ে আনা জল দিয়ে বেণকে স্নান করানোর পর দেবপতির প্রতিনিধি হিসেবে আগত দেব ও অপ্সরাগণ দেবপতির উপহারের পোশাক পরিয়ে দেন বেণকে। বেণের স্ত্রী অর্থাৎ মহিষী হংসপাদার জন্যও পশমী চামড়ার পোশাক ও উষ্ণীব পাঠিয়েছেন ইন্দ্র, যা এখন শোভা পাচ্ছে বেণের বামপাশের সিংহাসনে উপবিষ্ট হংসপাদার অঙ্গে। স্বর্গের দেবী সরস্বতী নৃপতি ও মহিষী দুজনের জন্যই পাঠিয়েছেন ঝিনুকের হার ও উত্তরীয়, যা এখন দুজনের গলায় শোভা পাচ্ছে। ব্রহ্মা বেণের জন্য পাঠিয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিধান করার জন্য বিশেষ ধরনের অঙ্গাবরণ- কবচ, বিষ্ণু পাঠিয়েছেন সুদর্শন চক্র, যম পাঠিয়েছেন কাঠের একটি দণ্ড, চন্দ্র পাঠিয়েছেন একটি বলবান অশ্ব, শিব পাঠিয়েছেন একটি শঙ্খ, আর বায়ু নিজেই এসেছেন ময়ূরের পালক দিয়ে তৈরি দু-খানা পাখা নিয়ে।

সমবেত দর্শকদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে হংসপাদার মুখে দৃষ্টি রাখেন বেণ, হংসপাদা তাঁর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসেন, স্বামীগর্বে তিনিও আজ ভীষণ গর্বিত। গর্বিত বেণের বন্ধু-স্বজন সকলেই, ওই তো পূর্বদিকের দর্শক আসনের একেবারে সামনে বসে পুত্রগর্বে গর্বিত বদনে নৃত্য উপভোগ করছেন তাঁর পিতা অঙ্গ আর মাতা সুনীথা। বেণের দৃষ্টি পিতা-মাতার মুখ দর্শনের পর অবলোকন করতে থাকে দক্ষিণদিকে কেদারায় উপবিষ্ট স্বর্গের সপ্তর্ষিমণ্ডলীর অন্যতম ঋষি অত্রি, তিনজন দেব আর তিনজন অপ্সরার মুখ; নৃপতি হিসেবে তাঁর অভিষেক উপলক্ষে দূর্গম এবং কষ্টসাধ্য পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে তারা স্বর্গ থেকে এসেছেন দেবপতি ইন্দ্রের প্রতিনিধি হয়ে, তাঁকে প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়েছেন, উপহার প্রদান করেছেন।

আজ তিনি নৃপতি আর হংসপাদা মহিষী! সত্য, তবু যেন স্বপ্নের মতো মনে হয় বেণের, আজ প্রভাতে ঘুম থেকে জেগে উঠার পর থেকেই তিনি কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন, মাথার মধ্যে যেনবা শরৎকালের অপরাহ্ণের পাতলা কুয়াশার আস্তরণ! সেই প্রভাতে উঠে পবিত্র সপ্তসিন্ধুর জল দিয়ে স্নান করার পর থেকেই নৃপতি-অভিষেকের ধর্মীয় নানান রীতি-ক্রীয়াদি শুরু হয় ঋত্ত্বিকগণের পরিচালনায়। মহা সমারোহে প্রচুর ঘৃত আর চন্দন কাঠ পুড়িয়ে যজ্ঞ করা হয় দেবপতি ইন্দ্র ও অগ্নিদেবের উদ্দেশ্যে। গরু, মহিষ, ভেড়া, পাঁঠা মিলিয়ে একশো একটি পশু বলি দেওয়া হয়; অনেকগুলো উনুনে বলির মাংস রন্ধন করা হয়। দূর-দূরান্তের বিভিন্ন গুহা, পর্বত এবং পর্বতের পাদদেশ থেকে ঋষিগণ এবং ব্রহ্মাবর্তের বিভিন্ন গোত্রের মানুষ নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসেন, হাতে পুষ্প দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানান। মধ্যাহ্নের পর থেকে শুরু হয় আহার, মানুষ বৈঠকের পর বৈঠকে বসে আর পেট পুরে আহার করে যবের রুটি ও মাংস। অনেকেই নিজ নিজ গৃহে ফিরে গেছে, আবার অনেকে রয়ে গেছে সন্ধ্যার পরের সোমপর্বে অংশ নেওয়া এবং নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠানাদি দেখার জন্য। সন্ধ্যার পর পুরোহিতগণের নেতৃত্বে তাঁকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয় সোমপর্ব, দেবপতি ইন্দ্রের উদ্দেশে সোমরস উৎসর্গ করা হয়েছে। আগামীকাল প্রত্যুষে মানবদের একটি দল স্বর্গের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করবে দেবপতি ইন্দ্র এবং বিশিষ্ট দেবগণের জন্য যজ্ঞের মাংস, সোমরস, ঘৃত, ছানা খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দিতে। সোমরস দেবপতি ইন্দ্রের বড় প্রিয়! স্বর্গে ইন্দ্রের জন্য সর্বদা সোমরস সংগ্রহ করে রাখা হয় যে বিশাল পাত্রে- তার নাম ইন্দ্রোদর। সোমরস পানের প্রতি অতিশয় আসক্তির কারণেই বর্তমান ইন্দ্র শত্রু’র বপু নাকি ভীষণ স্ফীত, যা অন্যদের কাছে হাস্যরসের বিষয়!

সন্ধ্যার পর থেকে একদিকে যেমনি চলতে থাকে নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান, তেমনি অন্যদিকে চলতে থাকে যবের ছাতু কিংবা মাংসের সঙ্গে সোমরস ও মাধ্বী পানের মহোৎসব! নারী-পুরুষ উভয়েই যবের ছাতু কিংবা মাংস খেয়ে আর সোমরস অথবা মাধ্বী পান করে এসে নৃত্য উপভোগ করতে থাকে নেশাতুর চোখে, কেউ কেউ মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে আবার সোমরস কিংবা মাধ্বী পান করে আসে, গভীর রাত পর্যন্ত আজ এভাবেই চলতে থাকবে। এদিকে নৃত্যও সহজে থামবে না আর ওদিকে সোমরস কিংবা মাধ্বীর পাত্রও সহসাই শূন্য হবে না!
অপরাহ্ণ থেকে বেণের মাথার ভেতরের কুয়াশার মতো ঘোর একটু একটু করে কাটতে শুরু করে, একটু একটু করে তিনি ধাতস্থ হতে থাকেন আর বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে- হ্যাঁ, তিনিই নৃপতি- ব্রহ্মাবর্তের মানবদের দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা!

স্বায়ম্ভূব মনুর নবম প্রজন্ম, প্রসিদ্ধ চাক্ষুস মনুর প্রপৌত্র আর গোত্র-প্রধান অঙ্গ’র পুত্র হিসেবে ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে নেতৃত্বগুণ থাকলেও, নৃপতি হওয়া তাঁর জন্য একেবারে নিষ্কণ্টক ছিল না। স্বায়ম্ভূব মনুর উত্তর প্রজন্ম এখন বহু ভাগে বিভক্ত, বহু শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত স্বর্গে এবং ব্রহ্মাবর্তে। চাক্ষুস মনুর প্রপৌত্রও তিনি একা নন; পুরু, শিবি, উল্লুক ইত্যাদি বারোজন পুত্র ছিল চাক্ষুস মনুর, এই বারোজন পুত্র আবার অনেক পুত্রের জন্ম দেন। উল্লুক জন্ম দেন অঙ্গ, গয় ইত্যাদি ছয় পুত্রের; এদের থেকে আবার বংশ বৃদ্ধি পায়। এ তো গেল স্বায়ম্ভূব মনুর জ্যেষ্ঠ্যপুত্র উত্তানপাদের বংশধরদের কথা, এদের বাইরেও রয়েছে তার তিন কন্যা দেবহুতি, আকুতি ও প্রসুতির বংশধররা। তার কনিষ্ঠ পুত্র প্রিয়ব্রত’র বংশ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় মহাপ্রলয়ের সময় বানের জলে ভেসে। চাক্ষুস মনুর আগে উত্তম, তামস এবং রেবত পরপর তিনজন মনুই ছিলেন প্রিয়ব্রত’র পুত্র। স্বায়ম্ভূব মনুর বংশধরদের হাতে ব্রহ্মাবর্ত বিস্তৃতি লাভ করে, এমনকি তাঁর বংশধররা ব্রহ্মাবর্তের বাইরেও বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ে বংশ বৃদ্ধি করে। সঙ্গত কারণেই বেণের রাজা হবার পথে অনেক বাঁধা ছিল, ছিল অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু যোগ্যতায় বেণ সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন।

বেণ বাল্যকাল থেকেই সমবয়সী তুতো ভ্রাতা এবং সখাদের মধ্যে ছিলেন সবচেয়ে সাহসী এবং নেতৃত্বগুণের অধিকারী। কী সাঁতার, কী মল্লযুদ্ধে; কী অশ্বচালনা, কী তীর নিক্ষেপ কিংবা পশু শিকারে; তিনি ছিলেন সকলের চেয়ে অনেক এগিয়ে, দূরন্ত তাঁর ক্ষিপ্রতা ও তুখোর তাঁর বাচনভঙ্গী। আর ভোজনসিক হিসেবেও তিনি বেশ খ্যাত, দু-তিনজনের আহার অবলীলায় একা সাবাড় করতে পারেন!

যৌবনে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই বেণ যুদ্ধে যোগ দিতে শুরু করেন, বাল্যকাল থেকেই অশ্বচালনা এবং তীর নিক্ষেপে তিনি সুদক্ষ। যৌবনে পা দিয়েই অনেকবার অনার্য দস্যু, রাক্ষস, নিষাদ, পনিজাতির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন; বেশ কয়েকবার সম্মুখযুদ্ধে অনার্যদের বসতি আর পশু দখলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, অনার্যদের রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছেন তাদের বসতি আর হয়ে উঠেছেন আর্য জাতির গৌরব। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি যেন এক ক্ষ্যাপা ষাঁড়, সব ভুলে শত্রুর রক্ত পিপাসায় মেতে ওঠেন, তরবারি কিংবা বর্শার আঘাতে মুহূর্তে ক্ষত-বিক্ষত করেন শত্রুর দেহ!

নয় বৎসর আগে সরস্বতীর উজানের দিকে নিষাদদের একটা গোত্রের সঙ্গে যুদ্ধে বিপুল বিক্রম দেখিয়েছিলেন সদ্য যৌবনে পা দেওয়া বেণ, তখনই ব্রহ্মাবর্ত এবং স্বর্গে তাঁর নামে জয়জয়কার পড়ে যায়। দেবপতি ইন্দ্রের ইচ্ছে নয় পবিত্র অলকানন্দা এবং সরস্বতী নদীর পাহাড়ী অংশের তীরে কোনো অনার্য জাতির বসতি থাকুক আর তারা এই দুই নদীর পবিত্রতা নষ্ট করুক! তাই দেবপতি ইন্দ্রের মনোস্কামনা পূরণ করতে বহু বৎসর ধরেই আর্যরা অনার্যদের বসতিতে আক্রমণ করে তাদেরকে উৎখাতের মাধ্যমে আর্যভূমি বিস্তারের চেষ্টা করছে। সরস্বতীর উজানের দিকের পর্বতগুলোতে আগে প্রচুর অনার্য গোত্রের বসতি ছিল, আর্যরা তাদের উৎখাত করতে করতে নিচের দিকে নামিয়েছে আর তাদের ভূমিতে নিজেরা বসতি গড়েছে। যদিও সরস্বতীর উজানের দিকে এখনো বেশ কিছু রাক্ষস, যক্ষ, রক্ষ, ভূত, পিশাচ ইত্যাদি জাতির বসতি রয়ে গেছে। এমনকি অনেক অনার্য গোত্রকে উৎখাত করে দেবগণ স্বর্গের আয়তন বাড়ানোর পরও স্বর্গের নিকটবর্তী কিছু কিছু অঞ্চলে এখনো অনার্যদের বসতি রয়ে গেছে। দেবগণ সকল অনার্য গোত্রকে উৎখাত করতে পারছেন না অনার্যদের আরাধ্য পুরুষ শিবের জন্য, শিব অত্যন্ত সাহসী সিদ্ধপুরুষ, অজস্র অনুচর তার, সেখানকার অনার্যদের উৎখাত করতে গেলেই শিব বুক চিতিয়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান। দক্ষযজ্ঞের ঘটনার পর থেকে শিব পদে যিনিই উপবিষ্ট থাকুন না কেন, আর্যরা তাকে ঘটাতে সাহস পায় না! তবু নানা সময়ে নানা কৌশলে অথবা ছলনার আশ্রয় নিয়ে চৌর্যবৃত্তি কিংবা লুণ্ঠনের অভিযোগ এনে অনার্য গোত্রগুলিকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে আর্যরা।

আর্যদের উচ্ছেদ অভিযানের ফলে বিভিন্ন অনার্য গোষ্ঠী সরস্বতীর ভাটির দিকে বসতি গড়েছে, আবার কোনো কোনো গোষ্ঠী আরো নিন্মভূমিতে অর্থাৎ সমভূমিতে নেমে বসতি গড়েছে গঙ্গা-যমুনা কিংবা ছোট কোনো নদীর তীর অথবা সরোবরের পাড়ে, যেখানে আগে থেকেই বিভিন্ন অনার্য জনগোষ্ঠী বাস করে। আর্যদের মধ্যে এখন যেমন চারটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে- দেব, মানব, দস্যু ও দানব; দেব এবং মানবদের সঙ্গে যেমনি দস্যু ও দানবদের হানাহানি-যুদ্ধ লেগেই থাকে; তেমনি অনার্যদের নিজেদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রায়শঃ এক গোষ্ঠীর সঙ্গে আরেক গোষ্ঠীর যুদ্ধ হয়, প্রাণ ক্ষয় হয়। পাহাড়ী উচ্চভূমিতে এখনো যে কয়েকটি অনার্য গোষ্ঠী বাস করে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী কিরাত জাতি। তাদের গাত্রবর্ণ অন্য অনার্যদের মতো কৃষ্ণবর্ণ নয়, গৌর বর্ণ, আকৃতিতে অবশ্য খর্বকায়, কিছুটা চ্যাপ্টা নাকের অধিকারী। খর্বকায় হলেও কিরাতরা দূর্ধর্ষ এক যোদ্ধা জাতি, ভীষণ শক্তিশালী আর সাহসী, নিজেদের সম্পদ ও গোত্রকে রক্ষায় জীবন দিতেও তারা পিছপা হয় না, যতক্ষণ তাদের ধড়ে প্রাণ থাকে ততক্ষণই তারা লড়াই চালিয়ে যায়। পুরুষরা তো বটেই কিরাত নারীরাও যুদ্ধবিদ্যায় দারুণ দক্ষ হয়, তারা ক্ষিপ্রহাতে তরবারি চালাতে জানে আর কিলকারীর সাহায্যে দূরের শত্রুর দিকে পাথর নিক্ষেপ করতে পারে। যে কারণে যুদ্ধে এখনো কিরাত জাতিকে জয় করা আর্যদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিরার পশুচারণ করে জীবিকা নির্বাহ করে, তাদের বসতি উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে, শীতকালে পাহাড়ের উচ্চভূমিতে তুষারপাত হওয়ার কারণে তৃণভূমি বরফের নিচে চাপা পড়ে যায় আর শীতে কষ্টও হয় খুব, ফলে শীতের আগেই শরৎকালে কিরাতরা নিচের দিকের পাহাড়ে নেমে আসে যাতে পশুদের জন্য পর্যাপ্ত তৃণভূমি পাওয়া যায় আর তাদেরও শীতের কষ্ট কম হয়, শীত শেষ হলেই তারা আবার নিজেদের বসতিতে ফিরে যায়। যতদিন কিরাতরা নিচের দিকের পাহাড়ে থাকে, ততদিন তাদেরকে খুব সতর্ক অবস্থায় থাকতে হয়, কেননা গবাদী পশুর লোভে ইন্দ্রের প্ররোচনায় এই সময়টাতেই মানবরা তাদের ওপর আক্রমণ করে। দেব এবং মানবরা সম্মিলিতভাবে অনেকবার আক্রমণ করেছে কিরাতদের, ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছে দু-পক্ষে, দু-পক্ষেরই প্রাণ ক্ষয় হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেব-মানবরা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। তবে কিরাতদেরকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করতে না পারলেও তাদের যথেষ্ঠ ক্ষতিসাধন করতে পেরেছে, অনেক গবাদী পশু লুণ্ঠন করতে পেরেছে। দেবপতি ইন্দ্রের এই এক আক্ষেপ যে তারা আজও কিরাত জাতিকে উচিত শিক্ষা দিতে পারলেন না!

কিরাতদের মতো যুদ্ধনিপুণ নয় নিষাদরা, তারা শান্ত-সরল এক জাতি, নয় বৎসর পূর্বের সরস্বতী নদীর উজানের দিকের সেই নিষাদ গোত্রটি মৎস্য এবং অরণ্যের পশু শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী একদিন মধ্যাহ্নে অশ্বারোহী এবং পদাতিক আর্য মানব যোদ্ধারা প্রায় এক যোজন দূরের নিষাদ বসতির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে, পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে তারা নিষাদ বসতি থেকে আধা ক্রোশ দূরের অরণ্যে আশ্রয় নেয়, সেখানে আহার-বিশ্রাম করার পর ভোররাতে যখন নিষাদদের বসতিতে আক্রমণ করে তখন নিষাদরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। আচমকা আক্রমণে ঘুমভাঙা দিশেহারা অপ্রস্তত নিষাদদের কিছু প্রাণ ক্ষয় হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা পিছু হটে গিয়ে একত্রিত হয়ে নিষাদ সর্দারের নেতৃত্বে আর্যদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। শুরুতে আর্যরা কেবল তাম্রধাতুর তৈরি বর্শা আর তরবারি নিয়ে নিষাদদের ওপর আক্রমণ করে, কিন্তু নির্ষাদরা তীর-ধনুক নিয়ে প্রতিরোধ শুরু করলে আর্যরাও ধনুক হাতে নিয়ে তীর ছুড়তে শুরু করে। আর্যরা দক্ষ যোদ্ধা, একাধিক পরিকল্পনা নিয়ে তারা যুদ্ধে নামে, প্রথম পরিকল্পনায় ফল না এলে দ্বিতীয়-তৃতীয় পরিকল্পনা প্রয়োগ করে। আর্য যোদ্ধাদের একটি দল সামনে থেকে তীর ছুড়তে থাকে, আর দুটি দল কিছুটা পিছু হটে ঘুরে গিয়ে গিয়ে ডান এবং বাম পাশ থেকে বিদ্যুৎ গতিতে অশ্ব চালিয়ে নিষাদদের বলয়ের মধ্যে ঢুকে ক্ষিপ্র হাতে বর্শা আর তরবারি নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, এই অতর্কিত আক্রমণে নিষাদদের অনেকেই মারা যায় আর জীবিতরা তীর-ধনুক ফেলে বর্শা কিংবা তরবারি হাতে নিয়ে আর্যদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এতক্ষণ আর্যদের যে দলটি তীর-ধনুক ছুড়ছিল এবার তারাও তরবারি আর বর্শা নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিষাদরা ভূমিতে দাঁড়িয়ে অশ্বারোহী আর্যদের সঙ্গে তেমন সুবিধা করতে পারে না, তাদের কেউ কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে পালাতে শুরু করে অরণ্যের দিকে। কিন্তু নিষাদ সর্দার না পালিয়ে কিছু যোদ্ধাকে নিয়ে বীরের মতো সম্মুখযুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন।

সূর্যের আগমনী বার্তায় অন্ধকার কেটে গিয়ে রাঙা হতে থাকে পুবের আকাশ, সংখ্যায় অধিক নিষাদ নিহত হলেও কিছু অশ্বারোহী এবং পদাতিক আর্যকেও ধরাশায়ী করে নিষাদরা। নিষাদ সর্দারকে প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করতে দেখে তার দিকে এগিয়ে যান বেণ। বেণ তরবারি হাতে অশ্বে আরোহণ করে আর নিষাদ সর্দার ভূমিতে দাঁড়িয়ে বর্শা হাতে। দুজনের মধ্যে তুমুল লড়াই চলতে থাকে, কেউ কারো থেকে কম যান না, যুদ্ধ করতে করতে হঠাৎ-ই বেণ অশ্ব থেকে ভূমিতে লুটিয়ে পড়েন আর নিষাদ সর্দারের বর্শার আঘাত লাগে অশ্বের পেটে, আর্তচিৎকার করতে করতে অশ্বটি দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে পেটে বিদ্ধ বর্শা নিয়েই। কিছু আর্য যোদ্ধা মনে করে বেণ হয়ত তীব্র আঘাত পেয়েছেন, এখনই মৃত্যুমুখে পতিত হবেন। কিন্তু সহসাই তরবারি হাতে উঠে দাঁড়ান বেণ, ঝাঁপিয়ে পড়েন নিষাদ সর্দারের ওপর। নিষাদ সরদারের বর্শা হাতছাড়া হলেও মৃত একজন আর্য সৈন্যের একটা তরবারি চোখের পলকে ভূমি থেকে তুলে নিয়ে তিনিও পাল্টা আক্রমণ করেন। যুদ্ধ চলতে থাকে দুজনের, সূর্যদেব রাঙা শরীরে মূর্ত হয়ে ওঠেন পুব আকাশে, যুদ্ধ করতে করতে হঠাৎ পিছন দিকে পড়ে থাকা একজন মৃত যোদ্ধার শরীরে পা লেগে উল্টে পড়ে যান নিষাদ সর্দার। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগান বেণ, ঝড়ের বেগে এগিয়ে গিয়ে তরবারির কোপে নিষাদ সর্দারের ডান হাতটি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন, ব্যথায় কাতরাতে থাকেন নিষাদ সর্দার। বেণ নিষাদ সর্দারের বুকের ওপর বাম পা রাখেন। আশ্চর্য, ভয় নয়, নিষাদ সর্দারের চোখে ফুটে ওঠে ক্ষোভ আর ঘৃণা! বেণ আর দেরি করেন না, এক কোপে নিষাদ সর্দারের ধড় থেকে মাথাটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন, ধড়টি ছটফট করতে থাকে, বেণ ডানহাতে রক্তাক্ত তরবারি আর সর্দারের রক্তমাখা কাটা মুণ্ডটি বামহাতে নিয়ে চিৎকার করে সিংহের মতো হুংকার দিতে থাকেন। নিষাদ সর্দারের রক্তমাখা কাটা মুণ্ড হাতে নিয়ে বেণের চিৎকার করার বীভৎস দৃশ্য দেখে অল্প যে ক’জন নিষাদ তখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল তারা দ্রুত পিছু হটে যে যে-দিকে পারে পালিয়ে যায়, আর আর্য বীরগণ বেণের বীরত্বে বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আর্যরা নিষাদদের বসতি, গবাদীপশু আর বেশকিছু নারী ও শিশু নিজেদের দখলে নেয়। পরে মনুর পরামর্শে নতুন জয় করা ভূমিতে মানবদের কিছু পরিবার বসতি স্থাপন করে। যে কজন নিষাদ নারী ও কিশোরকে আর্যরা বন্দী করেছিল, তাদেরকে নিজেদের গৃহে ভৃত্যের কাজে নিযুক্ত করে। অসীম বীরত্বের পুরস্কারস্বরূপ মনু কেশিনী নামের এক যুবতী আর মারীচ নামের এক কিশোরকে ভৃত্য হিসেবে উপহার দেন বেণকে। কেশিনী গাভীর দুগ্ধ দোহন, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত করে ছানা তৈরি, রন্ধনের খড়ি সংগ্রহ, ঝরনা থেকে জল আনা, নানা কাজে বেণের স্ত্রী হংসপাদাকে সাহায্য করত। মাস চারেক ছিল কেশিনী, তারপর এক গভীররাতে পালিয়ে কোথাও চলে গেছে। মরীচ অবশ্য এখনো আছে; সে গবাদীপশু চরায়, পশু শিকার করতে যায়, গৃহস্থালির টুকিটাকি কাজ করে।

নিষাদদের সঙ্গে যুদ্ধে বেণের সেই বীরত্বের কাহিনী বিভিন্ন আর্য গোত্রের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে; মনু, ব্রাহ্মণ এবং ঋষিরা বেণের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন, ঋষিদের মাধ্যমে তাঁর সেই বীরত্বের সংবাদ পৌঁছে যায় দেবতাদের কানেও, দেবতাগণ শুনে খুশি হন, স্বয়ং দেবপতি ইন্দ্র ও বিষ্ণু ঋষিদের কাছে তাঁর বীরত্বের প্রশংসা করেন। এর পরেও বেণ আরো অনেকবার যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন; কখনো অনার্যদের বিরুদ্ধে, আবার কখনো দেবতাদের পক্ষে দৈত্য ও দানদের বিরুদ্ধে।

তাঁর এইসব বীরত্বের কাহিনী-ই আর্য মানব এবং দেবতাদের কাছে তাকে জনপ্রিয় করে তোলে, ফলে নৃপতি হবার দৌড়ে তিনি অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে যান। মনুর গোত্র ছাড়াও অন্যান্য গোত্রের মানবরাও তাঁকে নৃপতি হিসেবে মেনে নিয়েছে। তবে তাঁর নৃপতি হবার পথে একেবারেই যে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি তা নয়, অধিকাংশ গোত্র থেকে আপত্তি না উঠলেও দু-একটি গোত্র থেকে কেউ কেউ বেণকে নৃপতি করার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল মনুর কাছে, দু-একজন গোত্র-প্রধান নিজেই নৃপতি হবার দাবিদার ছিলেন, কিন্তু জনপ্রিয়তা এবং বিচক্ষণতার নিরিখে তারা বেণের চেয়ে অনেক পিছিয়ে ছিলেন, আবার কোনো কোনো গোত্র তাদের পক্ষে ছিল না। তাছাড়া নৃপতি হতে গেলে কেবল মনু নয়, দেবতা, ঋষি এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিতদেরও অকুণ্ঠ সমর্থন প্রয়োজন; গোত্র-প্রধান অঙ্গ’র সঙ্গে ব্রাহ্মণ এবং পুরোহিতদের সম্পর্ক ভালো থাকায় তিনি নিজ পুত্রকে নৃপতি করতে ঋষিদের মাধ্যমে দেবতাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ করেন। তাছাড়া স্বায়ম্ভূব মনুর নবম প্রজন্ম হওয়ায় বর্তমান মনু বৈবস্বত, দেবতা, ঋষি এবং ব্রাহ্মণদের সমর্থনও ছিল বেণের পক্ষে; তাঁরা নৃপতি হিসেবে বেণকেই মনোনীত করেন।

কবিশ ও ভুবনার নৃত্য শেষে অনুষ্ঠানের ঘোষক নতুন নৃপতি ও ব্রহ্মাবর্তবাসীকে দেবপতি ইন্দ্রের বার্তা শোনানোর জন্য কল্পকদেবের নাম ঘোষণা করতেই কল্পকদেব নিজের আসন ছেড়ে মঞ্চের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ান। কল্পক দেবপতির খুবই অনুগত, তিনি ভবিষ্যতে নারদের আসনে অধিষ্ঠিত হতে চান, দেবপতিরও তেমনই ইচ্ছে, তাই এখন থেকেই দেবপতি তাকে নানা কাজে সম্পৃক্ত করেন। স্বর্গে নারদ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ, ব্রহ্মা নারদ পদ সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর এবং বেদের মাহাত্ম্য প্রচার করার জন্য। যদিও ব্রহ্মার সঙ্গে প্রথম নারদের বিরোধের পর থেকে তৎকালীন এবং পরবর্তী সকল নারদই কেবল বেদ ও বিষ্ণুর মহিমা কীর্তন করেন। ব্রহ্মার সঙ্গে তৎকালীন নারদের বিরোধের কারণ বিবাহ সংক্রান্ত, নারদ বিবাহ করতে চাইছিলেন না, তিনি চাইছিলেন আধ্যাত্মিক পথে জীবন অতিবাহিত করতে, কিন্তু যেহেতু তখন আর্যদের সংখ্যা কম ছিল, তাই ব্রহ্মা চাইছিলেন নারদ বিবাহ করে সন্তান উৎপাদন করুক। এই নিয়েই দুজনের বিরোধ, দুজন দুজনকে অভিশাপও দিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর থেকেই নারদ বিষ্ণুর বন্দনা শুরু করেন এবং অন্যদেরকেও বিষ্ণুর বন্দনা করতে পরামর্শ দেন। এই ঘটনা স্বর্গে বিষ্ণুর প্রভাব বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নারদ সংবাদ আদান-প্রদানের কাজ করেন, আধ্যাত্মিক সংগীত চর্চা করেন এবং মানুষকে আধ্যাত্মিক পথে চালিত করার চেষ্টা করেন। মানুষকে তিনি সহজেই প্রভাবিত করতে পারেন। সঙ্গত কারণেই কল্পকের লক্ষ্য অদূর ভবিষ্যতে নারদের পদে অধিষ্ঠিত হওয়া।

একত্রিশ বৎসরের তরুণ কল্পক মৃদু হেসে নৃপতি বেণ ও হংসপাদাকে অভিবাদন জানান। তার গায়ে চমরি গাইয়ের বেশ বড় বড় পশম সমৃদ্ধ চামড়ার নিবি, বাম কাঁধে হরিণের চামড়ার উত্তরীয়, পরনে নীলগাইয়ের চামড়ার বাস। গলায় কয়েকটি পুঁতির আর একটি শুভ্র পুষ্পের মালা, বাহুতেও পুষ্প মালা, আর দুই হাতের আঙুলে ধাতুর কয়েকটি অঙ্গুরীয়। মাথার উপরে বাঁধা খোঁপায় শুভ্র পুষ্পের মালা জড়ানো, কপাল এবং বাহুতে চন্দনের আলপনা, তিনি সেজেগুঁজে থাকতে ভালবাসেন। তাঁর স্বভাব কিছুটা মেয়েলি ধরনের, গলার স্বরও চিকন, হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলেন। দেবপতি ইন্দ্র ও বিষ্ণু মেয়েলি স্বভাবের এই ধরনের মানুষকেই নারদ হিসেবে নিয়োগ দেন এজন্য যে এই ধরনের মানুষেরা সংবাদ সংগ্রহ এবং বেদের মাহাত্ম্য প্রচারে অধিক সফল হন। পুরুষের মনের কথা বের করতে তো পারেনই, এমন কি নারীর অতল হৃদয়ের কথাও ছেকে আনতে পারেন! মেয়েলি স্বভাব হওয়ায় এই ধরনের পুরুষেরা সহজে মানুষের গৃহে প্রবেশ করে নারীদের সঙ্গে অবলীলায় মিশতে পারেন। প্রয়োজনে বেশভূষা বদলে ফেলে কখনো কখনো নারী কিংবা বৃহন্নলার রূপও ধারণ করতে পারেন। নৃত্য-গীতেও দারুণ পারদর্শী হন, ফলে এই ধরনের মানুষকেই নারদ নির্বাচন করেন দেপতি ইন্দ্র।

নৃপতি বেণের অন্তর কিছুটা চঞ্চল হয়ে ওঠে, কিছুটা হৃদকম্পনও তিনি অনুভব করেন, কল্পকের কাছে কী বার্তা পাঠিয়েছেন দেবপতি ইন্দ্র তা শোনার জন্য তিনি ভীষণ উদগ্রীব হয়ে আছেন। কেবল তিনি নন, তাঁর স্ত্রী হংসপাদা, তাঁর পিতা-মাতা এবং আগত দর্শকেরাও দেবপতি ইন্দ্রের বার্তা শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। কল্পক তাঁর বাম কাঁধের উত্তরীয় ঠিক করেন, প্রয়োজন না থাকলেও বারবার কেশ বিন্যাস করেন আঙুল দিয়ে, তারপর বলেন, ‘মহামান্য নৃপতি এবং সম্মানীত দর্শকমণ্ডলী, দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে স্বর্গ থেকে আমি ব্রহ্মাবর্তে এসেছি দেবপতি ইন্দ্রের বার্তা নিয়ে, দেবপতির পক্ষ থেকে আপনারা আমার অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আপনাদের এই সবুজ-শ্যামল ব্রহ্মাবর্তে এবারই আমি প্রথম এসেছি, কী অপূর্ব সুন্দর আপনাদের ব্রহ্মাবর্ত, নয়ন জুড়োনো সবুজ অরণ্য আর নীলাভ পাহাড়, ফাঁকে ফাঁকে ফসলের ক্ষেত আর গো-চরণভূমি, বহু দূরের বরফাচ্ছাদিত ধূসর পাহাড়ও এখান থেকে দৃষ্টিগোচর হয়, এখানকার পাহাড়-অরণ্যের বিপুল বৃক্ষরাজি বিস্ময় জাগায়, স্বচ্ছ ঝরনার কলতান হৃদয়ে জাগায় প্রেম, আর পবিত্র সরস্বতী নদীর গুণকীর্তন করতে গেলে বুঝিবা রাত্রি ভোর হয়ে যাবে!’



(চলবে....)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.