নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিখতে জানতে ও ছড়িয়ে যেতে চাই।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী

আমি বাপ্পী। জন্মস্থান বরিশাল। বেড়ে উঠা চট্টগ্রাম।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পের নামঃ ভালোবাসার বিজয়।

১৬ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ৭:০১

গল্পের নামঃ ভালোবাসায় বিজয়।
লিখেছেনঃ মোঃ জোবায়ের বাপ্পী।

মোবাইলের অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলো আসাদের। ঘড়িতে ৪ টা বেজে ৪৫ মিনিট। এখন ফজরের জামাত ০৫টা ১৫ মিনিটে। উঠবে উঠবে করে সে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠে তার ঘুম পুরোপুরি ভেঙে গেল। চোখে মেলে তার স্ত্রী নূরীকে দেখতে পেল। ভোরের পাখির মতো সুকণ্ঠে ডাকছে নূরী, “কি হলো উঠবে না? সময় চলে যাচ্ছে তো।” আসাদ উঠে বসলো। সাধারণত ভোরবেলায় সে গিয়ে নূরী ডাকে। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম হলো। আসাদের এই ছোট বাড়িতে তারা আলাদা আলাদা ঘুমায়। বড় মেয়ে নদীকে নিয়ে নূরী ভেতর রুমে ঘুমায়। আর ছোট ছেলে সাগরকে নিয়ে আসাদ সামনের রুমে ঘুমায়। নূরীর রুমের দরজা বন্ধ থাকে। মেয়ে কিশোরীতে পদার্পণের পর থেকেই একটা নতুন রুমের প্রয়োজনবোধ করছে আসাদ। কিন্তু আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তা পূরণ করতে পারছে না।
আসাদ চুপচাপ বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লো। জামাতের সময় শেষের দিকে। তাদের বাড়িতে মসজিদ থাকলেও সেটা তার বাড়ি থেকে মিনিট দশেকের পথ। এখন আর গিয়েও নামাজ পাওয়া যাবে না। তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো নামাজ ঘরেই পড়বে। নূরীকে নিয়ে কল পাড়ে এসে অযু করলো। আসদ লক্ষ্য করলো নূরীকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। মনেই হচ্ছে না দুই সন্তানের জননী। মনে হচ্ছে সদ্য ঘরে আসা নতুন বউ। চেহারায় যেন উজ্জ্বলতা হঠাৎই বেড়ে গেছে। আসাদ বিস্মিত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। নূরীর কথায় তার ধ্যান ভাঙলো, “আমাকে পরেও দেখতে পারবে। ফজরের সময় চলে যাচ্ছে।” ধরা পড়ায় আসাদ ভীষণ রকমের অস্বস্তিতে পড়লো।

জায়নামাজ দুটো পাশাপাশি বিছানো হলো। এটাও নিত্যদিনের থেকে ব্যতিক্রম ঘটনা। সচরাচর নূরী নিজ রুমে নামাজ পড়ে। আসাদ অনুযোগ করে নূরীকে তার রুমে যেতে বলায় নূরী হালকা হাসি দিয়ে বলল, “স্বামী স্ত্রী পাশাপাশি নামাজ পড়া যায়। হাদীসে আছে।” হাদিসের কথায় নাকি নূরীর হাসির কারণে তা ঠিক বুঝতে পারলো না আসাদ, তবে সে আর অনুযোগ করলো না। নূরী হালকা পেছনে দাঁড়িয়েছে। নামাজ শেষে নূরী কোরআন এনে বলল, “তুমি চাইলে আমার কোলে মাথা রেখে তিলাওয়াত শুনতে পারো।” আসাদ বড় বড় চোখ করে তাকালো। নূরী আবার বলল, “স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে তিলাওয়াত করা যায়, শোনা যায়। এসব হাদীসেরই কথা। এতে দুজনের মধ্যে মহব্বত বাড়ে।” আসাদ চুপচাপ একটা পাটি বিছিয়ে নূরীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। এতো শ্রুতিমধুর তিলাওয়াত যে, আসাদ মন দিয়ে শুনেই যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে সে কোনো বাগানে শুয়ে আছে। চারপাশে শীতল আবহাওয়া বইছে। ফুলের সুভাষ তার নাকে এসে দোলা দিচ্ছে। সে মনে মনে কিছুটা বিস্মিত হচ্ছে। এর আগে কখনোই সে নূরীর কোলে মাথা রাখেনি। নূরীও কখনো তাকে কোনো হাদীসের জ্ঞান দেয়নি। বিয়ের এতগুলো বছরেও সে নূরীর প্রতি এতোটা আকৃষ্ট হয়নি যতোটা আজ হচ্ছে। কিন্তু এর কারণ কি? আজ সবকিছুই যেন কেমন সুন্দর লাগছে।

“আব্বা, ও আব্বা উডেন। বেলা হইছে তো। গরু লইয়া মাডে যাইবেন না?” মেয়ের ডাকে আসাদ মিটমিট করে চোখ খুলল। ধপাস করে উঠে বসলো। সে বিছানায় কিভাবে এলো? সে তো মেঝেতে নূরীর কোলে শুয়ে ছিল। তাকে তোলার মতো ক্ষমতা নূরীর নেই। তবে?
- কি হইলো আব্বা? মাথা ব্যাথা করতাছে নি?
আসাদ মাথায় হাত রাখায় নদী এই প্রশ্নটা করলো। আসাদ মাথা নাড়িয়ে বলল, “না মা। তুই যা। আমি আইতাছি।” নদী চলে গেল। আসাদ বাইরে এলো। কোমড়ে শাড়ির আঁচল বেঁধে উঠানে কাজ করছে নূরী। সাথে আছে নদী। পরনে সেলোয়ার কামিজ ও বুকে ওড়না। ওড়না কেন পরতে হয় তা নদী এখনো জানে না। তবে কিছুদিন যাবত্‍ নদীর গলা থেকে ওড়না নামতে দেয় না নূরী। ওড়না এদিক সেদিক হলেই শাসায়।
আপাতত ভোরের ব্যাপারটা মনের মাঝে দমিয়ে রেখে আসাদ গোয়াল ঘর থেকে গরু নিয়ে বেরোলো।

আসাদ দুপুরের খাবারের ফাঁকে সুযোগ বুঝে নূরীকে বলল, “আমি বিছানায় গেলাম কেমনে?” নূরী বোকা বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন সে কিছুই বুঝেনি। আসাদ আবার বলল, “কতা কওনা কেন? তহন আমি বিছানায় গেলাম কেমনে?”
- কহন?
- ফজরে।
- আমি কেমনে কমু? তুমি তো আমারে আইজ ফজরে উডাওনি। অথচ নিজে পড়ছ। আমি জায়নামাজ দেইখাই বুজজি।
আসাদ কিছু বলল না। সকালে যখন সে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করেছিল তখনই তার সন্দেহ হয়েছিল ভোরের ব্যাপারটা হয়তো তার স্বপ্ন। কেননা সে কিছুতেই মনে করতে পারেনি ভোরে নূরী কি পরেছিল, শাড়ী নাকি অন্যকিছু? তারওপর সকালে নূরীর কথায় গ্রাম্য ভাষা ছিল না। তাছাড়া যে নূরী ভোরে তার সামনে ছিল সে ছিল লাবণ্যময়ী, যার দিকে একবার তাকালে বারবার তাকাতে ইচ্ছে করে। তার চোখে অদৃশ্য টান ছিল, সেই চোখের দিকে তাকালেই ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। তার কথার মাঝে মাদকতা ছিল, কথা শুনলেই মনের মাঝে অদ্ভুত নেশা জাগে। কিন্তু এই নূরীর মাঝে সেসবের কিছুই নেই। তবে আসাদ ভেবেই পাচ্ছে না স্বপ্ন এতো বাস্তব হয় কিভাবে? ভোরের প্রতিটি মুহূর্ত তার মস্তিষ্কে এখনো বিচরণ করছে। এ কেমন স্বপ্ন?

সেদিনের পর থেকে প্রতিদিন ভোরে সে নূরীর দিকে খুব মনোযোগ সহকারে তাকায়। এতে নূরী বেশ লজ্জা পায় আবার খুশিও হয়। সলজ্জ ভাবে নূরী বলে, “অমন কইরা কি দেহেন?” আসাদ কোনো জবাব দেয় না। সেদিনের পর সেই নূরীকে আর দেখেনি। ফজরের পর সেই সুরেলা তিলাওয়াত সে আর শুনেনি। স্বপ্ন ভেবে আসাদ ব্যাপারটা ভুলে গেল।
গত মাসে ইরিধান বিক্রি করে বেশ লাভবান হয়েছিল আসাদ। মহাজন থেকে আজ সেই টাকা পেল। সাথেসাথেই ঘর সংলগ্ন করে নতুন একটা রুমের কাজ ধরলো। কাঠের দেয়াল ও টিনের ছাউনি। দিন পনেরোর মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে গেল। নতুন রুমটা নদীর জন্য সাজিয়ে দিলো। তার জিনিসপত্র সব গুছিয়ে সেখানে স্থানান্তর করা হলো। রাতে খাবারের সময় নূরী বলল, “নদী, তুমি আইজ থাইকা নতুন রুমে ঘুমাবা, কেমন?” নদী রাজি হলো না। কেননা রুমটাতে এখনো আলকাতরার গন্ধ আছে। অগত্যা তারা নিত্যদিনের মতো ঘুমালো। ফজরের আযানের সাথে আসাদের ঘুম ভেঙে গেল। সে উঠতেই দেখলো কেউ একজন দরজা খুলছে। আসাদ ভাবলো চোর-টোর নয়তো? সে সজোরে চেঁচিয়ে বলল, “কে রে?”
“আমি।” নূরীর কণ্ঠ শুনে আসাদের ঘোর কাটলো। ঘুমো চোখের কারণে হয়তো চিনতে পারেনি। আসাদ বিছানা ছেড়ে নেমে এসে সন্দেহজনক ভাবে বলল, “এমন চুপেসারে কই যাও?” নূরী হেসে বলল, “তুমি যদি চুপিচুপি নামাজ পড়তে পারো। তবে আমি পারবো না কেন?” আসাদের অবাক হলো। এই সেই মায়াবী হাসি। সেই লাবণ্যময়ী চেহারা। সেই সুরেলা কণ্ঠ। এটা কি তার স্বপ্ন?
দুজনে অযু করে নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শেষে নূরী কুরআন তিলাওয়াত করতে লাগল। আসাদের মনে হতে লাগল এসবই সেদিনের মতো তার স্বপ্ন। আজও সে নূরীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।
সকাল হতেই সে নিজেকে বিছানায় পেল। স্বপ্ন ভেবে আসাদ ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করলো না। কিন্তু সে এই নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়লো। নূরীকে নিয়ে এমন স্বপ্ন দেখার কারণ কি? আসাদ এই নিয়ে গ্রামের বড় হুজুর শরিফুল্লাহর সাথে আলাপ করলো। তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা হিসেবে বললেন, “বিয়ের মূল উদ্দেশ্য শুধু যৌনতা নয়। একে অপরের পাশে থাকা, ভালোবাসা। তোমার স্ত্রীর বয়স হয়েছে। বয়সের সাথে তার লাবণ্যতা কমেছে। সেই সাথে স্ত্রীর প্রতি তোমার ভালোবাসাও কমেছে। যা অনুচিত। তুমি পথভ্রষ্ট হচ্ছো। তাই এমন স্বপ্ন দেখছো।”

নতুন রুমে আলকাতরার গন্ধ সরেছে। নদী খুশি মনে সেখানে ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ দীর্ঘদিন পর আসাদ-নূরী পাশাপাশি শুয়েছে। আসাদ উপলব্ধি করলো তার মনের মধ্যে কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। দীর্ঘদিন পর স্ত্রীকে কাছে পাওয়ার আকাংখা তার মাঝে জাগছে না। তবে কি শরিফুল্লাহ হুজুরের কথাই সঠিক? নূরীর প্রতি তার ভালোবাসা কমেছে? আসাদ অস্বস্তিবোধ করছে। সে বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারলো না। নূরী ঘুমিয়েছে বুঝতেই সে উঠে সাগরের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়লো। তবুও তার ঘুম হচ্ছে না। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে আবার উঠে পড়লো। রুমে এসে দেখলো নূরী নেই। নদীর রুমের ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখলো মেয়েকে জড়িয়ে ধরে নূরী শুয়ে আছে। আসাদের বুকে অনুশোচনার তীর বিঁধতে লাগল। ভাবতে লাগল সে কি নূরীর প্রতি অবিচার করছে? স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে? সেই রাত আসাদ আর ঘুমাতে পারলো না।

অজানা এক অস্বস্তি নিয়ে দিন কাটাতে লাগল আসাদ। আজ আসাদ একা একাই নামাজের জন্য উঠলো। রুম থাকা সত্ত্বেও তারা এখনো পৃথকভাবে ঘুমায়। রুম থেকে বের হতেই নূরীকে দেখে আসাদ থমকে গেল।
- তুমি তো কইছিলা আইজ নামাজ পড়তে পারবা না। তয় উডলা কেন?
নূরী হাসি দিয়ে বলল, “তাতে কি? তোমার পাশে তো থাকতে পারবো।” আসাদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এই সেই হাসি। অযু করে আসাদ নামাজ পড়ে নিলো। নামাজ শেষে সে উঠে যেতে লাগল। নূরী এসে তাকে বসিয়ে দিলো। তারপর নিজে মেঝেতে বসে আসাদকে তার কোলে শুইয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু আসাদ বাধা দিয়ে বলল, “তুমি তো আইজ অপবিত্র।”
- শুনো এসব মূর্খতা বেরিয়ে আসো। হাদীস জানো? বিশ্বনবী (সাঃ) তাঁর স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) এঁর ঋতুবর্তী সময়েও এক চাদরের নিচে শুতেন। আয়েশা (রাঃ) এমতাবস্থায়ও নবীজির মাথা আঁচড়িয়ে দিতেন। তাঁর কোলে মাথা রেখে নবীজি কুরআন তিলাওয়াত করতেন। অতএব আমার কাছে এলে কোনো পাপ হবে না।” আসাদকে টেনে তার কোলে শুয়ালো।
আসাদ প্রতিবারের মতো সকালে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলো। আর মুচকি হেসে ভাবতে লাগল স্বপ্ন কত সুন্দর ও মধুর হয়। তবে তার কাছে এই স্বপ্নটা জীবন্ত স্বপ্ন। ভোরের প্রতিটি স্পর্শ সে সর্বক্ষণ অনুভব করতে পারে।
পরেরদিন ফজরে আসাদ কিছুটা বিস্মিত হলো। সাধারণত লাবণ্যময়ী এই নূরীকে সে কিছুদিন পরপর দেখে। কিন্তু আজ পরপর দু'দিন দেখছে। আসাদ হা করে তাকিয়ে আছে। তা দেখে নূরী মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “কি গো তোমার বুঝি ঘোর কাটে না? সারাক্ষণ হা করেই তাকিয়ে থাকো কেন?”
“কি করবো চোখ যে ফিরে না।” কথাটা বলা মাত্রই আসাদ চমকে গেল। এমন কথা সে আগে কখনোই বলেনি। নূরীর পিছু পিছু কল পাড়ে গেল। আজ সে ফজরের বেশ কিছুক্ষণ আগেই উঠেছে। তাই কল পাড়ে বসে গল্প জুড়িয়ে দিলো। শুরুটা নূরীই করেছে। কিন্তু আসাদ শেষ করতে চায় না। তাই সে নানারকমের কথা বলে যাচ্ছে। নূরীর রূপ-গুনের প্রশংসা করছে। তার কণ্ঠের তারিফ করছে। তার হাসির গুনগান করছে। নূরী শুনছে আর হাসছে। আসাদ অবাক হয়ে দেখছে শুধু। কি সুন্দর এই হাসি! মনোমুগ্ধকর।
কল পাড়ের তিনদিকে শুকনো কলা পাতার বেড়া দেওয়া আর প্রবেশ পথে কালো কাপড়ের পর্দা আছে। হঠাৎ পর্দা উঠিয়ে কেউ প্রবেশ করলো। আসাদ অবাক হলো। তার স্বপ্নের মাঝে আবার কে এলো? নূরীকে দেখে আসাদের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। তাতক্ষণিক আসাদ সামনে তাকালো। কেউ নেই। তার মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। নূরী চেঁচিয়ে বলল, “কার লগে কথা কইতাছিলা? কার লগে এত রংঢংয়ের হাসাহাসি? কার লগে? কার লগে?”

আসাদের ধারণ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এতদিন সে যেটাকে স্বপ্ন ভেবেছে সেটা স্বপ্ন নয়। কিন্তু কি তা সে জানে না। সেই ভোর থেকেই নূরী চিল্লাচিল্লি করছে। কেঁদে কেঁদে বাড়ির লোকজনদের একত্র করেছে। একেবারে পাগলপ্রায় হয়ে গেছে। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কোনো মুমূর্ষু রোগী। নূরীর বাড়ি থেকে তার বাবা তৈয়ব আলী ও ছোট ভাই মাসুদ এসেছে। আসাদ শুকনো মুখ নিয়ে এখনো কল পাড়ের পাশে বসে আছে। সে একটা বিস্ময়ের মধ্যে আছে। নূরীর অভিযোগ আসাদের সাথে কারও অবৈধ সম্পর্ক আছে। বেশ কিছুদিন ধরে সে লক্ষ্য করেছে আসাদ ফজরের সময় চুপিসারে কারও সাথে ফিসফিসিয়ে কথা বলে। আগে দুজনে একত্রে ফজরে উঠতো। কিন্তু এই ফিসফিসানির পর থেকেই আসাদ চুপিসারে ফজরে উঠে। নূরীকে উঠায় না। আজকের ঘটনাটিও উল্লেখ করে নূরী জানালো কল পাড়ে কারও সাথে হাসাহাসি করছিল। তার আগমন টের পেতেই পালিয়েছে মেয়েটা। আসাদকে জেরা করলেও সে কোনো উত্তর দিলো না। এক পর্যায়ে সে উঠে চলে গেল। সবাই ধরে নিলো আসাদই দোষী। নদী-সাগরকে নিয়ে নূরী তার বাবার সাথে বাড়ি চলে এলো।

নূরীর চোখের পানি যেন থামছেই না। বিকাল গড়িয়ে এলো। তবুও সে কেঁদে যাচ্ছে। তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলছে, মা গো আমার সুহের সংসারে কার নজরঢা লাইগলো! এহন আমার এই বাচ্চা দুডার কি হইবো? আমি এহন কই যামু?
নূরী পাগলের মতো বিলাপ করতে থাকে। তাকে কেউ শান্ত করতে পারছে না। পরিস্থিতি শান্ত হলো আছরের নামাজের পরে। যখন শরিফুল্লাহ হুজুর এলেন। তিনি নূরীর পরিবারের সবাইকে বললেন, “আসাদের ওপর পরী ভর করেছে। নূরীর বেশেই পরী তার সাথে দেখা করে। পরীর রূপ কিশোরী নূরীর মতো। পরীর আচরণও খুব আন্তরিক। তার কথায় মায়া মায়া ভাব কাজ করে। স্বভাবতই আসাদ এসবে মুগ্ধ হয়েছে। শুরুতে আসাদ এটাকে স্বপ্ন ভাবতো। একদিন সে আমার কাছেও এসেছিল। আমিও স্বপ্ন মনে করে ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ যখন সে আমার কাছে এসে বিস্তারিত বলল। তখন বুঝলাম ব্যাপারটা ভিন্ন। আমি দোয়া-দুরূদ পড়ে ঝাঁড়ফুঁক দিলাম। ওর ডান হাতে একটা সাদা অবয়ব দেখতে পেলাম। জ্বীন-পরী ধরলে এটা দেখা যায়।” শরিফুল্লাহ হুজুর এই গ্রামের বড় মাওলানা। সবাই তাকে সম্মান ও বিশ্বাস করে। সব শুনে তৈয়ব আলী বললেন, “এখন উপায়?” শরিফুল্লাহ হুজুর নূরীকে ফিরে যেতে বললেন। এমতাবস্থায় আসাদকে একা রাখা বিপজ্জনক। যা করার তিনি খুব শীঘ্রই করবেন বলে আশ্বস্ত করলেন।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার ঠিক আগ মুহূর্তে নূরী তার বাবার সাথে সন্তানদের নিয়ে ঘরে ফিরলো। আসাদ তাদেরকে দেখেও কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। তৈয়ব আলী বললেন, “এইবারের মতোন রাইখা গেলাম। ফের যদি কোনো কিছু হুনি তবে ভুইলো না আমার নাম কিন্তু তৈয়ব আলী।”
নূরী স্বাভাবিকভাবেই রান্নাবান্না করলো। খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়লো। কান্নার স্রোত তার মনের মাঝেই প্রবাহিত হচ্ছে। যতো রকমের দোয়া-দুরূদ জানতো সবই পড়ে আসাদের অগোচরে তার ওপর ফুঁ দিয়েছে। সে নিজেকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলো না। তবে আসাদের চোখে ঘুম নেই। কিছুক্ষণ বিছানায় নড়চড় করার পর উঠে পড়লো। সাগরের রুমে এসে পায়চারী করতে লাগল। মনে মনে যা আশা করেছিল তাই হলো। লাবণ্যময়ী নূরী তার সামনে হাজির।
- কে তুমি? আমার সাথে এমন করছো কেন?
লাবণ্যময়ী নূরী এসে আসাদের সন্নিকটে উপস্থিত হলো। আসাদ যেন মায়াজালে বন্দী হয়ে গেল। সে তাকিয়ে আছে শুধু। নূরী তার ঠোঁট দুটো আসাদের কানের কাছে এনে বলল, “আমি তোমার ভালোবাসা। তুমি কি আমায় ভালোবাসো না?” আসাদ অজান্তেই মাথা দুলালো। অতঃপর তারা পরম চুম্বনে আবদ্ধ হলো।

ফজরের আজানের পরেই আসাদের ঘর থেকে নূরীর আর্তনাদের শব্দ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়লো। সবাই এসে উপস্থিত হলো। আসাদ মেঝেতে পড়ে আছে। অজস্র ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। নদীকে পাঠানো হয়েছে শরিফুল্লাহ হুজুরকে ডাকতে। সাগর তার মায়ের আঁচল ধরে পাল্লা দিয়ে কাঁদছে।
বাড়ির সামনে উপস্থিত হলো নূরীর ভাই মাসুদ। তার সাথে আছে দুজন শহুরে লোক। নাম আরিফ ও বাপ্পী। তারা এসে একটা বক্স থেকে কিছু যন্ত্রপাতি বের করে আসাদের হাত-পা, মাথা ও বুকের বাম পাশে লাগালো। তার জাতীয় জিনিসগুলো একটা মনিটরের সাথে সংযুক্ত। মাসুদের কারণে কেউ বাধা দিলো না। মাসুদ বলেছে এরা (দুজন) অস্বাভাবিক-ভৌতিক ও জ্বীন-পরীর আছর এসব নিয়ে কাজ করে।
আসাদের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে কখনো ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে আবার কখনো থেমে থেমে। বাপ্পী তারগুলো নিয়ে ব্যস্ত। আর আরিফের দৃষ্টি মনিটরে। উদ্বিগ্ন স্বরে আরিফ বলল, “পরিস্থিতি তো ভালো না। ঘর পরিদর্শন করতে হবে।” বাপ্পী একটা যন্ত্র বের করে ঘরের চারপাশে চলাচল করতে লাগল। যন্ত্রটাতে একটা এন্টেনা আছে, মাইক্রো মিটার আছে। যার কাঁটা ডানে বামে ছুটাছুটি করছে। হলুদ ও নীল রঙের দুটো ছোট বাতি আছে। হলুদ বাতিটা জ্বললেও নীলটা আপাতত নিভে আছে। নতুন রুমের দিকে যেতেই নীল বাতিটা জ্বলে উঠলো। বাপ্পী সাথেসাথে আরিফকে ডাকলো। আরিফ বক্স থেকে দুটো বল নিলো। এই বল দুটোতে অতি তেজস্ক্রিয় রশ্মি আছে। যা মানুষের চোখে দৃষ্টিগোচর হয় না। এই তেজস্ক্রিয় রশ্মির ফলে অস্বাভাবিক সবকিছু দৃষ্টিগোচর হয়। বাপ্পী-শরীফ চশমা পরলো। এই চশমা উন্নত মানের অ্যালুমিনিয়াম গ্লাসের তৈরি। তেজস্ক্রিয় রশ্মির ফলে অস্বাভাবিক যা কিছু দৃষ্টিগোচর হয় তা এই চশমার মাধ্যমে দেখা যায়। আরিফ বল দুটো ঘরের মাঝে নিক্ষেপ করলো। বল দুটো বিস্ফোরিত হওয়ার পর তারা ঘরের এদিক সেদিক ভালো করে তাকালো। ঘরের পশ্চিম দিকে একটা অস্বাভাবিক সরু পথ দেখতে পেল। পথটা অত্যন্ত আলোকিয়। কোথাও আসতে হলে জ্বীন-পরীর একটা মাধ্যম প্রয়োজন। এটাই সেই মাধ্যম। বাপ্পী বলল‚ “আমাদেরকে এই আলোক পথ ধরে সেই রাজ্যে যেতে হবে।” শরীফ বলল‚ “কিন্তু এটা ঝুঁকিপূর্ণ।”
- আমাদের এই কাজটাই তো ঝুঁকিতে ঘেরা।
একটা খাট আনা হলো। বাপ্পী সেখানে শুয়ে পড়লো। তার শরীরেও আসাদের মতো তার লাগানো হলো। কিছুক্ষণ পর বাপ্পীও আসাদের ন্যায় নিথর হয়ে পড়লো। শরীফের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দুই মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়িতে উপস্থিত হলো নদী। সাথে আছেন শরিফুল্লাহ হুজুর। তিনি এসে আসাদের অবস্থা দেখে অনুযোগ করলেন। কিন্তু মাসুদ তাকে বুঝালো এটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। শরিফুল্লাহ হুজুর মানতে না চাইলেও বাপ্পীর অবস্থা দেখে তিনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন। বাপ্পী ও আসাদের অবস্থা একই। তাদের গায়ে পানি ঢেলেও তাদেরকে একটুও নড়ানো যাচ্ছে না। শরীফ বলেছে বাপ্পীও সেখানে আছে যেখানে আসাদ আছে। শরীফুল্লাহ হুজুর নিজ কার্যক্রম চালাতে লাগলেন। দোয়া দুরূদ পড়তে লাগলেন।
বেশ কিছুক্ষণ পর বাপ্পী চেতনায় ফিরলো। ঘনঘন শ্বাস নিতে লাগল। হুঁশ ফিরতেই শরীর বেয়ে তরতর করে ঘাম ঝরছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ইট'স লাভ ম্যাটার। আমাদের কিছুই করার নেই।” মাসুদ অনুরোধের সুরে বলল, “কোনো উপায় নেই?”
- আসাদ একটি পরীর রূপে মুগ্ধ হয়ে ভালোবাসায় পড়েছে। পরীও তাকে ভালোবাসে। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই।
চোখে পানি ও কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে নূরী বলে উঠলো, “ও কহনোই অন্য মাইয়ার রূপে পইরবো না। এই মানুষটার লগে আমি আইজ পনেরোটা বছর সংসার করছি। তার চরিত্রডা কেমন তা আমার থাইকা ভালো আর কেউ জানে না।” বাপ্পী ছোট করে বলল, “তবে আপনাদের ভালোবাসাই এর সমাধান।”

আসাদকে নিয়ে নূরী পরী রাজ্যের বাগানের এদিক সেদিক উড়ে বেড়ালো। আসাদ ভালো করেই জানে সে এখন অন্য জগতে আছে। এই নূরী তার নূরী নয়। আসাদ এতক্ষণ ধরে মেয়েটাকে বুঝার চেষ্টা করেছে। মেয়েটার মন ভালো। অবশেষে আসাদ বলল, “আমার এখন যাওয়া উচিত।”
- কোথায় যাবে? এটাই তো আমাদের জীবন।
- এটা তোমার জীবন, আমার নয়।
- যা আমার তাই-তো তোমার।
- না। এটা ভুল।
- তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?
- শুনো‚ তুমি হয়তো ভাবছো আমি তোমার রূপের নেশায় পড়েছি। কিন্তু এটা তোমার ভুল। আমি আমার স্ত্রীর যৌবনকালের সেই রূপের প্রেমে পড়েছি। তোমাকে নূরী ভেবে তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। আমি আমার স্ত্রীর সাথেই সন্তুষ্ট। আমি শুধুমাত্র তাকেই ভালোবাসি। তার সাথেই জীবন কাটাতে চাই।
আসাদ এক নজর নূরীর দিকে তাকালো। নূরী পলকহীন ভাবে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো ছলছল করছে। আসাদ কোনো মায়ায় জড়ালো না। সে আবার দৃঢ়তার সাথে বলল, “তুমি হয়তো চাইলেই আমাকে আটকিয়ে রাখতে পারো। কিন্তু এতে আমরা কেউই সুখী হবো না। তাছাড়া তুমিও নারী। তোমার মাঝেও নারীর গুনাবলী আছে। এক নারী হয়ে অন্য নারীর সংসার কিভাবে কেড়ে নিতে পারো? তুমি হয়তো জানো না, নূরী যখন জানবে আমি ঘরে নেই। তখন সে পাগলপ্রায় হয়ে যাবে। কেননা আমিই ওর জীবন।” নূরী একটা হাসি দিলো। এরপরেই একটা পর্দা তাদেরকে আলাদা করে দিলো। তার মাথায় আগুনের বৃষ্টি নামতে লাগল। আসাদ অবাক হয়ে তাকালো। নূরী বলল, “এই আগুন কিছুই না। এর চেয়েও বেশি আগুন তোমার স্ত্রীর বুকে জ্বলছে। সত্যিই সে তোমার জন্য পাগল।” নূরী অদৃশ্য হয়ে গেল। আসাদের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল।

আসাদের শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক গতিতে ফিরেছে। একটু আধটু নড়াচড়া করছে। নূরীর অন্তরে যেন প্রাণ ফিরে এলো। আসাদের কাছে এসে বিলাপ করতে করতে বলল, “ওগো ওডো না। ওডো। একবার শুধু চোখ দুইডা মেলো।” বাপ্পী নিম্নস্বরে বলল, “ভালোবাসার জয় হয়েছে।” শরিফুল্লাহ হুজুর ঝাঁড়ফুঁক দিয়ে পানি ছিটাতে লাগলেন। আসাদ পিটপিট করে চোখ খুলল।

আজ পোলাও-কোরমা রান্না হয়েছে। সাগর-নদী নতুন জামা পরেছে। নূরীও নতুন শাড়ী পরেছে। লাল বেনারসি শাড়ি। অনেকদিন পর সে সেজেছে। মুখে সলজ্জ ভাব। দুপুরে শরিফুল্লাহ হুজুরকে দাওয়াত দিয়ে খাইয়েছে। বোয়াল মাছের বড় মাথাটা পেয়ে হুজুর বেশ খুশি হয়েছেন। নূরীও যে তার কাছে ঋণী। সেদিন তিনি না হলে আসাদকে আর ফিরে পেতো না এমন ভাবনা নূরীর। রাতে খেতে বসে আসাদের থালায় মুরগির রান খুঁজে খুঁজে দিচ্ছে নূরী। খুব যত্ন সহকারে সবাইকে খাওয়াচ্ছে। খাবার শেষে সাগর-নদীকে নিজ নিজ রুমে পাঠালো। তারপর তারা তাদের রুমে এলো। বেশ কিছুক্ষণ ধরে তারা শুয়ে আছে। দুজনই জেগে আছে। দুজনের মনেই জলপ্রপাত হচ্ছে কিন্তু কারও মুখে কথা নেই। খানিকক্ষণ বাদে নীরবতা ভাঙলো আসাদ। বলল‚ “দেখলা তো, আমার লাইগা পরীও পাগল। হা হা হা।”
“যাও না যাও। পরীর কাছে যাও।” নূরী রাগ নিয়ে উল্টো দিকে শুয়ে পড়লো। আসাদ মনে মনে হাসতে লাগল। নারী জাতটাই বোধহয় এমন। স্বামীকে কাছে না পেলে পরাণ যায় যায়, কিন্তু কাছে এলে দূরে রয়। নূরী যে তাকে কত ভালোবাসে তা আসাদ ভালো করেই জানে। হয়তো তাদের ভালোবাসা প্রকাশিত হয় না। চক্ষু নজরে দেখা যায় না। নূরী আবেগমথিত কথাবার্তা বলে না। আসাদও রোমাঞ্চকর কিছু করে না। কিন্তু তাদের মাঝে গভীর ভালোবাসা বিদ্যমান। যার প্রমাণ আসাদ এখন নূরীর পাশে। এতেই তারা সন্তুষ্ট।

সমাপ্ত।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.