নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিখতে জানতে ও ছড়িয়ে যেতে চাই।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী

আমি বাপ্পী। জন্মস্থান বরিশাল। বেড়ে উঠা চট্টগ্রাম।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পের নামঃ স্বার্থান্বেষী।

১৭ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১১:৩৩

গল্পের নামঃ স্বার্থান্বেষী।
লিখেছেনঃ মোঃ জোবায়ের বাপ্পী।

সবাই বলে সত্যই শক্তি। কিন্তু এই মুহূর্তে আসাদের অন্তর সত্য জেনে দুর্বল হয়ে আছে। যদিও তথ্যটা কতটুকু সত্য তা তার জানা নেই। তবে তার মন সত্যতা যাচাইয়ের আগেই ভেঙে পড়েছে। যদি তথ্যটি সত্য হয়েই বসে তখন কি হবে? কিছুক্ষণ আগেই সে এই তথ্যটা জেনেছে। অফিস থেকে বেরিয়ে নিচে নামতেই ইশতিয়াকের সাথে আসাদের দেখা হয়। বেশ কিছু বছর আগে তাদের শেষ দেখা হয়েছিল। তাই দুজনে একটু কথা বলতে বসে। কথায় কথায় ইশতিয়াক বলে, “শুনেছি তুমি নাকি সরকার কর্তৃক ফ্ল্যাট বাড়ি পেয়েছ।”
- হ্যাঁ। তুমি কিভাবে জানলে?
- আমি ওই সাইট দেখাশোনা করেছি। সেখান থেকেই জেনেছি। এটাও শুনেছি যে ফ্ল্যাট তোমার বউয়ের নামে স্থানান্তর করেছ।
- আমার ওর একই তো কথা।
- তোমাকে একটা সত্য কথা বলি।
- কি কথা?
- তোমার স্ত্রী নূরী তোমাকে নয় তোমার অর্থ সম্পদকে ভালোবাসে। কথাটা আমি তোমাকে বলতাম না। কিন্তু এই ফ্ল্যাটের ব্যাপারে জানার পর আমি খবর নিয়ে জেনেছি তোমার অনেক সম্পত্তিই নূরীর নামে। তাই তোমাকে বললাম।
- কি যাতা বলছো?
- আমি তো আর পর নই। তোমার গ্রামের পাশের বাড়িরই লোক। একটা সময় নূরীর সাথে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। তবে ভালোবাসার ব্যাপারস্যাপার ছিল না। কিন্তু যেই না বাবার সাথে ঝগড়া করে ঘর ছেড়েছি ওমনি নূরীর আচরণ পরিবর্তন হয়ে যায়। আমার সাথে আর আগেরমত কথা বলতো না। আমি বলতে গেলেও এড়িয়ে যেতো। অথচ একটা সময় অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতো। অনেক কিছু বানিয়ে খাওয়াতো। তাদের গাছের ফল আমার জন্য রেখে দিতো। এমন আরও অনেক কিছু। আমার সাথে সম্পর্ক আড়ি করার কিছুদিন পরেই গ্রামের তোমার আবির্ভাব হয়। তুমি তখন সরকারি চাকরিতে ঢুকেছিল। তোমার চালচলনও বেশ ভালো ছিল। তাই নূরীর নিশানা তোমার দিকে যায়। এবং সে সফল হয়। অবশ্য এটা তার জন্য কোনো ব্যাপার ছিল না। কেননা আশপাশ গ্রামে নূরীর মতো রূপবতী খুব কমই ছিল। ভেবো না আমি তোমার মনে নূরীর ব্যাপারে আগুন ঢালছি। তোমার সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু বলছি তুমি তোমার ও তোমার সন্তানের ভবিষ্যতের দিকেও একটু খেয়াল রেখো। আমার কথাগুলো শান্ত মাথায় ভেবে দেখো। চলি।

ইশতিয়াকের কথাগুলো শুনার পর থেকেই আসাদের মনে উত্তাল ঝড় শুরু হয়েছে। তার সাজানো গোছানো সংসারটা এলোমেলো লাগছে। ইশতিয়াকের সাথে তার কোনো শত্রুতা নেই। বরং তাদের সম্পর্কটা বেশ ভালো। এছাড়াও ইশতিয়াক বেশ ভালো মনের মানুষ। উদারতার দিক থেকে গ্রাম জুড়ে তার বেশ নাম রয়েছে। তাছাড়া দুজনেই এক বাড়ির ছেলে হওয়ায় নানারকম সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত। গ্রামের উন্নয়নে দুজনেই বেশ ভূমিকা রাখে। ইশতিয়াক কেন আসাদকে মিথ্যা বলবে? আসাদের সংসারে আগুন লাগিয়ে তার লাভ কি? আবার লাভ হতেও পারে। হয়তো সে নূরীকে ভালোবাসে। তাই অশান্তি লাগাতে চাচ্ছে। সত্য জানতে হলে নূরীকে প্রশ্ন করতে হবে। তবে ইশতিয়াকের কিছু কথার সাথে অতীতের মিল আছে। আনমনে চলতে চলতে আসাদ কখন যে মহল্লায় চলে এসেছে তা নিজেও জানে না। গলির মুখে বসে থাকা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে আসাদ চেতনায় ফিরে। তারপর পা চালিয়ে বাসায় চলে আসে। নিত্যদিনের মতো দরজা খুলতেই মাহিম তার ছোট ছোট পায়ে দৌড়ে এসে আসাদকে জড়িয়ে ধরে। নূরী মিষ্টি হাসি দিয়ে স্বাগত জানায়। অন্যান্য দিন আসাদও মিষ্টি হাসিতে উত্তর দিতো। কিন্তু আজ তা দিলো না। খাওয়া দাওয়া শেষে আসাদ বেডরুমে এসে শুয়ে পড়লো। নূরী লক্ষ্য করেছে আজ আসাদ মনমরা হয়ে আছে। সে ভাবলো হয়তো অফিসের কোনো কাজের চাপ আছে। শুয়ে পড়লেও আসাদের চোখে ঘুম নেই। আজ তার মনটা বিষণ্নতায় ডুবে আছে। আসাদ তার অতীত নিয়ে ভাবতে লাগল।

আসাদ-নূরী-ইশতিয়াক একই গ্রামের বাসিন্দা। বাড়িও পাশাপাশি। আসাদ ও ইশতিয়াক সমবয়সী। অতীতে আসাদের পারিবারিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। তবে ইশতিয়াকের বাবার বেশ ধন সম্পত্তি ছিল। তারা যখন হাইস্কুলের গণ্ডির পেরোলো তখন নূরী সবেমাত্র হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল। ছোট থেকেই বেশ রূপবতী নূরী। পরীক্ষার ফলাফলের পর আসাদ শহরে চলে আসে। তবে ইশতিয়াক গ্রামেই থেকে যায়। মাঝেমাঝে ছুটিতে গ্রামে আসতো আসাদ। তখন দেখেছিল ইশতিয়াকের সাথে নূরীর বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। তবে তার সাথে নূরীর তেমন সম্পর্ক ছিল না। আসাদদের আর্থিক অবস্থা ভালো হয় যখন সে সরকারি চাকরি পায়। টিনের তৈরি বাড়িটা খুব দ্রুতই ইটপাথরের তৈরি দালানে পরিণত হয়। আসাদের এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেবার সে যখন বাড়িতে গিয়েছিল তখন নূরী তার সাথে বেশ মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলেছিল। যখন তখন তাদের বাড়ি আসতো। আসাদের মাকে সব কাজেই সাহায্য করতো। ইশতিয়াকের সাথে আগেরমত কথা বলতো না। আসাদের জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে বিভিন্ন কিছু বানিয়ে আনতো। বলতো শহরে তো এগুলো পান না। তাই বানিয়ে খাওয়ালাম। এভাবে যেতে যেতে আসাদ নূরীকে ভালোবাসে ফেলেছিল। নূরীর আচরণও ছিল ইতিবাচক। তাই আসাদ তার বাবা মাকে ব্যাপারটা জানায়। নূরীকে তাদেরও বেশ পছন্দ। তাই পারিবারিকভাবে বিয়েটা হয়ে গেল। দীর্ঘ সাত বছরের সংসার তাদের। তাদের ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ঘরে এসেছে মাহিম। বেশ সুখী সংসার তাদের। কিন্তু সবকিছু বদলে গেল ইশতিয়াকের কথায়। তার কথাগুলো কতটুকু সত্য তা তো জানা নেই। তবে অনেকাংশই মিল আছে।

মনের মধ্যে কোনো কিছু চাপিয়ে রাখলে তা মস্তিষ্কে আঘাত হানে। এর প্রভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কর্মকান্ডেও পড়ে। তেমনি অফিসের কাজকর্মে আসাদের গাফলতি দেখা দিচ্ছে এবং পরিবারে তার রগচটা ভাবটা দিনদিন বেড়েই চলছে। নূরীর সাথে আগেরমত হেসে খেলে কথা বলে না। মাহিমকেও আগেরমত সময় দেয় না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। একদিন একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে মাহিমকে তুমুল বকাঝকা করলো আসাদ। এমনকি মারার জন্য তেড়ে গেল। কিন্তু নূরী সামনে চলে এলো। মাহিমকে বুঝিয়ে শোয়ার রুমে পাঠিয়ে দিলো। তারপর আসাদের সামনে দাঁড়ালো।
- কি সমস্যা তোমার? আমি বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করেছি তুমি বদমেজাজি ভাব দেখাচ্ছো। অফিসের রাগ তুমি ঘরে দেখাচ্ছো কেন?
- আমাকে একা থাকতে দাও তো।
- আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।
- আমি বাধ্য নাকি?
- এভাবে কথা বলছো কেন?
- আমি এভাবেই বলবো। তোমার সহ্য না হলে যেখানে খুশি যেতে পারো।
- তোমার কি মাথা ঠিক আছে? কি সব আবোলতাবোল বলছো?
আসাদ আর কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। নূরী আশ্চর্য হয়ে গেল। এই সাত বছরের সংসার জীবনে আসাদ কখনোই এমন কথা বলেনি। এমন কথা তো দূর তাদের মধ্যে কোনো বড় ধরণের ঝগড়াবিবাদও হয়নি। টুকিটাকি মনোমালিন্য তো সবার মধ্যেই হয়। কিন্তু আজ আসাদ যেভাবে কথা বলল তা আগে কখনোই বলেনি। নূরী বুঝলো যে এটা অফিসের চাপের ফল নয়। এর পেছনে অন্যকোনো কারণ লুকিয়ে আছে।

পরেরদিন সকালে আসাদের পছন্দের সরষে ইলিশ রান্না করা হলো। পুরো ঘর রান্নার ঘ্রাণে ভরে গেল। আসাদ খুব সামান্য পরিমাণে খেয়ে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। অন্যান্য দিন আসাদ মন ভরে খেতো এবং নূরীর প্রসংশা করতো। অথচ আজ কিছুই হলো না। কিছুক্ষণ পর নূরীও রুমে এলো। আসাদের পাশে বসে স্নেহের সাথে তার কাঁধে হাত রাখলো। বিরক্তি ভাব নিয়ে আসাদ সরিয়ে দিলো।
- তুমি এমন করছো কেন? কি হয়েছে বলো তো।
- আমাকে একা থাকতে দাও।
- দেখো কোনো সমস্যা থাকলে তার সমাধান করতে হয়। এভাবে একা একা থাকলে তো আর সমাধান হবে না।
- সবকিছুর সমাধান হয় না।
- কেন হয় না? তুমি বলেই তো দেখো। আমি সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করবো। আমি না পারলে আমাদের মুরব্বীরা আছেন তাদেরকে জানাবো। তারা নিশ্চয়ই সমাধান দিতে পারবেন।
আসাদ ভাবতে লাগল এভাবে আর চলবে না। এতে পারিবারিক সুখ শান্তি তো নষ্ট হচ্ছেই। তার কর্মজীবনেও সমস্যা হচ্ছে। তারওপর মাহিমের সাথে তার দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। নূরীর সত্যতা যাইহোক না কেন মাহিম তো তারই সন্তান। মাহিমের জন্য হলেও এখন নূরীর সাথে আলাপ করা প্রয়োজন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আসাদ বলল, “একটা কথা জিজ্ঞেস করব। সত্য বলবা।”
- হ্যাঁ বলো। কি জিজ্ঞেস করবে?
- তুমি কি আমাকে ধন সম্পদের জন্য বিয়ে করেছ?
নুরীর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। “কি যাতা বলছো?”
- তাহলে আমাকে কেন বিয়ে করেছ?
- তোমার মা-বাবাই তো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। বিয়ের এতগুলো বছর পর তোমার মনে এই প্রশ্ন জাগলো কেন?
- ইশতিয়াকের সাথে তোমার কেমন সম্পর্ক ছিল?
নূরী বিস্মিত হয়ে আসাদের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম ব্যস এইটুকুই। বিয়ের পর তো আর দেখাও হয়নি। কিন্তু এই প্রশ্ন কেন? তার সাথে আমাদের সংসারের সম্পর্ক কি?”
- আমার স্পষ্ট মনে আছে। যখন আমার কিছুই ছিল না। তখন তুমি আমার সাথে ঠিক করে কথা বলতে না। তবে ইশতিয়াকের সাথে তোমার ভালোই সম্পর্ক ছিল। সময় বদলালো। আমার চাকরি হলো। অবস্থার পরিবর্তন হলো। ওদিকে ইশতিয়াক তার বাবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলো। তখন তুমি ইশতিয়াককে এড়িয়ে চলতে লাগলে। আমার সাথে তোমার সখ্যতা বাড়লো। এতে কি বুঝা যায়?
আসাদ একনাগাড়ে কথাগুলো বলল। আসাদের কণ্ঠে তীব্র ঘৃণা ও আক্ষেপ ফুটে উঠেছে। নূরীর কপালে ঘাম জমেছে। তার চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে আছে। বেশ শান্ত গলায় বলল, “তুমি…তুমি এসব কি বলছ? তোমার মাথায় এসব কে ঢুকিয়েছে?”
- আমার বুঝি চোখ নেই? বিয়ের পর থেকেই দেখে এসেছি সম্পত্তির প্রতি তোমার লোভ অনেক। আমাকে ভুলিয়ে ফুসলিয়ে ফ্ল্যাটটাও নিজের নামে করিয়েছ।
- ও আচ্ছা। এই ব্যাপার। এতো না পেঁচিয়ে সোজা বললেই হয় যে, ফ্ল্যাট তোমার নামে করে নিতে চাও। তুমি কি ভাবছো ফ্ল্যাট বাড়ি নিয়ে আমি পালিয়ে যাব?
- তুমি কি ভেবেছ তুমি পালিয়ে গেলে আমি পাগল হয়ে যাব? আমি অন্যরকম ছেলে। বেইমানকে এক মুহূর্তের জন্যও মনে রাখি না। আমার কাছে ফ্ল্যাট নয় সত্যটা বড়।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নূরী বলল, “সত্য জানার পর আমাকে ঘৃণা করবে নাতো?”
- ওটা নির্ভর করবে সত্যের ওপর।
- ঠিক আছে। তবে শুনো। আমি ছোটকাল থেকেই অভাব অনটনের মাঝে বড় হয়েছি। যেখানে দুবেলা পেটপুরে খেতে পারতাম না। সেখানে শিক্ষার ইচ্ছেটা ছিল বিলাসীতা। সরকারের মেহেরবানীতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করতে পেরেছি। ষষ্ঠতে ভর্তি হয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু অভাবের সামনে তা আর এগোতে পারেনি। আমার বয়সী মেয়েরা স্কুলে যেতো আর আমি বাবার সাথে মাঠে যেতাম, মায়ের সাথে রান্নাঘরে থাকতাম। আমারও ইচ্ছে করতো স্কুল যেতে, তাদের মতো সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় পরতে, দুবেলা পেটপুরে খেতে। কিন্তু তা ছিল নিছকই এক কল্পনা। বুঝার পর থেকে ইশতিয়াকের সাথে আমার সখ্যতা হয়েছিল। ও আমাকে মাঝেমাঝে দামী দামী জিনিস উপহার দিতো। আমার জন্য ভালো ভালো খাবার কিনে আনতো। তখন মনে মনে ভাবতাম যদি ইশতিয়াকের সাথে আমার বিয়ে হয় তাহলে এই অভাবের দুনিয়া আমার পিছু ছাড়বে। সেই লক্ষ্যে আমি ওর সাথে সখ্যতা বজায় রাখতাম। কিন্তু হঠাৎ করে সে তার বাবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। ঠিক তখনই গ্রামে তোমার আগমন ঘটে। শহরে যে তুমি ভালো অবস্থানে আছ তা গ্রামবাসী ইতোমধ্যে তোমাদের ঘর-বাড়ি দেখে বুঝতে পেরেছিল। আমিও ইশতিয়াকের সঙ্গ ত্যাগ করে তোমার দিকে ঝুকলাম। তুমিও সাড়া দিলে। তোমার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক জমে উঠলো। কিন্তু আমাদের মাঝে প্রেম ভালোবাসা ছিল না। ইশতিয়াকের সাথেও ছিল না। আমি শুধু তোমাদের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছি। কারও মন নিয়ে খেলিনি। তোমার সাথে সখ্যতা বাড়ার দরুণ তুমি বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে। তারপর আমাদের বিয়ে হলো। আমার স্বপ্ন পূরণ হলো। অভাব আমার পিছু ছাড়লো।
এইটুকু বলে নূরী দম নিলো। বুক ভরা শ্বাস নিয়ে আবার বলতে লাগল, “এখন তুমি বলতেই পারো যে, আমি লোভী। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি শুধু আমার সুখের চিন্তা করিনি। আমি আমার সন্তানদেরও চিন্তা করেছি। আমি যেসকল সুযোগ সুবিধা পাইনি। তা যেন আমার সন্তানেরা পায়। আমি যে দুঃখ-কষ্টগুলো সহ্য করেছি তা যেন আমার সন্তানেরা না করে। অন্য সকল মায়ের মতো আমিও আমার সন্তানদের সুখের কথা চিন্তা করেছিলাম। হতে পারে আমার পদ্ধতি ভুল ছিল কিন্তু আমার নিয়তে কোনো দোষ ছিল না।”

সব শুনে আসাদ রেগে উঠলো। গর্জনের সাথে বলল, “এই ছিল তোমার মনে? ভালোবাসার নামে তুমি আমাকে ঠকিয়েছ। তুমি একটা প্রতারক। ছিঃ একটা প্রতারকের সাথে আমি এতদিন সংসার করেছি ছিঃ।” ঘৃণার সাথে কথাগুলো বলে উঠে যেতে লাগল। নূরী হাত ধরে ফেলল। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “আজ তোমার চোখে শুধু আমার স্বার্থপরতাই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। কিন্তু এযাবৎ ধরে আমি তোমার জন্য, মাহিমের জন্য, এই সংসারের জন্য কি কি করেছি তা আড়ালে পড়ে গেছে।” চোখের পানি মুছে আলমারি থেকে ফ্ল্যাটের দলিল বের করে আসাদের সামনে রেখে নূরী আরও বলল, “আমার এসব লাগবে না। আমার শুধু তোমাদের লাগবে। আমি আমার সংসারটা চাই শুধু।” আসাদ একনজর নূরীর দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মাঠের এক কোণে এসে চুপচাপ বসে আছে। ভাবছে, ভীষণ ভাবছে। ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু নূরী। তার শেষ কথা গুলো আসাদকে ভীষণ রকমের ভাবাচ্ছে। এই কথা অনস্বীকার্য যে, এই সংসারের জন্য নূরী অনেক ত্যাগ করেছে। নিজের জন্য সে কখনোই দামী শাড়ি-গহনা চায়নি। যা আছে সবই আসাদের জোর করে বানানো। নূরী সবসময়ই সঞ্চয়ের তাগিদ দিতো। সবসময়ই মাহিমের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতো। মাহিমের এটা লাগবে, ওটা লাগবে, ওকে ভালো স্কুলে পড়াতে হবে, মোদ্দা কথা নূরীর সব সব চাওয়া পাওয়া ছিল মাহিমকে কেন্দ্র করে। নিজের চাওয়া বলতে শুধু বাড়িটা চেয়েছে। তাও তো আজ ফিরিয়ে দিয়েছে। তবে কি নূরী স্বার্থপর? 'স্বার্থপর' শব্দটা আসাদকে আরও ভাবিয়ে তুললো। ভাবতে লাগল সে নিজেও তো স্বার্থপর। নূরী রূপবতী তাই সে তার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছিল। অথচ সেই সময় বাড়িতে আরও অনেক মেয়েই ছিল। কিন্তু তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল শুধুই নূরী। কেননা বাকিদের থেকে নূরী সুন্দরী ছিল। এটাও তো এক ধরণের স্বার্থপরতা। তবে কি দুজনেই স্বার্থপর? তবে তার ও নূরীর মাঝে তফাৎ আছে। নূরীর স্বার্থের পেছনে মহত্‍ উদ্দেশ্য ছিল যা আসাদের ছিল না। সে তো শুধু সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষিত ছিল। আসাদ উঠে দাঁড়ালো। বাসার দিকে পা বাড়াতে লাগল। বাসায় এসে নূরীর সাথে তেমন কথা বলল না। খেয়ে শুয়ে পড়লো।

বেশ কিছুদিন হয়ে গেল আসাদ ঠিকমতো নূরীর সাথে কথা বলে না। তাকে পূর্বের মতো সময় দেয় না। আগেরমত অফিসে থাকাকালীন ফোন দেয় না। নূরী দিলেও ধরে না। আসাদ ভাবনায় আছে কিভাবে নূরীর সাথে সহজ হবে।নূরীকে এত কিছু বলার পর সে নিজেই লজ্জিত হয়ে আছে। নূরীর চোখে চোখ মিলাতে পারছে না। তাই নূরীর থেকে দূরে দূরে থাকছে। অফিসে বসে ফাইল দেখছে। এমন সময় পিয়ন এসে একট পার্সেক দিয়ে গেল। আসাদ বেশ অবাক হলো। তাকে আবার কে পার্সেল পাঠাবে? আসাদ পার্সেল খুলল। দলিলের কাগজপত্র। সাথে একটা চিঠি। নূরী ফ্ল্যাটটা আসাদের নামে লিখে দিয়েছে। চিঠিতে লেখা, “আমার কাছে এই কাগজ মূল্যহীন। ফ্ল্যাট দিয়ে কি হবে যদি না সেখানে সংসার করা যায়? তুমি ভালো থেকো।” আসাদ সাথেসাথেই নূরীকে ফোন করলো। কিন্তু বন্ধ পেল। সে আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না। তড়িৎ গতিতে বাসায় চলে এলো। বাসায় এসে দেখলো নূরী নিত্যদিনের মতো মাহিমে পেছনে খাবার নিয়ে ছুটাছুটি করছে। আসাদের হৃদয়ে যেন প্রাণ এলো। নূরীর সামনে এসে দাঁড়ালো। নূরীর মুখে মুচকি হাসি। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আসাদ বলল, “চিঠিটার মানে কি?”
- কেন? বাংলা বুঝো না?
- ভালো থেকো মানে কি? ওটা কেন লিখলে?
- বারে, আমি আমার স্বামীকে ভালো থাকার কথাও বলতে পারবো না?
আসাদ রেগে গেল। কিছু বলার আগেই পেছন থেকে তার মায়ের কণ্ঠ শুনতে পেল, “দেখলে তো বউমা। এক চিঠিতেই চিড়িয়া ঘরে। হা হা হা।”
- হ্যাঁ মা। একদম ঠিক পরামর্শই দিয়েছেন।
আসাদ তার বাবা মাকে দেঝে অবাক হয়ে গেল। বলল, “এসব কি হচ্ছে? তোমরা আসবে সেটা তো আমাকে বলোনি।” জবাবে নূরী বলল, “তোমার মনে আছে, আমি তোমাকে বলেছিলাম, সমস্যার সমাধান আমি দিতে না পারলেও আমাদের মুরব্বীরা নিশ্চয়ই দিতে পারবেন।”
- হ্যাঁ তো।
- তোমার রুক্ষ ব্যবহারে আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। সংসার হারানোর ভয়ে আমি অস্থির হয়ে উঠি। উপায় না পেয়ে বাবা মাকে সব বলে দেই। এটাও বলি যে ভূমি অফিসে গিয়ে ফ্ল্যাটের দলিল তোমার নামে করার আবেদনও করে দিয়েছি। অতীতেত কথা ও বর্তমানে আমার মনের অনুভূতি বুঝতে পেরে মা আমাকে দলিল সহ এই চিঠি পাঠানোর বুদ্ধি দিলেন। আমিও কথামতো কাজ করে ফেললাম। আর ফলস্বরূপ চিড়িয়া ঘরে।
আসাদ নির্বাক হয়ে গেল। নূরীর চোখে তাকে পাওয়ার যে খুশি দেখা যাচ্ছে তা অগ্রাহ্য করার সাহস আসাদের নেই।

অনেকদিন পর আসাদের ঘরে হাসিমুখ দেখা গেল। সবাই মিলে আনন্দের সাথে রাতের খাবার খেল। তারপর নিজ নিজ রুমে ঘুমাতে এলো। নূরী নিত্যদিনের মতো মাহিমকে ঘুম পাড়াতে লাগল। কিছুক্ষণ পর মাহিম ঘুমি পড়লো। তা বুঝতেই নূরীকে বুকের মাঝে টেনে নিলো আসাদ। নূরী কিছুটা বিস্মিত হয়ে গেল। তবে পরক্ষণেই লজ্জায় মুখটা আসাদের মুখে গুজে রাখলো। আসাদ বলল, “একেবারে নতুন বউয়ের মতো লজ্জা পাচ্ছো দেখি।”
- ধুর! তুমি না!
- আমি সেদিনের ব্যবহারের জন্য লজ্জিত।
- ওসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। আমি তোমাকে আগেরমত চাই।
- আমি আগেরমতই আছি।
- এই কয়েকদিনে মাহিম তোমার থেকে দূরে সরে এসেছে। ওকে একটু বেশি বেশি ভালোবাসা দিও।
- তা তো দিবোই। কিন্তু মাহিমের মায়ের কি ভালোবাসা লাগবে না?
- যাহ! কি যে বলো! তোমার শুধু দুষ্টামি।
আসাদ একটা হাসি দিয়ে নূরীকে বুকের মাঝে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখলো। নূরীও একেবারে নিস্তেজ হয়ে আসাদের বুকের মাঝে পড়ে রইলো যেন কোনো পথি বহু পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে নীড়ে ফিরেছে।

সমাপ্ত।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.