নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিটন আলম

মিটন আলম › বিস্তারিত পোস্টঃ

মানবতার কবি নজরুল

৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ৯:৪০

কাজী নজরুল ইসলাম বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে ১৩০৬ সালের ১১ইং জ্যেষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ২৪ মে) এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল কাজী ফকির আহমেদ ও মাতার নাম জাহেদা খাতুন। কাজী ফকির আহমেদের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর চারপুত্রের অকাল মৃত্যু হওয়ার পর নজরুলের জন্ম, তাই তাঁর ডাক নাম রাখা হয় দুখু মিয়া।

বিংশ শতকের প্রথম দিকে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ যুগে নজরুল ইসলামের আর্বিভাব, তিনি লালিত পালিত হন এরই পরিবেশে এবং তাঁর কবিত্ব শক্তির স্ফূরণ ও বিকাশও এই যুগে ঘটে। তাই এই যুগের আশা আকাক্সক্ষা ও দ্বন্দ্ব তঁাঁর জীবনে ও কাব্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর কাব্যবিচারে যুগমানসতো অনস্বীকার্য মানদণ্ড। এই মানদণ্ডই তাঁকে খতিয়ে দেখতে হবে তাঁর রচনা। নজরুল মানুষের কবি,- মানবতার কবি। তাঁর কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে মানবতার সুর। মানবতার প্রতি অভ্রান্ত বিশ্বাসে তিনি কাব্য সাধনায় নিয়োজিত হয়েছেন। তাই তার কাব্যে মানব প্রত্যয় দ্বিধাহীনভাবে উচ্চারিত হয়েছে। নজরুল মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি পোষণ করেন। মানুষের ব্যথা ও বেদনা তাঁকে গভীরভাবে অভিভূত করে। তাই মানুষকে নির্যাতিত ও অপমানিত হতে দেখে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

মানুষের লাঞ্ছনায় তিনি যেমন দুঃখিত ও অভিভূত হয়েছেন, তেমনি লাঞ্ছিত মানুষের দুঃখ বেদনা অবসানের উজ্জ্বল উপস্থাপনা তাঁর কাব্যে লক্ষ্য করা যায়। মানুষ সম্বন্ধে তাঁর ধারণা উঁচু। তিনি মানুষের আত্মিক শক্তির বিপুলতায় বিশ্বাসী। কোন মানুষই তাঁর কাছে তুচ্ছ নয়, ক্ষুদ্র নয়। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে বিপুল শক্তি ও সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে বলে তাঁর বিশ্বাস। তাঁর মতে, “মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।” ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় তিনি কাব্য সৃষ্টির সপক্ষে কৈফিয়ৎ দিতে গিয়ে বলেছেন, মানুষকে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও উৎসারিত হতে দেখে তিনি বিদ্রোহী ভঙ্গিতে আত্মপ্রকাশ করেছেন। সমাজে যারা নির্র্যাতিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, অপমানিত, অবহেলিত তারা তাঁর কবিচিত্তকে আকৃষ্ট করেছে। কুলি, মজুর শ্রমিক, জেলে, চাষী তাঁর মধ্যে গভীর দরদের সঞ্চার করেছে, তিনি গভীর মমত্বে ও আশ্চর্য দরদে তাদের ছবি এঁকেছেন কাব্যে। কবির ভেতর যে প্রধান গুণগুলো দেখা যায় সাম্যবাদী অসাম্প্রদায়িক; নারী মুক্তির আহবায়ক ও বিদ্রোহী- এসবের মূলে রয়েছে তাঁর মানবতাবাদী বেদনা।
কবি অনুভব করেছেন ধনতান্ত্রিক সমাজে ধনিক অত্যাচারী শ্রেণি দরিদ্রের প্রতি কী না জুলুম করে। ধনীরা দরিদ্রকে শোষণ করে দিনের পর দিন স্ফীততর হচ্ছে, আর দরিদ্রমানুষ ক্রমাগত নিঃস্ব হচ্ছে, হচ্ছে লাঞ্ছিত। মানুষের প্রতি অপরিসীম দরদের কারণেই তিনি নির্যাতিত মানুষের বেদনার ছবি এঁকেছেন বিশেষ ক্ষোভের সাথে-
(১) “দেখিনু সেদিন রেলে
কুলি বলে এক বাবু সাব, তারে ঠেলে
দিলে নীচে ফেলে।
চোখ ফেটে এল জল, এমনি করে
জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল।”

(২) “আজ চারদিক হতে ধনিক বণিক শোষণকারীর জাত
ও ভাই জোঁকের মতো শুষছে রক্ত
কাড়ছে থালার ভাত।”
এ চিত্র সকল মানবতার পক্ষে নিদারুণ লজ্জা ও অপমানের। তাই ভাবনার দিকে দিকে মহাসাগরের মহাবেদনা ধ্বনিত হয়ে উঠেছে এবং ধনীক শ্রেণির মধ্যে দারুণ ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছে। চাষীদেরকে এক শ্রেণীর মানুষ ঘৃণ্য করে বলে কবি বলেছেন-
“চাষা বলে কর ঘৃণা!
দেখো চাষা রুপে লুকায়ে জনক বলরাম হয়ে এলো কিনা ?
যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারাও ধরিল হাল,
তারাই আনিল অমর বাণী-যা আছে রবে চিরকাল।”
কবির কাছে বিধাতার সৃষ্ট মানুষ সবাই সমান। তাই তিনি চন্ডাল ও স¤্রাটের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখেননি।
“ওকে? চন্ডাল? চমকাও কেন? ও নহে ঘৃণ্য জীব
ওই হতে পারে হরিশ্চন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব।”
মানবতাবোধের কারণেই তিনি বিশ্বের শোষিত বঞ্চিত মানুষকে সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের পতাকা তলে আহবান জানিয়েছেন।
“সকল কালের সকল দেশের মানুষ আসি
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শুনো এক মিলনের বাঁশী।”
মানুষের মুক্তির জন্যই ধর্মের উদ্ভব, অথচ ধর্মের নামে মানুষ মানুষের জীবনকে বিষময় করে তুলেছে। ধর্মের যারা ধ্বজাবাহী মুসলমান সমাজের মোল্লা ও হিন্দুদের পুরোহিত, তারা ধর্মকে নিজ স্বার্থ সাধনে নিয়োজিত করেছে। ধর্ম তাদের সকল আয়োজনের শিকারে পরিণত হয়েছে। ধর্মের নামে মানুষকে দূরে সরিয়ে অমানবিক হয়ে উঠেছে। তাই কবি বলেছেন-
“খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা।
.........................................................
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়।”
ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ভেদ, হিন্দু মুসলমানে রক্তক্ষয়ী সংঘাত কবিকে বেদনাদীর্ণ করেছে। তাই মানুষকে ধর্মীয় গন্ডীর ঊর্ধ্বে তুলে তিনি মানবতার গান করেছেন-
“জাতের চেয়ে মানুষ সত্য
অধিক সত্য প্রাণের টান
প্রাণ-ঘরে সব এক সমান।”
কবির মতে মানুষের বড় পরিচয় হচ্ছে সে মানুষ। হিন্দু বা মুসলমান তথা ধর্মের পরিচয়ে মানুষ পরিচিত নয়-

“হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ- সন্তান মোর মার।”
মানবতাবাদী কবি নজরুল সকল ধর্মগ্রন্থ ও শাস্ত্রবিধি অপেক্ষা মানুষকে বড় করে দেখেছেন-
“তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে নিজ প্রাণ”
মানুষের জন্যই ধর্মগ্রন্থ, ধর্মগ্রন্থের জন্য মানুষ নয়। তাই সকল ধর্মগ্রন্থ অপেক্ষা মানুষ অনেক বড়; অনেক মহীয়ান-
“এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই।”
কবি উপলব্ধী করেছেন যে, সমাজে শ্রমিক-কৃষকের মতই পুরুষশাসিত সমাজে নারী লাঞ্ছিত, অপমানিত, অবহেলিত ও অস্বীকৃত। অথচ সমাজ সভ্যতায় নারীর ভূমিকা ও অবদান পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাই নারীর বেদনায় কবি বেদনাতুর। নারী অবহেলিত হলে মানবতা লুন্ঠিত হয়, তাই কবি নারীর মর্যাদা দানে পুরুষকে অহবান জানিয়েছেন-
“বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
“এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী ছিল তাহে রুপ-রস, মধু গন্ধ সুনির্মল।”

মানুষের প্রতি মমত্ববোধের কারণেই নজরুল বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন। তার বিদ্রোহ শোষকের বিরুদ্ধে। মানবের মানবতা প্রতিষ্ঠাকল্পেই তাঁর বিদ্রোহ।
“আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।”
তিনি সাম্যের মধ্য দিয়ে শোষিত মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান সহ সামাজিক অধিকার দাবী করেছেন। তিনি প্রীতিসুন্দর সমাজ কামনা করেছেন। নজরুলের মনে মানবপ্রেমের প্রচণ্ডতার কারণেই তাঁর চিত্তে সাম্যবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা নারীমুক্তি, বিদ্রোহ প্রভৃতি সমবেত ছিল। এ সবকিছুই তাঁর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বহি:প্রকাশ।

নজরুল যে দরদের সাথে মানবভাগ্য পরিবর্তনের জন্য মানবতার গান গেয়েছেন, তা সম্পূর্ণ নতুন। নজরুলের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে আমরাও হয়ে উঠেছি মানবতাবাদী। আমরাও বলতে শিখেছি-
“মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।”
এখানেই নজরুলের মানবতাবাদের বিশেষ মাত্রা সংযুক্ত।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১০:১০

প্রন্তিক বাঙ্গালী বলেছেন: অনেক তথ্য সম্ভলিত, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

২| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১০:১৯

মিটন আলম বলেছেন: আপনাকেও পাঠ করার জন্য সাধুবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.