নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিখতে জানতে ও ছড়িয়ে যেতে চাই।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী

আমি বাপ্পী। জন্মস্থান বরিশাল। বেড়ে উঠা চট্টগ্রাম।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পের নামঃ আত্মার টান।

৩০ শে জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ৯:৪৭

"আত্মার টান"
"মোঃ জোবায়ের বাপ্পী"
………
মাহতাবউদ্দিন পঙ্গু। তাঁর এই পঙ্গুত্ব জীবনের একমাত্র সঙ্গি তাঁর স্ত্রী জুবায়েদা। আর্মিতে থাকাকালীন এক যুদ্ধে তিনি পা দুটো হারান। পারিবারিক স্ট্যাটাস বেশ ভালো। তাঁর বাবা অঢেল সম্পত্তির মালিক। তবুও দেশের সেবা করার লক্ষ্যে তিনি আর্মিতে যোগ দিয়েছিলেন। বিশটা বছর দেশের সেবা করেছেন তিনি। তারপর এক যুদ্ধে পা হারান। তবে দেশ তাঁকে ভুলেনি। বীরের সম্মানের ভূষিত করেছে। আজ তিনি কোথাও গেলে কার্ড দেখলে সরকারি অফিসাররা সম্মান দেয়। স্বামী পঙ্গু বলে জুবায়েদা কখনো স্বামীর দায়িত্বে অবহেলা করেননি। তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে আছে। ছেলেরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল আছে। আর মেয়ে নিলুফাকে বিয়ে দিয়েছে দুই বছর হলো। এখন সে তার হাজব্যান্ডের সাথে নিউজিল্যান্ড থাকে। আট মাস আগে নিলুফা তাঁদেরকে নানা-নানী হবে বলে খুশির খবর জানিয়েছিল। এটাই নিলুফার প্রথম সন্তান তাই সে নার্ভাসে আছে। যার কারণে বাবা মাকে চলে আসতে বলেছে। বর্তমানে মাহতাবউদ্দিন তাঁর স্ত্রী জুবায়েদাকে নিয়ে নিউজিল্যান্ড এসেছে। সপ্তাহখানেক আগে জুবায়েদার কাছে মেয়ের ফোন এসেছিল।
“মা, তোমরা চলে আসো। আমার ডেলিভারীর ডেট চলে এসেছে। আমার খুব ভয় করছে।” প্রতিটি মাও চায় মেয়ের এই সময়ে পাশে থাকতে। যতই আয়া বুয়া থাকুক মা তো মা-ই।

জুবায়েদা মেয়ের দেখাশোনা করতে লাগলেন। একদিন পেইন উঠায় নিলুফাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে জানালো তাদের ছেলে হয়েছে। তবে নিলুফার অবস্থা সিরিয়াস। আনন্দের পরিবর্তে বেদনা জুড়ে গেল পরিবারের মধ্যে। নিলুফার স্বামী ডাক্তারকে বললেন, “যত টাকা লাগে লাগুক তবুও নিলুফাকে বাঁচান।” কিন্তু টাকা দিয়ে আর জীবন বাঁচে? এদিকে নিলুফার ভাইয়েরা খবর পেয়ে গেল তারা মামা হয়েছে। কিন্তু বোনের খবর শুনে দুঃশ্চিন্তায় পড়ল। ঘন্টাখানেক পর যখন আবার জানল সিচুয়েশন ক্রিটিক্যাল হচ্ছে। সাথেসাথেই বড় ভাই ছোট ভাইকে ফোন করে জানাল, “নিলুফার অবস্থা ভালো না। আমি নিউজিল্যান্ড যাচ্ছি।” “আমিও শুনেছি। আর কিছুক্ষণ পরেই আমার ফ্লাইট।”
চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেল তবুও নিলুফার কোনো উন্নতি হলো না। বরং সময়ের সাথে অবনতি হচ্ছে। এদিকে দুই ভাই অস্ট্রেলিয়া থেকে ছুটে এসেছে। হইহুল্লোড় পড়ে গেল হাসপাতালে। প্রয়োজনে সুইজারল্যান্ড নিয়ে যাবে। তবুও শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। মাহতাবউদ্দিনের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। এই তো জীবনের সবচেয়ে দামী পাওয়া। ছেলেরা যতই দূরে থাকুক না কেন পরিবারকে ভুলেনি। অর্থ সম্পদের পাহাড়ে উঠেও তারা তাদের দায়িত্ব ভুলেনি। মা বাবা হিসেবে সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দিতে পেরেছে এটাই তো বড় পাওয়া। বাবা মা হিসেবে জীবন স্বার্থক।
দুই ভাই নির্ঘুমে দুদিন পার করে দিয়েছে। টাকা পয়সার বন্যা বইয়ে দিয়েছে। কেউ দুলাভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নেই। যখন যা লাগছে নির্দ্বিধায় খরচ করে যাচ্ছে। বোন তো তাদেরই। তার সাথে জুড়ে আছে তাদের ভাগ্নিও।

বাহাত্তর ঘন্টার পর ডাক্তার জানাল অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। খবর শুনে সবার বুক থেকে যেন পাথর নামল। মাহতাবউদ্দিন তাঁর স্ত্রীকে বলল, “চল, মসজিদে যেয়ে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে আসি।” জুবায়েদাও রাজি হয়ে গেল। মেয়ের জামাই থেকে পথ জেনে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়ল। তারপর চলে এল মসজিদে। বাকিরা হাসপাতালের নানান কাজে ব্যস্ত। তাই আসতে পারেনি। তাছাড়া হাসপাতালে কাছেই। মেয়েদের জন্য আলাদা মসজিদ আছে। প্রথমে জুবায়েদা তাঁর স্বামীকে পুরুষদের মসজিদে দিয়ে আসলো। তারপর রাস্তার ওপারে থাকা নারীদের মসজিদের চলে গেল। নামাজ পড়ে মাহতাবউদ্দিন আল্লাহর দরবারে হাত তুলে কেঁদে কেঁদে মেয়েসুস্থতার জন্য দোয়া করতে লাগল। মোনাজাত শেষ করে আমিন বলে মাহতাবউদ্দিন নামাজ শেষ করলেন। ঠিক তখনই গুলির শব্দ শুরু হলো। মাহতাবউদ্দিন আতংকিত হয়ে গেলেন। আশেপাশের সবাই আতংকিত। হঠাৎই একজন বন্দুকধারী লোক মসজিদে প্রবেশ করল। উপস্থিত মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে এলোপাতাড়িভাবে গুলি ছুড়তে লাগল। মাহতাবউদ্দিন আগেই শুয়ে পড়ল। কিন্তু বন্দুকধারী যেন হৃদয়হীন। শুয়ে পড়ার পরেও বন্দুকধারী গুলি করতে লাগল। এতে মাহতাবউদ্দিন সহ অনেকেই গুলিবিদ্ধ হলো।

নামাজ শেষ করে উঠলেন জুবায়েদা। ঠিক তখনই গুলির শব্দ পেলেন। তাড়াহুড়ো করে মসজিদ থেকে বেরিয়ে পড়লেন। সবাই মসজিদের বিপরীতে ছুটতে লাগল। জুবায়েদা লক্ষ্য করল গুলির শব্দ পুরুষদের মসজিদ থেকে আসছে। বুকের মধ্যে অজানা ভয় শুরু হলো। তিনি চোখ বন্ধ করে মসজিদের দিকে দৌড় দিলেন। লোকজন সবাই না যাওয়ার ইশারা দিতে লাগল। কিন্তু তারা তো জানে না জুবায়েদার প্রাণ ওই মসজিদে আছে। একটা মেয়ের জন্য যে তার স্বামীই সব। হোক সেটা নতুন দম্পতি কিংবা ষাটোর্ধ্ব দম্পতি। জুবায়েদা দৌড়ে পুরুষদের মসজিদের প্রাঙ্গণে চলে এলো। ঠিক তখনই বন্দুকধারী লোকটা বেরিয়ে এলো। বাইরে ছুটতে থাকা সবাইকেও এলোপাতাড়িভাবে গুলি করতে লাগল।
পুলিশ চলে এসেছে। যদিও বন্দুকধারীকে পায়নি। উদ্ধারকর্মীরা মসজিদের ভেতরে বাইরে নিহতদেরকে একত্রিত করতে লাগল। আর আহতদেরকে এম্বুলেন্সে উঠাতে লাগল। মাহতাবউদ্দিন আহত হয়েছে। তবে গুরুতর না হওয়ায় তাঁকে একটু পরে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। আশেপাশে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। তাঁর কানে ইংলিশে কিছু শব্দ ভেসে আসলো। যার অর্থাৎ - একটা পাগল মহিলা গুলির শব্দ শুনে পালানোর পরিবর্তে মসজিদের দিকে দৌড়াচ্ছিল। কি পাগল! নিষেধ করার পরেও থামেনি। আহ! বেচারি শেষে মারাই গেল। ইসস!
মাহতাবউদ্দিনের চোখ একটা নিথর নারী দেহের ওপর যেয়ে থমকে গেল। রক্তের কারণে বোরকার কালো রং আরও গাঢ় হয়ে গেছে। জুবায়েদাও কালো বোরকা পরে। আচ্ছা জুবায়েদা কই?

মাহতাবউদ্দিনের হুঁশ যেন এইমাত্র ফিরল। তিনি তাঁর হুইল চেয়ার লাশের দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন। কাছে যেয়ে স্কার্ফ দেখেই চিনে গেলেন এটাই তার জুবায়েদা। চেহারার দিকে তাকিয়েই মাহতাবউদ্দিন নির্বাক হয়ে গেলেন। চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন জুবায়েদার লাশের ওপর। হাউমাউ করে কান্না শুরু করলেন। আশেপাশের সবাই এসে গেল। বুঝল যে তার স্ত্রী। সবাই ইংলিশে কথা বলা শুরু করল। এই তো সেই মহিলাটা। নিষেধ করার পরেও মসজিদের দিকে দৌড়াচ্ছিল।
সবার কাছে আজ জুবায়েদা পাগল হলেও মাহতাবউদ্দিন জানে কেন জুবায়েদা ছুটেছিল মসজিদের দিকে। কেননা জুবায়েদার প্রাণ অর্থাৎ স্বামী যে এই মসজিদে ছিল। স্বামীর টানেই গুলির শব্দকে উপেক্ষা করে সে ছুটেছিল মসজিদের দিকে। নিজের পরিণতির কথা ভুলে স্বামীর চিন্তায় সে বিভোর ছিল। স্বামীর ভালোবাসার টানে জুবায়েদা বাকি সবকিছু ভুলেই গিয়েছিল। তাই তো পাগলের মতো ছুটেছিল। এই টান ষাট বছর এক সাথে সংসার করার টান। এই টান ভালোবাসার টান, মায়া মহব্বত ও আত্মার টান।
জুবায়েদার নিথর দেহ কোলে নিয়ে মাহতাবউদ্দিন নিঃশব্দে কেঁদেই যাচ্ছেন। হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তার স্ত্রীর চেহারায়। স্ত্রীর কপালে চুমু দিয়ে বললেন, “আমাদের ভালোবাসা আল্লাহ কবুল করুক। আখিরাতে তোমার সাথে যেন আবার দেখা হয়।” জুবায়েদার চেহারা উজ্জ্বল, আলোকিত ও পবিত্র লাগছে মাহতাবউদ্দিনের চোখে। একদম বাসররাতের মতো। শব্দহীন কান্নায় মাহতাবউদ্দিনের চোখমুখ ভিজে গেছে।
এরইমধ্যে তার ছেলেরা ও মেয়ের জামাই চলে এসেছে। আর্তনাদের চিত্‍কারে মসজিদের প্রাঙ্গন ভরে উঠল। এই চিত্‍কার শেষ হলেও আর্তনাদ শেষ হবার নয়।

সমাপ্ত

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.