নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিটন আলম

মিটন আলম › বিস্তারিত পোস্টঃ

নারী উন্নয়নে বিশ্বায়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব ; নেতিবাচক প্রভাব উত্তরণের সম্ভাব্য পদক্ষেপ।

০৮ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ১০:২১

বিশ্বায়নের সংজ্ঞাঃ
বিশ্বায়ন হল একটি প্রক্রিয়া যার সাহায্যে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংস্থা বা এজেন্সি বিশ্ব জুড়ে নিজেদের মধ্যে নানা প্রকার সম্পর্ক গড়ে তোলে। সম্পর্ক স্থাপনের পেছনে থাকে নানা ধরনের কারকের সক্রিয় অংশগ্রহণ। কারকগুলো নিজেদের মধ্যে যখন সম্পর্ক গড়ে তোলে তখন তা নিজক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। বিশ্বায়নের সঙ্গে সমগ্র বিশ্বের নানাবিধ বিষয় যেমন- অর্থনীতি, বাণিজ্য, যোগাযোগ, রপ্তানি, শিল্পায়ন ইত্যাদি নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মূলত রাজনৈতিক ধারনার সঙ্গে জড়িত।বেশির ভাগ বিশ্লেষক বিশ্বায়ন ধারণাটিকে অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মনে করে এর অনুপুঙ্খ আলোচনায় বসেন যা একেবারে অযেŠক্তিক নয়। কারণ সা¤প্রতিককালে তৃতীয বিশ্বের দেশগুলোর জনতা ও শিক্ষিত মহল বিশ্বায়নকে অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে দেখে থাকেন। বিশ্বায়নকে তাই উৎপাদন এবং মূলধনের আন্তঃরাষ্ট্রীকরণ বলে গণ্য করার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্?ানগুলো এই আন্তরাষ্ট্রীকরণকে বৈধ করে তোলার ব্যবস্থা করে। অন্য একটি সংজ্ঞায় বিশ্বায়নকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিশ্বায়ন হল বাজার-চালিত একটি প্রক্রিয়া, যা বহিস্কারকে স্বাগত জানায় অথবা বাধা দেয়। কিন্তু পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বিশ্বায়ন বলতে বোঝায় ক্রমবর্ধমান খোলামেলা পরিবেশ, উন্নত ধরনের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং সমন্বয়। বর্তমানে অনেকে বিশ্বায়ন বলতে অর্থনৈতিক লেনদেন এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্?ান তৎপরতা বৃদ্ধি বুঝিয়ে থাকেন। অর্থাৎ জাতি রাষ্ট্রের সার্বভেŠম ক্ষমতার আওয়ায় অর্থনৈতিক লেনদেনও ব্যবসা-বাণিজ্য থাকলে তার আকর ও চরিত্র যে রূপ নেবে বিশ্বায়নের গন্ডির মধ্যে এলে এগুলো সম্যক বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডঞঙ) মহাপরিচালক বিশ্বায়নের সাথে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে সংশ্লেষিত করেছেন-

১. মুক্ত বাণিজ্য নীতি;

২. বাজার ব্যবস্থার প্রাধান্য;

৩. বিশ্ব অর্থনীতির একত্রীকরণ;

৪. উৎপাদন ব্যবস্থার স¤প্রসারণ;

৫. বেসরকারিকরন;

৬. মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা;

৭. রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের প্রতি গুরুত্বারোপ;

৮. অর্থনীতিতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস ইত্যাদি।

বিশ্বায়ন কোন সংকীর্ণ ধারণা নয়, এটি একটি বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। এর বহিঃপ্রকাশও বিভিন্নমুখী। বিশ্বায়নের বিকাশে তাই বিভিন্ন ধরনের শক্তির প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ স্পষ্ট। বহুজাতিক সংস্থার মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল প্রভৃতি। এসব সংস্থা বিশ্ব অর্থনীতি স¤প্রসারণে পালন করছে ব্যাপক ভুমিকা। তথ্য ও প্রযুক্তির বিকাশ, বিশ্ব যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তনই বিশ্বের সভ্যতা ও জনসমাজে পারস্পরিক নৈকট্য সুদৃঢ় করেছে। আর এসবের ফলে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া হয়েছে ত্বরান্বিত।

বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্যঃ

বিশ্বায়নের চারটি মূল বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়:

ক. ভেŠগোলিক অবস্থানের ঊর্ধ্বে সামাজিক নতুন বিন্যাস যার মাধ্যমে দূরের মানুষের সাথে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ এবং সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব। এই সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে ক্ষমতার নতুন বিন্যাসও তৈরি হচ্ছে।

খ.বিশ্বব্যাপী সামাজিক সম্পর্কের এবং বিনিময়ের ব্যাপ্তি, গভীরতা, গতি এবং প্রভাব ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গ. নতুন নতুন নেটওয়ার্ক এবং যোগাযোগের ‘গ্রন্থী’ সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক সমাজবিজ্ঞানী একে জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা বলে অভিহত করছেন। যদিও পশ্চিমা দেশসমূহে এর উৎপত্তি, তথাপি এটি ক্রমশ যোগাযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে।

ঘ. বিশ্বায়ন কোন একমুখী প্রক্রিয়া নয়। দুটি বিপরীত বা অনেকের মতে, দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া এর সাথে জড়িত। এর প্রথমটি হচ্ছে বিশ্বমুখীনতা বা এষড়নধষ যার মাধ্যমে বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন সমাজ হচ্ছে।

বিশ্বায়নের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যঃ
উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে এবং বিগত একব দশকের অধিককাল বিশ্বায়নের ক্রমবর্ধমান সক্রিয়তা থেকে এর কতকগুলো বৈশিষ্ট্য পেয়ে থাকি। এগুলোকে সংক্ষেপে নিম্নে বর্ণনা করা হলো:
ক. বিশ্বায়নের সাথে রাজনীতি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় নিবিড়ভাবে জড়িত থাকলেও মুলত এটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া। বেশিরভাগ লোকের নিকট বিশ্বায়ন বলতে বোঝায় অর্থনৈতিক লেনদেন। বিশ্বায়নের মাধ্যমে প্রতিটি দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে যার ফালে পণ্যের উৎপাদন, বন্টন ও বিপণন সবই সমগ্র বিশ্বের বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে পরিচালিত হবে।

খ. বিশ্বের প্রতিটি দেশের আর্থ-ব্যবস্থা পরস্পরের নিকট উন্মক্ত হবার ফলে জাতিরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে অর্থনীতি মুক্ত হবে এবং বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি পারস্পরিক নির্ভরতার দ্বারা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে পড়বে। অর্থাৎ এক দেশের অর্থনীতি অন্য দেশের অর্থনীতির ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল হয়ে উ?বে যা বিশ্বায়নের আগে ছিল।

গ. এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার দরুন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্থ-ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে যে ফারাক ছিল তার অবসান ঘটবে এবং বিশ্বায়নের প্রবক্তগণের মতে সমগ্র আর্থ-ব্যবস্থার মধ্যে একটি অখন্ডতা বা সংহতির আবির্ভাব ঘটবে, এতে আমাদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং অখন্ডতা বা সংহতি পরস্পরের পরিপূরক বলে মনে হবে।

ঘ. বিশ্বায়নের সঙ্গে উদারীকরণের নিবিড় সম্পর্কে কথা অনেকে বলেন। বিশ্বায়নের আবির্ভাবের আগে প্রতিটি জাতি রাষ্ট্র নিজ নিজ অর্থনৈতিক নীতি ও কেŠশল স্থির করত। কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে সেই সমস্ত জাতি-রাষ্ট্রের ভূমিকা একেবারে কমে যাবে। বাজার-অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে জিনিসপত্রের উৎপাদন, দাম, বিনিময়, বাণিজ্য, লেনদেন ইত্যাদি সবকিছুই নির্ধারিত হতে থাকবে। যে কোন কারণেই হোক, জাতি রাষ্ট্র এই পরিস্থিতি মেনে নিয়েছে এবং বলা যেতে পারে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে এবং সর্বোপরি তা করার জন্য জাতি-রাষ্ট্রগুলো তাদের আর্থ-ব্যবস্থা সংস্কার সাধন করেছে। সুতরাং বিশ্বায়ন আর্থ-ব্যবস্থার একটি বিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া নয়, এর সঙ্গে উদারীকরণ ও সংস্কারের নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। বিশ্বায়নকে সফল করে তুলতে হলে প্রতিটি দেশের স্বতন্ত্র আর্থ-ব্যবস্থার সংস্কার অপরিহার্য হয় পড়ে।

ঙ. আপাতদৃষ্টিতে বিশ শতকের আটের দশকের শুরুতে বিশ্বায়নের আবির্ভাব ঘটলেও পন্ডিতরা বলেন যে উনিম শতকের সাতের দশকের শুরুতে এর সূচনা হয়েছিল। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের আগে পর্যন্ত বিশ্বায়ন মন্থর গতিতে চলেছিল। তারপর নানা কারনে এর গতি মন্থর বা স্তব্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্বায়ন ব্রিটন উডস প্রতিষ্?ানগুলো মাধ্যমে নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু করে। সুতরাং বিশ্বায়নকে একটি অত্যাধুনিক ঘটনা বলে মনে করা উচিত নয়।

চ. বিশ্বায়ন ধারণাটি যেমন সংস্কার ও উদারীকরণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ?িক তেমনি সুস্থিতিকরণ (ংঃধনরষরংধঃরড়হ) এবং কা?ামোগত সুবিন্যাস নামক দুটি ধারণার সঙ্গে জড়িত। অর্থনীতির একটি মেŠলিক ধারণা হল চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমতা বা ভারসাম্য না থাকলে আর্থ-ব্যবস্থাতে সংকট বা বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। বিশ্বায়ন চায় যোগান ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য থাকুক। সমগ্র বিশ্বের অর্থ-ব্যবস্থাকে এমনভাবে পরিচালিত করতে হবে যার ফলে যোগান ও চাহিদার মধ্যে অভারসাম্য না থাকে। এই পরিস্থিতির অবসান ঘটানো সম্ভব হলে প্রতিটি দেশের আর্থ-ব্যবস্থা এবং সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতির মধ্যে সুস্থিতি অবশ্যই আসবে। কা?ামোগত সুবিন্যাস বলতে বোঝায় শিল্প প্রতিষ্?ান ও উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্?ান বা সংস্থাগুলোকে সরকারের ক?োর নিয়মকানুনের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশের মধ্যে আনা। অর্থাৎ কা?ামোগত সুবিন্যাস বলতে বোঝায় প্রধানত বেসরকারিকরণ। এছাড়া অন্যান্য নিয়ম কানুনগুলোকে শিথিল করার কথাও বলা হয়েছে।

ছ. বিশ্বায়ন ভেŠগোলিক ব্যবধান মানে না। বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে অর্থনীতির হালচাল দ্রুত বদলে যেতে শুরু করে। অর্থনীতিক প্রক্রিয়া কোন একটি দেশের ভেŠগোীলক সীমানার মধ্যে বন্দী হয়ে থাকেনি। জাতি-রাষ্ট্রগুলোর ভেŠগোলিক সীমানাকে অস্বীকার করে বিশ্বের নানা দেশের প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব স্থাপন করতে থাকে। অর্থনীতির বিশ্ব জুড়ে বিস্তৃতি হল বিশ্বায়ন। অর্থাৎ বিশ্বায়ন স্বীকার করে নিল জাতি-রাষ্ট্রের গন্ডির মধ্যে অর্থনীতিক কাজ কর্ম সীমাবদ্ধ থাকে না।

জ. বিশ্বায়নের মধ্যে উন্মুক্ততা ও উদারীকরণ বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু এই দুটি শব্দকে সঙ্কীর্ণ অর্থে ব্যবহার করলে চলবে না। বিশেষ করে উন্মুক্ত কথাটি বিশ্বায়নের মধ্যে কার্যত ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে। যেমন-উন্মুক্ততা বলতে বুঝায় পুঁজি, পণ্য সামগ্রী ইত্যাদির অবাধ সরবরাহ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিশ্বায়নের মধ্যে প্রযুক্তিবিদ্যা, তথ্যভাবনা, চিন্তাধারা, মতবাদ, মতাদর্শ ইত্যাদির অবাধ বিস্তার। তথ্য প্রযুক্তি কোন একটি দেশে আবদ্ধ থাকবে না।

ঝ. বিশ্বায়নের মধ্যে একটি পরিচালনা বা প্রশাসনগত ধারণা নিহিত আছে বলে আমরা মনে করি। অর্থাৎ অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোন বিষয়ের পরিচালন দায়িত্ব কোন একটি দেশ বা সংস্থার ওপর থাকবে না। কার্যত পরিচালনা বিষয়টি পুরো আন্তর্জাতিককরণ হয়ে যাবে।

ঞ. কেউ কেউ মনে করেন যে উত্তরের শিল্পসমৃদ্ধ পুঁজিবাদী দেশগুলো প্রধানত নিজেদের স্বার্থেই বিশ্বায়ন বা উদারীকরণ দক্ষিণের উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। উন্নয়লশীল দেশগুলোর নতুন নতুন বাজার দখল করা, এই সমস্ত দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করাই বিশ্বায়নের প্রধান লক্ষ্য। তাই কেউ একে বিশ্বায়নের মোড়কে নয়া উপনিবেশবাদ নামে অভিহিত করতে চান।

বিশ্বায়নের কারণঃ
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিস্ময়কর বিকাশ। বিশ্বকে যুক্ত করার প্রথম প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ঔপনিবেশিক যুগের প্রথম দিকে সারা দুনিয়া জুড়ে টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপনের মাধ্যমে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কম্পিউটারের উদ্ভাবন ঘটে এবং ১৯৬৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের উদ্যোগে অজচঅঘঊঞ নামক প্রজেক্টের মাধ্যমে শুরু হয় ইন্টারনেটের। ইন্টারনেট এবং ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগ এখন বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম। বিশ্বায়নের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্র্ণ কারণ হচ্ছে বিশ্বের কেন্দ্রে এবং কেন্দ্রের বাইরে কোন কোন অঞ্চলে বিশাল বহুজাতিক সংস্থা গড়ে ও?া। বহুজাতিক সংস্থা তাদের প্রযুক্তি এবং ব্যবসায় কেŠশল এক দেশ থেকে অন্য দেশে প্রসার ঘটায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন বহুজাতিক সংস্থাগুলো ইউরোপ উৎপাদন শুরু করে। ১৯৭০ সালের পর ইউরোপীয় সংস্থাগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন শুরু করে। একই সময়ে জাপানী সংস্থাগুলোও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উৎপাদন শুরু করে। এভাবে বহুজাতিক সংস্থা অর্থনৈতিক একীভবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে করে ফেলেছে এককেন্দ্রিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিণত হয়েছে বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তিতে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পৃথিবীর সামনে ধনতন্ত্রের আর কোন বিকল্প নেই। ধনতন্ত্র পরিণত হয়েছে “প্রাকৃতিক ব্যবস্থায়”।

বিশ্বায়নের মাধ্যমসমূহঃ
বিশ্বায়ন কোন সংকীর্ণ ধারণা নয়, এটি একটি বহুমাত্রিক প্রক্রিয়া। এর বহিঃপ্রকাশও বিভিন্নমুখী। বিশ্বায়নের বিকাশে তাই বিভিন্ন ধরনের শক্তির প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ স্পষ্ট। বহুজাতিক সংস্থার মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল প্রভৃতি। এ সব সংস্থা বিশ্ব অর্থনীতির স¤প্রসারণে পালন করছে ব্যাপক ভূমিকা। তথ্য ও প্রযুক্তির বিকাশ, বিশ্ব যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তনই বিশ্বের সভ্যতা ও জনসমাজে পারস্পরিক নৈকট্য সুদৃঢ় করেছে। আর এসবের ফলে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া হয়েছে ত্বরান্বিত।

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার অবয়বঃ
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া একটি সর্বাতœক প্রক্রিয়া। তবু এর প্রধান অবয়বগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব:
(র) বিশ্বায়ন ও পুঁজিবাদঃ
পুঁজিবাজারের প্রসার ঘটেছে ইউরোপীয় দেশগুলোর লেইসেজ ফেয়ার (খধরংংবু-ভধরৎব) নীতির ফলে। পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত ধারনা হচ্ছে অন্তর্নিহিত ব্যবসা। বিশ্বজোড়া ব্যবসা। এটা উন্নয়নশীল দেশগুলোর চেয়ে পুঁজিবাদী দেশগুলোর জন্যই বেশি সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করছে। সাহায্য ও সহযোগিতার নামে শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো অপেক্ষাকৃত গরীব দেশগুলোর সস্তা শ্রম ব্যবহার করে তাদের শোষন করছে।

(রর) বহুজাতিক সংস্থা ও বিশ্বায়নঃ
মার্কিন যুক্তাষ্ট্রের ব্যবসা-সংস্থাগুলো একত্রীভবনের মাধ্যমে বহুজাতিক সংস্থার বিকাশ লাভ করে। গ.ডধঃবৎং. এর ‘এষড়নধষরুধঃরড়হ’ (১৯৯৫)-এ দেয়া তথ্য অনুসারে, ১৯৮৮ সালে বিশ্বে ২০,০০০ বহুজাতিক সংস্থা ছিল যাদের বৈদেশিক সম্পদ ছিল ১.১ ট্রিলিয়ন ডলার এবং মোট সম্পদ ছিল প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। বাজার অর্থনীতির ২৫-৩০ শতাংশ জিডিপি এবং ৭৫ শতাংশ আন্তর্জাতিক পণ্যবাণিজ্য ছিল তাদের হাতে। বহুজাতিক সংস্থাগুলো বিশ্বব্যাপী শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং অংশীদারি বাণিজ্যের মাধ্যমে সারা বিশ্বের বাজার অর্থনীতি তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে, ফলে সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতির। এভাবেই বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক অবয়ব বহুজাতিক সংস্থার ওপর নির্ভর হয়ে পড়ছে।

(ররর) রাজনৈতিক বিশ্বায়নঃ
বর্তমানকালের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জাতিরাষ্ট্রের অবক্ষয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্?ানের বিকাশ। ১৯২০ সাল থেকে শুরু হয় ‘আন্তর্জাতিক সরকারি সংস্থা’র বিকাশ। ১৯৫৫ সালে জাতিসংঘ ব্যবস্থা থেকে তার দ্রুতবিকাশ হয়। ১৯৯২ সালে এ ধরনের প্রতিষ্?ানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৩০০০-এ। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বেসকারি সংস্থার বিকাশও লক্ষণীয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মাত্র অল্প কিছু প্রতিষ্?ান থেকে ২০০৩ সালে এদের সংখ্যা ১৭০০-এ দাঁড়ায়।

স্যামুয়েল হান্টিংটন এবং ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার মত তাত্ত্বিকগণের মতে সারা বিশ্বজুড়ে একটি সাধারণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটছে, এই সাধারণ রাজনৈতিক সংস্কৃতিক হচ্ছে গণতন্ত্র। হেগেলকে অনুসরণ করে ফুকুয়ামা মনে করেন আমরা ইতিহাসের শেষপ্রান্তে এসে গেছি। ইতিহাসের বিশাল বিশাল প্রশ্নগুলোর সমাধান হয়ে গেছে। সারা বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি এবং উদারনৈতিক গণতন্ত্র বিস্তার লাভ করছে। বাজার অর্থনীতি এবং উদারনৈতিক গণতন্ত্রের কোন বিকল্প সম্ভব নয়। ফলে এর বিকল্প কা?ামোগুলো ক্রমশ ভেঙ্গে পড়ছে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ লক্ষণীয় পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে। সমাজতান্ত্রিক বিকল্প কা?ামো দেশগুলোতে একের পর এক ভেঙ্গে পড়েছে এবং পড়ছে। ফলে ক্রমাগতভাবে গণতান্ত্রিক কা?ামোর বিস্তার লাভ করছে।

(রা) সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নঃ
যদিও বিশ্বায়নমূলত ব্যবসা-বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক বিষযগুলোর সাথে জড়িত। তথাপি এখন একে শুধামাত্র সেই প্রেক্ষাপটেই বিবেচনা করা হয় না। টেলিভিশনের স্যাটেলাইট চ্যানেল এব সারা বিশ্বে ব্যবসা বাণিজ্য প্রসার করার জন্য একটি সীমানা হীন বাজার তৈরি রার পদ্ধতি। কিন্তু মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। যোগাযোগ মাধ্যমের অত্যাধুনিক উন্নতি এবং দ্রুতযোগাযোগ ব্যবস্থা দুনিয়াটাকে আরো কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। বিশ্বের সবগুলো দেশ একটি গ্রামের বিভিন্ন পরিবারের মত। একটি দেশ দুর্দশায় পতিত হলে অন্য দেশগুলো তাৎক্ষনিকভাবে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। বিশ্বায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে যদি আমরা পারস্পারিক সমঝোতা এবং সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে পারতাম তাহলে আমাদের পৃথিবী অবশ্যই আরো ভাল বাসযোগ্য পরিবেশ পরিমত হতো। এবং অংশীদারি বাণিজ্যের মাধ্যমে সারা বিশ্বের বাজার অর্থনীতি তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতির। এভাবেই বাজার অর্থনীতির ২৫-৩০ শতাংশ জিডিপি এবং ৭৫ শতাংশ আন্তর্জাতিক পন্যবাণিজ্য ছিল তাদের হাতে। গ.ডধঃবৎং এর এষড়নধষরুধঃরড়হ (১৯৯৫) এ দেয়া তথ্য অনুসারে ১৯৯৮ সালে বিশ্বে ২০,০০০ বহুজাতিক সংস্থা ছিল তাদের মোট সম্পদ ছিল প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার।

বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাঃ
বিশ্বায়নের ব্যাপারে এ যাবৎ উদ্ভুত সকল বিতর্কের মধ্যে যা জটিল ও গুরুত্বপূর্র্ণ তা হলো এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা। কেননা, বিশ্বায়ন মূলত উত্তরের ধনী দেশ খ্যাত পুঁজিবাদী বিশ্বের স্লোগান। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ভিন্নমাত্রায় অনেক আগেই সূচিত হলে বর্তমান সর্বগ্রামী ও সর্বধ্বংসীরূপ এই বিতর্কের জন্মদাতা। তথ্য প্রযুক্তির ওপর ভর দিয়ে গোটা বিশ্ব অনেক এগিয়েছে সত্য কিন্তু এ অগ্রযাত্রার সুফল কতটা পেয়েছে স্বল্পোন্নত দক্ষিণের বিশ্ব এটি জটিল প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। অথচ সবার জন্য সব সুযোগ ও সুবিধার লক্ষ্যেই শুরু হয়েছিল বিশ্বায়নের অভিযাত্রা। আজ অবধি বিশ্বায়নের যেটুকু সুমিষ্ট স্রোত তার সিংহভাগই প্রবাহিত হয়েছে উন্নত ও ধনিক দেশগুলো নিয়ে। স্বল্পোন্নত বিশ্বে সেটুক ছিটেফোঁটা এসেছে তাও একচেটিয়াভাবে কুক্ষিগত করেছে অতি ক্ষুদ্র একটি স্বার্থবাদী শ্রেণী। মোট কথা বিশ্বায়ন সকলের জন্য সমান সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরিতে দারুণভাবে ব্যর্থতারই পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু বিশ্বায়নের এ ব্যর্থতার অর্থ এ নয় যে বিশ্বায়নের অগ্রযাত্রায় স্থবিতা নেমে আসবে। বরং নিত্য নতুন কেŠশল নিয়ে বিশ্বায়ন তার অপ্রতিরোধ্য গতি আরো জোরদার করেছে, আর তাতে হুমকিগ্রস্ত হয়েছে স্বল্পোন্নত দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি। বিশ্বায়নের অবাধ প্রতিযোগিতার নীতিতে ধনিক ও দরিদ্র বিশ্বের মধ্যকার ব্যবধান আরো প্রকট হচ্ছে। আর এসব বিষয় মাথায় রেখে বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক এই দুই দৃষ্টিকোন থেকে আলোচনা করা যায়।

বিশ্বায়নের ইতিবাচক সম্ভাবনাঃ
বিশ্বায়ন মানবজাতির প্রয়োজনেই উদ্ভুত এক ব্যাপকভিত্তিক প্রত্যয়। কালের বিবর্তনে মানুষের রুচি মানসিকতার ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, মানুষের চাহিদাও ব্যাপকতা পেয়েছে বহুলভাবে। আর এ চাহিদা পূরণ কোন এক ক্ষুদ্র জনসমাজের পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষকরে স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় যেখানে সম্পদের তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি তাদেরকে বাধ্র হয়েই বিশ্বায়নে অঙ্গীভূত হতে হচ্ছে। তা ছাড়া পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত কলাকেŠশল ও প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়ে এসব দেশও তাদের সহযোগী ভাবতে পারছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আন্তর্জাতিক পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যয় হ্রাস, জাতীয ও আন্তর্জাতিক সমৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন গুরুত্বপূর্র্ণ ভূমিকা পালন করছে। বৈশ্বিক উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং পুঁজির প্রবাহ ব্যাপক হয়েছে। তাই এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় ঊনবিংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দী এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর জন্য বিশ্বায়ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্র্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসবে। এর প্রমাণ, গত চার দশকে এশীয় দেশগুলো বিশ্ব বাজারে তাদের পণ্য বিক্রি করে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

বিশ্বায়নের নেতিবাচক সম্ভাবনাঃ
এষড়নধষরুধঃরড়হ বা বিশ্বায়ন নয়া ঔপনিবেশিকতাবাদের একটি প্রক্রিয়া বা অর্থনৈতিক কেŠশল। উপনিবেশবাদের যুগ শেষ হলেও এখন চলছে বিশ্ব নয়া উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদের লগ্নি পুঁজি যুগ। সেদিনকার সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আজ আর সৈন্যসামন্ত নিয়ে দেশ দখল করে শাসন ও শোষণ করে না। এখন তারা পুঁজি লগ্নির মাধ্যমে চালায় প্রত্যক্ষ শোষণ ও পরোক্ষ শাসন। বিশ্বায়ন তৃতীয় বিশ্বের জন্য এই শোষণেরই ধারক ও বাহক। তাই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া থেকে তৃতীয় বিশ্বের প্রাপ্তির সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, অথচ হারাবার ভয় ব্যাপক। পুঁজিবাদের বিশ্বায়নের বা এষড়নধষরুধঃরড়হ-এর মোড়কে নব্য সাম্রাজ্যবাদই তাদের ওপর অগাধ রাজত্ব করে যাচ্ছে এবং উন্নত দেশের উৎপাদিত দ্রব্যের ভোক্তা শ্রেণীতে পরিণত করে চলেছে। ফলে অনুন্নত দেশের কলকারখানাগুলো অবাধ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারায় তা দিন দিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না পারলে অনুন্নত দেশগুলোর ভবিষ্যৎ হবে আরো অন্ধকার। বিশ্বায়নের প্রভাবে অনুন্নত দেশের শিল্প ধ্বংস হতে বাধ্য। কেননা বিদেশী পণ্যের সাথে প্রতিযোগিতায় দেশীয় পণ্য টিকে থাকতে পারবে না। বিশ্বব্যাংকের দেয়া কা?ামোগত সংস্কার নীতি বাস্তবায়নেও এসব দেশ আরো বেশি সমস্যায় পতিত হবে বলেই অভিজ্ঞ মহলের বিশ্বাস। সুতরাং বলা যায় বিশ্বায়নের অবাধ প্রতিযোগিতায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন।

বিশ্বায়নের ফলাফলঃ
বিশ্বায়নের ফলাফল সম্পর্কে অনুমান করা হয় যে, তা সবদেশের জন্য সমান হবে না। বিশ্বায়নের ফলে অনেক দেশ হয়ে পড়বে দরিদ্রতর, অনেক মানুষ হবে দরিদ্র। বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক লেনদেন এবং বিধিনিষেধ দরিদ্র দেশগুলির জন্য সৃষ্টি করবে নতুন ঝুঁকি এবং সংকট। পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলির পক্ষে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধি অর্জন ক?িন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পড়বে। স্বল্পোন্নত দেশগুলো ডব্লিউটিও এর বাণিজ্য নিয়মের ফলে বছরে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের লোকসানের শিকার হবে। আশি এবং নব্বই-এর দশকে বিশ্ববাণিজ্যে স্বল্পোন্নত দেশের অংশ ০.০৫ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে নেমে এসেছে ০.০৩ শতাংশে। বিশ্বায়নের ফলে উন্নয়নশীল বিশ্বে বেকারত্ব বেড়ে যাচ্ছে, মজুরিতে অসমতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং শ্রমের মান দুর্বল হচ্ছে। যথেচ্ছা উদারীকরণ নীতি উন্নয়নশীল দেশের শিল্পখাতের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। বিশ্বায়নের ফলে সৃষ্ট নতুন ব্যাধি এবং বিপর্যয়ের শিকার হয়ে অনেক মানুষ অসহায় হয়ে পড়বে। বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক ফলাফল খুব গুরুত্বপূর্র্ণ হলেও তার সামাজিক অভিঘাত কম তাৎপর্য বহন করে না। অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন বর্ণবাদের বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছে। আফ্রিকায় বিশ্বায়ন প্রভাবিত অর্থনৈতিক অসম বন্টন ইতোমধ্যেই বর্ণবাদ সংঘাতের সৃষ্টি করেছে। উন্নয়শীল দেশে নগরায়নের দ্রুতগতি এক বিরাট সমস্যা সৃষ্টি করেছে। নগায়ন প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত দ্রুতগতির উৎসে রয়েছে বিশ্বায়ন। উন্নয়নশীল বিশ্বে ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে দশ লক্ষ বা তার বেশি জনসংখ্যাবিশিষ্ট ৩০০টি নগর। এরকম সাতটি মহানগরের প্রত্যেকটিতে থাকবে ১৫ মিনিয়নের বেশি লোক। এসব নগরে থাকবে লক্ষ লক্ষ আশ্রয়হীন মানুষ। চীনেই রয়েছে এমন ৫০ মিলিয়ন আশ্রয়হীন মানুষ। নগর ক্রমাগত মানুষকে টানছে উজ্জ্বল আলোর দিকে, গ্রাম থেকে শহরে নগরে দেশ থেকে দেশান্তরে। ২০০০ সালে ১০০ মিলিয়নের বেশি লোক তার নিজ রাষ্ট্রের বাইরে বসবাস করছিল। পরিবার ভেঙ্গে পড়ছে, বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ, অপরাধ আন্তর্জাতিক হয়ে পড়ছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্যের বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে ৫০০ বিলিয়ন ডলার। অস্ত্র ব্যবসার পর এটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম পণ্য। সুতরাং, বিশ্বায়নের প্রভাব পর্যালোচনার জন্য অর্থনৈতিক ফলাফলের পাশাপাশি সামাজিক অভিঘাতগুলোও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উ?ছে।

বিশ্বায়ন এবং নারী পুরুষ বৈষম্য:

বিগত শতকের অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে বিশ্বায়ন বা ভুবনায়ন কথাটি অত্যন্ত পরিচিত একটি শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে। এই গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়ন শব্দটি এখন শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা ভেŠগোলিক ধারনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অঙ্গ হিসাবেই বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এই শব্দটিকে সযতেœ লালিত করছে তাদের আরো অধিকতর মুনাফা অর্জনের স্বার্থে। যদিও বিশ্বায়নের ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল যে, এটি ব্যবহার করা হবে জাতি, রাষ্ট্র সবকিছুর উর্ধ্বে এক বিশ্বব্যাপী সার্বিক উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। বিশ্বায়নের নীতি সারা পৃথিবীতে নানা ধরনের বৈষম্য বৃদ্ধি করছে। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য বৈষম্য হচ্ছে নারী-পুরুষ বৈষম্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে এই বৈষম্যের প্রকৃতি ভিন্ন। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্ম, সমাজ সর্বোপরি জীবনের সবক্ষেত্রেই এই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারীরা। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ন্যূনতম মেŠলিক প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম যার সংখ্যা প্রায় দুইশ কোটি। এদের মধ্যে ৭০ ভাগই হচ্ছেন নারী ও শিশু। বিশ্বায়নের কালো থাবায় আজ শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সামাজিক ব্যবস্থা জরাগ্রস্ত। নিজস্ব সুস্থ সংস্কৃতির বিপরীতে পুঁজিবাদী পণ্য সংস্কৃতিকে উপজীব্য করে এক প্রকার বিশ্ববাজারী সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকে এক প্রকার যেŠনতা এবং ভোগ সর্বস্ব অপসংস্কৃতির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া এসে পড়ছে নারীদের উপর। বিশ্বায়নের এই বাজার সংস্কৃতি ও বাজার অর্থনীতি নারীদের আজ পণ্য হিসেবে পরিণত করেছে। বিশ্বায়নের এই যুগে যদিও নারীদের ঘরের বাইরে কাজের সুযোগ তৈরি করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা নারী পুরুষ বৈষম্যকে সুকেŠশলে বাড়িয়ে তুলেছে। বরং এখন নারীদের ঘরে বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই সমান সময় দিতে হচ্ছে। যা নারীদের শ্রম বোঝাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। একজন শ্রমজীবী নারীকে তার বাইরের কাজ শেষে ঘরের কাজও সমানভাবে করতে হচ্ছে। বিবাহিত মহিলাদের ক্ষেত্রে এই অবস্থা আরো করুণ ও শোচনীয়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর পুরুষ ঘরের কাজে নারীদের সাহায্য করলেও আমাদের মত উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর নারীদের অবস্থা ততো সহজ নয়। যেহেতু শোষণ ও বৈষম্যের বিভিন্ন মাত্রা রয়েছে সেহেতু সে দৃষ্টি ভঙ্গি থেকে দেখলে দেখা যাবে যে পুরো বিশ্বের উন্নত অনুন্নত সব দেশের নারীরা বৈষম্যের শিকার। বিশ্বায়নের এই যুগে নারীদের উপর প্রকাশ্য সামাজিক অপরাধ এবং ব্যক্তিগত পারিবারিক হিংস্র আক্রমণ উভয়ই উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বায়নের ফলে শ্রেণি বৈষম্যের তীব্রতা যত বৃদ্ধি পেয়েছে নারীদের উপর বঞ্চনা- ?িক ততটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। সাথে সাথে নারীদের উপর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দাসত্ব চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, এই বৈষম্য কি! পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের কারণে বাড়ছে নাকি তার জন্য সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট দায়ী? এক্ষেত্রে বলা যায় পিতৃতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট কিছুটা দায়ী হলেও পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন বহুলাংশে দায়ী। বিশ্বায়নের ফলে নারীদের কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে এরকম একটা কথা প্রায়শই শোনা যায়। অীঊ ঘকঊ ইত্যাদি সংস্থার পক্ষ থেকে এশিয়া অঞ্চলে নারীদের কাজের সুযোগ বৃদ্ধির পরিসংখ্যান দেখানো হয়েছে এবং তা অনেক ক্ষেত্রে সত্যও বটে। কিন্তু এর পিছনে মূল কারণ কি? এর মূল কারণ মালিক পক্ষের কাছে নারী শ্রমিকরা অনেক বেশি অনুগত ও বাধ্য। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনেও যুক্ত নয়, যেহেতু তাঁরা পিতা বা স্বামীর পরিপূরক হিসেবে কাজ করেন তাই কম মজুরিতে কাজ করতে ইচ্ছুক এবং বিবাহ বা সন্তান সম্ভাব্য হলে সহজে ছাঁটাই করা যায়। জাতিসংঘের “নারী ও অর্থনৈতিক সংকট” রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, বেসরকারিকরণ ও উদারীকরণ অর্থনীতির ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো যখন হস্তান্তরিত হচ্ছে অথবা বৃহৎ পুঁজির কাছে মার খেয়ে মূল শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন প্রথম ছাঁটাই এর খàড়ে পড়ছেন নারী শ্রমিকরা। বিজ্ঞানের এই যুগে শিল্প কারখানাগুলোতে নতুন নতুন প্রযুক্তি আমদানি হচ্ছে এবং সেই প্রযুক্তি আয়ত্ত করার প্রশ্নে স্বাভাবিকভাবেই প্রশিক্ষণের অভাবে নারী শ্রমিক বা কর্মচারীরা পিছিয়ে পড়ছেন। চিরাচরিত ক্ষুদ্র কুটির শিল্পগুলোতে যে অদক্ষ নারী শ্রমিকরা কাজ করতেন সেগুলোর দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। পাশাপাশি কৃষি কাজে কমর্রত নারী শ্রমিকরা আজ সংকটের কবলে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো মূলত কৃষি প্রধান। কৃষি কাজে মহিলাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ রয়েছে। নৃবিজ্ঞানীদের মতে কৃষি কাজের উদ্ভাবক হচ্ছেন নারীরা। কৃষি কাজে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং চিরাচরিত কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে বহু মহিলা কর্মচ্যুত হচ্ছেন। রাসায়নিক সার, হাই ব্রীড, জৈব প্রযুক্তি ইত্যাদি ব্যবহারের ফলে কৃষি উৎপাদন প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুটা বাড়লেও পরবর্তীতে ক্রমহ্রাসমান হারে তা কমছে। তাছাড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কৃষি ক্ষেত্রে সরকারি ভর্তুকি হ্রাস এবং খাদ্যশস্য উৎপাদনের কারণে খাদ্যশস্য ঘাটতি শুরু হয়েছে। এর ফলে মেয়েরা দু’দিক থেকে আক্রান্ত হচ্ছেন। কর্মহীনতা এবং খাদ্যশস্য ঘাটতির ফলে খাদ্য গ্রহণের সুযোগ হ্রাসে পুষ্টিহীনতার শিকার হওয়া যদিও কৃষি বাণিজ্য-করণের ফলে কিছু কিছু সেক্টরে নারীরা কাজের সুযোগ পেলেও তা নিতান্তই অস্থায়ী এবং সাময়িক। বেজি-৫ এর বিশ্ব নারী সম্মেলনে বলা হয়েছে যে, “সুবিধাগুলো অসমভাবে বন্টিত হয়েছে যার ফলে অর্থনৈতিক ব্যবধান আরো বৃদ্ধি পেয়েছে, দারিদ্রের নারীকরণ আরো তীব্র হয়েছে, লিঙ্গ বৈষম্যের মাত্রা ব্যাপক, শুধু কাজের অবস্থার অবনতি ঘটেছে তা নয়, কাজের পরিবেশের নিরাপত্তাও বিঘিœত হয়ে যাচ্ছে, বিশেষত বাধ্যতামূলকভাবেই অনেক নারীকে অসংগ?িত ক্ষেত্রে কাজ করতে হচ্ছে। বিশ্বায়ন মুষ্টিমেয় নারীর জীবনে স্বতন্ত্রতা এবং বৃহত্তর অর্থনৈতিক সুযোগ এনে দিলেও বৃহৎ সংখ্যক নারীই প্রান্তবাসিনী হয়ে পড়ছেন। প্রতিটি দেশেই যেহেতু ধনী দরিদ্র বৈষম্য তীব্র হচ্ছে আর তার প্রতিফলন ঘটছে লিঙ্গ বৈষম্যের বাস্তবতায়। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে শিল্প ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বায়নের ফলে ধনবাদী শিল্পোন্নত দেশসহ প্রায়ই সব দেশেই এক দারুণ শিল্পসংকটের সম্মুখীন। উদাহারণস্বরূপ বলা যায় বহুজাতিক কর্পোরেশন লেভিস্ট্রস এন্ড কোং ইউরোপে চারটি কারখানা বন্ধ করে দিলে প্রায়ই ১,৫০০ নারী শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়েছেন। লোকসানের কারণে এই কোম্পানির চারটি কারখানা বন্ধ করা হয়নি। কোম্পানি ইউরোপের এক মফস্বল অঞ্চলে নতুন বেশ কয়েকটি কারখানা খুলেছে এবং সেখানে খুব সস্তা মজুরিতে নারী শ্রমিক পাওয়া যায়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফা বাড়ানোর স্বার্থে প্রথমেই তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত প্রযুক্তির পরিবর্তে উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে আসে এবং দ্বিতীয়ত উন্নত দেশ থেকে অনুন্নত দেশে যেখানে শ্রম অত্যন্ত সস্তা সেখানে শিল্প কারখানা প্রতিস্থাপন করে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তারা মূলত সস্তাই নারী শ্রমিকদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। উদাহারণ স্বরূপ বলা যায়, আমাদের দেশেও বৃহৎ বৃহৎ কোম্পানি উন্নত দেশগুলো থেকে কারখানা প্রতিস্থাপন করে আরো বৃহৎ আকারে ব্যবসা করছে। এর মূল কারণ সস্তায় শ্রম বাজার এবং আরো সস্তায় নারী শ্রমিকের আধিক্য। পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় এসব শিল্পে নারী শ্রমিকদের অনেক সস্তায় নিয়োগ দেওয়া যায়। এছাড়াও কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের প্রথম খড়গ নেমে আসে তাদের উপর। বিশ্বায়নের কবলে পড়ে আমাদের দেশে বিগত কয়েক বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় প্রায় ২০-২৫ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছেন। যাঁর বেশির ভাগই নারী শ্রমিক। বেসরকারি সংস্থাগুলোতে নিয়োগ বৃদ্ধি পেলেও তা অস্থায়ী, সাময়িক কিংবা স্বল্প মজুরির। ইউনিসেফের এক সমীক্ষায় দেখানা হয়েছে যে, রাশিয়ায় বিগত দশকে প্রায়ই ২৫ মিলিয়ন মানুষ কাজ হারিয়েছেন যার মধ্যে নারীদের সংখ্যা ১৪ মিলিয়ন। এমনকি সা¤প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে যে, খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারীদের চাকরির বাজার মন্দা। যেখানে নারী শ্রমিকরা একই কাজে পুরুষদের তুলনায় ২৫ শতাংশ কম মজুরি পায়। একই অবস্থা শিল্পোন্নত ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও বিরাজমান। সেখানেও নারীরা একই কাজে পুরুষদের তুলনায় কম মজুরি পায়।

বিগত কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশের শিল্পে এক অভূতপূর্ব সংকট চলছে। এসব দেশে লক্ষ-লক্ষ শ্রমিক কর্মচ্যুত হয়েছেন। যার বেশির ভাগই নারী শ্রমিক। দক্ষিণ কোরিয়ায় চাকরিচ্যুত মহিলাদের সংখ্যা প্রায়ই ৭.১ শতাংশ। কিন্তু তুলনায় পুরুষদের সংখ্যা ৩.৮ শতাংশ। ইউরোপ ও এশিয়ার অনেক দেশ আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে সস্তায় ও অস্থায়ীভাবে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক নিচ্ছে।

রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলে মোট শ্রম শক্তির প্রায়ই ৬০% নারী শ্রমিক। বাংলাদেশে বস্ত্র শিল্পে প্রায় ৮০% নারী শ্রমিক কাজ করেন। শ্রীলঙ্কাতে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে কর্মরত রয়েছেন প্রায়ই ৭০% নারী। এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, “তৃতীয় বিশ্বের প্রায়ই সবকটি দেশের ক্ষেত্রেই এগুলো সমভাবে প্রযোজ্য। যেহেতু এ কাজগুলো চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী, কোন শ্রম আইন বা ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার এখানে অচল। শ্রমিকদের জন্য কোন শ্রম সুরক্ষা আইন না থাকায় কোন দুর্ঘটনা, অসুস্থতা বা প্রতিবন্ধকতার কোন দায় কর্তৃপক্ষ নেয় না। এমনকি প্রসূতকালীন ভাতা বা ছুটিও এরা পায় না। সুস্থ সেনিটেশন ব্যবস্থা এবং সুন্দর পরিবেশের অভাবে নানা ধরনের অসুখে এরা সহজেই আক্রান্ত এবং জরাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।”

বিশ্বায়ন নারীদের স্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব:
বিশ্বায়ন নারীদের স্বাস্থ্যের উপরও নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। ভারতীয় বিশিষ্ট নারীবাদী বন্দনা শিবার মতে, “সবচেয়ে আশ্চর্য্যরে বিষয় হচ্ছে যাঁরা পৃথিবীতে খাদ্য সৃষ্টি করেন, তাঁরাই স্বাস্থ্য এবং পরিবেশজনিত সমস্যার কবলে পড়েন। এই মহিলারা হলেন উন্মুক্ত বাণিজ্য জোনে যে শ্রমিক কাজ করেন তাঁদের ৯০%। এই মহিলারা হলেন যাঁরা তাঁদের স্বামীদের থেকে আরো ৩-৪ ঘণ্টা বেশি কাজ করেন, বাড়িতে, মা?ে এবং কারখানায়। মহিলাদের এই বহুমুখী কাজের জন্যেই এত স্বাস্থ্যহানি ঘটে।

বিশ্বায়নের মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যয় সংকোচিত হওয়ায় স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আঘাত এসেছে। রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই সংকোচন মহিলাদের স্বাস্থ্য এবং প্রজননের উপর আঘাত এনেছে। স্বাস্থ্যের বেসরকারিকরণ ওষুধের উপর গুরুত্ব দিয়েছে, যা অনেক গরিব মহিলা কিনতে পারেন না। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন “নিরুদ্দেশ স্ত্রীলোক” বলে একটি ধারণা প্রদান করেন। এই “নিরুদ্দেশ স্ত্রীলোক হচ্ছেন মূলত বিশ্বায়নের ফলে কর্মহীন, খাদ্যভাবে পুষ্টিহীন, স্বাস্থ্য সেবার অভাবে নিরন্তন অসুস্থ নারী যাঁরা প্রতি বছর অকাল মত্যুতে হারিয়ে যান।

সুতরাং বলা যায় বিশ্বায়নের পতাকাধারীরা যতই গলাবাজি করে বিশ্বায়নের জয়জয়কার ধ্বনি উচ্চারিত করুক না কেন; বিশ্বায়ন যেই নারী পুরুষ বৈষম্য সৃষ্টি করছে তা স্বীকার করা ছাড়া উপায় নাই। বিশ্বায়ন শুধু নারীদের উপর বৈষম্য সৃষ্টি করছে তা নয়, সার্বিক বিচারে তা প্রতিটি শ্রেণির মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে চলেছে।

টেকসই উন্নয়নের চাবি ‘নারী ও স্বাস্থ্য’
পৃথিবীব্যাপী মাতৃমৃত্যুহার গত ২৩ বছরে ৪৫ শতাংশ কমেছে। এই সময়ে নারীর গড় আয়ু ৬.৬ বছর বেড়েছে, পুরুষের বেড়েছে ৫.৮ বছর।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রভাবশালী চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী দ্য ল্যানসেট এ তথ্য জানিয়েছে। গত শুক্রবার অনলাইন সংস্করণে নারী ও স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রকাশিত ল্যানসেট-এর এ বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, নারী, নারীর স্বাস্থ্য ও নারী স্বাস্থ্যকর্মীর বিষয়গুলো টেকসই উন্নয়নের কেন্দ্রে থাকা দরকার।
তিন বছরের চেষ্টায় ২৩ জন বিশেষজ্ঞ ‘ওমেন অ্যান্ড হেলথ: দ্য কি ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। এতে বাংলাদেশসহ ৩২টি নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, গত কয়েক দশকের চেষ্টায় নারী স্বাস্থ্যের উন্নতি হলেও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে বছরে প্রায় তিন লাখ প্রসূতির মৃত্যু হচ্ছে গর্ভধারণকালে বা প্রসবকালে। এসব দেশে নারীরা একই সঙ্গে সংক্রামক ও অসংক্রামক উভয় ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
ল্যানসেট-এর সম্পাদক রিচার্ড হর্টন বলেছেন, ‘নারী ও স্বাস্থ্য’ এবং ‘নারীর স্বাস্থ্য’ এক বিষয় নয়। পার্থক্যটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে নারীর অবদান সমাজে স্বীকৃত না হলে ২০১৫-পরবর্তী টেকসই উন্নয়নের বৈশ্বিক লক্ষ্য আকাশকুসুম হয়েই থাকবে। ‘নারী ও স্বাস্থ্য’ এই ধারণার দিকে জরুরি দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। নারীর স্বাস্থ্য মূলত বালিকা ও বয়স্ক নারীর প্রজননস্বাস্থ্যের অধিকার ও প্রয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও পদ্ধতি নারীর ব্যাপারে সংবেদনশীল নয়। পৃথিবীব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। পরিবারে ও কমিউনিটিতে সনাতন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে বর্তমান স্বাস্থ্য পদ্ধতির কারণে নারীর কাজকে মূল্য দেওয়া হয় না ও তাদের সহায়তা করা হয় না। তাই নারীর শক্তি পুরোপুরি ব্যবহার করা যায় না। নারীরা বর্তমান স্বাস্থ্য পদ্ধতিতে কম দক্ষতা প্রয়োজন এমন কাজ ও নিম্ন মজুরের কাজ করে।

আর্থিক প্রণোদনা কীভাবে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজে উদ্বুদ্ধ করে, তার উদাহরণ হিসেবে ব্র্যাকের মানসী প্রকল্পের কথা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ঢাকার বস্তিগুলোতে মানসী প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ব্র্যাক। বস্তির স্বাস্থ্যকর্মীরা বাসায় স্বাস্থ্য বার্তা পেŠঁছে দেন, গর্ভবতী নারী শনাক্ত করেন, প্রসবের সময় প্রসূতির পাশে থাকেন এবং নবজাতককে সেবা দেন। কিন্তু গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক স্বাস্থ্যকর্মী পূর্ণমাত্রায় কাজ করেন না এবং অনেকে কাজ ছেড়ে দেন। এটা হয় মূলত আর্থিক কারণে।

ল্যানসেট বলছে, দ্রুতগতির বিশ্বায়ন, নগরায়ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন নারীর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিশ্বায়ন নারীর লোকসান ও ক্ষতি ডেকে আনছে। বিশ্বায়ন দেশে দেশে বৈষম্য কমিয়েছে, কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে বা জনগোষ্?ীর মধ্যে নারীর প্রতি বৈষম্য গভীর করেছে। দ্রুত নগরায়ণের পরিপ্রেক্ষিতে নারীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। নগরজীবনে পুরুষের চেয়ে ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় নারীকে। জলবায়ু পরিবর্তন এই পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলবে।

ব্যবচ্ছেদ: বিশ্বায়নের অর্থনীতি-অর্থনীতির বিশ্বায়ন, গরিবের তোষন না শোষণ
কোথায় চলেছে নিয়ে যুগের বিশ্বায়ন
সাধারণভাবে বলা যায় যে বিশ্বায়ন হলো এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে স্থানীয় বা আঞ্চলিক কোন বিষয় বা প্রপঞ্চ বিশ্বব্যাপী বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিস্তৃত হয়। শীলা এল ক্রাউচার ( গ্লোবালাইজেশন এ্যান্ড বিলংগিং : দ্য পলিটিকস অব আইডেন্টিটি এ চেঞ্জিং ওয়ার্ল্ড) বলেন যে এর মাধ্যমে বিশ্ব মানব গোষ্?ী একটিমাত্র সমাজে একত্রিত হয় এবং একসাথে কাজ করে। আর এটি অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উপাদানমূহের সমষ্টি। জগদীশ ভগবতী (ইন ডিফেন্স অব গ্লোবালাইজেশন) একে অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন চিহ্নিত করে বলেছেন যে-দ্যাট ইজ ইন্টিগ্রেশন অব ন্যাশনাল ইকনমিকস ইনটু দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইকনমি থ্রু ট্রেড,ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট, ক্যাপিটাল ফ্লোস, মাইগ্রেশন এ্যান্ড দ্য স্প্রেড অব টেকনোলজি। বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সীমানাহীন উৎপাদন ও বিনিময়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য,আউটসোর্সিং, সরবরাহ শৃংখল,ব্যবসায়ী সংগ?ন, বহুজাতিক কর্পোরেশন (এমএনসি),মিশ্র সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়গুলো সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। এ যুগের প্রথিতযশা পন্ডিত নোয়াম চমস্কি(কর্পোরেট গ্লোবালাইজেশন, কোরিয়া এ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স) অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের নিওলিবারেল কা?ামো প্রসঙ্গে বলেন এর অর্থ হলো অর্থনৈতিক কার্যক্রমে জাতীয় সীমানা উন্মুক্তকরণ এবং এখানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আন্তআঞ্চলিক বাণিজ্যে পরিণত হবে। ফলে বিশ্বায়নের সুবাদে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে কেন্দ্র করে বিশাল আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে উ?েছে।

অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের পরিমাপঃ
মোটামুটিভাবে ০৪ টি অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন আবর্তিত হয়। (ক) পণ্য ও সেবা: জনগণের মাথাপিছু জাতীয় আয়ের অনুপাত হিসেবে আমদানী ও রফতানি (খ) শ্রমিক/জনসম্পদ: নীট মাইগ্রেশন হার, বহির্গামী ও অস্তগামী মাইগ্রেশন গতিপ্রবাহ (গ) প্রযুক্তি: আন্তর্জাতিক গবেষণা ও উন্নয়ন গতিপ্রবাহ, ‘ফ্যাকটর-নিউট্রাল’ প্রযুক্তি গত উন্নয়ন যেমন-টেলিফোন, মোটরকার, ব্রডব্যান্ড প্রভৃতির মাধ্যমে গবেষণায় নিয়োজিত জনগণের অনুপাত। এসব চলকের ভিত্তিতে কেওএফ ইনডেক্স এর মতে বিশ্বের প্রধান গ্লোবালাইজড দেশ হলো বেলজিয়াম এবং এর পরপরই আছে অস্ট্রিয়া, সুইডেন, ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডের অবস্থান। হাইতি, মায়ানমার ও বুরুন্ডি এ তালিকার সর্বনিম্নে অবস্থান করছে। সা¤প্রতিক সময়ে সিঙ্গাপুর, আয়ারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ড, কানাডা, ডেনমার্ক সর্ব্বোচ্চ গ্লোবালাইজড দেশ এবং সর্বনিম্নে রয়েছে মিশর, ইন্দোনেশিয়া,ভারত ও ইরান (এ টি কেয়ারনি)।
বিভাজনঃ অর্থনৈতিক বিশ্বায়নকে ঘিরে মোটামুটি ০৩ টি প্রধান চিন্তাধারা গড়ে উ?েছে। (ক) অর্থনৈতিক উদারবাদ: মিল্টন ফ্রিডম্যান, ওহন নেইসবিট প্রমুখ অর্থনৈতিক উদারবাদীরা আন্তর্জাতিক বাজার ব্যাবস্থাপনার সমান্তরালে দেখেছেন অর্থনৈতিক বিশ্বায়নকে। এখনকার বিশ্বে একটি পণ্য উৎপাদন বিশ্বের যে কোন প্রান্তে সম্ভব। পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা যায়। পণ্য উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত কোম্পানি বা কারখানাটি বিশ্বের যেকোন প্রান্তে অবস্থিত হতে পারে। উপরন্তু উক্ত পণ্যটি বিক্রয়েরও কোন নির্দিষ্ট জায়গা নেই অর্থ্যাৎ পৃথিবীর যেকোন বাজারে তা বিক্রয়যোগ্য। ফলে ব্যক্তি, পরিবার, কোম্পানি ও প্রতিষ্?ানের জন্য বিশ্বায়ন আমাদের সামনে এমন এক সুযোগ এনে দিয়েছে যা মানব ইতিহাসের কোন পর্বে দেখা যায়নি। অর্থনীতির এমন বিশ্বায়নের ফলে ব্যাক্তি ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন করেছে। ব্যাক্তিগত সফলতা তার পরিবার কে করেছে আরো সমৃদ্ধ ও গতিশীল। জীবনযাত্রার মান উন্নীত হয়েছে। এসব ব্যক্তিক সফলতা বিভিন্ন কোম্পানি প্রতিষ্?াকে ত্বরান্বিত করেছে। এভাবে বিশ্বব্যাপী গড়ে উ?েছে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি-কর্পোরেশন বা ট্রান্সন্যাশনাল কর্পোরেশন (টিএনসি), যার বেশ কয়েকটি বিভিন্ন খাতে বিশ্বের মোট উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রয়ের প্রায় অর্ধেক অংশ নিয়ন্ত্রন করছে। যেমন সুইজারল্যান্ডের ফুড ইন্ডাস্ট্রি নেসলে এসএ এর বহুজাতিক ইনডেক্স হলো ৯৪.০। এসনিভাবে সুইডেনের ইলেকট্রনিক্স শিল্প ইলেকট্রোলাক্স এবি, জাপানের ইলেকট্রনিক্স শিল্প সনি, মার্কিন কম্পিউটার শিল্প আইবিএম,কোরিয়ার দাওয়াউ যথাক্রমে ৮৮.৩,৫৯.১,৫৪.৯ ও ৪৭.৭ অংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এভাবে জাতিসংঘের এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের মাত্র ১০০ টি বহুজাতিক কর্পোরেশনের টিএনসি ইনডেক্সের হার ৫১.০ ভাগ।

(খ)বাস্তববাদী মার্কেন্টাইলিজম: থমসন, ক্রেন্সার, ক্যাপ্সটেইন প্রমুখ বলেন বিশ্বায়ন হলো জাতীয় রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা। এর বাইরে নতুন কিছু নেই।তারা দেখান যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ খুব উঁচুস্তরে ছিল, যা কেবল আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক।উল্লেখ্য যে বহুজাতিক কোম্পানি সমূহ তাদের পরিচয় হারিয়ে ফেলে না। কারণ তারা হচ্ছে গ্লোবাল প্লেয়ার। মাতৃভূমির সাথে রয়েছে তাদের নিবিড় সম্পর্ক। যেমন টেলিনরের সাথে নরওয়ের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক।তবে জাতি রাষ্ট্র বিশ্বায়নের ফলে হুমকির সম্মুখীন-উদারবাদীদের একথা অবাস্তব। কারণ এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের জন্য রাষ্ট্রের ক্যাপাসিটি কমেনি বরং বেড়েছে এ কথা সর্বোতভাবে গ্রহণযোগ্য।তবে তাত্ত্বিকভাবে এ মতবাদে রাষ্ট্রকে বড় করে এবং আন্তর্জাতিক নির্ভরশীলতাকে ছোট করে দেখাকে অন্যতম ত্রুটি হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

(গ) রবার্ট কক্স প্রমুখ মনে করেন অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন একদিকে যেমন পারস্পারিক নির্ভরশীলতাকে তীব্রতর করে তোলে তেমনি অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনীতি সৃষ্টিতে তৎপর হয়। জাতীয় রাষ্ট্রসমূহ বিশ্বায়নের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক, কিন্তু এক্ষেত্রে তারা অর্থনীতির উপর তাদের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এর ফলে তারা গ?ন করে ম্যাক্রো রিজিওন। মূলত অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন হলো অসম, স্বেচ্ছাচারী পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা ধীরে ধীরে নেতৃত্বদানকারী শিল্পোন্নত দেশের কব্জায় চলে যায়। মূলকথা বিশ্বায়ন হলো পুঁজিবাদের একটি ধরণ। পুঁজিবাদী ক্লাস ডোমিনেশনকে তা আরো পোক্ত করে। পাশাপাশি বিশ্বের অসহায় দরিদ্র জনগণকে শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট করে।

বিশ্বায়নের নীতি ও তত্ত্ব বিশ্ব অর্থনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।যেমন-(ক) শিল্প: বিশ্বব্যাপী উৎপাদন মার্কেটের উত্থান পর্ব ভোক্তা ও কোম্পানীর জন্য বিদেশী পণ্যের অবাধ প্রবেশাধিকার, বিশেষত, বস্তুগত ও খাদ্য সামগ্রীর আন্তদেশীয় বিনিময় বিশ্বায়নেরই ফল। (খ) ফিনান্সিয়াল:বিশ্বব্যাপী ফিনান্স মার্কেটের উত্থান এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের বিকাশ হয়। (গ) ইকোনমিক: পণ্যসামগ্রী মূলধন বিনিয়োগের স্বাধীনতার মাধ্যমে গড়ে উ?েছে একটি গ্লোবাল কমন মার্কেট। (ঘ) রাজনৈতিক: ফ্রান্সিস্কো স্টিপো ( ওয়ার্ল্ড ফেডারেলিস্ট মেনিফেস্টো: গাউড টু পলিটিক্যাল গ্লোবালাইজেশন) মনে করেন যে বিশ্বায়ন মানে হলো একটি বিশ্ব সরকার বা কতগুলো সরকারের সমষ্টি। ডব্লিউটিও, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফ সহ বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্?ান এসব সরকারের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ অর্থনীতির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশ্বায়নের প্রভাব ও নিজ বলিষ্?-কার্যকর নীতিমালার সাহায্যে চীনও গত শতকে বহুমুখী প্রবৃদ্ধি অর্জন ও সফলতা লাভ করেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই চীন বিশ্বের অদ্বীতিয় পরাশক্তি হয়ে উ?বে এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। চার্লস হার্স্ট ( সোস্যাল ইনইকুয়ালিটি) বলেছেন যে- চাইনা উইল হ্যাভ ইনাফ ওয়েলথ, ইন্ডাস্ট্রি এ্যান্ড টেকনোলজি টু রাইভাল দ্য ইউনাইটেড স্টেটস ফর দ্য পজিশান অব লিডিং ওয়ার্ল্ড পাওয়ার। (ঙ) প্রযুক্তি: ইন্টারনেট, কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট,সাবমেরিন কেবল, ওয়ারলেস টেলিফোন প্রভৃতি ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী টেলিকমিউনিকেশন অবকা?ামো ও বহু সীমা উপাত্ত গতিপ্রবাহ গড়ে তোলা হচ্ছে,যা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে করেছে আরো আধুনিক আরো গতিশীল।প্রযুক্তির উপর ভর দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি সমূহের প্রয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিশ্বায়ন বিভিন্ন দেশের দরিদ্র হার নিম্নমুখী করেছে। জেফরি সাচস ( দ্য এন্ড অব প্রোভার্টি,২০০৫) পরীক্ষা করে দেখান যে সাব সাহারান দেশের তুলনায় চীনে অধিক মাত্রায় বিশ্বায়ন ঘটেছে।ফলে চীনে দারিদ্রের হার উল্লখযোগ্যভাবে কমে আসে।তাছাড়া উন্মুক্ত বাণিজ্য, পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রকেও বিশ্বায়ন আরো সুসংহত করেছে বলে তার দাবি।উন্মুক্ত বাণিজ্যের সমর্থকরা বলে থাকেন যে বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে বিশ্বায়ন অর্থনেতিক সুযোগ সুবিধা ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করেছে। দ্রব্যমূল্যের নিম্নগতি, অধিক কর্মসংস্থান, উৎপাদনের উচ্চহার এবং জীবন যাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটেছে। উন্নয়নশীল দেশ যার ফলে সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হয়। সাউহুয়া চেন ও মার্টিন রেভেলিওন ( হাউ হ্যাভ দ্য ওয়ার্ল্ড’স পুওরেস্ট ফেয়ারড সিনস দ্য আরলি এইটিস) এবং বিশ্বব্যাংকের ডাটা থেকে দেখা যায় যে পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিক এলাকায় বিশ্বায়নের অভিঘাতে অগ্রগতির সূচক উর্ধ্বমুখী। অবশ্য সাব সাহারার ক্ষেত্রে বিপরীত প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিক এলাকায় ১৯৮১,১৯৮৭,১৯৯৩,১৯৯৯ ও ২০০২ সালে দিনে ১ ডলারের নিচে আয় করা মানুষের হার ছিল যথাক্রমে শতকরা ৫৭.৭,২৮.০,২৪.৯,১৫.৭ ও ১১.১ ভাগ এবং ১৯৮১ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত মোট পরিবর্তনের হার ছিল, -৮০.৭৬%। আর অত্র অঞ্চলে দিনে ২ ডলারের নিচে আয় করা মানুষের এ পরিবর্তনের হার ছিল উল্লিখিত সময়ে ,-৫২,০০%। সাব সাহারান আফ্রিকায় একই সময়ে দৈনিক ১ ডলারের ক্সেত্রে হার ছিল যথাক্রমে ৪১.৬, ৪৬.৮,৪৪.০, ৪৫.৭ ও ৪৪.০ ভাগ এবং মোট পরিবর্তনের হার হলো +৫.৭৭%। ২ ডলারের ক্ষেত্রে মোট পরিবর্তনের হার ছিল +২.১%।

ডেভিড ব্রুক (গুড নিউজ এ্যাবাউট পোভার্টি) বলেন বিশ্বায়নের ফলে সমগ্র বিশ্বের আয় অসমতা অর্থ্যাৎ ইনকাম ইনইকুয়ালিটি ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। জেভিয়ার সালা-ই মার্টিন অবশ্য বলছেন আয় অসমতা একেবারে দূরীভূত হয়ে গেছে। মূলত আপেক্ষিক অসমতার চেয়ে দারিদ্র মোকাবিলা হলো মূখ্য ব্যাপার। বিশ্বায়ন মানুষের আয় বৃদ্ধির সুযোগ করে দিয়েছে এটা সত্য।

উন্নত বিশ্বে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষের জীবনকাল দ্বিগুণে উপনীত হয়েছে। এমনকি অনুন্নত সাব সাহারান আফ্রিকায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এব আগের তুলনায় ৩০ বছর আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নয়নশীল দেশসমূহে শিশু মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে (গে পেফারম্যান, দ্য এইট লুজারস অব গ্লোবালাইজেশন)।

বিশ্বায়নের ফলে দেশে দেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়েছে একথা সমবেশী সত্য। ফ্রিডম হাউসের তথ্যমতে ১৯০০ সালে বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ জাতির ভোটাধিকার ছিল না। অথচ ২০০০ সালে এসে সমগ্র জাতির শতকরা ৬২.৫ ভাগ ভোটাধিকার পায়। এর পাশাপাশি নারীর অধিকার, সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন বাংলাদেশেই নারীদের চাকরি-বাকরি, কর্মসংস্থান, শিক্ষাসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশ্বব্যাপী খাদ্যঘাটতি গ্রাস পেয়েছে। এক হিসেবে দেখা যায় যে ১৯৬০ এর দশকে বিশ্ব জনগণের খাদ্য সরবরাহে ব্যক্তি প্রতি ২২০০ ক্যালরি ঘাটতি ছিল।যার শতকর হার ছিল ৫৬%। ১৯৯০ এর দশকে এ হার ১০% এর নিচে নেমে আসে। তাছাড়া ১৯৫০-১৯৯০ সালের মদ্ধ্যে বিশ্ব স্বাক্ষরতার হার ৫২% থেকে ৮১% এ উন্নীত হয়। অন্যদিকে শ্রমখাতে শিশুশ্রম ১৯৬০ সালের ২৪% থেকে ২০০০ সালে ১০% নামানো সম্ভব হয়েছে।

মানুষের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হওয়ার ফলে তাদের বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।বিদ্যুৎ, মোটর কার, টেলিফোন-মোবাইল ও নতুন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ ও ব্যবহারের গতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বিশ্বায়নের পরিবেশগত প্রভাব নেতিবাচক হওয়ায় তার অগ্রগতিকে অনেকটা সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে।

অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ইতিবাচক প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।যেমন- দরিদ্র রাষ্ট্রের অবস্থা: চার্লস হার্স্ট (সোস্যাল ইনইকুয়ালিটি:ফর্মস কজেজ এ্যান্ড কনসিকুয়েন্সেস) মত দেন বিশ্বায়ন দরিদ্র রাষ্ট্রের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে।উল্লেখ্য যে বিশ্বায়ন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে উন্মুক্ত বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে।এর অনেক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। কারণ কিছু দেশ তাদের জাতীয় বাজারকে সংরক্ষণের জন্য প্রচেষ্টা চালায়। দরিদ্র রাষ্ট্রের সাধারণত প্রধান রফতানি পণ্য হচ্ছে কৃষি ও কৃষিজাত সামগ্রী।এসব দেশের কৃষকদের ভর্তুকি প্রদান করে উন্নত দেশের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা ক?িন হয়ে পড়ে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে গরিব দেশের কৃষকরা বাজারের মূল্য অপেক্ষা অত্যন্ত কম মূল্যে তাদের পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

বিদেশী দরিদ্র শ্রমিক নির্যাতন:শক্তিশালী শিল্পোন্নত দেশসমূহের উন্নত ও বলিষ্? পুঁজির অভিঘাতে দুর্বল ও দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর আত্মরক্ষা ব্যুহ ক্রমেই ভেঙে পড়ে। এসব দেশের সস্তা শ্রমের নিশ্চয়তা তাদেরকে প্রলুব্ধ করে। আত্মরক্ষার অভাবের সুযোগ নিয়ে শিল্পোন্নত দেশের বিভিন্ন কোম্পানি উন্নয়নশীল দেশের শ্রমিকদের অল্প মজুরিতে নিয়োগ দেয়। এসব দেশে কর্মঘণ্টাও উন্নত দেশের তুলনায় অনেক বেশি।কাজের পরিবেশও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও অস্বাস্থ্যকর।এক্ষেত্রে বহুজাতিক কোম্পানি নাইকির প্রসঙ্গ টানতে পারি।

আমেরিকা ভিত্তিক এ কর্পোরেশন ক্রীড়া ও অ্যাপারেল সামগ্রী তৈরির জন্য বিখ্যাত। অত্যন্ত লাভজনক এ প্রতিষ্?ানের উৎপাদন খরচ নিতান্তই কম। এর কারণ হলো এর ফ্যাক্টরি সমূহ এশিয়ার দরিদ্র দেশসমূহে স্থাপন করা হয়েছ্ শ্রমিকদেরও মজুরি হিসেবে কোনমতে জীবনধারনের জন্য সামান্য অর্থ প্রদান করা হয়। এমনকি শিশুরাও কম মজুরিতে এখানে কাজ করে। যদি এসব উন্নয়নশীল দেশে প্রতিরক্ষামূলক বিভিন্ন ব্যাবস্থা (আইন ও তার প্রয়োগ) থাকত তে এসব কারখানা বন্ধ হয়ে যেত। তবে অনেকেই বলে থাকেন যে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে শ্রমিকরা কাজের স্বাধীনতা পায়। তারা এক্ষেত্রে কারখানা বদল করতে পাওে বা চাকরি ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু অনেক দরিদ্র দেশের শ্রমিকদের এ স্বাধীনতা ভোগ করা মানে কর্মসংস্থার হারানো বা ুধার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা । এসব দেশে কর্মসংস্থানের ত্রে অত্যন্ত সীমিত।

আউটসোর্সিং ও ইকোনমিক গ্যাপ: মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তের ফাঁদ-প্যাচ্রিক ম্যাকমোহন ( দ্য ডিকাইনিং মিডল কাস: এ্যা ফারদার এ্যানালাইসিস) দেখান যে উন্নয়নশীল দেশের সস্তা শ্রম কর্পোরেশনগুলোকে বিদেশের বাজারে পণ্য সামগ্রী উৎপাদন ও চালানে প্রলুব্ধ। মজুরি ও লাভ কম থাকার পরেও এখানকার অদ শমিকরা সার্ভিস সেক্টরে শ্রম দিতে বাধ্য হয়। উৎপাদন হয় কিন্তু বেশি। এভাবে দ ও অদ শ্রমিকদের মধ্যে ইকোনমিক গ্যাপ প্রলম্বিত হয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কিঞ্চিত ধ্বংসের জন্য এটি দায়ী। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এ রকম ক্ষতিগ্রস্থতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অসমতা বৃদ্ধিতে একটি বড় ফ্যাকটর হিসেবে কাজ করে। এভাবে আউটসোর্সিং ও অধিক উৎপাদনের জন্য অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার নিু অবস্থানে চলে আসছে। আর নিুবিত্তের অবস্থা আরো সঙ্গীন। তাদের অবস্থা ম্যাকমোহনের ভাষায়-দ্যাট পিপল ইন দ্য লোয়ার কাস হ্যাভ মাচ হার্ডার টাইম কাইম্বিং আউট অফ পোভার্টি বিকজ অফ দ্য এ্যাবসেন্স অফ দ্য মিডল কাস এ্যাজ এ স্টিপিং স্টোন।

দুর্বল লেবার ইউনিয়ন: চার্লস হার্স্ট যুক্তি দেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কোম্পানি নিজেদের মধ্যে উøুত্ত সস্তা শ্রমিক বিনিময় করার ফলে লেবার ইউনিয়নের মতা ও কার্যকারিতা দুর্বল হয়ে পড়ছে।লেবার ইউনিয়নের সদস্য প্রাপ্তি ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। ফলে কর্পোরেশনের উপর ইউনিয়নের প্রভাব কমে আসছে বলে তিনি মনে করেন।

অর্থনৈতিক অসমতা: অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের অন্যতম প্রধান নেতিবাচক দিক হলো অর্থনৈতিক অসমতা। বিশ্বব্যাংকের বিশ্বব্যাংকের এক খর্থনীতিবিদ ব্রাঙ্কো মিলানোভিক ডিসেম্বর ২০০৭ সালের এক হিসেবে বলেন নভেম্বর মাসে বিশ্বব্যাপী অসমতা (বিশ্বের সকল ব্যক্রির মধ্যকার প্রকৃত আয়ের পার্থক্য) হিসাব করা হয় ৬৫ গিনি পয়েন্টস; যেখানে ১০০ পয়েন্টস হলো সম্পূর্ণ অসমতা এবং ০ সম্পূর্ণ সমতা প্রকাশ করে; যেখানে সকলের আয় সমান ধরা হয়। এখানে অসমতার লেভেল দক্ষিণ আফ্রিকার অসমতার লেভেল থেকে উচ্চ। কিন্তু ডিসেম্বরে এই বিশ্ব অসমতা হয় ৭০ গিনি পয়েন্টস যা বিশ্বের কোথাও কোনোদিন আগে দেখা যায়নি। আর এর নগ্ন শিকার হলো তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো।

কর্পোরেট স্বার্থ: বিশ্বায়নের সমালোচনাকারীরা বলে থাকেন যে বিশ্বায়ন এমন একটি পদ্ধতি যা কর্পোরেট স্বার্থের তাহিদেই সৃষ্টি হয়েছে। আর এ স্বার্থুসদ্ধির তাগিদেই শূলত তৈরী হয় গ্লোবাল ইনস্টিটিউশন ও নীতিমালার বিকল্প সম্ভাব্যতা। এ সমস্ত প্রতিষ্?ান ও নীতিমালা দরিদ্র ও শ্রমিক শ্রেণীর ভাগ্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। পরিবেশগত বিষয়াবলী একই উৎস থেকে ব্যাখ্যা করা হয়। তার মানে কর্পোরেট সংস্থা০ই এখানে মূখ্য।

বিশ্বায়ন বিরোধী তত্ত্ব: বিশ্বায়ন বিরোধী আন্দোলন বেশ ব্যাপক। এখানে আছে চার্চ গ্রুপ, জাতীয় স্বাধীনতা গ্রুপ, কৃষক ইউনিয়নবাদী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, প্রতিরক্ষাবাদী, নৈরাজ্যবাদীসহ আরো অনেকে। নৈরাজ্যবাদীরা বলেন – বিশ্বায়ন হলো –রি লোকালাইজেশন। কিন্তু সংস্কার বাদীরা বলেন যে অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন পুঁজিবাদের মানবিক রুপ। বিপ্লববাদীরা একে দেখেন-এটি পুঁজিবাদ অপেক্ষা অধিক মানবিক পদ্ধতি। প্রতিক্রিয়াশীলরা বিশ্বাস করনে-বিশ্বায়ন জাতীয় শিল্প ও কর্মসংস্থানকে ধ্বংস করেছে।ৎ

শ্যাম্পেন গ্লাস ইফেক্ট: অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ফলে বিভিন্ন জাতির মধ্যে আয় বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। রবার্ট হান্টার ওয়েড ( দ্য রাইজিং ইনইকোয়ালিটি অফ ওয়াল্ড ইনকাম ডিস্ট্রিবিউশান) দেখান যে ২০০১ সালের আগের ২০ বছরে ৮ মেট্রিকসের মধ্যে ৭ টি আয় বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮০ এর দশকে নিম্নশ্রেণীর আয় ও বিশ্ব আয় বিতরণের মধ্যে স্পষ্ট ব্যাবধান গড়ে ও?ে। এ আয় বৈষম্য কে জেভিয়ার গোবোস্টিয়াগ শ্যাম্পেন গ্লাস ইফেক্ট তত্ত্বের মাধ্যমে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তার নির্দেশিত নিম্নোক্ত অধ্যয়ন থেকে দেখা যায় যে, বিশ্ব আয় বিতরণ ব্যাবস্থা অসম। ১৯৯২ সালের ইউএনডিপি রিপোর্ট মতে বিশ্বের ২০% ধনী ব্যক্তি বিশ্ব আয়ের মোট ৮২.৭% নিয়ন্ত্রণ করে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিচের দ্বিতীয় ২০% ধনীর এ হার ১১.৭%, তৃতীয় ২০% এর ক্ষেত্রে ২.৩%, চতুর্থ ২০% এর ক্ষেত্রে ১.৪% এবং সর্বনিম্ন পর্যায়ের অতি দরিদ্র ২০% ক্ষেত্রে এ আয় মাত্র ১.২%। এখান থেকে প্রতীয়মান হয় যে কি পরিমাণ আয় বৈষম্য বিশ্বে বিরাজমান।

ফেয়ার ট্রেড তাত্ত্বিক যেমন জেফ ফক্স ( ইকোনমিক পলিসি ইনস্টিটিউট) প্রমুখদের মতে নিয়ন্ত্রণহীন মুক্ত বাণিজ্য গরিবের টাকায় ধনিকশ্রেণীর মুনাফার সন্ধান দিবে। বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্?ান যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রভৃতি গরিব দেশের কাছ থেকে শোষণমূলক শর্তযুক্ত লোনের বিপরীতে মোটা অংকের সুদ নিয়ে তা দিয়ে পশ্চিমা উন্নত দেশের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। আর তৃতীয় বিশ্বের তাদেরই পৃষ্?পোষকতায় লালিত পালিত একশেণীর দালাল তাদের পক্ষে সাফাই গেয়ে যাচ্ছে।

আমেরিকানাইজেশন:আমেরিকাকরণ এমন একটি পিরিয়ড যখন অন্যদেশ ও জনগোষ্?ীর সাথে আমেরিকার উচ্চ রাজনৈতিক আঁতাত থাকবে।পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে আমেরিকার দোকান, বাজার ও অন্যান্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সহজেই প্রবেশ করতে পারবে। আমেরিকানাইজেশন মূলত মার্কিন নয়া সাম্রাজ্যবাদের একটি পরিভাষা।

লরেন্স লী, জোয়েল বাকান প্রমুখ মনে করেন যে, অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন হলো কর্পোরেটওদর স্বার্থসিদ্ধির ধারাবাহিক উন্নতি ও অগ্রগতিমূলক পদ্ধতি ও উৎকৃষ্ট হাতিয়ার। কর্পোরেট সংগ?নসমূহের স্বায়ত্ত্বশাসন ও শক্তিমত্ত্বা বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন দেষের রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে এগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করে যা ঐসব দেশের স্বাধীনতা সার্বভেŠমত্বের প্রতি হুমকি স্বরুপ। ঐসব দেশের সাধারণ জনগণ এগুলো কখনোই ভালো চোখে দেখে না। যেমন- বাংলাদেশ ইউএনডিপির সাবেক আবাসিক প্রতিনিধি রেনেটা লক ডেসালিয়ান, মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিউটেনিস, ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চেŠধুরী প্রমুখ বাংলাদেশর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ?নে মূখ্য ভূমিকা পালন করে।

অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন হলো মানুষের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত কর্মকান্ডের ঐতিহাসিক বিবর্তনের একটি পর্ব। এর ইতিবাচক নেতিবাচক দুটি দিকই রয়েছে। দরিদ্র বিশ্বের ক্রমাবনতি, শ্রমিক নিপীড়ন, অবাধ আউটসোর্সিং, লেবার ইউনিয়নের ক্ষমতা হ্রাস, অর্থনৈতিক ও আয় বৈষম্য, একক কর্পোরেট স্বার্থ, ধনকি শ্রেণীর অর্থ শোষণ প্রভৃতি বিশ্বায়নের অগ্রযাত্রাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।আর এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে এন্টি গ্লোবালাইজেশন মুভমেন্ট। যোসেফ স্টিগলিস, অ্যান্ড্রু চার্লটন প্রমুখ মনে করেন যে এ আন্দোলন মূলত বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও ডব্লিউটিও- এ প্রতিষ্?ানগুলোর অতিমাত্রায় শর্তারোপ, বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণ, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর দেŠরাতœ্য, উন্নত পশ্চিমা বিশ্ব কর্তৃক তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহকে শোষণ প্রভৃতি বিষয়গুলোর প্রতি বেশি নজর দিয়ে থাকে। এ ব্যাপারে তাদের অভিমত হলো- এ ম্যালটিচ্যুড অফ ইন্টারকানেক্টেড ফ্যাটাল কনসিকুয়েন্সেস-সোসাল ডিসইন্টিগ্রেশান, এ ব্রেকডাউন অফ ডেমোক্রেসি, মোর র্যাপিড এ্যান্ড এক্সটেনসিভ ডেটারিওরেশান অফ দ্য এনভায়রনমেন্ট, দ্য স্প্রেড অফ নিউ ডিজিজ, ইনক্রিজিং পোভার্টি এ্যান্ড অ্যালিয়েনেশান ( ফ্রিটজ অফ কোপরা, দ্য হিডেন কারনকশান)।এমনকি যুগের বিখ্যাত পন্ডিত নোয়াম চমস্কি অর্থনৈতিক বিশ্বায়নকে ধনিক শ্রেণীর স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে দেখেছেন। তবে আমরা অস্বীকার করব না যে শিল্প, ফিন্যান্স,অর্থনীতি , রাজনীতি, তথ্য-উপাত্ত, সংস্কৃতি, ইকোলজি, পারস্পারিক বিনিময়, প্রযুক্তি, আইনও নৈতিকতা, বাণিজ্য, আউটসোর্সিং, স্টাইল প্রভৃতি বিষয়ে বিশ্বায়ন জগতের সামগ্রিক অগ্রগতির ধারাকে শক্তিশালী ও এক সূত্রে গ্রোথিত করতে সচেষ্ট আছে। যাকে অনেকেই বলছেন-হোয়াট এ্যান এক্সট্রা অর্ডিনারি এপিসোড ইন দ্য ইকোনমিক প্রোগ্রেস অফ ম্যান। বিশ্বায়নের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর গতিবিধি, বহুজাতিক প্রতিষ্?ানগুলোর আচরণ, পুঁজি ও মেধা পাচার প্রভৃতি বিশ্বায়নের কল্যাণকামিতাকে মোটাদাগে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। উদ্বৃত্ত্ব পুঁজি বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে মুনাফা লাভ করার উদ্দেশ্যে উপনিবেশিক যুগে উন্নত দেশগুলো কেবলমাত্র নিজেদের স্বার্থে কলোনী স্থাপন করেছিলো। বর্তমানে সেই পুরনো পুঁজিবাদ তার বাহ্যিক রুপ পাল্টে ফেলেছে।অতীত নীতি ও উদ্দেশ্য ?িক রেখে প্রতিষ্?িত করেছে নয়া উপনিবেশবাদ। নব্য সাম্রাজ্যবাদ। আর বিশ্বায়ন সেই বাহ্যিক অবয়ব বৈ কিছু নয়। এসব কথা এখন বিশ্বের আনাচে কানাচে সমস্বরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।


বিশ্বায়নের মুক্ত পৃথিবীতে নারী কতটা স্বাধীন?
উপনিবেশবাদের উত্তরকালে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ ও নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্?ার জন্য নতুন ও সুদূর প্রসারী কেŠশল হাতে নেয়। তৃতীয় বিশ্ব অভিধায় পরিচিতি দিয়ে, উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ধারণায় বিভাজিত করে পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো উন্নয়ন সহায়তার নামে প্রান্তিক অবস্থানে থাকা দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানোর আড়ালে শোষণের নয়া কেŠশল সাজায়। সে মহাপরিকল্পনারই এক সফল বাস্তবায়ন বিশ্বায়ন।


বিশ্বায়নের প্রাতিষ্?ানিক কা?ামো নতুন মুক্ত বিশ্বের ইঙ্গিত দিলেও এর অপ্রতিরোধ্য গতিতে আত্মস¤প্রসারণের প্রক্রিয়া ভেঙে দিচ্ছে জাতীয় সীমানা, অকার্যকর করছে স্বনির্ভরতা এবং জাতীয় অস্তিত্ব ?েলে দিচ্ছে প্রান্তিকতার দিকে। বিশ্বায়নের মাধ্যমে পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ, বৈশ্বিক কা?ামোর উৎপাদন-ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্?ান এবং প্রযুক্তিগত বিকাশের মধ্য দিয়ে একদিকে সম্পদের প্রবৃদ্ধি দ্রুততর হয়েছে, দেখা দিয়েছে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত, অপরদিকে এর অব্যাহত একচেটিয়াকরণ, অকল্পনীয় অপচয় মানুষে মানুষে বিভাজন ও বৈষম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে সম্পদের অবাধ প্রবাহ সীমাহীন বিশ্বব্যবস্থা, সামাজিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদারীকরণ বিদ্যমান। অর্থাৎ এটা এমন এক ব্যবস্থা যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সীমানামুক্তকরণ ও আন্তর্জাতিকীকরণ। এক দেশের বাণিজ্য অপর দেশের বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কিংবা বাধা নিষেধ আরোপিত না হওয়ার প্রক্রিয়াই হলো বিশ্বায়ন।


বিশ্বায়নকে সকলের জন্য সম্পদ ও সুযোগ উন্মুক্ততা বলে ব্যাখ্যা করা হলেও এর কার্যকারিতার সাথে তার কোনো সঙ্গতি লক্ষ্য করা যায় না। বিশ্বায়ন প্রত্যয়টির বিশ্লেষণে দেখা যায় এর মূল প্রবণতার এক পি?ে রয়েছে আন্তর্জাতিকীকরণ, অন্য পি?ে একচেটিয়াকরণ। বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বের সম্পদ ও সুযোগসমূহ একচেটিয়া বৈশ্বিক প্রতিষ্?ানসমূহের কাছে পূর্বতন যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি উন্মুক্ত হচ্ছে। এ কারণে বিশ্ব এখন পূর্বের যে কোনো সময় অপেক্ষা অনেক বেশি একচেটিয়াকৃত। বিশ্বায়নের এ যুগে বৈষম্য হচ্ছে একটি প্রকটতর ও ক্রমবর্ধমান সমস্যা। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদি কারণে বৈষম্যের বিষয়টি বহুদিনের পুরনো। নারীর অধিকার রক্ষায় ও অনগ্রসর নারীদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সমকালীন বিশ্বে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে। বিশ্বায়নের ব্যাখ্যা ও প্রচারণায় নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সমঅধিকার প্রতিষ্?া ইত্যাদি বারংবার উচ্চারিত হলেও এর প্রক্রিয়া ও কার্যকারিতার মধ্যে লক্ষ্য করা যায় ব্যাপকতর বৈপরীত্য। মুক্ত পৃথিবী, মুক্ত মানুষ গড়ার স্বপ্ন দেখালেও বিশ্বায়ন লিঙ্গ বৈষম্য ও ব্যবধান বাড়িয়ে দিচ্ছে, বাড়ছে দুর্বল লিঙ্গের ওপর সবলের অত্যাচার, অধীনস্ততার সম্পর্ক হচ্ছে প্রকটতর।


বিশ্বায়ন ব্যবস্থার তত্ত্বানুসারে, সকল মানুষের সর্বোচ্চ উপযোগ প্রাপ্তি ও পরস্পরের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে স্বয়ংক্রিয় ভারসাম্য প্রতিষ্?া হবার কথা। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে তা প্রতিফলিত হচ্ছে না। মুক্তবাজার অর্থনীতির তত্ত্ব, ভোক্তা ছাড়া মানুষের অন্য কোন পরিচয়ের গুরুত্ব স্বীকার করে না। সবল জাতি, সবল লিঙ্গ, সবল শ্রেণী ও সবল ধর্মীয় গোষ্?ী বরাবরই তার কাছে যেŠক্তিক ভোক্তা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। আর দুর্বল শ্রেণী, দুর্বল লিঙ্গের মধ্যে অবস্থানকারী মানুষের আবেদন, অধিকার, প্রতিবাদ এ তত্ত্বের দৃষ্টিতে অনর্থনৈতিক, অযেŠক্তিক, বাজার অর্থনীতির স্বয়ংক্রিয় বিকাশের জন্য ক্ষতিকর, কাজেই এ ব্যবস্থায় যখন সমধিকার, বৈষম্য দূরীকরণ, স্বনির্ভরতার কথা বলা হয় তাকে নির্মম রসিকতা ছাড়া আর কিছুই বলার থাকে না। বিশ্বায়ন ব্যবস্থা সমাজ থেকে ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করে তাকেই আবার সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। ব্যক্তিকে করে তলে পুঁজি পণ্যে মুনাফা করার মেশিন। কিন্তু দিনের শেষে সে হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন সত্তা- একা ও নিঃসঙ্গ মানুষ। পুঁজি তখন নানান সামাজিক অনুষঙ্গ তৈরি করে ব্যক্তির একাকিত্ব ঘোচানোর জন্য। তৈরি করে পর্নো ব্যবসা, পর্নো বাজার। ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, পর্নোগ্রাফি এখন ৫৬ হাজার ডলারের বিশ্ববাণিজ্য।এই ক্রমবর্ধমান স¤প্রসারণে দেশে দেশে যেŠন নিপীড়নের বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। দিয়েছে প্রাতিষ্?ানিক রূপ। নারী আজ তাই লাভজনক পণ্য। নারীর কর্মসংস্থান ও আত্মনির্ভরশীল হয়ে ও?ার স্যুাগে বলা হলেও বিশ্বায়নের নামে নারীকে ব্যবহার করে মুনাফা করছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। তাই গণমাধ্যমে নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের চাইতে শারীরিক সেŠন্দর্য বৃদ্ধিকেই বেশি উৎসাহ দেওয়া হয় বাজারের চাহিদা অনুসারে। আর সেই সাথে বাজার উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়া হয় হাজারো প্রসাধনী। রূপসী তোমার গুণের খোঁজে জাতীয় সেŠন্দর্য প্রতিযোগীতার আড়ালে তাই লুকিয়ে থাকে বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ। বিশ্বায়নের সাথে আর একটি বিষয় চলে আসে, তা হলো বিশ্বজুড়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। এখানে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির কথা বলা হলেও নারীকে শারীরিক গ?নের কারণে পিছিয়ে রাখা হচ্ছে। অল্প মজুরীতে কিনে নেওয়া হচ্ছে তার শ্রম। বিশ্ববাজারে শ্রমিক প্রেরণের আড়ালে অনেক ক্ষেত্রেই হচ্ছে নারী পাচার। সম্মানজনক পেশায় নিয়োগের কথা বলে বিদেশে নিয়ে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়। বৈশ্বিকীকরণের নামে বিক্রি হচ্ছে নারী।


পুঁজিবাদী বৈশ্বিক প্রক্রিয়া যে নারীর আর্থিক উন্নয়ন ও স্বনির্ভরতা সৃষ্টির চাইতে বৈষম্যকেই উসকে দিয়েছে তার প্রামাণ্য দলিল যেন বিশ্ব রিপোর্ট (১৯৯৬)। সেখানে বলা হয়েছে : ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান অঙ্গীভবন বিশ্বদারিদ্র্য ও বঞ্চনার সমস্যা সমাধান করতে পারেনি বরং তা বিশ্বময় নারী পুরুষের বৈষম্যকেই তীব্রতর করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোতেই নারীর দারিদ্র্য আরো বেড়েছে, যা দারিদ্র্যের নারীকরণ নামে পরিচিতি পেয়েছে।’


প্রকৃতপক্ষে, এ বিশ্বকে সকলের জন্য উন্মুক্ত, সকলের জন্য নিজস্ব করে তুলতে বিশ্বায়ন ব্যবস্থাকে কার্যকর করা প্রয়োজন। কিন্তু বিশ্বায়নের সে প্রক্রিয়া হতে হবে মানুষের মুক্তির দীর্ঘকালীন লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। রাজ-রাজরাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়।




উপসংহারঃ
নতুন বিশ্বব্যবস্থায় বিশ্বায়নের কারণে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহকে বহুবিধ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাণিজ্যের উদারীকরণের কারণে যে অর্থনৈতিক বিন্যাস ফুটে উ?ছে তা বিশ্বকে পূর্বের মতোই ধনী ও দরিদ্র এই দুইভাগে বিভক্ত করবে। অথচ স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বের উদার অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশে নারী-পুরুষ সকল মানুষই সমঅধিকার ভোগ করবে এটাই ছিল প্রত্যাশিত। গ্যাট (এঅঞঞ) চুক্তির মধ্যে দিয়ে অনেকগুলো বিষয়কে প্রকারান্তরে উন্নত বিশ্বের হাতের মু?োয় সমর্পন করা হয়েছে, ফলে প্রান্তীয় বিশ্ব নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের স্পৃহা হারিয়ে ফেলতে পারে। তথাপি এ চুক্তিতে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য যে সহজশর্তে প্রযুক্তিগত সহায়তার কথা বলা হয়েছে, নিজস্ব ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ঘটিয়ে তার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে এ থেকে উন্নয়নশীল দেশসমূহও উপকৃত হতে পারে।
















তথ্যসূত্র:

পত্রপত্রিকা ও ইন্টারনেট


মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.