![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গল্পের নামঃ ভালোবাসার অসহায়ত্ব।
লিখেছেনঃ মোঃ জোবায়ের বাপ্পী।
নতুন সেলোয়ার-কামিজ এখনো বিছানায় পড়ে আছে। দরজায় এসে শেষবারের মতো টোকা দিয়ে সময় জানিয়ে দিলো সামিয়া। নূরী ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলের বিশাল ব্যবসা আছে। দেখতেও বেশ সুদর্শন। যেকোনো মেয়ে চোখ বন্ধ করে রাজি হবে। কিন্তু নূরী রাজি হচ্ছে না। কারণ আসাদের পূর্বে বিয়ে হয়েছে। শুধু বিয়ে নয় পাঁচ বছরের একটা মেয়েও আছে। তাই নূরী এই বিয়েতে রাজি না। কিন্তু নূরীর বাবা আজম তালুকদার এমন পাত্র হাত ছাড়া করতে রাজি নন। তিনি কড়া ভাষায় বলে দিয়েছেন বিয়ে এখানেই হবে। অবশেষে নূরী তৈরি হয়ে নেমে এলো। নামমাত্র দেখা সাক্ষাৎকারের পর্ব পূরণে যাচ্ছে নূরী। সাথে যাচ্ছে তার বড় বোন সামিয়া। যথাসময়ে তারা রেষ্টুরেন্টে এসে বসে আছে। পথিমধ্যে সামিয়া নূরীকে অনেক বুঝিয়েছে আসাদ তার মেয়েকে নিয়ে আসবে। মেয়ের প্রতি যেন একটু স্নেহ দেখায়।
কোলে করে ফুটফুটে পাঁচ বছরের সানজিদাকে নিয়ে রেষ্টুরেন্টে প্রবেশ করলো আসাদ। এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। সামিয়ার ইশারায় তাদের দিকে এগিয়ে এলো। কুশল বিনিময় করে নাস্তার অর্ডার করলো। সামিয়াকে অবাক করে আসাদের কাছে থেকে সানজিদাকে কোলে নিলো নূরী। আসাদও বেশ সানন্দেই দিলো। নূরী অনেক কথা বলতে লাগল ছোট্ট সানজিদার সাথে। ছোট মেয়েটাও যেন একেবারে মিশে গেল সানজিদার সাথে। খুব সুন্দর একটা মুহূর্ত অতিবাহিত করলো তারা। তারপর ফিরে গেল নিজ নিজ নীড়ে। সামিয়া বিস্ময় দেখে নূরী জানালো বিয়ে যখন হবেই তখন মেনে নেওয়াই উত্তম। নূরীরা বাসায় এসে জানতে পারলো সামনের সপ্তাহেই বিয়ে। আসাদ রাজি হয়েছে। এই বিয়ে নিয়ে নূরীর বাবার মত আগেই স্থির ছিল। বাকিটা নির্ভর করছিল আসাদের ওপর। যা আজ হয়ে গেল। নূরী যেভাবে সানজিদার সাথে নিজেকে মিশিয়ে নিতে পেরেছে তাতে আসাদ ভীষণ খুশি হয়েছে। তাই বিয়েটা দ্রুত করে নতুন জীবন শুরু করতে চায়।
বাসরঘরে নূরীর হাতে সানজিদাকে তুলে দিয়ে আসাদ বলল, “আজ থেকে ওর সমস্ত দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। আশাকরি তুমি ওকে পৃথিবীর সমস্ত খুশি দিবে ও আগলে রাখবে।” নূরী মাথা দুলালো। সে বেশ আদরে রাখে সানজিদাকে। সবসময়ই সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। তবে সেটা শুধুমাত্র আসাদের সামনে। আড়ালে দেয় শুধু অবহেলা ও কষ্ট। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করায় না। যত্ন নেয় না। ফুলের মতো যত্নে থাকা মেয়েটার ওপর অযত্নের ছাপ মুহূর্তেই পড়লো। যা আসাদের দৃষ্টিগোচর হলো। সানজিদা আগের তুলনায় শুকিয়ে গেছে। আগের ওর মুখের দিকে তাকালে আসাদের অন্তর জুড়িয়ে যেতো। এখন কষ্টের একটা ভাব অন্তরকে নাড়া দেয়।
নূরী তার সম্পূর্ণটা উজাড় করে দেয় আসাদের প্রতি। তার প্রতি ভালোবাসায় কার্পণ্য করে না। আসাদের সবকিছুতেই খেয়াল রাখে। স্বামী হিসেবে আসাদকে গ্রহণ করলেও মা হিসেবে সানজিদাকে গ্রহণ করেনি। এক রাতে খাবারের সময় সানজিদা এসে তার বাবার কোলে উঠলো। তারপর তার সাথে খেলো। আসাদের অন্তরটা কেঁপে উঠলো। কারণ সানজিদা ধীরে ধীরে সব খাবারই খেয়ে নিলো। যেই মেয়েকে জোর করে খাওয়াতে হয়। সেই মেয়ে চুপচাপ সব খেয়ে ফেলল। যেন সে বহুদিনের ক্ষুধার্ত। অথচ বাসায় এসে সানজিদার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় নূরী বলেছিল খাওয়ানো হয়েছে। এমনটা প্রতিদিনই বলে। তবে কি প্রতিদিনই সানজিদা না খেয়ে থাকে?
পরেরদিন সকালে নূরী ঘুম থেকে উঠতেই বিছানায় কিছু টাকার বান্ডিল দেখতে পেল। নূরী কিছু বুঝে উঠার আগেই আসাদ বলল, “এই হলো তোমার কাবিনের টাকা। ডিভোর্স পেপার তোমার বাসায় চলে যাবে। আমি তোমাকে এই সংসারে এনেছি সানজিদার দেখাশোনার জন্য। কিন্তু তুমি এইটুকু বাচ্চার ওপর যে নির্মম অত্যাচার শুরু করেছ। তা সহ্য করার মতো না। তুমি হয়তো ভেবেছ তোমার মায়ায় পড়ে আমি সানজিদাকে ভুলে যাব। কিন্তু এটা কখনোই সম্ভব নয়। আমি ওর বাবা। ওর প্রতি অবহেলা আমি সহ্য করবো না। তাই তুমি যেতে পারো।” আসাদ চলে গেল। নূরী নির্বাক হয়ে বসে রইলো। এমনটা সে কল্পনাও করেনি। সে ভেবেছিল নিজের ভালোবাসা দিয়ে আসাদকে বন্দী করে ফেলবে। তারপর সানজিদাকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দিবে। কিন্তু এখন তো উল্টো হচ্ছে। রুমের বাইরে সানজিদা ও তার দাদীর শব্দ শুনা যাচ্ছে। সানজিদার দাদা-দাদী গ্রামে থাকেন। আসাদ শত বুঝিয়েও তাদেরকে শহরে রাখতে পারে না। শহরে যেন তারা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারেন না। তাই গ্রামেও আসাদ বেশ বড় বাড়ি করেছে। ইদ কিংবা লম্বা ছুটিতে গ্রামে যায়। সানজিদার দেখাশোনার জন্য সাময়িকভাবে তাদেরকে এনেছে আসাদ। নূরী শ্বাশুড়ী কাছে এসেই কান্নাকাটি শুরু করলো। নিজের অনভিজ্ঞতার কথা বলতে লাগল। সে তো আগে কখনো সন্তান লালন পালন করেনি। তাই সানজিদার যত্নে ত্রুটি হয়েছে। সে ইচ্ছে করে এসব করেনি। সানজিদাকে জড়িয়ে ধরেও নূরী অনেকক্ষণ কেঁদেছে।
আসাদ অফিসে বসে আছে। আজ কাজে মন বসছে না। বারবার শুধু অতীত দোলা দিয়ে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের পছন্দে গ্রামের মেয়ে দিয়াকে বিয়ে করেছিল। তখন আসাদ সবেমাত্র আকাশ ছোঁয়ার যাত্রায় নেমেছিল। দিয়ার সাথে বিয়ের পর সেই যাত্রার গতি যেন আরও দ্রুত হয়েছে। খুব অল্প সময়েই সে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছে। তবে এত কিছুর পরেও সে দিয়াকে সময় দিতে ভুল করতো না। দিয়াকে খুব ভালোবাসতো। শ্যামলার মধ্যেও খুব মায়াবী ছিল। বেশ সুখেই ছিল তাদের সংসার। তাদের ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ঘরে এসেছিল সানজিদা। দুজনের চোখের মণি ছিল। দুজনেই খুব ভালোবাসতো তাকে। কিন্তু তাদের এই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সানজিদার তিন বছর হতেই দিয়া তাদেরকে ছেড়ে চলে যায়। দিয়ার মৃত্যু আসাদের বুকেই হয়েছে। অথচ আসাদ ভাবতেও পারেনি এমন কিছু হবে। প্রচন্ড জ্বর ছিল দিয়ার। ডাক্তারের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিল। রাতে ঘুমানোর সময় দিয়া বারবার বিড়বিড় করে বলেছিল, “আমার সানজিদার খেয়াল রেখো। আমার সানজিদার খেয়াল রেখো।” সারারাত আসাদেরও ঘুম হয়নি। মৃত্যু যে অর্থবিত্ত দিয়ে ধরে রাখা যায় না তা সেদিন আসাদ বুঝেছিল।
পরীর মতো সেজেছে সানজিদা। একদিনেই মেয়ের এমন পরিবর্তন দেখে আসাদ বেশ খুশি হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলো অন্যের সন্তানকে নিজের ভেবে ভালোবাসতে সমস্যা কোথায়? এই মেয়েটাই এতদিন নূরীর নির্যাতনে শুকনো ফুলের মতো ছিল। আর আজ দাদীর ভালোবাসায় একেবারে ফুটন্ত ফুলের মতো জেগে উঠেছে। সানজিদাকে কোলে নিয়ে ডাইনিং রুমে আসতেই অবাক হয়ে গেল আসাদ। নূরী খাবার পরিবেশন করছে। তা দেখে আসাদ তার মাকে ডাক রাগারাগি শুরু করলো। আসাদের মা তাকে বুঝালো যে, এসবই ভুল বুঝাবুঝি। সন্তান লালন পালনে নূরী অনভিজ্ঞ। তাই এমন হয়েছে। এই কয়েকদিন তিনি থেকে সবকিছু শিখিয়ে দিবেন।
আসাদ আর কোনো তর্কে যায়নি। রাতে খাবার শেষে সবাই শুয়ে পড়লো। আসাদের কাঁধে আলতোভাবে হাত রেখে নূরী বলল, “সকালে তুমি ওভাবে বললে কেন? আমি হয়তো সানজিদার দেখভালে ভুলে করেছি। তাই বলে তুমি ওমন কথা বলবে?” আসাদ কিছু বলল না। চুপচাপ শুয়ে রইলো। নূরী আরও বলল, “আমাকে বুঝাতে তো পারতে। আমি তো ওকে মেনেই তোমাকে বিয়ে করেছি।” নুরী আরেকটু কাছে এলো। ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলো। তা দেখে আসাদ বলল, “তুমি যদি ভাবো কাছে এসে মন জয় করতে পারবে। তবে সেটা তোমার ভুল ধারণা। আমি স্ত্রী চাই না, আমার মেয়ের জন্য একটা মা চাই। তোমার এসব জাদু বন্ধ করো।”
- আশ্চর্য! তোমার কাছেও কি আসা যাবে না? আমি তো মেনেছি আমি ভুল করেছি। তবে তুমি এই ব্যাপারটা বাবাকে বলে ঠিক করোনি। এসব আমাদের স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার। আমাদের মাঝে ভুলত্রুটি হবে। তা আমরাই সংশোধন করবো। এখানে তৃতীয় পক্ষ আসবে কেন? আচ্ছা যাইহোক আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। আমাকে কি আরেকবার সুযোগ দেওয়া যায় না? আমি এবার সানজিদার দেখাশোনায় কোনো ভুল করবো না।
- সুযোগ দিয়েছি বলেই ঘরে আছো। এখন চুপচাপ ঘুমাও। নয়তো সানজিদা উঠে যাবে।
নূরী চুপচাপ শুয়ে পড়লো। সকালে আসাদ যাওয়ার পর আরেক হুলস্থুল কাণ্ড ঘটেছিল ঘরে। আজম তালুকদার এসেছিলেন ঘরে। তিনি যেন নূরীকে জ্যান্ত পুতে ফেলতেই এসেছেন। যেই মেয়ে একটি বাচ্চাকে কষ্ট দেয় সেই মেয়েকে তিনি বাঁচিয়ে রাখবেন না। নূরী তো ভয়ই পেয়েছিল। কিন্তু শ্বাশুড়ীর হস্তক্ষেপ বেঁচে যায় নূরী। নয়তো আজম তালুকদারের হাত থেকে তাকে কেউ বাঁচাতে পারতো না।
সেদিনের পর থেকে নূরীর মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেল। সানজিদার দেখভালে কোনো ত্রুটি করে না। আসাদের বাবা মা কিছুদিন পর চলে যান। এবার আর সানজিদা শুকনো ফুলের মতো হয়নি। একেক দিন সানজিদাকে একেক ভাবে সাজায় নূরী। শিশুদের একটি স্বভাব তারা যার কাছে বেশি ভালোবাসা পায় তার কাছেই বেশি ভীড়ে। সানজিদাও এখন সারাক্ষণ নূরীর পিছু পিছু থাকে। সময় যতো গেল সানজিদা ততোই মা পাগল হয়ে উঠলো। নূরীকে ছাড়া সে ঠিকমতো খায় না‚ ঘুমায় না‚ গোসল দেয় না। মোট কথা নূরীকে ছাড়া সে কিছুই করে না। দুজনের এমন ভালোবাসা দেখে আসাদ খুব খুশি হয়।
আসাদ জুমার নামাজ পড়ে টেবিলে বসেছে। নূরী খাবার পরিবেশন শুরু করেছে। আসাদ খাওয়া শুরু করলো। নূরী সানজিদাকে খাইয়ে দিতে লাগল। আসাদের এই মুহূর্ত গুলো খুব ভালো লাগে। খাবার শেষে আসাদ বিশ্রামের জন্য শুয়েছে। এমন সময় সানজিদা এসে ধপাস করে আসাদের বুকে ঢুকে পড়লো। তারপর বলল‚ “বাবা, ঘুলতে যাবো। কতদিইইইইন ঘুলতে যাই না।” অতঃপর তৈরি হয়ে তিনজন একত্রে ঘুরতে বের হলো। শিশুপার্কে এলো। সানজিদাকে ঘোড়ায় চড়াল, দোলনায় ঘুরালো, ট্রেনে ঘুরালো। অনেক ঘুরাঘুরি শেষে সন্ধ্যায় তারা ঘরে ফিরলো। সানজিদা-নূরীর মুখ থেকে আজ হাসি যেন নামছেই না। এটা দেখে আসাদেরও বেশ ভালো লাগছে। ঘরের মেয়েরা হাসিখুশি থাকলে ঘরটাও যেন হাসতে থাকে। রাতে খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লো। সানজিদাকে ঘুম পাড়িয়ে নূরী আসাদের কাছে এলো। তার বুকে মাথা রাখলো। আসাদও নূরীর চুলে বিলি কাটতে লাগল। মুচকি হাসির সুরে আসাদ বলল, “বুদ্ধি তো তোমার ভালোই।” নূরী চমকিত হয়ে বলল, “মানে? কিসের বুদ্ধি?”
- এই যে দুপুরে সানজিদার মাধ্যমে ঘুরার কথা বলালে।
নূরী মুচকি হাসি দিলো। আসাদ আবার বলল, “তোমার কোনো আবদার থাকলে তা আমাকে সরাসরি বলতে পারো। স্বামী হিসেবে তোমার আবদার পূরণ করা আমার দায়িত্ব।” নূরী তাতক্ষণিক কিছু বলল না। নিজেকে আসাদের মাঝে আরেকটু ডুবিয়ে দিলো। কিছু সময় পর বলল, “আমরা তো আরেকটা সন্তাম নিতে পারি, তাই না?” আসাদ স্বাভাবিক ভাবে বলল, “আরও পরে। সানজিদা আরেকটু বড় হোক।”
সেদিনের পর আর এই নিয়ে তাদের মাঝে কথা হয়নি। নূরী মন দিয়ে সানজিদার দেখভাল করতে লাগল। সময়মতো সানজিদাকে পাশ্ববর্তী এক স্কুলে ভর্তি করা হলো। নূরী সকালে নিয়ে যায় আর দুপুরে নিয়ে আসে। সার্বক্ষণিক নূরী স্কুলেই থাকে। মাঝেমাঝে সানজিদা কান্নাকাটি করে। তখন নূরী তার পাশে বসে। বাকি বাচ্চাদের উদাহরণ দিয়ে তাকে বুঝায়। ধীরে ধীরে সানজিদা স্কুলে অভ্যস্ত হয়ে যায়। গ্রীষ্মের বন্ধে নূরী সানজিদাকে নিয়ে বাপের বাড়ি আসে। আসাদ তাদেরকে রেখে চলে যায়। কিছুদিন পর এসে নিয়ে যাবে বলে দেয়। নূরী ও সানজিদার মাঝে মা-মেয়ের বন্ধন দেখে তার পরিবারের সবাই বেশ খুশি হয়। সবচেয়ে বেশি খুশি হন আজম তালুকদার। নূরী ও সামিয়া রান্না করছে। দুজনে মিলে নিজেদের বৈবাহিক জীবনের নানান কথাবার্তা বলছে। এক পর্যায়ে সামিয়া বলল, “তুই না একদম বোকা। দুলাভাইকে এখনও হাত করতে পারলি না। কেমন মেয়ে তুই?”
- সে সানজিদা ছাড়া কিছু বুঝে না। নারী মোহ তাকে স্পর্শ করে না।
- একটা বাচ্চা নিয়ে নে। তারপর দেখবি সব হাতে চলে এসেছে।
- কিছুই আসবে না। তার কাছে সানজিদাই সব।
সময় চলতে লাগল তার গতিতে। সানজিদা এখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। নূরীকে ছাড়া সে কিছু বুঝে না। মা পাগল মেয়ে। সানজিদা আজও জানে না তার আসল মা কে। তার কাছে নূরীই তার মা। নূরীও তাকে ঠিক সেইভাবে ভালোবেসেছে। আজ সানজিদার জন্মদিন। রাত বারোটা বাজতেই নূরী তাকে উইশ করলো। ঘুমু ঘুমু চোখে সানজিদার চোখ ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে খুশিতে নেচে উঠলো। তারচেয়েও বেশি খুশি হয়েছে আসাদ। সেও উইশ করতে প্রস্তুতি নিয়েছিল কিন্তু তার আগেই নূরী উইশ করে দিয়েছে। ছোট একটা কেক কেটে তারা জন্মদিন উদযাপন করলো। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়লো। তবে কিছুক্ষণ পর নূরী জেগে উঠলো। আসাদকে ডাক দিলো।
- শুনছো?
- হু।
- ঘুমাওনি?
- তুমিও তো ঘুমাওনি।
- আজকের দিনটা আনন্দের তাই না?
- হুম। তুমি আমাকে সত্যিই চমকিয়ে দিয়েছ।
- আরও চমকে দিবো।
- আর কি কি পরিকল্পনা করেছ?
- হা হা হা। এখন বলবো না। তাহলে তো চমক থাকবে না।
সকাল হতেই ঘরে আয়োজনের তোড়জোড় শুরু হলো। সানজিদার জন্মদিন পালন করা হবে। তাই ঘরটা সাজানো হচ্ছে। খুব কাছের কিছু মানুষদের দাওয়াত করা হয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই নূরীর পরিবারের সবাই হাজির হলো। অনুষ্ঠান শুরুর আগ মুহূর্তে নূরী চুপিচুপি আসাদকে বলল‚ “তুমি বাবা হতে চলেছো।”
- সত্যি?
- হু।
- সত্যিই চমকিয়ে দিলে। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি।
অল্প বিস্তারের মধ্যে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে অনুষ্ঠান শেষ হলো। অনুষ্ঠানের সময় আসাদ খবরটা পরিবারের সবাইকে দিলো। নূরীর পরিবারের সবাই বেশ খুশি হলো। ভাই আসবে বলে সানজিদাও খুশি। সময় যতো যেতে লাগল নূরী ততো সাবধানতা অবলম্বন করতে লাগল। আসাদ লক্ষ্য করলো ইদানিং নূরী আগেরমত সানজিদার দেখাশোনা করে না। তবে ব্যাপারটা আসাদ আমলে নিলো না। ভাবলো এমন সময় মেয়েদের নানারকম জটিলতা দেখা দেয়। তেমনই কিছু হয়েছে নূরীর। কিছুদিন পর নূরীকে তার বাবার বাড়ি রেখে এলো। সাথে সানজিদাকেও। এর কিছু সপ্তাহ পরেই নূরী এক ফুটফুটে ছেলে জন্ম দিলো। আসাদ পুরো হাসপাতাল জুড়ে মিষ্টি বিতরণ করলো। কিছুদিন পর নূরীকে বাসায় নিয়ে এলো। ছেলের নাম রাখা হলো সাজেদ। দিন যতো যেতে লাগল আসাদের মনের আশংকা ততো বাড়তে লাগল। প্রথম থেকে সে যা ভেবেছিল দিন-কে-দিন সেটাই সত্য হতে যাচ্ছে। সানজিদা এখন নূরীর ধারেকাছেও ঘেষতে পারে না। সাজেদের সাথে খেলতে পারে না। এসবে আসাদ এক অশনিসংকেত পেতে লাগল। আসাদ বড় সোফায় হেলান দিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে। সানজিদা এসে তার বুকের ওপর আছড়ে পড়লো। আসাদ বেশ চমকে উঠলো। খানিকটা ব্যাথাও পেয়েছে।
- কি হয়েছে আমার মামনির? এভাবে কাঁদছো কেন?
- মা আমাকে ভাইয়ার কাছে যেতে দেয় না। কোলে নিতে দেয় না। মা বলে ও নাকি আমার ভাই না। মা এমন কেন করছে? তুমি মাকে ডাক্তার দেখাও। মার মনে হয় অসুখ হয়েছে। আমি টিভিতে দেখেছি মানুষের বড় অসুখ হলে সে উল্টাপাল্টা কথা বলে।
আসাদ তাকে শান্ত্বনা দিতে লাগল। সানজিদাকে ঘুম পাড়িয়ে তার রুমে শুইয়ে দিলো। তারপর নিজেদের রুমে এলো।
- তুমি এসব কি শুরু করেছ?
নূরী কোনো জবাব দিলো না।
- আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি।
- চেচাচ্ছো কেন? দেখছো না আমি সাজেদকে ঘুমা পাড়াচ্ছি।
- আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না। কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করো না।
- কি সিদ্ধান্ত নিবে? ডিভোর্স দিবে এই তো? দাও। আমি এখন আর এসবের তোয়াক্কা করি না। ঘুঘু দেখছো কিন্তু ঘুঘুর ফাঁদ দেখোনি।
- মানে?
- আমার সোজাসাপটা কথা শুনে নাও। যদি সংসারে শান্তি চাও। তবে সানজিদাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দাও। আমি ওকে আর এক মুহূর্ত সহ্য করবো না। এতগুলো বছর আমি ওর পেছনে নষ্ট করেছি। আর না। আমি এতদিন চুপ ছিলাম। কারণ আমার কোনো খুঁটি ছিল না। সাজেদ আমার খুঁটি হয়ে এসেছে। তুমি কালই সানজিদাকে হোস্টেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। নয়তো খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি।
নূরীর কথা শুনে রাগে আসাদের শরীর কাঁপতে লাগল। নূরীর এমন রূপ দেখবে তা সে কল্পনাও করেনি। তবে কি এতদিন ধরে নূরীর যে রূপটা দেখেছিল সেটা শুধুই অভিনয় ছিল?
মেয়ের এমন রূপ দেখে আজম তালুকদারও বিস্মিত হয়ে গেলেন। যেই মেয়ে তাকে বাঘের মতো ভয় পেতো আজ সে কঠোর চোখে বলছে, “আমার বৈবাহিক জীবনে তুমি নাক গলিয়ো না।” আসাদ নিরুপায় হয়ে শ্বশুরের কাছে গিয়েছিল। তাকে বিস্তারিত সব বলেছিল। তাই তিনি নূরীর সাথে কথা বলার জন্য এসেছেন। কিন্তু নূরীর কথা শুনে তিনি বিস্মিত হয়ে গেলেন। অবশেষে তিনিও পারলেন না নূরীকে দমাতে। নূরী সরাসরি হুমকি দিয়েছে যদি গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করে তবে মামলা করতে সে দ্বিতীয়বার ভাববে না। এমনকি সে থানায় একটা জিডি-ও করে রেখেছে। তালাকের ব্যাপারে আসাদ যেতে চাচ্ছে না। তালাক এখন সমস্যার সমাধান হতে পারে। সানজিদার জন্য নূরী তার মা। এছাড়াও সাজেদ তো তারই সন্তান। নূরী এটাও বলেছে যে তালাক দিলে সে সাজেদকে নিয়ে যাবে। সে শিক্ষিত তাই চাকরি জোগাড় করতে তার অসুবিধা হবে না। প্রয়োজনে সে দ্বিতীয় বিয়েও করবে। যৌবন তো আর ঢলে যায়নি। আসাদ ভেবেই কূল পাচ্ছে না এতদিন সে কার সাথে সংসারী করেছে! এই নূরী তো সেই নূরী না। তবে নূরীর এসব আচরণের পেছনে কোনো পর-ছায়ার আছে? তার অগোচরে নূরী কিছু করছে নাতো?
আসাদ অনেকটাই বাধ্য হয়ে সানজিদাকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠালো। বুকের ওপর পাথর বেঁধে সে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সানজিদাকে হোস্টেল পাঠাতেই নূরীর ব্যাপক পরিবর্তন এলো। সে আবার পূর্বের মতো আচরণ শুরু করলো। আসাদের জন্য সকাল সকাল নাস্তা বানায়, তার শার্ট প্যান্ট আয়রন করে রাখে, ঘরের প্রতিটি কোণা গুছিয়ে রাখে। সাজেদকে নিয়ে সারাক্ষণ খেলা করে। সময় সুযোগ পেলে বাবার বাড়ির লোকজনের সাথে ফোনে হেসে-খেলে কথা বলে। প্রতিটি রাতে আসাদের বুকে মাথা রেখে ঘুমায়। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে স্বাচ্ছন্দ্যে আসাদকে বলে। নূরীর হাবভাব এমন যেন এতদিন কিছুই হয়নি। ঘরের দিকে তাকালে মনে হয় পৃথিবীর অন্যতম সুখী পরিবারের মধ্যে এটি একটি।
আজ প্রায় মাস দুয়েক পর সানজিদা বাড়িতে এসেছে। আসাদ অনেক আকুতি মিনতি করে নূরীকে শান্ত রেখেছে। বলেছে, “মাত্র এক সপ্তাহের ব্যাপার এরপর সানজিদা চলে যাবে। দয়াকরে এই কটা দিন শান্ত থাকো।” নূরী প্রত্যক্ষভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও পরোক্ষভাবে সানজিদাকে কষ্ট দেয়। তাকে নিয়ে ঘরের কাজকর্ম করায়। ঠিকমতো খাবার দেয় না। আসাদ এসব সহ্য করতে না পেরে তৃতীয় দিনেই সানজিদাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেয়। নূরীর এমন রুক্ষ স্বভাবের প্রভাব সাজেদের ওপর পড়ে। পরিবারের কেউই সাজেদকে খুব একটা আদর যত্ন করে না। নানা-নানী, দাদা-দাদী কেউই সাজেদকে দেখতে আসে না। আসাদও খুব একটা কাছে আসে না। সাজেদের আগমনেই নূরীর এমন পরিবর্তন ঘটে। তাই আসাদের অবচেতন মন এসবের জন্য সাজেদকে দায়ী ভাবে। তাই সে পিতৃ স্নেহ দেয় না। তবে এসবে নূরীর কিছু যায় আসে না। সে একাই সাজেদকে ভালোবাসা দেয়। সাজেদ যতো বড় হতে লাগল তার মধ্যে ভালোবাসার অভাব ততো বাড়তে লাগল। মায়ের ভালোবাসা তো বাবা, দাদা-দাদী, নানা-নানীর ভালোবাসার অভাব পূরণ করতে পারে না। এত সব অভাবের মাঝে সাজেদ আরেকটা ভালোবাসা পায়। সেটা হলো বোনের ভালোবাসা। সানজিদা যখনই ছুটি নিয়ে বাসায় আসে তখনই সুযোগ পেলে সাজেদের সাথে সময় কাটায়। তার কাছে তো সাজেদ তার ভাই-ই। নূরীও কিছু বলে না। এতে তার উপকার হয়। রান্নাবান্নার সময় সাজেদের দেখাশোনা হয়। সাজেদও সানজিদার সাথে আনন্দে খেলে। সানজিদার কাছে সে নতুন নতুন জিনিস শিখে। চোখ বাকিয়ে তাকানো‚ মুখ গোল করে আফুউউ বলা, সানজিদার পিঠে ঘোড়ায় চড়া ইত্যাদি। ইদানিং নূরী লক্ষ্য করেছে সানজিদার অনুপস্থিতিতে সাজেদ মুখ গোল করে আফুউউ আফুউউ বলে কাঁদে। যতদিন সানজিদা কাছে থাকে ততদিন সাজেদ আনন্দে থাকে। কিন্তু সানজিদা চলে যেতেই সাজেদের আনন্দও চলে যায়। নূরী যতোই চেষ্টা করে না কেন সাজেদের হাসিমুখ ফেরাতে পারে না। এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করেও সাজেদের মুখে হাসি ফোটানো যায় না। সে সারাক্ষণ আফুউ আফুউ করে। ব্যাপারটা লক্ষ্য করায় নূরীও সানজিদাকে নানান বাহানায় বাসায় আনায়।
বাড়িতে সানজিদা স্থায়ী হলো সাজেদের ষষ্ঠ জন্মদিনে। সেবার জন্মদিনের অনুষ্ঠানের পর সানজিদা যখন হোস্টেল যাওয়ার জন্য রওনা দিলো তখন সাজেদ বাধা হয়ে দাঁড়ালো। সে কোনো ভাবেই সানজিদাকে যেতে দিবে না। আপু আমাদের সাথে থাকবে বলে কেঁদে কেঁদে পুরো ঘর মাথায় তুললো। অনেক বুঝানোর পরেও শান্ত হলো না। বরং কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ হওয়ার উপক্রম। নূরী সবকিছু সহ্য করতে পারলেও সাজেদের কান্না সহ্য করতে পারে না। অবশেষে নূরী বলেই দিলো, “ঠিক আছে তুই আজ থেকে এখানেই থাক। পড়ালেখা বাসায় থেকেও করা যায়। আমি ওই রুমটা তোর জন্য গুছিয়ে দিচ্ছি।” এই কথাগুলো শুনে অজস্র প্রশান্তি পেয়েছে আসাদ। এই কথাগুলোই যেন সে এত বছর ধরে শুনতে চেয়েছিল। সানজিদার প্রতি নূরীর ব্যবহার আগেরমত নেই। খুব স্বাভাবিক ব্যবহার। মায়া মমতা না দেখলেও আগেরমত কঠোর ব্যবহার করে না। তবে এসবে সানজিদার কিছু যায় আসে না। সে সাজেদকে নিয়ে হাসিখুশি থাকে। সন্তানদের দিকে তাকালে আসাদ বুঝতে পারে ভালোবাসায় শক্তি আছে। তাই তো সানজিদা আজ এই ঘরে ফিরতে পেরেছে। বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসার টান, ছেলের প্রতি মায়ের ভালোবাসার টান। এই দুই ভালোবাসার টানের জয় হয়েছে। হয়তো তার ভালোবাসার কোথাও খুঁত ছিল। তাই তো সে নূরীকে ফেরাতে পারেনি।
বেশ কিছু দিন ধরে আসাদ শান্তিতে ঘুমায়। কিন্তু তার এই শান্তির ঘুম এক রাতে নষ্ট হয়ে গেল। শান্ত গলায় নূরী বলল, “তোমার সব স্বয়-সম্পত্তির মালিক কিন্তু আমার ছেলে। তবে আমি অন্যায় করবো না। নূরীর বিয়ের জন্য লাখ পাঁচেক ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে বাদবাকি সবকিছু সাজেদের নামে লিখে দিবে। কবে দিবে সেটা তুমিই ভেবে নাও। তবে এই মাসের মধ্যেই দিতে হবে। আমি ঘরে অশান্তি চাই না। যদি তুমিও না চাও তবে কাজটা দ্রুত সেরে ফেলো।” আসাদের ইচ্ছে করছিল নূরীকে কষে থাপ্পড় দিতে। কিন্তু এক অসহায়ত্বের কারণে তা পারলো না। নূরীকে সে চিনতে পারেনি। কখনোই পারেনি। আসাদ উঠে পড়লো। অশান্ত মনে ঘুম আসে না। সে বারান্দায় এসে কাঁদতে লাগল। নীরবে ভীষণ কাঁদতে লাগল। এই মহাবিশ্বে সে খুব একা। ভীষণ একা।
সমাপ্ত।
©somewhere in net ltd.