![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গল্পের নামঃ জিহ্বার মূল্যায়ন।
লিখেছেনঃ মোঃ জোবায়ের বাপ্পী।
অফিসে বসে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রকল্পের নকশা বানাচ্ছে আসাদ। এই প্রকল্প তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই বছরে সে অফিসের চারজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে মধ্যে সে সেরা হয়েছে। এই প্রকল্পে যদি সফল হয় তবে এই কম্পানির প্রধান নির্বাহী হওয়ার সম্ভাবনা আছে। দরজা খুলে তার সহকারী সেক্রেটারি মিনা কিছু বলতে চাইলো কিন্তু সে রাগ দেখিয়ে বললো, “তোমাকে আমি নিষেধ করেছিলাম, আমি না বলা পর্যন্ত এই রুমে আসবে না।” মিনা মোবাইলটা দেখিয়ে বলল, “আপনার বাবার………” আসাদ আবারও থামিয়ে দিয়ে বললো, “যতোই গুরুত্বপূর্ণ হোক। তবুও বিরক্ত করতে নিষেধ করেছিলাম। যাও এখান থেকে।” বেশ বাক্যটা আসাদ কিছুটা রাগন্বিত হয়ে বললো। এতে মিনা ভয়ে কেপে উঠলো। তবে তার মুখ দিয়ে একটা বাক্য ঠুস করে বেরিয়ে এলো। যা শুনে আসাদ নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো। মিনার ডাকে তার জড়তা ভাঙলো। সে হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা চাইলো। মিনা মোবাইল দিয়ে চলে গেল। ওপাশ থেকে আসাদের বাবা শুধু একটাই কথা বললেন। “তোর দাদার শেষ ইচ্ছে ছিল তার কবরে যেন তুই মাটি দিতে আসিস।” এইটুকু বলেই ফোন কেটে দিলেন। আসাদ আর কিছু ভাবলো না। প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ছুটলো গ্রামে। অফিসের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। যে আসাদ পরিবারের কারও মারাত্মক অসুখেও ছুটি নেয়নি না। আজ সে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পকে সামনে রেখে চলে যাচ্ছে!
দীর্ঘ দশ বছর পর আসাদ গ্রামের মাটিতে পা রাখতে যাচ্ছে। দশ বছর আগে সে একজন বেকার ও পরাজিত ভাই হয়ে গ্রাম ছেড়েছিল। তখন সে এইচএসসি পাস করে ঘুরঘুর করছিল। এমন সময় তার বড় বোন মিতুর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। অথচ মিতুর ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবে। নিজ মেধায় মেডিকেলে সুযোগও পেয়েছিল। মা না থাকায় আসাদ তার বাবাকে বলেছিলো মিতুর ইচ্ছের কথা। কিন্তু তিনি তা গুরুত্ব দেননি। আসাদের বেকারত্বের খোটা দিয়ে বলেছিলেন বিয়ের সমস্ত খরচ ছেলে দিচ্ছে। যৌতুকও নিবে না। তাই তিনি এমন ছেলে হাতছাড়া করতে নারাজ। একজন বেকার ছেলের কথার কোনো দাম নেই তা সেদিন আসাদ বুঝেছিল। মিতুর বিয়ের পর নিজেকে খুব একা ও ছোট লাগছিল তার। তাই গ্রাম ছেড়ে চলে আসে শহরে। তারপর আর আসাদ গ্রামের দিকে পা বাড়ায়নি। অর্থ সম্পদ ও আকাশ ছোঁয়ার নেশা ব্যতীত কোনো কিছুই আসাদকে গ্রাস করতে পারেনি। বাবা-মা কিংবা গ্রামের কোনো মোহ আসাদকে নীড়ে টানতে পারেনি। কিন্তু আজ নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। শুধুমাত্র দাদার জন্য। ছোট থেকেই আসাদ তাঁর দাদার হাত ধরে হাঁটতে শিখেছে। মায়ের পর দাদার কোলেই বেশি খেলেছে। তার জীবনের অন্যতম সঙ্গী ছিল তার দাদা। প্রতিটি পরাজয়ের পর আসাদকে উত্সাহ দিয়েছিলেন তার দাদা। তিনি সবসময়ই বলতেন, “দাদু ভাই, একদিন তুমি পারবাই। হতাশ হইয়ো না।” আজ আসাদ পেরেছে। কিন্তু আফসোস দাদাকে তা দেখাতে পারেনি। যেদিন আসাদ গ্রাম ছাড়ছিলো সেদিনও দাদা তাকে ভরসা দিয়ে বলেছিলেন, “সত্ পথে চলবা। আল্লাহ-ই সাহায্য করবেন। নিজেকে একা ভাববে না। আমি ও আমার দোয়া তোমার সাথেই আছে।”
নিজস্ব গাড়ি করে রাতের মধ্যেই আসাদ বাড়ি চলে আসে। বাড়ি এসে আসাদ কারও দিকে তাকায়নি। তার দৃষ্টি উঠানের আলোতে ঘিরে থাকা লাশের খাটে স্থির হয়ে আছে। পা দুটো যেন আপনাআপনিই সেদিকে চলে এসেছে। আসাদ লাশের পাশে বসে নীরবে কাঁদতে লাগলো। মনে মনে বললো, দাদা তুমি উঠে একটিবার বলো, দাদুভাই তুমি পারবাই। আসাদ কতক্ষণ সেখানে বসে ছিলো তা সে নিজেও জানে না। মিতুর ডাকে তার ঘোর কাটলো। “আমি দাদাকে শেষ দেখা দেখতে পারলাম নারে আপু।” এই বলে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো আসাদ। মিতু শান্ত্বনা দিয়ে ঘরে নিয়ে গেল। পরেরদিন সকালেই দাফন করা হলো। কবর বানানো থেকে শুরু করে কবরে মাটি দেওয়া পর্যন্ত সব কাজেই আসাদ ছিলো। কবরটা আসাদ নিজ হাতে খুব যত্ন সহকারে বানালো। সেখানে বসেই কিছুক্ষণ কাঁদলো। দাদার নামে বেশ বড় করে অনুষ্ঠান করলো। সব খরচ আসাদ একাই বহন করলো। এতো বড় অনুষ্ঠান এই গ্রামে আগে কখনো হয়নি। অনুষ্ঠান শেষে শহরে ফেরার জন্য সব গুছিয়ে নিলো। কিন্তু মিতুর আকুতির কাছে আরও দুদিন থাকতে বাধ্য হলো।
তাড়াহুড়োয় আসাদ প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই আনতে পারেনি। যার মধ্যে টুথব্রাশ একটি। এই কয়েকদিন নিম গাছের ডাল দিয়ে দাঁত মেজেছে। চাইলেই ব্রাশ কিনতে পারে কিন্তু গ্রামের অস্তিত্বকে অনুভব করতে চাচ্ছে। তার দাদাও নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজতেন।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মোবাইলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে বলতে আসাদ তাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে চলে এসেছে। কথা শেষে পাশে একটা নিম গাছ দেখে দাঁত মাজার জন্য সেখান থেকে একটা ডাল ভাঙলো। ওমনি একটা মেয়েলী কণ্ঠের কর্কশ চিত্কার তার কানে ভেসে এলো। নাম নূরী।
- এইইইই আপনি কার অনুমতি নিয়ে ডাল ভেঙেছেন? এতো বড় সাহস হলো কিভাবে? কোন বাড়ির ছেলে?
আসাদ কিছুটা বোকা হয়ে গেল। সামান্য ডালের জন্য এভাবে কথা বলার কারণ খুঁজে পেল না। তবুও আসাদ শান্ত সুরে বললো, “আ'ম স্যরি।”
- ওসব স্যরি ট্যরি বলে পার পাওয়া যাবে না। এই রাঙা-সাঙা উনাকে আটকিয়ে রাখ। আমি চাচাকে নিয়ে আসতেছি।
নূরী এক দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। আসাদের পাশে দুটো কুকুর হিংসাত্মক দৃষ্টিতে আসাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আসাদ বুঝলো এরাই রাঙা-সাঙা। কিছুক্ষণের মধ্যেই জয়নালকে নিয়ে এলো নূরী। তাকে আসাদ চিনে। কেননা সে তার কিশোর বয়সটা এখানেই কাটিয়েছে। আসাদকে দেখেই জয়নাল বলে উঠলেন, “আয় হায়! এ তো তালুকদার বাড়ির সেই আসাদ। এ কি করলি মা?” নূরীর রাগন্বিত চেহারা মুহূর্তেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সে এক দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। আসাদ কিছু বলার আগেই জয়নাল বললেন, “কিছু মনে করো না বাবা। ও তোমায় চিনতো না তাই এমন করেছে। এসো, ভেতরে এসো।”
- আজ একটু তাড়া আছে। অন্য কোনো দিন আসবো।
- ওর পক্ষ থেকে আমি লজ্জিত। এসব কাউকে বলো না বাবা।
আসাদ মাথা দুলিয়ে চলে এলো।
জয়নাল ভেতরে এসে নূরীকে বললেন, “যার ছবি নিয়ে সারাক্ষণ পড়ে থাকিস। তাকেই চিনতে পারলি না? আল্লাহ জানেন এখন কি হবে!” লজ্জা পেয়ে নূরী এক দৌড়ে নিজের রুমে চলে এলো। তারপর বই থেকে আসাদের ছবিটা বের করলো। ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা আপনিই বলুন। এই চেহারার সাথে বর্তমান চেহারার কোনো মিল আছে? তাহলে আমি কিভাবে চিনবো?” নূরী একটা লাজুক হাসি দিয়ে বালিশে মুখ গুজে শুয়ে রইলো। আসাদ-নূরীর বিয়ে পারিবারিক ভাবে নির্ধারিত করা আছে। এই কথাটা আসাদ জানে না। তবে নূরী জানে। যখন সে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলো। তখন এক ছেলে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। নূরী বলেছিল যদি সত্যিই ভালোবেসে থাকে তবে তার বাবার সাথে আলাপ করতে। ছেলেটা সাবলম্বী ছিলো। তাই পরিবার নিয়ে এসে নূরীর বাবার সাথে আলাপ করে। কিন্তু নূরীর বাবা নাকোচ করে দেয়। তখন নূরী তার চাচার মাধ্যমে আসাদের ব্যাপারে জানতে পারে। সেই থেকেই নূরী তার মনে প্রাণে আসাদকে বসিয়ে রেখেছে। চাচার মাধ্যমেই আসাদের এই ছবিটা জোগাড় করে নূরী। তারপর থেকে নিজের সব অনুভূতি গুলো ছবির সাথেই ভাগাভাগি করে। প্রায় ছয়টি বছর ধরে নূরী এই ছবিটির মাধ্যমে আসাদকে ভালোবেসে এসেছে।
আসাদকে দুদিন থাকার অনুরোধ করেছিল বিয়ের কথাটা জানানোর জন্য। বিয়ের কথা জানতেই আসাদ চেঁচিয়ে উঠে মিতুকে বলল, “এটা কখনোই সম্ভব না। বাবা চান আমি যেন এই বন্ধনের সূত্র ধরে হলেও গ্রামে আসি। বাবার ফাঁদে আমি পড়বো না। আমি কালই চলে যাব।” মিতু অনেক চেষ্টা করলো আসাদকে বুঝানোর। কিন্তু আসাদ কিছুই শুনলো না। পরেরদিন সকালে সে কাউকে কিছু না বলে রওনা দিলো। কিছুদূরে থাকা পারিবারিক কবরস্থানে দাদার কবরের সামনে দাঁড়ালো। কবর জিয়ারত করলো। তখন দাদার একটা কথা আসাদের মনে পড়লো। তিনি সবসময়ই বলতেন দাদুভাই এই জিহ্বার দাম অনেক। মাথা যাক তবুও কথার হেরফের যেন না হয়। ছোট থাকতে আসাদ দেখেছিল যখন টাকা পয়সার অধিক প্রয়োজন হতো দাদা গাছগাছালি বিক্রি করতেন। কিন্তু শত অভাবের মাঝেও বাড়ির উঠানের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা বড় গাছটা বিক্রি করতেন না। কারণ তিনি তার স্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন এই গাছটা মেয়ের বিয়ের সময় বিক্রি করবেন। শত কষ্টের মাঝেও আসাদের দাদা নিজের কথা ভঙ্গ করেননি।
নূরীর বাড়িতে একটা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। কারণ আসাদ এসেছে। তাদের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে আসাদকে মাথায় বসিয়ে রাখতে পারলে তাদের শান্তি হয়। “আমি কি নূরীর সাথে একটু কথা বলতে পারি?” আসাদের কথা শুনে সবাই যেন একটু থমকে গেল। জয়নলা এগিয়ে এসে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই।” আসাদকে নূরীর রুমটা দেখিয়ে দেওয়া হলো।
নূরী কিছুটা আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। আসাদ বললো, “আমাদের পারিবারিক সিদ্ধান্ত জানেন তো?” নূরী মাথা দুলালো।
- আমি গতকাল জেনেছি। আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে একটা শর্ত আছে।
নূরীর এক নজর আসাদের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নিচে নামিয়ে নিলো। আসাদ বলতে লাগলো, “আমি কিন্তু দশ বছর পর এবার গ্রামে এসেছি। শহরে আমার কাজের প্রচুর চাপ থাকে। তাই ভবিষ্যতেও হয়তো গ্রামে আসা হবে না। আমাকে বিয়ে করলে আপনি আপনার বাবা-মা‚ ভাইবোন‚ রাঙ্গা-সাঙ্গা এদের মুখ হয়তো দুই-চার বছরেও দেখতে পারবেন না। এবার সিদ্ধান্তটা আপনার।” নূরী শুধু মাথা দুলালো। আসাদ কিছুটা অবাক হলো। রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় নূরী ডাক দিয়ে নিচু স্বরে বলল, “আমি গতকালের জন্য খুব লজ্জিত। আমি জানতাম না যে আপনিই আমার………। আসলে আপনার আগে ছবির সাথে বর্তমানের কোনো মিল নেই।” এইটুকু বলে নূরী চুপ হয়ে গেল। নূরীরে চোখে লজ্জা ফুটে আছে। গাল দুটো ঈষৎ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। চোখের পাতা টিপটিপ করছে। মনোরম এই চেহারার মায়ায় না পড়ার জন্য আসাদ দ্রুত প্রস্থান করলো।
আসাদ শহরে ফিরে গেল। তবে মিতুকে জানিয়ে দিলো যে, বাবার কথা রাখতে পরবর্তী মাসে আসবে। অনলাইনের মাধ্যমে আসাদ আগেই প্রকল্পের নকশা জমা দিয়েছিল। সেটা পাসও হয়েছে। কিছুদিন পর প্রধান নির্বাহী হিসেবে অফিসের অন্য শাখায় যোগ দিলো। সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পর ছুটি নিয়ে বাড়ি এলো। তারপর বিয়ে করলো। বেশ ধুমধাম করেই বিয়ে হয়েছে। পরেরদিনই নূরীকে নিয়ে শহরে চলে এলো। এতে সবাই বেশ আপত্তি জানালো। তবে নূরী ব্যাপারটা সামলে নিয়েছে। সবাইকে বলেছে আসাদের অফিসে কাজের চাপের কারণে এমনটা করতে হয়েছে।
নিত্যদিনের মতো রাতে আসাদ অফিস থেকে ফিরলো। নূরী তার হাতের লান্স বক্সটা নিয়ে তাকে ফ্রেশ হতে বলল। আসাদ মাথা দুলিয়ে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে ডিনারে বসলো। দুজনে মিলে নিশ্চুপে খেয়ে নিলো। টুকটাক যা কথা হয়েছে তা সবই নূরী বলেছে। আর কিছু লাগবে? আরেকটু নিন। আলু ভাজি তো আপনার প্রিয় আরেকটু নিন। এসবের মধ্যেই তাদের আলাপ সীমাবদ্ধ থাকে। খাওয়া দাওয়া শেষে আসাদ ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। কোনো কাজের জন্য নয়, নূরীর ঘুমের অপেক্ষা মাত্র। বিয়ের পর থেকে এমনই করে আসছে আসাদ। রান্নাঘরের কাজ শেষে নূরী এসে আসাদের পাশে বসলো।
- কিছু কথা আছে। এই বাক্সটা বন্ধ করবেন?
- হুম। বলো।
নূরী বলতে শুরু করলো। “আমি যখন এসএসসি দিচ্ছিলাম তখন আপনার ব্যাপারে জানলাম। চাচার মাধ্যমে আপনার একটা ছবি জোগাড় করলাম। তারপর থেকে আমার প্রেম, আবেগ, ভালোবাসা সবই ছিল ছবিটাকে ঘিরে। প্রথম প্রথম আপনার ছবি দেখেও খুব লজ্জা পেতাম। বইয়ের মাঝে লুকিয়ে রাখতাম। একদিন বান্ধবীদের কাছে ধরা পড়ে গেলাম। সেদিন কি যে লজ্জাটাই না তারা দিলো! সকলের সামনে লজ্জা পেলেও আড়ালে এসে কেন জানি ভালো লাগতো। দিন দিন আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা বাড়তে লাগল। সেই সাথে অভিমানও। কেন আপনি বাড়ি আসেন না? কত ইদ-কোরবানি গেল তবুও আপনার দেখা মিললো না। একটা সময় কিছু লোকে বলাবলি করতে লাগল আপনি নাকি শহরেই বিয়ে করেছেন। সকলের সামনে আমি ভেংচি মারতাম। কিন্তু আড়ালে এসে খুব কাঁদতাম। কি আশ্চর্য! যে মানুষটাকে আমি আজও স্বশরীরে দেখিনি সে মানুষটার জন্য এতো আমার এতো খারাপ লাগে কেন? তাকে হারানোর এতো ভয় কেন? তখন এসব ভাবতাম। আমার দুঃসময়ের একমাত্র সাথী ছিল আপনার বোন মিতু। তিনি সবসময়ই বলতেন আমার ভাই আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করবে না। আমিও সেই আশায় বসে রইলাম। অবশেষে আপনার দেখা মিললো। আমার শত আশা যেন পূরণ হলো। আমার মা বলতো নারী জীবনে স্বামীই সবার উপরে। তাই তো সবকিছু ছেড়ে বিয়ের পরেরদিনই আপনার হাত ধরে এই অজানা শহরে চলে এসেছি। আপনি হয়তো ভাবছেন আজ এসব আপনাকে কেন বলছি? আসলে কথাগুলো দীর্ঘদিন ধরে মনের মধ্যে বেধে রেখেছি। আর পারছিলাম না। তাই আপনাকে সব বলে দিলাম। জানি আমি গ্রামের মেয়ে। আপনার শহর ব্যবস্থার সাথে আমি মানানসই নই। তবে আমি ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিবো। আমাকে নিয়ে যেন আপনি লজ্জিত না হোন আমি সেদিকে লক্ষ্য রাখবো। আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি।” শেষ কথাটা বলা মাত্রই নূরী উঠে দৌড় দিলো।
আসাদ নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। তার কানে নূরীর একটা কথা বারবার বাজতে লাগল। “আমার শত আশা যেন পূরণ হলো।” সত্যিই কি নূরীর আশা পূরণ হয়েছে? একটি মেয়ে স্বামীকে নিয়ে মনের মধ্যে যে ইচ্ছে-আকাংখা লালন করে তা কি আসাদ পূরণ করেছে? পেরেছে কি নূরীকে ভালোবাসা দিতে কিংবা গ্রহণ করতে? এসব প্রশ্ন আসাদের মনকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলল। পরেরদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় আসাদ বলল, “সবকিছু গুছিয়ে নিও।”
- কেন?
- তোমাকে গ্রামে দিয়ে আসবো।
নূরী আঁতকে উঠে বলল, “ক্কে…ক্কে…কেন?”
- তোমার মাঝে বেশি আবেগ উঠেছে তাই।
নূরী স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। সে ভেবেছিল মনের কথাগুলো আসাদকে জানালো হয়তো তার মাঝে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু আসাদ যে এতো রুক্ষ হবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। আসাদের পায়ে পড়ে গেল নূরী আর বলল লাগল, “দোহাই লাগে আমাকে আপনার কাছ থেকে দূর করবেন না।” আসাদ তাত্ক্ষণিক নূরীকে উঠালো। বলল, “আরে কি করছো এসব? আমি তো একটু দুষ্টামি করেছি।” নূরী অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে। আসাদ বলল, “ওটা মজা করে বলেছি। কান্না থামাও। অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয়নি তাই যাবো।”
- না, আমি বাড়ি যাবো না।
- আচ্ছা ঠিক আছে যাবো না। কান্না থামাও এখন।
নূরী কিছুটা শান্ত হলো। আসাদ বলল, “তোমাকে বাড়ি রেখে এলে আমি বাঁচবো কি নিয়ে? তুমিই তো আমার প্রাণ।” আবেগী এই কথা শুনেও নূরীর মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে ডুকরে ডুকরে নাক টানছে। আসাদ তার ব্যাগটা রেখে নূরীকে সোফায় বসালো। তারপর তার সাথে গল্প শুরু করলো। আজ আর তার অফিসে যাওয়া হলো না।
সমাপ্ত।
©somewhere in net ltd.