নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব- পাঁচ )

০৫ ই অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১২:২৭

দুই

নৃপতিমাতা সুনীথার দু-চোখের পাতা যেন আজ বাতাসে ভাসমান বুলবুলি পাখির বিচ্ছিন্ন পালক, রাত্রের শেষ প্রহরে তাঁর চোখে ঘুম আসতে চায় না! তাঁর দু-চোখে কেবলই ভাসে পুত্র বেণের মুখমণ্ডল, পুত্রগর্বে গর্বিত মাতা তিনি। এত এত আর্য গোত্রপতি ও যুবক বীরদের ভিড়ে তার পুত্র নৃপতি হয়েছেন, মাতা হিসেবে এটা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া, এখন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখ উদযাপনের কাল, এখন কী আর ঘুমের সময়! দেবগণকে সামনে রেখে মনু বেণকে নৃপতি হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকেই নৃপতিমাতা হিসেবে সকলে তাকে ভিন্ন চোখে দেখতে শুরু করেছে, মানুষ তাকে পূর্বের চেয়ে অধিক শ্রদ্ধা করছে, মান্য করছে। আর এইসব হচ্ছে পুত্র বেণের সৌজন্যে, এমন পুত্রের মাতা হওয়ার সৌভাগ্য ক’জন নারীর জীবনে হয়! অনেক সাধনার ফসল তার এই পুত্র। স্বায়ম্ভূব মনুর বংশের গোত্রপতি অঙ্গ’র সঙ্গে বিবাহের পর অনেকগুলো বৎসর কেটে গেলেও সন্তান হচ্ছিল না তাদের। লোকে নানা কথা কানাকানি করত, তাকে বন্ধ্যা বলত আর অঙ্গকে বলত আটকুঁড়ে গোত্রপতি। সন্তানের সাধ না পাওয়ায় তিনি কাঁদতেন আর অঙ্গ বিমর্ষ হয়ে থাকতেন এই ভেবে যে তার বংশ রক্ষা করবে কে, গোত্রপতি হবে কে। মনের দুঃখে অঙ্গ মাঝে মাঝে গৃহ ছেড়ে ঋষিদের আশ্রমে তীর্থ করতে যেতেন, আশ্রমে থেকে ঈশ্বরের আরাধনা করতেন, তারপর মনটা যখন একটু হালকা হত তখন গৃহে ফিরতেন। তারপর এক ঋষির পরামর্শে অঙ্গ পুত্রেষ্টী যজ্ঞ করেন, পুত্রেষ্টি যজ্ঞের নয় মাস আঠারো দিনের মাথায় অনিন্দ্য সুন্দর এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন সুনীথা, নাম রাখেন বেণ, তার নিত্যদিনের আদর-যত্নে শিশুপুত্র বেণ বেড়ে ওঠে। পুত্রের বিভিন্ন বয়সের স্মৃতি মনে পড়ে সুনীথার।

ছেলেবেলা থেকেই বেণ ডাকাবুকো স্বভাবের, কেউ তাকে এক কিল দিলে সে চার কিল দিয়ে আসত। এজন্য সুনীথাকে কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। বাল্য-কৈশোরে প্রতিদিন বেণের বিরুদ্ধে গণ্ডায় গণ্ডায় অভিযোগ আসত তার স্বামী গোত্রপতি অঙ্গ’র কাছে, তার কাছেও। খেলতে গিয়ে কারো সাথে গণ্ডগোল লাগলে মেরে একদিন কারো হাত ভাঙত তো পরদিন ঘুষি মেরে ভাঙত কারো দাঁত, আরেকদিন হয়ত ফাঁটাত কারো মাথা! একবার এক অনার্য নিষাদ বালককে পর্বতের চূড়া থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল বর্ষাকালের খরস্রোতা সরস্বতী নদীতে, কে জানে সেই বালক বেচারা বেঁচে ফিরতে পেরেছিল কি না! নিত্যদিন বেণের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনতে শুনতে তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনই অতিষ্ট হয়ে যেতেন, শাসনও করতেন বেণকে, দড়ি দিয়ে বৃক্ষের সঙ্গে বেঁধে লাঠি দিয়ে প্রহার করতেন, কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখতেন, কোনোদিন হয়ত রেগে খেতে দিতেন না। কিন্তু কোনো কিছুতেই বেণের দুরন্তপনা কমত না। শাসন করার এক-দুদিন পরই আবার যা তাই! লোকে বলত, ‘গোত্রপতির পুত্র তো, তাই আহ্লাদে অমন করে!’ কেউ বলত, ‘পিতা-মাতা প্রশ্রয় দিয়ে পুত্রকে অমন অশান্ত বানিয়েছে!’ আবার মানুষের বিপদেও সকলের আগে বেণই ঝাঁপিয়ে পড়ত। কারো সন্তান সরস্বতীর স্রোতে ভেসে যেতে দেখলে বেণই সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধার করত, কারো গরু কিংবা ভেড়া বাঘে ধরলে সে-ই সবার আগে ছুটে গিয়ে বাঘকে তাড়া করত। সেই বাল্য-কৈশোরে কিংবা প্রথম যৌবনে পুত্র তাদেরকে জ্বালাতন করত ঠিকই, আবার গর্বিতও করত। মানুষের অভিযোগ শুনে সুনীথা কখনো সখনো প্রহার করেছেন পুত্রকে, কিন্তু মায়ের মন তো, খুব বেশি জোরে প্রহার করতেন না। তবে তার স্বামী অঙ্গ প্রহার আরম্ভ করলে সহজে আর ছাড়তেন না। স্বামীর হাতে পুত্রকে প্রহৃত হতে দেখে কতবার তিনি দৌড়ে গিয়ে পুত্রকে জড়িয়ে ধরেছেন, কতদিন দু-চোখের অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন। রাত্রিবেলা স্বামীকে বোঝাতেন, ‘বড় হলে পুত্রের দুরন্তপনা সেরে যাবে। তুমি এত বেশি প্রহার কোরো না।’

অঙ্গ তখন তাকে ধমকাতেন, ‘তোমার প্রশ্রয় পেয়েই পুত্র এমন বেয়াড়া হয়েছে!’

বেণের দুরন্তপনার জন্য সারাক্ষণ সুনীথাকে দুষতেন অঙ্গ। আজ দিন বদলেছে, পুত্রকে নিয়ে অঙ্গও এখন গর্বিত। স্বামীর পাশে শুয়ে এইসব ভাবতে ভাবতে সুনীথার মনে হয় স্বামী তাকে সারাজীবন খোটা দিয়েছেন, আজ ওকে দু-কথা শুনিয়ে দেওয়া যায়। চিৎ হয়ে ছিলেন সুনীথা, স্বামীর দিকে পাশ ফিরে শুয়ে বলেন, ‘ঘুমোলে?’

সন্ধে থেকে সোমরস পান করেছেন অঙ্গ, নেশা হয়েছিল খুব, তবে এখন নেশা অনেকটাই কেটে গেছে। বলেন, ‘ঘুম আসছে না। মনে হচ্ছে আরেকটু সোমরস পান করা দরকার।’
‘আজ অনেক গিলেছ, আর দরকার নেই।’

‘আমার পুত্র নৃপতি হয়েছে। আজ সোমরস পান না করলে আর কবে করব বলো! আজ তো সোমরসের স্রোতে আমার ভেসে যাওয়া উচিত! আজ আমি ব্রহ্মাবর্তের মানবদের নৃপতির গর্বিত পিতা!’

সুনীথা খোঁচা দেন, ‘ইস, ব্রহ্মাবর্তের মানবদের নৃপতির গর্বিত পিতা! আজ পুত্রকে নিয়ে বড় গর্ব করছ, অথচ বাল্যকালে একটু দুষ্টুমি করলে কী প্রহারই না করেছে! তখন উঠতে-বসতে আমায় কথা শোনাতে, বলতে- তোমার পুত্র এই করেছে, তোমার পুত্র সেই করেছে। আর আজ নৃপতির পিতা হিসেবে বড্ড গর্ব করা হচ্ছে, লজ্জা করছে না তোমার!’

বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন সুনীথা। অঙ্গ বলেন, ‘আহা, কাঁদছ কেন! না হয় বাল্যকালে পুত্রকে একটু বেশিই প্রহার করেছি, সে তো ওকে সু-পথে আনার জন্য, তা বলে এতকাল পর আজ এই আনন্দের দিনে তুমি কাঁদবে নাকি!’

‘পুত্র আমার কী ব্যথাটাই না পেত! আমি যে বলতাম বড় হলে সেরে যাবে, সে-কথা কানে তুলতে না।’

সুনীথার কান্না থামতে চায় না। অঙ্গ স্ত্রীকে বুকে টেনে নেন, বলেন, ‘আজ স্বীকার করছি, আমি পুত্রকে একটু বেশিই প্রহার করেছি। সে-জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু আজ এই আনন্দের দিনে কেঁদে তুমি আমার অপরাধ দ্বিগুণ কোরো না। কেঁদো না আমার ময়নাপাখি।’

সুনীথার কপালে চুম্বন করেন অঙ্গ, মাথায় হাত দিয়ে আদর বুলান। এই আদরে সুনীথার অভিমান গলে জল হয়ে যায়, প্রৌঢ় দম্পতি একে-অন্যকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসায় ভেসে যান।


অনেকক্ষণ পূর্বেই উৎসব অঙ্গন থেকে গৃহে ফিরে শয্যায় শয়ন করলেও ব্রহ্মাবর্তের মহিষী বেণপত্নী হংসপাদার দু-চোখ নিদ্রাহীন, তার দু-পাশে ঘুমিয়ে নেতিয়ে আছে আট বৎসরের পুত্র পৃথু আর তিন বৎসরের কন্যা অর্চি। একবার শয্যা থেকে উঠে তিন চষক মাধ্বী পান করেছেন হংসপাদা, নেশা ধরেছে বেশ কিন্তু নিদ্রার আভাসটুকুও নেই করোটির কন্দরে! তার মনোশ্চক্ষে অনবরত ভাসতে থাকে পতি নৃপতি বেণ আর অপ্সরা সুরোত্তমার নৃত্যের দৃশ্য। এমন নয় যে আর্য পুরুষগণ কেবল একজন নারীতে কিংবা নিজ স্ত্রীতেই আসক্ত, অনেক পুরুষেরই একাধিক স্ত্রী আছে, আবার অনেকের গৃহে একজন স্ত্রী থাকলেও বাইরে তারা অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে। একজন পুরুষের একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকাটা আর্য সমাজে গোপনীয় কিছু নয়, আর্য নারীরাও এটা মেনে নিয়েছে অনেককাল আগে থেকেই। হংসপাদা বেণের একমাত্র স্ত্রী হলেও মাঝে মাঝে বেণ অন্য নারীর সঙ্গ উপভোগ করেন না তেমন নয়। এটা নিয়ে কখনোই হংসপাদার মন খারাপ হয়নি, কেননা শৈশব থেকেই তিনি সমাজের এমন রীতি দেখে আসছেন। তার মাতাকে রেখে তার পিতাও অন্যত্র নারীসঙ্গ করতেন; আর তার ঠাকুরদার তো তিনজন স্ত্রী ছিলেন, এছাড়াও অন্য নারীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না এমন নয়। পুরুষেরা এখন সমাজে যে স্বাধীনতা ভোগ করে, পূর্বে নারীরাও তেমনি সুবিধা ভোগ করত, নারীদের যৌনজীবনও ছিল অবাধ, নারীরা তাদের পছন্দের যে-কোনো পুরুষের সঙ্গে সংসর্গ করতে পারত যদি সেই পুরুষটি রাজি থাকত। নারী-পুরুষ উভয়ের জীবনাচারেই তখন কোনো বন্ধন ছিল না। নারীরা তাদের পছন্দের যে-কোনো পুরুষের ঔরস গর্ভে ধারণ করে সন্তান জন্ম দিতে পারত। নারী-পুরুষ একসঙ্গে জুটি বেঁধে পতি-পত্নীর মতো কিংবা বিবাহ করে পতি-পত্নী হয়ে একই গৃহে থাকত, সন্তান উৎপাদন করত, আবার উভয়েই নিজ সন্তানের পিতা কিংবা মাতা ব্যতিত অন্য নারী বা পুরুষের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হতে পারত। পুরুষ সঙ্গী নারীকে কিংবা নারী সঙ্গী পুরুষকে বাঁধা দিত না। অনেককাল আগে মহর্ষি উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতু নারী-পুরুষের বহুগমনের প্রথা রোধ করে একগমনের প্রথার প্রচলন করেন। একদিন পিতা-মাতার সঙ্গে নিজেদের আশ্রমে ছিলেন শ্বেতকেতু, তখন তার পিতা এবং তার সম্মুখেই এক ব্রাহ্মণ তার মাতার প্রতি কামনায় আসক্ত হয়ে মাতার হাত ধরে জোরপূর্বক নিয়ে যেতে থাকেন সংসর্গের উদ্দেশ্যে, যা দেখে ক্রুদ্ধ হন শ্বেতকেতু। পিতা উদ্দালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি পুত্রকে ক্রুদ্ধ হতে নিষেধ করে জানান যে- ‘ইহা নিত্যধর্ম বৎস, ভূমণ্ডলে স্ত্রীগণ অবারিতা, গো-ধনের ন্যায় স্বাধীন। স্ত্রীগণ স্ব-জাতির শত-সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও অধর্ম হয় না।’

পিতার কথায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি শ্বেতকেতু, পিতা ব্যতিত অন্য পুরুষ তার মাতার সংসর্গ লাভ করবে এটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। এরপর তিনি এই স্বাধীন সঙ্গম প্রথা বন্ধ করতে নিয়ম করেন- যে নারী নিজ পতি ভিন্ন অন্য পুরুষের সঙ্গে সংসর্গ করবে এবং যে পুরুষ নিজ স্ত্রী ব্যতিত অন্য নারীর সঙ্গে সংসর্গ করবে, তাদের ভ্রূণহত্যার পাপ হবে।

শ্বেতকেতুর এই সামাজিক বন্ধন নারীকে বাঁধতে পারলেও পুরুষকে আর বাঁধতে পারল কোথায়! অধিকাংশ পুরুষ সেই আগের মতোই আছে, তারা একাধিক নারীতে আসক্ত। পুরুষ শাসিত আর্য সমাজের পুরুষরা পূর্বের মতোই অবাধ যৌন স্বাধীনতা ভোগ করে, কিন্তু পুরুষেরা নারীর যৌন স্বাধীনতা আর ফিরিয়ে দেয়নি! অবশ্য এরপরও কিছু কিছু বিবাহিত নারী যে এই সামাজিক বন্ধন ছিন্ন করে অন্য পুরুষের সঙ্গে সংসর্গ করেনি তা নয়, কিন্তু তা গোপনে, সমাজের চোখের আড়ালে।

পতির বহুগমন অন্য পাঁচজন আর্য নারীর মতো হংসপাদাও মেনে নিয়েছেন, তবু তার হৃদয়াকাশ আজ বিষন্নতার ঘন কৃষ্ণ মেঘে আচ্ছন্ন। আজ তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন, তার পতি ব্রহ্মাবর্তের নৃপতি হয়েছেন, তিনি হয়েছেন মহিষী, অথচ এমন আনন্দের দিনে পতিকে একটু সময়ের জন্যও নিরলে নিজের কাছে পেলেন না। তিনি ভেবেছিলেন উৎসব শেষে রাত্রে পতিকে নিজের কাছে পাবেন, কিন্তু অপরাহ্ণে সাংস্কৃতিক উৎসব শুরুর পর বেণ তাকে জানান যে তিনি অপ্সরা সুরোত্তমাকে নিয়ে নতুন গৃহে রাত্রিযাপন করবেন।
তখন থেকেই বুকের ভেতরে কেমন শূন্যতা অনুভব করতে থাকেন হংসপাদা, আর রাত্রের সাংস্কৃতিক উৎসবে সুরোত্তমার সঙ্গে বেণের নৃত্য করার সময় সেই শূন্যতার হাহাকারের তীব্রতা যেন আরো বহুগুণ বেড়ে যায়! সারাদিনের উৎসব-আনন্দ হঠাৎ ম্লান হয়ে যায় যেন, অনেক পাওয়ার দিনেও পতিকে কাছে না পাওয়ার ব্যথা উদগ্র হয়ে ভীষণ কান্না পায় তার।


নিত্যদিনের মতোই প্রভাতে সর্যোদয়ের পূর্বেই নিদ্রা ভঙ্গ হয় নতুন নৃপতি বেণের, বাইরে থেকে কানে ভেসে আসে পাখির কলকাকলি, তিনি চোখ খোলেন ঠিকই কিন্তু রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি এখনো জড়িয়ে আছে চোখে। বাইরে আলো ফুটলেও গৃহাভ্যন্তরে অন্ধকার। ভেড়ার লোমে বোনা মোটা চাদরের নিচে উদোম অঙ্গে শুয়ে আছেন বেণ আর অপ্সরা সুরোত্তমা; বেণের বাম বাহুর ওপরে মাথা আর ভাঁজ করা বাম পা বেণের ঊরুর ওপরে রেখে বুকে লেপটে ঘুমিয়ে আছেন সুরোত্তমা, তার এলোমেলো কেশদাম ছড়িয়ে আছে বেণের বুকে-বাহুতে। বেণ ডানহাত দিয়ে বাতায়নের পর্দা তুলে দিলে প্রভাতের ললিত আলোয় ভাস্বর হয়ে ওঠে দুজনের মুখমণ্ডল। বেণ নিজের বুকের সাথে লেপটে থাকা সুরোত্তমার মুখশ্রীর দিকে তাকান, বিস্রস্ত কেশদামে সন্তর্পণে আদুরে হাত বোলান, কপালে আলতো চুম্বন করেন, কেশের গন্ধ নেন। তাঁর মনশ্চক্ষে রাত্রের কামকলার দৃশ্য ভেসে উঠলে তিনি দারুণ প্রশান্তি অনুভব করেন আর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে- কামকলায় ব্রহ্মাবর্তের নারীদের তুলনায় স্বর্গের অপ্সরারা অধিক দক্ষ; একজন অপ্সরা যতটা শারীরিক সুখ পুরুষকে দিতে পারেন, ব্রহ্মাবর্তের নারীদের পক্ষে ততটা সুখ দেওয়া সম্ভব নয়। সুরোত্তমা কামকলার অনেক রকম কৌশল জানেন, একের পর এক কৌশল প্রয়োগ করে পুরুষকে নিঙড়ে কামরস শুষে নেন, তবু ক্লান্ত হন না। বেণের মনে বাসনা জাগে, সুরোত্তমা যদি চিরকাল তাঁর কাছেই থেকে যেতেন, কী ভালোই না হতো! কিন্তু সুরোত্তমা খুব বেশিদিন এখানে থাকবেন না তা তিনি জানেন, দু-চারটি ব্যতিক্রম বাদে হৃদয় উজার করা ভালবাসা দিয়েও ব্রহ্মাবর্তের মানুষ অপ্সরাদের বেঁধে রাখতে পারে না। তবে তিনি অনুনয়-বিনয় করে, ভালোবাসায় ভুলিয়ে যতোদিন পারেন সুরোত্তমাকে রেখে দেবেন বহির্ষ্মতীতে।

আবারও সুরোত্তমার কেশে নাক গুঁজে ঘ্রাণ নেন বেণ, কপালে পুনরায় আলতো চুম্বন করেন, তারপর সন্তর্পণে নিজের বাহুর ওপর থেকে সুরোত্তমার মাথাটা উপাধানে নামিয়ে রেখে শয্যায় উঠে বসেন। দক্ষিণের বাতায়ন দিয়ে বাইরে তাকালে তাঁর চোখে পড়ে বিভীদক বৃক্ষের শাখায় একটা খয়েরি ডানা পাপিয়ার চঞ্চলতা, তিনি মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকেন পাপিয়া এবং বাইরের প্রকৃতির দিকে। আজকের প্রভাতও নিত্যদিনের মতোই একইরকম, তবু তাঁর কাছে অন্যরকম লাগে, এতদিন তিনি প্রভাত দেখতেন গোত্রপতির পুত্রের চোখে, আর আজ দেখছেন সমগ্র ব্রহ্মাবর্তের নৃপতির চোখে, তাই আজকের প্রভাতটা তার কাছে অধিক সুন্দর ও মায়াবী মনে হয়।

তিনি শয্যা থেকে উঠে গৃহকোনে ঝুলিয়ে রাখা ধূসর রঙের গরুর চামড়ার পুরোনো বাস পরিধান করেন, নিবি জড়ান গায়ে। বসন্তকাল হলেও এখনো বেশ শীত, দিনে কম হলেও সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে শীত পড়তে শুরু করে আর রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেঁকে বসে, সারারাত্রি শিশির পড়ে, বৃক্ষপত্রে আর ঘাসে শিশির জমে থাকে সকালে সূর্য শাসন না করা পর্যন্ত।

বাতায়ন ভেদ করে আসা মৃদু আলোয় গৃহের চতুর্দিকে দৃষ্টি বোলান বেণ, আজই প্রথম রাত্রিযাপন করলেন এই গৃহে, গৃহটি খুব পছন্দ হয়েছে তাঁর। নতুন নৃপতির জন্য বানর শ্রমিকদের দিয়ে দুটি নতুন গৃহ নির্মাণ করিয়ে দিয়েছে গোত্রের মানুষেরা, গৃহদুটি পূর্বমুখী আর একটির থেকে আরেকটি কিছুটা দূরত্বে অবস্থিত, প্রত্যেক গৃহে দুটি করে কক্ষ, দক্ষিণের গৃহের এক কক্ষে এখন তিনি ও সুরোত্তমা অবস্থান করছেন আর অন্য কক্ষে ঋষি অত্রি আছেন; উত্তরের গৃহের দুটি কক্ষে শয়ন করেছেন দেবতা ও অপ্সরাগণ।

গৃহাভ্যন্তর এখনো ভালো করে সাজানো-গোছানো হয়নি; গৃহের দক্ষিণদিকে শয্যা পাতা যেখানে এখন অবোধ বালিকার মতো ঘুমোচ্ছেন সুরোত্তমা গরুর চামড়ার আচ্ছাদনের ভেতরে ভেড়ার লোম ঢুকিয়ে বানানো আরামদায়ক উপাধানে মাথা রেখে। পশ্চিম দিকে জলের পাত্র এবং প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস। উত্তরদিকের রজ্জুতে ঝোলানো বেণ আর সুরোত্তমার কয়েক প্রস্ত পরিচ্ছদ। পুরোনো গৃহ থেকে এখনো জিনিসপত্র আনা হয়নি নতুন গৃহে, স্বর্গের অতিথিগণ ফিরে গেলে হংসপাদা যখন পুত্র-কন্যাকে নিয়ে এই গৃহে উঠবেন তখন জিনিসপত্র আনা হবে।

গৃহের দ্বার সরিয়ে পাদুকা পায়ে গলিয়ে বাইরের প্রশস্ত আঙিনায় এসে দাঁড়ান নৃপতি বেণ। শরীরের আড়মোড়া ভাঙেন, লম্বা-সুঠাম শরীর তার, মাখনের ন্যায় শরীরের রঙ, রূপে ও গুণে সুপুরুষ তিনি। উত্তরের যে গৃহে দেবগণ ও অপ্সরারা শয়ন করেছেন সেদিকে তাকান, তারা এখনো ঘুম থেকে ওঠেননি।

গৃহ দুটি গোত্রের অন্যদের গৃহের চেয়ে বেশ বড়, গোত্রের প্রধান পুরোহিত উদয়গিরির শাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী গৃহ দুটি পূর্বমুখী করে নির্মাণ করা হয়েছে, শাস্ত্রমতে পূর্বদিককে অত্যন্ত শক্তিশালী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পূর্বদিকের অধিদেবতা হচ্ছেন ইন্দ্র এবং সূর্য; ইন্দ্র বৃষ্টি, প্রতিপত্তি, উৎসব ও শক্তির দেবতা; আর সূর্যদেব জগতের সকল শক্তির উৎস, তিনি অন্ধকারকে নাশ করেন। সূর্যের প্রভাবে জীবনে উন্নতি হয়, তাই পূর্বদিককে উন্নতির দিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন মুনিগণ।



(চলবে....)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১:৪৭

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর ঝরঝরে লেখা।

০৬ ই অক্টোবর, ২০২২ রাত ১:০৩

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.