![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গল্পের নামঃ সময়ের শিক্ষা।
লিখেছেনঃ মোঃ জোবায়ের বাপ্পী।
আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে আসাদের। তাই তাড়াহুড়োয় লান্স বক্স নিতে ভুলে গেছে। বাইরের খাবার তার একদম সহ্য হয় না। গ্যাস্ট্রিক সমস্যাটা বাড়ে। তাই তার মা ইয়াসমিন বেগম লান্স বক্স নিয়ে এসেছেন। সাধারণত ঘরে কেউই দামী শাড়ি গয়না পরে থাকে না। নববধূর ব্যাপারটা ভিন্ন। আসাদের মা সাধারণ শাড়ি পরেই ছেলের অফিসে এসেছেন। অফিস তিনি চিনেন। তবে এর বেশি বিস্তারিত কিছু জানেন না। আসাদ কত তলায়, কিসের কাজ করে তা জানেন না। আসাদের মা হিসেবে পরিচয় দেওয়ায় দারোয়ান কোনো বাধা দেয়নি। যুগ ভালো না, তাই ইয়াসমিন বেগম নিজ হাতেই লান্স বক্সটা আসাদকে দিতে চান। আসাদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় একজন জানালো আসাদ মিটিংয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বের হবে। ওয়েটিং রুমের এককোণায় সোফায় বসে রইলেন ইয়াসমিন বেগম। কিছুক্ষণ পর নূরী এলো সেখানে। সে এই অফিসের সহকারী ম্যানেজার। আসাদ তার অধীনেই কাজ করে।
- আপনি কে? এখানে ঢুকতে দিলো কে?
- আমি আসাদের ………
ইয়াসমিন বেগমের কথা শেষ করতে না দিয়েই নূরী বলল, “বুঝেছি। আসাদের জন্য লান্স বক্স নিয়ে এসেছেন, তাই তো?”
- হ্যাঁ।
- তো এটা দারোয়ানকে দিলেই হতো। ভেতরে কেন এলেন?
ইয়াসমিনকে তুচ্ছ করে কথাটা বলল নূরী। এতে ইয়াসমিন বেগম বেশ আহত হলেন। তবে পরক্ষণেই বুঝলেন এসবই কাপড়ের জন্য। আজ যদি তিনি ভালো কাপড় পরে আসতেন তাহলে তার সাথে ভালো আচরণ করা হতো। নূরী দারোয়ানকে ডাকলো। তাকে বকাঝকা করে বলল, “তুমি আমাদের অফিসের নিয়ম জানো না? এই ওয়েটিং রুমটা বিদেশী ক্লাইন্টদের জন্য তা জানো না? আজ যদি একটা বিদেশী ক্লাইন্ট আসতো তাহলে কি ভাবতো? আমাদের কোনো স্ট্যান্ডার্ড নাই, পরিবেশ ঠিক নাই এসব ভাবতো। তখন আমাদের পজিশন কোথায় যেতো?” দারোয়ান অনবরত স্যরি ম্যাম, স্যরি ম্যাম বলে যাচ্ছে। নূরী লান্স বক্সটা দারোয়ানকে নিতে বলল। দারোয়ান সেটা নিতে পা বাড়াতেই আসাদ সেখানে উপস্থিত হলো।
- মা, তুমি এখানে?
নূরীর কথাগুলো শুনে বেশ অপমানবোধ করলেন ইয়াসমিন বেগম। কষ্টের চাপে তার মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না। বক্সটি রেখে তিনি লজ্জিত মুখে বেরিয়ে যেতে লাগলেন। আসাদ বাধা দিয়ে বলল, “কোথায় যাচ্ছো? আজ যখন অফিসে এসেই পড়েছ, তো আমাদের অফিস দেখে যাবে। আমার কেবিনও দেখে যাবে।” হঠাৎ আসাদ লক্ষ্য করলো তার মায়ের চোখে পানি। আসাদ বলল, “কি হয়েছে মা? তোমার চোখে পানি কেন?” নূরী বুঝলো যে সে বড় ভুল করে ফেলেছে। পরিস্থিতি সামলাতে সে এগিয়ে এসে বলল, “আন্টি আসুন না অফিসটা এক নজর দেখে নিন। আপনি তো আগে কখনো আমাদের অফিসে আসেননি। এই দারোয়ান, আন্টির জন্য ঠান্ডা জুস ও নাস্তা নিয়ে আসো।”
ইয়াসমিন বেগম সত্যটা এড়িয়ে গেলেন। ছেলে এতো ভালো জায়গায় জব করে এটা দেখেই তার চোখে পানি এসেছিল বললেন। আসাদও বিশ্বাস করলো। নূরী বেশ খাতির-যত্ন করলো। নাস্তা-পানি, জুস এনে অফিস রুমকেই ডাইনিং টেবিল বানিয়ে ফেলল। ইয়াসমিন বেগম অল্প কিছু খেয়েই বেরিয়ে পড়লেন। জানালেন ঘরে অনেক কাজ ফেলে এসেছেন। আসাদও বাধা দিলো না। একটা সিএনজিতে তুলে দিলো। ইয়াসিন বেগম এটা ভেবে খুশি হলেন যে অফিসে আসাদের একটা সুনাম আছে। তাই তো আসাদের মা জানার পর নূরী তাকে খুব গুরুত্ব দিয়েছে।
ঘন্টাখানেক পর রীতার মাধ্যমে সত্যটা জানলো আসাদ। রীতা ও আসাদের একই বিভাগে কাজ করে। নূরীকে সে দুচোখে দেখতে পারে না। যার অন্যতম কারণ আসাদ। আসাদ ও নূরী একে অপরকে ভালোবাসে। অপরদিকে রীতাও আসাদকে পছন্দ করে। নূরী তাদের সিনিয়র হলেও আসাদের সাথে তার ভালোবাসাটা বেশ দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। এই নিয়ে অফিসে বেশ গুঞ্জনও আছে। সবাই মনে করে আসাদ যেসব সুযোগ-সুবিধা পায় তা নূরীর বদৌলতে। অথচ সত্য হলো যোগ্যতা অনুসারেই সুযোগ-সুবিধা পায়।
সত্য জানার পর আসাদ রেগেমেগে আগুন। সোজা নূরীর কেবিনে এলো।
- তুমি তখন আমার মাকে অপমান করেছ, তাই না?
ভয়ে নূরীর গলা শুকিয়ে গেল। এই অফিসে তার অধীনস্থ সবাই তাকে ভয় পায়। কিন্তু সে আসাদকে ভীষণ ভয় পায়। একেই হয়তো ভালোবাসার ভয় বলে। নূরী কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, “আসলে আমি উনাকে চিনতে পারিনি। তাই………”
- তাই বলে তুমি আমার মাকে অপমান করেছ। তোমার মাঝে কি নূন্যতম মূল্যবোধ নেই? একজন মায়ের বয়সী মহিলার সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা জানো না?
- আমি সত্যিই লজ্জিত। ভবিষ্যতে আর এমন হবে না।
- হওয়ার মতো সুযোগ তুমি পাবেও না।
আসাদ বেরিয়ে গেল। নূরী কোনো তামাশা সৃষ্টি করতে চাইলো না। তাই আসাদকে বাধা দিলো না। অফিস ছুটির পর সে আসাদের সাথে কথা বলতে চাইলো। কিন্তু আসাদ তাকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়েই চলে গেল।
আজ প্রায় চারদিন হয়ে গেল নূরী কোনোভাবেই আসাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। অনলাইনের সবকিছু থেকে নূরীকে ব্লক করে দিয়েছে আসাদ। অফিস এলেও তার মুখোমুখি হয়নি। নূরীর মুখোমুখি না হওয়ার জন্য পরবর্তী প্রেজেন্টেশন থেকে নিজের নামটাও সরিয়ে নিয়েছে আসাদ।
নূরীকে দেখে ইয়াসমিন বেগম বেশ অবাক হলেন। এই মেয়ে হঠাৎ ঘরে এলো কেন?
- আন্টি আমি কি ভেতরে আসতে পারি?
- হ্যাঁ মা এসো।
নূরী ভেতরে এসে বসলো। ইয়াসমিন বেগম এক গ্লাস জুস নিয়ে এলেন। নূরী এসে তার পাশে বসলো। এতে ইয়াসমিন বেগম বুঝলেন যে নূরী বিশেষ কোনো কথা বলার জন্য এসেছে।
- কি হয়েছে মা? তোমাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।
- আসলে আন্টি, কথাটা কিভাবে বলব বুঝে উঠতে পারছি না।
- আমি সেদিনের ব্যাপারটা ভুলে গেছি। ওসব নিয়ে কিছু বলতে হবে না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে নূরী বলতে লাগল, “আমি আর আসাদ একে অপরকে ভালোবাসি। দুই বছর ধরে আমাদের রিলেশন। এযাবৎ আমাদের সবকিছুই ভালো যাচ্ছিল। কিন্তু সেদিন পর থেকে সবকিছু বদলে গেছে। ও আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। আমি জানি সেদিন আমার ভুল ছিল। আমি তো মানুষ। ভুল তো মানুষেরই হয়। কিন্তু ………”
নূরী কাঁদতে লাগল। ইয়াসমিন বেগম তাকে আশ্বস্ত করলেন। তিনি এই ব্যাপারে আসাদের সাথে আলাপ করবেন। নূরী চলে গেলেন। ইয়াসমিন বেগম ছবির এ্যালবাম বের করে একটি ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন। ছবিটি তার স্বামী আজাদ হোসেনের। আসাদের শরীরে যে তারই রক্ত বইছে আজ সেটার প্রমাণ পেলেন ইয়াসমিন বেগম। বর্তমান যুগে অনেক ছেলে তার গার্লফ্রেন্ড, স্ত্রী কিংবা সোসাইটির স্ট্যাটাসের জন্য বাবা-মাকে সমাজে পরিচয় করাতে দ্বিধাবোধ করে। অথচ আসাদ তার মায়ের জন্য নূরীর মতো স্মার্ট, সফল মেয়ের সাথেও সম্পর্ক ভাঙতে দ্বিধাবোধ করেনি। এ যে আজাদ হোসেনেরই রক্ত।
রাতে খাবার টেবিলে ইয়াসমিন বেগম প্রসঙ্গটা তুললেন।
- নূরী মেয়েটা কিন্তু সত্যিই খুব ভালো মেয়ে। তোর সাথে দারুণ মানাবে। ভুল তো মানুষই করে। তুই ওকে মাফ করে দে। আমি যতো দ্রুত সম্ভব ওকে ঘরের বউ করে আনতে চাই। সংসার সামলাত সামলাতে আমি ক্লান্ত। এবার একটু বিশ্রাম চাই।
আসাদ শুধু মাথা দুলালো। মায়ের কোনো কথার অবাধ্য সে হয় না। বছর চারেক আগে চাকরিতে জয়েন করার পরপরই আসাদের বাবা পরলোকগত হোন। সেই থেকে আসাদের কাছে তার মা-ই সব। ছোট থেকেই আসাদ তার বাবা-মায়ের বাধ্য সন্তান। কখনো তাদের কোনো কথার অবাধ্য হয়নি। আসাদ প্রতি মাসের বেতন এনে তার মায়ের হাতেই দেয়। আজ যদি তার বাবা বেঁচে থাকতো তাহলে বাবার হাতেই দিতো। বাবাকে তো সুখ দেখাতে পারেনি। তাই আসাদ চায় তার মা সব রকমের সুখ দেখুক। কেননা ছোট থেকেই আসাদ দেখেছে তার মা পরিবারের জন্য অজস্র ইচ্ছা, অভিলাষ বিসর্জন দিয়েছে।
অন্য একটি কোম্পানি থেকে ভালো সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় আসাদ সেখানে চলে গেল। এতে নূরী ভীষণ ভেঙে পড়লো। সে ভেবেছিল আসাদের মায়ের সাথে আলাপ করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আসাদ তো এবার জবই ছেড়ে দিয়েছে।
- আমি তো ভুল স্বীকার করেছি। তুমি যদি চাও তবে আমি তোমার মায়ের পা ধরে ক্ষমাও চাইবো। তবুও প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না।
- আধুনিক যুগে একটা সফল মেয়ের মুখে এই কথা শোভা পায় না। আমার মতো কতশত আসাদ তুমি এক নিমিষেই পেয়ে যাবে।
- ওসব কি বলো তুমি? আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি সফল তখনই হবো যখন তোমার হবো। এই জব, স্ট্যাটাস এসব আমার সফলতা নয়।
একটা মুচকি হাসি দিয়ে আসাদ বলল, “তাই তো তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।”
- তাহলে আমার থেকে দূরে যাচ্ছো কেন?
- স্ত্রী অফিসের বস হলে ব্যাপারটা কেমন যেন দেখায়। তাই জবটা ছেড়েছি।
- মানে?
- মানে হলো মা বলেছেন তোমাকে শীঘ্রই পুত্রবধূ রূপে দেখতে চান। আর তুমি তো জানোই আমি মায়ের কথা ফেলতে পারি না।
নূরী আনন্দে আসাদকে জড়িয়ে ধরলো।
পারিবারিক সম্মতিতেই বেশ ধুমধাম করে তাদের বিয়ে হলো। নূরীকে নিয়ে তাদের নতুন সংসার বেশ ভালোভাবেই কাটতে লাগল। সকাল সকাল দুই বউ-শ্বাশুড়ী মিলে ঘরের সব কাজ করে। তারপর আসাদ-নূরী নিজ নিজ অফিসে চলে যায়। রাতে এসে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে। ইয়াসমিন বেগমের সময়গুলো বেশ আনন্দের সাথেই কাটতে লাগলো। এক বন্ধের দিন নূরী সকাল সকাল উঠে নাস্তা বানাতে লাগল। তা দেখে ইয়াসমিন বেগম বললেন, “পুরো সপ্তাহ এতো কষ্ট করো। বন্ধের দিন অন্তত একটু বিশ্রাম নাও।”
- আমি বিশ্রাম নিবো আর আপনি আমাদের জন্য নাস্তা বানাবেন। তা কি হয় মা? এটা তো ঘরের পুত্রবধূ হিসেবে আমার জন্য লজ্জার কথা হবে।
- আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবতী। একদিকে আসাদের মতো ছেলে পেয়েছি। অন্যদিকে তোমার মতো মেয়ে। আজকালকার যুগে এমনটা সচরাচর হয় না। বিয়ের পর তো সংসারই টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
- আপনি শুধু দোয়া করবেন যেন আমি এই সংসারকে এক সুতোয় গেঁথে রাখতে পারি।
নূরীর মাথায় হাত বুলিয়ে ইয়াসমিন বেগম একটি প্রশান্তির হাসি দিলেন।
বেশ চিন্তিত অবস্থায় বসে আছে নূরী। তা দেখে আসাদ বলল, “কি হয়েছে? অফিসে কোনো সমস্যা?”
- আ'ম প্রেগন্যান্ট।
আসাদের জন্য ব্যাপারটা আনন্দের হলেও নূরী এই মুহূর্তে বাচ্চা চাচ্ছে না। সে এখন ক্যারিয়ার গড়তে ব্যস্ত। এই মুহূর্তে বাচ্চা নেওয়া মানেই ক্যারিয়ারে বাধা। আসাদ তার মনের অবস্থা বুঝলো। আসাদ বলল, “তুমি যদি না চাও তবে আমরা এই সন্তান নিবো না।”
- কিন্তু মা যদি জানতে পারেন?
- স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার মা কিভাবে জানবেন?
নূরী কিছুটা আশ্বস্ত হলো।
বিকালে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে হাসপাতালে এলো। ডাক্তারের সাথে আলাপ করলো। আজই এবরশন করবে। রিসেপশন রুমে বসে আছে নূরী। একটা মহিলা এসে তার পাশে বসলো। রিপোর্ট হাতে নিয়ে কাঁদতে লাগল। মানবতার খাতিরে নূরী তার কাছে কান্নার কারণ জানতে চাইলো। তারপর মহিলার কথা শুনে নূরীর মন নড়ে উঠলো। মহিলাটির নাম নাজমা। বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় দশ বছর হতে লাগল। কিন্তু এখনো সন্তানের মুখ দেখতে পারেননি। অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছেন। তবুও কোনো সমাধান আসেনি। মা না হতে পারার কি যে যন্ত্রণা তা নাজমার কথায় স্পষ্ট ফুটে উঠলো। অজস্র অর্থ সম্পদের মালিক তার স্বামী। তবুও ঘরে শান্তি নেই। যার একমাত্র কারণ নিঃসন্তান জীবন।
নূরী সোজা অফিসে এলো। মাতৃকালীন ছুটি চেয়ে আবেদন করলো। কিন্তু উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানালো তিন মাসের বেশি ছুটি দেওয়া যাবে না। অতঃপর নূরী রিজাইন করে বাসায় চলে এলো। খবরটা আসাদের কানে পৌঁছালো। রাতে ঘরে আসতেই ইয়াসমিন বেগম তার মুখে মিষ্টি পুড়ে দিয়ে বলল, “তোকে আরও দায়িত্ববান হতে হবে। তুই যে এখন বাবা হতে চলেছিস।” আসাদ রুমে এলো। নূরীর হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে আসাদও খুশি হলো।
- তো সিদ্ধান্ত বদলালে কেন?
- আমি নিজের সন্তানের খুনি হতে চাই না। তাছাড়া এই সন্তান তো আমাদের ভালোবাসার প্রতীক। তাই ভুল সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি।
- জবটাও ছেড়ে দিলে?
- এখন আমার গুরুত্বপূর্ণ জব হলো ওর দেখভাল করা। তবে স্বামী হিসেবে তোমার উচিত ছিল আমাকে বুঝানো। অথচ তুমি আমাকে সাপোর্ট দিয়েছিল।
- আমিও পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু ভেবেছিলাম দেরি হয়ে গেছে। যাইহোক আমরা দুই থেকে তিন হতে যাচ্ছি।
আসাদ হাসি দিয়ে নূরীর কপালে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিলো।
ইয়াসমিন বেগম সারাক্ষণ নূরীর দেখাশোনা করেন। নূরীকে কোনো কাজ করতে দেন না। কখন কি খেতে হবে, করতে হবে এসব বলে দেন। দেখতে দেখতে সময় ঘনিয়ে এলো। নূরী একটা ফুটফুটে ছেলেকে জন্ম দিলো। নাম রাখা হলো আয়ান। দাদী ও মায়ের কোলে তার সময় কাটে। নূরী পুরোপুরি গৃহিণী রূপ ধারণ করেছে। একটি সুখী পরিবারে বেশ দারুণ সময় যাচ্ছে তাদের।
নূরী লক্ষ্য করলো আসাদ তার বেতন এনে তার মায়ের হাতে দেয়। যদিও ব্যাপারটা শুরু থেকেই নূরী দেখেছে। তবে এযাবৎ সে এটা নিয়ে কিছু মনে করেনি। কিন্তু বর্তমানে সে এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব ভাবছে। এক রাতে সে ব্যাপারটা আসাদের সামনে তুললো।
- বলছিলাম যে, এখন তো আমাদেরকে আয়ানের ব্যাপারেও ভাবতে হবে তাই না?
- তা তো অবশ্যই।
- তো আমি বলছিলাম তোমার বেতনের কিছু অংশ আমাদের ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখো।
- ঠিক বলেছ। সকালেই মাকে ব্যাপারটা জানাবো।
নূরী আর কিছু বলল না। চুপচাপ শুয়ে পড়লো। সকালে ব্যস্ততার কারণে আসাদ ব্যাপারটা ভুলে গেল। বেশ কিছুদিন কেটে গেল আসাদ আর কথাটা তুলেনি। ইয়াসমিন বেগম লক্ষ্য করছেন ইদানিং নূরীর আচরণে পরিবর্তন এসেছে। সে আগেরমত মতো তার সাথে কথা বলে না। গল্প গুজব করে না। প্রয়োজন ব্যতীত খুব একটা কথাই বলে না। কিছুদিন পর তিনি এর কারণও বুঝলেন। একদিন ইয়াসমিন বেগ বললেন, “বউমা, কি হয়েছে তোমার? ইদানিং কেমন যেন উদাস হয়ে থাকো।” নূরীও চট করে উত্তর দিয়ে বলল, “ভবিষ্যৎ অন্ধকার থাকলে কার মন ভালো থাকবে? আসাদ আজ পর্যন্ত একটা টাকাও তো জমা করেনি। বেতন যে কি করে আল্লাহই জানেন। এমন পরিস্থিতি আয়ানের ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার তাই না? তো মা হয়ে কিভাবে ভালো থাকি বলুন।” ইয়াসমিন বেগম বুঝলেন নূরীর সমস্যাটা কোথায়। তবে তিনি কিছু বললেন না। আসাদ যখন তার বেতন নিয়ে এলো, তখন ইয়াসমিন বেগম বললেন, “টাকা পয়সা দিয়ে আমি কি করবো?তুই বরং বেতনটা বউমার হাতেই দে।”
- আমি বেতন তোমাকেই দিবো। তুমি যা খুশি করো।
ইয়াসমিন বেগম সকালে বেতনটা নূরীর হাতে দিলেন। কিন্তু নূরী নিলো না। বেশ রাগ নিয়ে বলল, “আমাকে তো দেয়নি। আপনাকে দিয়েছে আপনিই রাখুন।” দিনদিন ঘরে অশান্তি হতে লাগল। নূরী সারাক্ষণ আয়ানকে নিজের কাছে রাখে। ইয়াসমিন বেগমকে তার ধারে কাছেও আসতে দেয় না। নানান বাহানা দিয়ে নিজের কাছেই রাখে। সংসারের কোনো কাজে নূরী হাত দেয় না। আয়ানকে নিয়ে ব্যস্ততা দেখায়। ইয়াসমিন বেগম গল্প-গুজব করতে এলেও নূরী এড়িয়ে যায়। জবাব দিলেও বেশ তাচ্ছিল্যের সাথে দেয়। এসবে ইয়াসমিন বেগম বেশ কষ্ট পান। তবুও মুখ বুজে সব সহ্য করে যান। আসাদকে কিছু বুঝতে দেন না।
আসাদ ও নূরীর মধ্যে তর্কবিতর্ক চলছে। কারণ নূরীর আচরণ দিনদিন রগচটা হচ্ছে। যা আসাদ মেনে নিতে পারছে না। ইয়াসমিন বেগম দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছেন। আজ অতীতের কিছু কথা তার ভীষণ মনে পড়ছে। অতীতে তিনিও নূরীর মতো সংসারে ঝগড়া করতেন। কেননা তার স্বামী আজাদ হোসেনও বেতনের টাকা তার বাবার হাতে দিতেন। ইয়াসমিন অনেক চেষ্টা করেও আজাদকে নিজের আয়ত্তে আনতে পারেননি। আজাদের কথা স্পষ্ট ছিল। তার বাবা-মা সংসারের গুরুজন। তারা যেভাবে চাইবেন সংসার সেভাবেই চলবে। আজ নূরীর মাঝে ইয়াসমিন বেগম নিজের ছায়াই দেখতে পাচ্ছেন। অতীতে তিনিও এমন করেছেন। তবে আজ আজাদ হোসেনকে নিয়ে তার ভীষণ গর্ব হচ্ছে। আসাদের শরীরে যে আজাদের রক্তই প্রবাহিত হচ্ছে। তাই তো আসাদও তার বাবার মতো নিজ সিদ্ধান্তে অটল। নারীর মোহ তাদের ওপর কাজ করে না। তাই তো অতীতে ইয়াসমিন বেগম পারেননি আজাদ হোসেনকে নিজের হাতে আনতে। আর বর্তমানে নূরীও পারছে না।
সকালে আসাদ না খেয়েই অফিসে চলে গেল। আয়ানকে নিয়ে রুমে বসে আছে নূরী। ইয়াসমিন বেগম এসে নূরীর পাশে বসলেন। বলতে লাগলেন, “জানো মা, তোমার এই রুক্ষ ব্যবহারে আমি একটুও কষ্ট পাচ্ছি না। এসবই আমার অতীতের কৃতকর্মের ফল। তোমার শ্বশুরও আসাদের মতো বেতন তার বাবা মায়ের হাতে দিতেন। এই নিয়ে আমিও তোমার মতো রাগারাগি করতাম। শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর সাথে দুর্ব্যবহার করতাম। আসাদকে তাদের ধারেকাছে ঘেষতে দিতাম না। নানান ভাবে অত্যাচার করতাম। স্বামী হাতের মুঠোয় আনতে তাকে নিজের কাছেও আসতে দিতাম না। বলতাম যেদিন বেতন আমার হাতে দিবে সেদিন কাছে আসবে। ভালোবাসা থেকে স্বামীকে বঞ্চিত করতাম। তবুও ফলাফল শূন্য। এই বংশের ছেলেদের রক্তে বাবা-মায়ের আদর্শ দৌড়ায়। তাই নারীর জাদু কাজ করে না। আজ তুমি এসবের কিছুই বুঝবে না। কিন্তু সময় একদিন তোমাকে সবই বুঝিয়ে দিবে। সেদিন আমি থাকবো না। যেমন আজ আমি আমার অতীতের ব্যাপারে অনুতপ্ত। অথচ আমার স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুড়ী তারা কেউই নেই।” নূরী চুপচাপ কথাগুলো শুনলো। কোনো প্রত্যুত্তর দিলো না। ইয়াসমিন বেগম কিছু কাগজপত্র দিয়ে বললেন, “আসাদের বেতন থেকে সংসারের খরচ বাদে বাকি যা থাকতো তা আমি ব্যাংকে জমা রাখি। এই তার কাগজপত্র। সবকিছু আসাদের নামেই।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়ানের কপালে হাত বুলিয়ে ইয়াসমিন বেগম চলে গেলেন।
সময় কেটে গেছে। সেই ছোট আয়ান আজ প্রথম বেতন পেয়েছে। তা দিয়ে আসাদের জন্য একটা পাঞ্জাবি এনেছে। নূরীর জন্য একটা জামদানি শাড়ি এনেছে। ছোট বোন সামিয়ার জন্য একটা ভালো থ্রিপিস এনেছে। বাকি টাকা আসাদের হাতে দিয়ে বলল, “এটা আমার জীবনের প্রথম উপার্জন।” আসাদ খুশি হলো। আয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিলো যাতে সে অনেক বড় হয়। নূরী শাড়ি হাতে চুপচাপ বসে আছে। তার কানে ইয়াসমিন বেগমের একটা কথা বারবার বাজতে লাগল। “সময় একদিন তোমাকে সবই বুঝিয়ে দিবে। কিন্তু সেদিন আমি থাকবো না।” হ্যাঁ তার শ্বাশুড়ী আজ আর নেই। তিনি পরলোকগত হয়েছেন আজ প্রায় দশ বছর হলো। নূরীর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। অতীতের কৃতকর্মের জন্য আজ সে অনুতপ্ত। অথচ সময় পেরিয়ে গেছে। সময় ঠিকই সব বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু তখন অনুতপ্ত হওয়া ব্যতীত কিছু করার থাকে না।
সমাপ্ত।
©somewhere in net ltd.