নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
বত্রিশ
কেশিনীর মামাতো ভ্রাতা সুনদের বিবাহ-উৎসবে যোগ দিতে বেণ, কেশিনী, মতঙ্গ আর পৃথু চারজন চারটে অশ্বে আরোহণ করে যাত্রা করে নিষাদপল্লীর উদ্দেশ্যে। বরাবরের মতো এবারও সুনীথা এবং হংসপাদাকে যেতে অনুরোধ করেন বেণ ও কেশিনী, কিন্তু কিছুতেই যেতে সম্মত হননি তারা। কিছুদিন পূর্বে কেশিনীর মামাশ্রী এবং মামী এসেছিলেন তাদের পুত্রের বিবাহের নিমন্ত্রণ করতে, সুনীথা আর হংসপাদাকে বিবাহ-উৎসবে যাবার জন্য এবং তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা রাখতে করজোড়ে বিনীত অনুরোধ করেন তারা। কিন্তু সুনীথা আর হংসপাদার মন গলেনি, তাদের ভাষায় কুৎসিত দর্শন আর কদর্য সংস্কৃতির নিষাদরা কখনোই আর্যদের আত্মীয় হবার যোগ্য নয়, তাই তাদের গৃহে পা রাখতেও চান না তারা।
বেণের স্ত্রী হিসেবে বহির্ষ্মতীতে আসার পূর্বে কেশিনী অশ্বে আরোহণ করতে পারতেন না, বেণ তাকে শিখিয়েছেন, এখন অশ্ব চালনায় দারুণ দক্ষ তিনি। অনেকদিন পর মামাশ্রীর গৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করায় কেশিনী খুব আনন্দচিত্তে আছেন, একে তো আপনজনদের কাছে পাবেন, তার উপর আবার মামাশ্রীর কনিষ্ঠ পুত্র সুনদের বিবাহ, এবারের আনন্দ যেন দ্বিগুণ! কেশিনী বেণের নিকট অনুরোধ করেছেন এবার পুত্রদের নিয়ে বেশ কিছুদিন মামাশ্রীর গৃহে অতিবাহিত করার, পিতৃগৃহ তো আর নেই, মামাশ্রী আর তার পরিবারের লোকেরাই কেশিনীর সব, বেণ সম্মতি দিয়েছেন। বেণ হংসপাদাকে যতটা ভালোবাসেন, কেশিনীকে তার চেয়ে কিছু কম ভালোবাসেন না। বরং কেশিনীর প্রতি তাঁর একটু বাড়তি মমত্ববোধ রয়েছে একারণে যে অনেককাল পূর্বে তারাই আক্রমণ করে কেশিনীকে পিতৃ-মাতৃহীন করেছেন, এছাড়া কেশিনীর মধ্যে কোনো জটিলতা-কুটিলতা নেই, সুনীথা এবং হংসপাদা তাকে অবহেলা করলে কিংবা কটুবাক্য বললেও তিনি নীরবে সহ্য করেন, পতির নিকট শাশুড়ি-সতীনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেন না। কোনো কারণে দুঃখ পেলে অভিমান করে কথা বলা বন্ধ করেন না, সংকটেও ভেঙে না পড়ে এমন শান্ত আর স্বাভাবিক থাকেন যেন মনে হয় দুঃখ কিংবা সংকট তার অন্তর স্পর্শ-ই করতে পারে না। বেণের সঙ্গে বিবাহের পর কেশিনী একবার গর্ভবতী হয়েছিলেন, একটি মৃতপুত্র প্রসব করেছিলেন, তারপর অনেক চেষ্টার পরও আর গর্ভবতী হতে পারেননি, এ বিষয়েও তাকে কখনো দুঃখ করতে দেখা যায়নি।
তারা বহির্ষ্মতী পিছনে ফেলে এসেছেন অনেকক্ষণ পূর্বেই, দু-দিকের উঁচু পাহাড়ের মধ্য দিয়ে হাত তিনেক চওড়া পথ নেমে গেছে নিচের দিকে, পথের দু-দিকে কুশ ঘাস আর সবুজ লতা-পাতার ঝোপঝাড়। পথের বাঁক ঘুরতেই তরুণ বণিক বীতু পণির সঙ্গে দেখা, সে দুটো গাধার পিঠে পণ্যের বোঁচকা চাপিয়ে আরেকটি গাধার পিঠে নিজে আরোহণ করে চলেছে বহির্ষ্মতী এবং অন্যান্য আর্য বসতিতে পণ্য বিক্রির উদ্দেশ্যে। ব্রহ্মাবর্তের পশ্চিম প্রান্তে তার বসতি। সে এবং তার মতো আরো কয়েকজন বণিক আছে, যারা পাতাল থেকে নানা প্রকার পণ্য ক্রয় করে এনে ব্রহ্মাবর্তের বিভিন্ন আর্য বসতিতে বিক্রয় করে। আর্যরা গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতির বিনিময়ে তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করে থাকে এসব পণি বণিকদের নিকট থেকে। বেণকে দেখেই বীতু গাধার পিঠ থেকে ভূমিতে নেমে করজোড়ে বলে, ‘প্রণাম নৃপতি, প্রণাম মহিষী।’
বেণ অশ্ব থামিয়ে ডানহাত উঁচু করেন; তিনি অশ্ব থামানোয় কেশিনী, পৃথু আর মতঙ্গকেও অশ্ব থামাতে হয়। বীতু তাদের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে আবার বেণের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে বলে, ‘কোথায় চললেন নৃপতি, মনে হচ্ছে নিষাদপল্লী?’
বেণ বলেন, ‘হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ।’
‘এবার পাতাল থেকে অনেক সুন্দর সুন্দর পণ্য এনেছি, দূর্ভাগ্য আমার যে আপনাদের কাছে কিছুই বিক্রয় করতে পারব না।’ বীতুর কণ্ঠে আক্ষেপ ঝরে পড়ে।
‘পরের বার এসো বীতু, তখন নিশ্চয় ক্রয় করব।’
‘বেশ, আপনাদের যাত্রা শুভ হোক।’ আবারও বেণ ও কেশিনীকে প্রণাম করে বীতু।
‘তুমিও সাবধানে যেও।’
বীতুকে অতিক্রম করে আবার সামনে এগিয়ে যান বেণ, কেশিনী এবং পুত্রদ্বয়। অনেকটা পথ পেরোনোর একটি পর্বতের পাদদেশে স্বচ্ছ জলের ঝিরির পাড়ে যাত্রা বিরতি দেন বেণ। অশ্বগুলো বৃক্ষের সঙ্গে বেঁধে সবাই ঝিরির জল থেকে হাত-মুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হন। বেণ এবং কেশিনী উপবেশন করেন ঝিরিলগ্ন উঁচু ভূমির দূর্বাঘাসের ওপর। মতঙ্গ কদলীগাছের পাতা কেটে ঝিরির জলে ধুয়ে নিয়ে আসে, আর চামড়ার থলেগুলোয় ঝিরির জল ভরে আনে পৃথু। কেশিনী সঙ্গে আনা আহার সামগ্রী পোটলা থেকে বের করে সবার পাতায় বেড়ে দেন- যবের রুটি, হরিণের শুকনো মাংস, মধু আর যবাশীর পিঠা। আহার করতে করতে বেণ হঠাৎ উদাস হয়ে পড়েন, তা দেখে কেশিনী বলেন, ‘কী হলো তোমার? আহার করছ না যে?’
বেণের চোখ ছলছল করে ওঠে, বুকচেঁড়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘এই স্থানে এসে কুথানকে খুব মনে পড়ছে, কতদিন এই ঝিরির পাশে বিশ্রাম নিয়েছি আমরা, এমনিভাবে বসে আহার করেছি!’
মতঙ্গ আর পৃথু পিতার দিকে তাকায়, ওদেরও বুকের ভেতর হুহু করে ওঠে কুথান কাকাশ্রীর জন্য, কাকাশ্রী ওদের দুজনকেই ভীষণ আদর করতেন। বেণ আহার করতে করতে তাঁর আর কুথানের একসঙ্গে কাটানো সময় আর নানা ঘটনার স্মৃতিচারণ করেন।
আহার শেষ হলে আবার অশ্বের পৃষ্ঠে আরোহণ করে যাত্রা শুরু করে সবাই।
ধনদের গৃহ আজ উৎসব মুখর, তার কনিষ্ঠ পুত্র সুনদের বিবাহ উপলক্ষে পাড়া-পড়শী এবং আত্মীয়স্বজন এসেছে; সবাই হইচই, পানাহার আর নৃত্যগীতে মত্ত। সুনদ ভালোবেসে বিবাহ করছে এক আর্যকন্যা পুলোমাকে, বেণ স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বে হলে একজন নিষাদপুত্রের পক্ষে একজন আর্যকন্যাকে বিবাহ করা দূরে থাকুক, বিবাহের প্রস্তাব দিলে কিংবা গোপনে কোনো আর্যকন্যার সঙ্গে প্রেম করলেই যুদ্ধ লেগে যেত, নিষাদদের বসতি পুড়িয়ে তাদেরকে উৎখাত করত আর্যরা। কিন্তু ব্রহ্মাবর্ত স্বাধীন হবার পরে সেই দিন আর নেই, বেণের অনুশাসন অনুযায়ী কোনো নারী বা পুরুষ স্বেচ্ছায় যদি অন্য কোনো গোত্র বা জাতির নারী বা পুরুষকে বিবাহ করে এতে পরিবার বা সমাজ কোনো বাধা দিতে পারবে না। ফলে এখন অনার্যদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যেমনি বিবাহ হয়, তেমনি আর্য এবং অনার্যের মধ্যেও বিবাহের প্রচলন হয়েছে। আর্য কন্যারা তো অনার্য পণি বণিকদেরকে বিবাহ করার জন্য রীতিমতো মুখিয়ে থাকে! কিছু কিছু আর্য পিতামাতাও পণি বণিক বা বণিকপুত্রের সঙ্গে কন্যার বিবাহে আপত্তি করে না, কেননা পণি বণিকদের অবস্থা স্বচ্ছল, তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত।
নিষাদদের বিবাহ পদ্ধতি যাজ্ঞিক আর্যদের মতো নয়, অগ্নিসাক্ষী রেখে অগ্নি প্রদক্ষিণ করে তারা বিবাহ করে না। বেণ যজ্ঞ নিষিদ্ধ করলেও বিবাহ পদ্ধতির ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করেননি। ফলে কোনো যাজ্ঞিক আর্য যদি অগ্নি প্রদক্ষিণ করে বিবাহ করতে চায়, করতে পারে; আবার গান্ধর্বমতে পাত্র-পাত্রী নিজেদের মধ্যে মাল্য বিনিময় করেও বিবাহ করতে পারে। সুনদ আর পুলোমার বিবাহ গান্ধর্বমতেই হবে। ব্রহ্মাবর্তে ক্রমশ গান্ধর্ববিবাহ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, পাত্র-পাত্রী স্বেচ্ছায় নিজের পছন্দের পাত্র বা পাত্রীকে বিবাহ করছে। অনেক ঋষিও গান্ধর্ব বিবাহকে উত্তম বিবাহরীতি বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
সন্ধ্যার পর পর মাল্য বিনিময় করে সুনদ-পুলোমার বিবাহ সম্পন্ন হয়, কিন্তু উৎসব চলে গভীর রাত্রি পর্যন্ত। আহারের পর মতঙ্গ আর পৃথুকে নিয়ে কেশিনী আঙিনায় উপবেশন করে নৃত্যগীত উপভোগ করেন গভীররাত্রি পর্যন্ত, নৃত্যগীত উপভোগ করতে করতে একসময় পৃথু নিদ্রাকাতর হয়ে ঝিমুতে শুরু করলে কেশিনী দুই পুত্রকে নিয়ে শয্যায় যান।
অন্যদিকে নৃত্যগীতের আসর থেকে উঠে বেণ অনেক আগেই নিষাদ সর্দার বঙ্কলের গৃহের অলিন্দে মদ্যপান করতে বসেন। সোমরস নয়, নিষাদদের তৈরি এক বিশেষ ধরনের মদ্য, সোমরসের মতো কোমল নয়, একটু কড়া, নেশাও হয় সোমরসের চেয়ে অধিক। বেণের এখনো ভালো মতো নেশা হয়নি, নেশা বেশি হবার আগেই কাজের কথাটি তোলেন তিনি; ব্রহ্মাবর্তের সকল আর্য, নিষাদ, রাক্ষস, পণি, কিরাত ও নাগ গোত্র থেকে চৌকস যুবকদের বাছাই করে যৌথ সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলার কথা। শুনে সানন্দে সম্মতি দেন বঙ্কল, ‘এ তো খুবই ভালো সংবাদ নৃপতি! এমন একটি সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলতে পারলে আমরা সকলেই নিরাপদে বসবাস করতে পারব। আপনি যতজনকে চাইবেন আমি ততজন যুবককেই আপনার হাতে সমর্পণ করব।’
‘আপাতত তুমি আমাকে দুইশোজন যুবককে দাও সর্দার, এদেরকে দক্ষ যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তুলি, তারপর প্রয়োজন বুঝে আবার চাইবো।’ চষকে চুমুক দেন বেণ।
‘বেশ, তাই দেব, তবে আরো অধিক যুবককে প্রয়োজন হলে আপনার যখন ইচ্ছে আমাকে আদেশ করবেন।’
‘নিশ্চয়। এখন থেকে আমরা সম্মিলিতভাবে পথ চলব। দেবগণ, ঋষিগণ ও ব্রাহ্মণগণ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন আমাকে উৎখাত করার জন্য। সম্মিলিত শক্তি ব্যতিত তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীনতা স্থায়ীভাবে রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন হবে।’
‘আপনি আমাদের জীবন বদলে দিয়েছেন নৃপতি, সম্মান দিয়েছেন, আপনার জন্য আমরা জীবন দিতেও প্রস্তুত আছি।’
‘শুনে অত্যন্ত আনন্দ বোধ করছি সর্দার, নতুন ব্রহ্মাবর্ত গড়তে আমি সর্বদা তোমাদের সহযোগিতা চাই।’
দুজনেরই নেশা বাড়তে থাকে, বেণ ব্রহ্মাবর্ত নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা বলতে থাকেন আর মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকেন বঙ্কল।
গভীর রাত্রে শয্যায় যাবার কারণে বেণের নিদ্রাভঙ্গ হয় বেশ বেলায়, তখন চারিদিকে রোদ ঝলমল করছে, লোকজন কর্মব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তিনি শয্যা ত্যাগ করে নিষাদপল্লীর পথে কিছুক্ষণ বিলম্বিত প্রাতঃভ্রমণ আর পথ চলতি লোকজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন, ফিরে এসে প্রাতঃকৃত্য সেরে পুলোমার অনুরোধে প্রাতঃরাশ করতে বসেন। নববধূ পুলোমা নদদ-জামাইয়ের পাতে বেড়ে দেন যবের রুটি আর হরিণের মাংস। একপাত্র কাটা ফল, ছানা, দুগ্ধ আর জল রাখেন পাতের পাশে। পুলোমা কাছে উপবেশন করে আহার করান বেণকে। কেশিনী এবং অন্য কয়েকজন আত্মীয়রা অদূরে কেউ দাঁড়িয়ে, কেউবা উপবেশন করে দেখেন বেণের আহার। কেউ কেউ রসিকতাও করেন, বেণও রসিকতার উত্তর দেন রসিক বাক্যেই।
আহার শেষে বেণ বহির্ষ্মতীতে ফিরবার জন্য তৈরি হন। কেশিনী এখনই বহির্ষ্মতীতে ফিরবেন না, পূর্বের দাবী অনুযায়ী তিনি মামাশ্রীর গৃহে আরো কয়েকটা দিন থাকবেন, সঙ্গে থাকবে দুই পুত্র। বেণকে বিদায় জানাতে নির্ষাদ সর্দার বঙ্কল এবং নিষাদপল্লীর আরো অনেক নারী-পুরুষ ছুটে আসে, বঙ্কল এবং আরো কয়েকজনের সঙ্গে বেণের বাক্য বিনিময় হয়। অশ্বে আরোহণের পূর্বে বেণ মতঙ্গ আর পৃথুর কপালে চুম্বন করে বলেন, ‘বেশি দুষ্টুমি করবে না তোমরা, মাতার কথা শুনবে।’
দুজনেই সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে, বেণ দুজনের কেশ এলোমেলো করে আদর বুলিয়ে দেন।
তারপর সুনদের উদ্দেশে বেণ বলেন, ‘সপ্তাহ খানেক পর তোমার ভগিনী আর ভাগ্নেদের পৌঁছে দিও ভ্রাতা, পুলোমাকেও সঙ্গে নিও, কয়েকটা দিন থেকে আসবে।’
সুনদ বলেন, ‘আপনি আর দুটো দিন থেকে গেলেই পারতেন জামাইবাবু।’
‘এখন থাকবার মতো সময় নেই ভ্রাতা, অনেক কাজ পড়ে আছে। হাতের কাজ গুছিয়ে সময় করে আবার পরে আসবো।’
সবশেষে বেণ কেশিনীকে মৃদু আলিঙ্গন করে অশ্বে আরোহণ করলে পুলোমা যাত্রাপথের জন্য কিছু আহার সামগ্রী আর জলের থলে বাড়িয়ে দেন বেণের দিকে, বেণ হাসিমুখে গ্রহণ করে সকলের উদ্দেশে হাত নেড়ে যাত্রা শুরু করেন।
এক দণ্ড পর বেণ পণিপল্লীর সর্দার কেষ্ট’র বাটীতে পৌঁছান। মৃত্তিকা আর পাথরের দেয়াল গেঁথে তৈরি চমৎকার বাটী কেষ্ট’র। পাতালের পণিদের মতো না হলেও এই পণিপল্লীটি যথেষ্ট উন্নত, অধিকাংশ মানুষই কোনো না কোনো বাণিজ্য করে, সকলেরই অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল। কেষ্ট মহা সমাদর করে বেণকে গৃহে নিয়ে উপবেশন করান, নানা প্রকার আহারাদি দিয়ে আপ্যায়ন করা হলেও বেণের ক্ষুধা না থাকায় কেবল ভদ্রতাবশত তিনি সামান্য কিছু মুখে দেন। তারপর পণি সর্দার কেষ্ট’র সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন সৈন্যবাহিনী গঠনের ব্যপারে। কেষ্ট সৈন্য প্রদানসহ সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস দেন বেণকে। এরপর কেষ্টকে নিয়ে বেণ যান পণি অস্ত্রবণিক সতু’র নিকট, ধাতুর অস্ত্র ক্রয়ের ব্যাপারে কথা হয় সতু’র সঙ্গে। সতু প্রথম পর্যায়ে এক মাসের মধ্যে কিছু অস্ত্র দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন, এরপর পর্যায়ক্রমে আরো অস্ত্র দেবেন চাহিদা অনুযায়ী। বৈঠক শেষে কেষ্ট এবং সতু’র নিকট থেকে বিদায় নিয়ে বেণ অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে যাত্রা শুরু করেন বহির্ষ্মতীর উদ্দেশ্যে।
বেণের অশ্ব ছুটে চলে উপত্যকার পথ ধরে কখনো টগবগিয়ে কখনোবা দুলকি চালে সবুজ চারণভূমি আর অরণ্যের ভেতর দিয়ে, নদীর পার ধরে, ঝিরি অতিক্রম করে; কখনো মাথার উপর উন্মুক্ত আকাশ, আবার কখনো গভীর অরণ্যের ঘন ছায়া।
অনেকটা পথ পেরোনোর পর একটা ঝিরির কাছে এসে অশ্ব থেকে নেমে অশ্বকে জল পান করিয়ে একটি দেবদারু বৃক্ষের সঙ্গে বেঁধে নিজের আহারের পুঁটলি আর জলের থলে নিয়ে তৃণভূমির ওপর উপবেশন করেন। পুঁটলি খুলে যবের রুটি আর হরিণের মাংস আহার করে ঝিরি থেকে হাত ধুয়ে জল পান করেন। তারপর আবার উপবেশন করে ঝোলা থেকে একটা ফল বের করে তাতে দাঁত বসান। ফলাহার শেষে হাত ধুয়ে আবার অশ্বের পৃষ্ঠে আরোহণ করেন। বিশাল চারণভূমি আর তারপরের উপত্যকা পেরিয়ে অরণ্যে প্রবেশ করে বেণের অশ্ব। চারিদিকে ছোট-বড় অজস্র বৃক্ষের সমাহারে শোভিত ছায়াময় অরণ্য, বৃক্ষাদি আর পুষ্পের সুবাসে সুরভিত। দুলকি চালে চলতে থাকে অশ্ব।
হঠাৎ তীব্রবেগে একটা তীর এসে বেণের শরীরের নিবি ভেদ করে বুকের বামপাশে বিদ্ধ হয়, তাঁর সারা শরীরে যেন ভূমিকম্পন হয়ে যায়, তীরবিদ্ধ ক্ষতস্থান থেকে তীব্র বেগে বের হতে থাকে রক্ত। তবু তিনি রজ্জু ধরে অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে থাকার চেষ্টা করেন, চেষ্টা করেন অশ্বের গতি বাড়াতে যাতে দ্রুত অরণ্য পেরিয়ে বহির্ষ্মতীতে পৌঁছতে পারেন। ঝোপের মধ্য থেকে আসা একা বর্শা তীব্র বেগে তার মাথার পাশ দিয়ে চলে যায়। পরক্ষণেই প্রায় একই ক্ষণে একঝাঁক তীর ধেয়ে আসে তার দিকে যার মধ্যে কয়েকটি তীর তাঁর আশপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলেও তিনটি তীর গেঁথে যায় তাঁর বুক ও পেটে, তারপর আরো দুটি! তবুও তিনি শক্তহাতে রজ্জু ধরে থাকেন, কিন্তু অশ্বের শরীরে পর পর তিনটি তীর বিদ্ধ হলে অশ্ব তীব্র যন্ত্রণায় লাফিয়ে ওঠে আর বেণ ছিটকে পড়ে যান ভূমিতে। দ্গ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অশ্ব ছুটে যায় বেণকে রেখেই। বেণের পক্ষে যতটা তাড়াতারি সম্ভব তিনি উঠে দাঁড়ান, তাঁর শরীর কাঁপতে থাকে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়, বুক-পেট ভেসে যায় রক্তের ধারায়, গড়িয়ে নামে পা বেয়ে ভূমিতে। মনে সাহস এনে বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় সামনের দিকে পা বাড়ান তিনি, বাঁচতে যে তাঁকে হবেই, সামনে অনেক কাজ পড়ে আছে, এখনই মৃত্যুকে বরণ করবার সময় কোথায় তাঁর! মাত্রই কয়েক বৎসর হলো দেব-ব্রাহ্মণদের থাবা থেকে ব্রহ্মাবর্তকে মুক্ত করেছেন, সমাজিক বৈষম্যমুলক ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর মনুর বিধানসমূহ এবং ফলশূন্য যজ্ঞ নিষিদ্ধ করেছেন। সমাজে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন অনেক আইন চালু করেছেন। এখনো কত কাজ বাকি, অনাগত কালের জন্য সমাজটাকে সুন্দরভাবে গঠন করতে হবে। পুরোনো ব্রাহ্মণ্যবাদী দুঃশাসন যাতে সমাজে আর কোনোদিন ফিরে না আসে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। কত কী করার বাকি আছে এখনো! কিন্তু এখন তাঁর মৃত্যু হলে সব বিনষ্ট হবে, সুশাসনের যে বীজ তিনি রোপন করেছেন ব্রহ্মাবর্তের ভূমিতে, অনেক যত্নে তাকে মহীরুহ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তিনি ব্যর্থ হলে যে মানবজাতি অনন্তকালের জন্য ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে! না, না, তাঁকে বাঁচতেই হবে, টলতে টলতে সামনে পা বাড়ান তিনি। কিন্তু আবারো কয়েকটি তীর গেঁথে যায় তাঁর বুক, পাঁজর ও তলপেটে। তাঁর নাক-মুখ থেকে রক্ত বের হতে থাকে, মাথা ঘুরতে থাকে, সারা শরীর কাঁপতে থাকে, ভূমিতে চিৎ হয়ে পড়ে যান তিনি। আর উঠবার শক্তি তাঁর নেই, তাঁর পরিণতি কী হতে চলেছে তা বুঝতে পারেন তিনি। তাঁর মনোশ্চক্ষে ভেসে ওঠে বহির্ষ্মতীর বসতি, ব্রহ্মাবর্তের মেঘাবৃত পর্বতশ্রেণি, সবুজ অরণ্য, যবক্ষেত আর চারণভূমি, মাতার মতো মমতাময়ী সরস্বতী নদী, বৃক্ষরাজি আর ব্রহ্মাবর্তের নানা জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের মুখ। ঠিক তখনই তিনি দেখতে পান দশ-বারোজন মানুষ তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, একে একে সবার মুখের দিকে তাকান তিনি, সবারই মুখে লম্বা লম্বা দাড়ি-গোঁফ, বাদামী বর্ণের কেশ আর জটা চুড়ো করে বাঁধা, গলায়-বাহুতে রুদ্রাক্ষের মালা, কারো হাতে তীর-ধনুক, কারো হাতে বর্শা, কারো হাতে ত্রিশূল। এদের সবাই তাঁর পরিচিত, একদিন তিনিই এই মানুষগুলোর মুখে আহার যোগাতেন! কয়েকজন তীর-ধনুক তাক করে তাঁর দিকে, একযোগে ছুটে আসা তীরের আঘাতে ভূপতিত শরীর কেঁপে ওঠে। আর কয়েক নিমেষ পরেই কব্জিতে রুদ্রাক্ষের মালা জড়ানো দু-হাতের মুঠোয় ধরা একটি ত্রিশূল হঠাৎ ঈষৎ উপরে উঠে পরক্ষণেই নেমে আসে নিচের দিকে।
নৃপতি বেণের মনে হয় পাখির কলকাকলি আর ঝিঁঝির ডাক থেকে তিনি বহু দূরে চলে যাচ্ছেন, তাঁর সামনের শ্যাওলা পড়া পাথরের মতো মুখগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে, সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে, তাঁর মনে হয় ব্রহ্মাবর্তে অন্ধকার নামছে, অন্ধকার নামছে মানবজাতির জীবনে! আর কোনো শব্দ তাঁর কানে আসে না, তাঁর দু-চোখ আর কোনো রঙ দেখতে পায় না। পাথরের মূর্তির মতো হন্তারকেরা চলে যাবার পর হলুদ রঙের ওপর কালোর ছিটাসমৃদ্ধ বেশ বড় একটা প্রজাপতি উড়তে উড়তে এসে বসে বেণের বুকের ওপর, কয়েক নিমেষ ডানা ঝাপটায়, তারপর উড়ে যায় প্রজাপতিটা, উড়তে উড়তে ভূমি থেকে অনেক উপরে উঠে যায়, উড়তেই থাকে, উড়তেই থাকে!
২৭ শে নভেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৫২
মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনার অনুপ্রেরণার জন্য। প্রকাশ হলে নিশ্চয় জানাবো।
২| ২৯ শে নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১:২৭
রাজীব নুর বলেছেন: হ্যাঁ জানাবেন। আমি অপেক্ষায় থাকবো।
৩০ শে নভেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৪৫
মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ২৭ শে নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১:৫৭
রাজীব নুর বলেছেন: জাস্ট গ্রেট।
অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর।
পড়ে খুবই ভালো লেগেছে। এখন আরেকবার পুরোটা একসাথে পড়তে চাই। প্রকাশ হওয়ার পর আমাকে জানবেন। আমি সংগ্রহ করে নিবো।