নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব- নয়)

১০ ই অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১২:১০

পাঁচ

সরস্বতী নদীর পারে দাউ দাউ করে চিতা জ্বলতে থাকে, তিনজন মধ্যবয়সী পুরুষ দাহকার্য পরিচালনায় ব্যস্ত। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন মানুষ অল্প দূরে শাল্মলী বৃক্ষের তলায় বসে কেউ কথায় মত্ত, কেউ-বা মৌন; কেবল দিবনেশ কাঁদতে কাঁদতে প্রলাপ বকতে থাকেন। এদের মধ্যে নৃপতি বেণকেও দেখা যায়, তিনি মৌন হয়ে চিতার আগুনের দিকে তাকিয়ে আছেন। সেদিন তিনি শিকার থেকে গৃহে ফেরার পথে জানতে পারেন যে দিবনেশের চৌদ্দ বছরের পুত্র অনিমেষকে বাঘে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। অনিমেষ বন্ধুদের সঙ্গে সরস্বতীর পারে খেলা করছিল, খেলতে খেলতে মনের খেয়ালে সবাই মিলে অরণ্যে চলে যায় ফল পাড়তে, ফেরার পথে অকস্যাৎ অনিমেষের ওপর বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাকে অরণ্যের গভীরের দিকে টেনে নিয়ে যায়। অনিমেষের বন্ধুরা তখন চিৎকার করতে থাকে, অরণ্যে তখন একদল মৌয়াল মৌচাক ভাঙছিল, চিৎকার শুনে তারা ছুটে গিয়ে যখন জানতে পারে যে অনিমেষকে বাঘে ধরে নিয়ে গেছে, তখন তারা লাঠি-সোটা নিয়ে বাঘের পিছু নেয়, কিছু দূর যাবার পর বাঘের মুখে অনিমেষেকে দেখতে পায় মৌয়ালরা, তারা বাঘকে তাড়া করলে বাঘ মুখ থেকে অনিমেষেকে ফেলে পালিয়ে যায়। অনিমেষ তখনও বেঁচে ছিল, ঘাড়ে বাঘের দাঁতের গভীর ক্ষত হয়েছিল আর সারা শরীর অরণ্যের লতাগুল্ম ও কাঁটায় ছড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছিল প্রচুর। মৌয়ালরা ক্ষত-বিক্ষত অনিমেষকে বহির্ষ্মতীতে নিয়ে আসে, বদ্যিকে খবর দেওয়া হয়। বদ্যি নানারকম লতা-পাতা দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন, ছয়দিন চিকিৎসার পর আজ সকালে অনিমেষের প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়। অনিমেষ এখন জ্বলন্ত চিতায়।

দিবনেশের চারটি সন্তানের মধ্যে অনিমেষই ছিল একমাত্র পুত্র, বাকি তিনজন কন্যা। একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন দিবনেশ। সেদিন তিনিও বেণের সঙ্গে শিকারে গিয়েছিলেন, বহির্ষ্মতীতে ফিরে পুত্রকে বাঘে ধরে নিয়ে যাবার দুঃসংবাদ শুনে তিনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, মাথায় জল ঢেলে, চোখে-মুখে জলের ঝাঁপটা দিয়ে তার জ্ঞান ফেরানো হয়। আজ সকালে একমাত্র পুত্রকে হারাবার পর থেকে দিবনেশ পাগলের ন্যায় প্রলাপ বকছেন আর আর্তনাদ করছেন।

যুদ্ধ ছাড়াও প্রায়ই অপঘাতে মৃত্যু হয় আর্যদের; শিকারে গেলে, পশু চরাতে গেলে, ভূমি চাষ কিংবা যব কাটতে গেলে প্রায়ই তাদেরকে বাঘে কিংবা ভাল্লুকে ধরে নিয়ে যায়, সাপে কাটে কিংবা পাগলা হাতি আক্রমণ করে। পশু চরানোর সময় সুযোগ বুঝে পশুকেও আক্রমণ করে বাঘ। বেণ নৃপতি হবার পর এই প্রথম গ্রামের কারো প্রাণ গেল বাঘের আক্রমণের কারণে, তার ওপর দিবনেশের পুত্রটি একেবারে অল্প বয়সী কিশোর, সঙ্গত কারণেই তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে। নৃপতি হিসেবে বেণ চান না যে তাঁর কোনো প্রজার অপঘাতে মৃত্যু হোক, তাই তিনি সবাইকেই সতর্ক করেন, অল্প বয়সীদের বহির্ষ্মতীর বাইরে যেতে নিষেধ করেন, পূর্ণ বয়স্ক পুরুষদের দলবদ্ধ হয়ে বাইরে যাবার পরামর্শ দেন। নিজে নৃপতি হবার আগেও তিনি এমন পরামর্শ দিতেন। কিন্তু কিশোরেরা বয়সের দূরন্তপনার কারণেই সর্বদা কথা শোনে না, তারা ফলের লোভে কিংবা বনরুই বা খরগোশ ধরার লোভে প্রায়ই অরণ্যে চলে যায়। বনরুই কিংবা খরগোশ পেলে সকলে মিলে সরস্বতীর পারে পুড়িয়ে খায়। আবার বেপরোয়া হয়ে সরস্বতী নদীতে সাঁতার কাটতে কাটতে অনেক দূর অবধি চলে যায়, এইতো গত বর্ষায় নলেশের পুত্রটি স্রোতে ভেসে গিয়েছে।

দাহকার্য শেষ হলে শ্মশানযাত্রীরা সরস্বতী নদীতে স্নান করে গৃহে ফেরে। অপঘাতে মৃত্যু আর্যদের কাছে দূর্লভ কিছু না হলেও সারা বহির্ষ্মতী আজ ব্যথিত, নিত্যদিনের মতো হইচই নেই, যেন নীরবতার চাদরে আবৃত! অনিমেষ ছিল এক প্রাণোচ্ছ্বল কিশোর, সকলেই তাকে ভালবাসত, সকলেরই হৃদয় আজ শোকাচ্ছন্ন। যদিও আর্যদের কাছে শোক কোনো স্থায়ী বিষয় নয়, রাত পেরোলেই তারা নিত্যদিনের কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, সন্ধ্যা হলে নৃত্য-গীত করে, মদ্যপান করে, শোক থিতিয়ে যায়। আবার হয়ত কিছুদিন পর বাঘের হামলায় কিংবা সাপের ছোবলে কেউ মারা যাবে, আবার দাউ দাউ করে চিতা জ্বলবে সরস্বতীর পারে, আর আজকের মতোই ঘন কৃষ্ণ মেঘের ন্যায় শোক গ্রাস করবে সারা বহির্ষ্মতীকে, তারপর আবার মেঘের মতোই শোক উড়ে যাবে বাতাসের তোড়ের মতো দিন যাপনের কোলাহলে।


‘হা হা হা……ও মাতা গো, হা হা হা…..আমার শরীর শিরশির করছে, মাথার মধ্যে কেমন যেন করছে! ধীরে প্রিয়তম, আরো ধীরে যাও, পড়ে যাব তো!’ প্রায় চিৎকার করে বলেন সুরোত্তমা।

‘ভয় পেয়ে না প্রিয়তমা, তুমি আমার বাহুডোরে আবদ্ধ আছো, কিছুতেই তোমাকে ভূপতিত হতে দেব না।’ সুরোত্তমাকে নিজের প্রিয় শ্বেত অশ্বের পিঠে আরোহণ করিয়ে সরস্বতী নদীর পার দিয়ে তুমুল বেগে ছুটতে ছুটতে বলেন বেণ।

‘যদি দুজনই পড়ে যাই, পাথরে মাথা ফেটে মরব যে!’
‘তোমার সঙ্গে মরেও আমি সুখী হবো প্রিয়তমা!’ হাসতে হাসতে বলেন বেণ, অশ্বের গতিও কিছুটা কমান।

সুরোত্তমা ঘাড় ফিরিয়ে বেণের গালে চুম্বন করে বলেন, ‘সত্যি বলছি, তুমি অন্যরকম পুরুষ, নৃপতিসুলভ দম্ভ তোমার নেই!’
বেণ সুরোত্তমার গালে গাল রেখে বলেন, ‘দম্ভ তো থাকে সংকীর্ণমনা মানুষদের।’
‘ঠিক বলেছ প্রিয়তম।’

বেণ সুরোত্তমাকে নিয়ে যাচ্ছেন বহির্ষ্মতী থেকে বেশ দূরের একটা ঝরনা দেখাতে, অশ্বের গতি আরো কমিয়ে সরস্বতীর তীর ছেড়ে প্রবেশ করেন অরণ্যে, অরণ্যের ভেতরের পায়ে চলা পথে দুলকি চালে এগোতে থাকে অশ্ব। অশ্বের পায়ের নিচে শুকনো পাতা মর্মর ধ্বনি তোলে, ঝিঁঝিপোকা আর পাখ-পাখালির ডাক ভেসে আসে কানে।

সুরোত্তমা বলেন, ‘প্রিয়তম, আমরা যদি কোনো বন্যপ্রাণির সামনে পড়ে যাই, আর ওরা যদি আমাদেরকে আক্রমণ করে!’
‘আমি সঙ্গে আছি কী করতে, বন্যপ্রাণি আমাদের আক্রমণ করার আগেই আমি ওদের বুকে তরবারি গেঁথে দেব!’

পথ একে-বেঁকে কখনো উপর দিকে উঠে গেছে, আবার কখনো নিচের দিকে। গহীন অরণ্য, বিশাল বিশাল বৃক্ষ, কোথাও কোথাও শত-সহস্র বুনো লতা লতিয়ে লতিয়ে বিশাল বৃক্ষের মগডালের মাথায় এমনভাবে বিস্তার লাভ করেছে যে তা ভেদ করে তলায় সূর্যের আলো পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না ভূমিতে। একটানা অনেকক্ষণ আঁকা-বাঁকা আর চড়াই-উৎরাই পথ পেরিয়ে অনেকটা উঁচুতে উঠার পর একটা টিলার উপর থেকে নিচের দিকে আঙুল দিয়ে সুরোত্তমাকে দেখিয়ে বেণ বলেন, ‘ওই দেখ আমাদের বহির্ষ্মতী।’

সুরোত্তমা নিচের দিকে তাকিয়ে গাছপালাবেষ্টিত ছোট ছোট গৃহগুলো লক্ষ্য করে বলেন, ‘আমরা এত পথ এলাম, অথচ মনে হচ্ছে এখান থেকে বহির্ষ্মতী বেশি দূরে নয়। ঝরনা আর কত দূরে প্রিয়?’

‘যতটা পথ এসেছি, আরো এতটা।’
আবার অশ্বকে তাড়া দেন বেণ। কিছুদূর যাবার পর সুরোত্তমা হঠাৎ চিৎকার করে ঘাড় ফিরিয়ে বেণের বুকে মুখ গোঁজেন।
‘কী হলো?’ বেণ জিজ্ঞাসা করেন।
‘অজগর।’

বেণ সামনের দিকে পথের ডানপাশে ঘাস-লতাপাতার মধ্যে তাকিয়ে দেখেন একটা বিরাটাকার সবুজ-বাদামী রঙের অজগর একটা সাদা রঙের বন্য শুকর পেচিয়ে শুকরের মাথাটা মুখে ঢুকিয়ে আছে, ধীরে ধীরে গিলছে শুকরটিকে।

বেণ বলেন, ‘ভয় নেই, ও আহার পেয়েছে, আমাদের কিছু বলবে না।’

বেণ আবার জোরে অশ্ব ছোটান, সুরোত্তমার কেশ বাতাসে উড়ে বারবার তাঁর মুখে লাগে, তিনি দুষ্টুমি করে কখনো চুলের গোছা দুই ঠোঁটের মাঝে আটকে ধরেন, কখনো নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়ি দিয়ে সুরোত্তমার কাঁধে সুড়সুড়ি দেন, আবার কখনো-বা আনন্দের আতিশয্যে অকারণে চিৎকার করে ওঠেন। আরো কিছুদূর চড়াই-উৎরাই পার হবার পর দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ জলের ঝিরির সামনে অশ্ব থামে। সুরোত্তমা বলেন, ‘কী সুন্দর স্বচ্ছ জলের ঝিরি, দেখলেই স্নান করতে ইচ্ছে করে!’

বেণ বলেন, ‘ঝিরি দেখেই যদি স্নান করতে ইচ্ছে করে, তাহলে ঝরনা দেখে কী করবে!’
‘নৃত্য করব, হি হি হি…! আর কত দূর প্রিয়?’
‘এইতো, এই ঝিরি ধরে কিছুদূর এগোলেই ঝরনা। এখন আমাদের নেমে হেঁটে যেতে হবে প্রিয়তমা।’

বেণ অশ্ব থেকে নেমে সুরোত্তমাকে কোলে তুলে ভূমিতে নামিয়ে দেন, তারপর দুজনই ঝিরির মধ্য দিয়ে হাঁটতে শুরু করেন, বেণের ডান হাতে সুরোত্তমার হাত আর বাম হাতে অশ্বের রজ্জু। হাঁটুরও কম জলের মধ্য দিয়ে কিছুদূর এগাতেই কানে ভেসে আসে ঝরনার জল পড়ার শব্দ, ঝিরির মধ্যে ছোট-বড় নানা আকৃতির অসংখ্য পাথর, কোথাও কোথাও নানা প্রকার বৃক্ষ আর লতা ঝিরির ওপর এমনভাবে ঝুঁকে আছে যেনবা নত হয়ে আগন্তুকদের সম্মান জানাচ্ছে! আরো কিছুদূর এগোনোর পর অরণ্যের মাঝে দৃশ্যমান হয় রূপসী ঝরনা। সুরোত্তমা উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন, ‘কী অসম্ভব সুন্দর! প্রিয়তম তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে এখানে নিয়ে আসবার জন্য।’

বলেই ঘাড় ফিরিয়ে বেণের গালে চুম্বন করেন। বেণ হেসে বলেন, ‘আমি জানতাম এই ঝরনা তোমার ভালো লাগবে, তাই তো তোমাকে এখানে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছি।’

ঝরনাটির উচ্চতা অনেক, প্রশস্তও বেশ, এখন বর্ষাকাল না হলেও জলের তীব্রতা মন্দ নয়। তিনদিকে উঁচু পাথুরে পাহাড়, তারই মাঝে এই পাহাড়ীকন্যা ঝরনা দেবী সরস্বতীর হাতের বীণার মতো নিরন্তর জলধ্বনি তুলছে যেন। দীর্ঘকাল যাবৎ ঝরনার জল পড়ে নিচে বেশ একটা সরোবরের মতো সৃষ্টি হয়েছে, আর সরোবর থেকে জলের স্রোতধারা নামতে নামতেই জন্ম হয়েছে ঝিরির। এখানে চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ছোট-বড় অজস্র পাথর। বেণ নিজের কাঁধ থেকে স্নানের পর পরিধান করার জন্য পরিচ্ছদের পোটলা, ধনুক আর তীর ভর্তি তূণ নামিয়ে রাখেন একটা বড় পাথরের ওপর। তারপর অশ্বটিকে একটা বৃক্ষের সঙ্গে বেঁধে কোমর থেকে তরবারি খুলে আরেকটি পাথরের ওপর রাখেন। সুরোত্তমা একটা পাথরের ওপর বসে জলে পা ডুবিয়ে রাখেন, বেণ জলের কাছে গিয়ে আঁজলায় ভরে জল পান করার পর দুষ্টুমি করে সুরোত্তমার দিকে জলের ছিটা মারেন। সুরোত্তমা দু-হাত বাড়িয়ে জল আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে পরক্ষেণেই শরীরে জলের স্পর্শ পেয়ে আশ্চর্য রকমের অঙ্গভঙ্গি করেন যা বেণের সুপ্ত কামনায় টঙ্কার তোলে! বেণ ছোট ছোট পাথর ডিঙিয়ে এগিয়ে যান সুরোত্তমার কাছে, সুরোত্তমার অঙ্গের উত্তরীয় দু-হাতে ধরে ঘ্রাণ নিয়ে ভেজা হাত মোছেন, সম্পূর্ণ উত্তরীয়খানা নিজের দু-হাতের মুঠোয় নিতেই সুরোত্তমা দুষ্টুমির ছলে পাথর থেকে উঠে দৌড়ে দূরে সরে গেলে বেণ ধাওয়া করে ধরে ফেলেন তাকে। নিজের অঙ্গের সঙ্গে চেপে ধরে বেণ অপলক চোখে চেয়ে থাকেন সুরোত্তমার চোখের দিকে, তারপর সুরোত্তমার মুখখানা নিজের দু-হাতে ধরে নিজেরই ছিটিয়ে দেওয়া সুরোত্তমার কপোলের জলের ফোঁটার কাছে ঠোঁট নিয়ে আলতোভাবে স্পর্শ করে জল শুষে নেন, জিভ দিয়ে চাটেন। সুরোত্তমা লাস্যময় হাসি দিয়ে বেণকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরেন বুকে মাথা রেখে।


বৃক্ষের অনেক ওপর থেকে কমলা বুক হরিয়ালের একটা খসে পড়া পালক বাতাসে ভাসতে ভাসতে আর বৃক্ষের পাতায় আর লতার স্পর্শ পেতে পেতে জলের মধ্যে পড়ে; ঝরনার জল পড়ার ঢেউয়ে দোল খেতে খেতে পালকটি কূলের দিকে যেতে থাকে, তারপর কূলের দিক থেকে আসা ঢেউয়েও বাধাপ্রাপ্ত হয়, দু-দিকের ঢেউয়ে পালকটি প্রায় একই জায়গায় দুলতে থাকে। অনেকক্ষণ পরে কূলের দিকের জলের ঢেউ থেমে যায়, দুটো নগ্ন ক্লান্ত শরীর অল্প জলে ডোবা সমতল মতো পাথরের ওপর শুয়ে পড়ে পাশাপাশি চিৎ হয়ে; একজন তাকিয়ে থাকে ওপরের গাছপালার দিকে, আরেকজনের চোখ নিমীলিত; দুজনেই মৌন, কেবল দুজনের বিলম্বিত শ্বাস-প্রশ্বসের শব্দ শোনা যায়, ঝরনার জলধ্বনি, ঝিঁঝি আর পাখ-পাখালির ডাক শোনা যায়। ঝরনার জলকণা বাতাসে ভেসে এসে ছোঁয় দুজনের অনাবৃত অঙ্গ।

অনেকক্ষণ পর মৌনতা ভেঙে সুরোত্তমা বলেন, ‘কেমন শরীর ছমছম করা অদ্ভুত নির্জনতা, তাই না?’
‘হুম। তোমার ভালো লাগছে?’ জানতে চান বেণ।
‘হ্যাঁ, খুব। নির্জনতা আমার খুব ভালো লাগে।’
‘আমার এত নির্জনতা সহ্য হয় না, দম আটকে আসে! আমার চাই কোলাহল, প্রাণবন্ত হইচই।’
‘তোমরা সব পুরুষরাই কারণে-অকারণে হইচই পছন্দ করো।’
‘আমার জীবনে আমি কেবল একজন পুরুষকে দেখেছি যে তোমার মতো নির্জনতা প্রিয়।’
‘নিশ্চয় তিনি তোমার সখা কুথান?’
‘ঠিক ধরেছ।’

‘আর কিছুদিন পরই আমরা স্বর্গে ফিরে যাব, তোমার সখার সঙ্গে মনে হয় দেখা হবে না আমার।’
‘তার দেখা পাওয়ার চেয়ে চাঁদ হাতে পাওয়াও সহজ, কোথায় কোন অতলে না পাতালে পড়ে আছে কে জানে!’
‘তুমি পাতালে গিয়েছে?’
‘হ্যাঁ, কুথানের সঙ্গে একবার গিয়েছি।’
‘পাতাল এখান কত দূরে?’
‘অনেক দূরে। সেখানে কোনো আর্যজন বাস করে না; অনার্য পণি, অজ, রাক্ষস, বানর ইত্যাদি জাতির বসতি।’
‘শুনেছি ব্রহ্মাবর্তেও নাকি এখনো অনেক অনার্য জাতি বাস করে?’

‘ঠিকই শুনেছ তুমি। সরস্বতী নদীর একটু ভাটির দিকে ব্রহ্মাবর্তের ভূমিতে এখনো কিছু অনার্য পণি, রাক্ষস, বানরদের বসতি রয়েছে। এমনকি সরস্বতী নদীর উজানের দিকের উচ্চর্ভূমিতে এখনো কিছু অনার্য বসতি আছে। উত্তরের দিকের অরণ্যেও কয়েকটি অনার্য বসতি রয়েছে। দেবপতি ইন্দ্র সরস্বতীকে কলঙ্কমুক্ত করতে এইসব অনার্যদের বসতি ধ্বংস করতে চান, আমাকেও তেমনই বার্তা পাঠিয়েছেন।’
‘রাক্ষস-বানররা দেখতে কেমন?’

‘তারা দেখতে রাত্রির মতো কৃষ্ণবর্ণ, বেঁটে, কোনো কোনো গোষ্ঠীর চ্যাপটা নাক, কুৎসিত দর্শন আর ভীষণ বর্বর।’
‘পূর্বে যিনি নারদ ছিলেন, আমি তার মুখে শুনেছি যে অনার্যদের জনপদ আর গৃহ অনেক সুন্দর।’
‘ঠিকই শুনেছ তুমি, গৃহ নির্মাণে অনার্যরা নিপুণ, বিশেষত বানরজাতি। পাথর, মৃত্তিকার তৈরি ইট, কাদা, বাঁশ, কাঠ, খড় ইত্যাদি দিয়ে বড় মনোরম গৃহ নির্মাণ করতে পারে ওরা।’

অনেকদিন বাদে পাতালে যাবার সেই স্মৃতি মনে পড়ে বেণের, কুথান আর তিনি কিছু গবাদীপশু নিয়ে এক শীতকালের শেষদিকে যাত্রা শুরু করেছিলেন পাতালের উদ্দেশে। নিজেদের আরোহণের দুটো অশ্ব ব্যতিত পথে পথে অনার্যদের কাছে পশুগুলো বিক্রি করে ধাতুর মুদ্রা সংগ্রহ করেন তারা। পূর্বে পাতাল ভ্রমণের কারণে কুথান ধাতুর মুদ্রার সঙ্গে পরিচিত থাকলেও বেণ সে-বারই প্রথম দেখেন আর বিস্ময় বনে যান! ছোট্ট গোলাকার একপ্রকার ধাতুখণ্ডের নাম মুদ্রা; পণিসহ কিছু অনার্য জাতি এই মুদ্রার বিনিময়ে সকল প্রকার পণ্যের বিনিময় করে থাকে, এই ধাতুখণ্ডের ওজন এবং মূল্য নির্ধারণ করা থাকে। শুধুমাত্র পণ্য বিনিময় নয়, যে-কোনো প্রকার সেবাও পাওয়া যায় মুদ্রার বিনিময়ে। পণিজাতি-ই প্রথম ধাতুখণ্ডের মাধ্যমে পণ্য বিনিময়ের প্রচলন করে। পরে তাদের দেখাদেখি অন্যান্য অনার্য জাতিও পণ্য বিনিময়ে ধাতুখণ্ডের ব্যবহার শুরু করে। প্রথমদিকে ধাতুখণ্ড সমতল থাকলেও এখন ধাতুখণ্ডের ওপর প্রাণির চিত্র এবং অনার্য ভাষার লিপি ক্ষোদন করা হয়।

বেণ এবং কুথান সে-বার পাতালের উলুকপুর নামক এক নগরে গিয়েছিলেন, মুদ্রার বিনিময়ে উঠেছিলেন এক অতিথিশালায়। উলুকপুর নগর দেখে মুগ্ধ হন বেণ। পণি, বানর, অজ, অসুর নানান জাতির অনার্যদের বাস সেই নগরে। বানররা মৃত্তিকা মন্থন করে কাঠের চৌকো ছোট ছাঁচে ঢেলে ইট তৈরি করে ভালো করে রোদ্রে শুকায়, তারপর আঠালো কাদা দিয়ে সেই ইট একটার পর একটা গেঁথে গৃহের প্রাচীর তৈরি করে। গৃহের ওপরে কাঠের ছাদ কিংবা ছনের ছাউনি দেয়। নগরে পথের দু-ধারে এরকম সারি সারি সুদৃশ্য গৃহ। আর সমগ্র নগরটি ইটের উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, যাতে সহজে তাদেরকে কেউ আক্রমণ করতে না পারে। বেণ উলুকপুরের হাট থেকে ধাতুর তৈরি তীর-ধুনুক, বর্শা, কিছু বাসনপত্র আর মাতা এবং স্ত্রীর জন্য গহনা ক্রয় করে করেছিলেন।

ধাতুর তৈরি আশ্চর্য সব নকশার গহনার কথা শুনে সুরোত্তমা বলেন, ‘আমি সেই আশ্চর্য নগর উলুকপুরে যেতে চাই প্রিয়তম। আমায় নিয়ে যাবে তুমি?’

‘তোমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া বিপদজনক হতে পারে। অনার্যজাতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো নয়, অনেকবার ওদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়েছে, যুদ্ধে হেরে অনেক অনার্য জাতি ব্রহ্মাবর্ত ছেড়ে পাতালে বসতি গড়েছে।’

‘আমরা তো যুদ্ধ করতে যাব না, ভ্রমণ করতে যাব, তাহলে ওরা আমাদের ক্ষতি করবে কেন?’
‘অতীতে আমরা ওদের অনেক ক্ষতি করেছি, ব্রহ্মাবর্ত থেকে উৎখাত করেছি, সুযোগ পেলে ওরা আমাদের ছেড়ে দেবে না।’

‘পাতালে না নিতে চাইলে ব্রহ্মাবর্তেরই কোনো অনার্য নগরীতে আমায় নিয়ে চলো, এবার ব্রহ্মাবর্তে এসেছি ইন্দ্রদেবের নির্দেশে, পথও ভীষণ দূর্গম, আর হয়ত কোনোদিন আসা হবে না। দয়া করে আমায় নিরাশ কোরো না প্রিয়তম।’

‘ব্রহ্মাবর্তে কোনো অনার্য নগরী নেই, সবই পল্লী বসতি। আমায় তুমি ক্ষমা করো প্রিয়তমা। তোমাকে অনার্য বসতিতে নিয়ে গিয়ে কোনো দূর্ঘটনার কবলে পড়লে দেবপতি ইন্দ্র আমায় ভর্ৎসনা করবেন। তুমি আমার অতিথি, তোমার কোনো বিপদ হোক তা আমি চাই না। মাঝে মাঝে কিছু পণি বণিক পাতাল থেকে নানা দ্রব্য ক্রয় করে এনে ব্রহ্মাবর্তের বিভিন্ন আর্য এবং অনার্য বসতিতে বিক্রয় করে। আমি কোনো বণিককে দিয়ে তোমার জন্য গহনা আনিয়ে দেব।’
‘সত্যি আনিয়ে দেবে?’
‘নিশ্চয়।’

সুরোত্তমা বামহাতে ভর দিয়ে শায়িত অবস্থা থেকে উঠে বেণের কপালে চুম্বন করেন, সুরোত্তমার ভেজা কেশের জল গড়িয়ে পড়ে বেণের মুখে, বেণ সুরোত্তমাকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে খুনসুটি করতে থাকেন।

সুরোত্তমা বলেন, ‘এই চলো স্নান সেরে উঠে পড়ি, দীর্ঘক্ষণ ভেজা অঙ্গে আছি, ঠান্ডা লেগে যাবে যে!’

‘বেশ চলো।’ বলেই বেণ দুষ্টুমি করে সুরোত্তমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেই গড়িয়ে পড়েন সুরোবরের জলে। কয়েক নিমেষ পর দুজনই উঠে নাভিসমান জলে দাঁড়ান, সুরোত্তমা বলেন, ‘তুমি ভারী দুষ্টু!’

বেণ হাসেন। সুরোত্তমা হাতের আঁজলায় জল নিয়ে পান করেন, তারপর হাতে জল নিয়ে বেণের শরীরে ছুড়ে মারেন, পাল্টা জল ছুড়ে মারেন বেণও, শুরু হয় দুজনের জলকেলি, অবশেষে হার মেনে জলে ডুব দেন সুরোত্তমা।

স্নান করে উঠে পোটলায় থাকা পরিচ্ছদ বের করে দু-জনে পরিধান করেন, আর ভেজা পরিচ্ছদ পোটলায় রাখেন। বেণ তরবারি দিয়ে কদলীবৃক্ষের দুটো পাতার ডগার দিকটা কেটে এনে ধুয়ে পাথরের ওপর রাখলে সুরোত্তমা সঙ্গে নিয়ে আসা যবের রুটি ও বাঁশের পাত্রের মধু বের করেন পোটলা থেকে। একটার পর একটা রুটিতে মধু মাখিয়ে বেণের পাতায় রাখেন, তারপর নেন নিজের পাতায়। দু-জনে খেতে খেতে গল্প জুড়ে দেন। কোথা থেকে একটা বুনো পাখি এসে নিচের পাথরের ওপর বসে দুজনের দিকে তাকায় ঘাড় নেড়ে নেড়ে। সুরোত্তমা বলেন, ‘দেখ প্রিয়তম, ও আমাদের আহারে ভাগ বসাতে এসেছে।’

বলেই সুরোত্তমা ছোট্ট এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে ছুড়ে দেন পাখিটার দিকে, পাখিটা একবার রুটির দিকে তাকায় আরেকবার সুরোত্তমার দিকে, তারপর রুটির টুকরোটা মুখে পুড়ে নেয়। বেণও কয়েক টুকরো রুটি ছেুড়ে দিয়ে বলেন, ‘ওর ক্ষুধা পেয়েছে।’

অনেকক্ষণ সময় নিয়ে দুজনে আহার করেন আর পাখিটাকে আহার করান। বেণের আহার শেষ হলে সরোবরের জলে হাত ধুয়ে পোটলাটা বাঁধতে থাকেন আর সুরোত্তমা দুজনের আহার শেষে বেঁচে যাওয়া রুটি দুটো ছিঁড়ে ছিঁড়ে পাখিটাকে আহার করাতে থাকেন। হঠাৎ একটা তীর এসে দুজনের থেকে সামান্য দূরে পাথরের ওপরে জমা বালু-কাদাময় একটা জায়গায় গেঁথে যায়, তীর দেখে ভড়কে যান দুজনই, আর খেতে থাকা পাখিটা উড়ে চলে যায় ডানায় আতঙ্কময় শব্দ তুলে। বেণ কাল বিলম্ব না করে নিজের তীর-ধনুকের দিকে ধাবিত হতেই একটি কণ্ঠস্বরের সতর্কবার্তা ভেসে আসে, ‘সাবধান, তীর-ধনুক হাতে নেবার চেষ্টা করলে বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেব, দু-হাত মাথার ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে থাকো।’

ধনুক আর তীরভরা তূণ বেণের থেকে কিছুটা দূরে, নিতে গেলে সত্যিই যদি শত্রুর তীর এসে তাঁর বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়! ঝুঁকি নেবার চেয়ে দাঁড়ানোর কথাই ভাবেন তিনি, দেখা যাক কী হয়, তিনি মাথার উপরে দু-হাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়েন। তাকিয়ে শত্রুকে দেখার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাঁর চোখে পড়ে না।

এবার শত্রু’র কণ্ঠস্বর আবার বলে, ‘ঝরনার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়াও। এই কন্যা, তুমি ঝরনার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বোসো।’

বেণ পিছন ফিরে ঝরনাকে সামনে রেখে দাঁড়ান, সুরোত্তমাও একই দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসেন। বেণ শত্রুর পায়ের শব্দ শুনতে পান, ক্রমশ কাছে আসছে। উহ, এখন যদি শত্রুর তীর পিঠে ঢুকে বুক ফুঁড়ে বেরোয়! এই নির্জন অরণ্যে এভাবে বেঘোরে মরতে হবে! এমন মরণ লেখা ছিল কপালে! সবে মানবদের নৃপতি হয়েছেন, কত কাজ পড়ে আছে সামনে- ব্রহ্মাবর্তের মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে, পবিত্র সরস্বতী নদীর তীর থেকে অনার্যদের বিতাড়িত করে আর্য সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটাতে হবে, ব্রহ্মাবর্তের পরিধি বিস্তৃত করতে হবে, অরণ্য পরিষ্কার করে চাষের ভূমি বাড়াতে হবে, অথচ সব কাজ অসম্পূর্ণ রেখে তাঁকে মরে যেতে হবে! হায় জীবন, হায় মহাজীবন, এখনই বিনাশ হ’য়ো না! হে ধরিত্রী মাতা, তোমার এই তেজস্বীপুত্রকে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আর অগৌরবের মৃত্যু দিও না, যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর অস্ত্রের আঘাতের মাধ্যমে আমার প্রাণ নিও, কিন্তু এভাবে নয়।

শত্রু’র কণ্ঠস্বর আবার বলে, ‘দুজনে লুকিয়ে লুকিয়ে এখানে প্রেম করছ না, বের করছি তোমাদের প্রেম!’
এ কী! এতক্ষণ পুরুষ কণ্ঠ ছিল, অথচ এখন মনে হচ্ছে নারীকণ্ঠ, শেষ পর্যন্ত নারীর হাতের তীরে মরতে হবে!
একটু থেমে নারীকণ্ঠ আবার বলে, ‘না, আমার জন্য কিচ্ছু রাখেনি দেখছি, দুজনে সব চেটেপুটে খেয়েছে!’

কণ্ঠস্বরটি কেমন চেনা মনে হয় বেণের! তাছাড়া যে ভাষায় কথা বলছে শত্রু নিশ্চয় নয়, সাহস করে ঘুরে তাকান বেণ, আর আশ্চর্য হয়ে দেখেন যে তাঁরই পিসতুতো ভ্রাতার বিশ বছর বয়সী কন্যা অনূকা! হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন বেণ, হাত উঁচিয়ে মারতে যান অনূকাকে, ‘ওরে দুষ্ঠু, এমন ঘাবড়ে দিয়েছিস! মেরে তোর….!’

অনূকা তার কাকাশ্রীর হাত থেকে বাঁচতে দৌড়ে একটা বড় পাথরের ওপাশে চলে যায়, বেণ সে-দিকে গেলে অনূকা দৌড়ে সুরোত্তমার কাছে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে বলে, ‘এই কাকীমা তুমি আমাকে বাঁচাও।’

সুরোত্তমাও এতক্ষণ ভয়ে কাঁপছিলেন, এখন স্বস্তি পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ছেড়ে দাও ওকে, বেচারী না হয় আমাদের সঙ্গে একটু দুষ্টুমী-ই করেছে।’

পাথরের ওপর বসে পড়েন বেণ, অনূকা বলে, ‘এই কাকাশ্রী, তুমি আবার বিবাহ করেছ কেন? তোমাদের পুরুষদের এই বহুবিবাহের বদ অভ্যাস আর গেল না!’

‘বিবাহ করিনি তো।’ বেণ বলেন।
‘তাহলে? প্রেম?’
‘তা বলতে পারিস। ইনি মর্তবাসিনী নন, স্বর্গের অপ্সরা। আমার নৃপতি হওয়া উপলক্ষে স্বর্গ থেকে এসেছেন আমাকে শুভকামনা জানানোর জন্য।’

‘ও তাই বলো। তোমার নৃপতি হবার খবর আমি শুনেছি, খুব খুশি হয়েছি। এবার তুমি অনেক নিয়ম-কানুন বদলে দেবে। শোনো, তোমাকে আমি অনেক পরামর্শ দেব। এক কাজ করতে পারো, তুমি আমাকে তোমার উপদেষ্টা করে নিতে পারো।’

বেণ হেসে বলেন, ‘তুই তো সেই ল্যাংটাকাল থেকেই আমার উপদেষ্টা! এমন বকবক করে মাথাটা ধরিয়ে দিতিস, অবশ্য এখনও তুই তেমন পাগলী-ই আছিস! তা এবার বল তুই এই নিভৃত অরণ্যে কী করে এলি? আর কেনই-বা এলি?’

‘আমার গুরুগৃহের শিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে, এপথ দিয়েই গৃহে ফিরছিলাম। তা হঠাৎ মনে হলো ঝরনাটা একবার দেখে যাই।’
‘এত পথ হেঁটে যাচ্ছিলি তুই?’
‘হেঁটে নয়, অশ্বে নিয়ে এসেছি। দূর থেকে তোমাকে দেখেই চিনেছি, তাই ভয় দেখাবার জন্য অশ্বটি ওখানে বেঁধে রেখে এসেছি।’
‘দুষ্টু বুদ্ধি আর গেল না তোর! তা এখন তো শিক্ষা সমাপ্ত করে ফিরে এলি, এবার ধুমধাম করে তোর একটা বিবাহ দেব।’
‘সেটি হচ্ছে না। বিবাহের কথা পরে ভাবা যাবে। আগে একটা আশ্রম খুলব, সেখানে কন্যাদের শাস্ত্র আর অস্ত্র চালনা শিক্ষা দেব, কন্যাদের যোগ্য করে গড়ে তুলব।’
‘সে তো খুব ভালো কথা রে! আমি তোকে আশ্রম নির্মাণ করে দেব।’
‘সত্যি দেবে!’
‘তবে কী মিথ্যে বলছি।’

অনূকা দৌড়ে গিয়ে বেণের গলা ধরে গালে চুম্বন করে বলে, ‘আমার ভালো কাকাশ্রী, তুমি সেই আগের মতোই আছো, নৃপতি হয়ে একটুও বদলাওনি।’

‘কিন্তু তোর পিতা-মাতা যদি তোকে আগে বিবাহ করতে বলে?’
‘পারবো না। তুমি তোমার ভ্রাতা-আর বৌদিকে বোঝাবে।’

‘বেশ বোঝাবো। চল এখন আমরা বাটীর পথে যাত্রা শুরু করি, নইলে সূর্যদেব নিদ্রায় গেলে পথ হারিয়ে ফেলব। চলো অপ্সরা।’


(চলবে.....)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১২:৪২

tutorial.rongdhonu.com বলেছেন: বাহ, বেশ লিখেছেন তো

১০ ই অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:২২

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ১০ ই অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১২:৫৫

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর লেখা।

১০ ই অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:২২

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

৩| ১০ ই অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:২৮

সোনাগাজী বলেছেন:



২/১ লাইন পড়ার পর, লেখার প্রতি কোন টান অনুভব করলাম না।

১০ ই অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:২২

মিশু মিলন বলেছেন: আমি সমালোচনা গ্রহণ করি। কিন্তু প্রত্যেক পোস্টে উদ্দেশ্যমুলকভাবে নেতিবাচক মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। আপনি আমার কোনো পোস্টে আর মন্তব্য করবেন না, করলেও আমি ডিলিট করে দেব।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.