নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব- সাঁইত্রিশ)

২৫ শে নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:০৬

ত্রিশ

বেণ নৃপতি হবার পর ব্রহ্মাবর্তের আর্যরা একবার মাত্র অনার্যদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, তাও দেবপতি ইন্দ্রের নির্দেশে, বানরদের সঙ্গে। আর বেণ স্বাধীনতা ঘোষণার পরে অনার্যদের সঙ্গে কোনো যুদ্ধ হয়নি, আর্যদের নিজেদের মধ্যেও বড় ধরনের রক্তক্ষয়ী গোষ্ঠীসংঘর্ষ হয়নি। আর্যদের নিজেদের মধ্যে টুকটাক ঝগড়া গণ্ডগোল হয়, অনার্যদের মধ্যেও অন্তর্কোন্দল হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব ঝগড়া-গণ্ডগোলের মীমাংসা করে দেয় আর্যদের গোত্রপতি এবং অনার্যদের সর্দার। কদাচিৎ কখনো কখনো নৃপতি বেণকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। শাসক হিসেবে বেণ যতটা দয়ালু, ঠিক ততটাই কঠোর। যদি কেউ অন্যায় করে; সে যে গোত্রের বা যে জাতির-ই হোক না কেন, তাকে দণ্ড ভোগ করতেই হয়। ফলে দণ্ডের ভয়ে যে কেউ অন্যায় করার আগে দু-বার ভাবে এখন। যে-সব ব্রাহ্মণ উশৃঙ্খল-দুর্বিনীত ছিল, অন্যান্য জাতি বা গোত্রের মানুষকে নিপীড়ন করত, নারীদের ধর্ষণ করত, তাদের কেউ কেউ দণ্ড ভোগ করার পর বাকিরা দণ্ডের ভয়ে সংযত হয়েছে এখন। তিনজন ব্রাহ্মণ ধর্ষককে একশত ঘা বেত্রাঘাত করে গাধার পিঠে চড়িয়ে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন বেণ, তারপর থেকে ব্রহ্মাবর্তে আর কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি, অন্তত তাঁর কাছে কেউ বিচরের দাবী নিয়ে আসেনি। বেণের সাম্রাজ্যে এখন সত্যিকার অর্থে দণ্ড জাগ্রত। আর দণ্ড জাগ্রত আছে বলেই মানুষ সুখে-শান্তিতে আছে।

ব্রহ্মাবর্তে বেশ কয়েক বৎসর যুদ্ধ হয় না, যুদ্ধ হবার মতো পরিস্থিতি তৈরিও হয়নি, তাই বলে যোদ্ধাদের বসে থাকলে চলে না, যোদ্ধাদের নানারকম শরীরচর্চা এবং অস্ত্রবিদ্যার চর্চা অব্যাহত রাখতে হয়, নতুন যোদ্ধা তৈরি করতে হয়, নৃপতির নির্দেশ মতো অস্ত্রও মজুদ রাখতে হয়। কেননা কখন কোন স্বার্থের কারণে এক জাতি আরেক জাতির ওপর কিংবা একই জাতির এক গোত্র আরেক গোত্রের ওপর আক্রমণ করে বসে তার ঠিক কী! ব্রহ্মাবর্তের অন্যসব আর্যগোত্র বা অনার্যজাতির মতো বহির্ষ্মতীর যোদ্ধারাও শরীরচর্চা এবং অস্ত্রবিদ্যার চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। অরুণের আখড়ায় মল্লযুদ্ধ ও তরোবারি প্রশিক্ষণ, দনুর নির্দেশনায় বর্শা ও পাথর নিক্ষেপ, মাধবের নির্দেশনায় অশ্বচালনা, সঞ্জয়ের নির্দেশনায় তীর নিক্ষেপসহ অভিজ্ঞ যোদ্ধাদের নির্দেশনায় সব ধরনের অস্ত্রবিদ্যার চর্চাই অব্যাহত আছে। বেণ মাঝে মধ্যে অপরাহ্ণে প্রশিক্ষণশালায় গিয়ে প্রশিক্ষণ দেখেন আর নিজেও শিক্ষার্থীদেরকে নানারকম কলাকৌশল দেখিয়ে দেন।
তাঁর হৃদয় আজও হাহাকার করে অনূকার জন্য, অনূকা থাকলে ওর প্রশিক্ষণশালা থেকেও দারুণ সব নারী যোদ্ধা তৈরি হতো। কোথায় যে গেল কন্যাটি, ঘোষার আশ্রমে যায়নি, দূত পাঠিয়ে সমগ্র ব্রহ্মাবর্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ওকে পাওয়া যায়নি!

সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মতঙ্গ আর কিশোর পৃথু তাদের পিতার কাছেই অশ্বচালনা ও তীর নিক্ষেপের প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেছে। তারা এখন প্রশিক্ষণশালায় গিয়ে গুরুদের কাছ থেকে নানারকম অস্ত্রবিদ্যার প্রশিক্ষণ নিলেও মাঝে মাঝেই পিতার কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র প্রয়োগ সম্পর্কে পরামর্শ নেয় এবং কৌশল রপ্ত করে। বেণ নিজেই আগ্রহী হয়ে প্রায়শই অপরাহ্ণে দুই পুত্রকে নিয়ে সরস্বতীর পারে যান পরীক্ষা করে দেখতে যে তাদের অস্ত্রশিক্ষা কতটা সঠিক ও নিখুঁত হচ্ছে। বেণ নিজে একজন দক্ষ যোদ্ধা, নানা প্রকার অস্ত্রের প্রয়োগ তিনি জানেন, সমগ্র ব্রহ্মাবর্তে তার মতো দক্ষ অস্ত্রবিদ খুব কম আছে। তাই তিনি চান তাঁর দুই পুত্রও তাঁরই মতো দক্ষ অস্ত্রবিদ, চৌকস যোদ্ধা হয়ে উঠুক।

পৃথুর বয়স কম হলেও সে লম্বায় এখনই প্রায় মতঙ্গ’র সমান হয়ে উঠেছে। মতঙ্গ হয়ত বেণের মতো দীর্ঘকায় হবে না, তার মাতার মতো কিছুটা খর্বকায় হবে। তবে শরীরের গড়ন বেশ মজবুত। এরই মধ্যে বহির্ষ্মতীর অনেক যুবতী-কিশোরী তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। যদিও সে প্রেম করে কেবল একজনের সঙ্গেই,এক ষোড়শী ব্রাহ্মণকন্যা, অনবশা তার নাম। প্রথমদিকে তারা লুকিয়ে প্রেম করত পাহাড়ের টিলায়, যবক্ষেতের আলপথে, অরণ্যে কিংবা ঝিরির পাশে ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে বসে। একদিন যবক্ষেতের আলপথে বসে প্রেম করার সময় দুজন ধরা পড়ে যায় বেণের কাছে, বেণ তখন অন্য এক বসতি থেকে যবক্ষেতের আলপথ দিয়ে হেঁটে বাটীতে ফিরছিলেন। মতঙ্গ আর অনবশা একে-অন্যের ঠোঁটে চুম্বন করার সময় ওদেরকে দেখে ফেলেন বেণ। বেণকে দেখে ওরা একে-অন্যকে ছেড়ে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। বেণ দুজনের কাছে গিয়ে গম্ভীর মুখে দাঁড়ান, মতঙ্গ মাথা নত করে ভূমিতে দৃষ্টি রেখে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, ‘আমাকে ক্ষমা করুন পিতাশ্রী, আমার ভুল হয়ে গেছে।’

বেণ কোনো কথা না বলে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, মতঙ্গ আবারও ক্ষমা চেয়ে পিতার পা ধরতে গেলে বেণ হেসে পুত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর মতঙ্গ’র কপালে চুম্বন করে বলেন, ‘পুত্র তুমি তো কোনো অপরাধ করোনি, ক্ষমা চাইছ কেন! প্রেম-ভালোবাসা তো অপরাধ নয়। তুমি নিজে যদি বোঝো যে তুমি অপরাধ করোনি, তাহলে কখনোই কারো কাছে ক্ষমা চাইবে না। নিজের পিতা-মাতা কিংবা গুরুদেব হলেও না। মনে থাকবে?’

সেদিন পিতাশ্রীকে নতুন করে আবিষ্কার করে মতঙ্গ। ঘাড় নেবে বলে, ‘হ্যাঁ।’ তারপর বৃক্ষের মতো ছায়াশীল পিতাশ্রীর বুকে মাথা রেখে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে ফেলে। বেণ হাত বাড়িয়ে অনবশাকেও বুকে টেনে নিয়ে বলেন, ‘তোমরা কোনো অপরাধ করোনি যে লুকিয়ে লুকিয়ে বিপদজন স্থানে বসে প্রেম করতে হবে। এখানে ভাল্লুক তোমাদেরকে আক্রমণ করতে পারতো। তোমরা নিরাপদ স্থানে বসে প্রেম করবে, অনবশা ব্রাহ্মণকন্যা হলেও আমার জীবদ্দশায় এই ব্রহ্মাবর্তে কারো সাহস নেই যে তোমাদের প্রেমে বাধা দেয়।’

সেদিন থেকেই মতঙ্গ ব্রাহ্মণদের গাত্রদাহ বাড়িয়ে অনবশাকে নিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় বহির্ষ্মতী, এমনকি বহির্ষ্মতীর বাইরের নানা স্থানে।

আজ প্রভাতকালে বেণ দুই পুত্রকে ঘুম থেকে জাগিয়ে সঙ্গে নিয়ে যান সরস্বতীর পারে, পুত্রদের অস্ত্রের পরীক্ষা নিতে আর তাদের অস্ত্র চালনার কৌশলে কোনো ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করে দিতে। মতঙ্গ আর পৃথু দুজনেই পিতার নিকট পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত, দুজনের অঙ্গে মোট কাপড়ের নিবির ওপর পুরু চমড়ার কবচ, পরনে কাপড়ের বাস, বাহুতে চামড়ার বাহুবন্ধনি, দুজনের হাতেই ধাতুর তরবারি আর কাঠের ঢাল। বেণ দু-হাতে তালি বাজাতেই দুজনের লড়াই শুরু হয়, কিছুক্ষণ লড়াইয়ের পর বেণ বোঝেন যে দুজনই ক্ষিপ্র, আক্রমণাত্মক, তবে আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে পৃথু কিছুটা দূর্বল। তিনি দু-বার তালি বাজাতেই দু-ভাই থেমে যায়; দুজনের মাথা, মুখমণ্ডল ও শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরতে থাকে, দুজনই কাপড় দিয়ে মাথা ও মুখের ঘাম মুছে পিতার সামনে এসে দাঁড়ায়। বেণ প্রথমে পৃথুকে বোঝান যে আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে কোন কোন জায়গায় তার দূর্বলতা রয়েছে এবং কোন কৌশলে সেই দূর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে। তারপর পৃথুর হাত থেকে ঢাল আর তরবারি নিজের হাতে নিয়ে মতঙ্গকে বলেন তাঁকে আক্রমণ করতে, মতঙ্গ কথা মতো পিতাকে আক্রমণ করে, বেশ কিছুক্ষণ পিতা-পুত্রের লড়াই চলে। বেণ লড়াইয়ের মাঝেই পৃথুকে মুখে বলে বোঝাতে থাকেন যে কী কৌশল অবলম্বন করতে হবে, নিজের রক্ষণ শতভাগ সুরক্ষিত রেখে কিভাবে প্রতিপক্ষকে আক্রমণে যেতে হবে।

এরপর মতঙ্গ’র কিছু ত্রুটি ধরেয়ে দেন বেণ, লড়াইয়ের সময় কখনো কখনো তার মাথা প্রয়োজনের চেয়ে অধিক বেঁকে যায়, যা বিপক্ষ যোদ্ধাকে সুবিধা করে দিতে পারে।

ত্রুটি শুধরে দেবার পর মতঙ্গ আর পৃথু পুনরায় লড়াই শুরু করে, লড়াইয়ে কেউ কাউকে এতটুকু ছাড় দেয় না। এবার আর তারা পুরোনো ভুল করে না দেখে বেণ ভীষণ খুশি হন এই ভেবে যে পুত্রদ্বয় যথেষ্ট মনোযোগী শিক্ষার্থী, তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছে এবং সফলভাবে প্রয়োগও করেছে। বেশ কিছুক্ষণ লড়াই চলার পর যখন কেউই পরাজয় স্বীকার করে না, কিন্তু দুজনই হাঁফিয়ে ওঠে, তখন দু-বার তালি বাজিয়ে লড়াই শেষের ইঙ্গিত দেন বেণ আর সঙ্গে সঙ্গে লড়াই থামিয়ে দেয় মতঙ্গ আর পৃথু। দুজনই হাতের ঢাল আর তরবারি রেখে ভূমিতে উপবেশন করে, দুজনের বুক ঘন ঘন ওঠা-নামা করতে থাকে। পুত্রদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে গর্বে বুক ভরে ওঠে বেণের, এমন দুটি পুত্রের পিতা হিসেবে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয় তাঁর। দুজনের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বাহুবন্ধনি আর কবচ খুলে রেখে তোমরা ভূমিতে চিৎ হয়ে শয়ন করো পা টান করে, দু-হাত শরীরের পাশে টান রেখে শবাসন করো।’

পিতার নির্দেশ মতো দুজন বাহুবন্ধনি ও কবচ খুলে রেখে ভূমিতে শয়ন করে হাত-পা টান করে। বেণ বলেন, ‘এবার চোখ বন্ধ করো।’

দুজনই চোখ বন্ধ করার পর বেশ কয়েক নিমেষ পেরিয়ে যায়, তারপর বেণ খুব ধীরে ধীরে শান্তস্বরে বলতে থাকেন, ‘শরীর সম্পূর্ণভাবে ভূমিতে ছেড়ে দাও। মনে করো শরীরের ওপর তোমাদের কোনো কর্তৃত্ব নেই, তোমাদের শরীরের সমস্ত ঘাম-ক্লান্তি শুষে নিচ্ছে ভূমি। পাখির পালকের ন্যায় হালকা হয়ে গেছে তোমাদের শরীর আর আস্তে আস্তে ভূমি থেকে শূন্যে ভেসে উঠছে, বাতাসে ভাসছে। ভাসতে ভাসতে পেরিয়ে যাচ্ছে নদী, অরণ্য, পাহাড়। ভূমি থেকে অনেক উপরে শুভ্র মেঘের ভেতর দিয়ে ভাসছে তোমাদের শরীর। মেঘের পরশে তোমাদের শরীর এখন তুষারের মতো শীতল। তোমরা শূন্যে ভেসে চলেছে, অবিরাম ভেসে চলেছ হিমালয় পর্বতের দিকে।’

এই পর্যন্ত বলার পর বেণ চুপ করে থাকেন, কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে তারপর আবার বলতে শুরু করেন, ‘বাতাসে ভাসতে ভাসতে তোমাদের শবীর আবার বহির্ষ্মতীর দিকে ফিরে আসছে, আস্তে আস্তে তোমাদের শরীর নিচের দিকে নেমে আসছে; ধীরে, খুব ধীরে পাপিয়ার খয়েরি পালকের ন্যায় বাতাসে মৃদু দোল খেতে খেতে শরীর নিচের দিকে নেমে আসছে। নেমে আসছে এই পবিত্র সরস্বতী নদীর পারে, খুব সন্তর্পণে শরীর পুনরায় শয়ন করছে ভূমিতে। প্রশান্তি, প্রশান্তিতে তোমাদের শরীর এলিয়ে পড়েছে ভূমিতে।’

এই পর্যন্ত বলে আবার থামেন বেণ। দুই পুত্রের মায়ায় ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন- শিথিল হয়ে পড়ে আছে দুজন, কোনো নড়াচড়া নেই, শরীরের ঘাম শুকিয়ে গেছে, মৃদুমন্দ বাতাসে দুজনের কেশ উড়ছে। পুত্রদের মুখের দিকে তাকিয়ে গর্বে বুক ভরে ওঠে বেণের, এমন দুটি পুত্রের পিতা হবার সৌভাগ্য ক’জনের হয়! দুজনই তাঁর খুব বাধ্য। তিনি প্রথম যখন মতঙ্গকে গৃহে নিয়ে আসেন তখন তাঁর আশঙ্কা ছিল যে পৃথু তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে মেনে নেবে কি না, সম্মান করবে কি না, তার মাতা ও ঠাকুমার কথায় প্ররোচিত হয়ে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে অপমান করবে কি না। কিন্তু বেণের আশঙ্কা সত্য হয়নি, সুনীথা আর হংসপাদা আজও কেশিনীকে মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও মতঙ্গ’র সঙ্গে তারা কখনো দূর্ব্যবহার করেননি, পৃথুর কানে কখনো কুমন্ত্রণা দেননি। ফলে পৃথু জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হিসেবে মতঙ্গকে মেনে নিয়েছে, মতঙ্গ’র কথা সে মান্য করে, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হিসেবে সম্মান করে। যা বেণের জন্য খুব সুখের, স্বস্তির, প্রশান্তির। তিনি চান ওরা দুই ভ্রাতা আজীবন মিলেমিশে থাকুক, তাহলে যে-কোনো প্রতিবন্ধকতা ওরা দূর করতে পারবে।

বেণ এবার পুত্রদের উদ্দেশে বলেন, ‘মতঙ্গ, পৃথু, এবার তোমরা আস্তে আস্তে আঁখি খোলো।’ একটু বিরতি দিয়ে আবার বলেন, ‘শরীরের বামদিকে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বোসো।’

পুত্রদের নিমীলিত চোখের পাতার দিকে তাকান বেণ, ধীরে ধীরে মতঙ্গ’র চোখের পাতা নড়া চড়া করে, ধীরে ধীরে সে উঠে বসে। তার মুখমণ্ডল দেখে মনে হয় যেন সে দীর্ঘক্ষণ নিদ্রায় থাকার পর জেগে উঠেছে!

কিন্তু পৃথুর চোখের পাতার কোনো নড়াচড়া নেই, বেণ পৃথুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন, মতঙ্গও। মৃদু হেসে বেণ মতঙ্গ’র উদ্দেশে বলেন, ‘পৃথু বুঝি নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে, ওর অঙ্গে হাত দিয়ে জাগিয়ে দাও।’

মতঙ্গ পৃথুর কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘পৃথু, ভ্রাতা ওঠো, পৃথু।’
পৃথু চোখ খোলে, নিদ্রার রেশ কাটিয়ে উঠে বসে বলে, ‘আমি পিতাশ্রীর কথা শ্রবণ করছিলাম, কখন যে নিদ্রায় ডুবে গেছি বুঝতেই পারিনি।’
বেণ বলেন, ‘নিদ্রা পেলেও জেগে থাকতে হবে পুত্র। শবাসনের সময় সমস্ত চিন্তা-ভাবনা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের মধ্যে ডুব দিতে হবে, তবেই শবাসনের সুফল মিলবে।’
‘শবাসন করলে কী হয় পিতাশ্রী?’ পৃথু জিজ্ঞাসা করে।

‘শবাসন করলে অনেক সুফল পাওয়া যায়। যেমন-ক্লান্তি দূর করে শরীর সতেজ করে, চিত্তের উদ্বিগ্নতা-উত্তেজনা প্রশমিত করে চিত্তকে শান্ত করে, মানসিক অবসাদ দূর করে। তোমরা আজকের ন্যায় অস্ত্রশিক্ষার পর প্রতিদিন শবাসন করবে। এখন যাও, তোমরা নদী থেকে স্নান করে এসো। আমি গৃহের দিকে যাচ্ছি।’
‘আচ্ছা পিতাশ্রী।’ বলে মতঙ্গ।
‘বেশিক্ষণ জলে থেকো না, ঠান্ডা লেগে যাবে।’
‘ঠিক আছে পিতাশ্রী।’ উঠে দাঁড়ায় মতঙ্গ।

বেণ গৃহের দিকে পা বাড়ান আর মতঙ্গ ও পৃথু সরস্বতীর জলের দিকে। দুজনই সাঁতার জানে, কোমর জলে নেমে পরপর ডুব দেয় দুজনই। হঠাৎ মতঙ্গ অনেকটা দূরে সরস্বতীর স্রোতে ভেসে চলা একটি মৃতদেহ দেখতে পায়, বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে তার, মৃতদেহ দেখলে তার খারাপ লাগে। কার না কার মৃতদেহ, দাহ হয়নি, ভেসে চলেছে জলে, হয়ত মৎস্য আর পশুপাখিতে ভক্ষণ করবে! পিতাশ্রীকে বললে হয়ত মৃতদেহটি দাহ করার ব্যবস্থা করবেন। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বেণের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ডাকে, ‘পিতাশ্রী….পিতাশ্রী…..!’

ফিরে তাকিয়ে উচ্চস্বরে সাড়া দেন বেণ, ‘ডাকছো কেন পুত্র?’
‘দয়া করে একটু এখানে আসবেন পিতাশ্রী? নদীতে একটি মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে।’
‘দাঁড়াও আসছি।’

দ্রুতপদে বেণ পুত্রদের দিকে এগিয়ে এলে মতঙ্গ অঙ্গুলি নির্দেশে তাঁকে মৃতদেহটি দেখায়। বেণ নিচুস্বরে বলেন, ‘আহা, কার বুকের ধন বেঘোরে মারা পড়েছে, একটু অগ্নিও পায়নি! মৃতদেহটি দাহ করার ব্যবস্থা করা উচিত। নৃপতি হিসেবে অচেনা মানুষের মৃতদেহ দাহ করা আমার কর্তব্য, পবিত্র কর্মও বটে। মতঙ্গ তুমি দ্রুত যাও, তোমার প্রভাষ কাকাশ্রী-চক্রধর কাকাশ্রীদের ডেকে নিয়ে এসো।’

‘বেশ, আমি যাচ্ছি।’ মতঙ্গ জল থেকে উঠে প্রভাষের বাটীর উদ্দেশ্যে দৌড়তে শুরু করে।

বেণ তীর থেকে বেশ দূরে সরস্বতীর স্রোতে ভেসে যেতে থাকা মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে থাকেন, নগ্ন মৃতদেহটি উল্টে আছে, মাথার প্রায় পুরো অংশ আর পা ডুবে আছে জলে, পিঠটা ভেসে আছে জলের ওপর। প্রভাষদের জন্য অপেক্ষা করলে স্রোতের টানে মৃতদেহটি অনেক দূরে চলে বলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন নিজেই মৃতদেহটি তীরে তুলে আনার, তারপর প্রভাষরা এলে দাহ করা যাবে।

মতঙ্গ আর পৃথুর রেখে দেওয়া দুটি তরবারির একটি হাতে নিয়ে বেণ সরস্বতীপারের ঝোপঝাড় থেকে মোটা দুটি বুনো লতা কেটে পাতা ছাড়িয়ে ফেলেন, তারপর তরবারি পূর্বের স্থানে রেখে লতা দুটো নিয়ে জলে নামতে নামতে কোমর জলে দাঁড়িয়ে থাকা পৃথুর উদ্দেশে বলেন, ‘তুমি অপেক্ষা করো পুত্র, আমি মৃতদেহটি তীরে নিয়ে আসি।’
‘আমিও তোমার সঙ্গে আসবো পিতাশ্রী?’
‘না, তোমাকে আসতে হবে না।’
‘তুমি পারবে একা?’
‘হ্যাঁ, পারব, তুমি চিন্তা কোরো না, অপেক্ষা করো।’

বেণ জলে সাঁতার দেন, মৃতদেহের কাছে গিয়ে বুঝতে পারেন যে দেহটি বেশ ফুলে উঠেছে, দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। হাতদুটো জলের ভেতর দু-দিকে ছড়ানো, পা দুটোও। তিনি মৃতদেহের ডানবাহু লতা দিয়ে বন্ধন করেন, তারপর লতা ধরে মৃতদেহ টানতে টানতে সাঁতরাতে থাকেন। দূর্গন্ধে তাঁর দম নিতে কষ্ট হয়, তবু তিনি মৃতদেহটিকে সরস্বতীর বুকে ছেড়ে যেতে সম্মত নন, সৎকার করতে চান। বুক জলে এসে ভূমিতে দাঁড়িয়ে কয়েক নিমেষ জিরিয়ে আবার লতা ধরে টানতে টানতে জলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকেন।

পৃথু বলে, ‘পিতাশ্রী উনি কি জলে ডুবে মৃত্যুবরণ করেছেন?’
‘তা নিশ্চিত করে বলা যায় না; হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে।’

মৃতদেহটি একেবারে তীরের কাছাকাছি টেনে এনে শক্ত ফোল ডানহাত ধরে উল্টে দিতেই চমকে ওঠেন বেণ, পেটে এখনো বিঁধে রয়েছে একটি ধাতুর ছুরি, আশপাশে আরো কয়েকটি কোপের ক্ষতচিহ্ন! মৃতদেহের মুখের দিকে তাকাতেই বজ্রের আঘাতে আহত মানুষের ন্যায় তীব্রস্বরে আর্তনাদ করে ধপাস করে জলের মধ্যে বসে পড়েন বেণ।



(চলবে.....)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ২:৫৩

রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর।

২৫ শে নভেম্বর, ২০২২ রাত ৯:৫৫

মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.