নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব- পঁয়ত্রিশ)

২২ শে নভেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:২২

আটাশ

ডানায় গাঢ় নীল রঙের মাঝে সাদার ছিটা দেওয়া বেশ বড় আকৃতির দুটো প্রজাপতি শুন্যে উড়তে উড়তে কখনো একটি আরেকটির কাছে আসে আবার কখনো দূরে সরে যায়, একটি উড়ে গিয়ে লতা কিংবা শাখায় বসলে আরেকটি গিয়ে সেটির ওপর বসে, ডানা ঝাপটায় কিছুক্ষণ, আবার উড়ে বেড়ায় দুটোতে, আবার কোনো লতার ওপর বসে! এই বসন্তে টিলার তৃণভূমির ওপর উপবেশন করে প্রজাপতিদ্বয়ের শৃঙ্গার দৃশ্য দেখতে দেখতে কুথানের হৃদয়ে হঠাৎ আলিঙ্গনের আকাঙ্ক্ষা চাগাড় দিয়ে ওঠে; মন্থন নয়, মৈথুনও নয়, তীব্র জলতৃষ্ণার ন্যায় শুধুই আলিঙ্গনের নেশা জাগে! কুথান চক্ষু নিমীলিত করেন আর সঙ্গে সঙ্গেই যেন তার সামনের ধূসর পাথরের ওপর দেবায়ণী উপবেশন করেন মুখে হাস্যপুষ্প ফুটিয়ে, বসন্তের আউলা বাতাস যেন দেবায়ণীর শরীরের ঘ্রাণ নিয়ে আসে কুথানের ঘাণেন্দ্রিয়ে! আলিঙ্গনের নেশা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়, বুঝিবা সোমরস কিংবা মাধ্বীরও সাধ্য নেই কুথানের অন্তর থেকে আলিঙ্গনের নেশা দূর করে! মাঝে মাঝে এমন হয় কুথানের, কোনো বসন্ত কিংবা বর্ষার রাত্রে কী অপরাহ্ণে তার ইচ্ছে করে দেবায়ণীর পাশে বসে থাকতে, কখনো ইচ্ছে করে দেবায়ণীর হাত ধরে সরস্বতীর পারে হাঁটতে, কখনো ইচ্ছে করে একগুচ্ছ বুনোপুষ্প ছিঁড়ে দেবায়ণীর খোঁপায় পরিয়ে দিতে, আবার কখনো ইচ্ছে করে শুধুই দেবায়ণীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে!

কুথান চোখ খোলেন, ধূসর পাথরটিতে প্রজাপতি দুটি একটি আরেকটির ওপর বসে বসন্তকালীন কামকলায় রত! উঠে দাঁড়ান কুথান, দেবায়ণীকে দেখার জন্য তার চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। অনেককাল তিনি দেবায়ণীকে দেখেন না, ব্যস্ততা ছিল, বেণ ব্রহ্মাবর্তকে স্বাধীন করেছেন, তিনি হয়েছেন বেণের উপদেষ্টাদের একজন, সাম্রাজ্য গুছিয়ে নিতে বেণের পাশে থেকে বেণকে নানারকম সুপরামর্শ দিতে হয়, ঋষি আর ব্রাহ্মণ ও তাদের অনুগত গোত্রগুলির বিদ্রোহ দমনে বেণের পক্ষের গোত্রগুলির গোত্র-প্রধান আর অন্যান্য বিশিষ্টজনদের সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠক করে নানা কৌশল নির্ধারণ করতে হয়, নিয়মিত বৈঠক করতে হয় ব্রহ্মাবর্তের অনার্য জাতিগুলোর সর্দার এবং যোদ্ধাদের সঙ্গেও। স্বাধীনতার পর কুথান মাত্র দু-বার ব্রহ্মাবর্তের বাইরে পা রেখেছেন; একবার সুতলে, আরেকবার বিতলে গিয়েছেন, সেও ছয় মাস পূর্বে। যৌবনে পা দেবার পর থেকে এত দীর্ঘ সময় তিনি কখনোই বহির্ষ্মতীতে থাকেননি। তবু এই ব্যস্ততার মধ্যেও যে তিনি একবারের জন্য দেবায়ণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতে পারতেন না তা নয়, হয়ত কিছুটা অভিমানবশতই যাননি; ওই যে- গেলে ব্যথা বেড়ে যায়, ফিরবার সময় তীব্র কষ্ট হয় বুকে, তাই যাননি। দেবায়ণী যে তার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, তাকে বিবাহ করার কথা দিয়ে কথা রাখেননি তা নয়। তিনি নিজেও জানেন যে দেবায়ণী কোনো ভুল কিংবা অপরাধ করেননি, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার অন্য সকলের মতো দেবায়ণীরও আছে, দেবায়ণী ঋষি মানুষ, তার পুনরায় বিবাহ না করতে চাওয়াই হয়ত যৌক্তিক এবং স্বাভাবিক। কুথান নিজেও তা বোঝেন, কিন্তু বুঝেও তার প্রেমিক হৃদয় মাঝে মাঝে চঞ্চল হয়ে ওঠে, অভিমান করে দেবায়ণীর ওপর, এতটাই অভিমান যে নিজের কষ্ট হয় তবু দেবায়ণীর আশ্রমে যাবার কথা ভাবেন না।

স্বর্গ, ব্রহ্মাবর্ত, সুতল, অতল, বিতল, পাতালের অনেক আর্য-অনার্য নারী তার প্রেমে পড়েছেন; তাকে বিবাহ করতে চেয়েছেন, কিন্তু তাদের প্রেমের আহ্বানে বা বিবাহের প্রস্তাবে তার হৃদয় জাগেনি দেবায়ণীর প্রতি ভালোবাসার কারণে, দেবায়ণী ব্যতিত অন্য কোনো নারীর সঙ্গে তিনি সম্পর্কে জড়াতে চাননি। যেসব নারী তাকে প্রেমের আহ্বান জানিয়েছেন কিংবা বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন, তাদের মধ্যে কেবল একজনের জন্য তার মন কেমন করে, কষ্ট হয়, নিজের দোষ নেই জেনেও কিছুটা অপরাধবোধে ভোগেন তিনি। সেই নারী- অপ্সরা সুরোত্তমা, প্রিয় সখা বেণের প্রেয়সী ছিলেন যিনি। বেণের নৃপতি অভিষেক উপলক্ষে সুরোত্তমা যখন বেশ কিছুকাল ব্রহ্মাবর্তে অতিবাহিত করেন; তখন তিনি কুথানের জীবন, কর্ম, দর্শন ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে যান। চন্দ্রালোকিত এক সন্ধ্যায় নির্জন পাহাড়ের টিলায় কুথানকে ডেকে নিয়ে পাথরের ওপর পাশাপশি উপবেশন করে প্রেম নিবেদন করেন, ‘কুথান, আপনার গল্পকথন আমাকে মোহিত করে, আমি সারাজীবন আপনার পাশে থেকে গল্প শুনতে চাই।’

কুথান কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকেন, তারপর বলেন, ‘সারাজীবন সবাইকে গল্প শোনানোর জন্যই তো আমি ধরিত্রীতে জন্মেছি।’
‘সবাই যেভাবে গল্প শোনে সেভাবে নয়, আমি আরো কাছ থেকে আপনার গল্প শুনতে চাই, আপনার বুকে মাথা রেখে।’ কুথানের বাহু জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখেন সুরোত্তমা।

কুথান কিছু বলেন না। সুরোত্তমা আবার বলেন, ‘চুপ করে আছেন যে? আমি আপনার ভ্রমণ সঙ্গী হতে চাই, আপনার জীবনের সঙ্গী হতে চাই, আমি আপনাকে বিবাহ করতে চাই কুথান।’
কুথান বলেন, ‘সে হয় না দেবী। পথ বড় কণ্টকময়, আপনার কষ্ট হবে।’
‘হোক, তবু আমি আপনাকে চাই।’
‘আমায় ক্ষমা করবেন দেবী, আমি একজনকে ভালোবাসি।’
‘আমি জানি, আপনি ঋষি দেবায়ণীকে ভালোবাসেন। কিন্তু তিনি তো বিবাহ করতে চান না। আপনি শুধু শুধু অপেক্ষা করছেন!’
‘ভালোবাসলে বিবাহ করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই, দূর থেকেও ভালোবাসা যায়। আমি আজীবন দেবায়ণীকে দূর থেকেই ভালোবেসে যাব।’

এবার কুথানের বুকে মাথা রাখেন সুরোত্তমা, ‘আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচব না কুথান, আমাকে ফেরাবেন না।’
‘তা হয় না দেবী, আপনি আমার সখা বেণের প্রেয়সী, আপনাকে আমি ভালোবাসতে পারি না।’

‘সে-তো কিছুদিনের জন্য, দেবপতি ইন্দ্র পাঠিয়েছেন তাই। অপ্সরাদের এরকম অনেক পুরুষকেই প্রেম-কাম বিলাতে হয়। কিন্তু আমি ভালোবেসেছি আপনাকে, আপনাকে পেলে আমি অপ্সরার জীবন ত্যাগ করে সংসারী হব। আমি আপনার জীবনে স্থিত হতে চাই।’
‘আমি আপনাকে বিবাহ করলে আমার সখা কষ্ট পাবে, তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নষ্ট হবে। আমি আমার বাল্যসখাকে কষ্ট দিতে পারব না। আমি অপারগ দেবী, আমায় ক্ষমা করুন।’

কুথানের বুক থেকে মাথা তুলে দু-হাতে মুখ গুঁজে হু হু শব্দ করে কেঁদে উঠেছিলেন সুরোত্তমা। সুরোত্তমার মৃত্যুসংবাদ শোনার পর থেকে যখনই দেবায়ণীর কথা মনে পড়ে কুথানের, কী কারণে কে জানে তখন সুরোত্তমার কথাও মনে পড়ে, সুরোত্তমার ওই কান্নার শব্দ কানে বাজে, বুকে বাজে ব্যথার বেণু, তার মনে হয় এর নামও কী প্রেম!

অনেক দিন পর প্রজাপতি দুটি কুথানের ভেতরে প্রেম এবং তীব্র আলিঙ্গনের নেশা জাগিয়ে তোলায় দেবায়ণীর প্রতি তার সব অভিমান গলে জল হয়ে যায়, তার মনে হয় যেন দেবায়ণীই প্রজাপতি দুটিকে তার কাছে পাঠিয়েছেন প্রেমের দূত করে!

এখন যাত্রা করলে দেবায়ণীর আশ্রমে পৌঁছতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি হবে নিশ্চিত, কিন্তু কুথানের মন এমন উচাটন হয়েছে যে তিনি কিছুটা ঝুঁকি নিয়েও যাবার সিন্ধান্ত নেন। তিনি অনুভব করেন তার মনটা চলে গেছে দেবায়ণীর আশ্রমে, দেহটা বহির্ষ্মতীতে রেখে দিলে অযথাই মনের পীড়া আরো বাড়বে। তিনি দ্রুত পা চালিয়ে টিলা থেকে নেমে পড়েন যবক্ষেতের আলপথে। নয়ন জুড়োনো বিস্তীর্ণ সবুজ যবক্ষেত, যবের পাতা আর বলিষ্ঠ শীষ বাতাসে মৃদুমন্দ দোল খায়, প্রজাপতি ও ফড়িং উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নেয় শীষের ওপরে। অন্য সময় হলে নয়নভরে দেখতেন কুথান, প্রজাপতি আর ফড়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতেন, শীষে বসা ফড়িং কিংবা প্রজাপতিকে দুষ্টুমি করে উড়িয়ে দিতেন কিংবা ওদের নিয়ে মাথার মধ্যে অদ্ভুত কোনো গল্প বুনে ফেলতেন। কিন্তু এখন সময় কোথায় তার! দু-হাত দু-দিকে প্রসারিত করে কিশোরের চঞ্চলতা আর উচ্ছ্বাসে আলপথ ধরে দৌড়তে থাকেন বহির্ষ্মতীর দিকে। ধাবমান কুথানকে দেখে দুটো শুকপাখি আলপথ থেকে যবক্ষেতের ভেতরে পালিয়ে যায়।

গৃহে ফিরে দ্রুত পোশাক বদলান কুথান, তার পরিভ্রমণে যাবার ঝোলাটার মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছদ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে মাতাকে জানিয়ে প্রিয় অশ্বের পৃষ্ঠে চড়ে বসেন। কিছুদূর এগোতেই দূর থেকে বেণের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘কোথায় যাচ্ছো সখা?’
‘দেবায়ণীর আশ্রমে।’

‘তোমার সঙ্গে আমার প্রয়োজনীয় কথা আছে, আজকে যেও না।’
‘ফিরে এসে শুনবো সখা, আজকে বাধা দিয়ো না।’
‘এই অবেলায় যাত্রা করলে আশ্রমে পৌঁছতে রাত্রি হয়ে যাবে।’

‘শুধু রাত্রি কেন, রাত্রি পেরিয়ে প্রভাত হলেও আমি যাব সখা! হৃদয়ে প্রেমের হড়পা বান ডেকেছে সখা, সেই বানের স্রোতে ভেসে চলেছি আমি, আমার সাধ্য নেই ফেরার! দয়া করে আমায় পিছু ডেকো না, ফিরে এসে তোমার সব কথা শুনব প্রিয় সখা আমার, এখন যেতে যাও আমাকে।’

বেণ হেসে বলেন, ‘বেশ, প্রেমের হড়পা বানের স্রোতে ভাসছ যখন, আমার সাধ্য কী তোমায় ধরে রাখি! সাবধানে যেও, আর ফিরে এসো শীঘ্রই।’

‘আচ্ছা, শীঘ্রই ফিরব। সতর্ক থেকো।’

কুথান যখন দেবায়ণীর আশ্রম থেকে প্রায় এক ক্রোশ দূরে তখনই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে পাহাড়ে। পথ চেনা হওয়ায় পাহাড়ের অরণ্যে হারাবার ভয় না থাকলেও জন্তু-জানোয়ারের আক্রমণের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর থেকে একটা বাঘ কিংবা ভাল্লুক ঝাঁপিয়ে পড়তেই পারে ঘাড়ের ওপর। কুথান হাতের লম্বা লাঠিটা শক্ত করে ধরে সামনে এবং ডানে-বামে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। চড়াই-উৎরাই পথ হওয়ায় অশ্ব জোরে ছোটাতে পারেন না, ধীরলয়ে হাঁটে অশ্ব। কোথাও কোথাও পথ এমন খাড়া যে অশ্ব থেকে নেমে হেঁটে উঠতে হয়। একটা চড়াই পেরিয়ে আবার অশ্বের পিঠে আরোহণ করে বিশাল এক শীশম বৃক্ষের তলার অন্ধকার অতিক্রম করার সময় কুথানের কানে ভেসে আসে এক গম্ভীর কণ্ঠস্বর, ‘কে যায়?’

এমন জনমানবহীন অন্ধকারে হঠাৎ শব্দ দুটি কানে আসায় চমকে ওঠেন কুথান, ডানে ঘাড় ঘুরিয়ে বৃক্ষের গোড়ার দিকে তাকান কিন্তু জমাট অন্ধকার ব্যতিত কিছুই তার চোখে পড়ে না। আবার ভেসে আসে কণ্ঠস্বর, ‘কে তুই?’
‘আমার নাম কুথান, বর্হিষ্মতী আমার নিবাস।’

কয়েক নিমেষ রাগতস্বরে গোঙানোর শব্দ ভেসে আসে কুথানের কানে, তারপর হঠাৎ একটি পাথর এসে লাগে তার ডান বাহুতে, বেশ ব্যথা পান তিনি। পরমুহূর্তেই আবার ভেসে আসে বজ্র কণ্ঠস্বর, ‘ধর্মদ্রোহী পাপাত্মা, কুমন্ত্রণাদাতা, তুই বিনাশ হবি, ভস্ম হবি, তোরা ব্রাহ্মণের আহার কেড়ে নিয়েছিস, ব্রাহ্মণকে অভুক্ত রেখেছিস, তোদের বিনাশ অনিবার্য!’

কুথান বলেন, ‘আপনার বচন সত্য, তবে এই বচন কেবল আমার ক্ষেত্রেই নয়, সকল মানুষের ক্ষেত্রেই সত্য হবে, আপনার ক্ষেত্রেও। ধরনীতে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়, সবকিছুই বিনাশ হবে। এই দেহ একদিন বিনাশ হবে, আর দাহ করলে ভস্মও হবে।’

চিৎকার করে ওঠে কণ্ঠস্বর, ‘আহ….! শৃগাল-শকুনে ভক্ষণ করবে তোর দেহ, অগ্নি পাবে না।’

এবার আরো তীব্রভাবে গোঙানোর শব্দ হয়, ভূমিতে হাতের আঁচড়ের শব্দ হয়, কুথানের মনে হয় নিশ্চয় মানুষটি অন্ধকারে ভূমি হাতরে পাথর খুঁজছে আবার তার দিকে ছুড়ে মারার জন্য। তিনি অশ্বকে তাড়া দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে উচ্চস্বরে বলেন, ‘আপনি কে তা আমি জানি না, বোধকরি কোনো ঋষি হবেন, হিংসা আর ক্রোধ বর্জন করুন, তাহলে শান্তি পাবেন।’
পিছনের কণ্ঠস্বর আবার গর্জে ওঠে, ‘ধ্বংস হবি তুই, তোকে শৃগাল-শকুনে ভক্ষণ করবে ধর্মদ্বেষী পাপাত্মা!’

কুথান নিশ্চিত ধরে নেন যে এই মানুষটি কোনো ঋষি-ই হবেন। ঋষি কিংবা পাগল ব্যতিত এই নির্জন জায়গায় অন্ধকারে কেউ বসে থাকবে না। ব্রাহ্মণ এবং ঋষিগণ শুধু বেণের ওপর নন, তার ওপরেও যে ভীষণ ক্ষেপে আছেন সে খবর তিনি আগেই গুপ্তচরদের কাছ থেকে পেয়েছেন।

বহির্ষ্মতীর ব্রাহ্মণদের ধারণা ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীনতা ঘোষণার পিছনের কারিগর কুথান, বেণ নৃপতি হিসেবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেও পিছন থেকে বেণকে মন্ত্রণা দিয়েছেন কুথান। কুথান মন্ত্রণা আর সাহস না দিলে বেণের কখনোই সাহস হতো না দেবগণ এবং ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার। কুথান আগে থেকেই ধর্মবিরোধী, বেদ এবং যজ্ঞবিরোধী। তিনি অনেক যুবককে তার যুক্তি ও বাকচাতুর্যতার প্রভাবে নাস্তিকতার পথে টেনে নিয়েছেন। অনেক যুবক কুথানকে এতটাই ভালোবাসে যে তার জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করবে না! কেবল যুবকেরাই নয়, গল্পকথনের কারণে ব্রহ্মাবর্তের অনেক প্রৌঢ় কিংবা প্রবীণরাও কুথানকে খুব ভালোবাসে তার বেদ কিংবা যজ্ঞবিরোধীতা সত্ত্বেও।

ব্রহ্মাবর্তের অনার্যদের সঙ্গে বেণের কখনোই সুসম্পর্ক ছিল না, বরং তিনি সর্বদা ছিলেন অনার্য বিরোধী, নৃপতি হবার আগে অনেকবার যুদ্ধে তিনি অনার্যদের বিস্তর ক্ষতি সাধন করেছেন। অথচ সেই বেণই হঠাৎ অনার্যদের প্রতি দয়াশীল হয়ে ওঠেন কুথানের প্রভাবে। অনার্যদের সঙ্গে যত সখ্যতা কুথানের, আর কুথানই অনার্যদেরকে বেণের পক্ষে অবস্থান নিতে সহায়তা করেছে, যে কারণে বেণের পক্ষে দেব এবং ব্রাহ্মণদের বিরোধীতা করে ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীনতা ঘোষণা করা সহজ হয়েছে। ফলে ব্রাহ্মণদের ক্ষোভ যত না বেণের ওপরে, তার চেয়েও বেশি কুথানের ওপরে। তবে কুথানের ধারণা ছিল কেবল বহির্ষ্মতী আর বহির্ষ্মতীর আশপাশের ব্রাহ্মণ ও ঋষিগণ হয়ত তার ওপর বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন, কিন্তু ক্ষোভ যে বহির্ষ্মতী থেকে এত দূরেও গড়িয়েছে সেই সম্পর্কে তার ধারণা ছিল না।

সামনেই একটা কিরাত পল্লী, মশাল এবং মৃৎপ্রদীপের আলোর আভা দেখা যায় কিছু বাটীতে। কুথানের একটা মশাল নেবার কথা মনে হয়, কেননা এখনো আধা ক্রোশ পথ বাকি, মশাল থাকলে জন্তু-জানোয়ার ভয়ে আক্রমণ করবে না। এ পল্লীর প্রাপ্তবয়স্ক প্রায় সকলেই কুথানের পরিচিত আর কিরাত সর্দার খিমবুঙের সঙ্গে রয়েছে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। খিমবুঙের বাটীর কাছে গিয়ে অশ্ব থেকে নেমে আঙিনায় প্রবেশ করে নাম ধরে ডাকেন কুথান, ‘খিমবুঙ গৃহে আছো মিত্র?’

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গৃহের ভেতর থেকে খিমবুঙের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ‘আরে কতকাল পরে মিত্র কুথানের কণ্ঠস্বর শুনছি মনে হয়!’

কয়েক নিমেষ পর গৃহাভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে আঙিনায় নেমে কুথানকে জড়িয়ে ধরেন খিমবুঙ, ‘এতদিন কোথায় ছিলে তুমি?’
‘বহির্ষ্মতীতেই ছিলাম, সময় পাচ্ছিলাম না আসার।’
‘দাও অশ্ব আমায় দাও, তুমি হাত-মুখ ধুয়ে এসো।’
‘তুমি ব্যস্ত হোয়ো না মিত্র, আমি আজকে রাত্রিযাপন করব না।’
‘সে কী! এতদিন পর এলে, আজ তোমায় ছাড়ছি নে। কতদিন তোমার মুখে গল্প শুনি না।’
‘আজ আমায় যেতেই হবে মিত্র, আমি পরে সময় করে এসে থাকব, গল্পও শোনাব! তুমি বরং আমায় একটা মশাল দাও।’
‘এই রাত্রে বিপদসঙ্কুল পথে কোথায় যাবে তুমি?’
‘যাব তোমাদের ভগিনী দেবায়ণীর আশ্রমে।’
‘এই তো দিন চারেক আগে আমি ওদিকে গিয়েছিলাম, ভগিনী তোমার কথা জিজ্ঞেস করলেন। আমি তোমার কোনো সংবাদ তাকে জানাতে পারিনি।’

খিমবুঙের কথা শুনে কুথানের যেন আর এক নিমেষও তর সয় না, তিনি বলেন, ‘দাও মিত্র, একটা মশাল দাও, রাত্রি আরো বেড়ে যাবার আগেই আমি তার আশ্রমে পৌঁছতে চাই।’

‘একা একা যাবে বিপদসঙ্কুল পথে, আমি তোমায় এগিয়ে দিয়ে আসব?’
‘সেই তোমাকেও তো আবার একা একা ফিরতে হবে বিপদসঙ্কুল পথেই। তোমার যাবার দরকার নেই, তুমি আমায় একটা মশাল দাও, আর তো মাত্র আধা ক্রোশ পথ, আমি একাই যেতে পারব।’

খিমবুঙ আর কথা না বাড়িয়ে গৃহাভ্যন্তরে গিয়ে একটা মশাল আর চর্বির পাত্র নিয়ে আসে, মশালে ভালোমতো চর্বি মাখায়, তারপর তাতে আগুন জ্বালিয়ে কুথানের দিকে এগিয়ে যায়। খিমবুঙকে পুনরায় আলিঙ্গন করে অশ্বের পিঠে আরোহণ করেন কুথান। খিমবুঙ কুথানের দিকে মশাল বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘সাবধানে যেও মিত্র।’
কুথান মশাল হাতে নিয়ে বলেন, ‘চিন্তা কোরো না, আমি নিরাপদে পৌঁছে যাব। আসছি, শুভরাত্রি মিত্র।’
‘এসো, শুভরাত্রি।’

কুথান পথে বেরোয়, হাতের মশালের আলোয় অন্ধকার তাড়াতে তাড়াতে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। পথের ধারেই পল্লীর সারি সারি গৃহ, তারই একটি থেকে গীতের সুর ভেসে আসে, অন্য সময় হলে কুথান অশ্ব থেকে নেমে গায়কের পাশে বসে গীত শুনতেন, হয়ত-বা গানে-গল্পে রাত্রিটাই পার করে যেতেন এখানে। কিন্তু এখন তার হাতে সেই সময় নেই, এখন যে তিনি প্রেমের স্রোতে ভাসছেন! পল্লী পেরিয়ে ছোটে অশ্ব, গীতের সুর থেকে দূরে সরতে সরতে ক্রমশ আর শোনা যায় না।

সামনেই একটি ঝিরি, অরণ্যের স্রোতস্বিনী ঝিরি বড় বিপদজনক, নানান জীবজন্তু জল পান করতে আসে, আর দিনের চেয়ে রাত্রি আরো অধিক বিপদজনক, কেননা রাত্রে বৃক্ষরাজি আকাশ আর চাঁদ আড়াল করে রাখায় সর্বত্র অধিক অন্ধকার বিরাজ করে, ঝিরির কোথাও বাঘ কি ভাল্লুক জল পান করছে কি না তা বোঝা যায় না।

কুথান ঝিরিতে নামার আগে হাতের রজ্জু টেনে ধরতেই অশ্ব দাঁড়িয়ে পড়ে, মশাল আর রজ্জু বাম হাতে ধরে ডানহাতের লাঠি দিয়ে মাঝারি আকৃতির একটি পাথরে শব্দ করেন তিনি, যাতে কোনো প্রাণি থাকলে শব্দ শুনে ভয়ে পালিয়ে যায়। না, ঝিঁঝিপোকা ব্যতিত আর কোনো প্রাণির সাড়া পাওয়া যায় না। মশালটা উঁচিয়ে এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে দেখেন ভালো করে, তারপর অশ্বকে তাড়া দেন। অশ্ব থেকে নামেন না কুথান, বিঘত খানেক উচ্চতার জলের ঝিরি অশ্বে আরোহণ করে পেরিয়ে যান কোনোরকম বিপদের সম্মুখীন না হয়েই।
অশ্বকে কিছুই নির্দেশ দিতে হয় না, সে নিজেই ঝিরি থেকে উঠে চড়াই পথ ধরে হাঁটতে থাকে, এ পথ তারও চেনা, অনেকবার সে তার প্রভুকে নিয়ে এসেছে, এবার এতদিন পরে আর রাত্রের অন্ধকারেও সে পথ ভোলেনি। ঝিরি থেকে উঠে অরণ্যের মধ্য দিয়ে পায়ে চলা পথ ধরে অশ্ব চলতে থাকে আর কিছুদূর যাবার পর অকস্যাৎ সামনের দিকে সামান্য দূরত্বে ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে দ্রুত গতিতে কোনো প্রাণির ছুটে যাবার শব্দ শুনে মুখে চিঁ হিঁ হিঁ শব্দ তুলে দাঁড়িয়ে পড়ে। কুথানও চমকে যান, পরক্ষণেই বুঝতে পারেন যে কোনো হিংস্র প্রাণির তাড়া খেয়ে প্রাণভয়ে পলায়নরত কোনো প্রাণি হয়তবা। কয়েক নিমেষ থমকে থাকার পর আবার অশ্বকে তাড়া দেন কুথান, নিরাপদে পৌঁছে যান দেবায়ণীর আশ্রমের কাছের ঝিরির পাড়ে, অদূরের ঝরনা থেকে জলপতনের শব্দ ভেসে আসে কানে, আশ্রমের আলো দেখতে পান তিনি। অল্প জলের ঝিরি পেরিয়ে আশ্রমে যাবার সরু পথে ওঠে অশ্ব, কিছুক্ষণের মধ্যেই আশ্রমের আঙিনায় গিয়ে অশ্ব থেকে নামেন, একটি গৃহের অলিন্দে প্রদীপ জ্বলছে কিন্তু সেখানে কেউ নেই। আশ্রমের দুটি গৃহের ভেতরেও আলো জ্বলছে। কুথান বলেন, ‘অতিথি এসেছে আশ্রমে, তপস্বিনীরা কোথায়?’

একটি গৃহের ভেতর থেকে ভেসে আসে নারীকণ্ঠ, ‘দাদাশ্রী না!’

ক্ষণকাল পরেই প্রায় ঝড়ের বেগে গৃহ থেকে বেরিয়ে এসে দেবায়ণী পাগলিনীর ন্যায় কিল মারতে থাকেন কুথানের বুকে, কুথান একটুও বিচলিত না হয়ে মশাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন, তার হাতের মশাল দুলে দুলে ওঠে। তারপর কুথানের বুকে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে ওঠেন দেবায়ণী। আশ্রম কন্যারা দুটি গৃহের অলিন্দে এসে তাদের প্রিয় দিদি আর দাদাশ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কোথানের চোখ ছল ছল করে ওঠে, তিনি তার ডানহাতের মশাল ছুড়ে ফেলে দেন ভূমিতে, তারপর নিজের বুকে মুখ গুঁজে ক্রন্দনরত দেবায়ণীকে বামহাতে জড়িয়ে ধরে ডানহাত দিয়ে মাথায় আলতোভাবে আদর করতে থাকেন। তার চোখের অশ্রু বাঁধ ভেঙে পড়ে আর দেবায়ণীর কান্নার ঢেউ অনবরত আছড়ে পড়ে বুকে।

‘আহ, কী শান্তি!’ বলেই চোখ বুজে মুখ সামান্য হাঁ করে উপরদিকে তাকান কুথান আর ঝরনার জল তাকে ছুঁয়ে পতিত হয় পাথুরে ভূমিতে। অদূরে মশাল হাতে দাঁড়িয়ে দেবায়ণী তাকিয়ে থাকেন আলোর আভাময় অবিরাম জলের ধারার মধ্যে স্নানরত উৎফুল্ল কুথানের দিকে। মশালের আলোর প্রতিবিম্ব কাঁপতে থাকে ঝরনাধারায়।

‘শীতল জলের নিচে বেশিক্ষণ থেকো না কুথান, ঠান্ডা লাগবে তোমার, চলে এসো।’

এই কথাগুলো মধুর মতো বর্ষিত হয় কুথানের কানে, কথার ভালোলাগার তান ছড়িয়ে পড়ে তার সারা দেহ-মনে। তিনি যৌবনে পা দেবার আগেই তার মা মারা যান, তারপর আজ অব্দি কোনো নারী তাকে এই ভাষায় এতটা মায়ায় কিছু করতে নিষেধ করেনি। শিশির, বৃষ্টি কিংবা ঝরনার জলে অবিরাম ভিজলেও কোনো নারী বলেনি- ঠান্ডা লাগবে তোমার, চলে এসো; সোম পান করতে করতে রাত্রি ভোর হয়ে গেলেও কোনো নারী বলেনি- আর পান কোরো না, এবার শুতে যাও; দুঃখ পেয়ে কাঁদলেও কেউ বলেনি- দুঃখ কোরো না, আনন্দে বাঁচো, আমি তো পাশে আছি। এতদিনে তবে সেই অভাব ঘুচল! জীবন সুন্দর মনে হয়, বেঁচে থাকা স্বার্থক মনে হয় কুথানের। তিনি ইচ্ছে করেই ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে থাকেন দেবায়ণীর মুখ থেকে একই বাক্য আবারো শোনার জন্য। আর সত্যি সত্যিই দেবায়ণী আবারো বলেন, ‘ওঠো কুথান, ঠান্ডা লাগবে তোমার।’

‘লাগুক ঠান্ডা, ঠান্ডা লেগে মরে গেলেও এখন আমার আর কোনো দুঃখ থাকবে না। এই জীবনে যা পাবার আমি তা পেয়ে গেছি।’
‘এমন কু-কথা বোলো না কুথান, আমার কষ্ট হয়।’

‘তোমার জীবনের সব কষ্ট আমি দূর করে দেব তপস্বিনী। আজ থেকে আমাদের জীবনে আর কোনো কষ্ট নেই, কেবল আনন্দ, আনন্দে বাঁচব আমরা।’
‘তাই যেন হয় কুথান।’

কুথান চিৎকার করে বলেন, ‘দেবায়ণী, বিবাহের পর আমরা অনেক স্থান ভ্রমণ করব। আমি তোমায় কুচদ্বীপে নিয়ে যাব।’
‘কুচদ্বীপ! সে-স্থান কোথায়?’

‘বহু যোজন দূরে, সরস্বতী নদী যেখানে সমুদ্রে মিলিত হয়েছে প্রায় তার কাছে, সরস্বতী নদীর বুকে জেগে ওঠা একটি দ্বীপ।’
‘সেখানে মানুষ থাকে?’

‘থাকবে না কেন! তবে সেখানে লোকজন কম। বিভিন্ন স্থান থেকে লোক গিয়ে সরস্বতী নদীর বুকে জেগে ওঠা নতুন সেই দ্বীপে বসতি গড়েছে। দূর-দূরান্তের নানান বসতির বিচিত্র সব জাতির লোকজন সেখানে ভ্রমণ করতে যায়। আর কত কী সামগ্রী যে সেখানে পাওয়া যায়, দেখলে দু-চোখ জুড়িয়ে যায়! কুচদ্বীপ থেকে আমি তোমায় শঙ্খের মাল্য কিনে দেব!’

দেবায়ণীর দু-চোখে যেন স্বপ্নের ঘূর্ণিবায়ু বয়ে যায়! তারও যে ইচ্ছে করে নানা স্থানে ভ্রমণ করতে আর বিচিত্র সব মানুষ দেখতে! তিনি বলেন, ‘তা তুমি দিও, তোমার যা ইচ্ছে তা দিয়ে আমায় সাজিও, যেখানে খুশি নিয়ে যেও। কিন্তু এখন ওঠো তো, সত্যি সত্যিই ঠান্ডা লাগবে তোমার।’

এবার ঝরনা থেকে উঠে আসেন কুথান, ভেজা শরীর মুছে শুকনো পরিচ্ছদ পরিধান করেন। স্নানের পর পথের ক্লান্তিও যেন ধুয়ে যায় জলে, বেশ তরতাজা অনুভব করেন তিনি।

দেবায়ণী বলেন, ‘আর কখনো এমন পাগলামী করবে না, অবেলায় কোথাও যাত্রা করবে না।’

‘আর কারো প্রেমে পড়বার ইচ্ছে আমার নেই, সুতরাং আর কখনো অবেলায় যাত্রা করবার প্রয়োজনও হবে না।’

কুথানের কথা শুনে হাসেন দেবায়ণী। কুথান দেবায়ণীর গলায় মণিবন্ধ পরিয়ে বলেন, ‘এতদিন ধরণীর রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করে মনে হতো বেশ তো আছি, বেঁচে থাকার জন্য ধরণী মন্দ নয়; কিন্তু আজ মনে হচ্ছে এতদিন যে-ভাবে বেঁচে ছিলাম, জীবন তার চেয়েও অধিক সুন্দর, অপূর্ব মায়াময়। যে-দিকেই তাকাচ্ছি, মনে হচ্ছে পূর্বের চেয়ে অধিক সুন্দর; ওই আকাশ সুন্দর, চাঁদ সুন্দর, নক্ষত্ররাজি সুন্দর, বৃক্ষ-অরণ্য সুন্দর, পর্বতশ্রেণি সুন্দর! আশ্চর্য সুন্দর এই ধরিত্রীতে তোমার সাহচর্যে বেঁচে থাকা বড় আনন্দের, বড় সুখের তপস্বিনী!’
রাত্রে রুটি, সবজি, দুধ ও ছানা দিয়ে কুথানকে আপ্যায়ন করেন আশ্রম কন্যারা; কুথানের আহার শেষে কন্যারা আহার করে। সকলের আহার শেষ হলে দেবায়ণী কন্যাদের অলিন্দে আসতে বললে তারা এসে উপবেশন করে, কুথান আগে থেকেই অলিন্দে উপবিষ্ট। প্রদীপের আলোয় একে একে ছয় কন্যার মুখের দিকেই তাকান দেবায়ণী। তারপর বলেন, ‘তোমাদের সঙ্গে আমার কিছু প্রয়োজনীয় কথা আছে, সে-জন্যই তোমাদেরকে আমি ডেকেছি।’

কন্যারা কৌতুহলী হয়ে তাকায় দেবায়ণীর দিকে, তিনি আবার বলেন, ‘তোমাদের কুথান দাদাশ্রীর কণ্ঠস্বর শুনে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে ছুটে গিয়ে তাকে আলিঙ্গন করেছি। তোমরা হয়ত ভাবছ, দিদি একজন তপস্বিনী হয়ে কেন এমনটা করলেন! তোমরা তো জানোই যে তোমাদের দাদাশ্রী আমাকে ভালোবাসেন, আমাকে বিবাহ করতে চান, অতীতে বারবার তিনি আমার কাছে এসেছেন আর আমি তাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিয়েছি। তাকে ফিরিয়ে দেওয়ায় তার যেমনি কষ্ট হয়েছে, তেমনি আমারও কষ্ট কিছু কম হয়নি। তিনি চলে যাবার পর আমি গোপনে অনেক কেঁদেছি। আমিও তাকে ভালোবেসেছি, কিন্তু কখনো তা প্রকাশ করিনি। বাইরে কাঠিন্যের আবরণ রাখলেও ভেতরে ভেতরে আমি তুষারের মতো গলে জল হয়ে গেছি। সত্যি বলতে কী, পুরুষ সম্পর্কে আমার অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়, সমাজ-সংসার নামক উনুনে পুরুষ আমায় নিরন্তর দগ্ধ করেছে এক সময়, তাই তো সমাজ-সংসার ছেড়ে তপশ্চর্যার পথ বেছে নিই। কিন্তু ঈশ্বরের নামে দিব্যি দিয়ে বলতে পারি আমার দেখা সমাজের আর পাঁচজন পুরুষের থেকে তোমাদের দাদাশ্রী একেবারেই ভিন্ন, অন্যরকম। তিনি কাউকে দগ্ধ করতে জানেন না, নিজে দগ্ধ হন। সব বুঝেও আমি তাকে বারবার ফিরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এবার দীর্ঘদিন তিনি আশ্রমে না আসায় আমি হৃদয়ে পীড়া অনুভব করেছিলাম, তার বিরহে আমি ভীষণ কাতর হয়ে পড়েছিলাম, ক্রমশ আমার ভেতরের মতো বাইরের কাঠিন্যও গলে জল হয়ে গেছে, আমি বুঝেছি তাকে ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ। প্রতিদিন আমি তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থেকেছি, তার জন্য চোখের অশ্রু ঝরিয়েছি। তাই এতদিন পর আজ তার কণ্ঠস্বর শুনে আমি নিজের আবেগ সংবরণ করতে পারিনি, পাগলিনীর মতো ছুটে গিয়ে তাকে আঘাত করেছি, তার বুকে মাথা রেখে কেঁদেছি।’

কয়েক নিমেষের জন্য থামেন দেবায়ণী, তরপর আবার বলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাদের দাদাশ্রীকে বিবাহ করব। তোমাদের দাদাশ্রী আগামীকাল বহির্ষ্মতীতে ফিরে যাবেন, তিনদিন পর বসন্ত পূর্ণিমায় তিনি আবার আসবেন আমাকে বিবাহ করতে। আমরা গান্ধর্ব মতে বিবাহ করব একে অন্যকে পুষ্পমাল্য পরিয়ে। তারপর তোমাদের দাদাশ্রীর সঙ্গে তার গৃহে চলে যাব। আমি আজ থেকেই এই আশ্রমের দায়িত্বভার অর্পণ করলাম বৃন্দাকে, সে বুদ্ধিমতী এবং বিচক্ষণ, আমি আশা করি সে সকলের প্রতি সমান দৃষ্টি রেখে আশ্রম পরিচালনা করতে পারবে।’

‘দিদি তুমি আশ্রম ছেড়ে যাবে না, দাদাশ্রীকে বিবাহ করে এখানেই থাকবে। তোমাকে ছাড়া আমরা থাকতে পারব না দিদি।’

বলেই হু হু করে কেঁদে ওঠে বৃন্দা। অন্য কন্যাদের চোখ থেকেও অশ্রু গড়িয়ে নামে, সমাজের অনেক গঞ্জনার থেকে তাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন যে দিদি, সেই দিদি বিনা তারা আশ্রমে কিভাবে থাকবে! অন্য কন্যারাও কেউ শব্দ করে কেঁদে ওঠে, কেউবা নীরবে কাঁদে। দেবায়ণীর আরো কিছু কথা বলবার থাকলেও পরিস্থিতি এমন আবেগঘন হয়ে ওঠে যে কন্যাদের স্বান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া তার আর অন্য কিছু বলা হয়ে ওঠে না।



(চলবে......)


মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ২:২৯

রাজীব নুর বলেছেন: আপনার এই ধারাবাহিকটি আমি প্রথম থেকেই পড়ছি। পড়ে আনন্দ পেয়েছি। উপন্যাসে সুন্দর ভাষা/শব্দ ব্যবহার করেছেন। প্রতিটা চরিত্র সুন্দর করে সাজিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা আপনার উপন্যাসে কোনো ভান বা ভনিতা নেই।

২২ শে নভেম্বর, ২০২২ বিকাল ৫:০০

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, শুরু থেকে সাথে থেকে অনুপ্রেরণা দেবার জন্য।

২| ২৩ শে নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১:৪৬

রাজীব নুর বলেছেন: আমি পড়ি। পড়তে আমার ভালো লাগে।

২৩ শে নভেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৪৯

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.