নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিটন আলম

মিটন আলম › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইয়াবার ইতিকথা

০৮ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:৪৩


সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মানুষ পৃথিবী নামক এই গ্রহে নিজের জীবনকে সুস্বাস্থ্য, আরামদায়ক করার জন্য আবিষ্কারের নেশায় মত্ত। নব নব আবিষ্কারের মাধ্যমে নিরবিচ্ছিন্ন ও অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটে চলেছে সম্মুখ পানে। মানব জাতির এ গৌরবময় জয়যাত্রায় প্রেরণা ও শক্তি যুগিয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের নিরলস জয়যাত্রা ও অকৃপণ উপহার মানুষকে পৌঁছে দিয়েছে আধুনিক সভ্যতার চরম শিখরে। বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে এ সভ্যতা কল্পনা করা যায় না। বিজ্ঞানী যদি হন আরব্য উপন্যাসের আলাদীন। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার হবে তার হাতের আশ্চর্য প্রদীপ। বিজ্ঞানের আশ্চর্য প্রদীপের মতোই, একদিন ইয়াবার মূল উপাদান Ephedrine (ইফিড্রিন) এর আবিষ্কার হয়েছিল। সময়টা ১৯৪০ সাল বিশ্বজয়ের নেশায় জার্মানরি চ্যান্সেলর হিটলার তখন উন্মাদ প্রায়। অপ্রতিরোধ্য গতিতে নাৎসী বাহিনী দখল করছে ইউরোপীয় ভূ-খন্ড। কিন্তু উন্মাদ হিটলার এতেও সন্তুষ্ট নন, দ্রুত আরো দ্রুত সবকিছু গ্রাস করতে হবে। গতি, আরো গতি বাড়াতে হবে। কিন্তু বড় বাঁধা ঘুম, ক্ষুধা আর দুর্বার গতিতে একটানা পথচলার ক্লান্তি। ধ্বংসযজ্ঞের মহানায়ক হিটলার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। কোন ক্ষুধা, ঘুম, ক্লান্তি, তৃষ্ণা মানতে রাজি নন তিনি। কেমিস্টদের ডেকে হুকুম দিলেন এমন কিছু বের কর যা শুধু ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘুম, ক্লান্তি সবকিছুকে জয় করতে পারে না, পারে হিংস্রতা, ক্ষিপ্রতা, গতি, সতর্কতা, শক্তি ও সাহস বাড়াতে। জার্মান কেমিস্টরা মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের মিলিটারী ল্যাব এর যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক উপর। কি করতে হতে তা তাদের আগেই জানা ছিল।

রসায়ন ও ওষুধ বিজ্ঞানের বহু পুরোনো ঐতিহ্য নিয়ে ততদিনে অনেক দূর এগিয়েছে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগেই চীনা ভেষজ বিজ্ঞানীরা “Mahuany” আবিষ্কার করেছেন, যার আধুনিক নাম Ephedra, এবং যার মূল নির্যাস উত্তেজনা সৃষ্টিকারী মাদক Ephedrine (ইফিড্রিন) এ্যাজমা ও ‘ব্রংকিয়াল কনজেশন’ দূর করতে ব্যবহৃত হত। এফিড্রিন যে প্রক্রিয়ায় এ্যাজমা ও শ্বাসনালীর সংকোচন দুর করতো তা হলোঃ এটা প্রয়োগের পর এক ধরণের উত্তেজনা বা উদ্দীপনা তৈরি করে শ্বাসনালীকে ডাইলেট বা প্রসারিত করে দিত, একই সঙ্গে স্নায়ুর উত্তেজনা বা শক্তি বাড়াতো, রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করতো, রক্তচাপ বাড়াতো এবং সমগ্র দেহমনে এক ধরণের চনমনে ভালো লাগার অনুভুতি, আত্মবিশ্বাস ও সাহস জাগিয়ে তুলতো। এতে এফিড্রিন ব্যবহারকারীর শারীরিক শক্তি, সামর্থ্য, কর্মদক্ষতা, ক্ষিপ্রতা এবং সতর্কতা বা সজাগ ভাব বৃদ্ধি পেত। কিন্তু Ephedra এক ধরণের প্রকৃতিজাত ভেষজ এবং প্রকৃতিতে এর সরবরাহ অফুরন্ত ছিল না। ফলে এটা কৃত্রিমভাবে তৈরি, কিংবা এর মতো হুবহু একই গুণাগুণ সম্পন্ন বা বিকল্প রাসায়নিক বস্তু আবিষ্কারের জন্য সারা বিশ্বের রসায়নবিদরা চেষ্টা করতে লাগলেন।

একাজে প্রথম যিনি সফলতা লাভ করেন তিনি জাতে রোমান হলেও কাজ করতেন জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার নাম Lazar Edelean। ১৮৮৭ সালে তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়নিক গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে এফিড্রিন-এর বিকল্প হিসেবে Amphetamine (এ্যামফিটামিন) তৈরি করেন। এটি ক্ষুধা দমন, ওজন কমানো, কর্মদক্ষতা বাড়ানো এবং স্নায়বিক গতি ও ক্ষিপ্রতা বাড়ানোতে বিশেষ কার্যকর বলে এর নাম হয়ে গেল “Speed” বা গতি। Lazar তাঁর আবিষ্কারের প্রাথমিক নাম Phenyliso-propylamine দিলেও পরবর্তীকালে এটি Amphetamine নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯২০ সালে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে এ্যামফিটামিনের Medical Us শুরু হয়। জার্মানিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে, জাপানে এবং আমেরিকায় Benzedrine ব্যান্ড নামে এর ব্যাপক ফার্মাসিউটিক্যাল উৎপাদন শুরু হয়। অসঢ়যবঃধসরহব বা এর সাহায্যে উৎপাদিত ওষুধ যে সব সময় সারাবিশ্বে হতাশাজনিত মানসিক রোগ নিরাময়সহ শক্তি ও উদ্দীপনাবর্ধক নানা কাজে এক জাদুকরী শক্তির মতো ব্যবহার শুরু হয়।

আল্লাহ যেমন মানুষের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নির্দিষ্ট আকার-আকৃতি দিয়েছেন, তেমনি সে দেহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা, শক্তি ও সামর্থ্যরে দিয়েছেন সীমাবদ্ধতা। এ সীমাবদ্ধতাকে জয় করার চেষ্টা সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষের মধ্যে বিদ্যমান। এর জন্য যাদুটোনা, ঝাড়ফুঁক, অতিপ্রাকৃতিক শক্তির চর্চা, কত কি-ই না হয়েছে। কোন ওষুধ দিয়ে যদি সে সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে মানুষকে আরো কর্মক্ষম, শক্তিশালী, সমর্থ, সজাগ, ক্ষিপ্র ও গতিশীল করে তোলা যায় তবে তা যাদুর চেয়েও চমকপ্রদ বৈকি। সুতরাং রসায়ন শাস্ত্রকে ঘিরে এ যাদুবিদ্যার আরো উন্নয়ন ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি নিয়ে সারা বিশ্ব গবেষণায় মেতে উঠলো। মাত্র ৩ দশকের মধ্যে সারা বিশ্বে এ্যামফিটামিন-এর প্রায় অর্ধ শতাধিক এমাইন গ্রুপভুক্ত এ্যানালগ ও এ্যাগোনিস্ট তৈরি হয়ে গেল।

১) এ্যাজমা ও শ্বাসনালীর সংকোচন এবং রক্ত সঞ্চালন সমস্যায় Bronco-dilator হিসেবে। এক্ষেত্রে এ্যামফিটামিন ও এর এ্যানালগসমূহ তাদের Stimulant Effect দিয়ে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে, সংকীর্ণ শ্বাসনালীর সম্প্রসারণ ঘটায় এবং শ্বসনক্রিয়ায় আরাম ও স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনে। ফলে এ্যাজমা বা শ্বাসনালীর সমস্যায় এ্যামফিটামিন ব্যবহার করা হতো।
২) Narcolepsy নামক রোগের চিকিৎসা: Narcolepsy রোগ হলো দিনের মধ্যে বিশবার, ত্রিশবার এমনকি পঞ্চাশবার পর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়ে। সারাক্ষণ চোখের পাতা ঘুমে ভারী হয়ে আসে। সমস্ত দেহহমনে জড়তা ও ক্লান্তি ভর করে। যে কোন কাজে গতি শ্লথ হয়ে যায়। সারাক্ষণ একটা ঝিঁমুনিভাব অনুভুত হয়। এ্যামফিটামিন বা এদের এ্যানালগগুলো রেগীর শরীরে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি, স্নায়বিক উত্তেজনা সৃষ্টি এবং সজাগ ও সতর্কভাব তৈরি করে এ জাতীয় রোগীদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে সহয়তা করতো।
৩) শিশুদের Hyperactivity নিয়ন্ত্রণেও এক সময় এ্যামফিটামিন ব্যবহার করা হতো।
৪) এ্যামফিটামিন ব্যবহার করার পর ক্ষুধার অনুভুতি কমে যায়, খাবার ইচ্ছা থাকে না। ফলে অতিভোজনজনিত শারীরিক স্থূলতা কমাতে এক সময় ব্যাপকভাবে এ্যামফিটামিন ব্যবহার শুরু হয়। শুধু তাই নয়, স্বাভাবিক ভোজনে অভ্যস্ত লোকদের উপর এ্যামফিটামিন প্রয়োগ করেও ভালো ফল পাওয়া যায়। মডেলিং ও চলচ্চিত্র জগতে ফিগার ঠিক রাখার জন্য ‘স্লিমিং ওষুধ’ হিসেবে এ্যামফিটামিনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়।
৫) এ্যামটিামিন গ্রহণ করার ফলে যেহেতু ঘুম দুর হয় এবং সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রে একটি সতর্ক, সজাগ ও টান টান অবস্থা তৈরি হয়। এমন কি কোন কিছু মনে রাখা ও মুখস্ত করার ক্ষেত্রে এটা মস্তিষ্কের স্মৃতি কেন্দ্রকেও Hyper Active করে তোলে, সেজন্য মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা অতিমাত্রায় অধ্যয়ন করতে হয়, এমন ধরণের ছাত্রদের মধ্যেও এ্যামফিটামিন গ্রহণের প্রবণতাে বেড়ে যেতে থাকে।
৬) আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে বা অন্য কোন কারণে অতিমাত্রায় ঘুমের বড়ি সেবনের ফলে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া এবং শ্বাসক্রিয়া শ্লথ হয়ে যাওয়া রোগীদের হৃদযন্ত্র এবং শ্বাসক্রিয়া স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্যও চিকিৎসকগণ এক সময় এ্যামফিটামিন ব্যবহার করতেন, যদিও এর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় আজকাল চিকিৎসা ক্ষেত্রে আর এর কোন প্রয়োগ নেই।
৭) হেরোইন সেবনের ফলে প্রাথমিক অবস্থায় অতি উচ্চমাত্রায় আনন্দ বা শিহরণ অনুভুত হলেও এর পর পরই হেরোইন সেবীদের মধ্যে মারাত্মক নিস্তেজ ভাব দেখা দেয়। হেরোইনের মাত্রা বেশি হলে শ্বাস-প্রশ্বাস ধীর, চেখের মণি সংকুচিত, নাড়ীর গতি কমে যাওয়া, হার্টবিট কম, এমনকি রক্তচাপ কমে গিয়ে ব্যবহারকারী কখনও কখনও ‘কমায়’ চলে যায়। এ কারণে এক সময় হেরোইন সেবীদের এ ধরণের ঝুঁকি ও বিপদ কমানোর জন্য হেরোইনের সঙ্গে এ্যামফিটামিন মিশিয়ে এর Depressant Effect কে K Balance করা হতো।
৮) এক সময় কোকেন সেবীরা কোকেন না পেলে হেরোইন ও এ্যামফিটামিনের ককটেল(Speed Ball) তৈরি করে কোকেনের উপযোগিতা লাভ করতো।
৯) এ্যামফিটামিন যেহেতু শরীরে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে, স্নায়ুর ক্রিয়াশীলতা ও শক্তি বাড়ায়, দেহের স্বাভাবিক দক্ষতা, সামর্থ্য ও কর্ম ক্ষমতা বাড়ায়, সেজন্য ক্রীড়াবিদদের মধ্যে ৪০-এর দশক থেকে ব্যাপকভাবে এ্যামফিটামিন ব্যবহারের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বস্তুতঃ এ্যামফিটামিন দেহের সামর্থ্য, ক্ষিপ্রতা ও গতি বৃদ্ধি করে বলে এ সময় থেকে এর নাম হয়ে যায় “Speed”।
১০) দূরপাল্লার যানবাহন চালাতে গেলে দীর্ঘক্ষণ সজাগ, সচেতন ও সতর্ক থাকতে হয় এবং শরীরকে যে কোন রকম ক্লান্তি, অবসাদ ও ঝিঁমুনি থেকে মুক্ত রাখতে হয়। এ্যামফিটামিনের মধ্যে এসব যাদুকরী শক্তি থাকায় যানবাহন চালকেরা, বিশেষভাবে দূরপাল্লার ট্রাক, লরি ও ভারী কন্টেইনবাহী যানবাহন চালকদের মধ্যে এ্যামফিটামিন গ্রহণের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা দেয়।
১১) ইউরোপীয় এবং আমেরিকান সমাজ ও সভ্যতা মূলতঃ Club-oriented। দেখা যায় মদ্যপানের পর উন্মত্ত তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সের নারী-পুরুষ তাদের Week-end গুলো সারারাত নেচে গেয়ে আমোদ ফূর্তি করে কাটায়। এসব নাচ-গান ও আমোদ-ফূর্তির জন্য দরকার অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও রাত্রি জাগরণের সামর্থ্য। এ্যামফিটামিনকে এ অফুরন্ত প্রাণশক্তির যাদুর কাঠি মনে করে ৩০-এর দশকের পর থেকেই পাশ্চাত্য সমাজে নাইটক্লাব এবং Week-end উদযাপন সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করা হতো।

পিছনের কথায় ফিরে আসি। উত্তেজনা, গতি, ক্ষিপ্রতা, শক্তি, সাহস ও উদ্দামতা সৃষ্টিতে Amphetamine ও Methamphetamine- এর এসব যাদুকরী শক্তির কথা উন্নত বিশ্বে প্রায় সব বিজ্ঞানী ও রসায়নবিদদেরই জানা ছিল। জার্মানদের এটা আরো বেশি জানা ছিল। কেননা ১৮৮৭ সালে জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারেই প্রথম জন্ম হয় এ্যামফিটামিনের। ১৯১৯ সালে জাপানে এ্যামফিটামিনের সবচেয়ে শক্তিশালী এ্যানালগ Methamphetamine তৈরি হলেও এটি ততদিনে জার্মানদের কাছে ডালভাতের মতো। হিটলারের লক্ষ্য ছিল এমন কিছু বের করা যা মানুষদের মধ্যে ক্লান্তি, অবসাদ, ঘুম, জড়তা, দুর্বলতা বা নিস্পৃহতা দুর করে তার মধ্যে গতি, ক্ষিপ্রতা, দক্ষতা, সাহস, শক্তি ও হিংস্রতা বাড়িয়ে তুলে তাকে খুনে রোবটের মতো করে তোলে। হিটলারের হুকুম পাওয়ার পরই জার্মান যুদ্ধ ফ্রন্টগুলোর মতো জার্মান মিলিটারী গবেষণাগারগুলো অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠলো। Methamphetamine-কে আরো শক্তিশালী করার জন্য এর সঙ্গে কোকেন, এক্সটেসি, ক্যাফেইন ইত্যাদি উত্তেজক বস্তুর সমন্বয় ঘটিয়ে তৈরি করা হলো যুদ্ধের ফ্রন্টিয়ারে বৃষ্টির মতো উদগিরণশীল জার্মান বুলেটের মতোই ক্ষিপ্র ও শক্তিশালী মাদক-বুলেট। এগুলো ৪ থেকে ৫ মিঃ মিঃ ব্যাস এবং ৩ মিঃ মিঃ ঘনত্ব বিশিষ্ট ২৫ থেকে ৩০ মিঃ গ্রাম এর ট্যাবলেট। রং লালচে, কমলা বা সবুজাভ। কোটি কোটি, টনকে টন ট্যাবলেটে ভরে উঠতে লাগলো জার্মান সামরিক রসদের ভান্ডারগুলো।

বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সামরিক ভান্ডার থেকে সৈন্যদের যত বুলেট সরবরাহ করা হয়েছিল তার প্রায় সমপরিমাণ সরবরাহ করা হয়েছিল Methamphetamine-সম্বলিত এই ক্ষিপ্রতা সৃষ্টিকারী ট্যাবলেট। এমনও হয়েছে যে শুধু এই ট্যাবলেট খেয়েই ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত জার্মান সেনারা বিনা ঘুমে, বিনা বিশ্রামে, বিনা খাবারে, বিনা ক্লান্তিতে, অসম্ভব ক্ষিপ্রতা, সাহস, গতি ও হিংস্রতা নিয়ে শুধু একটানা সামনে এগিয়েছে। একর পর এক ইউরোপের নগর-বন্দর, জনপদ, ক্ষেষত-খামার, মাঠ-প্রান্তর পাড়ি দিয়েছে। প্রতিপক্ষের গুলিও খেয়েছে, কিন্তু ট্যাবলেটের মধ্যে কোকেনের উপস্থিতির কারণে তাদের ছিল না কোন ব্যথার অুনভুতি। বরং এর মধ্যকার Ecstacy তাদেরকে করে তুলেছে আরো হিংস্র ও ক্ষিপ্র। শুধু জার্মানি নয়, জার্মানির দেখাদেখি জাপান, আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের সেনাবাহিনীর মধ্যে বুলেটের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে মেথামফিটামিন ট্যাবলেট ও ইনজেকশনের ব্যবহার শুরু করে। গেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জুড়ে মেথামফিটামিনের উপস্থিতি এমন প্রকট ছিল যে, এ যুদ্ধকে গেলাবারুদ ও সমরাস্ত্রের যুদ্ধ না বলে মেথামফিটামিনের যুদ্ধ বললেও অত্যুক্তি হবে না। মেথামফিটামিন মানুষের মধ্যে কেবল গতি ও ক্ষিপ্রতা সঞ্চার করে না, ভয়ঙ্কর উন্মাদনা এবং হিংস্রতারও জন্ম দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর নির্মিত বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র ও মুভি এবং লিখিত বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে এসব উন্মাদনা ও হিংস্রতার বহু প্রমাণ পাওয়া যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বিভিন্ন ফ্রন্টে জার্মান বাহিনী মার খাচ্ছিল। কোথাও কোথাও অচিন্তনীয়ভাবে তারা Collapse করে যাচ্ছিল। বিশেষ করে রাশিয়ার ফ্রন্টে তাদের শোচনীয় পরাজয়ের বহু রকম ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও সে সময় তাদের গতি, ক্ষিপ্রতা, সতর্কতা ও ক্রিয়াশীলতার যে ভাটা পড়েছিল তার পিছনে মেথামফিটামিন সরবরাহের ঘাটতি স্থানীয়ভাবে পূরণ করা সম্ভব হলেও একমাত্র মেথামফিটামিন পাওয়ার কোন পথ ছিল না।

মেথামফিটামিনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি মুখে গ্রহণ করলে ২ থেকে ৩ ঘন্টার মধ্যে এর স্নায়ু উত্তেজক ক্রিয়া শুরু হয়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘন্টা স্থায়ী হয়। এ সময়ের মধ্যে ব্যবহারকারী শারীরিক ও মানসিকভাবে এমন এক জগতে অবস্থান করে যেখানে কোন ক্ষুধা, বেদনা, ক্লান্তি, অবসাদ নেই। বরং ব্যবহারকারীর মধ্যে এক ধরণের অতিমানবিক শক্তি ভর করে। এ অতি মানবিক শক্তির প্রভাবে সে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। কিন্তু ১০-১২ ঘন্টা পর মাদকের প্রভাব কেটে যাওয়ার পর নতুন করে আবার এ মাদকটি গ্রহণ না করলে ব্যবহারকারী সোজা আকাশ থেকে পাতালে পতিত হয়। মাদকের প্রভাব তাকে যে পরিমাণ গতি, ক্ষিপ্রতা, উদ্দামতা, উচ্ছ্বলতা, শক্তি, সাহস, ক্ষমতা যোগায়, রক্তপ্রবাহ থেকে মাদকের প্রভাব দুরীভুত হলে ব্যবহারকারী তার দ্বিগুণ পরিমাণে ভেঙ্গে পড়ে। তার মধ্যে নেমে আসে মৃত মানুষের নিস্তেজতা, নিঃস্বতা ও অসাড়ত্ব। সীমাহীন ক্লান্তি, অবসাদ, বিষাদ, অসহায়ত্ব ও নৈরাশ্য তাকে এক অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে দেয়। একে প্রত্যাহার জনিত প্রতিক্রিয়া বলা যায়। মেথামফিটামিনের প্রত্যাহারজনিত প্রতিক্রিয়া হেরোইনের চেয়েও মারাত্মক; কখনও কখনও জীবন বিধ্বংসী। এর ব্যবহৃত ডোজের মাত্রা বেশি হলে প্রত্যাহারজনিত প্রতিক্রিয়া এতো তীব্রতা লাভ করে যে এ অবস্থায় ব্যবহারকারী যে কোন অস্বাভাবিক ও অযাচিত ঘটনা ঘটাতে, এমনকি আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে পারে।

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরে আমেরিকা, জার্মানি, ইংল্যান্ড, জাপান প্রভৃতি সুপার পাওয়ার দেশগুলোর যে লক্ষ লক্ষ সৈন্য ওয়ার ফ্রন্ট ছেড়ে ঘরে ফিরে আসে, তাদের অধিকাংশই ছিল মারাত্মকভাবে মেথাফিটামিনে আসক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নায়করা দেশজয় ও নরহত্যার নিষ্ঠুর খেলায় এমন উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন যে, তাদের নিজ দেশের সন্তান তরুণ সেনাদের উপর মেথামফিটামিন প্রয়োগের ক্ষেষত্রে তাদের কোন পরিণতি চিন্তা, নীতিবোধ বা মাত্রাজ্ঞান ছিল না। যুদ্ধের ফ্রন্টে এদেরকে একটানা ৫দিন, ৭ দিন বা ১০ দিন জাগ্রত ও সচল রাখার জন্য অতি উচ্চ মাত্রায় যথেচ্ছ মেথামফিটামিন প্রয়োগ করা হতো। ফলে এদের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের যে ব্যাপক ক্ষতি হয়, তাতে যুদ্ধ শেষে অনেকের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। কারো কারো Chronic insomnia, আবার কারো কারো Narcolepsy দেখা দেয়। এসব যুদ্ধফেরত †সনাদের অনেকে মেথামফিটামিন তথা ‘Speed’ এর Top peak বা Flash থেকে হঠাৎ এবং বার বার হতাশা, বিষাদ, নৈরাশ্য, অবসাদ ও ক্লান্তির অতল গহ্বরে পতিত হবার ধাক্কা সামলাতে না পেরে নানা রকম স্নায়ুরোগ ও মনোবৈকল্যের শিকার হয়, এমনকি কেউ কেউ আত্মহত্যাও করে (চলবে)


মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:০০

হামিদ আহসান বলেছেন: ভাল পোস্ট৷ অনেক কিছু জানার অাছে..
.....

২| ০৮ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:৫৫

মিটন আলম বলেছেন: ধন্যবাদ হামিদ আহসান

৩| ২০ শে আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪০

এহসান সাবির বলেছেন: ইয়াবার ইতিহাস জেনে গেলাম।

৪| ২০ শে আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৭

তপ্ত সীসা বলেছেন: জানলাম ভায়া। এইডা তো দেখি ডেঞ্জুপদ জিনিস

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.