![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গল্পঃ আগলে রাখা
লিখেছেনঃ মোঃ জোবায়ের বাপ্পী
উত্সর্গিতঃ Md Sharif JD [Part of BAS. One of my childhood best friend]
শুভ জন্মদিন। ভালো কাটুক জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত।
অনেকক্ষণ ধরে ফোন করেই যাচ্ছি। তবুও রিসিভ করছে বান্দরনীটা। নাম নূরী। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে, তবুও কিছু করার নাই। তাই ধৈর্য ধরে কল করেই যাচ্ছি। কেননা বান্দরনীটাকে যে লাগবেই। একটু সময় নষ্ট হলেও অনেক টাকাই বেঁচে যাবে। তাই টাকার চিন্তা করে হলেও ধৈর্য ধরে রেখেছি। বেশ কিছুক্ষণ পর বান্দরনীটা ফোন উঠালো। ঘুম জড়িত কণ্ঠে নূরী বলল, “একটু শান্তিতে কি ঘুমাতেও দিবি না?” আমি উত্কণ্ঠিত স্বরে বললাম, “আজ সাতাশটা রোজা চলে যাচ্ছে। এখনো আমার ঈদের শপিং করা হয়নি।” বেশ বিরক্ত ও রাগ নিয়ে নূরী বলল, “তো যা নারে, শপিং করে ফেল। আমাকে কেন জ্বালাচ্ছিস?” এবার আমিও রেগে গেলাম। রোজা দশটা যাওয়ার পর থেকেই নূরীকে আমার সাথে শপিংয়ে যাওয়ার জন্য বলছি। কিন্তু কোনো না কোনো বাহানা করে এড়িয়ে যাচ্ছে। ধৈর্যেরও তো একটা সীমা আছে, নাকি? আমি রেগে বললাম, “ঠিক আছে। আমি একাই যাব। আজ তিনটায় ঘর থেকে বের হবো। রাখি।” রাগ করে কেটে দিলাম।
সময়মতো আমি রেডি হয়ে ঘরে বসে আছি। আমি জানি নূরী আসবে। সেজন্য তখন সময়টা ইচ্ছে করেই বলেছি। নূরীর সাথে কলেজ লাইফ থেকে পরিচয়। তবে বন্ধুত্বটা হয় ভার্সিটিতে এসে। ও ছেলেদের সাথে খুব একটা মিশে না। মেয়ে বন্ধুর অভাব নেই তবে ভার্সিটি জুড়ে ওর একমাত্র ঘনিষ্ঠ ছেলে বন্ধু বলতে আমিই। শপিংয়ে ওকে নিতে চাচ্ছি কারণ ও ফ্যাশন ডিজাইনার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো তর্কাতর্কিতে নূরী সেরাদের সেরা। একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনাটা আমার আজও মনে আছে। আমি যখন বললাম আমার শার্টের মূল্য এক হাজার টাকা। তখন নূরী বলেছিল এটা বেশি জোর পাঁচশো টাকা হতে পারে। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ নিলো নূরী। এই শার্ট সে ওই দোকান থেকেই পাঁচশো টাকায় কিনবে। সেই চ্যালেঞ্জ পূরণে নূরী আমার সাথে সেই দোকানে এলো। আমি দূরে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখে অবাক হলাম নূরী একই শার্ট মাত্র চারশো টাকায় কিনে আনলো। আমি বোকা হয়ে গেলাম। সেই থেকে আমার শপিংয়ে নূরী সঙ্গী হয়। ওরই কড়া নির্দেশ ছিল যাতে ওকে ছাড়া কেনাকাটা না করি। আমি প্রতিবার ওকে নিয়ে যেতাম। এতে সময়টাও কাটতো, টাকাও বেঁচে যেতো। তারওপর ভালো ও ডিজাইনিং কাপড় কম দামেই পেতাম। কিন্তু এবার কেন জানি একটু ভাব নিচ্ছে। নূরীর ফোন এলো। সে নিচে এসেছে। আমি মুচকি হাসি দিয়ে নেমে এলাম।
নূরীর সাথে যতবারই শপিংয়ে বের হই ততবারই ভয়ের মধ্যে থাকি। এই বুঝি দোকানদারের সাথে ঝগড়া লাগল। তিন হাজার টাকার দরাদরিতে নূরী এক হাজার বলে। আমার বুকটা ধুরুধুরু করে। কিন্তু অবাক হই যখন শেষমেষ দোকানদার জিনিসটা দিয়ে দেয়। আমার তখন খুব রাগ হয়। অহেতুক এত দাম কেন চায়? যার ফলে আমার মতো সহজ সরল টাইপের ছেলেরা বাঁশ খেয়ে যায়। যেমনটা আমি আগে খেতাম। কেনাকাটা শেষ করে সন্ধ্যার কিছুটা আগে আমরা মার্কেট থেকে বেরিয়ে ইফতার করার জন্য একটা রেষ্টুরেন্টে এলাম। মেন্যু লিস্ট দেখে নূরী ৪৯৯ টাকার প্যাকেজ নিলো। আমি বললাম, “একটাতে হবে?” ভেংচি দিয়ে নূরী বলল, “তবুও বেঁচে যাবে।” আমি একটু ইতস্ততঃ হয়ে বললাম, “লোকে হাসবে।” নূরী কিছুটা রাগ নিয়ে বলল, “তোর পেটে ভাত না পড়লে লোকে খাওয়াবে? সঞ্চয় করা শিখ।” আমি চুপ হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর ইফতার দিয়ে গেল। খেয়ে দেয়ে নূরীকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমি আমার বাসায় চলে এলাম। বাবার জন্য পাঞ্জাবি এবং মায়ের জন্য শাড়ি কিনেছি। দুটাই নূরীর পছন্দের। আমি আবার এসব বুঝি না। কাপড়চোপড় দেখে বাবা মা খুব খুশি হলেন। আমার আয়ের একমাত্র উত্স টিউশন। পরিবারের দায়িত্ব বাবার কাঁধেই। আমি শুধু আমার হাত খরচ ও পড়ালেখার খরচটা চালাই। বুঝার পর থেকে লজ্জায় বাবার কাছে হাত খরচ চাইনি। তবুও বাবা মাঝেমাঝে হাত খরচ ধরিয়ে দেন। বাবারা বোধহয় এমনই।
ঈদের দিন সকালেই নূরীর ফোন। বিকালে আমার সাথে ঘুরতে যাবে। যদিও এটা গত দু'বছর ধরে আমার জন্য এক ধরণের শিডিউল হয়ে গেছে। বিকালে আমরা ঘুরতে বের হলাম। পাহাড়ে ঘুরতে এসেছি। অনেক হেঁটে পাহাড়ের একদম উঁচু স্থানে এলাম। সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে নূরী বলল,
“আচ্ছা তোর ফিউচার প্ল্যান কি?”
- ব্যাংকার হবো। এই তো রেজাল্ট বের হবার পর কিছু ব্যাংকে ইন্টারভিউ দিব।
কিছুটা কটমট চোখে নূরী বলল, “আরে গাধা বিয়েশাদীর কথা জিজ্ঞেস করছি।”
- তা নিয়ে এখনো ভাবিনি।
- বিয়ে করার ইচ্ছে আছে নাকি ছ্যাঁকা খেয়ে বেকা হয়ে গেছিস?
- করবো, তবে পরে। তুই?
- খুব শীঘ্রই।
- দাওয়াত দিস কিন্তু।
নূরী মুচকি হেসে বলল “তোকে তো দিবোই।”
আমরা পাহাড় থেকে নেমে আসলাম। আশ্চর্য ব্যাপার আজ নূরী বাসায় যাওয়ার কথা বলছে না। অন্যান্য দিন যতোই কাজ থাকুক না কেন সন্ধ্যার আগে নূরী বাসায় চলে যেতো।
- কিরে বাসায় যাবি না?
- কেন? তোর তাড়া আছে?
- সন্ধ্যা হয়ে এলো তো।
- তো কি হয়েছে?
আমি কিছুটা জোর করেই নূরীকে বাসায় পৌঁছে দিলাম। এতে নূরী বেশ রাগ করেছে। রিকশা থেকে নামার সময় নূরী রাগ করে বলল, “তোর সাথে আর কোথাও ঘুরতে যাবো না।” ওর রাগ থেকে আমি মুচকি হাসি দিলাম।
কিছুদিন পর,
সকাল সকাল নূরীর ফোন। ওর বাসায় যেতে বলল। এর আগে দু'চারবার কিছু কারণে ওর বাসায় গিয়েছিলাম। তবে আজ এভাবে জরুরী তলব করার কারণ খুঁজে পেলাম না। ওর বাসায় গিয়ে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। নূরী নাকি তার বাবাকে বলেছে সে আমাকে পছন্দ করে। অথচ আমি তাকে বন্ধু ব্যতীত আর কিছুই ভাবি না। নূরীর বাবা খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, “নূরী আমার একমাত্র মেয়ে। ওর পছন্দের দিকে আমি সবসময়ই খেয়াল রাখি। ও তোমাকে পছন্দ করে। তোমার মতামত কি? মেয়ের বিয়েটা আমি খুব শীঘ্রই দিতে চাই।”
নূরীর বাবার কথা শুনে আমার গলা শুকিয়ে গেল। আমি আমতা আমতা করতে লাগলাম। আমাকে অপ্রস্তুত দেখে নূরীর বাবা বললেন, “ঠিক আছে। তুমি তোমার সিদ্ধান্ত পরে জানিয়ে দিও।” আমি বেরিয়ে এলাম। বাইরে রোদের প্রচন্ড গরম। তবুও মনে হচ্ছে এরচেয়ে গরম আবহাওয়া নূরীর বাসায় ছিল। কিছুদূর যেতেই নূরীর মেসেজ এলো। বিকালে দেখা করতে বলেছে। আমি বুঝে উঠতে পারছি না আমি এখন কিভাবে নূরীর সম্মুখীন হব? তবুও হতে হবে। নয়তো নূরী বাসায় চলে আসবে। খুব সাংঘাতিক মেয়ে।
বর্তমানে নূরীর সামনে বসে আছি। রাগে ফুসছে মেয়েটা। নাক-মুখ-চোখ লাল হয়ে আছে। নিঃশ্বাসের সাথেও যেন রাগ বের হচ্ছে। খোলা আকাশের নিচে বসেও আমি গরম অনুভব করছি।
“কি সমস্যা তোর? তখন বাবার প্রশ্নে হ্যাঁ বললি না কেন?” সম্পূর্ণ রাগন্বিত স্বরেই কথাগুলো বলল নূরী।
- আসলে আমি এমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।
- কিসের প্রস্তুতি? তোকে কি পরীক্ষা দিতে ডেকেছিলাম?
আমি আমতা আমতা শুরু করলাম। তা দেখে নূরীর রাগ আরও বেড়ে গেল।
- চুপ। একদম তোতলাবি না।
আমি চুপ করে ঝিম মেরে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ নীরবতা পালিত হলো আমাদের মাঝে। তারপর আমি বললাম, “আচ্ছা তুই যে আমাকে পছন্দ করিস। কখনো ভেবেছিস আমারও তো পছন্দ থাকতে পারে।” বাতাসের ঝাপটায় নূরী তার কানের পাশে আসা চুল গুলো পুনরায় কানের পেছনে গুজে দিয়ে মুখে মিষ্টি একটা হাসি এনে ঢঙ্গী ভাব নিয়ে বলল, “তাই নাকি খোকা? তা তুমি কার কার সাথে চলাফেরা করতে পেরেছ যে পছন্দ হওয়ার মতো মুহূর্ত এসেছে?” এবার আমি চুপ হয়ে গেলাম। আসলেই তো, নূরী আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়ার পর থেকে আমি কখনোই কোনো মেয়ের সাথে চলতে পারিনি। আগে আমার অনেক বান্ধবীই ছিল। নূরীর সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পর ভার্সিটিতে সারাক্ষণ নূরীই আমার পাশে থাকে। আগে অনেক বান্ধবী আসতো লেখাপড়ার বিষয় নিয়ে। কিন্তু নূরী আসার পর তারা সবাই যেন উড়ে গেছে। আমি কোথাও ঘুরতে বের হলে নূরী আমার সাথে থাকে। বাসায় এলেও নূরীর সাথে আমার ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ইমুতে নিয়মিত যোগাযোগ থাকে। সামাজিক মাধ্যমে কোনো মেয়ের সাথে একদিন কমেন্ট বক্সে কিংবা চ্যাট বক্সে কথা হলে। পরেরদিন আর তার নামও খুঁজে পেতাম না। যদিও এসব নিয়ে কখনো ভাবিনি। তবে আজ এসব ব্যাপার মনের মধ্যে দোলা দিচ্ছে।
নূরীর চেহারায় পরিবর্তন এলো। রাগি ভাবটা চলে গেল। এই মুহূর্তে ওর চেহারায় একটা মায়া মায়া ভাব কাজ করছে। ঠোঁট দুটো কিছু বলার জন্য কাঁপছে। চোখের পাতা পিটপিট করছে। আবেগ ভরা সুরে নূরী বলল, “তুমি কখনো লক্ষ্য করেছ কিনা জানি না। তবে আমি সবসময় তোমাকে নিজের কাছে আগলে রেখেছি। তোমার আশেপাশে কোনো মেয়েকে ঘেষতে দেইনি। আমি তোমাকে অনেক আগ থেকেই মনে বসিয়ে দিয়েছি। এই মনে এখন শুধুই তোমার বসবাস। তাই তো বাবাকে বলতে দ্বিধাবোধ করিনি। তবে ভালোবাসা পূর্ণতা পায় দুজনের সম্মতিতে। আমি কথা দিচ্ছি আমি কখনোই তোমার মনে কষ্ট দিব না। এখন বাকিটা তোমার ওপর।” আমি মন দিয়ে নূরীর কথাগুলো শুনলাম। নূরী যে এত আবেগী তা আজ উপলব্ধি করলাম। নূরীর কথায় ভালোবাসি শব্দটা না থাকলেও প্রতিটি লাইনে অসম্ভব আবেগ মিশে ছিল। প্রতিটি লাইনেই ভালোবাসা লুকিয়ে ছিল। দীর্ঘদিন পর নূরী আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করলো। বন্ধুত্বের শুরুতে তুমি বলতো। বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়ার পর আর বলেনি। শান্তশিষ্ট ভাষায় আমি বললাম, “আমি তো মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। আমার সাথে তোকে মানাবে?” নূরী যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। বেশ রাগ নিয়ে বলল, “আসলেই তুমি বোকা। আর কিভাবে বুঝাবো? আমি বাজেটে চলতে পারি। তোমাকে কিন্তু বাজেটে চলতে আমিই শিখিয়েছি। আর হ্যাঁ তুই না তুমি করে বলবা।” আমি মুচকি হাসি দিলাম। বুঝলাম এই মেয়ে পিছু ছাড়বে না। দুজনে মিলে কিছুক্ষণ পড়ন্ত বিকেলটা উপভোগ করতে লাগলাম। রক্তিম আকাশের ডুবন্ত সূর্যটা যখন সন্ধ্যার জানান দিতে শুরু করে তখন নূরীকে বললাম, “সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। চলো, তোমায় বাসায় দিয়ে আসি।” দুজনে মিলে হাঁটা দিলাম। আজ ভীষণ ইচ্ছে করছে নূরীর হাতটা ধরতে। কিন্তু লজ্জার কাছে আমি হেরে যাই। নূরীকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। যাওয়ার আগে নূরী হুঁশিয়ারি দিয়েছে যত দ্রুত সম্ভব তার বাবাকে হ্যাঁ জবাব জানানোর। আমি শুধু মুচকি হাসি দিলাম।
জীবনসঙ্গিনী হিসেবে নূরী একদম । রূপে গুনে মাশাল্লাহ। বাবার একমাত্র মেয়ে হওয়ায় নূরী ছোট থেকেই আরাম আয়েশে বড় হয়েছে। আগে নাকি নূরী বড় বড় রেষ্টুরেন্ট ছাড়া খেতো না। কিন্তু এখন সে সবকিছুই মানিয়ে চলে। হয়তো নূরী মনে মনে আমার সাথে ভবিষ্যৎ সাজিয়ে নিয়েছে। মেয়েটা বাজেটে চলতে শিখেছে। আমিও আগে উল্টাপাল্টা খরচ করতাম। আমাকে নূরীই বাজেট করা শিখিয়েছে। নূরীর কথা বাবা মাকে জানাতে হবে। তবে তার আগে একটা ভালো চাকরি খুঁজতে হবে। রাতের তারাগুলোকে আজ খুব ভালো লাগছে। চাঁদটাও যেন আজ ঝলমলে আলো ছড়াচ্ছে। চাঁদের আলোর মাঝে আমি যেন নূরীর অবয়ব দেখতে পাচ্ছি। বাতাসের মাঝে আছে এক প্রকার প্রশান্তি। পরিবেশ তো বদলায়নি। তবে আজ সবকিছু ভালো লাগছে কেন? হয়তো এরই নাম ভালোবাসা। নয়তো আগে কখনো এমন হয়নি। কেউ একজন বলেছে, “ভালোবাসা যখন আসে, তখন চারপাশটাও ভালো লাগতে শুরু করে।” উপলব্ধি করলাম যে আমার মনটাও নূরীর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।
©somewhere in net ltd.