নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিটন আলম

মিটন আলম › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুজিবনগর সরকার ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ

২০ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ৯:২৫

মুজিবনগর সরকার ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ





‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ নামে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা হলো ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (চৎড়পষধসধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব) আমাদের ম্যাগনাকার্টা স্বাধীনতার সনদ। এই ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে কেন, কোন ক্ষমতার বলে এবং কোন পরিস্থিতিতে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলো। যে রাষ্ট্রের নামকরণ হলো গণপ্রজাতন্ত্রী (চবড়ঢ়ষবং জবঢ়ঁনষরপ) বাংলাদেশ। যেহেতু এই সরকার মুজিবনগরে তার প্রধান দপ্তর স্থাপন করেছিলো, তাই এর ব্যাপক পরিচিতি হলো মুজিবনগর সরকার রূপে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে এই সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতাতে স্থাপন করা হয়, প্রধানত নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে। মুজিবনগর সরকার বিভিন্ন কার্যাবলী পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে কত ব্যাপক এবং সুসংগঠিত ছিল এই সরকারের কর্মসূচি এবং গঠন কাঠামো।



প্রবাসী সরকার সম্পর্কে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। বিংশ শতাব্দীতে এরকম সরকারের অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। স্থান ও কাল ভেদে এদের প্রকার এবং চরিত্র বিভিন্ন রূপ হয়েছে। একটি সুপ্রতিষ্ঠিত কিন্তু প্রবাসী সরকারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো কম্বোডিয়ার প্রিন্স নরোদম সিহানুকের সরকার। যার সাথে পলপটের খেমাররুজ যুক্ত ছিল। এদের সদর দপ্তর দীর্ঘকাল চীনের বেইজিংয়ে অবস্থিত ছিল। কোন কোন সময় থাইল্যান্ডেও অবস্থান করতেন। সিহানুকের স্বাধীন কম্বোডিয়া সরকার একদিকে প্রবাসী ছিলেন অন্যদিকে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাদের দখলে ছিল, যেখানে তাঁরা সরকার পরিচালনা করতেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বালাদেশ সরকার বহুলাংশে এই সরকারের সাথে তুলনীয়।



মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১০ এপ্রিল এ সরকার গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। মুজিবনগর সরকারের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের মূল ভূ-খণ্ডের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়েছিলো বলে এ সরকার ‘প্রবাসী মুজিবনগর সরকার’ হিসেবে খ্যাত। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত মুজিবনগর সরকারের কার্যকাল।



১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আওয়ামীলীগের হাইকমান্ড তথা প্রধান নেতৃবৃন্দকে নিয়ে সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুক্তাঞ্চল বৈদ্যনাথতলায় সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করে আব্দুল মান্নান এম এন এ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করে অধ্যাপক ইউসুফ আলী এম এন এ। নবগঠিত সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।



মুজিবনগর সরকারের কাঠামো হলো:

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : রাষ্ট্রপতি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম : উপরাষ্ট্রপতি

(রাষ্ট্রপতি পাকিস্তানে অন্তরীণ থাকার কারণে

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের দায়িত্বপ্রাপ্ত)

তাজউদ্দিন আহমদ : প্রধানমন্ত্রী

এবং প্রতিরক্ষা, তথ্য, স¤প্রচার ও যোগাযোগ, অর্থনৈতিক বিষয়াবলী, পরিকল্পনা বিভাগ, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ সংস্থাপন এবং অন্যান্য যেসব বিষয় কারও উপর ন্যস্ত হয়নি তার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী।

খন্দকার মোস্তাক আহমেদ : মন্ত্রী

পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

এম মনসুর আলী : মন্ত্রী

অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এ এইচ এম কামরুজ্জামান : মন্ত্রী

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষিমন্ত্রণালয়।

মুজিবনগর সরকারকে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ভাগ করা হয়। এছাড়াও কয়েকটি বিভাগ মন্ত্রী পরিষদের কর্তৃত্বাধীনে থাকে। ১০ এপ্রিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা প্রদান করেছিলেন গণভোটে নির্বাচিত আওয়ামীলীগের সংসদবৃন্দ। কী পরিস্থিতিতে তারা এই ঘোষণা প্রদান করেছেন, ঘোষণাপত্রের শুরুতে তা বল হয়েছে। এরপর বলা হয়েছে “বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রর্ণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।” “সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের ক্ষমতায় গণ-পরিষদ গঠন করিয়া পারস্পারিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য, সেইহেতু আমরা বাংলাদেশকে প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি এবং উহা দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করিতেছি।”





“আমাদের এই স্বাধীনতা ঘোষণা ১৯৭১ সনের ২৬ শে মার্চ হইতে কার্যকরী বলিয়া গণ্য হইবে।”



জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রের সংখ্যা বর্তমানে ১৮৯। এতগুলো দেশের মধ্যে মাত্র দু’টি দেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র রয়েছে। একটি বাংলাদেশ অন্যটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নয় মাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যে মর্যাদা ও স্বীকৃতি পেয়েছে তার প্রধান কারণ এই যুদ্ধ ছিল ন্যায়সঙ্গত এবং বৈধ সরকার দ্বারা পরিচালিত।



১৭ এপ্রিল নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের পর মুক্তিযুদ্ধ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে এগারটি সেক্টরে ভাগ করা হয়। মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর এ কে এম শফিউল্লাহ, মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত, মেজর আবু তাহের, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর মীর শওকত আলী, মেজর রফিকুল ইসলাম, উইং কমান্ডার কে এম বাশার, মেজর কাজী নূরুজ্জামান, মেজর এম এ জলিল প্রমুখ ছিলেন এই এগারটি সেক্টরের অধিনায়ক। কর্নেল এম এ জি ওসমানী ছিলেন মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি। উপ-প্রধান সেনাপতি ছিলেন কর্ণেল আব্দুর রব ও উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার।



মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুজিবনগর সরকার যেমন সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করেছিল, একইভাবে সরকার পরিচালনার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের সচিবালয় ও বিভিন্ন বিভাগ গঠন করেছিল। সীমিত সামর্থ্য নিয়ে মুজিবনগর সরকার যে দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ও প্রশাসন পরিচালনা করেছিল, দেশপ্রেমের পাশাপাশি মেধা ও সততা ছাড়া এ গুরু দায়িত্ব পালন সম্ভব ছিল না। মুজিবনগর সরকার রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার হলেও কার্যত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন মূল চালিকা শক্তি। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণাবলী, প্রশাসনিক দক্ষতা ও দেশপ্রেম ছিল প্রশ্নাতীত।



গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ দখলমুক্ত হওয়ার পর অত্যন্ত অল্প সময়ের ভেতর বঙ্গবন্ধুর সরকার এক অসাধারণ সংবিধান প্রণয়ন করেছিলো, যার ভিত্তি ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র।



আমাদের জন্য এই সরকার গঠন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যুদ্ধের উপরে এর প্রভাব ছিল সুদুর প্রসারী। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়েই এটা ছিল বৈধ সরকার। ফলে বাংলাদেশের জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে যে কোন ধরণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার আইনানুগ ক্ষমতাও ছিল তাদের। মুজিবনগর সরকার গঠিত না হলে জনগণ যতই প্রশংসা করুক না কেন আমরা আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী অথবা বিদ্রোহী হয়ে পড়তাম।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.