নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিখতে জানতে ও ছড়িয়ে যেতে চাই।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী

আমি বাপ্পী। জন্মস্থান বরিশাল। বেড়ে উঠা চট্টগ্রাম।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পের নামঃ জড়তা কাটানো এক বক্তৃতা।

২০ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১১:০২

"জড়তা কাটানো এক বক্তৃতা"
"মোঃ জোবায়ের বাপ্পী"
………
গাড়ি করে স্কুল প্রাঙ্গণে আভা ও তার মা নূরী নামলো। ফোন বের করে আভা তার বাবাকে কল দিল। মেয়ের কল দেখে আসাদ রিসিভ করে বলল "এইতো মামণি এসে গেছি।" "তাড়াতাড়ি আসো। ফাংশন শুরু হয়ে যাচ্ছে।"
আসাদ এসে গেল। আভা তার বাবা মাকে নিয়ে সামনের কাতারে বসিয়ে দিল। তারপর স্টেজে চলে গেল। ফাংশন শুরু হল। "নারী দিবস" উপলক্ষে ভার্সিটির পক্ষ থেকে এই ফাংশন। সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ অনেক ছাত্রীকেই "সাহসী নারী" উপাধি দিয়ে পুরষ্কৃত করবে। সেখানে আভার নামও আছে। একে একে নাম ডেকে পুরষ্কৃত করা হচ্ছে। সবাই এসে নারী ক্ষমতায়নের ওপর নিজ নিজ অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে। স্টেজে এবার আভার নাম ডাকা হল। আভাকে পুরষ্কৃত করা হল। মাইকের সামনে এসে আভা তার বক্তৃতা শুরু করলো।

"নারী ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে আমাদের সবার চোখেই মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার ছবিটা ভেসে উঠে। কিন্তু আমার চোখে ভেসে উঠে অন্য এক নারীর ছবি। আজ তার গল্পই বলব আপনাদের। বলব, কেন সে আমার কাছে মহীয়সী নারী?
ছোট্ট একটা গ্রামে জন্ম আলোর। বাবা মায়ের ঘরের আলো। তাই নামও দিয়েছে আলো। আদর করে লালন পালন করে বড় করার পর ব্যবসায়ী ছেলে দেখে মেয়ে ভালো থাকবে এই আশায় বিয়ে দিয়ে দেয়। আলো গ্রাম পাড়ি দিয়ে চলে আসে শহরে। স্বামীর নাম জামাল। শহরে আসার পরপরই আলো বুঝলো যে জামাল অত্যন্ত বদমেজাজি। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলে। ফলে আলো তার স্বামীকে ভয় পেতে শুরু করে। জামালের মন ভালো কিন্তু রেগে গেলে হুঁশ থাকে না। তখন কি করে তা নিজেও জানে না। একবার তো রাগের মাথায় টিভিই ভেঙে ফেলেছিল। আলোকেও দুচারটে থাপ্পড় দিয়েছিল। আলোর জীবন আলোকিত করে এসেছিল প্রভা। আলোর শত কষ্টের মাঝে তার মেয়ে প্রভা হল সুখের ঠিকানা। জামাল বদমেজাজি হলেও মেয়ে হওয়ায় আলোকে খোটা স্বরূপ কিছু বলেনি। আলোর জীবনে এক দূর্বিষহ ঘটনা ঘটে প্রভা জন্মের এক বছর পর। দিনটা ছিল বন্ধের দিন। শারীরিক যন্ত্রণার কারণে সেদিন আলোর কোনো হুঁশ ছিল না। এদিকে প্রভা অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে। আচমকা জামাল এসে আলোকে মারধর করেছিল। সেই মারের ফলে আলোকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল। সেদিন আলো মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। আলোর ইচ্ছে ছিল প্রভা একটু বড় হলে ছেলের আশায় আরেকটা সন্তান নিবে। কারণ জামাল প্রথম সন্তান হিসেবে ছেলে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিন সব ইচ্ছে শেষ হয়ে গিয়েছিল। এই কষ্টটা কেবলমাত্র একটা মেয়েই বুঝে। তবুও আলো কোনো প্রতিবাদ করেনি। একটা বাক্য পর্যন্ত বলেনি স্বামীকে।"

একটু থেমে আভা আবার তার বক্তৃতা শুরু করলো,
"জামালের রাগ প্রভার ওপরও পড়ত। প্রভার তখন পাঁচ বছর। ঈদের কেনাকাটা করার সময় প্রভা একটা খেলনা নেয়ার জেদ করে বসে। লোকের মাঝে জামাল কিছু না বললেও বাসায় এসে ছোট্ট বাচ্চাটাকে খুব মারধর করে। মেয়েকে বাঁচাতে যেয়ে মারের কিছু অংশ আলোর ওপরও পড়ে। মা মেয়েকে মেরে জামাল ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এটা তার নিত্যদিনের স্বভাব। প্রায়শই আলোরে মারধর করে সে বেরিয়ে যায়। প্রভার ছোট্ট শরীরে এত মার সহ্য হয়নি তাই জ্বর চলে আসে। প্রায় এক সপ্তাহ জ্বরে ভুগে প্রভা। বিছানা ছেড়েও উঠতে পারেনি সে। তবুও আলো তার স্বামীকে প্রতিবাদমূলক কিছু বলেনি। আল্লাহ নারীকে মায়া দিয়েই পাঠায়। প্রতিটি পুরুষ সেই মায়ায় পড়ে। তবে রূপ ভেদে। হয়তো মায়ের রূপে, নয়তো স্ত্রীর রূপে কিংবা মেয়ের রূপে। জামালের অন্তরের মা ও স্ত্রীর মায়া কাজ না করলেও মেয়ের মায়া কাজ করে গেল। প্রভা যে সপ্তাহটা অসুস্থ ছিল। জামালের কাছে সেই সপ্তাহটা পুরো ঘরটা যেন অন্ধকার মনে হচ্ছিল। আগে জামাল বাসায় এসে প্রভার লাফালাফি দেখত, প্রভার মুখের নিত্যনতুন বুলি শুনতো। কিন্তু এই সপ্তাহ জুড়ে ঘরটা শূণ্য থাকে। সেদিন প্রথম জামাল ঘরে ডাক্তার নিয়ে আসে। আলো শুধু ছলছল চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে ছিল। একপ্রকার অজানা সুখ তার মনে দোলা দেয়। ধীরে ধীরে প্রভা সুস্থ হয়ে উঠে। প্রভা ছোট হলেও অভিমান ছিল খুব বেশি। সুস্থ হওয়ার পর রাগ করে সে বাবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। জামাল মাঝেমাঝে ডাকে কিন্তু প্রভা সাড়া দেয় না। একদিন রাতে ঘর ভর্তি খেলনা নিয়ে আসে জামাল। কিন্তু প্রভা একটা খেলনা ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখলো না। জামাল খেলনা নিয়ে প্রভার কাছে যেতেই প্রভা ভয়ে আতকে উঠলো যেন জামাল কোনো ভুত। আলো মেয়েকে অনেক বুঝায় কিন্তু প্রভা কাছে যেতেও নারাজ। তার একটাই বাক্য "বাবা আমায় মেরে ফেলবে।" নিজের মনের মধ্যে সেদিন জামাল খুব অপমানবোধ করে।"

বাবা মায়ের দিকে একনজর তাকালো। তার মায়ের চোখ দুটো ছলছল করছে। আর বাবার চোখে অনুশোচনাবোধ কাজ করছে। আভা আবার বলতে শুরু করলো,
"জামাল নিজেকে বদলাতে শুরু করে। আলো কাছে না থাকলে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রভাকে স্যরি বলে। আর মারব না বলে কানে পর্যন্ত ধরে। আড়াল থেকে আলো সবই দেখে। তাই মাঝেমধ্যে সে বাবা মেয়েকে একা সময় করে দেয়। প্রভার সাথে আসাদের সম্পর্ক বন্ধুসুলভ হয়ে গেল। প্রতিটি সন্তানের বেস্ট ফ্রেন্ড তার বাবা মা। সময় যত গেল জামালের দুনিয়া জুড়ে প্রভার বিস্তার হতে লাগল। এক সকালে আলোর সাথে জামালের খুব ঝগড়া হল। শেষমেষ মারধর করে চলে গেল। প্রভা তখন স্কুলে ছিল। কিন্তু বাসায় এসে বুঝলো বাবা তার মাকে মেরেছে। সাথেসাথে ফোন করল। আলো অনেক বুঝিয়েছে ফোন না করার জন্য। কিন্তু প্রভা শুনলো না। জামালকে অনেক জেরা করল। তবে জামাল বকাবকি করেনি। আভা হুমকি স্বরূপ আজ ভাত পানি বন্ধ বলে দিল। আলোর রাতটা শুরুই হল ভয় দিয়ে। আজ ঘরে তুফান হবে। প্রভা রান্না করতে দেয়নি। যা ছিল নিজে খেয়েছে। আলো খায়নি। স্বামীকে রেখে সে কখনোই খায় না।। জামাল এসে দেখল ঘরের পরিবেশ থমথমে। প্রভা অনেক রাগারাগি করলো। আলো ভয় পেয়ে গেল এই বুঝি প্রভাকে মারবে। তাই সে নিজেকেই যেয়ে প্রভাকে দুটা থাপ্পড় মেরে দিল। আলো অবাক হয়ে গেল জামালের প্রতিক্রিয়া দেখে। আমার মেয়ে আমার সাথে কথা বলছে তুমি মারলে কেন? প্রভার কথায় আসাদ সেদিন প্রতিজ্ঞা করল সে আর কখনো আলোর গায়ে হাত তুলবে না। হোটেল থেকে রাতের খাবার এনে খেল। ধীরে ধীরে আলোর জীবন বদলে গেল। এখন আর মারধর হয় না। এখন আলো তার ঘরে রাজ করে।"

বক্তৃতার এই পর্যায়ে এসে আভা আবার থামলো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো,
"আমার কাছে এই আলো হল মহীয়সী নারী। সে তার জীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট করেছে। কিন্তু কখনো প্রতিবাদ করেনি। তার এই প্রতিবাদ না করার পিছনে রয়েছে পরিবার ভাঙার ভয়। নিজে কষ্ট করে গেছে কিন্তু পরিবার ভাঙার ভয়ে মুখ ফুটে কিছু বলেনি। আমার কাছে এই আলো মহীয়সী। কারণ সে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করে গেছে। নিজে না খেয়ে স্বামী ও মেয়েকে খাইয়েছে। নিশ্চুপ থেকেছে মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। তাই আমার কাছে এই আলোই মহীয়সী। এই আলোই মহীয়সী। আমি যখন হতাশ হই তখন এই আলোর কথা চিন্তা করলে মনে সাহস পাই। তাই আমার কাছে এই আলো মহীয়সী।"

আভা থামলো। সবার উদ্দেশ্যে ধন্যবাদ বলল। সেইসাথে করতালির শব্দ শুরু হল। আভা চোখের অশ্রু মুছে স্টেজ থেকে নেমে গেল। সবাই বক্তৃতার প্রশংসা করলো। ফাংশন শেষে আভা তার বাবা মাকে নিয়ে বের হল। আসাদ আভাকে বলল, "তুই ঐ গাড়িতে যা।" আভা হুম বলে চলে গেল। আভার গাড়ি যাওয়ার পর আসাদ তার ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিল। তারপর স্ত্রী নূরীকে নিয়ে নিজে ড্রাইভ করতে লাগল। কিছু দূর যেয়ে থামলো। নূরী-আসাদ দুজনই এতক্ষণ চুপ ছিল। হঠাৎ নূরী তার হাতে আসাদের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো। নূরী তাকিয়ে দেখলো আসাদের চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। ঝরছে নূরীর চোখ দিয়েও। নূরীর হাত ধরে আসাদ বলল, "আমি তোমার বড় অপরাধী। স্বামী হয়ে আমিই তোমার মাতৃত্ব কেড়ে নিয়েছিলাম। আরও কত কষ্ট দিয়েছি তা আমিও জানি। আজ যদি আভা তার বক্তৃতায় এসব না বলত আমি অধম কখনোই তোমার কষ্ট বুঝতে পারতাম না। আমাকে ক্ষমা করে দাও।" কথাগুলো বলে আসাদ কাঁদতে লাগল। "ক্ষমার কথা বলে আমাকে পাপের ভাগী করিও না। আমি অতীত ভুলে গেছি। বর্তমান নিয়ে সুখে আছি।" কাঁদছে দুজনই।
আভার ভাষণের গল্পটা তার বাবা মায়ের। দুজনের মধ্যে এখন অনেক ভালোবাসা। কিন্তু অতীতের কিছু কালো স্মৃতির জন্য দুজনের মধ্যে জড়তা বিদ্যমান। যা আজ শেষ হল। এবার বাবা মায়ের মধ্যে জড়তা থাকবে না ভেবে বেশ খুশিতে আছে আভা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.