নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিটন আলম

মিটন আলম › বিস্তারিত পোস্টঃ

কারমাইকেল কলেজের ভাস্কর্য ‘প্রজন্ম’ ইতিহাস

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:১৯

কারমাইকেল কলেজের ভাস্কর্য ‘প্রজন্ম’ ইতিহাস





‘প্রজন্ম’ ভাস্কর্য কারমাইকেল কলেজের তথা উত্তরবঙ্গের অনন্য সাধারণ শিল্পকর্ম। ‘প্রজন্ম’ ভাস্কর্য আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সৌর্য-বীর্যের প্রতীক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার অহংকারের স্মারক।



উত্তরের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত কারমাইকেল কলেজের প্রধান ফটক পেরিয়ে প্রায় শতাব্দী প্রাচীন দেবদারু গাছের সারি, এশিয়ার দূর্লভ প্রজাতির গাছ ‘কাইজেলিয়া’ ছেড়ে দেবদারু বন (কল্পিত বৃন্দাবন) ডানে মোড় ঘুরে ২০/২৫ গজ এগিয়ে গেলে মূল ভবন সংলগ্ন চোখে পড়বে প্লাস্টার অব প্যারিসের ধবধবে সাদা প্রলেপ দেয়া সদম্ভে দাঁড়ানো ভাস্কর্য ‘প্রজন্ম’। রাইফেল হাতে দাঁড়ানো মুক্তিযোদ্ধার কাঁধে একটি শিশু। শিশুটি পতাকা হাতে নিয়ে যেন এ প্রজন্মের সকলের প্রতিনিধিত্ব করছে। আর যেন চিৎকার করে আহ্বান করছে, ‘এসো সত্যিকারের সোনার বাংলা গড়ি’।



মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে রংপুরের সাহসী মানুষ তীর-ধনুক, লাঠিসোটা আর কিছু পুরানো আমলের থ্রি নট থ্রি রাইফেল সম্বল করে ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে। আধুনিক মারণাস্ত্রধারী পেশাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে অসমযুদ্ধে অসংখ্য বাঙালি ও এ অঞ্চলের উপজাতি সাঁওতাল, ওরাঁও স¤প্রদায়ের মানুষ হতাহত হয়। কিন্তু নাড়া দেয় মুক্তিকামী মানুষকে যে, শোষণ-বঞ্চণা থেকে রক্ষার জন্য স্বাধীনতার বিকল্প নেই। স্বাধীনতার জন্য কারমাইকেল কলেজের ৬ জন শিক্ষক-কর্মচারী ও নির্বাচিত ছাত্র সংসদের ভিপি খন্দকার মোশতাক এলাহী সহ অসংখ্য স্বাধীনতাকামী মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানী বাহিনী। এ নির্মম ঘটনাগুলো ছাত্র-শিক্ষক ও আপামর জনসাধারণকে অত্যন্ত ব্যথিত করে।



মুক্তিযুদ্ধের স্মারক নির্মাণের জন্য ‘শব্দকণ্ঠ’ নামে কারমাইকেল কলেজের সাংস্কৃতিক সংগঠন ১৯৯০ সালে উদ্যোগ গ্রহণ করে ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য শিক্ষক-ছাত্রের সমন্বয়ে তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. রেজাউল হকের নেতৃত্বে ভাস্কর্য নির্মাণ কমিটি গঠিত হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত কথাশিল্পী ও শিক্ষাবিদ জনাব হাসান আজিজুল হক ভাস্কর্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন স্থাপন করেন। সেটি প্রগতিবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র রাতের আঁধারে গুড়িয়ে দেয়। ২০০৯ সালে ভাস্কর্য নির্মাণ বাস্তবায়নের দাবী আবারও জোরদার হয়। ২০১০ সালের মাঝামাঝি প্রফেসর এবিএম রমজান আলীকে আহ্বায়ক করে ভাস্কর্য নির্মাণ বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে এম ফিল করা মেধাবী ভাস্কর শ্যামলী নাসরিন এঁর নেতৃত্বের একদল ভাস্করের নিরলস নিবেদিত সৃজন কর্মীর হাতের স্পর্শে ভাস্কর্য ‘প্রজন্ম’ পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। ভাস্কর্যের উচ্চতা ১৬ ফুট, মোট ব্যয় ১০ লক্ষ টাকা। ভাস্কর্য নির্মাণে কলেজ কর্তৃপক্ষ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জনাব মোতাহার হোসেন, মাননীয় সংসদ সদস্য টিপু মুন্সি, মাননীয় সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ মহোদয়গণের নিকট নৈতিক ও আর্থিকভাবে ঋণী। স্থানীয় সূধী ও সংস্কৃতিকর্মীগণও ভাস্কর্য নির্মাণে সহযোগিতা করে কলেজ কর্তৃপক্ষকে ঋণী করেছেন।



আনুষ্ঠানিকভাবে ভাস্কর্যের উন্মোচন ঘটে ১৬ ডিসেম্বর ২০১০ সালের কুয়াশা ঢাকা সকালে। রংপুরের মানুষ সৌর্য-বীর্য ও বীরত্বের প্রতীক, স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ ভাস্কর্য ‘প্রজন্ম; দেখলো, কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ আব্দুল ওয়াদুদ ও উপাধ্যক্ষ প্রফেসর সৈয়দা সাহারা ফেরদৌস-এর পর্দা ওঠানোর মধ্য দিয়ে। ‘প্রজন্ম’ ভাস্কর্য দেখলো তিস্তা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরীর বালক, যুবা, পৌঢ় ও বৃদ্ধ স্বাধীনতা প্রিয় মানুষকে।



স্বাধীনতার জন্য আকাশ সমান আকুতি যে দেশের মানুষের, সে দেশের মানুষের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণ করতে চল্লিশ বছর লাগে। কৃষক নেতা নুরলদীনের ও নারী জাগরণ জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার দেশে আরও কতদিন লাগবে স্বাধীনতার সুফল পেতে?



রংপুরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য থাকার পরও স্বাধীনতা পূর্বকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আনুষ্ঠানিকভাবে হলো ২০০৮ সালে। শতাব্দীকাল আগে বেগম রোকেয়া তাঁর লেখনিতে শিক্ষার উপর অন্তহীন গুরুত্বের কথা বার বার উল্লেখ করেছেন। সামষ্টিক অর্থনীতির স্রোতধারায় কোন অঞ্চলকে বঞ্চিত করে গোটা দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, “দেহের সমস্ত রক্ত মুখে এসে জমা হলে সেটাকে স্বাস্থ্যের লক্ষণ বলে না। তেমনি গোটা দেশকে রিক্ত করে, নিঃস্ব করে, বঞ্চিত করে অল্প কিছু মানুষের জন্য অনন্য সাধারণ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করাটাও কোন সভ্য সমাজের রীতি নয়।”



মধ্যপ্রাচ্যের মিশর, সিরিয়া, আলজেরিয়া ও ইরানসহ অনেক মুসলিম দেশে ভাস্কর্য আছে। সেদেশগুলোতে ভাস্কর্যের মাধ্যমে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করা হয়েছে। গ্রীসে আজও প্রাচীন অলিম্পিকের প্রচুর ভাস্কর্য সযতেœ রক্ষা করা হচ্ছে। ইতিহাস-ঐতিহ্যকে দেশ-বিদেশের মানুষকে দেখার ও দেশের ঐতিহ্যকে তুলে ধরার মাধ্যমে। ভাস্কর্য শুধু কারও অবয়ব তুলে ধরার জন্য নয়, গর্বিত হওয়ার ও প্রাণিত হওয়ার জন্যও।



ভাস্কর্য ‘প্রজন্ম’ শুধু স্বাধীনতার স্মারক ভাস্কর্য নয়, কারমাইকেল কলেজ তথা রংপুরের স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক চেতনা সম্পন্ন মানুষের অনুপ্রেরণায় তীর্থস্থানে রূপান্তরিত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত গণতান্ত্রিক কর্মকান্ডের ক্ষেত্র ‘অপরাজেয় বাংলা’ স্মারক ভাস্কর্য শুধুমাত্র দর্শনীয় কীর্তি নয়, স্মারক ভাস্কর্য গর্বিত হওয়ার অনুপ্রাণিত হওয়ার ও স্পর্ধিত হওয়ার। উত্তরের জনপদ রংপুরের মাটি মানুষের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ও উন্নয়ন সং®কৃতিতে উদ্বেলিত হওয়ার, গণতন্ত্র ও মানবিক সমাজ গড়ার, অনুপ্রাণিত হওয়ার, গর্বিত হওয়ার তীর্থস্থান হোক স্মারক ভাস্কর্য ‘প্রজন্ম’।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.