নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিখতে জানতে ও ছড়িয়ে যেতে চাই।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী

আমি বাপ্পী। জন্মস্থান বরিশাল। বেড়ে উঠা চট্টগ্রাম।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পের নামঃ মুখোশের আড়ালে।

১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ৭:০৫

গল্পঃ মুখোশের আড়ালে।
লিখেছেনঃ মোঃ জোবায়ের বাপ্পী।

নূরীর প্রেমের ব্যাপারটা জেনে যান তার বাবা রফিকুল ইসলাম। তিনি অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন মেয়েকে। ডিম থেকে বের হতে না হতেই এত জ্বালা কিসের? এতো ঘষাঘষি কিসের? অবশ্য এসব নূরীর জন্য নতুন কিছু নয়। বাবার মুখে এমন সব কথাবার্তা সে প্রায়ই শুনে। শুধু সে একা নয় তার মা কুলসুমও শুনেন। রফিকুল ইসলামের ব্যবহারই এমন। নূরী ভেবে পায় না এই মানুষটার সাথে তার মা কিভাবে সংসার করছেন? নূরীর তো মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে গলা টিপে মেরে ফেলতে। তবে এই ব্যাপারে কুলসুম নির্বিকার। তার কথা হলো এই ঘর থেকে যেদিন সে বের হবে সেদিন লাশ হয়ে বের হবে‚ তার আগে না।
নূরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পারিবারিক সম্মতিতেই তার প্রেমিক আসাদের সাথে তার বিয়েটা হয়ে গেল। নতুন পরিবেশে এসে নূরী বেশ খুশি। শ্বশুর-শ্বাশুড়ী ও একমাত্র ননদীর ভালোবাসা, সম্মান পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী ভাবতে লাগল। তাছাড়া আসাদের ভালোবাসা, আদর-সোহাগ তো আছেই। প্রায়শই বাড়িতে আসার সময় আসাদ তার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসেই। পরিবারে যে এত সুন্দর পরিবেশ হয় তা নূরীর জানাই ছিল না। সে যেমনটা কল্পনা করতো আসাদের পরিবার ঠিক তেমনই। হাসিখুশি পরিবার।
আসাদের প্রমোশন খুব তাড়াতাড়ি হলো। লোকে বলে শ্বশুরবাড়ির যৌতুক দিয়ে ঘুষের বদৌলতে এই প্রমোশন হয়েছে। এতে অবশ্য নূরীর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তার বাবার অঢেল সম্পত্তির মালিক তো সে একাই। স্বামীর জন্য কিছু করা মানেই তার জন্য করা। এতে তো তাদের ভবিষ্যৎ-ই ভালো হবে।
যৌথ পরিবারের কাজকর্ম করতে করতে নূরী অল্পদিনেই হাঁপিয়ে উঠলো। তাই চতুরতার সাথে আলাদা ফ্ল্যাটে উঠলো। ফ্ল্যাটটা অবশ্য নূরীর বাবাই দিয়েছেন। আসাদের বাবা মাও আপত্তি করেননি। ছেলে ও পুত্রবধূকে সাদরে নতুন ফ্ল্যাটে তুলে দিয়েছেন। ফ্ল্যাটের উদ্ভোধন নূরী নিজ হাতে করেছে। উপস্থিত ছিল তাদের দুই পরিবারই। নতুন ভাবে নূরী তার সংসার সাজাতে লাগল। একটা সংসার একা সামলিয়ে রাখা যে কতটা ঝামেলার তাও সে হাড়ে হাড়ে টের পেতে লাগল। তবুও সে মনের আনন্দে সব করতে লাগল। কেননা এই সংসারটা তার একার। বিয়ের প্রায় চার বছরের মাথায় নূরী কনসিভ করলো। খুশির এই খবর দুই পরিবারে ছড়িয়ে পড়লো। সবাই এসে উপস্থিত হলো। সবাই নানারকম উপহার সামগ্রী নিয়ে এসেছে। নূরীর মা তাকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু নূরী রাজি হলো না। বরং মাকেই এখানে রেখে দিলো। ঘরের সার্বিক কাজকর্মের জন্য একটা বুয়া রাখলো।

সাধারণত কন্যাসন্তান হলে নার্সরা মনে মনে অখুশি হয়। কেননা তারা মনঃপুত পুরষ্কার পায় না। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম হলো। রফিকুল ইসলাম হাসপাতাল জুড়ে মিষ্টি বিতরণ করলেন। নার্সদেরকে পুরষ্কৃত করলেন। নূরীর অপারেশন করা ডাক্তারকে দামী শাড়ি উপহার দিলেন। অথচ হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে ডাক্তার-নার্সরা রফিকুল ইসলামকে তার ভাষার জন্য নিম্নশ্রেণীর লোক মনে করতেন। প্রায় সপ্তাহখানেক পর নবজাতককে নিয়ে সবাই বাসায় এলো। বেশ কিছুদিন বাসার মধ্যে হইহুল্লোড় ছিলো। ধীরে ধীরে তা কমলো। একেবারে শেষে গেলেন নূরীর বাবা-মা। তবে যাওয়ার আগে রফিকুল ইসলাম মেয়েকে বললেন, “শুনছি আজকালকার মায়েরা নাকি শরীর ঠিক রাখতে সন্তানকে বুকের দুধ দেয় না। খবরদার আমার নাতনির প্রতি যেন এই অমানবিক আচরণ না হয়। এতে কিন্তু পাপ হবে। এখন ওর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মায়ের বুকের দুধ।” নূরীর ইচ্ছে করছিল সুই-সুতা দিয়ে বাবার মুখটা সেলাই দিতে।

নাম রাখা হয়েছে সাবরিনা। চোখ দুটো অত্যন্ত মায়াবী। দন্তহীন হাসিটাও মন কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ছোট এই চেহারাটির দিকে তাকালে নূরী সব সুখ খুঁজে পায়। বলা হয় মেয়েরা বাবা পাগলী হয়। কিন্তু সাবরিনার ক্ষেত্রে তা ভিন্ন। জন্মের পর থেকেই আসাদের কোলে সে এক মুহূর্তও থাকে না। আসাদ কোলে নিলেও হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। ছোট শরীরে যতোটা শক্তি আছে সব দিয়ে নড়াচড়া করে। এতে নূরী হেসে বলে, “ও মা পাগলী হয়েছে।” আসাদ গম্ভীর ভাব নিয়ে বলে, “আমার তো মনে হয় তুমি জাদুটোনা করেছ।” নূরী খিলখিলিয়ে হাসে।
আজ প্রায় মাস ছয়েক পর নূরী বেশ সাজলো। রান্নাও নিজ হাতে করলো। এতদিন বুয়া করতো। তবে এসবের কিছুই আসাদী চোখে পড়লো না। সে নিত্যদিনের মতো খেয়েদেয়ে ঘুমাতে গেল। সাবরিনাকে একপাশে রেখে আসাদের কাছে এলো নূরী।
- কি ব্যাপার? তোমার কি মন খারাপ?
- নাতো।
- মিথ্যা বলছো কেন? আজ আমি রান্না করেছি, সেজেছি। এসব কিছুই তোমার দৃষ্টিগোচর হয়নি।
- আসলে ব্যাংকের কিছু কাজের প্রেসারে আছি।
- আমার কাছে। সব প্রেসার দূর করে দিবো।
দুজনে কাছাকাছি আসতেই যাবে ঠিক তখনই সাবরিনা কেঁদে উঠলো। নূরী সরে এলো। সাবরিনাকে কোলে নিয়ে “ও-ও-ও মামণি কাঁদে না।” বলে দোল খাওয়াতে লাগল। হঠাৎ আসাদ লক্ষ্য করলো সাবরিনা খুব রাগি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আসাদ বিস্মিত হলো। আরেকটু লক্ষ্য করলো। হ্যাঁ, এক ভয়ংক রাগি দৃষ্টিতে তার দিকে সাবরিনা তাকিয়ে আছে। মুহূর্তেই আসাদের কপালে ঘাম জমে গেল। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এইটুকু বাচ্চার চাহনিতে কি ভয়াল দৃষ্টি!
সেদিনের পর থেকে আসাদ সবসময়ই সাবরিনার দিকে আড়চোখে তাকায়। সেই ভয়াল দৃষ্টি না দেখলেও একটা কঠোর দৃষ্টি দেখতে পায়। সে ভেবে পায় না এইটুকু বাচ্চা এতো কঠোর দৃষ্টিতে তাকায় কিভাবে? আসাদ রাতে ঘুমাতে পারে না। ইদানিং রাতে সাবরিনার চোখদুটো যেন জ্বলে। ভয়ে সে সাবরিনার দিকে তাকাতে পারে না। তার মনের মাঝে কেমন যেন খচখচ করে। কিন্তু কিসের জন্য তা সে বুঝে উঠতে পারে না।

জাহেদকে দেখে নূরী উত্তেজিত স্বরে বলল, “তুমি এখানে!” আসাদ উঠে বলল, “তুমি উনাকে চিনো নাকি?”
- হ্যাঁ, আমরা একই কোচিংয়ে পড়তাম।
আসাদ জানালো জাহেদ তার ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তা। নূরী অনুযোগ করে বলল‚ “কাউকে ঘরে আনবে সেটা আমাকে জানাবে তো নাকি?” আসাদ জানালো জাহেদ হুটহাট এর ওর বাসায় যায়। এটা নাকি তার অভ্যাস। বুয়াকে নিয়ে নূরী সামান্য কিছু নাস্তা বানিয়ে আনলো। সাবরিনাকে কোলে নিতে গিয়ে জাহেদ বিফল হলো। হাত বাড়াতেই সাবরিনা বিকট স্বরে কেঁদে উঠলো। নূরী হেসে বলল, “ও আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না।” তবে আসাদ দেখতে পেল সাবরিনার চোখে সেই কঠোর চাহনি। গল্পের আসর জমালো তিনজন মিলে। আসাদ-নূরীর প্রেমের গল্প, জাহেদ-নূরীর কোচিংয়ের দিনগুলোর গল্প এসবের মধ্য দিয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেল। অতঃপর রাতের খাবার খেয়ে জাহেদ চলে গেল।
সেদিনের পর থেকে সাপ্তাহিক ছুটিতে জাহেদ উপস্থিত হয়। তিনজনে মিলে গল্পগুজব করে সময় কাটায়। এভাবে যেতে যেতে জাহেদ অন্য সময়েও আসতে লাগল। নূরীও একটা সঙ্গ পেয়ে জমিয়ে আড্ডা দেয়। এক বিকালে জাহেদ তাকে একটা ফাইভ স্টার হোটেলে লান্সের দাওয়াত দিলো। সাবরিনাকে বুয়ার কাছে রেখে নূরীও বেশ সেজেগুজে এলো। যা দেখে জাহেদ বলল, “ওয়াও! তোমাকে এখনো ভার্সিটির সেই নূরী লাগছে।” নূরী লাজুক ভরা হাসি দিলো। খাবার অর্ডার করা হলো। খাওয়ার এক পর্যায়ে জাহেদ বলল, “তোমাকে কিছু দেখানোর জন্য ডেকেছি।” জাহেদ কিছু ছবি দিলো। নূরীর চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। জাহেদ বলল‚ “কিছু ভিডিও আছে। তোমার ইমোতে পাঠিয়ে দিয়েছি। ঘরে গিয়ে দেখিও। আর হ্যাঁ, নিজেকে শক্ত রেখো। তাড়াহুড়োয় কোনো সিদ্ধান্ত নিও না।”

সাবরিনাকে নিয়ে দিন-কয়েক ব্যস্ত ছিল নূরী। বছর পেরিয়ে গেছে তবুও সাবরিনার মুখ থেকে মা শব্দ ব্যতীত অন্যকোনো শব্দ বের হয় না। দুদিন ধরে সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এখন ঠোঁট নাড়িয়ে নানননা-নানননী বলে। এই নিয়ে আসাদের মায়ের অনুযোগ, নাতনিটাকে এমনভাবে হাত করেছে যে দাদা-দাদীর নামটাও নেয় না। এই নিয়ে পরিবারে এক অশান্তি চলছে। ডাক্তাররাও কোনো সমাধান দিতে পারছেন না। নূরীর জীবনে হঠাৎই কালো মেঘ নেমে এলো। একদিকে সেই ছবি-ভিডিও অন্যদিকে একমাত্র মেয়েটার এমন পরিস্থিতি। নূরীর দিশেহারা অবস্থা।

আলিশান হোটেলের একটা বিলাসবহুল রুমে আছে নূরী। সাথে আছে জাহেদ। নূরী তার দুঃখ গুলো বলছে আর কাঁদছে। কেন আসাদ তার সাথে বেঈমানী করলো এই নিয়েই তার সব দুঃখ। জাহেদ মনোযোগ সহকারে সব শুনলো। তারপর শান্ত্বনা দিয়ে বলল‚ “কেঁদো না নূরী। বেঈমানের জন্য চোখের জল ফেলতে নেই?” জাহেদের হাত এতক্ষণ নূরীর মাথায় ছিল। তা ধীরে ধীরে নিচে নামতে লাগল। জাহেদ আরও বলল, “আসলে ভুলটা আমার। সেদিন আমার উচিত ছিল তোমাকে আটকানো। তাহলে হয়তো তুমি এমন বেঈমানের পাল্লায় পড়তে না। আমি আজও পস্তাই সেদিনের জন্য। একটা রূপসীকে কাছে পেয়েও তার মূল্য বুঝিনি।” নূরী অনুভব করলো জাহেদের হাত তার নগ্ন পিঠে ঘুরপাক খাচ্ছে। কামিজের চেইন কখন খুলা হয়েছে তা বুঝতেই পারলো না নূরী। তার মাঝে বাধা দেওয়ার প্রবণতা দেখা দিলো না। আসাদের প্রতারণা তাকে যেন অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে। জাহেদ আরও সামনে এগোতে লাগল। ধীরে ধীরে নূরীও সাড়া দিতে লাগল। দুজনে এক অবৈধ সম্পর্কের দিকে এগোতে লাগল। হঠাৎ করেই নূরীর হাত দুটো নিথর ভাবে জাহেদের মাথা থেকে পড়ে গেল। সে চাচ্ছে হাত দুটো তুলে জাহেদকে আঁকড়ে ধরতে কিন্তু কোনোমতেই তা পারছে না। এরইমধ্যে মাথা প্রচন্ড ব্যাথায় ফেটে যেতে লাগল। নূরী বেদনায় ককিয়ে উঠলো। হাতে জীবন ফিরে পেতেই জাহেদকে সরিয়ে দিলো। মাথায় হাত দিয়ে ছটফট করতে লাগল। আর বলতে লাগল, “উফফ আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ হাতুড় দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছে।” জাহেদ কোনো তাড়াহুড়ো করলো না। কারণ সে জানে আজ যদি জোর করা হয় তবে নূরীকে আর কখনো কাছে পাওয়া যাবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই নূরী নিজেকে গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লো। জাহেদ তাকে বাসা অব্দি এগিয়ে দিলো। বাসায় এসে নূরী ছটফট করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো।

সাবরিনার ওপর বদ-আছর পড়েছে - এমনটা জানালেন নূরীর মা। শিক্ষিত হয়েও নূরী তা মেনে নিলো। কেননা শহরের বড় বড় সব ডাক্তার বিফল হয়েছে সাবরিনার অসুখ ধরতে। তাছাড়া কিছুদিন ধরে নূরীর কোলেও আসে না মেয়েটা। কোলে নিতে চাইলে প্রচন্ড কান্নাকাটি করে। নূরীর হাতে খাবারও খায় না। অথচ একা একা খুব লক্ষী মেয়ের মতো খেলে ও খায়। যেন মায়ের কোনো প্রয়োজন তার নেই। কিছুদিন পর এক বড় হুজুর থেকে পানি পড়া নিয়ে নূরীর বাবা-মা এলেন। নূরী তাদেরকে কিছুদিন থাকার অনুরোধ করে বলল, “কিছুদিন থেকে যাও মা। আমার ভালো লাগবে। তুমি পাশে থাকলে ভরসা পাবো।”
সাবরিনা চুপচাপ পুতুল নিয়ে খেলছে। খেলছে বললে ভুল হবে। সে চুপচাপ পুতুলটার দিকে তাকিয়ে আছে আর মাঝেমাঝে হাত পা নাড়াচ্ছে। যেন তার সাথে কথা বলছে। সাবরিনার পাশে বসলেন নূরীর বাবা-মা। কুলসুম নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। সাবরিনা হাসছে। খিলখিলিয়ে হাসছে। তা দেখে নূরী খুশি হলেও আসাদ গম্ভীর হয়ে আছে। এই হাসি দেখলে তার মাঝে কেমন যেন একটা গা-কাটা ভাব কাজ করে। হঠাৎই কুলসুম উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। এতে রফিকুল ইসলাম বেশ অবাক হলেন। এভাবে কেউ উঠে যায়? নাতনিটা কত হাসাহাসি করছিল! রফিকুল ইসলাম এটা ভেবেও অবাক হলেন সে একবারও কুলসুমকে বাধা দেননি। অথচ তার ইচ্ছে করছিল বাধা দেওয়ার। কিছুক্ষণ পর রফিকুল ইসলাম অবাক হয়ে সাবরিনার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার মনে হচ্ছে কেউ তাকে নানু বলে ডাকছে। কিন্তু এখানে আর কেউ নেই।
- কি ভাবছো নানু? হ্যাঁ, আমিই কথা বলছি। ও আচ্ছা‚ ঠোঁট নাড়িয়ে কথা না বললে বুঝি বিশ্বাস করবে না?
এইটুকু শুনলেন রফিকুল ইসলাম। তারপরেই সাবরিনা ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে বলল, “দরজাটা বন্ধ করে এসো। তোমার সাথে অনেক কথা আছে।” রফিকুল ইসলাম যন্ত্রের মতো উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে আবার পূর্বের জায়গায় এসে বসলেন। সাবরিনা বলতে লাগল, “আমি কথা বলতে পারি। একদম স্পষ্টই বলতে পারি। এই বয়সে পুরোপুরি কথা বলাটাও তোমাদের কাছে অস্বাভাবিক। চার বছরের একটা মেয়ে সচরাচর এভাবে কথা বলে না। আমার মনে অজস্র কথা জমে আছে। কিন্তু আমি কারও সাথে কথা বলি না। কার সাথে বলবো বলবো? এখানে কারও মন তোমার মতো পরিষ্কার না। একি! তুমি ঘামছো কেন? ভয় পাচ্ছো বুঝি? যাও আমি তোমার সাথেও কথা বলবো না।” সাবরিনা রাগ করে অন্যদিকে ফিরলো। রফিকুল ইসলাম সত্যিই ভয় পেয়েছেন। ভয়ে তার শরীর ঘামছে। তার শার্ট ভিজে গেছে। কাঁপা কাঁপা স্বরে তিনি বললেন, “না, আমি ভয় পাচ্ছি না।”
- তাহলে আমাকে কোলে নাও। ভয় নেই। আমি রূপকথার গল্পের মতো তোমার ঘাড় মটকাবো না। হা হা হা।
রফিকুল ইসলাম এবার ভয়ে কেঁদে ফেলার উপক্রম। তার ইচ্ছে করছে চিত্‍কার দিয়ে বলতে কে আছো বাঁচাও। অনিচ্ছার সত্ত্বেও তিনি সাবরিনাকে কোলে নিলেন। ছোট্ট সাবরিনা বলে উঠলো, “একি নানু! তোমার হার্টবিট তো অস্বাভাবিক গতিতে ছুটাছুটি করছে। কি লজ্জা! নিজের নাতনিকে ভয় পাও।”

রফিকুল ইসলাম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে স্বাভাবিক স্বরে বললেন, “তুমি কারও সাথে কথা বলো না কেন?” সাবরিনা তার পুতুলটা হাতে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, “এসব নোংরা লোকদের সাথে আমি কথা বলি না। এক নাম্বার নোংরা হলো আমার বাবা।”
- কি বলছো এসব?
- হ্যাঁ ঠিকই বলছি। তাই তো আমি আজ পর্যন্ত তার কোলে যেতে চাইনি। যতবারই কোলে নিয়েছে ততবারই কেঁদে উঠেছি। সে যখন আমাকে তার অপবিত্র হাত দিতে স্পর্শ করতে চায় তখন আমার ইচ্ছে করে একটা জোরে ঘুষি মারি। কিন্তু আমি এমনটা করি না। তাহলে সবাই ভয় পেয়ে যাবে। তুমিই বলো, পরনারীর সাথে অবৈধ কাজ করে তারপর কোন অধিকারে সন্তানকে কোলে নিতে চায়?
রফিকুল ইসলাম বিস্মিত হলেন। এসব কি বলছে? সাবরিনা হেসে বলল, “তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না তাই না? এই বাড়িটা যে তুমি আমার নামে লিখে দিয়েছ তা কিন্তু আমি বাদে কেউই জানে না।” এবার রফিকুল ইসলাম একেবারে শান্ত হয়ে গেলেন। তিনি বুঝে গেলেন এই মেয়ে সাধারণ কোনো মেয়ে নয়। কেননা এই সত্যটা তিনি এখন পর্যন্ত কাউকে বলেননি। সাবরিনা আরও বলল, “বাবা মায়ের বিয়ের তিন বছর মাথায় বাবা এই নোংরামিতে জড়িয়ে পড়ে। আমি বড় হলে তাকে নিজ হাতে শাস্তি দিবো। খুব ভয়ানক শাস্তি। তোমার মেয়েটাকেও দিবো। আরও ভয়ানক।”
- কেন? ও কি করেছে?
- বাবার থেকেও জঘন্য কাজ করেছে তোমার মেয়ে। ভার্সিটি পড়াকালীন জাহেদ নামের এক ছেলের সাথে নোংরামি করে বেড়াতো। কি নির্দয়ী তোমার মেয়ে জানো? এই নোংরামিতে তোমার মেয়ে গর্ভবতীও হয়েছিল। অথচ খুব শান্তভাবে আমার ভাইটাতে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। বাবা যে-ই-হোক না কেন মা তো এই নোংরা মহিলাই। তাই ওকে আমি ভাই বলি। মাঝেমাঝে কথাও বলি। তারপর শুনো, তোমার এই খারাপ মেয়েটা সেই সম্পর্ক খুব সহজেই শেষ করে দেয়। জাহেদ তো হাফ ছেড়ে বাঁচে। তারপর জড়িয়ে পড়ে বাবার সাথে। অথচ বিয়ের এতগুলো বছর পর জাহেদের ফাঁদে পড়ে আবার………
রফিকুল ইসলাম আঁতকে উঠে বললেন, “কি বলছো তুমি? আমার মেয়ে এমন ………” সাবরিনা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমি হতে দেইনি। মায়ের সাথে আমার নাড়ীর সম্পর্ক তাই আমি তার ওপর আমার জাদু প্রয়োগ করতে পারি। ও হ্যাঁ, তোমাকে তো জাদু দেখানোই হয়নি। পারলে তোমার হাত তুলো তো।” রফিকুল ইসলাম লক্ষ্য করলেন তিনি হাত তুলতে পারছেন না। কোনোমতেই পারছেন না। সাবরিনা হেসে উঠলো। বলল, “এটা আমার জাদু। আমিও সেদিন মায়ের সাথে এমন করেছিলাম। তারপর তাকে কষ্ট দিলাম। এতে মা দিশেহারা হয়ে বাসায় চলে আসে। মাকে হয়তো আমি নোংরা কাজ থেকে বাঁচিয়ে এনেছি। কিন্তু তার মন? সেটা তো নোংরা হয়ে আছে। তাই আমি সেদিন থেকে মা বলা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু তোমরা ভাবছো বদ-আছর পড়েছে। হা হা।” এতক্ষণে রফিকুল ইসলাম তার হাত তুলতে পারলেন। তার বুকে প্রচন্ড ব্যাথা করছে। আর্তনাদের ব্যাথা। সাবরিনা বলল, “তোমার কষ্ট হচ্ছে খুব, তাই না? ভাবো আমি কতটা কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি। একদিকে নোংরা বাবা অন্যদিকে নোংরা মা। দাদা-দাদীও নোংরা। তাদের নজর তোমার সম্পত্তির দিকে। আমি আস্ত একটা নোংরা ডাস্টবিনে আছি। তোমার মুখের ভাষা খারাপ কিন্তু মনটা একদম কাঁচের মতো স্বচ্ছ ও পরিষ্কার।” সাবরিনা একটু থামলো। তারপর বলল, “এখন তুমি যাও। আমি একটু একা থাকবো। আর হ্যাঁ, এসব কাউকে বলবে না। তোমার বউটাকেও না। হা হা হি হি।” সাবরিনা হাসতে লাগল। এই হাসির কষ্টের নাকি অন্যকিছুর তা তিনি বুঝলেন না। তিনি উঠে পড়লেন। দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। নূরী তার মায়ের সাথে হাসাহাসি করছে। রফিকুল ব্যথিত স্বরে বললেন, “কুলসুম, উঠো। চলে যাব আমরা।” নূরী উঠে বলল, “থাকো না কিছুদিন।” রফিকুল ইসলাম সজোরে নূরীর গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। তারপর ছলছল চোখে রাগে ফুঁসতে লাগলেন। কুলসুম যেন আকাশ থেকে পড়লেন। হঠাৎ রফিকুল ইসলামের এমন কেন করলেন তা কেউই বুঝলো না। তারা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না।

জাহেদ এক দুপুরে নূরীর এলো বাসায়। দুজনে মিলে কিছুক্ষণ গল্প করলো। একসময় জাহেদ বলল, “সাবরিনাকে অন্য রুমে রেখে এসো।” নূরী মুচকি হাসি দিয়ে মেয়ের দিকে এগোতেই দেখলো সাবরিনা চোখদুটো বড় বড় করে জাহেদের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এক ভয়ানক দৃষ্টি। বাচ্চারা সাধারণত এভাবে তাকায় না। নূরী দেখলো জাহেদ তার সামনে থাকা চায়ের কাপ উঠানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। সে হাত নড়াতে পারছে না। নূরী কিছুক্ষণ দুজনকেই পর্যবেক্ষণ করলো। তারপর জাহেদের কাছে এসে শান্ত স্বরে বলল, “কি হয়েছে?”
- বুঝতেছি না। হঠাৎ হাত নড়াতে পারছি না।
- আমার মনে হয় এখন তোমার যাওয়া উচিত।
জাহেদ সাথেসাথেই উঠে দাঁড়ালো। তার মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা করতে লাগল। তাই সে প্রস্থান করলো।

রাতে বারান্দায় বসে আছে আসাদ ও নূরী। আজ সারাদিন নূরী অনেক কিছু নিয়ে ভেবেছে। আসাদের কোলে যেতে সাবরিনার অনাগ্রহ, আজ পর্যন্ত বাবা বলে না ডাকা, জাহেদের সাথে সেদিন হঠাৎ তার হাত অবশ হয়ে যাওয়া, ঘটনাটির পর মা বলাও বন্ধ করে দেওয়া, আজ জাহেদের হাত অবশ হয়ে যাওয়া, ওইদিন তার বাবা সাবরিনার সাথে সময় কাটানোর পর এসেই তাকে থাপ্পড় মারা এসব ঘটনা নিয়ে নূরী বেশ ভেবেছে। সবচেয়ে দৃষ্টিগোচর ব্যাপার হলো তার ও জাহেদের হাত অবশ হয়ে যাওয়া। এছাড়াও সাবরিনার সেই দৃষ্টি এখনো নূরীর চোখের চোখের সামনে ভাসছে। নূরীকে বিচলিত ও গম্ভীর দেখে আসাদ বলল, “কি হয়েছে তোমার?” নূরী কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “ফারজানার সাথে তোমার সম্পর্ক কবে থেকে?” আসাদ ভীষণ অবাক হলো। ভয়ও পেল। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই নূরী বলল, “আমি সব জানি। অতএব আমাকে মিথ্যা বলার চেষ্টা করবে না। সত্য বল এতেই মঙ্গল।”
- অনেকদিন থেকে। আ'ম স্যরি নূরী।
- সাবরিনা জন্মের আগ থেকে?
আসাদ মাথা দুলিয়ে বলল, “তবে আমি এখন ওসব থেকে সরে এসেছি।”
- মিথ্যে। তুমি এখনো ওই নারীতে আসক্ত আছ। তাই তো সাবরিনা আজ পর্যন্ত তোমার কোলে যায়নি। ও কোনো সাধারণ মেয়ে নয়। ও অদ্ভুত।
আসাদ কোনো বিস্মিত হলো না। কেননা সে সাবরিনার সেই হাসির রহস্য আজও উন্মোচন করতে পারেনি। নূরী লাজ লজ্জা ভুলে হোটেল ও আজকের ঘটনাটি বলল। তবে অতীত নিয়ে কিছু বলল না। তারপর আসাদের হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বলল, “আমি তোমার অপরাধী। আমাকে ক্ষমা করো।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসাদ বলল, “বড় অপরাধী তো আমি। আমি প্রতিনিয়ত তোমাকে ঠকিয়েছি।” দুজনেই কাঁদতে লাগল। কান্নার শব্দে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠলো। বেশ কিছুক্ষণ পর তা শান্ত হলো। নূরী বলল, “তুমি বিশ্বাস করো বা না করো আমার মনে হয় সাবরিনা আমাদের ব্যাপারে সবই জানে। ও আমাদের অন্তর পড়তে পারে।”

তারা দুজন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে সাবরিনার কাছে এলো। পুতুলের সাথে খেলছে সাবরিনা।
“মাফ করে দে মা। আমরা আর কখনোই খারাপ পথে পা বাড়াবো না। আমাদেরকে ক্ষমা করে দে।” একই কথা বলে তারা সাবরিনার সামনে পড়ে কাঁদতে লাগল। সাবরিনা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। যেন সে অভিমান করেছে। অজস্র চেষ্টা করেও তারা সাবরিনার মুখ ঘুরাতে পারলো না। সাবরিনাকে ছুঁতে গিয়ে তারা স্পষ্ট স্বরে শুনতে পেল, “চলে যাও। এক্ষুণি চলে যাও।” অত্যন্ত রাগী ও ভয়ানক স্বরের কথাগুলো। অথচ সাবরিনার মুখ একটুও নড়েনি।

ছয় মাস পেরিয়ে গেল। সাবরিনা বিগত কিছু মাস ধরে নানা-নানীর কাছেই থাকে। নাতনির সাথে সময় বেশ ভালো উপভোগ করেন নানা-নানী। আজ সাবরিনার জন্মদিন উপলক্ষে আসাদ-নূরী একটা কেক নিয়ে হাজির হলো। রফিকুল ইসলাম বললেন, “আয় ভেতরে আয়।”
নূরীঃ না, বাবা। আমরা ভেতরে আসবো না। তুমি এটা সাবরিনাকে দিও।
পেছন থেকে সাবরিনা মা মা বলে ডাক দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। নূরী দৌড়ে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলে কেঁদে উঠলো। সাবরিনা তার বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে বাবা বাবা বলে ডাক দিলো। আসাদের পা জমে গেল। এই প্রথম সে বাবা বলে ডেকেছে। খুশিতে আসাদ সেখানে বসে পড়লো আর কাঁদতে লাগল। অদৃশ্য শব্দের মাধ্যমে সাবরিনা তার নানাকে বলল, “এরা এবার ভালো জগতে ফিরেছে। আমিও এবার স্বাভাবিক হয়ে ফিরবো। তবে পৃথিবীটা খুব নোংরা। খুব। এই অদ্ভুত শক্তি না পেলেই বোধহয় ভালো হতো। তাহলে আমি বাকিদের মতো চুপচাপ জীবন অতিবাহিত করতে পারতাম।” রফিকুল ইসলাম মনে মনে বললেন, “এই শক্তি বোধহয় তুমি তোমার বাবা মাকে সঠিক পথে ফেরাতেই পেয়েছ। চাইলে আরও ভালো ভালো কাজেও ব্যবহার করতে পারবে। আর হ্যাঁ, হয়তো পৃথিবীটা নোংরা। কিন্তু এই পৃথিবীতে তোমার মতো একটা পবিত্র মনও তো আছে।” সাবরিনা হেসে বলল, “আর নানীর মতো একটা কিউট-রোমান্টিক মনও আছে। তুমি শুধু তোমার কর্কশ স্বভাব কমাও। বুড়ো হয়েছো এবার শান্ত স্বভাবে ফেরো।” রফিকুল ইসলাম বললেন, “মন তো আর বুড়ো হয়নি ছোট ডার্লিং।” মনে মনে কথাটা বলেই তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। সেই সাথে সাবরিনাও। আসাদ-নূরী কিছু বুঝলো না। তবুও তারা সঙ্গ দিয়ে হেসে উঠলো।

সমাপ্ত।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.