নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিটন আলম

মিটন আলম › বিস্তারিত পোস্টঃ

কার্ল মার্কসের দর্শন”

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:১৬

কার্ল মার্কসের দর্শন”

ভূমিকা:
মার্কসসবাদ-এর যৌথ প্রবক্তা (এঙ্গেলসের সাথে), বিচ্ছিন্নতা ও শ্রমিকের ব্যাখ্যা, কমিউনিস্ট ইস্তেহার, ডাস কাপিটাল, ঐতিহাসিক বস্তুস্তুবাদ, কার্ল হাইনরিশ মার্কস (৫ই মে, ১৮১৮-১৪ই মার্চ, ১৮৮৩) একজন প্রভাবশালী জার্মান সমাজ বিজ্ঞানী ও মার্কসবাদ-এর প্রবক্তা। জীবিত অবস্থায় সেভাবে পরিচিত না হলেও মৃত্যুর পর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের কাছে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠেন, জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তাঁর ইতিহাস দর্শন। বিংশ শতাব্দীতে সমগ্র মানব সভ্যতা মার্কসের তত্ত্ব দ্বারা প্রবলভাবে আলোড়িত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতনের পর এ তত্ত্বের জনপ্রিয়তা কমে গেলেও তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মার্কসবাদ এখনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মার্কসের জীবনী:
কার্ল মার্কস প্রুশিয়া সম্রাজ্যের নিম্ন রাইন প্রদেশের অন্তর্গত ঞৎরবৎ নামক স্থানে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বাবা হাইনরিশ মার্কস এমন এক বংশের লোক যে বংশের পূর্বপুরুষেরা রাব্বি ছিলেন। অবশ্য তাদের মধ্যে অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ এবং আলোকময়তার যুগের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাদের অনেকেই ভলতেয়ার ও রুশোর মত দার্শনিকদের প্রশংসা করতেন। জন্মের সময় হাইনরিশ মার্কসের নাম ছিল ঐবৎংপযবষ গড়ৎফবপযধর, তার বাবার নাম খবাু গড়ৎফবপযধর (১৭৪৩-১৮০৪) এবং মা'র নাম ঊাধ খড়িি (১৭৫৩-১৮২৩)। ইহুদি পরিবারেই হাইনরিশের জন্ম, কিন্তু ধর্মের কারণে আইন অনুশীলনে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় তিনি ইহুদি ধর্ম ত্যাগ করে লুথারীয় মতবাদে দীক্ষা নেন। লুথারীয় ধর্ম তখন প্রুশীয় সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম ছিল, তাই সেই রোমান ক্যাথলিক সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে লুথারীয় সংখ্যালঘু হিসেবে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা লাভের আশায়ই তিনি এভাবে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।

কার্ল মাকর্সের মা'র নাম ঐবহৎরবঃঃব হল্কব চৎবংংনঁৎম (১৭৮৮-১৮৬৩)। তিনি শিল্পপতি এবৎধৎফ চযরষরঢ়ং ও অহঃড়হ চযরষরঢ়ং এর মাতামহ (আপন নন) এবং ইধৎবহঃ-ঈড়যবহ পরিবারের উত্তরসূরী। ঐবহৎরবঃঃব এর বাবার নাম ওংধধপ ঐবরলসধহং চৎবংনঁৎম (১৭৪৭-১৮৩২) এবং মা'র নাম ঘধহবঃঃব ঝধষড়সড়হ ইধৎবহঃ-ঈড়যবহ (১৭৬৪-১৮৩৩)। ঘধহবঃঃব এর বাবা ছিলেন ঝধষড়সড়হ উধারফ ইধৎবহঃ-ঈড়যবহ (মৃ. ১৮০৭) এবং মা ছিলেন ঝধৎধ ইৎধহফবং। এই সালোমোন ও সারা আবার বিবাহ সূত্রে ঘধঃযধহ গধুবৎ জড়ঃযংপযরষফ এর স্ত্রীর চাচা-চাচী ছিলেন।

শিক্ষা:
কার্লমার্কস ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশোনা করেন। বাল্যপাঠ শেষে ঞৎরবৎ এুসহধংরঁস এ ভর্তি হন, ১৭ বছর বয়সে সেখান থেকে স্নাতক হন। এরপর ইউনিভার্সিটি অফ বন-এ আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তার ইচ্ছা ছিল সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে পড়া, কিন্তু তার বাবা মনে করতেন কার্ল স্কলার হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবে না। কিছুদিনের মধ্যেই তার বাবা তাকে বার্লিনের ঐঁসনড়ষফঃ-টহরাবৎংরঃু-তে এ বদলি করিয়ে দেন। সে সময় মার্কস জীবন নিয়ে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন, তার লেখার ভাষা ছিল বাবার কাছ থেকে পাওয়া ধর্মতাত্ত্বিক তথা অতিবর্তী ঈশ্বরবাদের ভাষা। এ সময়ই তরুণ হেগেলিয়ানদের নাস্তিকতাবাদ গ্রহণ করেন। ১৮৪১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল "ঞযব উরভভবৎবহপব ইবঃবিবহ ঃযব উবসড়পৎরঃবধহ ধহফ ঊঢ়রপঁৎবধহ চযরষড়ংড়ঢ়যু ড়ভ ঘধঃঁৎব" (প্রকৃতি সম্বন্ধে দেমোক্রিতোসীয় ও এপিকুরোসীয় দর্শনের মধ্যে পার্থক্য)। উল্লেখ্য, পিএইচডি অভিসন্দর্ভ তিনি বার্লিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা না দিয়ে ইউনিভার্সিটি অফ জেনা-তে জমা দেন। কারণ তরুণ হেগেলিয়ান র‌্যাডিকেল হওয়ার কারণে বার্লিনে তার ভাবমূর্তি ভাল ছিল না।

তরুণ হেগেলিয়ান মার্কস -বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মার্কস:
বার্লিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি ভাগ ছিল। তরুণ হেগেলিয়ান, দার্শনিক ছাত্র এবং লুডউইগ ফয়েরবাক ও ব্রুনো বাউয়ার-কে কেন্দ্র করে গঠিত সাংবাদিক সমাজ ছিল বামপন্থী। আর শিক্ষক সমাজ ছিল জি ডব্লিউ এফ হেগেল। এই দুটি ভাগ ছিল পরস্পরবিরোধী। হেগেলের অধিবিদ্যাগত অনুমিতিগুলোর সমালোচনা করলেও বামপন্থীরা প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ও রাজনীতির কঠোর সমালোচনার জন্য হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিই অনুসরণ করতো।

কিছু তরুণ হেগেলিয়ান এরিস্টটল-উত্তর দর্শনের সাথে হেগেল-উত্তর দর্শনের সাদৃশ্য তুলে ধরেন। যেমন, মার্কস স্টির্নার তার উবৎ ঊরহুরমব ঁহফ ংবরহ ঊরমবহঃযঁস (১৮৪৪) বইয়ে ফয়ারবাখ ও বাউয়ারের সমালোচনা করেন, বিমূর্ত ধারণাগুলোর দ্ব্যর্থতাবোধক হেত্বাভাস (ৎবরভরপধঃরড়হ) চর্চার জন্য তাদেরকে ধার্মিক ব্যক্তি বলে আখ্যায়িত করেন। মাকর্স এই বই পড়ে মুগ্ধ হয়ে ফয়ারবাখের বস্তুবাদ ত্যাগ করেন। এই রূপতাত্ত্বিক বিরতি (বঢ়রংঃবসড়ষড়মরপধষ নৎবধশ) ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বিষয়ে তার ধারণার ভিত্তি রচনায় যথেষ্ট সাহায্য করে। এই নতুন ধারণার মাধ্যমে তিনি স্টির্নারেরও বিরোধিতা করেন। এ বিষয়ে একটি বইও লিখেন যার নাম উরব উবঁঃংপযব ওফবড়ষড়মরব (১৮৪৫)। অবশ্য ১৯৩২ সালের আগে এই বই প্রকাশের মুখ দেখেনি।

প্যারিস ও ব্রাসেল্স:
১৮৪৩ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে মার্কস প্যারিসে আসেন। এ শহর তখন জার্মান, ব্রিটিশ, পোলীয় ও ইতালীয় বিপ্লবীদের সদর দফতর হয়ে উঠেছিল। তিনি প্যারিসে গিয়েছিলেন মূলত জার্মান বিপ্লবী অৎহড়ষফ জঁমব এর উবঁঃংপয-ঋৎধহুস্খংরংপযব ঔধযৎনহৃপযবৎ-এর উপর কাজ করতে। সে সময় ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস প্যারিসে গিয়েছিলেন মার্কসকে ১৮৪৪ সালের বাস্তবতায় ইংল্যান্ডে কর্মজীবী মানুষের অবস্থা অবহিত করতে। এর আগে ১৮৪২ সালে মার্কসের সাথে এঙ্গেল্সের এ নিয়ে কথা হয়েছিল। সে পরিচয়ের ভিত্তিতেই এঙ্গেল্স এ ধরণের উদ্যোগ নেন। এভাবেই ১৮৪৪ সালের ২৮শে অক্টোবর মার্কস ও এঙ্গেল্স প্যারিসের ঈধভল্ক ফব ষধ জল্কমবহপব-তে তাদের বন্ধুত্ব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা ঘটান। এটা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধুত্বের একটি।

জার্মান-ফরাসি বার্ষিকী বা উবঁঃংপয-ঋৎধহুস্খংরংপযব ঔধযৎনহৃপযবৎ-এর পতন হওয়ার পর মার্ক্স প্যারিসের সবচেয়ে প্রগতিশীল জার্মান পত্রিকায় ("লিগ অফ দ্য জাস্ট" নামক গোপনীয় সমাজ এটা প্রকাশ করতো) একটি প্রবন্ধ লিখেন। এই প্রবন্ধের বিষয় ছিল "ইহুদি প্রশ্ন" এবং হেগেল। লেখালেখির বাইরে মার্ক্সের সময় কাটতো ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস, চরবৎৎব-ঔড়ংবঢ়য চৎড়ঁফযড়হ এর রচনা এবং গ্রাম্য প্রোলেতারিয়াদের কথা পড়ে এ সময় প্রোলেতারিয়াদের অবস্থা নিয়ে তার বিশেষ আগ্রহ সম্পর্কে উইলিয়াম এইচ সিউয়েল জুনিয়র তার ওয়ার্ক অ্যান্ড রিভলিউশন ইন ফ্রান্স গ্রন্থে বলেন, ... মার্কসের হঠাৎ করে প্রোলেতারীয় কারণ সম্বন্ধীয় মতবাদের প্রতি সমর্থনের সাথে এর আগে ফ্রান্সের সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সমাজের সাথে তার নিবিড় যোগাযোগের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করা যায়।

মার্কস তরুণ হেগেলিয়ানদের সাথে তার সম্পর্কের পূনর্মূল্যায়ন করেন। ১৮৪৩ সালে বাউয়ারের নাস্তিকতার জবাবে রচিত "অন দ্য জিউইশ কোয়েশ্চ্ন" এই পুনর্মূল্যায়নেরই অংশ। এ সময়ই আরেকটি প্রবন্ধ লিখেন যার বিষয় ছিল রাজনৈতিক মুক্তি, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্ম কিভাবে মানুষের মুক্তির বিরোধিতা করে এবং বেসামরিক ও মানবাধিকার বিষয়ে সমকালীন দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা। প্রত্যয়ী সাম্যবাদী এঙ্গেল্স মার্কসের অর্থনৈতিক গবেষণাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান এবং কর্মজীবী শ্রেণীর অবস্থার প্রতি তার উৎসাহ সৃষ্টি করেন। এভাবেই মার্কস সাম্যবাদী হয়ে উঠেন, ইকোনমিক অ্যান্ড ফিলোসফিক্যাল মেনুস্ক্রিপ্ট্স অফ ১৮৪৪ (১৯৩০-এর দশকের আগে প্রকাশিত হয়নি) রচনার মাধ্যমে সাম্যবাদ বিষয়ে তার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন, পুঁজিবাদী সমাজে বিচ্ছিন্ন (এলিয়েনেটেড) কর্মজীবী শ্রেণীর বিপরীতে সাম্যবাদী সমাজে সম্পৃক্ত (আন-এলিয়েনেটেড) কর্মজীবী শ্রেণীর কথা বলেন। তার মতে, এ ধরণের সাম্যবাদী সমাজে সবাই নিজেদের স্বাধীনভাবে গড়ে তুলতে পারে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারে।

১৮৪৫ সালের জানুয়ারিতে যখন ঠড়ৎরিঃং প্রুশিয়ার রাজা ফ্রিডরিক উইলিয়াম ৪-কে হত্যার প্রচেষ্টাকে অনুমোদন দেয় তখন প্যারিস থেকে কার্ল মার্ক্স সহ সব বিপ্লবীকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি এঙ্গেল্সের সাথে ব্রাসেল্স চলে যান। এখানেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে সম্পূর্ণ করার জন্য ইতিহাস অধ্যয়ন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তার দ্য জার্মান আইডিওলজি-তে (১৮৪৫) বলেন, প্রতিটি ব্যক্তির স্বভাব-প্রকৃতি তাদের উৎপাদন নির্ধারণকারী বস্তুর শর্তের উপর নির্ভর করে। এর মাধ্যমেই উৎপাদনের নকশা প্রণয়ন করেন এবং শিল্পকেন্দ্রিক পুঁজিবাদের পতন ও তার বদলে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যদ্বাণী করেন। এর পরই ফরাসি সমাজতন্ত্রের সমালোচনা প্রকাশ করেন যার নাম ছিল দ্য পোভার্টি অফ ফিলোসফি (১৮৪৭)। এটা ছিল চরবৎৎব-ঔড়ংবঢ়য চৎড়ঁফযড়হ রচিত "দ্য ফিলোসফি অফ পোভার্টি"-র (১৮৪৭) প্রত্যুত্তর। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে চিন্তা করলে মার্কসের দ্য জার্মান আইডিওলজি এবং দ্য পোভার্টি অফ ফিলোসফি-ই পরবর্তীকালে প্রকাশিত দ্য কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর মূল ভিত্তি। এই ইশতেহার ছিল কমিউনিস্ট লিগ-এর মূলনীতি।
প্যারিসে প্রত্যাবর্তন:
১৮৪৮ সালে ইউরোপ জুড়ে প্রচুর বিপ্লব সংঘটিত হয়। অনেক কিছুই বদলে যায়। মার্কসকে বন্দী করা হয় এবং পরবর্তীতে বেলজিয়াম থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরই মধ্যে বিপ্লবীরা ফ্রান্সের রাজা লুই-ফিলিপ কে রাজি করিয়ে মার্ক্সকে প্যারিসে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে। রাজার আমন্ত্রণেই তিনি প্যারিসে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় প্যারিসে জুন ডেইস আপরাইজিং নামে পরিচিত বিপ্লবটি সংঘটিত হয় যা মার্কস প্রত্যক্ষ করেন।

জার্মানিতে প্রত্যাবর্তন ও পুনরায় নির্বাসন:
প্যারিসে জুন ডেইস আপরাইজিং শেষ হওয়ার পর ১৮৪৯ সালে মার্ক্স জার্মানির ঈড়ষড়মহব শহরে ফিরে যান এবং ঘবঁব জযবরহরংপযব তবরঃঁহম পত্রিকাটি প্রকাশ করতে শুরু করেন। এই পত্রিকা প্রকাশকালীন সময়েই তাকে দুই বার অভিযুক্ত করা হয়। প্রথম বার ১৮৪৯ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি ঢ়ৎবংং সরং-ফবসবধহড়ঁৎ পৎরসব প্রকাশের জন্য এবং পরের বার একই বছরের ৮ই ফেব্রুয়ারি রহপরঃবসবহঃ ঃড় ধৎসবফ ৎবনবষষরড়হ প্রকাশের জন্য। দুই বারই তিনি অব্যাহতি পেয়ে যান। কিন্তু এই ধারাবাহিকতায় আরও বাঁধা আসতে থাকে। একসময় পত্রিকাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং তাকে প্যারিসে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু প্যারিস তাকে শরণার্থী হিসেবে গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়, অগত্যা লন্ডনে চলে যান। লন্ডন তাকে ইউরোপ মহাদেশের একজন শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করে।

লন্ডন:
১৮৪৯ সালের মে মাসে কার্ল মার্কস লন্ডনে যান এবং ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৮৫১ সালে নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউন-এর স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন, এতে তার জীবিকা অর্জনেও সুবিধা হয়। ১৮৫৫ সালে মার্কস পরিবারের সন্তান এডগার যক্ষ্ণায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এসব কারণে কয়েক বছর রাজনৈতিক অর্থনীতির কাজ বেশ ধীরগতিতে চলে। ১৮৫৭ সালে ৮০০ পৃষ্ঠার একটি পান্ডুলিপির কাজ শেষ করেন। এই ৮০০পৃষ্ঠায় মূলধন, ল্যান্ডেড প্রোপার্টি, মজুরি শ্রম, রাষ্ট্র, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বিশ্ব বাজার বিষয়গুলো স্থান পায়। এই পান্ডুলিপিটি ১৯৪১ সালে এৎঁহফৎরংংব ফবৎ কৎরঃরশ ফবৎ চড়ষরঃরংপযবহ শড়হড়সরব (রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনার সাধারণ পরিচিতি) নামে প্রকাশিত হয়। বইটির সংক্ষিপ্ত নাম ছিল এৎঁহফৎরংংব। ১৮৫৯ সালে প্রকাশ করেন কন্ট্রিবিউশন টু দ্য ক্রিটিক অফ পলিটিক্যাল ইকোনমি যা তার অর্থনীতি বিষয়ক পরিপক্ক প্রকাশনাগুলোর মধ্যে প্রথম হিসেবে বিবেচিত হয়। একইসাথে সংবাদ প্রতিবেদক হিসেবে মার্কস মার্কিন গৃহযুদ্ধের (১৮৬১-১৯৬৫) ইউনিয়ন কারণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেন।

১৮৬০-এর দশকের প্রথম দিকে মার্কস তিনটি খন্ড রচনা শেষ করেন। প্রথম খন্ডের নাম থিওরিস অফ সারপ্লাস ভ্যালু। এর প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল কয়েকজন রাজনৈতিক অর্থনীতি তাত্ত্বিকদের (বিশেষত অ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড রিকার্ডো) মতবাদ। সম্পাদক কধৎষ কধঁঃংশু মাকর্সের মৃতত্ত্ব্যর পর এটা প্রকাশ করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত না হলেও এই খন্ডকে ডাস কাপিটাল-এর "চতুর্থ পুস্তক" হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ইতিহাস নিয়ে জ্ঞানগর্ভ রচনাগুলোর এটাই প্রথম। ১৮৬৭ সালে তিন খন্ডে ডাস কাপিটাল প্রকাশিত হয়। প্রথম খন্ড ডেভিড রিকার্ডো প্রণীত মূল্যের শ্রম নীতি-কে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে এবং সে দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শ্রমিকদের শোষণকারী পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করে। মার্কস এতে বলেন, এই উদ্বৃত্ত মূল্য ও শোষণের কারণে একসময় পুঁজিবাদীদের লাভের হার একেবারে কমে যাবে এবং যথারীতি শিল্পকেন্দ্রিক পুঁজিবাদের পতন ঘটবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় খন্ড মার্কসের জীবদ্দশায় পান্ডুলিপি পর্যায়েই থেকে যায়, তিনি এ দুটোর আরও উন্নয়ন ঘটান। তার মৃতত্ত্ব্যর পর এঙ্গেলস এগুলো সমাপ্ত করেন এবং প্রকাশ করেন।

ডাস কাপিটাল প্রকাশে একটু দেরী হয়, কারণ মার্কস তখন প্রথম আন্তর্জাতিক এর কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ১৮৬৪ সালে মূল জেনারেল কাউন্সিলে নির্বাচিত হন। কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল-এর প্রথম বার্ষিক সভার প্রস্তুতি গ্রহণ এবং মিখাইল বাকুনিন (১৮১৪-১৮৬৭) এর অ্যানার্কিস্ট দলের সাথে অন্তর্ঘাতী বিরোধে নেতৃত্ব দানের দায়িত্ব তার উপরই পড়ে। এই বিরোধে তিনি জয়ী হন, কিন্তু ১৮৭২ সালে তারই সমর্থনে জেনারেল কাউন্সিলের সভাস্থল লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্কে সরিয়ে নেয়ার কারণে ইন্টারন্যাশনালের পতন ত্বরান্বিত হয়। ইন্টারন্যাশনালের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল ১৮৭১ সালের প্যারিস কমিউন। এই কমিউনের মাধ্যমে প্যারিসের বিপ্লবীরা ফরাসি সরকারের বিরোধিতা করে দুই মাস শহরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে, অবশেষে রক্তাক্ত সংঘর্ষের মাধ্যমে সরকার পুনরায় নেতৃত্ব নিয়ে নেয়। মার্কস তার দ্য সিভিল ওয়ার ইন ফ্রান্স রচনায় কমিউনকে সমর্থন করেছিলেন।
জীবনের শেষ দশকে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে, আগের মত প্রত্যয়ী বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন পরিচালনায় অক্ষম হয়ে পড়েন। অবশ্য সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে বক্তব্য প্রদান থেকে কখনই বিরত ছিলেন না, বিশেষত জার্মানি ও রাশিয়ার রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেন। ঈৎরঃরয়ঁব ড়ভ ঃযব এড়ঃযধ চৎড়মৎধসসব-এ তিনি ডরষযবষস খরবনশহবপযঃ (১৮২৬-১৯০০) এবং অঁমঁংঃ ইবনবষ (১৮৪০-১৯১৩) নামক দু'জন জার্মান অনুসারীর প্রবণতার বিরোধিতা করেন। এই দুজন ফের্দিনান্দ লাসালের রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের সাথে সমঝোতা করার মাধ্যমে একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজতান্ত্রিক দলের স্বার্থের পক্ষাবলম্বন করেছিল।

১৮৮২ সালে পারিবারিক জীবন:
মার্কস জেনি ফন ভেস্টফালেন-কে বিয়ে করেন। জেনি ছিলেন এক প্রুশীয় ব্যারনের শিক্ষিত কন্যা। তাদের সম্পর্কের বিষয়টি গোপন রাখতে হয়েছিল, কারণ এই বিয়েতে মার্কস পরিবারের সম্মতি ছিল না। ১৮৪৩ সালের ১৯শে জুন ইধফ কৎবুঁহধপয-এর কৎবুঁহধপযবৎ চধঁষঁংশরৎপযব-এ তাদের বিয়ে হয়। ১৮৮১ সালের ডিসেম্বরে জেনি মারা যাওয়ার পর মার্ক্স এক ধরণের পধঃধৎৎয-য় আক্রান্ত হন। এই রোগ তাকে জীবনের শেষ ১৫ মাস অসুস্থ করে রাখে। এই রোগ পরবর্তীতে ব্রঙ্কাইটিস ও সব শেষে ঢ়ষবঁৎরংু তে পরিণত হয়। এই ঢ়ষবঁৎরংু-র কারণেই ১৮৮৩ সালের ১৪ই মার্চ তার মৃতত্ত্ব্য হয়। মৃতত্ত্ব্যর সময় মাকর্সের কোন জাতীয়তা তথা দেশ ছিল না, তাকে ১৭ই মার্চ লন্ডনের হাইগেট সেমিটারি-তে সমাহিত করা হয়। তার সমাধি ফলকে দুটি বাক্য লেখা আছে। প্রথমে লেখা, কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর শেষ লাইন "দুনিয়ার মজদুর এক হও" (ডড়ৎশবৎং ড়ভ ধষষ ষধহফ ঁহরঃব), এরপরে লেখা ১১তম থিসিস অন ফয়ারবাখ-এর এঙ্গেলীয় সংস্করণের বিখ্যাত উক্তি, "এতোদিন দার্শনিকেরা কেবল বিশ্বকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যাই করে গেছেন, কিন্তু আসল কাজ হল তা পরিবর্তন করা।" (ঞযব চযরষড়ড়িঢ়যবৎং যধাব ড়হষু রহঃবৎঢ়ৎবঃবফ ঃযব ড়িৎষফ রহ াধৎরড়ঁং ধিুং - ঞযব ঢ়ড়রহঃ যড়বিাবৎ রং ঃড় পযধহমব রঃ)




কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) ও তাঁর দর্শন
একঃ দর্শন ও বিজ্ঞান
প্রতিটি দর্শনের ক্ষেত্রে একটি কথা এখানে প্রযোজ্য যে যেকোন দর্শনই তাঁর কালকে অতিক্রম করতে পারে না। সকল দার্শনিক তাঁর সময়কাল দ্বারা সীমাবদ্ধ। কথাগুলো সমভাবে প্রযোজ্য প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ গুলোর জন্য। সাধারনত প্রতিটি শেষ ধর্ম বা দর্শন আগের গুলোর ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই তৈরী হয় বলে শেষের ধর্মটি বা দর্শনটি হতে পারে সর্বোত্তম। ধর্মগ্রন্থ গুলোকে আমি দর্শনের ইতিহাসের একটি অংশবিশেষ। শুধু পার্থক্য এই যে দাবী করা হয়ে থাকে যে, ধর্মের কথাগুলো সরাসরি ঈশ্বরের, আর দর্শনের গুলো মানুষের। যদি কেউ বলে থাকেন যে কারোর দর্শন সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য তবে তিঁনি ইতিহাসকেই অস্বীকার করেন। এখন কথা হল দর্শন আর বিজ্ঞানের মাঝে পার্থক্য কি? বিজ্ঞানের যে কোন আবিষ্কার তাঁর পূর্ববর্তী জ্ঞান বা তত্ত্ব¡কে পর্যালোচনা করেই সৃষ্টি হয়। কিন্তু বিজ্ঞানের যে কোন তত্ত্ব¡ হয় কালের উর্ধ্বে। যদি একটি তত্ত্ব¡ তাঁর পর্যবেক্ষনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় তবে তা যেমন তাঁর পূর্ব ও বর্তমান কালে সত্য তেমনি তা হতে হবে ভবিষ্যতেও সত্য। যদি ভবিষ্যতের কোন একটিও পর্যবেক্ষণ দ্বারা সেই তত্ত্ব¡ অসত্য প্রমানিত হয় তবে তা আর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব¡ থাকে না। দর্শনগুলো যেহেতু তাদের কালকে অতিক্রম করতে পারে না তাই দর্শনের মাঝে বিজ্ঞান খোঁজা অবান্তর। সম কারণেধর্মের মাঝেও বিজ্ঞান খোঁজাও অবান্তর।

তবে প্রত্যেক দার্শনিকই বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ প্রণালী ব্যবহার করে থাকেন- জেনে বা না জেনেই। যে কোন কিছু জানার চেষ্টা করা- পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রশ্ন এবং তার উত্তরের মাধ্যমে- তাহাই বৈজ্ঞানিক প্রনালী। যেমন আদিম সমাজে মানূষ জানার চেষ্টা করতো কেন তাঁরা অসুস্থ হয়। তাঁদের যেহেতু জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ছিল তাই তাঁরা বের করলো দেবতাদের খুশী রাখলে, পূঁজা করলে তাঁরা সুস্থ হয়ে যাবে। তাঁরা বের করলো জটিল মন্ত্র, যার হয়তো কোন ব্যাখ্যা নেই কিন্তু তারপরেও তা আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্বের তুলনায় কোন অংশে কম ছিল না তাঁদের কাছে। তবে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ প্রনালী ব্যবহার করলেই সেটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব¡ হয়ে যায় না, যেমনটি হল আদিম সমাজের মন্ত্রতত্ত্ব¡। আজ আমরা যে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষনা করতে গেলে আমরা কি করি? প্রথমে আমরা ঠিক করি আমি কি নিয়ে কাজ করতে চাই এবং কেন করতে চাই। তারপর লিটেরেচার রিভিউ করি। আমার আগে যারা একই বিষয় নিয়ে কাজ করেছে তাঁরা কি কি করেছেন দেখি। তাঁদের সীমাবদ্ধতা কোথায় ছিল বোঝার চেষ্টা করি। এটা যখন ধরা যায় তখনি কেবল নিজের পক্ষে কতটুকু কাজের সুযোগ আছে এই বিষয়ে সে সম্পর্কে একটা ধারণা হয়। এই ধারণাটি যখন হয়ে যায় তারপরের কাজ বেশ সহজ। কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষা করা হয় যা আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে সাহায্য করে। এভবে পরীক্ষা আর প্রশ্নের উত্তর খোঁজা চলতে থাকে যতক্ষন না আমি সন্তুষ্ট হই।

দর্শনের ক্ষেত্রেও দার্শনিকরা কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজে চলেছেন। তবে এক্ষেত্রে তাঁরা পর্যবেক্ষণ করে থাকে মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাস। যিনি যত পরে এসেছেন তাঁর কাছে পূর্ববর্তী ইতিহাসের তথ্য বেশী ছিল, তাই তাঁর পর্যবেক্ষন তত্ত্ব ভাল হয়েছে। সক্রেটিস, এরিষ্টটল, কান্ট, হেগেল, মার্কস তাঁরা সবাই অনেক প্রতিভাবান ছিলেন কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁরা সকলেই তাঁদের সময়কাল দ্বারা আবদ্ধ ছিলেন। তাঁরা যেটুকু ইতিহাস দেখেছেন তাই শেষ নয়, তাই তাঁদের কথাই শেষ নয়। তবে তাঁরা যে কথাগুলো বলেছেন তা বুঝতে হলে আপনাকে তাঁরা যে ইতিহাস দেখে উনাদের সিদ্ধান্তে এসেছেন আপনাকেও পৃথকভাবে তাঁর কাছাকাছি যেতে হবে। যখন আপনি সেটা করতে পারছেন তখনি কেবল সম্ভব হবে চিন্তা করতে যে তাঁরা আজ বেঁচে থাকলে কি বলতেন।

নিছক মার্কসবাদের সমালোচনা করা, বা কারো ব্যাক্তিগত বিশ্বাসে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মার্ক্স এর দর্শন যা বুঝেছি তাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি কেবল। চেষ্টা করেছি মার্ক্স এর দূর্বলতা গুলোকে চিহ্নিত করে তাঁর প্রকৃত দর্শনকে তুলে ধরতে। আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষন একশত ভাগ সত্য হবে তা মনে করি না, তবে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে দ্বিমত পোষন করলে যুক্তি খন্ডন করে মতামত দিলে খুশি হবো। লেখার সময় চেষ্টা করেছি প্রতিটি রেফারেন্স উল্লেখ করতে এবং সমস্ত রেফারেন্সই অন্তর্জালে আছে। তাই আমার বক্তব্য খতিয়ে দেখা খুব বেশী কঠিন নয় বলেই মনে করি।

দুইঃ দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ:
মার্কস(কধৎষ গধৎী, ১৮১৮-১৮৮৩) এর দর্শনের প্রধানত দু’টি দিক- একটি বস্তুবাদ এবং অন্যটি দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি। এই দু’য়ের সংমিশ্রনে সৃষ্ট তাঁর দর্শন দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ। বস্তুবাদ কিংবা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি, মার্কসই প্রথম বলেন তা নয়। বস্তুবাদ দর্শন আমরা দেখতে পাই গ্রীক দার্শনিক থেল্স্ (ঞযধষবং, ৬২৪ ইঈ-৫৪৬ ইঈ), ডেমোক্রিটাস্ (উবসড়পৎরঃঁং, ৪৬০ ইঈ-৩৭০ ইঈ ), ইপিকিউরাস্ (ঊঢ়রপঁৎঁং, ৩৪১ ইঈ-২৭০ ইঈ) এর মাঝে। তারপরে দেখা যায় হব্স্ (ঞযড়সধং ঐড়ননবং, ১৫৮৮-১৬৭৯), ফুয়েরবার্খ (ঋবঁবৎনধপয, ১৮০৪-১৮৭২), মার্কস (গধৎী, ১৮১৮-১৮৮৩), এংগেল্স্ (ঊহমবষং, ১৮২০-১৮৯৫), বার্ট্রান্ড রাসেল (ইবৎঃৎধহফ জঁংংবষ, ১৮৭২-১৯৭০) এর মাঝে। বর্তমান সমসাময়িকে দেখা যায় ডেনেট (উবহহবঃ, ১৯৪২-), কুইন (ছঁরহ, ১৯০৮-২০০০), ডেভিডসন (উধারফংড়হ, ১৯১৭-২০০৩) প্রমুখ দার্শনিকের মাঝে।

বস্তুবাদ দর্শনের মূল কথা হল, বস্তুই সব। পৃথিবীর সমস্তই বস্তু দ্বারা গঠিত এবং তা সর্বদা গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। বস্তুবাদ দর্শনে মন বা আত্মার কোন আলাদা অস্তিত্ব নেই। মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়া/প্রতিক্রিয়াই হল মন। মার্ক্স এর পিএইচডির বিষয়বস্তু ছিল “ঞযব ফরভভবৎবহপব নবঃবিবহ ঃযব উবসড়পৎরঃবধহ ধহফ ঊঢ়রপঁৎবধহ ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যু ড়ভ হধঃঁৎব”. উক্ত কাজের সময় এবং পরবর্তীতে জার্মান দার্শনিক হেগেল ও ফুয়েরবার্খ নিয়ে কাজ করার সময় তিনি বস্তুবাদী দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছিলেন বলে মনে হয়।

দ্বান্দ্বিকপদ্ধতিও মার্ক্স সর্বপ্রথম বলেননি। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস্ (ঝড়পৎধঃবং, ৪৬৯ ইঈ-৩৯৯ ইঈ), প্লেটো (চষধঃড়, ৪২৮/৪২৭ ইঈ-৩৪৮/৩৪৭ ইঈ), এরিষ্টটল্ (৩৮৪ ইঈ-৩২২ ইঈ) এর মাঝে দ্বান্দ্বিক কথোপকথন লক্ষ্য করা যায়। তবে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন জার্মান দার্শনিক হেগেল (ঐবমবষ, ১৭৭০-১৮৩১), যার ধারণা তিনি পেয়েছিলেন আরেক জার্মান দার্শনিক কান্ট (কধহঃ, ১৭২৪-১৮০৪) থেকে। এই পর্যায়ে হেগেল এর কথা কিছুটা না বললেই নয়। হেগেলকে বলা হয় ভাববাদী দার্শনিকদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। প্রাচীন গ্রীক দর্শনের যুগের পর বিশাল মধ্যযুগে (রোমান সভ্যতার পতনের পর, পঞ্চম শতাব্দি, থেকে রেনেসাঁস্, ষোড়শ শতাব্দি, এর আগ পর্যন্ত) দর্শনের বিষয়বস্তু মূলত সীমাবদ্ধ থাকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমানে এবং তার ভাল গুণাবলীর আবিষ্কারে। মধ্যযুগের পর আধুনিক দর্শনকালে গ্যালিলিও (এধষরষবড়, ১৫৬৪-১৬৪২), ডেস্কার্টেস (১৫৯৬-১৬৫০), স্পিনোজা (১৬৩২-১৬৭৭), লিব্নিজ (১৬৪৬-১৭১৬) কান্ট, হেগেল অন্যতম। এই সময়কার দর্শনের মূল বিষয়বস্তু ছিল যুক্তির ব্যবহার। আর হেগেল এই যুক্তির ব্যাবহার কে এক অনন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে। তাঁর খবপঃঁৎবং ড়হ ঃযব ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঢ়যরষড়ংড়ঢ়য পড়লে দর্শনের ইতিহাস সম্পর্কে পুরো ধারণা লাভ করা যায়। সেখানে তিনি প্রাচীন কাল হতে তাঁর সময়কাল পর্যন্ত সকল পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দার্শনিকদের নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে তাঁর লেখা হচ্ছে দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বোধ্য।

তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মূল বিষয় হল ঃযবংরং (তত্ত্ব) এবং ধহঃরঃযবংরং (প্রতিত্ত্বত্ত্ব) এর দ্বন্দ্ব এবং এই দু’য়ের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে একটি ংুহঃযবংরং এ পৌঁছা। ংুহঃযবংরং কে অবশ্যই ধহঃরঃযবংরং কে যুক্তি দিয়ে জয় করে আসতে হবে। হেগেল যেটি দেখিয়েছেন যে প্রকৃতির মাঝে সবসময় একপ্রকার দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এই দ্বন্দ্বের কারণে প্রতিটি বস্তু প্রতি নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকালেও মানব জাতির মাঝে একই রকমের দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। হেগেল এবং মার্কস দু’জনেই মানব সভ্যতার ইতিহাসকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। শুধু পার্থক্য এই যে হেগেল সবকিছুতে ছিলেন ভাববাদী আর মার্কস ছিলেন বস্তুবাদী। মার্কস এর নিজের ভাষায় তিনি হেগেল এর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে মস্তিষ্ক (ভাব) থেকে পাঁয়ে (বস্তু) নামালেন, বলা যায় একেবারে উল্টিয়ে দিলেন।

হেগেল সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে যেটা শেষমেশ দাঁড় করালেন তা হল, বস্তু হচ্ছে ‘ধনংড়ষঁঃব রফবধ’ এর দ্বান্দ্বিক প্রকাশ। তিনি যেটা ধরে নিয়েছেন তা হচ্ছে আইডিয়া হল ‘অরিজিনাল আইডিয়া’। কিন্তু তার মধ্যে স্ববিরোধী দ্বন্দ্ব আছে, এবং সেই দ্বন্দ্বের ফলেই বাস্তব জগতের সৃষ্টি। তাঁর কথার মানে দাঁড়ায়, বাস্তব জগৎটা হচ্ছে একটা ছবি এবং সেই অর্থে সেটা হল ‘ধনংড়ষঁঃব রফবধ’ এর প্রকাশ। অর্থাৎ দুনিয়াতে যা কিছু ঘটছে তা সেই ধনংড়ষঁঃব রফবধ এরই বহিঃপ্রকাশ। এই কারণেহেগেলরই কিছু ছাত্র যাদের বলা হত বাম-ঘেঁষা (খবভঃ ঐবমবষরধহ), তাঁরা তাঁদের শিক্ষকের ‘অরিজিনাল আইডিয়া’ কে মানতে রাজী হল না। এর মাঝে ফুয়েরবার্খ, মার্কস অন্যতম। তাঁরা যেটা বললেন, ভাব থেকে বস্তু সৃষ্ট নয়, বরং ভাবই বস্তু থেকে সৃষ্ট। মন বা আত্মার কোন আলাদা অস্তিত্ব নেই। মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়ার ফলেই মন বা ভাবের সৃষ্টি। মানুষের মস্তিষ্কেই ঈশ্বরের অবস্থান। ঈশ্বরের আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই। তাঁরা বললেন হেগেলের দ্বান্দ্বিকপদ্ধতি সব ঠিকই আছে শুধু তাকে ভাববাদ থেকে মুক্ত করতে হবে। এভাবেই সৃষ্ট দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ।

দ্বন্দমূলক বস্তুবাদের মূল কথা হল সমস্ত বস্তুই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং দ্বন্দ্বও সমন্বয়ের মধ্যেই সম্পর্কযুক্ত এই দ্বন্দ্বআবার দুই প্রকারঃ অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহির্দ্বন্দ্ব। কোন বস্তু নিজের অভ্যন্তরে যে দ্বন্দ্বতা হল অন্তর্দ্বন্দ্ব আর একটি বস্তুর সাথে অন্য বস্তুর যে দ্বন্দ্বতা হল বহির্দ্বন্দ্ব। তবে মার্কস এর ভাষায় এই দুই দ্বন্দ্বের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্বই হল পরিবর্তনের ভিক্তি। বহির্দ্বন্দ্ব কোন কোন ক্ষেত্রে অন্তর্দ্বন্দ্বকে প্রভাবিত করতে পারে কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত অন্তর্দ্বন্দ্ব পরিপক্কতা লাভ না করে তত্ত্বক্ষন পর্যন্ত বহির্দ্বন্দ্ব কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। এটার উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যখন কোন সমাজ বা গোষ্ঠী নিজেরা বিপ্লব বা পরিবর্তনের জন্য তৈরি না হয় তখন বাহির হতে কেউ তাদের কোন সাহায্য করলে বিশেষ লাভ নেই।

মানব সভতার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে সমাজের অভ্যন্তরেও প্রতি নিয়ত বহুধরণের শক্তির দ্বন্দ্বচলছে। শ্রেণী, বর্ণ, লিংগ, ধর্ম, জাত, রাজনীতি, ব্যক্তিস্বার্থ এরকম আরো অনেক বিভাজনের মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ চলছে। দ্বন্দমূলক বস্তুবাদের তিনটি মূলনীতি। প্রথমটি হলঃ বিরোধী শক্তির ঐক্য (ঁহরঃু ড়ভ ড়ঢ়ঢ়ড়ংরঃবং)। একটি মানুষের মাঝে যেমন ভাল-খারাপ দুই গুণই বর্তমান, তেমনি সকল বস্তুতে এবং সমাজেও স্ববিরোধী শক্তির সহবস্থান আছে। ধনাত্মক ও ঋনাত্মক চার্জ, ইলেক্ট্রন ও প্রোটন, কিংবা সৌরজগতের আকর্ষণ ও বিকর্ষণ শক্তি এর উদাহরন।

এই পরস্পরবিরোধী শক্তির সাম্যবস্থার কারণেসব স্বাভাবিক ভাবে চলছে। যখন কোন একটি শক্তি অন্যটি অপেক্ষা বেশী শক্তিশালী হয়ে যায় তখন দ্বিতীয় নীতিটি আসে, তা হলঃ বিকাশের পথে অবলুপ্তি, অবলুপ্তির পথে বিকাশ (ঘবমধঃরড়হ ড়ভ ঃযব হবমধঃরড়হ)। এই নীতির অর্থ হচ্ছে নিছক সৃষ্টি বা ধ্বংস বলে কিছু নেই। সৃষ্টি মানেই হচ্ছে ধ্বংস আবার ধ্বংসের মাঝেই হচ্ছে নুতনের সৃষ্টি। মানব শরীরে যেমন শৈশবের ধ্বংসের মাঝে একজন মানুষ কৈশোরে পদার্পণ করে, আবার সে কৈশোরকে ধ্বংস করেই যৌবনে পদার্পন করে। মার্কসের মতে সমাজেও সে রকম এক সমাজ ধ্বংস হয়ে নুতন সমাজ গড়ে উঠে। সবশেষ তৃতীয় নীতিটি হলঃ পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন (ঋৎড়স য়ঁধহঃরঃধঃরাব পযধহমব ঃড় য়ঁধষরঃধঃরাব পযধহমব)। এই নীতির কথা হল যে সকল পরিবর্তনই গুণগত পরিবর্তন আনে না। যেমন পানিকে তাপ দিলে তা বাষ্প হয় না যতক্ষণ না তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হচ্ছে। তেমনি সমাজে হয়তো প্রতিনিয়ত অল্প অল্প পরিমাণগত পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু তা যখন বিশাল আকারে হয় তখনই একে গুণগত বা বৈপ্লবিক বা মৌলিক পরিবর্তন বলা হয়।


তিনঃ সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ
সমাজতন্ত্রের ধারণাও মার্কসই প্রথম বলেননি। ফরাসী বিপ্লবের (১৭৮৯-১৭৯৯) আগে দার্শনিক রুঁশো (১৭১২-১৭৭৮) রচনা করেছিলেন ‘সামাজিক চুক্তি (ংড়পরধষ পড়হঃৎধপঃ)’। যেখানে তিনি বলেন- মানুষ জন্ম নেয় মুক্ত হয়ে, কিন্তু জন্মের পর দেখে চারিদিকে শুধু বাঁধার শেঁকল। এ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বলেছেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা, যে আইন হবে সকল মানুষের নিজেদের তৈরী আইন- এক ধরণের সামাজিক চুক্তি। রুঁশো সমাজতন্ত্রের কথা সরাসরি না বললেও তাঁর লেখায় ছিল নিপীড়িত মানুষদের মুক্তির কথা। যে কারণে ফরাসী বিপ্লব যদিও রুঁশোর মৃতত্ত্ব্যর প্রায় দশ বছর পর সংঘঠিত হয়, তারপরও ফরাসী বিপ্লবে রুঁশোর দর্শনের অবদান ছিল বলে ধারণা করা হয়। বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির চিন্তা মনে হয় মার্কস পেয়েছেন এই ফরাসী বিপ্লব থেকেই।

সেইণ্ট সিমন (১৭৬০-১৮২৫) ছিলেন ফরাসী বিপ্লবের সন্তান। তাঁর মতে ভবিষ্যত সমাজে সকলকে অবশ্যই কাজ করতে হবে, এবং সমাজে প্রত্যেক ব্যক্তির স্থান নির্ধারিত হবে তার শ্রমের কৃতিত্ত্ব¡গুলো দিয়ে। তবে রাজনীতিক সংগ্রাম ও বিপ্লব সম্পর্কে তিনি নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। ফরাসী বিপ্লবে সর্বহারাদের শাসন কে আখ্যায়িত করেছেন ‘সন্ত্রাসের শাসন’ হিসেবে। তিঁনি চেয়েছিলেন সরকারি সংস্কারকর্ম আর এক নুতন ধর্মের চেতনায় সমাজের নৈতিক প্রশিক্ষণের ফলেই শ্রেণী-বিরোধের বিলুপ্তি ঘটবে, যা মার্কস এবং এঙ্গেলস এর মতে ইউটোপিয়।

পরবর্তীতে ফুঁরিয়ে (১৭৭২-১৮৩৭), তাঁর লেখায় বুর্জোায়া সমাজের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তবে তিনিও হিংসাশ্রয়ী বিপ্লবের ধারণার বিরোধিতা করতেন এবং মনে করতেন যে ভবিষ্যত সমাজতান্ত্রিক সমাজে উত্তরণ ঘটানো যেতে পারে শান্তিপূর্ণ প্রচারণের মধ্য দিয়ে-যেখানে লোকে কাজ করবে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে। তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন, যে কোন একটি সমাজের সাধারণ মুক্তির মাপকাঠি হল সে সমাজের নারী মুক্তির মান।

ইংলেন্ডে যখন শিল্প বিপ্লবের শুরু হয়, সে সময় ওয়েন (১৭৭১-১৮৫৮) একটি সুতাকলের সুপারেন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করতেন। তিনি মনে করতেন যে সামাজিক অসাম্যের প্রধান কারণ যথেষ্ট জ্ঞানালোকের অভাব যা শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের দ্বারা দূর করা যায়। তাই যেখানে অন্য কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করতো দৈনিক তেরো-চৌদ্দ ঘন্টা সেখানে তাঁর শ্রমিকরা কাজ করতো সাড়ে দশ ঘন্টা। তিনি শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য কিন্ডারগার্ডেন এর ব্যাবস্থা করেন। যখন কারখানা বন্ধ থাকে তখনো তাঁর শ্রমিকরা পুরো মজুরি পেয়েছে। এ সব সত্ত্বেও তাঁর কারখানার মুনাফা কম হয় না।

সেইণ্ট সিমন, ফুঁরিয়ে কিংবা ওয়েন এরা সবাই সামজিক অসাম্য দূর করতে চেয়েছেন সমাজকে সংস্কারের মাধ্যমে। শিল্প বিপ্লব ইংলেন্ডে সবে মাত্র শুরু হয়েছে, এমন সময় পুঁজিবাদী ব্যাবস্থার স্বরূপ তাঁদের পক্ষে ধরা অসম্ভব ছিল আর তাই তাঁদের সমাজ সংস্কারের ধারণা ইউটোপিয় হতে বাধ্য বলেই মার্ক্স ও এঙ্গেলস মনে করতেন। মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) এর সময়কালে আরো বেশ কয়েকজন সমাজতন্ত্রী ছিলেন। যাদের মধ্যে প্রুধুন (১৮০৯-১৮৬৫), বুকিনিন (১৮১৪-১৮৭৬), এবং ব্লাঙ্কুই (১৮০৫-১৮৮১) অন্যতম। প্রুধুন এবং বুকিনিন ছিলেন নৈরাজ্যবাদী সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিতা। তাঁরা মার্কস এর শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কতন্ত্রিক শাসনের বিরোধী ছিলেন। আর ব্লাঙ্কুই ছিলেন মুলত বিল্পবী চিন্তা ধারণার।

এখন পর্যন্ত যা দেখেছি তাতে দেখা যায় যে মার্কস এর সাম্যবাদ এর ধারণার পেছনে যে সমস্ত মানুষের অনুপ্রেরণা আছে তাঁরা হলঃ
১। দ্বান্দ্বিকপদ্ধতির দর্শনঃ জার্মান দার্শনিক হেগেল।
২। বস্তুবাদ দর্শনঃ আরেক জার্মান দার্শনিক ফুয়েরবাখ।
২। সমাজতন্ত্র অথবা সাম্যবাদ এর প্রাথমিক ধারণাঃ রুঁসো, সেইন্ট সিমন, ফুরিয়ে, ওয়েন।

এর বাহিরে আরো কয়েকজনের কথা উল্লেখ করতে হয়। মার্ক্স এর বস্তুবাদী হবার পেছনে ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২) এর বিখ্যাত ‘অন দা ওরিজিন অফ স্পিসিস’ এর অবদানও ছিল। মার্কস এর কাজকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। একটি মুলত দর্শন নিয়ে এবং আরেকটি হল অর্থনীতি নিয়ে। রাজনৈতিক অর্থনীতি (চড়ষরঃরপধষ ঊপড়হড়সু) এর উপর মার্কসের বেশ কয়েকটি লেখা আছে যেখানে তিনি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উপর আলোচনা করেছেন। রাজনৈতিক অর্থনীতির মুল ধারণা তিনি নিয়েছেন এডাম স্মিথ (১৭২৩-১৭৯০) এবং রিকার্ডো (১৭৭২-১৮২৩) থেকে। এর মাঝে স্মিথ কে বলা হয়ে থাকে আধুনিক অর্থনীতির জনক হিসেবে। স্মিথ তার লেখায় প্রথম পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মুনাফা এবং মুনাফার জন্য শোষণ এর ব্যাপারটি তুলে এনেছিলেন, যা পরপর্তীতে মার্কসকে অনুপ্রাণিত করেছে।

সর্বশেষ ব্যক্তিটি হল তাঁর বন্ধু এবং সহলেখক এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫)। মার্কস এর লেখায় একধরণের অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়। যা তাঁদের সম্মিলিত লেখায় নেই। তাঁর কারন এঙ্গেলস এর লেখার ধরণ অনেক গোঁছানো। তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনা অনেক পরিষ্কার। এঙ্গেলস অবশ্য নিজে স্বীকার করেন যে সাম্যবাদের মূল ধারণা মার্কসই, তথাপী এটাও অনস্বীকার্য যে শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির স্বপ্ন এঙ্গেলস নিজেও দেখতেন। মার্কস এর দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ এর মাধ্যমে এঙ্গেলস দেখলেন যে পুঁজি এবং শ্রেণীর দ্বন্দ্বটি প্রমাণ করা সম্ভব। যে কারণে সাম্যবাদের বা মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের উপর বিজ্ঞানের তঁকমা লাগানোর কাজটিও তিনিই করেছেন তাঁর ‘ইউটোপিয় ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ লেখায়।

চারঃ সাম্যবাদ
তাহলে ইউটোপিয় সমাজতন্ত্র আর কমিউনিজম বা সাম্যবাদের মাঝে পার্থক্য কি? মার্কস এর মতেই ইউটোপিয় সমাজতন্ত্রীরা চান সমাজের প্রত্যেক সদস্যের, এমনকি সবচেয়ে সুবিধাভোগীর অবস্থার উন্নতি করতে]। আর মাকর্সবাদীরা চান কেবল শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি, যা কিনা হবে বুর্জোয়া সমাজের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে [৭]। মার্কস মনে করতেন না যে সমাজের সকল সদস্যের মুক্তি সম্ভব, তাই এই ধরণের যে কোন চিন্তা ইউটোপিয় হতে বাধ্য। এটা পরিষ্কার যে মার্কস নিজেকে মানবতাবাদী বলে মনে করতেন না, বরং মানবতাবাদীদের তিনি আখ্যা দেন রক্ষণশীল বলে যারা আসলে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থাকেই রক্ষা করতে চায় মানবতার আড়ালে।

এবার দেখা যাক মার্ক্সবাদের মূল ধারণা কি এবং তা কিভাবে আসলো। মার্কস হেগেলের দ্বন্দমূলক পদ্ধতিকে বস্তুবাদের উপর দাঁড় করিয়ে দেখলেন যে আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলেরই ইতিহাস শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। ডারউইন তার বিবর্তনবাদে যেমন দেখালেন যে প্রকৃতিতে সব সময় বিবর্তন হচ্ছে এবং যোগ্যতমরাই টিকে থাকছে, সে রকম মার্কসও দেখলেন যে মানব সমাজে সর্বত্র অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম চলছে, এবং একটি সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে তার উপর আরেকটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। প্রাচীন রোমান যুগে ছিল দাসভিত্তিক সমাজ। পরে মধ্যযুগে সেটা ভেঙ্গে হয় সামন্তপ্রথা সমাজ। সামন্তপ্রথা হচ্ছে আমাদের উপমহাদেশের জমিদারী প্রথার মত একটি ব্যবস্থা। ইউরোপে মধ্যযুগে এই সামন্তপ্রথার সমাজই ছিল। আধুনিক যুগে সেই সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে হল বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থা যা মার্কস এর মতে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা। মার্কস এর মতে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে মধ্যবিত্ত শ্রেণী পুরোনো সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে তৈরী করে আজকের এই সমাজ, যার সুচনা হয় ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।

আধুনিক এই বুর্জোয়া সমাজের বৈশিষ্ট কি? ব্যক্তি স্বাধীনতা, অবাধ বাণিজ্য, ব্যক্তি মালিকানা, পুঁজিবাদ। এ সবই হল বৈশিষ্ট, কিন্তু বুর্জোয়া বা পুঁজিবাদী সমাজের মুল দ্বন্দ্ব কি?- তা হল পুঁজি এবং শ্রমের দ্বন্দ্ব। এখন দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির নিয়ম অনুসারে এই পুঁজি এবং শ্রম তারা বিরোধাত্বক, অর্থাৎ তারা একত্রে অবস্থান করতে পারে না। তারা একে অপরকে উচ্ছেদ করতে চায়। পুঁজির কাজ হল শ্রমকে শোষণ করে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা। শ্রমিক শ্রেণী যতদিন পর্যন্ত না পুঁজিকে উচ্ছেদের মত শক্তি অর্জন করছে, তত্ত্বদিন তারা সহবস্থান করবে। যখনি সেই শক্তি অর্জন করবে তখন পুঁজির পতন অনিবার্য। এই হল স্বল্প কথায় মার্কস এর মুল তত্ত্ব।

এখন মার্কস এই তত্ত্ব¡ কিভাবে পেলেন? মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) এর সময়টা এমনই যে তখন ইউরোপের চারিদিকে শিল্পের ব্যাপক প্রসার। স্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কারের ফলে সর্বত্রই কলকারখানা গড়ে উঠেছে। এই সব কারখানায় কাজ করে প্রচুর শ্রমিক। ১৮২৫ সালে ইংলেন্ডে প্রথম একটি অর্থনৈতিক মন্দা আসে, যার কারণে প্রচুর শ্রমিক চাকুরী হারায়। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা তখন অঙ্কুরে বিধায় মন্দা প্রায় দশ বছর পর পর দেখা দিত, আজ যেটা অনেক বছর পর দেখা দেয়। ১৮২৫ সাল থেকে ১৮৪৮ পর্যন্ত এরকম মন্দা আসে পাঁচবার এবং ১৮৭৭ সালে আসে ষষ্ঠবার। বলাই বাহুল্য যে মার্কস এই সব মন্দা এবং এর ফলাফল খুব কাছ থেকেই পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং একই কথা প্রযোজ্য এঙ্গেলস এর জন্য। এ কথা অনস্বীকার্য যে মার্কস পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকে বেশ ভাল ভাবে ধরেছিলেন। কিভাবে এই মন্দা আসে এবং এই মন্দার চিত্র তিনি বেশ ভাল ভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন। একের পর এক কারখানা গড়ে উঠার ফলে, উৎপাদন হয়ে যায় প্রচুর। এক পর্যায়ে অতিপ্রাচুর্য্যরে ফলে অনেক উৎপন্ন পণ্য অবিক্রিত থেকে যায়, কারখানা লোকসান দেয়। কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, শ্রমিকেরা চাকুরী হারায়। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আরো কমে যায়, পণ্য বিক্রি আরো কমে যায়। এভাবেই চলতে থাকে যা ঠিক হতে কয়েক বছর লেগে যায়- ঠিক যেন আমাদের এখনকার (২০০৯ সালের) মন্দারই চিত্র।

এরকম একটি চিত্র থেকে মার্কস তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির প্রয়োগে স্বিদ্ধান্তে আসলেন যে, বুর্জোয়া সমাজ ব্যাবস্থা যেমন সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে উৎপত্তি, তেমনি বুর্জোয়া সমাজ ভেঙ্গে তৈরি হবে নুতন একটি সমাজ ব্যাবস্থা। এটি দ্বান্দ্বিকবস্তুবাদের দ্বিতীয় সুত্র ‘বিকাশের পথে অবলুপ্তি (ঘবমধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ঘবমধঃরড়হ)’ থেকে পাই। সেই নুতন সমাজ হবে প্রলেতারিয়েত বা শ্রমিক শ্রেণীর সমাজ। তিনি ভাবলেন যেভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংকট দেখা দিচ্ছে, অচিরেই শ্রমিক শ্রেণী হবে সংখ্যায় গরিষ্ঠ। আর সেই শ্রেণী একদিন এই বুর্জোয়া সমাজ ভেঙ্গে তৈরী করবে কমিউনিষ্ট সমাজ। কমিউনিষ্ট পার্টির কাজ হচ্ছে সেই শ্রমিক শ্রেণীকে সংঘবদ্ধ করা, তাদেরকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে সাহায্য করা।

এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল। মার্কসবাদ এর সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক কিভাবে আসলো। বিজ্ঞান যেভাবে তত্ত্ব¡ প্রদান করে যা সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য, সে রকম মার্ক্সও সমাজের ক্ষেত্রে তার তত্ত্ব¡টি দিয়েছিলেন। মার্কস যেমন বলেন নি যে শ্রমিক শ্রেণীর সংঘবদ্ধ হওয়া উচিৎ বা তাদের ক্ষমতায় যাওয়া উচিৎ তাদের মুক্তির জন্য। তিনি বলেছেন শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি আর বুর্জোয়া সমাজের ধ্বংস দুইই অনিবার্য। অর্থাৎ এটি বস্তুবাদের ইতিহাসের নিয়মে বা দ্বান্দ্বিকবস্তুবাদের সুত্র অনুসারে হবেই, এক ধরণের প্রেডিকশন (ভবিষ্যতবাণী)। বলাই বাহুল্য সে রকম কিছু হয়নি আজো। বরং আধুনিক সমাজ এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বেশ ভাল ভাবেই আছে এবং থাকবে।

তাহলে মার্কস এর তত্ত্বের ভুল কোথায়? কোথায় মার্কস ভুল বুঝেছেন? আমি বলবো প্রতিটি দার্শনিক বা গবেষক যেমন তাঁর সময়কাল দ্বারা আবর্তিত, তেমনি মার্কস পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বা আধুনিক অর্থনীতি ব্যবস্থাকে পুরোপুরি দেখতে পারেননি। পুঁজিব্যবস্থা তখন সবে মাত্র যাত্রা শুরু করেছে আমি বলবো। এটা অনস্বীকার্য যে মার্কস এর পর প্রায় দেড়শত বছর পার হয়ে গেলেও বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অনেক ভুল আছে, যার কারণে এখনও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। কিন্তু সেটা কেটে যায়, তা থেকে মানুষ নুতন কিছু শিখে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আরো সুসংহত হয়।

আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা খুবই জটিল একটি ব্যাপার। একক ভাবে মানুষ নিজে একটি জটিল প্রাণী। তার মাস্তিষ্কের ব্যবহার অন্য যে কোন প্রাণী থেকে অনেক বেশী বিধায় তাকে সঠিক ভাবে মূল্যায়ন সম্ভব নয়। এমন কোন তত্ত্ব¡ নেই যা দিয়ে বলা সম্ভব মানুষ একটি অবস্থায় কিভাবে নিজেকে বদলে নিবে বা কাজ করবে। অতীত ইতিহাস দেখে আমরা একটি ধারণা করতে পারি, কিন্তু সেটা ঘটবেই বলতে পারি না। আর এই মানুষ যখন গোষ্ঠিবদ্ধ ভাবে চলে, যখন একটি সমাজ গঠন করে, সেই সমাজে উক্ত মানুষগুলো কিভাবে চলবে সেটা কোন তত্ত্ব¡ দিয়ে প্রকাশ করা আরো অসম্ভব। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর সমাজ ব্যবস্থা দুইই সরাসরি ব্যক্তি ও গোষ্ঠিবদ্ধ মানুষের কাজের সাথে জড়িত। এই দুই ব্যবস্থা এতই নন-লিনিয়র (ঘড়হ-ষরহবধৎ) এবং নন-ডিটারমিনিষ্টিক (ঘড়হ-উবঃবৎসরহরংঃরপ) যে সমাজ বিজ্ঞানে বা অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে সে রকম কোন নির্দিষ্ট তত্ত্ব¡ নেই। যা আছে তা কোন নির্দিষ্ট পারিপার্শ্বিকতার ক্ষেত্রে কিছু ইম্পিরিকাল (বসঢ়রৎরপধষ) সুত্র।

একটি নন-লিনিয়র চিত্রের উদাহরণ যদি দেই তাহলে আরো পরিষ্কার হবে। সবচেয়ে ভাল উদাহরণ হচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিচলণ প্রক্রিয়া। আমাদের জলবায়ুর মডেল আছে, তাত্ত্বিক সুত্র আছে- তথাপি এই প্রক্রিয়া নিজেই এত নন-লিনিয়র যে সে প্রক্রিয়াটিকে সঠিকভাবে প্রেডিক্ট করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমরা সর্বোচ্চ পাঁচদিন পর্যন্ত প্রেডিকশন করতে পারি, তারপরেও বলা হয়ে থাকে ৩০% বা ৬০% বৃষ্টি হবার সম্ভবাবনার কথা। কোন ভাবে হয়তো এই মুহুর্তের কথা বলতে পারবো, যদি পর্যাপ্ত তথ্য থাকে, বা পরবর্তী এক ঘন্টার কথা বলতে পারবো কিন্তু এক মাস পর কি হবে তা বলা অবাস্তব বা ইউটোপিয়। যে কারণে আজকের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরাও নিশ্চিত করে বলতে পারেন না ঠিক কোন পদ্ধতিতে বা কবে বর্তমান মন্দা দূর হবে।

নন-লিনিয়র প্রক্রিয়ার এর আরেকটি মজার দিক রয়েছে, যা তার প্রেডিকশনকে আরো কঠিন করে তুলে। তা হল এক কথায় ‘বাটারফ্লাই এফেক্ট’। বলা হয়ে থাকে আজ যদি বাংলাদেশে কোন একটি প্রজাপতি তার পাখা নাঁড়ায় আর সেই সঞ্চালণ, নন-লিনিয়র এফেক্ট এর কারণে বাড়তে বাড়তে নিউইয়র্কে বৃষ্টি ঘটাতে পারে। যেমন ঘটতে পারে- কোন এক পথচারীর আকষ্মিক মৃত্যু, যা রূপ নিতে পারে বিশাল ভাংচুড়ে। সেখানে কিছু হলে সেটা আরো বড় আকার হয়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিতে পারে।

এরকম একটি জটিল সামাজিক এবং অর্থলনতিক ব্যবস্থাকে অঙ্কুরে দেখে যে তত্ত্ব¡ই দেওয়া হোক না কেন তা কাজ না করাটাই স্বাভাবিক, বরং যদি কাজ করে আমি বলবো সেটাই কাকতলীয়। তা হলে মার্কস এর দর্শনের সব কিছু কি ভুল? না তা নয়।

পাঁচঃ গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র:
মার্ক্স এর কমিউনিষ্ট পার্টির ইস্তেহারের প্রথম কথা দিয়েই শুরু করছি। তিনি বলছেন যে আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলেরই ইতিহাস শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। কথাটি আংশিক সত্য। এ কথা ঠিক যে প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে আমরা বেঁচে থাঁকার জন্য সংগ্রাম করি। সেই সংগ্রাম হয় প্রকৃতির সাথে আমাদের, প্রকৃতির অন্য প্রানীদের সাথে আমাদের এবং আমাদের নিজেদের সাথে নিজেদের। যখনই উৎপাদন এর তুলনায় চাহিদা বেশি থাকবে তখনই দ্বন্দ্ব থাকবে। আজ পর্যন্ত যত সংগ্রাম হচ্ছে তা হচ্ছে সেই চাহিদা আর উৎপাদনের মাঝে ব্যবধান এর জন্য। সেই সংগ্রাম ভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে হতে পারে আবার নিজস্ব শ্রেণীর মাঝেও হতে পারে। পৃথিবীতে যদি কোন সাদা-কালো না থেকে শুধু সাদারাই থাকতো তবে কি রক্ত ঝরতো না? যদি কোন বুর্জোয়া শ্রেণী না থেকে শুধু শ্রমিক শ্রেণী হয় তবে কি কোন দ্বন্দ্ব থাকবে না? বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম চলবে যতদিন পৃথিবীতে সম্পদের উৎপাদন তার চাহিদার তুলনায় কম থাকবে। যদি সমাধান খুঁজতেই হয় তবে চাহিদা আর উৎপাদন এর ব্যাবধান কমাতে হবে। তা জনসংখ্যা সীমিত করে বা উৎপাদন এর পরিমাণ বাড়িয়ে।

তবে হ্যাঁ একটি সুষ্ঠ সামাজিক ব্যবস্থা দরকার যা চাহিদা আর উৎপাদন এর ব্যবধানকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করবে। মার্কস তাঁর দর্শনে যেটা বলার চেষ্টা করেছেন তা হল বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আমরা সেটা করছি না। যার কারণে অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছেকৃত ভাবে চাহিদার পরিমাণকে বাড়িয়ে রাখা হয় শুধু মাত্র পণ্যের মান ধরে রাখার জন্য। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নিয়ম বানানো হয় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা, সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর তাঁদের সুবিধার্তে। জনগণের করের টাকায় সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা নিম্ন বিত্তের জন্য করা হয় কম। রাষ্ট্র মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিৎ করে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র হয়ে উঠে শোষনের যন্ত্র। এ ধরণের সমাজ ব্যবস্থায় ধনী-গরিবের ব্যবধান শুধু বৃদ্ধি পায়। মার্ক্স এটাকেই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার ফল (ঙঁঃঢ়ঁঃ) হিসেবে বলেছেন। এটা মানুষের মানসিকতার সমস্যা, নৈতিকতার দৈন্যতার প্রকাশ। এবং এই সমস্যা যে কোন সাম্যবাদী দলের শাসনের ক্ষেত্রেও হতে পারে যদি মানসিকতার পরিবর্তন না ঘটায়। যেমনটি আমরা দেখতে পাই বর্তমান কমিউনিষ্ট শাসিত দেশ গুলোর ক্ষেত্রেও।

মার্কস সমাজ ব্যবস্থার এই ত্রুটিকে ভালভাবে চিহ্নিত করেছেন এবং খুব ভাল ভাবে বুঝেছেন যে শুধু শাসক গোষ্ঠির পরিবর্তন বা শাসন ক্ষমতা থেকে বুর্জোয়াদের দূর করালেই সমাজে পরিবর্তন হবে না, করতে হবে বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন। যে কথাটি আমার মতে আজো প্রযোজ্য। শুধু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েতের সজ্ঞাটিকে একটু বদলাতে হবে। শিল্প বিপ্লবের সময়কালে মার্ক্স দেখেছিলেন শুধু দু’টি শ্রেণী- বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েত। সেই সময়কার সমাজ ব্যবস্থায় এই দু’টি শ্রেণীই প্রধান ছিল। মার্ক্স এর ভাষায় নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীরাও স্বল্প পুঁজির কারণে এক সময় প্রলেতারিয়েত শ্রেণীতে পরিণত হবে এবং পুঁজি আরে শ্রমের দ্বন্দ্বে প্রলেতারিয়েতের সংখা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আজ যদি আমরা দেখি তাহলে দেখবো সমাজে এখন স্পষ্টতই তিনটি শ্রেণী। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত। মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে আমরা আরো কিছুটা ভাগ করতে পারি, উচ্চ-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত হিসেবে। আজকের সমাজে যদি বুর্জোয়া বলতে হয় তবে আমি বলবো উচ্চবিত্ত আর উচ্চ-মধ্যবিত্তদের। আর যদি প্রলেতারিয়েত বলতে হয় তবে বলবো নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর নিম্ন বিত্তদের। আজকের যুগের বিশাল এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অবস্থান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার অঙ্কুরকালে তেমন প্রকট ছিল না, এবং এই শ্রেণীটি মার্কস এর দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি শুধু বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে ধরে নিয়ে এগিয়েছেন এবং আমার মতে মার্ক্স এর প্রধান ভুলটি এখানেই। আজ যদি কেউ এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বুর্জোয়া শ্রেণীর মাঝে ফেলে চিন্তা করে তবে তিনি আরো বড় ভুল করবেন। কারণ আজ এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীই সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রেণী।

তাই শ্রমিক শ্রেণী যে শুধু তৈরী শাসন ব্যবস্থাটিকে পেলেই যে সমাজের পরিবর্তন হবে না সেটা তিনি বুঝতে পেরেছেন প্যারিস কমিউনে (১৮৭১) কমিনিউষ্টদের দুই মাসের শাসন কালে। ১৮৭২ সালের ইস্তেহারের মুখপত্রেই যা তিনি স্বীকার করেছেন। মার্কস তরুণ বয়সে বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে তিনি সে পথ থেকে সরে এসেছিলেন, যার নমূণা পাই ১৮৭২ সালে আমর্স্টাডাম এ দেওয়া একটি সাক্ষাতকারে, যেটা আমি পাই কার্ল কাউটস্কি এর ‘সোস্যাল ডেমোক্রেসি ভার্সাস কমিউনিজম’ লেখায়। যেখানে তিনি বলেছেন- “ শ্রমিকদের অবশ্যই কোন একদিন রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করতে হবে, নুতন সামাজিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্যে। তাদের অবশ্যই পুরাতন রাজনৈতিক যন্ত্রটিকে উতখাত করতে হবে যা কিনা ক্রিষ্টিয়ানদেরর জীর্ণ কাঠামোর উপর গঠিত। কিন্তু এই অর্জনের পন্থা সর্বত্র একই রকমের হতে পারে না। আমাদের অবশ্যই বিভিন্ন দেশের বর্তমান কাঠামো, সংস্কৃতি, রীতিনীতি এই সমস্ত বিষয়কে চিন্তায় রাখতে হবে। আমরা এটা অস্বীকার করতে পারিনা যে-কিছু দেশ যেমন, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কিংবা হলান্ড- সেখানে শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণ ভাবে তাদের লক্ষে পৌছতে পারে যা অন্য সব দেশে সম্ভবপর নয়।” এখানে তিনি স্পষ্টতই সে সব দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শ্রমিক শ্রেণীর লক্ষ্যে পৌছার কথা বুঝিয়েছেন।


উপসংহার:
মার্কস শ্রমিক শ্রেণীর শাসনের মাঝ দিয়ে সমগ্র সমাজের মুক্তির পথ দেখেছেন। তাতে যদি বুর্জোয়া সমাজ ধ্বংস হয়, মানুষের মনে সহিংসতা আসে তাতে তিনি বিচলিত নন। যে কারণে মার্কস এর এই পন্থা অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ। যারা মানবতাবাদী, সমগ্র মানব জাতির মুক্তি চায়-নির্দিষ্ট কোন শ্রেণীর মুক্তি চায় না- তাদের পক্ষে জেনে শুনে মার্কসবাদ অনুসরণ করা সম্ভব নয়।

সমাজতন্ত্র মানেই যে ব্যক্তিমালিকানার উচ্ছেদ, বা সকল কিছু রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত হতে হবে তা নয়। আজ অনেক দেশে মিশ্র অর্থনীতি বিরাজমান। রাষ্ট্রীয় তদাকরীতে বেসরকারীভাবে সব কিছু চলছে। কিন্তু রাষ্ট্র মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করছে। আমেরিকার কথা বিস্তারিত বলতে পারবো না, কিন্ত কানাডায় পাঁচ বছর ধরে আছি দেখছি- এখানে বিনামূল্যে সর্বোচ্চ চিকিৎসা পাবেন, বাচ্চাদের পড়াশুনা পাবেন। আঁয় ভাল না হলে স্বল্প ভাড়ায় সরকারী বাসা পাবেন, বেকার ভাতা পাবেন। কোন কিছু জানতে চাইলে সমস্ত তথ্য ইন্টারনেট এ দেওয়া আছে, ফোন লাইন দেওয়া আছে, জানতে পারবেন। এরা সমাজতান্ত্রিক দেশ না হয়েও মানুষের মৌলিক অধিকার গুলো বাস্তাবায়নের চেষ্টা করছে। উন্নত দেশেও যে সমস্যা নেই তা নয়। ধনী-গরিবের ব্যবধান নেই, বেকারত্ব নেই, অপরাধ নেই তা নয়। যেখানেই সমাজ আছে তা থাকবেই এবং সে গুলো দূর করার চেষ্টাই হল আদর্শ রষ্ট্রের কাজ।




তথ্যসূত্র:
১। কার্ল মার্কস-এর ইতিহাস দর্শন পর্যালোচনা- হায়াৎ মামুদ
২। মার্কসীয় মডেলে মানুষের ব্যাক্তি অস্তিত্ব নেই: শুধু সামাজিক অস্তিত্ব আছে- ইমানুল হক
৩। উৎপাদন ব্যাবস্থার সাথে সম্পকেই কে বুর্জোয়া, কে মালিক আর কে প্রলেতারিয়েত নির্ণয় করা হয়
৪। উৎপাদন ব্যাবস্থার পরিবর্তনই সমাজের দ্বন্দগুলির বিবর্তনের চালিকা শক্তি
৫। উৎপাদনে ব্যাবস্থার পরিবর্তন ও সমাজের দন্দ্বের বিবর্তন-
৬। দ্বান্দিক বস্তুবাদের সাথে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের পার্থক্য-
৭। মার্কসের জীবনী- উইকিপিডিয়া
৮। দৈনিক প্রথম আলো- ২০/০৫/২০১৪ ইং
৯। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন- ১২/০৩/২০১৪ ইং
১০। বিজ্ঞান চেতনা কর্তৃক প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা- মার্চ, ২০১৫ ইং






মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.