নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিখতে জানতে ও ছড়িয়ে যেতে চাই।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী

আমি বাপ্পী। জন্মস্থান বরিশাল। বেড়ে উঠা চট্টগ্রাম।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পের নামঃ সম্মান।

২৩ শে জুন, ২০২০ দুপুর ১:৫৯

গল্পের নামঃ সম্মান।
লিখেছেনঃ মোঃ জোবায়ের বাপ্পী।

আধুনিকতার ছোঁয়া এখন শহর পেরিয়ে গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে। পুরানো সেই মেঠোপথ এখন পাকাপোক্ত হয়েছে। ইঞ্জিন চালিত গাড়ি এখন অহরহ। যে রাস্তায় আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও একটা রিকশা দেখা যেতো না, আজ সেখানে মিনিট দশেক পরপরই গাড়ি আসা-যাওয়া করে। কুঁড়ের ঘরের স্থান দখল করেছে টিন ও ইথ পাথরের তৈরি দালান। তবে এই দালানগুলোর সাথে আধুনিকতার পাশাপাশি অর্থনীতিরও সম্পর্ক আছে। গ্রামের লোকজন এখন শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে শহরে যাচ্ছে কিংবা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। ফলে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। তারই ছোঁয়া এই দালানকোঠা। গ্রামের অনেককিছুই বদলে গেছে। শুধু বদলায়নি প্রাকৃতিক পরিবেশ। এখনো রাস্তার দুই ধারে সবুজের সমারোহ দেখা যায়। বাতাসে সবুজের ঢেউ খেলে। গ্রামের মানুষজনও এখন যান্ত্রিক জিনিসের উপর নির্ভর হয়ে পড়েছে। তবে এখনো কিছু লোক ব্যতিক্রম আছে। তারা এখনো দু'পায়ের ওপর নির্ভর করে মাইলের পর মাইল হেঁটে যায়। তাদেরই একজন মাস্টার মইনউদ্দিন। গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ শিক্ষকদের একজন। গ্রামজুড়ে তার বেশ নামডাক রয়েছে। “শিক্ষক জাতি গঠনের কারিগর” এই কথাটার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ তিনি। শিক্ষকতার জীবনে ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিজের সবটুকু বিসর্জন দিয়েছেন। পারিবারিক তিনি বেশ ধনাঢ্য পরিবার সন্তান ছিলেন। নিজের ধন সম্পদের অর্ধেকও বেশি খরচ করেছে ছাত্রছাত্রীদের উন্নত পড়ালেখার জন্য। তারই হাত ধরে আজ এই গ্রাম থেকে মেজিস্ট্রেট, পুলিশ, আর্মি, সচিব‚ মন্ত্রী বেরিয়েছে। আজ এই গ্রামের অনেকেই সমাজের প্রতিষ্ঠিত আসনে বসে আছে যার অবদান এই মইনউদ্দিন মাস্টারের। তিনি শিক্ষকতাকে পেশা নয় সেবা হিসেবে নিয়েছিলেন। শুধু আর্থিক সহায়তা দিয়েই তিনি ক্ষান্ত থাকতেন না, কড়া তদারকিও করতেন। তাই তো গ্রামজুড়ে তার এত সম্মান। পথচলার সময় দেখা হওয়া প্রতিটি লোক তাকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে।

গ্রামে এখন সাঁকোর স্থান দখল করেছে ছোট ছোট কালভার্ট ও ব্রিজ। তেমনি এক ব্রিজে বসে আড্ডা দিচ্ছে আসাদ ও তার বন্ধুরা। ব্রিজের সামনে দিয়ে হাতে সিগারেট নিয়ে তাতে ফুঁ দিতে দিতে এগিয়ে আসছেন রুবেল খন্দকার। এক সময় তাদের আর্থিক অবস্থা শোচনীয় থাকলেও বর্তমানে তাদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। শহরের নামকরা গার্মেন্টসের উচ্চ পদে নিয়োজিত আছেন। মাস শেষে মোটা অংকের বেতন পান তিনি। যা দিয়ে ঘরের পরিবেশ বদলে ফেলেছেন। সেই সাথে বদলে গেছে গ্রামে তার নিজস্ব স্থানও। বছরে গ্রামে দুএকটা বড় অনুষ্ঠান করেন তিনি। এখন গ্রামের দশজনে তাকে চিনে।
অন্যদিকে ব্রিজের পেছন থেকে এগিয়ে আসছে মইনউদ্দিন মাস্টার। সাথে তার নাতি সলিমুল্লাহ আছে। দুই দাদা নাতি কথা বলতে বলতে বাজারের দিকে যাচ্ছে। আসাদ ও তার বন্ধুরা ব্রিজের রেলিং থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মইনউদ্দিন মাস্টার কাছে আসতেই আসাদরা সালাম দিলো।
- আসসালামু আলাইকুম স্যার। ভালো আছেন?
- ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছ তোমরা?
- এই তো স্যার ভালো। আপনি?
- আছি তোমাদের দোয়ায় ভালোই। পড়ালেখা চলে তো?
- জ্বি স্যার। দোয়া রাখবেন।
- দোয়ার সাথে পড়তেও হবে কিন্তু।
আসাদ ছোট একটা হাসি দিলো। হাঁটতে হাঁটতে এইটুকুই কথা হলো।

একটু সামনে এগিয়ে যেতেই রুবেল খন্দকারের মুখোমুখি হলেন মাস্টার সাহেব। তবে রুবেলের হাতে সিগারেট দেখে তিনি রুবেলকে দেখেও না দেখার ভান করে হাঁটতে থাকলেন। কিন্তু রুবেলের দৃষ্টিগোচর হতেই তিনি ডাক দিলেন।
- সালামালাইকুম স্যার। কেমন আছেন?
- এই তো ভালো। তা তুমি কেমন আছ? কবে এলে?
- এই তো স্যার আজ সকালেই এলাম। বাজারগ ঘাট করে বাসায় যাচ্ছি।
- তা বাজার কই?
- অনেক বাজার তাই গাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি।
- তা তুমি হেঁটে যাচ্ছ কেন? অভ্যাস নেই। পায়ে ব্যাথা করবে।
- এই সামনে মনিরের বাসায় যাব তো তাই।
- আচ্ছা যাও।
দু'জন দুজনের গন্তব্যে হাঁটা দিলো। আসাদ এতক্ষণ তাদেরকেই লক্ষ্য করেছে। রুবেল খন্দকার তার দূর সম্পর্কের চাচা হয়। আসাদের কাছে আসতেই রুবেল খন্দকার বলল, “কেমন আছ ভাগ্নে?”
- এই তো চাচা ভালো। তা এই সাতসকাল হেঁটে হেঁটে কোথায় যাচ্ছেন? মর্নিং ওয়াক করছেন নাকি?
- অনেকটাই তেমন। মনিরের বাসায় যাবো একটু।

রুবেল হাঁটা দিলেন। খানিকটা দূরে যেতেই আসাদের বন্ধু শুভ বলল, “দেখলি রুবেল চাচা কি কাজটা করলো? মাস্টার সাহেবের সামনে সিগারেট খেলো।”
- টাকা রে দোস্ত টাকা। এই জিনিসটা যার কাছে চলে আসে সে মানুষকে তার যথাযথ মর্যাদা দিতে ভুলে যায়।
- আরে ধুর। উনার কয় টাকা আছে? সুবাহান চাচার যে টাকা আছে তার এক ভাগও তো নাই। কিন্তু সুবাহান চাচা আজ পর্যন্ত মাস্টার সাহেবের সামনে মাথা তুলেও কথা বলেননি।
- হাতের পাঁচ আঙুল তো আর সমান নয়। ধুমপান আমাদের একটি বদ-অভ্যাস। এটা যতটা সম্ভব লুকিয়ে করাই উত্তম। সিনিয়রদের সামনে হাত উঁচিয়ে সিগারেটে ফুঁ মারার আগে আমাদের একবার স্মরণ করা উচিত যে আমাদের জুনিয়ররা যদি এই একই কাজ করে তখন কেমন লাগবে?
- ঠিক বলেছিস। কিন্তু আজকাল এসব কেউ ভাবে না।
- দিনদিন বিবেকের অধঃপতন হচ্ছে।

ওদিকে মইনউদ্দিন মাস্টার হাঁটছে আর ভাবছে টাকা পয়সা হলে মানুষ এত বদলে যায় কেন? একটা সময় এই রুবেল তার ছাত্র ছিল। শুধু সেই নয় তার বাবাও এক সময় তার ছাত্র ছিল। কিন্তু আজ সেই রুবেল সম্মান দিতেও ভুলে গেছে। টাকা কি মানুষকে অমানুষে রূপান্তর করে? না, তা করে না। মানুষই টাকার অহংকারে অমানুষে রূপান্তর হয়। নয়তো সুবাহানের মতো ধনাঢ্য ব্যক্তিও অমানুষে রূপান্তর হতো।

বেশ কিছুদিন পর,
ব্রিজের রেলিংয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে আসাদ ও তার বন্ধুরা। বাজারের দিকে যাচ্ছেন রুবেল খন্দকার। তাকে দেখে আসাদ তার বন্ধু শুভ যে ব্রিজের ওপাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে তাকে বলল, “দোস্ত, তোর সিগারেটটা একটু দে তো।” কথাটা শুনে শুধু শুভ নয় পাশে থাকা বাকি দুজনও অবাক হলো। কেননা আসাদ আজ পর্যন্ত সিগারেট হাতে নেয়নি। এমনকি তার সামনে তার বন্ধু মহলের কেউ সিগারেট জ্বালাতে পারে না। তাই তো শুভ দূরে গিয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। শুভ বলল, “এই তো দোস্ত শেষ হয়ে গেছে।” কথাটা বলে শুভ জোরে জোরে টান দিতে লাগল।
- আরে আরে থাম। আমার একটা কাজ আছে তাই বলছি।
- আমি জানি তুই ফেলে দিবি।
- ফেলব না। শুধু কাজটা করব।
শুভ এগিয়ে এসে আসাদের হাতে সিগারেট দিলো। আসাদ সিগারেট হাতে নিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে রইলো। রুবেল খন্দকার ব্রিজের ওপর পা ফেলতে আসাদ পা নাড়াতে লাগল আর সিগারেটটা উঁচিয়ে ধরে বন্ধুদের সাথে কথা বলতে লাগল। যাতে সিগারেটটা রুবেলের দৃষ্টিগোচর হয়। রুবেল খন্দকার ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেলন। রুবেল চলে যেতেই আসাদ বলল, “ধুর কাজ হলো না।”
- হা হা হা। আমি বুঝেছি। তবে এতে উনার কিছু আসে যায় না। বিবেক থাকলে স্যারের সামনে সিগারেট হাতে রাখতো না।
- তবে একদিন আমি উচিত শিক্ষা দিয়েই ছাড়বো।

প্রতি বছরের মতো এবারও বেশ বড় অনুষ্ঠান করছেন রুবেল খন্দকার। পরিবারের সুখ শান্তি ও উন্নতির জন্য একটা মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছেন। চারদিকে হইহুল্লোড় চলছে। গ্রামবাসীকে দুপুরের খাবার খাওয়ানো হচ্ছে। প্রধান গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন রুবেল। উপজেলার চেয়ারম্যান আসতেছে। তাকে স্বাগত জানাতে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। উপজেলার চেয়ারম্যান আসাতে তার নাম আশেপাশের গ্রামেও ছড়িয়েছে। বেশ দূরে দাঁড়িয়ে আছে আসাদ ও তার বন্ধুরা। সেই দিন ব্রিজের ঘটনার পর রুবেল খুব একটা কথা বলেন না আসাদের সাথে। দেখেও না দেখার ভান করেন। আসাদের একটু সামনে গ্রামের কিছু ছেলেমেয়েরা আনন্দ উল্লাস করছে। হঠাৎই ছেলেরা নিজ নিজ ঘরের দিকে ছুটে গেল। অন্যান্যরা দুষ্টামি বন্ধ করে দিলো। শুভ তার হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে ভদ্রভাবে দাঁড়ালো। পুরো ব্যাপারটা রুবেলের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কিন্তু কি কারণে হঠাৎ এই পরিবর্তন তা বুঝতে পারলেন না। তবে একটু সময় পরেই মইনউদ্দিন মাস্টারকে দেখে তিনি সব বুঝে গেলেন। মাস্টারের পেছন পেছন আসাদররা সহ বাচ্চাকাচ্চা অনেকেই প্রবেশ করলো যেন ছোটখাটো একটা মিছিল। এর কিছুক্ষণ বাদেই উপজেলা চেয়ারম্যান এলেন। গাড়িবহর নিয়ে এলেও তার পেছনে নেতাকর্মী ও উত্‍সুক কিছু বাচ্চাকাচ্চা ব্যতীত তেমন কোনো ভীড় নেই। রুবেল খন্দকার অনুধাবন করলেন সম্মান জিনিসটা টাকা পয়সা কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে পাওয়া যায় না। সেটা নিজের পরিশ্রম ও সততা দিয়ে অর্জন করতে হয়। যা মইনউদ্দিন মাস্টার অর্জন করেছেন। সেদিন তার সামনে সিগারেট খাওয়াটা যে বড় বেয়াদবি হয়ে গেছে তা উপলব্ধি করতে পেরেছে।
।। সমাপ্ত ।।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.