নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব- চৌদ্দ)

২১ শে অক্টোবর, ২০২২ সকাল ১০:৪৫

নয়

পাহাড় এবং সমতলের অনেক আর্য ও অনার্য বসতি পরিভ্রমণ শেষে, সরস্বতী নদীর তীর ছেড়ে বহু পথ অতিক্রম করে কুথান আর কল্পক এসে পৌঁছান যমুনা নদীর তীরে পাতালের প্রসিদ্ধ কৈলাসনগরের নিকটে। তারা যাত্রা শুরু করেন গ্রীষ্মের শুরুতে, তারপর বর্ষা গিয়ে এখন শরৎ শেষের দিকে, গত কয়েক মাস তারা বিভিন্ন বসতি পরিভ্রমণ করেন, কখনো কুথানের কোনো পরিচিত আর্য এবং অনার্য বসতিতে রাত্রিযাপন করেন, আবার কখনো অনার্যদের ছোট কোনো পুর বা নগরের অতিথিশালায় রাত্রি অতিবাহিত করেন।

যমুনা নদীর তীর ধরে তাদের অশ্ব পাশাপাশি এগিয়ে যেতে থাকে কৈলাসনগর অভিমুখে। নদীর বাঁক ঘুরতেই দৃশ্যমান হয় কৈলাসনগর আর যমুনার ঘাটে নোঙর করা সারি সারি তরণী। দূর থেকে গাঢ় রক্তিমবর্ণের প্রাচীর বেষ্টিত কৈলাসনগরের রক্তিমবর্ণ প্রাসাদ আর যমুনার ঘাটে নোঙর করা বিভিন্ন আকৃতির তরণী দেখে বিস্ময় বনে যান কল্পক, এমন উঁচু গৃহসমৃদ্ধ সুদৃশ্য নগর আর এত বড় বড় তরণী তিনি জীবনে দেখেননি! আসবার পথে যে নগরগুলো তিনি দেখেছেন তা নিতান্তই বালক যদি কৈলাসনগরকে যুবক ধরা হয়!

তিনি কুথানের কাছে জানতে চান, ‘এই নগরের প্রাচীর আর গৃহ রক্তিমবর্ণের কেন কুথান, ওরা কি রঙ করেছে?’

‘না রঙ করেনি। পূর্বে আপনি যে নগরগুলো দেখেছেন, সেগুলোর গৃহ এবং প্রাচীর ছিল কাঁচা ইটের তৈরি। আর এই কৈলাসনগরের গৃহ এবং প্রাচীর তৈরি অগ্নিতে পোড়ানো ইট দিয়ে। ইট অগ্নিতে পোড়ালে এরকম গাঢ় রক্তিম রঙ ধারণ করে।’

‘আশ্চর্য কাণ্ড বটে! এই বিস্ময় নগর কাদের কুথান?’

‘এই নগর অনেক প্রাচীন, একসময় এই নগরে শুধুই পণি জাতি বাস করত, পণি জাতির শিবভক্তরা বানর জাতির কারিগরদের দিয়ে নির্মাণ করায় আর শিবের আদি নিবাস কৈলাসের নাম অনুসারে এই নগরের নাম রাখে- কৈলাসনগর। তখন অবশ্য নগর অনেক ছোট আর কাঁচা ইটের তৈরি ছিল। কালক্রমে কৈলাসনগর আরো বিস্তৃত হয়, আর বানরজাতিও গৃহ ও নগর নির্মাণে পূর্বের চেয়ে অধিক দক্ষ হয়ে ওঠে, কাঁচা ইট পুড়িয়ে গৃহ তৈরি করার কৌশল উদ্ভাবন করে তারা। পোড়া ইটের তৈরি গৃহ নাকি দীর্ঘকাল টিকে থাকে, সংস্কারও করতে হয় না তেমন।’

‘পর্বতের অনার্যদের মতো সমতলের অনার্যদের কাছেও তাহলে শিব খুব জনপ্রিয়!’

‘আর্য দেবতা এবং মানবদের মধ্যে যেমনি বিষ্ণু জনপ্রিয়, তেমনি অনেক অনার্য জাতির মধ্যে শিব জনপ্রিয়। শিব একজন যোগীপুরুষ, পর্বত এবং সমতল উভয় স্থানের অনেক অনার্যের কাছেই তিনি আরাধ্য পুরুষ। শিবভক্তরা শিবকে জগতের কল্যাণকারী সিদ্ধপুরুষ জ্ঞান করে তাঁর উপাসনা করে থাকে। তারা বিশ্বাস করে শিব মানুষের দুঃখ-কষ্ট নাশ করেন, এজন্য তারা শিবকে শর্ব নামেও ডাকে।’
‘সমতলের সকল অনার্য জাতিই কি শিবের উপাসনা করে?’

‘না, তেমন নয়। দক্ষিণে এবং পূর্বে আরো অসংখ্য বসতি আছে, যে-সব বসতিতে বিভিন্ন অনার্য জাতি বাস করে, সে-সব স্থানে হয়ত শিবের মাহাত্ম্য এখনো পৌঁয়নি, হয়ত কালক্রমে পৌঁছবে। আমি সমতলে গঙ্গার ধারে এমন একটি বসতিতে গিয়েছিলাম, যেখানকার মানুষ কেবল বৃক্ষ আর পশু-পাখির পূজা করে, তারা শিবের নামই শোনেনি।’

‘আমরা আসবার পথে অনার্য বসতির শিবভক্তদেরকেও তো বৃক্ষ আর পশু-পক্ষির পূজা করতে দেখলাম!’

‘শিবের পূজা করলে বৃক্ষ কিংবা পশু-পাখির পূজা করা যাবে না ব্যাপারটা তেমন নয়, আমার দেখা সকল অনার্যদেরকেই আমি বৃক্ষ এবং পশুপাখির পূজা করতে দেখেছি।’

কল্পক আবার নগরের দিকে তাকান, ক্রমশ নগরের সঙ্গে তাদের দূরত্ব ঘুচতে থাকে। কল্পক বলেন, ‘পণি জাতি কি খুব ধনী?’
‘সবাই নয়, কৈলাসনগরের বাইরে পল্লী অঞ্চলে অনেক পণি আছে, তারা খুবই দরিদ্র। এমনকি কৈলাসনগরেও অনেক দরিদ্র পণি বাস করে। তবে পণি জাতির কিছু কিছু মানুষ তাদের মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে ধনী হয়ে উঠেছে, তারাই কৈলাসনগরের গোড়াপত্তন করেছে। এখন অবশ্য কৈলাসনগর শুধু পণিদের নেই; গোরাপত্তনের পর থেকে কালক্রমে অন্যান্য অনার্য জাতি যেমন- বানর, অসুর আর পণিজাতির শাখা অজ, শিগ্রু, যক্ষরা এখানে ভিড় করতে থাকে। তারা বসতবাড়ি নির্মাণ করতে থাকে আর বাড়তে থাকে নগরের পরিধি। এমনকি কিছু আর্য দৈত্য ও দানব পরিবারও এখন এখানে বসতি গড়েছে, দু-চারটি আর্য মানব পরিবার থাকাও অস্বাভাবিক নয়। কৈলাসনগর এখন মিশ্র সংস্কৃতির মানুষের বসতিতে পরিণত হয়েছে।’

‘দৈত্য এবং দানবরা যতই আমাদের শত্রু হোক, তারাও তো আর্য, আমাদের শিকড় একই আদি ব্রহ্মা থেকে। ওরা ওদের রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা করে তো?’

কুথান মৃদু হাসেন, ‘কল্পক, আসবার পথে দেখলেন তো- কত ছোট ছোট নদী সরস্বতী আর যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে, সরস্বতী-যমুনার জলে মিশে গেছে ছোট নদীগুলোর জল। আপনি সরস্বতী-যমুনার জল আর ওই ছোট নদীগুলোর জল পৃথক করতে পারবেন? পারবেন না। একই ধারায় বয়ে চলেছে আর মানুষ-পশুপাখির তৃষ্ণা মিটাচ্ছে, মানুষের প্রাত্যহিক কাজের চাহিদা মিটাচ্ছে। তেমনি জগতের নানা জাতের মানুষ মিলনের মাধ্যমে একই ধারায় প্রবাহিত হলে, ভেদাভেদ মুছে গেলে, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ থেমে গেলে, জগৎ সুন্দর হয়ে উঠবে!’

যেন আঁৎকে ওঠেন কল্পক, ‘আপনি বর্ণ সংকরের পক্ষে কথা বলছেন কুথান!’

‘ক্ষতি কী যদি গৌর বর্ণ আর কৃষ্ণ বর্ণ মিলে গিয়ে জগত থেকে বর্ণ বৈষম্য দূর হয়ে যায়?’

‘প্রাণিজগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো- মানুষ, আর এই মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আমরা আর্যজাতি। সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। দৈহিক সৌন্ধর্যে, শৌর্যে-বীর্যে, মেধায় আমরা আর্যরাই শ্রেষ্ঠ। আমাদেরকে এই শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে হলে বর্ণ সংকর সৃষ্টি করা যাবে না। বর্ণশংকর সৃষ্টি করা পাপ, মহাপাপ!’

‘আপনি মানুষ, তাই প্রাণিজগতে মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলছেন। অন্য কোনো প্রাণির সঙ্গে তো আমাদের কথা হয় না, তাই তাদের অভিমত আমরা জানতেও পারি না। মৃগরাও তো নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবতে পারে, ওদের যুক্তি হতে পারে এই যে ওরা কোনো প্রাণিকে হত্যা করে না, ওরা মানুষ কিংবা অন্য অনেক প্রাণির মতো সহিংস নয়। তাছাড়া আপনি মানুষের মধ্যে আর্যজাতিকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করছেন, এ তো আর্যদের নির্ধারণ করা শ্রেষ্ঠত্ব, পণিজাতি যদি দাবী করে যে তারাই শ্রেষ্ঠ, কিরাতরা যদি দাবী করে তারাই শ্রেষ্ঠ, বানরা যদি বলে যে তারাই শ্রেষ্ঠ জাতি?’

‘তা কখনোই নয়; জ্ঞানে, সৌন্ধর্যে, শৌর্যে-বীর্যে আর্যরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি।’

‘আমি তেমনটা মনে করি না। কোনো জাতি নিজেদের শ্রেষ্ঠ দাবী করে আত্মগৌরব অনুভব করতেই পারে, তাতে অন্য জাতির কিছু যায় আসে না। আমি মনে করি জন্মসূত্রে কোনো জাতির বা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হয় না, শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হয় ব্যক্তির কর্মে। সে ব্যক্তি আর্য হতে পারে, আবার অনার্যও হতে পারে। আমাদের আর্যদের মধ্যে অনেক নীচু স্বভাবের মানুষ আছে, যারা শঠতা-প্রতারণায় অভ্যস্ত; আবার আমি বিভিন্ন অনার্যজাতির মধ্যে অনেক মহান মানুষ দেখেছি, যারা তাদের চিন্তা এবং কর্মে সৎ আর পরপোকারী। তাছাড়া দেখুন না, অনার্যরা কী সুন্দর গৃহ ও নগর নির্মাণ করেছে, ওদের হাতের অন্যান্য কাজও অনেক চমকপ্রদ, ওরা সভ্যতাকে এগিয়ে নিচ্ছে, সভ্যতার অগ্রগতিতে আর্যদের চেয়ে ওদের অবদান অনেক বেশি, সঙ্গত কারণেই ওরাও নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতি দাবী করতে পারে।’

কল্পক কয়েক নিমেষ কুথানের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলেন, ‘আপনি নিজের জাতিকে হেয় করে অনার্য জাতিকে অধিক প্রশংসা করছেন কুথান!’

‘আমি নিজের জাতিকে হেয় করছি না, আমি আর্য এবং অনার্য নানা জনপদ ভ্রমণ করে নিজের চোখে যে সত্য অবলোকন করেছি, মর্মে যে সত্য উপলব্ধি করেছি, সে-সত্য তো আমাকে বলতেই হবে কল্পক। অনার্যরা ওদের মেধা এবং সৃজনশীলতা দিয়ে জগতকে প্রতিনিয়ত এগিয়ে নিচ্ছে। সনাতনী জীবনধারার জগত পাল্টাতে শুরু করেছে ওদের হাত ধরে। যুদ্ধ নয়, আমাদের উচিত ওদের উদ্ভাবনী কৌশল গ্রহণ করে ওদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা, হাতে হাত রেখে সভ্যতার অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখা।’

‘আপনি আর্য জাতির দর্শন থেকে দূরে সরে গেছেন কুথান; আপনি প্রজ্ঞাবান মানুষ, আর্যজাতির সম্পদ হতে পারতেন, কিন্তু আপনার প্রজ্ঞা আর্যদের কল্যাণে কাজে লাগছে না, আপনি ভুল পথে আছেন। এটা আর্যদের জন্য অত্যন্ত দূর্ভাগ্যজনক!’

কুথান মৃদু হেসে বলেন, ‘কল্পক, আমি আমার প্রজ্ঞা নির্দিষ্ট কোনো জাতির কল্যাণে নয়, সকল জাতির কল্যাণে কাজে লাগাতে চাই। আর কোন দর্শন ভুল বা কোন দর্শন সঠিক, সেটা সর্বদা সমকালে নির্ধারিত হয় না। অনাগত কালও অনেক কিছু নির্ধারণ করবে। আর্যজাতি আজ যে কাজের জন্য গৌরববোধ করছে, এই কাজের জন্যই যে ভাবীকালে আর্যদের উত্তরপুরুষ লজ্জাবোধ করবে না তা কে বলতে পারে! আচ্ছা, এই বিতর্ক অনেক করা যাবে, আসুন, নগরে প্রবেশের আগে অশ্বগুলোকে যমুনার জল পান করিয়ে নিই, ওরা আমাদের অনেক সেবা দিয়েছে।’

কল্পক দম্ভের সঙ্গে বলেন, ‘অশ্বের মতোই অনার্যজাতিকে আর্যদের সেবক বানিয়ে রাখতে হবে, অনার্যদের জন্ম হয়েছে আর্যদের সেবা করার জন্য। এরই মধ্যে অনেক স্থানে ওরা আর্যদের পদানত হয়ে সেবা করছে।’

‘আপনার এই চিন্তা বাস্তবায়ন করতে গেলে কেবলই দ্বন্দ্ব বাড়বে, হানাহানি-রক্তপাত হবে, জগতে কখনোই শান্তি আসবে না।’

কুথান লাফিয়ে অশ্ব থেকে নেমে রজ্জু ধরে অশ্বটিকে জলের কাছে নিলে চু চু শব্দ করে জল পান করতে থাকে অশ্ব, কল্পকও অশ্ব থেকে নেমে কুথানকে অনুসরণ করতে করতে বলেন, ‘অশ্ব দুটি অতিশয় দীর্ঘকায় আর স্বাস্থ্যবান।’

কুথানের অশ্বটি শ্বেত বর্ণের আর কল্পকের অশ্বের বর্ণ হালকা বাদামী। কুথান বলেন, ‘দুটোই পখ্ত অঞ্চলের অশ্বের জাত, পখতের অশ্ব আর গাভী দীর্ঘকায় এবং অত্যন্ত শক্তিশালী হয়।’

‘পখতের নাম শুনিনি কখনো, কোনদিকে সেই বসতি?’
‘উত্তর-পশ্চিম দিকে।’
‘আপনি ভ্রমণ করেছেন সেই বসতি?’
‘হ্যাঁ, করেছি।’
‘এখান থেকে কত দূরের পথ?’

‘অনেক দূরের পথ, আর সে পথ অতি দূর্গম। শীতকালে আপনাদের স্বর্গের মতোই সেখানে তীব্র তুষারপাত হয়, পথ-ঘাট ঢেকে যায় শুভ্র তুষারে।’
‘ওই বসতি কারা শাসন করে, আর্য না অনার্যরা?’
‘পখতে আর্যরা ছাড়াও অল্প সংখ্যক অনার্য জাতি বাস করে।’
‘ওখানকার আর্যরা দেখতে কেমন?’

‘ওখানকার আর্যরা আমাদের চেয়েও দীর্ঘকায় এবং শক্তিশালী, অঙ্গবর্ণও আমাদের চেয়ে অধিক গৌর বলেই মনে হয়। কেশ আমাদের মতোই সোনালী, নীলাভ চোখ। তারাও আমাদেরই মতো অধোবস্ত্র, দ্রাপি এবং উষ্ণীব পরিধান করে; তবে তা আমাদের চেয়েও অধিক মোটা।’
‘আর অনার্যরা?’

‘অনার্যরা পাতালের অনার্যদের মতো কৃষ্ণবর্ণ নয়; তারা দেখতে অনেকটা কিরাতদের মতো, গাত্রবর্ণ গৌর, নাক চ্যাপ্টা আর চোখ ছোট।’
অশ্বকে জল পান করিয়ে রজ্জু ধরে হেঁটে গল্প করতে করতে পথে উঠে দুজন পুনরায় অশ্বে আরোহণ করেন, এই পথটিই চলে গেছে কৈলাসনগরের প্রবেশদ্বারে। কল্পক বলেন, ‘কৈলাসনগরে আমরা কোথায় থাকব কুথান?’

‘এখানে আমার কয়েকজন সখা আছে, কিন্তু আমরা যেহেতু এখানে অধিক দিন থাকব, তাই সখাদের বাটীতে না উঠে অতিথিশালাতে উঠব। খুব ভালো অতিথিশালা আছে এখানে।’
‘আপনার সখারা সবাই নিশ্চয় অনার্য?’
‘একজন আছে আর্য দানব, তার নাম অনল, বাকি সবাই অনার্য।’
‘বাহ, খুব ভালো হলো! দানব হলেও আপনার এই সখাটির সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ করতে চাই।’

‘বেশ, আমি আমার সখার গৃহে আপনাকে নিয়ে যাব। আমার সখাটি খুব ভালো, উদার মনের। এক পণিকন্যাকে বিবাহ করে এখানেই স্থায়ী হয়েছে।’

চমকে ওঠেন কল্পক, ‘বিষ্ণু, বিষ্ণু; কী অনাসৃষ্টি! দেবপতি ইন্দ্র চান সপ্তসিন্ধু এবং গঙ্গা-যমুনার পারে আর্যজাতির বিস্তার; অথচ এই দানবরা আর্যজাতির মর্যাদা, আচার, সংস্কৃতি সব ভুলুণ্ঠিত করছে!’

হাসেন কুথান, ‘আপনি যাবেন তো আমার সখার গৃহে?’

‘নিশ্চয় যাব, আমি ভবিষ্যতে নারদের পদে অধিষ্ঠিত হতে চাই, তাই এখন থেকেই আমাকে সকল পরিবেশে মানিয়ে নিয়ে তথ্য সংগ্রহ এবঙ শ্রীবিষ্ণু মহিমা প্রচার করার অভ্যাস করতে হবে। কিন্তু আপনার সখার আর্যবিরোধী কার্য আমাকে ব্যথিত করেছে।’

‘কল্পক, যার জীবন, সে তার মতো করে যাপন করবে, এটা তার স্বাধীনতা। এতে তো আপনার কষ্ট পাবার কিছু নেই। আর এখন বহু আর্য পুরুষ অনার্য নারীকে বিবাহ করে সুখে সংসার করছে। আবার অনেকে বিবাহ না করে কিংবা ধর্ষণ করে আর্য নারীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করেছে। ধর্ষণ করা অন্যায়, এর চেয়ে বিবাহ করা উত্তম।’

‘ওইসব সন্তানেরা পতিত, এরা আর্যদের দাস হবার যোগ্য।’
‘ধরণীতে প্রত্যেক মানব সন্তানই স্বাধীন, কাউকে দাস বানিয়ে রাখার চিন্তা করা অন্যায়।’

‘আপনি বড্ড ছেলেমানুষ কুথান, আপনার কথা শুনলে মাঝে মাঝে আমার হাসি পায়! হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আপনার সখা পণিকন্যাকে বিবাহ করে পতিত হয়েছেন, নিশ্চয় তিনি পণিদের মতো পতিত কর্মও শুরু করেছেন।’
‘বাণিজ্যের কথা বলছেন?’
‘পণিজাতির কর্ম তো সেটিই।’

‘বাণিজ্য পতিত কর্ম হতে যাবে কেন! বস্তুত ধরণীর কোনো সৎ কর্মই পতিত নয়। হ্যাঁ, আমার সখা অনল বাণিজ্য করেন, ওই যে দেখছেন যমুনার ঘাটে বড় বড় তরণী নোঙর করা, আমার সখা ওই তরণীতে আরোহণ করে পশ্চিমের বিভিন্ন নগরে বাণিজ্য করতে যান।’

এই পথটিই যমুনার ঘাটের পাশ দিয়ে চলে গেছে নিকটস্থ কৈলাসনগরে। যমুনার ঘাটে ছোট-বড় নানা আকৃতির অসংখ্য তরণী নোঙর করা, কিছু তরণী ঘাট ছেড়ে যাচ্ছে আর কিছু ঘাটে নোঙর করছে। ঘাটে অনেক লোকের ভিড়, কর্মব্যস্ত শ্রমিকেরা নানারকম পণ্য গরু, গাধা আর মহিষের দুই চাকাবিশিষ্ট গাড়ি থেকে নামিয়ে তরণীতে উঠাচ্ছে এবং তরণী থেকে নামিয়ে গাড়িতে সাজাচ্ছে।

ঘাটের পাশ দিয়ে যাবার সময় কল্পক বিস্ময়ে নোঙর করা তরণী আর শ্রমিকদের কর্মকাণ্ড দেখেন এবং এই সম্পর্কে অনভিজ্ঞ প্রশ্ন করতে থাকেন কুথানকে, কুথান কল্পকের অসীম কৌতুহল উপভোগ করেন আর তার বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকেন। কল্পক একদিন তরণীতে আরোহণ করবার বাসনা ব্যক্ত করেন কুথানের কাছে, কুথান কল্পকের বাসনা পূরণের প্রতিশ্রুতি দেন।

কৈলাসনগরের তোরণের কাছে পৌঁছে যান দুজন। এবারের আগে কুথান দু-বার এসেছেন কৈলাসনগরে; ব্রহ্মাবর্ত তো বটেই, অতল, বিতল, সুতল, মহাতল ও পাতালের অনেক বসতি পরিভ্রমণ করেছেন তিনি, কিন্তু অগ্নিতে পোড়ানো ইটের তৈরি এমন দৃষ্টিনন্দন নগর কোথাও দেখেননি। ইট গেঁথে তৈরি উঁচু এই তোরণের নিচ দিয়েই প্রাচীর ঘেরা নগরে প্রবেশ করতে হয়, নগরের সুরক্ষায় সীমানা প্রাচীর অনেক উঁচু করে নির্মাণ করা। তোরণের নিচে রয়েছে দুই পাল্লার কাঠের দ্বার, সন্ধ্যার পর অন্ধকার ঘনিয়ে আসতেই দ্বার বন্ধ করে রাখা হয় যাতে বহিঃশত্রু নগরে প্রবেশ করে আক্রমণ কিংবা লুণ্ঠন করতে না পারে। এখন অবশ্য দ্বার খোলা, দুটো পাল্লা দু-দিকে রাখা। দ্বারে সর্বদাই লোক থাকে পাহাড়ায়। তোরণের উপরের কাঠামোর ঠিক মাঝখানে এবং দ্বারের দুই পাল্লায় রক্তিমবর্ণে একইরকম চিহ্ন আঁকা। তোরণের দু-পাশের স্তম্ভে চামড়ায় লিখিত বিজ্ঞপ্তি ঝোলানো, নগর-প্রধানের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বার্তা থাকলে তা চামড়ায় লিখে এভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয় যাতে নগরের মানুষ তা পড়তে পারে। কল্পক অশ্ব থামিয়ে ঘাড় উঁচিয়ে তোরণ দেখেন, তার দৃষ্টি আটকে যায় তোরণের ওপরের রক্তিমবর্ণ চিহ্নে। আসবার পথে তারা যে-সব পল্লী এবং নগর পরিভ্রমণ করেছেন, সে-সব নগরের কোনো কোনো গৃহের দ্বারেও রক্তিমবর্ণ এমন চিহ্ন দেখেছেন কল্পক। তখন তিনি এই চিহ্নকে তেমন গুরুত্ব দেননি, তাই এই চিহ্ন সম্পর্কে কুথানকে কিছু জিজ্ঞেসও করেননি। কিন্তু কৈলাসনগরের তোরণে এবং দ্বারে একইরকম চিহ্ন দেখে তার মনে কৌতুহল জাগে, তিনি তর্জনী উঁচিয়ে কুথানকে চিহ্ন দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কুথান, ওটা কিসের চিহ্ন?’



(চলবে......)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে অক্টোবর, ২০২২ রাত ৯:২২

রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর লেখা।

২১ শে অক্টোবর, ২০২২ রাত ৯:২৭

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.