নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিখতে জানতে ও ছড়িয়ে যেতে চাই।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী

আমি বাপ্পী। জন্মস্থান বরিশাল। বেড়ে উঠা চট্টগ্রাম।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পের নামঃ বিস্ময়কর পাথর।

১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৪:২৯

গল্পের নামঃ বিস্ময়কর পাথর।
লিখেছেনঃ মোঃ জোবায়ের বাপ্পী।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। পশ্চিমাকাশ সূর্যকে তার গর্ভে সমাধিত করে ফেলেছে। তবে লাল আভাটা এখনো পুরোপুরি বিলীন হয়নি। সূর্যও যেন তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু পেরে উঠছে না। সূর্যের অনুপস্থিতিতে চারদিকে আঁধার নেমে আসছে। পাখিরা তাদের নীড়ে ফিরে গেছে। কিছু কিছু এখনো ফিরছে। ফিরছে অনেক মানুষও তাদের নীড়ে। তাদেরই একজন নূরী। যার আপাতত লক্ষ্য আঁধার হওয়ার আগেই ঘরে ফেরা। সেই উদ্দেশ্যে খুব দ্রুত পা চালাচ্ছে। মা-বাবার কঠোর আদেশ সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ঘরে ফিরে আসতে হবে। প্রতিদিনই ভার্সিটি-টিউশন-কোচিং শেষে সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরে। কিন্তু আজ বান্ধবীকে এসাইনমেন্ট দেখাতে তার বাসায় যাওয়ায় দেরি হয়ে গেছে। মিঠাগলির মুখে মোড়ে পা ফেলতেই নূরী মনে মনে দোয়া দুরূদ পড়া শুরু করলো। মনেপ্রাণে দোয়া চাইতে লাগল যাতে গলির ছেলেগুলোর সম্মুখীন না হতে হয়। অন্যান্য দিন সাথে দুজন বান্ধবী থাকতো। আজ তারা নেই। তারওপর সন্ধ্যা। আবার এই সময় এইদিকে মানুষজনও খুব একটা থাকে না। মিঠাগলি পের হয়ে পরবর্তী গলিতেই নূরীদের বাসা। একটু সামনে আসতেই নূরীর মন ভয়ে অস্থির হয়ে পড়লো। কথায় আছে যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। ঠিক তাই। ছেলেগুলো সামনেই তাদের আড্ডাখানায় বসে আছে। নূরীকে দেখতেই সবাই যেন খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। তাদের সবার নজর নূরীর দিকে। তারা ধীরে ধীরে নূরীর দিকে এগিয়ে আসছে। নূরী দেখেও না দেখার ভান করে হেঁটে যাচ্ছে। তার ইচ্ছে করছে দৌড় দিতে। কিন্তু ভয়ে সেটাও করতে পারছে না। তাছাড়া দৌড় দিলে অবস্থা আরও বেগতিক হয়ে যেতে পারে। নূরী যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে হেঁটে যাচ্ছে। ছেলেগুলো নূরীকে উদ্দেশ্য করে নানা রকম বাজে কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু নূরী সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না। সে তার গতিতে পা চালাচ্ছে। হঠাৎ একটা ছেলে এসে নূরীর পথ আটকে দাঁড়ালো। ভয়ে নূরীর কান্না পেতে লাগল। সে আমতা আমতা করে বলল, “কি সমস্যা আপনার? পথ আটকালেন কেন?” ছেলেটা তার হাত বাড়িয়ে নূরীকে স্পর্শ করতে লাগল। ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ একজন নূরীর নাম ধরে ডাক দিলো। সবাই সেদিকে ফিরলো। নূরীও তাকালো।বাইকের ওপর বসে আছে একটা ছেলে। ল্যাম্পপোষ্টের মৃদু আলোতেও নূরী ছেলেটাকে চিনতে পারলো। ছেলেটি আসাদ। তাদের বাড়ির তৃতীয় তলায় থাকে। নূরী ছেলেগুলোর পাশ কাটিয়ে আসাদের কাছে ছুটে এলো। ছেলেগুলোর একজন বলল, “বুঝলি দোস্ত, বাইক কিনতে হবে। বাইক থাকলে মেয়েরা এভাবে ছুটে আসবে। তারপর বাইকের পেছনে বসাবো। আর বারবার হার্ড ব্রেক মারবো। সেই ফিলিং দোস্ত। সেইইইই।”

নূরীকে নিয়ে বাসার সামনে চলে এলো আসাদ। বাইক থেকে নেমে নূরী বলল, “আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো! আজ আপনি না হলে কি যে হতো! ভাবতেই গা শিউরে উঠে।” আসাদ তার বাইক পার্ক করতে করতে বলল, “আংকেলকে বলো কিপটেমি ছেড়ে দিতে। মেয়ে তার একটাই।” আসাদ চলে গেল। নূরী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। নূরীর বাবা আফজাল খান বেশ ধন সম্পদের মালিক। ভালো ব্যবসা আছে। শহরের মধ্যে সাত তলা এই বিশাল ভবন আছে। তবে বেশ কৃপণ। বাসা থেকে নূরীর ভার্সিটি পায়ে হেঁটে মিনিট বিশেকের পথ। তাই আফজাল খান বলেন পায়েই হেঁটে যেতে। এতে স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। নাস্তা পানির জন্য মাত্র দশ টাকা দেন। বলেন, “দুটো সিঙ্গারাই যথেষ্ট।” অবশ্য নূরীর মা দিলুয়ারা বেগম লুকিয়ে লুকিয়ে আরও কিছু হাত খরচ দেন। কেননা তিনি জানেন এই যুগে ছেলেমেয়েদের হাত খরচ একটু লাগেই। কৃপণতার এই ব্যাপারটা নূরী কাউকে বুঝতে দেয় না। তাহলে আসাদ জানলো কিভাবে? গাড়ির হরণ শুনে নূরীর ভাবনায় ছেদ পড়লো। নূরী ঘরে চলে এলো। দেরি হওয়ায় দিলুয়ারা বেগম কিছুটা বকাঝকা করেছেন। নূরী ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। আসাদের কথা ভাবতে লাগল। আসাদকে একটা নাম দিয়েছে নূরী। বিস্ময়কর পাথর। আসাদ তাদের বাড়িতে আজ প্রায় চার বছর ধরে থাকছে। এই চার বছরে আসাদের ফ্ল্যাটে কেউই যেতে পারেনি। কিভাবে যাবে? আসাদ যে কারও সাথেই মিশে না। আসাদ সকালে বের হয় আর রাতে ফিরে। মাঝে মাঝে সন্ধ্যায়ও ফিরে। শুক্রবারও সে যথাসময়ে অফিস ড্রেসে বেরিয়ে যায়। বাসা নেওয়ার সময় আসাদ বলেছিল সে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। নূরী ভেবে পায় না এমন কোন অফিস যা সপ্তাহে সাতদিন, মাসে তিরিশ দিনই খোলা থাকে। এই চার বছরে আসাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করার জন্য কেউ আসেনি। আসাদ বলেছিল তার কেউ নেই। তাই বলে বন্ধুবান্ধবও নেই? আসাদের এসব বিস্ময়কর তথ্যের কারণে নূরী তাকে বিস্ময়কর পাথর বলে। পাথর বলার অন্যতম কারণ আসাদের মুখে নাতো হাসি দেখা যায় নাতো দুঃখ। সবসময়ই মাঝামাঝি পর্যায়ে থাকে।

পরেরদিন নূরী যথাসময়ে বান্ধবীদের সাথে ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরছে। মিঠাগলি দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই যাচ্ছে। অন্ধকার এখনো হয়নি। লোকজনের সমাগমও আছে। সাধারণত এমন সময়ে ছেলেগুলো শুধু দূর থেকেই টিজিং করে। কাছে আসে না। তবে আজ এগিয়ে আসছে। তা দেখতেই নূরী কিছুটা ভয় পেল। তার বান্ধবীরাও জড়োসড়ো হয়ে হাঁটতে লাগল। ছেলেগুলো নূরীর সামনে এসে সালাম দিলো। নূরী মনে মনে ভাবলো হয়তো টিজিং করার নতুন কোনো পদ্ধতি এটা। ছেলেগুলোর মধ্যে নেতা ধরণের ছেলেটা বলল, “আপু, আপনি যে ইমতিয়াজ ভাইয়ের পরিচিত সেটা আগে বলবেন তো। আমি আসলে জানতাম না। এখন থেকে কেউ আপনাকে বিরক্ত করলে আমাকে বলবেন। একদম শায়েস্তা করে দিবো। আচ্ছা আপু যান। ভালো থাকবেন।” নূরী ও তার বান্ধবীরা অবাক হয়ে গেল। পথিমধ্যে তারা জিজ্ঞেস করলো ইমতিয়াজ ভাইটা কে? নূরী বলল তার কাজিন। অথচ এই নামে কাউকে সে চিনে না। তবে সে অনুমান করছে এর পেছনে আসাদের হাত আছে। নয়তো বিগত কয়েক মাস ধরে ছেলেগুলো বিরক্ত করে যাচ্ছে। অথচ গতকাল আসাদের সম্মুখীন হওয়ার পরেই আজ ছেলেগুলোর আচরণ বদলে গেছে।
কিছুদিন যাবত্‍ নূরী শত চেষ্টা করেও আসাদের মুখোমুখি হতে পারলো না। ছেলেটা যে কখন আসে আর কখন যায় বুঝাই যায় না। অবশেষে এক সকালে আসাদের দেখা মিললো। নূরী ভার্সিটির বাহানা করে বেরিয়ে পড়লো। আসাদকে দেখে এমন ভাব করলো যাতে সে সত্যিই ভার্সিটিতে যাচ্ছে এবং তার খুব তাড়া আছে। দিলুয়ারা বেগম হরলিকসের গ্লাস নিয়ে এগিয়ে এলেন। এই কয়েকদিন ধরে নূরী সাতসকালেই ভার্সিটির জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে। নূরী আসাদকে বলল, “আপনি তো আমার ভার্সিটির পাশ দিয়েই যান। আমাকে কি ওখানে একটু ড্রপ করে দিবেন? আসলে একটা এসাইনমেন্টের কাজের জন্য দেরি হয়ে গেছে।” আসাদ বিন্দুমাত্র অবাক না হলেও দিলুয়ারা বেগম ভীষণ অবাক হয়েছেন। যেখানে নূরী তার কাজিনদের বাইকেও উঠে না। সেখানে একটা অপরিচিত ছেলের বাইকে উঠার প্রস্তাব নিজ থেকেই দিচ্ছে! ব্যাপারটা বেশ বিস্ময়কর। গ্লাস হাতে নিয়ে দিলুয়ারা বেগম মেয়ের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছেন। তবে নূরী কোনো ভ্রুক্ষেপ করলো না। আসাদ বাইক চালু করলো। তার নীরবতাকে সম্মতি মেনে নিয়ে নূরী পেছনে উঠে পড়লো। কিছুদূর যেতেই আসাদ অন্য রাস্তা নিলো। তা দেখে নূরী কিছুটা ভয়ভীত হলো। বলল, “ভার্সিটি তো ওই দিকে। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?” আসাদ কোনো জবাব দিলো না। সে চুপচাপ বাইক চালিয়েই যাচ্ছে। নূরী ভয়ে কিছু বলতেও পারছে না। বেশ কিছুদূর আসার পর আসাদ বাইক থামালো। তারপর নূরীকে নামতে বলল। নূরীও চুপচাপ নেমে পড়লো। কিন্তু কিছু বলার আগেই আসাদ বলল, “নেক্সট টাইম এসব চালাকি করলে অন্য শহরে নিয়ে ছেড়ে আসবো।” আসাদ কোনো জবাবের অপেক্ষা করলো না। এক টান দিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। নূরী বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। তার মস্তিষ্ক যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সে বুঝতেই পারছে না আসাদ এমন কেন করলো?

নূরী বই নিয়ে বসে আছে। তবে তার মন বইতে নেই। আনমনেই সে আসাদের কথা ভাবছে। কেন যেন আসাদকে নিয়ে ভাবতে তার ভীষণ ভালো লাগছে। কিন্তু কিসের এই ভালোলাগা তা নূরী বুঝে উঠতে পারছে না। এমন সময় দিলুয়ারা বেগম রুমে এলেন। নূরী তার মায়ের উপস্থিতিও বুঝতে পারলো না। দিলুয়ারা বেগম কিছুক্ষণ নূরীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “দুনিয়াতে বুঝি আর ছেলে ছিল না? এমন একটা ছেলের প্রেমেই পড়তে হলো?”
“কেন মা? ও কি খারাপ ছেলে? কত শান্তশিষ্ট ছেলে। এমন ছেলে আজকাল পাওয়া যায় নাকি?” আনমনেই নূরী কথাগুলো বলে দিলো। তারপর হুট করেই জিহ্বায় কামড় দিলো। মনে মনে বলল আয় হায় কার সামনে কি বলে ফেললাম। নূরী আমতা আমতা শুরু করলো।
- ইয়ে… মানে… আসলে হয়েছে কি …… মা তুমি কখন এলে?
- যখন তুই ছেলেটাকে নিয়ে ভাবনার বিভোর।
- কি যে বলো না মা। কোন ছেলে? কিসের ছেলে?
- হয়েছে। আর নাটক করতে হবে না।
নূরী ধরা পড়ে গেল। অবশেষে বলতে বাধ্যই হলো যে‚ সে আসাদকে পছন্দ করা শুরু করেছে। এতে অবশ্য দিলুয়ারা বেগম কিছু অনুযোগ করেছেন। এমন একঘেয়েমি ছেলের সাথে জীবন পার করা কষ্টকর। তবে নূরী তার সেই বিপদের ঘটনাটি উল্লেখ করে বলেছে আসাদ হয়তো মিশুক নয় তবে ছেলে হিসেবে খুব ভালো।

নূরী এখন আসাদের সময়সূচী ধরে ফেলেছে। খুব সকাল সকাল বেরিয়ে যায়। আর খুব রাত করে বাড়ি ফিরে। যাতে কারও নজরে না আসে। তবে নূরীর নজরে ঠিকই আসে। এক সকালে নূরী সেই আগেরমত ভার্সিটিতে ড্রপ করার প্রস্তাব দিলো। তবে এবার আসাদ সরাসরি না বলে জানালো তার অফিস পরিবর্তন হয়েছে। সে এখন অন্য রাস্তা দিয়ে যায়। যদিও নূরী ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। নূরী এখন নিয়ম করে আসাদের সামনে আসে। সকালে-রাতে আসাদের সাথে তার দেখা হয়। নানান ভাবে শাসায়। এত রাত করে কেন ফিরেন? এত সকাল কোন অফিসটা খুলে নাম বলুন। সারা মাসই খোলা থাকে এমন চাকরি কেন করেন? আপনার বন্ধুবান্ধব নাই কেন? এমন সব প্রশ্ন করে নূরী। তবে আসাদ কোনোটারই জবাব দেয় না। শুধু রাগ-বিরক্তি মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে যায়। কিছুদিন ধরে নূরীর মনে ব্যাপক আনন্দ কাজ করছে। আসাদকে জ্বালিয়ে সে খুব মজা পাচ্ছে। বারান্দায় বসে বসে নূরী ভাবছে আজ কি কি প্রশ্ন করবে। দিলুয়ারা বেগম এসে বললেন, “আসাদ বাসা ছেড়ে দিয়েছে। আজ ভাড়া দেওয়ার সময় তোর বাবাকে কথাটা বলেছে। এই মাসেই চলে যাবে।” নূরীর মাথায় যেন একটা বাজ পড়লো। তার দুনিয়া নড়েচড়ে উঠলো। নূরী অনেক রাত ধরে আসাদের অপেক্ষা করলো কিন্তু আজ আর তাকে ধরতে পারলো না। দুয়ারে কান পেতে থাকতে থাকতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে তাড়াতাড়ি উঠেও কোনো হদিস পেল না। এভাবে বেশ কিছুদিন চলে গেল। আসাদ যেন তার তার সাথে লুকোচুরি খেলা শুরু করেছে। আর এই খেলায় আসাদই জয়ী হচ্ছে। আসাদের রুমেও বেশ কয়েকবার এসেছে নূরী। কিন্তু প্রতিবারই আসাদের রুমে বাইরে তালা ঝুলতে দেখেছে। নূরী ভেতর থেকে একেবারে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। নূরীর মনের পরিস্থিতি দিলুয়ারা বেগম বুঝলেন। মেয়েকে শান্ত্বনা দিতে লাগলেন। কিন্তু নূরীর মন তা মানে না। আর কিছুদিন পরেই তার প্রাণ পাখি অজানা কোনো নীড়ে বাসা বাধবে। নূরী এটাও জানে না আসাদ এখন কোথায়। কেননা এই কয়েকদিনে সে আসাদের অস্তিত্ব অনুভব করেনি। দুঃখের সাগরে ভেসে ভেসে নূরী তার দিন অতিবাহিত করতে লাগল।

এক মধ্যরাতে নূরীর ঘুম ভেঙে গেল। কিছুদিন ধরে এমনিতেই তার ঘুম হচ্ছে না। বারান্দায় আসতেই তার নজর বাড়ির পাশে থাকা মাঝারি আকারের ট্রাকের ওপর পড়লো। কিছু লোকজন ট্রাকে সোফা তুলছে। নূরীর মনে অজানা ভয় হামলা দিলো। সে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলো। তার ধারণাই সত্য হলো। আসাদ রাতের আঁধারে চুপিচুপি আসবাবপত্র নিয়ে পালাচ্ছে। নূরী তার আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলো না। আসাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। নূরীকে দেখে আসাদ বেশ অবাক হলো। তবে নিজেকে সামলে নিলো। নূরী কিছুটা উচ্চ স্বরে বলল, “আপনি আমার সাথে এটা করতে পারেন না।”
- এত রাতে একটা মেয়ের বাইরে আসা উচিত না। যাও ভেতরে যাও।
- এভাবে রাতের আঁধারে পালিয়ে যাচ্ছেন কেন?
- পালাচ্ছি কোথায়? আমি আংকেলকে আগেই বলে রেখেছি।
- কেন চলে যাচ্ছেন?
- আমার ট্রান্সফার হয়েছে।
- সব মিথ্যে। আমাকে ভালোবাসার ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন তাই না?
- কি যাতা বলছো?
নূরী হঠাৎই আসাদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। উপস্থিত লোকজন রীতিমতো অবাক হয়ে গেল। আসাদ অনেক কষ্ট নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। চোখের পানির সাথে নূরী বলল, “প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাবেন ন। আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো। খুব ভালোবাসি আপনাকে।” নূরীকে ধাক্কা দিয়ে বাড়ির মধ্যে পাঠিয়ে দিয়ে বলল‚ “একটা থাপ্পড় দিব। যা ভেতরে যা।”
- আমি আপনাকে যেতে দিবো না।
আসাদ এগিয়ে এলো। তার চেহারা আগুনের মতো লাল হয়ে উঠেছে। নূরী কিছুটা ভয় পেয়ে বলল, “মারবেন? মারেন। তবুও বলব আমি আপনাকে ভালোবাসি।” আসাদ কষে একটা থাপ্পড় মেরে দিলো। নূরী ছিটকে পড়লো মেঝেতে। আসাদ বলল, “তোর যোগ্যতা আছে আমার মতো একটা শিক্ষিত ছেলেকে ভালোবাসার? আমি আমেরিকা থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এসেছি। আমার নিজের একটা পরিচয় আছে। তোর কি আছে? তোর বাবার টাকা দেখে লোভীরা তোকে ভালোবাসবে। আমি না। যা আগে নিজের পরিচয় বানা। তারপর আমাকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখিস।” আসাদ চলে গেল। নূরী মেঝেতেই পড়ে রইলো।

সেদিনের পর নূরী একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেছে। সারাক্ষণ একাকী ঘরে বসে থাকে। হাসিমাখা মেয়েটার এমন নীরবতা দিলুয়ারা বেগমকে খুব কষ্ট দেয়। তিনি বুঝান, যে যাওয়ার সে চলে চলে গেছে। তার জন্য জীবন থামিয়ে রেখে লাভ নেই। কিন্তু নূরীর মাঝে কোনো পরিবর্তন আসছে না। তাই দিলুয়ারা বেগম সিদ্ধান্ত নিলেন নূরীর বিয়ে দিবেন। এই নিয়ে স্বামীর সাথে আলাপ করলেন। তিনিও সম্মতি দিলেন। তবে নূরী রাজি হলো না। দিলুয়ারা বেগম শত চেষ্টা করেও রাজি করাতে পারলেন না। 'জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না।' - এই সূত্র মেনে নিয়ে কিছু মাস পর নূরীও তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরলো। ভার্সিটিতে যাতায়াত শুরু করলো। উপরে উপরে নূরী হাসিখুশি থাকলেও ভেতরে ভেতরে সে নিস্তেজ হয়ে আছে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয় না। তবে দিলুয়ারা বেগম ঠিকই বুঝতে পারেন। মায়ের মন তো তাই। সময় তার গতিতে চলে গেল। পেরিয়ে গেল চারটি বছর। আজ নূরী নিজ পায়ে প্রতিষ্ঠিত। মাসিক খরচ বাবার থেকে খুঁজতে হয় না। সে নিজেই এখব পারিবারিক খরচ বহন করে। কৃপণতার স্বভাবের কারণে নূরীর বাবাও বেশ খুশি। বর্তমানে দেশের সুনামধন্য একজন আর্কিটেকচার।

দিলুয়ারা বেগম এবার উঠেপড়ে লেগেছেন নূরীকে বিয়ে দেওয়ার জন্য।
- নূরী, এই ছেলেটার ছবি দেখ তো। তোর সাথে খুব মানাবে।
- উফফ মা! আমি কতবার বলেছি এখন বিয়ে করবো না।
- এযাবৎ কিছু বলিনি। তবে এবার তোর বিয়ে দিয়েই ছাড়বো।
- তুমি যা খুশি করো। তবে আমি বিয়ে করছি না।
- দেখ মা, তোর বয়সী সবার বাচ্চাকাচ্চাও আছে। আমার এখন নাতি-নাতনিদের নিয়ে খেলার সময়। অথচ আমি তোর বিয়ে নিয়ে হ্যাঁ-না, হ্যাঁ-না খেলছি।
নূরী আর তর্কে জড়ালো না। উঠে চলে গেল। সে কিভাবে বিয়ে করবে? তার মন প্রাণ জুড়ে এখনো আসাদের বসবাস। তার মনে এখনো অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

পৃথিবী কমলা লেবুর মতো আংশিক চ্যাপ্টা হলেও সবাই সাধারণত বলে থাকে পৃথিবী গোল। এই গোল পৃথিবীতে ঘুরতে ঘুরতে অনেক সময়ই হারিয়ে যাওয়া মানুষের সাথে আবার দেখা হয়ে যায়। নূরীর সাথেও তাই হয়েছে। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে আসাদের সাথে তার দেখা হয়ে গেল। দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। নূরীর চোখে আনন্দ ও বিস্ময় থাকলেও আসাদ একদম স্বাভাবিক আছে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর নূরীই কথা শুরু করলো।
- কোথায় ছিলেন এতদিন?
- তাতে তোর কি?
- অনেক পরিবর্তন হয়েছেন। আগে তুই তুকারি করতেন না।
- আমাকে ভালোমতো চিনিসনি। আমি খুব খারাপ।
- তা আপনার ওয়াইফ কোথায়?
- আমি এসবে নাই। ব্যাচেলর ছিলাম‚ আছি, থাকবো।
আসাদ এখনো বিয়ে করেনি শুনে নূরী মনে মনে খুশি হলো। আসাদ বলল, “তোর হাজব্যান্ড কোথায়?” নূরী হাতের ইশারায় তার এক কাজিনকে দেখিয়ে বলল, “ওই যে আমার হাজব্যান্ড।” নূরী কথাটা বলে আসাদের দিকে লক্ষ্য রাখলো। তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। নূরী কিছুটা হতাশ হলো। সে ভেবেছিল তার হাজব্যান্ডের কথা শুনে আসাদের মন খারাপ হবে। কিন্তু কিছুই হলো না। কিভাবে হবে? আসাদ যে বিস্ময়কর পাথর। নূরী বলল, “এনিওয়ে এখন আমার একটা নিজস্ব পরিচয় আছে। আমি একজন আর্কিটেকচার।”
- ভালো।
- এখন তো একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা হয়েছে তাই না?
- মানে?
- আমি এখনো আপনার স্ত্রী হতে রাজি আছি।
কথাটা বলতে দেরি কিন্তু আসাদের রিয়েকশন হতে দেরি হয়নি। নূরীর গালে কষে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। নূরীর পরিবারের সবাই এগিয়ে এলো। আসাদকে দেখে দিলুয়ারা বেগম বেশ অবাক হলেন। নূরীর বাবা জেরা করতেই আসাদ বলল, “আপনার মেয়ে তো একটা চরিত্রহীনা। নিজের স্বামীকে রেখে পরপুরুষের সাথে পালাতে চায়। এই শিক্ষা দিয়েছেন মেয়েকে?” দিলুয়ারা বেগম পরিস্থিতি সামলে নিলেন। আসাদ-নূরীকে নিয়ে অন্য রুমে গেলেন। তারপর বিস্তারিত সব বললেন। সত্য শুনে নূরী অবাক হয়ে গেল। চার বছর আগে আসাদের চলে যাওয়ার পেছনে তার মায়ের হাত ছিল। বুঝার পর থেকেই নূরীর স্বপ্ন ছিল একজন আর্কিটেকচার হবে। সেই লক্ষ্যেই সে এগোচ্ছিল কিন্তু আসাদের সাথে পরিচয় হওয়ার পর প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। তাই একদিন দিলুয়ারা বেগম ব্যাপারটা আসাদকে বুঝিয়ে বলেন। অতঃপর আসাদ বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।

বেশ ধুমধাম করে আসাদ ও নূরীর বিয়ে হলো। আসাদের অনেক বন্ধুবান্ধবও এসেছে। তা দেখে নূরী কিছুটা অবাক হয়েছে। এই বিস্ময়কর পাথরের বন্ধুবান্ধবও আছে?
বেশ কিছুক্ষণ পর আসাদ বাসরঘরে প্রবেশ করলো। নূরীর পাশে এসে বসলো। তার হাতটা ধরলো। নূরী আসাদের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। আসাদ হেসে বলল, “আরে নতুন বউ এমন করে নাকি? লাজ শরম নাই বুঝি?”
- রাখো তোমার নতুন বউ। এই চারটা বছর আমি কতটা বিরহে কাটিয়েছি তা তুমি জানো?
- দোষ তোমারই। তুমি লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিলে। মেয়েদের এই একটাই সমস্যা। সফলতার খুব কাছাকাছি গিয়ে প্রেম ভালোবাসা মায়ায় পড়ে সব নষ্ট করে ফেলে।
- তবে একটা জিনিস মানতে হবে। তোমার থাপ্পড়ে জাদু আছে।
- থাপ্পড়ে জাদু?
- হ্যাঁ। প্রথম থাপ্পড়ে আমি আর্কিটেকচার হয়ে গেছি। দ্বিতীয় থাপ্পড়ে আমি বিবাহিতা হয়ে গেছি। এখন আরেকটা থাপ্পড় দাও। আমি মা হয়ে যাব।
নূরী চোখ টিপ মেরে হেসে উঠলো। সেই সাথে আসাদও হাসতে লাগল। তাদের হাসির শব্দে রুম ভরে উঠলো। কিছুক্ষণ পর নূরীর হাসি থামলেও আসাদের থামছে না। নূরী অবাক হয়ে দেখছে শুধু। কি মায়াবী হাসি! কি সরল হাসি! এই হাসিতে কোনো কারচুপি নেই। নূরী মনে মনে বলল, এই বিস্ময়কর পাথর হাসতেও জানে? তার ইচ্ছে করছে সময়কে থামিয়ে দিতে। যেন এই হাসিটা সবসময়ই দেখতে পায়। কিন্তু তা তো সম্ভব না। তাই কিছুক্ষণ পর হাসিট থেমে গেল। আসাদ বলল, “কি দেখছো?”
- তোমার হাসি খুব ভালোবাসি।
- এই ডায়লগ তো আমার হওয়া উচিত ছিল।
- যা আমার তাই তোমার।
- তুমিও আমার।
আসাদ নূরীকে জড়িয়ে ধরে আবার হাসতে শুরু করলো।

সমাপ্ত।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.