নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিটন আলম

মিটন আলম › বিস্তারিত পোস্টঃ

নিচের গল্লটি অবলম্বনে একখান মুভি(সিনেমা) বানাইবার চাই। কেউ যদি চিত্রনাট্য খান লেইখ্যা দেন তাহইলে খুবই উপকৃত হইতাম।

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:৫৬

নিচের গল্লটি অবলম্বনে একখান মুভি(সিনেমা) বানাইবার চাই। কেউ যদি চিত্রনাট্য খান লেইখ্যা দেন তাহইলে খুবই উপকৃত হইতাম।



মনোনীত হইলে হালকা পাতলা সম্মানীও (মজুরী) দিতাম।

চিত্রনাট্য পাঠানের ঠিকানা:- [email protected]





গোলক

মিটন আলম



পৃথিবীতে গোলকের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-পরিজন নেই। একেবারে একা সে, জন্ম মুহূর্তের অব্যবহিত পর থেকেই। সামাজিক কারণে অবাঞ্ছিত শিশুকে পরিত্যাগ করা হলে তাকে কুড়িয়ে পায় তথাকথিত একজন স্বহৃদয় ব্যক্তি। তিনি তাকে তৎক্ষণাৎ হস্তান্তরিত করে দেন একটি শিশুসদনে এবং আত্মতৃপ্ত হন। শিশুসদনের ম্যানেজার শিশুটির গোলগাল স্বাস্থ্য দেখে তার নাম রাখেন গোলক। কিন্তু নামের শেষে কোন উপাধি যোগ করেন না- ঘোষ কিংবা রাহমান। তিনি ভাবেন, গোলকের মন্দ-ভালো বোঝার বয়স হলে নিজের ইচ্ছা ও পছন্দ অনুযায়ী ধর্ম বেছে নেবে সে। তখন তার নামটিও পূর্ণতা পাবে।



শিশুসদনে স্বাভাবিক নিয়মে বড় হতে থাকে গোলক। নয়-দশ বছর, একটু বোঝার মতো বয়স হলে শিশুসদনের কড়া শাসন ভালো লাগে না তার। সপ্তাহে ছয় দিনই বন্দী থাকতে হয় সেখানে। একদিন মাত্র ছেলেদের বাইরের মাঠে খেলতে দেয়া সে-মাঠও প্রাচীর বেষ্টিত। তাই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে একদিন শিশুসদন থেকে পালালো গোলক। গেট টপকিয়ে বাইরে বের হয়ে সাথে সাথেই দৌড়। দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে এসে হাঁপাতে লাগলো। অতঃপর সম্মুখ পথ ধরে গন্তব্যহীন হাঁটা শুরু করলো। যতদূরে পারে যেতে চায় সে। মুক্তির আনন্দ মিইয়ে গেল ক্ষুধার তাড়নায়। শিশুসদনে বন্দী জীবন যাপন করলেও তিন বেলা খেতে পেত। মুক্তির রোমাঞ্চের স্থানে মাথায় কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নই বার বার ঘুরে-ফিরে আসতে লাগলো, কোথায় যাবে? কী খাবে? থাকবে কোথায়? ইত্যাদি। বাইরের জগত তার কাছে অপরিচিত ছিল তাই চারিদিকের দোকানপাট, গাড়ী, রিক্সা, লোকজন সর্বোপরি বিচিত্র ধ্বনিপুঞ্জ তার ভীতির উদ্রেক করলো। কান্না পেল তার।





শিশুসদনের পাশেই রেলস্টেশন। গোলক ট্রেনে উঠে কয়েকটি স্টেশন পার হয়ে অন্যশহরের স্টেশনে নামলো। প্লাটফর্ম পেরিয়ে শহরে ঢুকলো গোলক। ক্ষিধেতো ছিলই এবার যোগ হলো তীব্্র পিপাসা। রাস্তার ধারে একটা হোটেল দেখে ভিতরে ঢুকে একগ্লাস পানি পান করলো কাঁচের আলমারির ভেতরে সাজিয়ে রাখা খাদ্যদ্রব্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে। কিন্তু টাকা না থাকায় কিনে খেতে পারলো না। পুনরায় হাঁটা শুরু করলো সে। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে ক্রমে সন্ধ্যা অতঃপর রাত নেমে এলো এ জেলা শহরে, শহরের রাস্তায়, একটি অফিসের সামনের সিঁড়িতে বসে পড়লো গোলক। আশেপাশে অনেককে শুয়ে থাকতে দেখে নিজেও শুয়ে পড়লো। সারাদিনের ক্লান্তিতে, উদ্বেগ থাকা স্বত্ত্বেও সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লো সে। ঘুম থেকে উঠে চোখ রগড়িয়ে চারিদিকে তাকালো গোলক। এখানের নতুন সকালে গোলকের প্রথমেই অনুভুত হলো তীব্র ক্ষিধের চাপ সাথে সাথে প্রসাবের প্রবল বেগ। তাই প্রস্রাবের উদ্দেশ্যে চারিদিকে তাকালো সে। নির্জনস্থান খুঁজে পেয়ে প্রস্রাব করে এলো পরম তৃপ্তিতে। দ্বিতীয় সমস্যাটির সমাধান হলেও প্রথমটির কোন সমাধান হলো না। সেটা মনে হতেই আরো তীব্রভাবে ক্ষিধে অনুভব করলো। গতকালের দেখা হোটেলে সাজিয়ে রাখা খাদ্যগুলোর দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। পা দুটোও যেন নিয়ন্ত্রনহীন, হোটেলের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো গোলককে। গোলক হোটেলের সামনে গিয়ে দেখলো হোটেলের মালিক টেবিলের কাঁচ মুছছে একটি কাপড় দিয়ে এবং ভিতরে তার চেয়ে একটু বড় একটি ছেলে চুলো জ্বালানোর তোড়জোড় করছে। গোলক আর একটু ভিতরে ঢুকে হোটেলের মালিককে বললো, একগ্লাস পানি হবে?

হোটেল মালিক কোন কথা বললেন না।

গোলকেরই বয়সী একটি ছেলে গোলককে বুঝিয়ে দিলো যে, কিছু না খেলে সকাল সকাল পানি হবে না, বউনি এখনও হয় নি।

নিরুপায় গোলক বললো, আমার কাছে টাকা নাই।

হোটেল মালিক খেকিয়ে উঠলো, টাকা নাই তো ফোট, দোকান খুলতে না খুলতেই আইসা পানি! হালার বাপের দোকান নাকি?

গোলক ভড়কে গেলো এরকম ধাতানি শুনে, ফিরে যেতেও উদ্যত হলো না। কেমন বিমর্ষ দাঁড়িয়ে থেকে তাকালো মালিকের দিকে। অনেকক্ষণ পরে মালিক রাগী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, বাড়ি কই?

-আমার বাড়ি নাই।

-বাপের নাম কী?

-জানি না।

-জানো না! ও বুঝছি বাড়িত থন পলাইছো?

গোলক নিরুত্তর।

-কি ছোড়া কথা কও না ক্যা? জিগাইলাম না বাড়িত থন পলাইছো?

-জ্বী না আমার কোন বাড়ি নাই, বাপ-মাও নাই।

- বাড়ির মানসের ওপরে এতো রাগ! এ পটলা দেতো হালার পোরে একগ্লাস পানি দে।

পটলা গোলকে পানি এনে দিল। গোলক পান শেষ করে আর এক গ্লাস চাইলো। বইসবার জায়গা পাইলে মানষে শুতবার জায়গা চায়, কথাটা দেহি মিছা না। -বললেন মালিক।



হঠাৎ হোটেল মালিক বললেন, এইহানে কাম করবি? তাইলে খাওন দিমু। গোলক সম্পর্কে মনগড়া কাহিনী তৈরি করে হোটেল মালিক ভাবলেন, শুধুমাত্র খাবারের বিনিময়ে গোলককে দিয়ে প্রচুর কাজ করিয়ে নেয়া যাবে। গোলক হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। সেই থেকে দিনরাত পরিশ্রম, আধপেটা খাবার এবং পুরোদমে গালি, ধমক, চড়, থাপ্পর, লাথি খেয়ে দিন কাটছিলো গোলকের। হোটেলে নতুন মাখলুকাতকে কর্মরত দেখে অনেকে কৌতুহলী হয়ে গোলক সম্পর্কে মালিকেেক জিজ্ঞেস করলে, তিনি নানা মনগড়া কাহিনী রসিয়ে রসিয়ে তাদের শোনাতে লাগলেন। বললেন, কোন খানকীর পুত, কোন মফিজের পাপের ফল কেডা জানে! হালা হইলো গিয়া পাট ক্ষ্যাতের পাপ। মালিককে একদিন চাচা বলে সম্মোধন করলে, মালিক রেগে গিয়ে উচ্চগ্রামে বললেন, আমারে চাচা-পাছা কইবি না। কইবি মালিক নাইলে হুজুর। আর একবার যদি চাচা কস তাইলে থাপ্পর দিয়া দাঁত ফালইয়া দিমু। তারপর বিরবির করতে লাগলেন, আমার কোন চ্যাডের ভাইপো আইছে রে, হুম চা-চ্যা!



নানাবিধ অযৌক্তিক অত্যাচার সহ্য করতে করেেত গোলকের দাঁত ফেলার পূর্বেই গোলকই মালিকের মাথা ফাটিয়ে কাজ ছেড়ে দিলো। একটি কাপ গোলকের হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে গেলে মালিক এসে কেটলির ফুটন্ত চা-এর পানি গোলকের গায়ে ঢেলে দিয়েছিল শাস্তি-স্বরূপ। ফলে যন্ত্রনার সাথে সাথে তার প্রচণ্ড রাগও হয় মালিকের প্রতি এবং ভাঙ্গা কাপের অর্ধাংশটি মালিকের কপাল বরাবর ছুঁড়ে দেয় যথাসাধ্য জোরে, কপাল ফেটে যায় মালিকের। মালিক তখন- মাইরা হালাইলোরে, ডাকাইতডা আমারে মাইরা হালাইলো-এ চিৎকার শোনার পূর্বেই কর্মে ইস্তফা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ না করেই গোলক উধাও। এরপর অন্যান্য টোকাইদের মতো ছন্নছাড়া জীবন শুরু করলো গোলক। বাধ্য হলো। বিভিন্ন বস্তু টুকিয়ে বিক্রি করা, গুলতি হাতে ঘোরাফেরা করা, ইত্যাদি তার প্রধান কাজ হলো। দোকানের ছাদের নিচে ঘুমানোর বদলে। বিভিন্ন অফিসের সিঁড়ি, স্টেশনের প্লাটফর্মে রাত্রিযাপন শুরু করলো পুলিশের লাঠিগুতোসহ।



স্থানীয় টোকাই রহিম, মন্টু, কালা ও আজিমদের সাথে গোলকের আলাপ পরিচয় হলো। রহিম গোলকের সমবয়সী। সে আইচক্রিম বিক্রি করে। মন্টু সবার বড়, কালা গোলকের সমান এবং আজিম গোলকের চেয়েও ছোট। গোলককে তারা প্রতিযোগিতা ও ঈর্ষার কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবলেও শ্রদ্ধা করে এবং একবাক্যে স্বীকার করে ছোঁড়ার বুকের পাটা আছে, নইলে অমন বজ্জাত মালিকের মাথা ফাটাইতে পারতো না। মন্টু চা-সিগারেট-পান বিক্রি থেকে শুরু করে সিনেমার টিকেট ব্লাক থেকে নেশাত্রব্য বিক্রি এমনকি ছিনতাই সব ধরণের কাজই করেছে। আজিম বস্তির এন.জি.ও স্কুলে ক্লাশ টু-তে পড়ে। পড়ালেখায় আগ্রহও আছে। কিন্তু রহিমদের সঙ্গ ছাড়তে না পেরে কোন কোন দিন ওদের সাথেই চব্বিশ ঘন্টা। এদের সাথেই বছর কেটে যায় গোলকের।



একদিন চারজনে খোশগল্পে মেতেছে একসময় মন্টু বললো, তরা জানোস প্রেসিডেন্ট আমাগো লাইগা গান বানছে, হেই গান টিভিতে দেহায়। আমাগো নাম থুইছে পথকেলি। কালা বললো, দুর শালা পথকেলি না পথকুলি। ভালা কইরা হুনিশ। গোলক উৎফুল্ল হয়ে বললো, আমাগো কুলির কাম দিবে নাকি? মন্টু হাসতে হাসতে বললো, তুই দেহি পলিটিক্সের কিচ্ছু বোঝোস না! কুলির কাম কিরে! এটা হইলো পলিটিক্স, উপরানি দরদ। আজিম অনেক্ষণ ধরে কি যেন বলতে চাইছিলো, কিন্তু ছোট বলে বেশি একটা পাত্তা পায় না। এবার সে বলেই ফেললো, তরা কইতাছোস পথকেলি, পথকুলি ওইসব কেলি কুলি কিছুই না আসলে হইবো পথকলি। পথ মানে হইলো রাস্তা আর কলি মানে ফুলের কলি। যে ফুল অহনও ফোটে নাই তারে কয় কলি মানে রাস্তার কলি। আমরা ছোড হের লাইগা কলি। স্কুলে আফায় আমারে কইছে। মন্টু বললো, আমাগো আজিম দেহি হাছা হাছাই পন্ডিত হইয়া গেল! তয় তর আফায় কিন্তু আসলেই গোলাপের কলি। শইল্যের যা রং, মাশাল্লাহ। মন্টু আজিমের প্রসংশা করছে ভেবে আজিম বললো, আমি তোমাগো আগেই কইছিলাম স্কুলে যাইতে, হোন নাই। স্কুলে গেলে হাজার কিসিম জিনিস শিখবার পাইবা। হে বাদেও স্কুলের হগল ছাত্রছাত্রীগো বনরুটি খাইবার দেয়। আর মাসের শ্যাষে একশ কইরা ট্যাহা। মন্টু ঈষৎ রাগান্বিত হয়ে বললো, এ দেহি মাস্টারগো লাহান লেকচার দিবার লাগছে! হালা আবার স্কুলের কথা কবি তো লাত্থি দিয়া গুয়ার হাড্ডি ফাটাইয়া দিমু। তর ট্যাহা রুটিতে আমি মুইত্যা দেই। এ কথায় আজিম ছাড়া সকলেই হো হো করে হেসে উঠলো। গোলক ভাবলো, স্কুলে ভর্তি হলে টাকা রুটি দুই পাওয়া যাবে। এ ব্যাপারে পরে আজিমের সাথে পরামর্শ করবে। কিন্তু মন্টুর সামনে কিছু বললো না সে।



পরে আজিমকে একা পেয়ে গোলক স্কুলে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে জানালো সত্যি রুটি, টাকা দেয় কিনা নিশ্চিত হয়ে। আজিম বললো, এহন তো ভর্তির সময় না, তয় তেনাগো অফিসের পরিচালক না ফরিচালক স্কুল দেহার লাইগা আইবো হের লাইগা আফা হগলরে আরো পোলাপান সাথে লইয়া যাইবার কইছে। কাইল দশটার সময় স্কুলে আইয়ো আমি আফার লগে আলাপ করাইয়া দিমু। যথাসময়ে গোলক স্কুলে উপস্থিত হলো। আপা বারো হাত বাকুরের তের হাত বিচির মতো একটা বড় খাতা টেনে নিয়ে গোলকের দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞস করলো, নাম?

-গোলক

-বাবার নাম?

-জানি না

-ঠিকানা?

-গোলক বললো সে কোন রাতে ব্যাংকের/অফিসের সিঁড়িতে কোন রাতে স্টেশনের প্লাটফর্মে থাকে, ঘুমায়।

-ধর্ম?

-গোলক তার বাবার পরিচয় জানে না এতে তার কোন গ্লানি নেই। বরং ধর্ম প্রসঙ্গটি তার সমস্ত চিন্তা চেতনা আচ্ছন্ন করে দিল। এ ব্যাপারে পূর্বে সে ভাবেনি। হঠাৎ কী মনে করে আমি স্কুলে পড়–ম না, বলে দৌড়ে পালিয়ে গেলো গোলক। আপা বিরক্ত হয়ে আজিমকে বললো, এসব ফাজিল ছেলেকে কেন আনো? যত্তসব, রাবিশ।



পরে গোলকের কাছে আজিম স্কুল থেকে ওভাবে পালিয়ে আসার কারণ জানতে চাইলে উত্তরে গোলক বললো, আফায় যে জানবার চাইলো আমি হিন্দু না মুসলমান।

-তাতে হইছেডা কি, তুমি যা তাই কইতা। যেমন আমি মুসলমান ও পাড়ার কানাই হিন্দু।

গোলক হতাশ কণ্ঠে বললো, হেইডাইতো জানি নারে ভাই।

-জানো না মানে তোমার বাপ যা তুমিও তাই!

-আমিতো বাপেরে আর মায়েরে চিনি না, কত কী করি?

স্কুল পড়–য়া আজিমও এ সমস্যার কোন সমাধান দিতে পারলো না। শুধু গোলকের হতবুদ্ধি অবস্থা দেখে সান্তনার স্বরে বললো, এহন তো কেউ জিগাইতেছে না তুমি কি?



ধর্ম বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সর্বদা অন্তর্দাহে জ্বলতে থাকে গোলক। কথাবার্তায় সে মাঝে মাঝে “আল্লা” শব্দটি বলে বটে। কোন অদ্ভুত ঘটনায় “এ আল্লা”, “আল্লা আল্লা” ইত্যাদি। তাই প্রথমে ইসলাম ধর্মের কথাই তার মনে হলো। সেকি তবে মুসলমান! সাথে সাথেই আজান কানে এলে (চিন্তা শূন্য হয়ে) সে আহ্বানে মসজিদে গিয়ে হাজির হলো গোলক। মসজিদের ভিতরে পবিত্রতার স্পর্শ ও শান্তি অন্তর্দাহ হতে মুক্তি দিলো। নামাজ না জানলেও ফরজ নামাজের সময়ে কাতারে সামিল হয়ে ওঠাবসা করলো অন্যান্যদের সাথে। নামাজ শেষে একজন মুসুল্লির চৈতন্য হলো যে, গোলকের মসজিদে প্রবেশের ফলে মসজিদের পবিত্রতার হানি ঘটেছে। তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, হায়-হায় এই জারুয়াডা কনে থাইকা আইলো! কুত্তার বাচ্চা মসজিদডারে অপবিত্র কইরা হালাইলো! তাকে সমর্থন করে অপর একজন মুসল্লি টিপ্পনী কেটে বললেন, হ্যারে আমি পূজার সময় প্রসাদ খাইতে দেখছি। হালা গু খাইতে পারোস না? অতঃপর কয়েকজন মুসল্লি মিলে গোলককে চরম উত্তম-মধ্যম দিয়ে কান ধরে টেনে হেচড়ে মসজিদ থেকে বের করে দিলো। গোলক কাঁদতেও ভুলে গেলো যেন। সমস্ত অপমান হজম করে নীরবে চলে গেলো। তবে জাগলো ক্ষোভ, প্রতিশোধ স্পৃহা। কিছুদিন পরে এশার নামাজের সময়ে ঐ মসজিদের জানালার কাছে লুকিয়ে বিরবির করে উচ্চারণ করলো, ও ওঠা-বসা চাচা ভাই এইবার তোমাগো নিস্তার নাই। পরক্ষণই দুই টাকা দামের একটি ফাটকা ছুঁড়ে দিলো জানালা দিয়ে মসজিদের ভিতরে। ফলে সশব্দে বিস্ফোরণ। ইমাম অজ্ঞান, অনেকে বিপদের দোয়া আওড়ালেন নামাজের সুরার বদলে। ঘটনাটি প্রচণ্ড গুরুত্ব পেয়েছিলো। জাতীয় পত্রিকাতেও পেয়েছিলো ঠাঁই। এভাবে-



“...স্থানের...মসজিদে এশার নামাজ চলাকালীন সময়ে কে বা কারা হাতবোমা ছুঁড়ে মেরছিলো মুসুল্লিদের উদ্দেশ্যে। ভাগ্যক্রমে কোন হতাহত হয়নি। সবাই তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। ...ধারণা করা হচ্ছে কোন মুসলিম বিরোধী চক্রের কাজ এটি।”



এ ব্যাপারে গোলককে সন্দেহ করা হয়নি। মূলত তার কথা কারও মাথায় আসেনি। ঘটনার পর সপ্তাহ যেতে না যেতেই বিনয় মজুমদারের পাটের গুদামে আগুন লেগে সমস্ত পাট পুড়ে যায়। অগ্নিবীমাধীন ছিলো বলে বিনয় মজুমদারের তেমন কোন লাভ-লোকসান হয়নি। ফলে ইর্ষিত হৃদয় আরো ঈর্ষাপূর্ণ হয়েছিলো কিছুদের।



একপকেটে ভর্তি পাথর (অন্য পকেট ছেঁড়া) নিয়ে গুলতি হাতে শিকারে বেড়িয়েছে গোলক দুপুর অবধি কোন খাদ্য জোটাতে না পেরে। এ শহরে নাকি পূর্বে ঘুঘু, বক, সারস, হরিয়াল ইত্যাদি হালাল পাখি পাওয়া যেত। হোটেলে থাকাকালীন বৃদ্ধদের বলতে শুনেছে সে। বর্তমানে কাক, মাঝে মধ্যে দুই-একটি শালিক ও চড়াই ছাড়া অন্য কোন পাখিই দৃষ্টিগোচর হয় না। যদিও খাদ্য বিবেচনায় গোলকের বাছবিচার নেই। চড়াই, শালিক, সাতভাই, বক সবই খেতে সবই খেতে পারে কাক, চিল ছাড়া। তার লক্ষ্যভ্রষ্ট খুব কমই হয় (তার প্রমাণ পূর্বেই মিলেছে)। ফলে আট-দশটি রকমারি পাখি পেল সে। একটি পায়রাও মেরে চামড়া ছিলে রেখে দিয়েছে যেন কেউ বুঝতে না পারে। ফিরে এসে কটকটিওয়ালা আফান দাকে একটি বক দিয়ে বিনিময় পেল পাঁচ টাকা। এক টাকার লবণ এবং এক টাকার বিড়ি কিনে কিছু পাখিকে ঝলসে লবণ মেখে পেট পুরে খেলো। অর্ধেক পরে খাওয়ার জন্য রেখে দিলো। তারপর বিড়ি ধরিয়ে আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলো। মন্টু তাকে বিড়ি খাওয়া শিখিয়েছে। পেট ভরা থাকলে পৃথিবীটাকে বেহেস্ত মনে হয়। কাল আবার হরতাল। হরতালকে কেন যে সবাই অপছন্দ করে বুঝতে পারে না গোলক। বরং হরতাল হলেই তার ভালো লাগে। শহরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে যায়। তাছাড়া হরতালের দিনে মিছিল, পিকেটিং এর জন্য কিছু রোজগার হয়। চা-সিঙারা তোর বাড়তি পাওনা। একবারতো সে একটা খুব বড় অফার পেয়েছিলো, বোমা নিক্ষেপের একটি জনসভায়। শুধুমাত্র জনসভা ছত্রভঙ্গ করার জন্য নয় বরং একজন নেতার ইহলোক সাঙ্গ করার দায়িত্ব পেয়েছিলো। তাকে তিন দিনের ট্রেনিংও দেয়া হয়েছিলো, কীভাবে কী করতে হবে। চূড়ান্ত ট্রেনিং-এ বোমাটিও দেখেছিলো গোলক। প্রথম সে ঐ ধরণের বোমা দেখে অবাক হয়েছিলো এটা ভেবে যে, এতটুকু টেনিস বলের মতো বোমাটি মানুষ মারতে পারবে। এ বিষয়ে ওস্তাদকে প্রশ্ন করলে ওস্তাদ বলেছিলো, আরে এটা হইলো খাস বিলেতি চিজ বোঝছোস? কিন্তু পরবর্তীতে জনসভাটি হয়নি। কারণ নেতার গাড়ী জনসভাস্থলে পৌঁছানোর পূর্বেই কে বা কারা গুলি করে তাকে পরপারে পাঠিয়েছিলো।



এরই মধ্যে মন্টু একদিন গোলককে এসে বললো, তর কামাইয়ের একটা রাস্তা পাইছি।

-কী রাস্তা?

মন্টু শার্টের নিচে হাত দিয়ে কোমরে গোঁজা একটা পত্রিকা বের করে বললো, এইগুলা বেচবি। গোলক পত্রিকাটি হাতে নিলে প্রথমেই তার চোখ পড়লো প্রচ্ছদে। সেখানে নগ্ন মেয়েদের ছবি। লজ্জা পেলো সে এবং বললো, এইগুলা আমি কেমনে বেচমু? মাইনষেরে তো দেহাইতেই পারুম না। মন্টু ভেংচি কেটে বললো, কেমনে বেচুম! হালা, তর কাজ কাম নাই দেইখা একটা বেবুস্তা কইরা দিলাম আর কইতাছোস কেমনে বেচুম! হোন, কলেজ, ভার্সিটি, লাইব্রেরী মাঠে যাইয়া পোলাপানগো কইবি পত্রিকা লইবেন? লইতে চাইলে দেহাইবি তার বাদে দাম-দর কইরা বেচবি। একটার দাম চাইবি পঁচিশ-ত্রিশ টাকা পনের-বিশ হইলেই দিবি। তর কমিশন থাকবো, যত বেচবি তত লাভ হইবো, বোঝছোস? গোলক সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়, ইতস্তত করেও রাজি হয়। অতঃপর কাধে পর্ণপত্রিকা ভর্তি ব্যাগ ঝুলিয়ে বিপনন কাজে নেমে পড়ে। প্রথমের দিকে কিছুটা লজ্জা করলেও আস্তে আস্তে তা কেটে যায় এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সে বিভিন্ন জনের কাছে পত্রিকা বিক্রির প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে পারে এবং কারা এইসব কেনে সে বিষয়েও স্পষ্ট ধারণা লাভ করে। তাছাড়া, অনেক সময় নির্দিষ্ট দামের চেয়ে বেশি মূল্যেও বিক্রি হয়। ফলে কমিশন ছাড়াও অতিরিক্ত লাভ যোগ হয়। বরং সেটা কমিশনের থেকেও বেশি।



সব মিলিয়ে গোলকের ছন্নছাড়া জীবনে স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য এলো। নগদ টাকা নাড়াচাড়ার সুযোগ পেলো এবং খরচেরও। কিন্তু একদিন লাইব্রেরীর মাঠে একটি ছেলেকে বসে থাকতে দেখে তাকে কাস্টমারের মর্যাদা দিয়ে তার কাছে গিয়ে বললো, পত্রিকা লইবেন ছার? ছেলেটি চশমাসহ মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলো, কি পত্রিকা? গোলক তখন প্রক্রিয়া মাফিক একটি পত্রিকা বের করে ছেলেটির হাতে দিলো। ছেলেটি পত্রিকাটির প্রচ্ছদ এবং শিরোনাম দেখা মাত্র-হারামজাদা, এ বয়সে এসব করিস!? বলে গোলককে ভীষণ জোরে থাপ্পর মেরে কিছু বোঝার আগেই হাতের পত্রিকাটি ছিঁড়ে ফেললো। ফলে ভেতরের পাতার সঙ্গমের বিভিন্ন দৃশ্যগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে লাগলো। শুধুমাত্র হাতের পত্রিকাটি ছিঁড়েই ছেলেটি ক্ষান্ত হলো না গোলকের কাধ থেকে কবিদের ব্যাগের মতো খলিটি কেড়ে নিয়ে অন্যান্য পত্রিকাগুলোও ছিঁড়ে ফেললো। গোলক আর্তনাদ করে উঠলো, ছার বইগুলা ছিঁইরেন না ছার। আপনে আমার ধর্মের ভাই ছার। মহাজনরে আমি কনে থাইক্যা ট্যাহা দিমু? গরিবরে মাইরেন না ছার। গোলকের কান্না ও ভদ্র ছেলেটির চিৎকার চেচামেচিতে আশেপাশের কৌতুহলী লোকজন জড়ো হলো। ঘটনা কী? জানতে চাইলে সত্যিকার অর্থেই ভালো ছেলেটি বক্তৃতার ঢং-এ সকলকে ঘটনা বোঝাতে লাগলেন হাত নেড়ে নেড়ে। বললেন, এতটুকু ছেলে ‘যৌনক্ষুধা’ বিক্রি করছে তাও আবার আমার কাছে! আমাকে কিনতে বলে! এদের জন্যই যুব সমাজের আজ এই দশা! বলুন কি করা যায়? এর প্রতিকার আমাদেরই বের করতে হবে। ভিড়ের ভিতর হতে কে একজন বললো, আরে এডাতো ওই জারুয়াডা। হালা চুরি বাদ দিয়া অহন এই কাম ধরছোস। নানারূপ টীকা টীপ্পনী গালমন্দের পর সিদ্ধান্ত হলো গোলককে একশবার কান ধরে ওঠাবসা করতে হবে এবং থুতু চেটে খেতে হবে। গোলক কান ধরে ওঠাবসা করতে করতে ভাবলো সতিই কি তাকে থুতু চেটে খেতে হবে! তার নিজের থুতু নাকি অন্যের, নিজের হলে না হয় কথা ছিলো না। কিন্তু মন্টুকে পত্রিকার টাকা কিভাবে দেবে বুঝতে পারছে না গোলক। এই চিন্তার কাছে সব অপমান ম্লান হয়ে গেলো।



খ্রিস্টান মিশনারি ভাসমান শিশুদের আবাসন ও শিক্ষা সমস্যার সমাধান কল্পে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। দৈবক্রমে গোলক জড়িয়ে গেলো তাতে।...



মিশনারিতে এসে অদ্ভুত পবিত্র পরিবেশে খুব সাচ্ছন্দ্য অনুভব করলো গোলক। গীর্জার পরিবেশ, যীশুর ভাস্কর্য, ক্রুশ, রবিবাসরীয় প্রার্থনা, গীটারের ধ্বনি, সঙ্গীত সবকিছু ভালো লাগলো তার। ফাদার তাকে বললেন, যীশুর সাথে তার সাদৃশ্যের কথা, বৈসাদৃদ্যের কথা, স্বর্গীয় পিতার কথা, মুক্তির কথা সর্বোপরি স্বর্গÑসুখের কথা। তিনি তাকে নতুন জামা-জোতা, মোজা-প্যান্ট কিনে দিলেন এবং তার নতুন নাম রাখলেন গোল্ডস্মিথ। ফাদারকে ‘ফাদার’ বলে সম্মোধন করে পুলক অনুভব করে গোলক, শিহরিত হয়। এর পূর্বে সে কাউকে ‘বাবা’ বলে ডাকেনি ধোলাই বা মার খাওয়ার সময়ে ছাড়া। চাচা ডেকেও কটুবাক্য শুনতে হয়েছিলো। গোলক জানে যে, ফাদার মানে পিতা, বাবা অর্থাৎ বাপ। শিশুসদনে থাকাকালীন প্রাথমিক শিক্ষাটা সে পেয়েছিলো। খুব ভালো সময় কাটতে লাগলো গোলকের। গীর্জার পাশে কোয়ার্টারে তার জন্য আলাদা রুম, হোক না তা ছোট। শিশুসদনের মতো দশ-পনের জনের ঢালাও বিছানা নয়। তার একার বিছানা, ঘর! পাশেই ফাদারের রুম। খাবার দাবারও ভালো পরিবেশন করা হয়। প্রায়ই কোন কাজই করতে হয় না গোলককে। এটাওটা কিনে আনা, ঝাড়– দেয়া, গীর্জার মেঝে মোছা এসব ফাইফরমায়েস ছাড়া এবং মাঝে মধ্যে ফাদারের শরীর মর্দন করা। এর পূর্বে গোলক এরূপ জীবন কল্পনা করতে পারেনি। জন্ম থেকে এ অবধি এই সময়টাই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বলে তার মনে হয়। কিন্তু একটা হিসেব কিছুতেই মেলাতে পারে না গোলক। সে পূর্বে শুনেছিলো যে খ্রিস্টানরা কাউকে ধর্মান্তরিত করতে চাইলে পূর্বের ধর্ম ত্যাগ করার প্রমাণ স্বরূপ সেই ব্যক্তিকে তার নিজের ধর্মগ্রন্থের উপরে পা তুলে দিতে হয়। গোলককে কোন ধর্মগ্রন্থের উপরে পা তুলে দিতে হয়নি। হয়তো তার নির্দিষ্ট কোন ধর্ম ছিলো না বলে। ফলে গোলকের ভুল ভেঙ্গে যায়। কারণ গোলক আসার পরে অন্য একজন লোক ধর্মান্তরিত হয়েছিলো, খ্রিস্টান ধর্মে। কিন্তু সেই লোককেও কোন ধর্মগ্রন্থের উপরে পা তুলে দিতে হয়নি। সে যাই হোক ধর্ম থেকে শুরু করে আশ্রয়, খাদ্য সবই তার আছে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে মনে-মনে গোলক বলে ধন্যবাদ আল্লাহ, পরক্ষণই ধন্যবাদ ঈশ্বর।



কিন্তু সুখের সময় সব সময় থাকে না। ফাদারের শরীর মর্দন করতে গিয়ে ফাদার তাকে একটি বিশেষ অঙ্গ বিশেষভাবে মর্দন করতে বলেন। এতে গোলকের অস্বস্তি লাগলেও তা মর্দন করতে থাকে; একসময় বিশেষ অঙ্গটি গোলকের হাতে বমি করে দেয়। গোলক সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলে। তবুও গোলক প্রায়ই মর্দন করে এবং হাত ধোয়। তবে একদিন ফাদার গোলকের উপরে উপগত হলে তীব্র ব্যথায় দ্বিতীয় বারের মতো জীবন থেকে পালালো গোলক।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:০১

হেডস্যার বলেছেন:
আমি লেইখা দিমু।
খালি কন ক্যামনে লেখে।

২| ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:০৯

গোলক ধাঁধা বলেছেন: পুরাটা পড়ি নাই,ভালই লাগল যতটুকু পড়লাম।বাকিটা পরে এসে পড়ব

৩| ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২৩

কৈশর বলেছেন: ভাই কি লেখছেন ১ টু সর্টে কন তো !! এত বড় লেখা পরতে সাহস পাইলাম না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.