নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিখতে জানতে ও ছড়িয়ে যেতে চাই।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী

আমি বাপ্পী। জন্মস্থান বরিশাল। বেড়ে উঠা চট্টগ্রাম।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পের নামঃ মিজান মাঝির ঘাট।

২০ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১:১৮

"মিজান মাঝির ঘাট"
মোঃ জোবায়ের বাপ্পী

চিঠির খামে প্রেরকের নাম-ঠিকানা দেখে নূরী নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছে। ঠিকানা - রূপনগর। প্রেরক আশরাফ আলী। নূরী চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী একজন এনজিও কর্মকর্তা। স্বামী রিটায়েড ব্যাংক অফিসার। স্বামী সন্তান নিয়ে বেশ ভালোই আছে সে। চিঠিটা তার শৈশবের স্কুলের আশরাফ মাস্টারের। আজ প্রায় ত্রিশ বছর পর চিঠিতে নামটা দেখে নূরীর চোখ দুটো আবেগে ভরাক্রান্ত হয়ে উঠলো। স্কুলের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে পুনর্মিলন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। আসার জন্য আকুল আবেদন করা হয়েছে। পড়ার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নূরী চিঠিটা বেগে রেখে দুই পুরানো বন্ধুদের ফোন দিল। সময়ের স্রোতে শৈশবের সবাই হারিয়ে গেলেও কর্মক্ষেত্রে এসে দুজনকে পেয়েছে নূরী। আসাদ ও লামিয়া। তাদের সাথেই আলাপ করলো। তারাও চিঠি পেয়েছে। যাওয়ার জন্য তারাও প্রস্তুত। দিন তারিখ ঠিক করলো। রূপনগর যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম নদীপথ।
নির্ধারিত দিনে লঞ্চ থেকে নেমে রূপনগরের মাটিতে পা রাখলো নূরী, লামিয়া, আজম, জয়নাল ও আসাদ। সবাই স্কুলের প্রাক্তন। নূরীই তাদেরকে একত্রিত করেছে।
- সবকিছু বদলে গেছে তাই না নূরী?
- হ্যাঁ লামিয়া। নেই সেই মেঠোপথ, নেই সেই শীতলতা, নেই সেই মনোমুগ্ধকর হিমেল বাতাসও। গ্রাম তার ধর্ম বদলে শহরের ধর্মকে আপন করে নিয়েছে।
- যান্ত্রিক শহরে থেকেও সাহিত্য? বাহ বাহ!
- অনেক সময় পরিবেশ মনকে চাঞ্চল্য করে তোলে।
রূপনগরে বাকিরা মাঝেমধ্যে আসা যাওয়া করলেও শৈশবের পর আজই প্রথম পা রাখলো নূরী। তাই রূপনগরের এই বিশাল পরিবর্তন নূরীর চোখে পড়লো। আসাদ সবাইকে নিয়ে একটা টমটমে (গ্রাম্য যানবাহন) উঠে পড়লো।

টমটম করে তারা মিজান মাঝির ঘাটে এলো। নদী পার করে ওপারে যেতে হবে। সবাই ট্রলারে উঠতে লাগল তখন নূরী ডাক দিয়ে বলল,
- সময় যেহেতু আছে নৌকায় ভ্রমণ করলে কেমন হয়?
সবাই আনন্দের সাথে সম্মতি দিল। ষাটোর্ধ্ব এক বুড়ো মাঝি বৈঠা নিয়ে নৌকায় বসে আছে। জয়নাল তার কাছে যেয়ে বলল,
- চাচা ওপার যাবেন?
চাচা বেশ আনন্দের সাথে রাজি হয়ে গেল।

চাচা নৌকা বেয়ে যাচ্ছে। সবার চোখে আনন্দ ভাসছে। কিন্তু নূরীর চোখ ছলছল করছে। বেশ কিছুক্ষণ পর লামিয়া চাচাকে জিজ্ঞেস করল,
- আচ্ছা চাচা এটাকে মিজান মাঝির ঘাট বলা হয় কেন?
- একাত্তরে এখানে মিজান নামের এক মাঝি ছিল। তার সাহসিকতার জন্য এখানের নাম দেয়া হয়েছে মিজান মাঝির ঘাট।
- কি সেই সাহসিকতা?
- শুনেছিলাম তিনি নাকি হানাদারদের এই নদীতে ডুবিয়ে মেরেছিলেন।
- ওয়াও! গ্রেট।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর সবার উদ্দেশ্যে নূরী বলল,
- একটা গল্প শুনবে সবাই?
সবাই একটু অবাক হল। কিন্তু সাঁই দিয়ে লামিয়া বলল,
- হ্যাঁ বল। এতে সময়টা ভালোই কাটবে।

নূরী বলতে শুরু করলো,
"সময়টা একাত্তরের। এক নদীর পাড়ে এক মাঝি তার গর্ভবতী স্ত্রী নিয়ে বসবাস করে। নদীই ছিল তার জীবিকার মাধ্যম। যুদ্ধের কারণে আতংক ছিল চারদিকে। গ্রামগঞ্জে তখন যুবক ছিল না বললেই চলে। পালিয়ে গেছে নয়তো মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এরমধ্যেই জীবন অতিবাহিত করছে লাখো বাঙ্গালী। তাদেরই একজন এই মাঝি। নৌকা দিয়ে নদী পথ পারাপার করিয়ে মাঝি তার গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালাচ্ছে। এক দুপুরে তপ্তরোদে নৌকায় বসে যাত্রীর আশায় তাকিয়ে আছে মাঝি। হঠাৎ তার প্রতিবেশীর এক বাচ্চা এসে তাকে বলল, "মা আপনাকে এক্ষুণি ডাকছে।" মাঝি সাথেসাথে দৌঁড়ে চলে এলো।
ঘরের ভেতর প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছে তার স্ত্রী। আর বাইরে চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে মাঝি। খানিকক্ষণ বাদে দাইমা এসে জানালো মেয়ে হয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি আদায় করে আলহামদুলিল্লাহ বলল মাঝি। এক নতুন অতিথির দায়িত্ব এসে মাঝির কাঁধে পড়ল। মাঝি তার নৌকা ও বৈঠা নিয়ে নদীর বুক বেয়ে সেই দায়িত্ব পালন করে যেতে লাগল। আগে শরীর একটু খারাপ লাগলে মাঝি ঘরে চলে আসতো। কিন্তু এখন আর আসে না। তার কাঁধে যে এখন দায়িত্ব বেশি। মাঝির সাদামাটা জীবনে রঙ্গিন হাওয়া লাগল এক রৌদ্র উজ্জ্বল দুপুরে। সবসময়ের মত বিশ্রাম নিতে ছাউনিতে শুয়ে আছে মাঝি। এই কড়া দুপুরবেলা যাত্রী থাকে না বললেই চলে। তবুও আশায় থাকা তার নিত্যদিনের অভ্যাস। হঠাৎ একজনের গলার স্বরে মাঝির তন্দ্রা ভাংলো।
- চাচা, ও চাচা। ওপারে যাবেন?
মাঝি উঠে পড়লো। প্রায় পনেরো জন লোক। সবারই চাদর দিয়ে নাক মুখ ঢাকা। সাথে দুটা বক্স আছে। মাঝি বেশ সন্দেহ নিয়ে তাদের দিকে তাকালো। হ্যাঁ এরাই মুক্তিবাহিনী। মাঝির চোখমুখ আতংকে ভরে উঠলো। অনেকদিন ধরেই এদের নাম শুনছে। তাদের গ্রামের জমিদার নদী পার হওয়ার সময় প্রায়ই বলে, "এই মুক্তিবাহিনী কুত্তাদের একদিন জ্যান্ত পুতে মারবো। কতবড় সাহস স্যারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলছে। হারামীর দল সবকটা।" জমিদার গ্রামের সবাইকে হুশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন যাতে কেউ মুক্তিবাহিনীর সাহায্য না করে। যদি কেউ করে তবে জ্যান্ত মেরে ফেলবে। মাঝির চোখে ভয় দেখে সেই যুবকটি বলল,
- আমরা মুক্তিবাহিনী। ভয় নেই চাচা। কেউ জানবে না। আমাদের ওপারে যাওয়া খুব জরুরী।"

"মাঝি সবাইকে ছাউনিতে লুকিয়ে থাকতে বলল। যাতে কেউ না দেখে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে নৌকা বাওয়ার পর মাঝি বলল,
- ওপারে কেন যাচ্ছো?
তারা সবাই একে অপরের দিকে তাকালো। তারপর সেই যুবকটি বলল,
- কিছুদিন আগে ওপারের গ্রামে হানাদাররা হামলা করেছিল, শুনেছিলেন?
সেই হামলার ঘটনা শুধু মাঝি কেন এপারের সবাই শুনেছিল। রাতের আঁধারে হানাদারদের বর্বরতার আর্তচিৎকারে ভরে উঠেছিল ওপার। আগুনের আলো যেন এপারকেও আলোকিত করে তুলেছিল। সকাল হলেও যেন ওপারের আকাশ আগুনের ধোঁয়ায় অন্ধকারই ছিল। মাঝি হ্যাঁ বলল। সেই যুবক বলল,
- আমরা সেই অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছি।
বেশ গর্ব ও সাহস নিয়েই কথাটা বলেছে যুবক। যুবকের চোখ দুটো যেন জ্বলছে। মাঝি নীরবতার সাথে নৌকা বাইতে লাগল। ওপারে আসার পর মাঝি বলল,
- সময় বলে দাও। আমি তোমাদের নিতে আসবো।
- ফিরতে আসি নাই, চাচা। হয়তো মরে এই মাটির বুকে মিশে যাব। নয়তো শত্রু মুক্ত করে এগিয়ে যাব।
মাঝির চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। অল্প বয়সী যুবক। কিন্তু বুকটা সাহসে ভরপুর। এদের চোখে মৃত্যুর নেশা। মারবে নয়তো মরবে। মাঝি বলল,
- ভয় করে না তোমাদের?
- একদিন এই দেশের ভালবাসা অনুভব করে দেখিয়েন। তখন আর ভয় করবে না। বরং সাহস বেড়ে যাবে। দোয়া করবেন যেন সফল হয়ে মরতে পারি।"

"মাঝি রাতে বাসায় এসে নিত্যদিনের মত সবকিছুই তার স্ত্রীকে বলল। সব শুনে তার স্ত্রী বলল,
- খবরদার এসব আর কাউকে বলবে না। জমিদার শুনতে পারলে আমাদের খবর আছে।
হঠাৎই ভারি গোলাবর্ষণের শব্দ পেতে লাগল। মৃদুস্বরে ভেসে আসছে, "জওওওয় বাংলা।" ওপারে গোলাগুলি হচ্ছে। মাঝি বুঝল যে মুক্তিবাহিনী প্রতিশোধের জন্য পা বাড়িয়েছে। মাঝি তার স্ত্রীকে বলল, "শুরু হয়েছে যুদ্ধ।" ভয়ে তার স্ত্রী তাকে আকড়ে ধরলো। মাঝির মনও আনচান করছে। কি হচ্ছে ওখানে? মুক্তিবাহিনী কি পারছে হানাদারদের সাথে? একটা সময় গোলাবর্ষণ শেষ হল। এবার উচ্চস্বরে শোনা যাচ্ছে, "জওওওয় বাংলা। জওওওয় বাংলা।" মাঝি বুঝলো যে তারা প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হয়েছে। প্রশান্তি নিয়ে মাঝি ঘুমিয়ে পড়লো। অনেকদিন পর যেন একটা শান্তির ঘুম দিল। কিন্তু ………" নূরীর গলার স্বর ভারি হয়ে উঠলো। নূরীর কাঁধে হাত রেখে লামিয়া পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, "আগে পানি খেয়ে নে।" পানি খেয়ে নূরী আবার বলতে শুরু করল।"

"এক রাত, না শুধু রাত নয় একে বাংলার ঐতিহাসিক রাত বলা যায়। মাঝি তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ দরজায় কড়া পড়লো। জমিদারের চামচার কণ্ঠ ভেসে আসতে লাগল। "মাঝি, ঐ মাঝি।"
মাঝি ও তার স্ত্রী উঠে পড়লো। মাঝি কুপি জ্বালিয়ে তার স্ত্রীকে বলল, "কোনো শব্দ করবে না।" মাঝি দরজা খুলে কুপি নিয়ে বের হয়ে দেখল হানাদার বাহিনী নিয়ে জমিদার ও তার চামচা এসেছে। মাঝি ভয়ে আঁতকে উঠলো। মাঝি ভাবলো মুক্তিবাহিনীকে সাহায্যের ব্যাপারটা এরা জেনে গেছে। ভয়ে মাঝির গলা শুকিয়ে গেল। মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে শুধু। জমিদার কিছুটা শাসিয়ে বলল, "কিরে বেটা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি বৈঠা নিয়ে আয়। স্যারেরা ওপার যাবে।" "আচ্ছা হুজুর" বলে মাঝি ভেতরে চলে এল। "আজ মুক্তিবাহিনীর শেষ দিন। কুত্তার বাচ্চাগুলোর বুক গুলি দিয়ে ঝাজরা করে দিয়েন স্যার। কতবড় দুঃসাহস আপনাদের ক্যাম্প দখল করছে।" কথাগুলো জমিদার বলছে। মাঝি সবই শুনেছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। হানাদারদের সাহায্য করবে? মাঝির চোখের সামনে সেই তরুণদের ছবি ভেসে উঠলো। মাঝি মনে মনে এক কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। তারপর স্ত্রীর কাছে এসে চুপিসারে বলল, "ওগো বিদায় দাও। দেশের ভবিষ্যৎ বাঁচাতে যাচ্ছি। আর হয়তো দেখা হবে না।" স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে মাঝির স্ত্রী আতকে উঠলো। ভয়ার্ত স্বরে বলল, "ওগো এসব কি বল? আমার কি হবে? এই বাচ্চা মেয়েটার কি হবে?" একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাঝি বলল, "তোমাদেরকে আল্লাহর কাছে রেখে গেলাম।" মাঝি তার শিশু মেয়েটাকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু দিল। তারপর স্ত্রীর কপালে চুমু দিল। বাইর থেকে জমিদারের দালাল তাড়া দিয়ে বলল, "কিরে বেটা, তাড়াতাড়ি আয়।"

"নৌকা বেয়ে চলছে মাঝি। নৌকায় আছে কিছু পাক সেনা, জমিদার ও তার দালাল। এই নদীপথ মাঝির মুখস্ত। তাইতো এত রাতে জমিদার তাকেই নিয়ে এসেছে। মাঝি শুধু নৌকা ঘুরাচ্ছে। কিছুক্ষণ এদিকে তো কিছুক্ষণ ওদিকে। ওপারে তো নেয়াই যাবে না। কিন্তু বেশিক্ষণ ঘুরানোও যাবে না। কি করা যায় তা মাঝি বুঝে উঠতে পারছে না। মাঝি চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগল। চোখ বন্ধ করতেই মাঝির চোখে সেই যুবকটার ছবি ভেসে উঠলো। কি উজ্জ্বল চোখ দুটো! মাঝির কানে যুবকটার কথাগুলো ভেসে উঠলো, "একদিন এই দেশের ভালবাসা অনুভব করে দেখিয়েন। তখন আর ভয় করবে না। বরং সাহস বেড়ে যাবে।।" জমিদার বলে উঠলো, "কিরে বেটা, আর কতক্ষণ?" মাঝির হুঁশ ফিরলো। "এইতো হুজুর চলে এসেছি।" মাঝি চিন্তা করলো নৌকা ডুবিয়ে দিবে? না না এরা সবাই আর্মি। সাঁতার তো জানেই। মাঝি নানারকম চিন্তা করতে লাগল। হঠাৎ ত্রিমোহনার কথা মনে পড়লো। ত্রিমোহনাতে পড়লে সাঁতার দিয়েও কাজ হবে না। ত্রিমোহনায় প্রচন্ড স্রোত ও নদীর প্রবাহ চলে। বড় বড় স্টিমারও ত্রিমোহনা এড়িয়ে চলে। মাঝি আকাশে তাকালো। চাঁদ তারার মাধ্যমে মাঝি ত্রিমোহনা পথ নির্ধারণ করলো। মাঝি জোরে জোরে নৌকা বাইতে লাগল। হঠাৎ এমন করায় জমিদার বলল, "কিরে হঠাৎ শক্তি বেড়ে গেল নাকি?" মনে মনে মাঝি বলল, তোদের শেষ করার পথ পেতেই শরীরে শক্তি ফিরে এসেছে। আর মুখে বলল, "চলে এসেছি তো তাই।" মাঝি তার বৈঠা ও নৌকায় হাত দিয়ে মনে মনে বলল, "তোরা আমার মা বাবার মতই। তোদের দিয়েই আমি বেঁচে আছি এতদিন। কিন্তু আজ দেশের জন্য তোদেরকে বিসর্জন দিচ্ছি। এতে তোদেরই গর্ব।" মাঝির চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জ্বল গড়িয়ে পড়লো। ত্রিমোহনার কাছাকাছি আসতেই নৌকার দোলানী অনুভব করে জমিদার ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলো। "কিরে তুই কি পথ ভুলে গেলি নাকি?" জবাবে মাঝি বলল, "না। জেনেশুনেই আনছি।" মাঝির জবাব ও বলার ভাবভঙ্গি শুনে জমিদার সব বুঝে গেল। জমিদার কিছু বলার আগেই মাঝি উচ্চস্বরে বলে উঠলো, "জওওওয় বাংলা। জওওওয় বাংলা।" স্লোগান শুনেই পাকসেনারা নড়েচড়ে উঠলো। কিছু করার আগেই মাঝি লাফ দিল। নৌকা ত্রিমোহনার ঘূর্ণিতে পড়ে গেল।"

নূরীর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। লামিয়া সহ বাকিরাও নিজ নিজ চোখ মুছলো। লামিয়া বলল, "তারপর কি হল?" চোখের পানি মুখে নূরী আবার বলতে শুরু করলো।
"রাত পেরিয়ে সকাল হল। মুক্তিসেনারা নদীর পাড়ে কিছু পাকসেনাদের লাশ পেল। রাতের স্লোগান তারা শুনেছিল। কারণ তারা প্রতি রাতেই সীমান্ত পাহারা দেয়। ওদিকে মাঝির স্ত্রী কোলের শিশু মেয়েটাকে নিয়ে পাগলের মত পাড়ে পাড়ে স্বামীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোথাও মাঝিকে পাওয়া গেল না। কেটে গেল কয়েক দিন। মাঝির লাশেরও কোনো খবর নেই। মাঝির এই প্রতিদানের কথা লুকিয়েই থাকতো যদি না পাকসেনারা মাঝির স্ত্রীকে তুলে নিয়ে যেত। সেই রাতে ত্রিমোহনার ঘূর্ণিতে পাকসেনার অফিসার বেঁচে যায়। এক দুপুরে সে তার সেনা নিয়ে এসে মাঝির স্ত্রীকে তুলে নিয়ে যায়। পাশবিক নির্যাতন করে। গ্রাম জুড়ে আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ে মাঝির অবদানের কথা। মুক্তিসেনাদের কাছে এই খবর যেতেই তারা পাক ক্যাম্পে হামলা করে মাঝির স্ত্রী সহ অনেককেই উদ্ধার করে। মেয়ের কথা ভেবে মাঝির স্ত্রী বেঁচে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।
যুদ্ধ শেষ হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু মাঝি ফিরে আসেনি। তবুও মাঝির স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে স্বামীর আশায় বসে থাকে। স্বামীর কষ্ট ব্যতীত আর কোনো কষ্ট তার বুকে নেই। মেয়েকে নিয়ে বেশ সুখেই যাচ্ছে তার দিনকাল। দেশ স্বাধীন হলেও পাক দালাল থেকে গেছে। তারা পিঠ পিছু মাঝির স্ত্রীকে ধর্ষিতা বলে। যদিও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। কারণ কিছু লোক মাঝির স্ত্রীকে শহীদের স্ত্রীর সম্মামনা দেয়। জীবনের গতিতে সবকিছু চলতে লাগল। আশরাফ মাস্টারের কথায় মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করায়। অনেক কষ্ট করে মেয়েকে নিয়ে জীবন চালিয়ে যাচ্ছে সে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই সে যেন সুখ পায়। এক দুপুরে সব সুখের যেন অবসান ঘটলো। ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া তার মেয়েটা স্কুল থেকে এসে বলল, "মা, মা ধর্ষিতার মেয়ে মানে কি? জমিদার বাড়ির লোকগুলো আমাকে দেখলে ধর্ষিতার মেয়ে বলে হাসে কেন?" মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি সে। দেশ স্বাধীন হলেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা ও তাদের পরিবার যথাযথ সম্মান পায়নি। সেদিন রাতেই নিশ্চুপে মেয়েকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যায় সে। নতুন জীবন, নতুন পথ, নতুন শুরু। যেখানে কেউ শহীদের স্ত্রী বলে সম্মান না দিলেও মেয়েকে তো আর কেউ ধর্ষিতার মেয়ে বলবে না।"

নূরী থামলো। সবাই চোখ মুছছে। নৌকা বেয়ে যাওয়া চাচা চোখ মুছে বলল, "এটা তো আমাদের এই মিজান মাঝির ঘটনা। তুমি কিভাবে জানলে? নূরী কোনো জবাব না দিয়ে ছলছল চোখ নিয়ে এক হাত দিয়ে নদীর পানি স্পর্শ করতে লাগল। এই পানিতে যেন আজ সে তার বাবার স্পর্শ পাচ্ছে। নদীর পাড়ের দিকে তাকালে যেন দেখতে পাচ্ছে এক স্বামী হারা স্ত্রী কোলে শিশু নিয়ে দৌঁড়াচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে নূরী মনে মনে বলল, "জানো মা, আমি চিত্‍কার করে বলতে চাই আমি সাহসী মাঝি ও বীরাঙ্গনার মেয়ে।" নূরীর মা মারা যাওয়ার কিছু বছর আগে এক বিজয় দিবসে অন্তরে লুকিয়ে রাখা এই ঘটনাটা নূরীকে জানিয়েছিল।
মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা। খোদা আপনাদের উত্তম প্রতিদান দিক।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.