নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিখতে জানতে ও ছড়িয়ে যেতে চাই।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী

আমি বাপ্পী। জন্মস্থান বরিশাল। বেড়ে উঠা চট্টগ্রাম।

মোঃ জোবায়ের বাপ্পী › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পের নামঃ স্বপ্ন ভঙ্গুর।

১৪ ই জানুয়ারি, ২০২২ সকাল ৯:৩৮

গল্পের নামঃ স্বপ্ন ভঙ্গুর।
লিখেছেনঃ মোঃ জোবায়ের বাপ্পী।
উত্‍সর্গিতঃ Nishi Chowdhuri

বিমানবন্দর থেকে নেমে এদিক সেদিক তাকিয়ে ড্রাইভারকে খুঁজতে লাগলাম। এই তো পেয়েছি। গাড়িতে উঠলাম। আমি আসাদ। কানাডার একটা মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। আজ প্রায় আট বছর পর দেশের মাটিতে পা রাখলাম। যদিও দেশে আসার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু একমাত্র ছোট বোনের বিয়েতে না এসে কি পারা যায়? আমার সুখে দুখের অন্যতম সাথী আমার বোন নিশি। কানাডাতে থাকা অবস্থায় যখনই কোনো মানসিক চাপে পরতাম তখন নিশি আমাকে মানসিক সাপোর্ট দিতো। ছোটবেলায় মা বলতো আমি নাকি সবসময় মনমরা হয়ে থাকতাম। নিশি আসার পরই মুখে হাসি ফুটেছিল। ছোটবেলার কথা জানি না। তবে বড় হয়ে ঠিকই বুঝেছি আমার হাসিখুশির অপর একটা নাম নিশি। ছোটবেলায় যখনই বাবা আমাকে মারতো তখন নিশিই এসে বাঁচাত। বাবা কখনোই নিশির কথা ফেলত না। তখন খুব অভিমান হতো বাবা কেন শুধু নিশিকে ভালবাসে! কিন্তু এখন বুঝছি মেয়েরা জন্মের সাথে মায়া নিয়ে আসে। আর ছেলেরা প্রত্যাশা। অবশ্য মা আমাদের দুজনকে সমান ভালবাসতেন। হয়তো এইজন্যই মা সবার উর্ধ্বে। ফোনের শব্দে চিন্তাভাবনায় ছেদ পড়ল। মা কল করেছেন।
- আহা! এত চিন্তা করছো কেন? আমি কাছাকাছি চলে এসেছি। আর মিনিট বিশেক লাগবে।
ফোন কেটে আমি পকেটে রাখলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে প্রথমেই সিম কিনেছি। তারপর মাকে কল করে জানিয়েছি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত মা বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছেন। মায়েরা বুঝি এমনই।

রাস্তায় জ্যাম পড়ল। জানালা খুলে আমি একটু বাহিরের দিকে তাকালাম। শহরটা অনেক বদলে গেছে। সবুজ ভাবটা আগের থেকে কমে গেছে। গাড়ির পে-পু শব্দ আগের তুলনায় বেড়েছে। আমি জানালা বন্ধ করতে যাব ঠিক তখনই একটা বাচ্চা মেয়ে ফুল হাতে এসে বলল, “একটা নিন না ভাইয়া। মাত্র দশ টাকা। মাত্র দশ টাকা।” এমন অভিজ্ঞতা আট বছর আগেরও আছে। বাংলাদেশে এটা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। দশ টাকা দিয়ে একটা ফুল কিনলাম। আমার বোনটা ফুল খুব পছন্দ করে। অবশ্য সব মেয়েরাই ফুল পছন্দ করে। আবারও মায়ের ফোন। বুঝতে পারছি যে, আমাকে দেখার জন্য মা অস্থির হয়ে আছেন।
- জ্যামে পরেছি। কতক্ষণ লাগে বলা যাচ্ছে না।
- আচ্ছা বাবা সাবধানে আয়।
আধাঘণ্টার মতো আমি জ্যামেই আটকে রইলাম। এই শহরটা আসলেই অনেক বদলে গেছে। প্রায় এক ঘন্টার পর বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি দেখে বুঝাই যাচ্ছে কোনো বাবার একমাত্র মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। শুধু বাড়ি নয় আশপাশের এলাকাও সাজানো হয়েছে। আমি বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্রই বাবাকে দেখলাম। বাবা চারদিকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। আমাকে দেখে মা এগিয়ে এলেন। আমি সালাম করলাম। মায়ের চোখ আনন্দের অশ্রুজলে ভিজে উঠল। বাবাও এগিয়ে এলেন। আমি সালাম করে ভেতরে চলে এলাম। সোজা নিশির রুমে এলাম।

- কেমন আছিস বুড়ি?
নিশি অভিমান নিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “তুই আমার সাথে কথা বলবি না।” আমি হাসি দিয়ে বললাম, “জানতাম তুই অভিমান করে আছিস। তাই তো দেশে আসার পর কোনো ফোন দিসনি। অথচ কানাডায় থাকতে তো প্রতিদিনই যোগাযোগ করতি।”
- অভিমান করব না? একমাত্র ছোট বোনের বিয়ে অথচ বড় ভাই এসেছে মাত্র এক সপ্তাহ আগে। তোর তো এক মাস আগে আসা উচিত ছিল।
- কি করব বল! বড় কম্পানি তো তাই ছুটি পাওয়া মুশকিল।
- হইছে আর চাপা মারতে হবে না।
আমি হাসি দিয়ে তারপর বললাম, “আচ্ছা তুই কি এই বিয়েতে রাজি?”
নিশি হাসি দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমার মতামতেই বিয়ে হচ্ছে। বাবার সাথে কথা হয়েছে?”
আমি চুপ হয়ে গেলাম। নিশি আমার হাত ধরে বলল, “ভাইয়া আট বছর হয়ে গেছে। এবার তো রাগটা ফেলে দে।” আমি একটা হাসি দিলাম। কিছু হাসি কষ্টেরও হয়। নিশি তা স্পষ্ট বুঝল। আমি বললাম, “পিছু কথা না তুলাই ভাল। তোর সম্মতিতে বিয়ে হচ্ছে জেনে খুশি হলাম। যাই একটু বিশ্রাম নিবো।”

আমি ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে ঘুম দিলাম। বিকালে ঘুম থেকে উঠে আহাদের বাসায় গেলাম। কানাডায় যাওয়ার পর বন্ধুদের মধ্যে আহাদের সাথেই যোগাযোগ ছিল। আহাদের বাসায় এসে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে রাতে বাড়ি ফিরলাম। রাতের অন্ধকারে বাড়ির আলোকসজ্জা ফুটে উঠেছে। দূর থেকে দেখলেই বুঝা যায় বিয়ের বাড়ি। ডিনারে বসলাম। আমি চুপচাপ খেতে লাগলাম। নিশিই অনবরত এটা সেটা বল যাচ্ছে। কানাডা কেমন, মানুষজন কেমন, শহরগুলো কেমন ইত্যাদি। খাওয়া শেষ করে রুমে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পর নিশি চা নিয়ে এল। রাতে খাওয়া শেষে চা খাওয়া আমার পুরানো অভ্যাস।
- তুই দেখি একটুও বদলাসনি।
- কিন্তু তুই বদলে গেছিস। আট বছর হয়ে গেল। তবুও রাগটা পুষে রেখেছিস।
- ওসব বাদ দে তো।
- জানিস বিয়েটা আরও পরে করতাম। শুধুমাত্র তোকে দেশে আনার জন্য তাড়াতাড়ি রাজি হয়েছি। কারণ এছাড়া তুই দেশে কখনোই আসতি না।
- চা খুব ভাল হয়েছে। রান্নায় বেশ পটু হয়েছিস।
- রাগটা ফেলে দে না ভাই।
আমি নিশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,
- নে কাপটা। এখন গিয়ে শুয়ে পড়।
নিশি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যর্থ মনে চলে গেল।

আজ নিশির বিয়ে। ওর মুখে হাসিখুশি দেখে আমার বেশ ভালো লাগছে। বর পাশে বসে আছে। দুজনকে বেশ মানিয়েছে। এইতো আর কিছু সময়। তারপর ও চলে যাবে। ভাবতেই বুকের বাঁ পাশটা চিনচিন করে উঠল। বোনের বিয়ের সময় হয়তো সব ভাইয়েরই এমন ব্যাথা হয়। দেশের বাইরে থেকেও নিশির সাথে আমার যোগাযোগ কমেনি। কিন্তু এবার কমে যাবে। এখানে স্বার্থপরতার কিছু নেই। এটা বাস্তবতা। বিয়ের পর মেয়েদের জীবন বদলে যায়। বদলে যায় বললে ভুল হবে। সত্য হল বিয়ের পর তাদেরকে বদলাতে হয়। এটাই নিয়তি। আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো। চলে যাচ্ছে নিশি। মা অঝোরে কান্না করছেন। বাবা আপ্যায়নে ব্যস্ত। নিশি আমার কাছে এল বিদায় নিতে। আমি নিশির চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম‚ “পিচ্চিটা কখন যে বড় হয়ে গেছে বুঝতেই পারলাম না।”
নিশির কান্না আরও বেড়ে গেল। সাথে আমারও। একে অপরকে শান্ত্বনা দিয়ে থামালাম। চলে গেল আদরের বোনটা। অনেক কান্নাকাটি করেছে। যাওয়ার আগে ওর শেষ বাক্য ছিল, "আমার একটা শেষ আবদার, এবার রাগটা ফেলে দে।"

দুদিন পর,
আমাদের পারিবারিক রীতি অনুযায়ী বিয়ের দুদিন পর পরিবারের আত্মীয়স্বজন মিলে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যায়। সেই উদ্দেশ্যে আমি, মা, বাবা, আংকেল-আন্টি-কাজিনেরা গাড়িতে উঠছি। আমি বাবা ও মায়ের জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিলাম। বাবা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর গাড়িতে বসে পড়লেন। দেশে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাবার সাথে আমি ভালোমতো কথা বলিনি। তাই বাবা ও আমার মধ্যে একধরনের জড়তা কাজ করছে। এর পিছনে আট বছর আগের একটি ঘটনা দায়ী। আমি গাড়িতে উঠতে যাব এই সময় একজন কুরিয়ার সার্ভিসের লোক এল। তার থেকে নিশির নামে একটা লেটার পেলাম। তা পড়ে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেল। চিঠিটা লন্ডনের ল কলেজ থেকে এসেছে। নিশি সেখানে চান্স পেয়েছে। ছোট থেকেই নিশির স্বপ্ন ছিল বড় হয়েছিল ব্যারিস্টার হবে। স্বপ্ন পূরণে ছোট থেকেই সে খুব পরিশ্রমী ছিল। অথচ স্বপ্ন পূরণ হয়েও অধরা রয়ে গেল। আমি কাউকে কিছু বললাম না। গাড়িতে উঠে পড়লাম।

নিশির শ্বশুরবাড়ি চলে এলাম। নিশিকে দেখে বুঝাই যায় না যে, সে একটা স্বপ্ন মাটি চাপা দিয়ে এসেছে। বেশ হাসিখুশিই আছে। আমি তাকে লেটারের ব্যাপারে কিছু বললাম না। এতে কষ্ট বাড়বে। নিশির শ্বশুরবাড়িতে কিছু সময় থেকে আমরা আবার চলে এলাম। এসেই আমি কানাডায় ফেরার টিকিট কাটলাম। ফোনালাপ মা শুনেছেন।
- তুই আর কোথাও যাবি না। যা করার এখানেই করবি।
- সম্ভব না মা।
- কেন সম্ভব না? তুই এখানেই নিজস্ব কাজ শুরু কর। যতো টাকা লাগবে তোর বাবা দিবে।
- যা আট বছর আগে হয়নি তা এখন আর করতে চাই না।
- আমি কিছু শুনতে চাই না। তুই কোথাও যাবি না। এতদিন নিশিকে বুকে নিয়ে বেঁচে ছিলাম। এখন কাকে নিয়ে বাঁচবো? আমি মরার পর যাইস।
চোখের জল ফেলতে ফেলতে মা কথাগুলো বললেন। আমি মায়ের হাতে নিশির এডমিশন লেটারটা দিয়ে বললাম‚ “নিশি লন্ডনে চান্স পেয়েছে। তুমি তো জানতেই ওর স্বপ্ন ছিল ব্যারিস্টার হবে। কিন্তু …… আট বছর আগে তোমার স্বামী আমার স্বপ্নকে গলা টিপে মেরেছিল। আর আজ আমার বোনের স্বপ্নকে খুন করেছে। এবার তুমিই বলো এত কিছুর পরেও আমি কিভাবে থাকবো?” লেটারের দিকে মা নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছেন। আমি আমার রুমে চলে এলাম। সবকিছু গুছাতে লাগলাম। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পর আমি চেয়েছিলাম ছোটখাটো একটা ব্যবসা শুরু করতে। আমার বাবার অর্থ সম্পদ বেশ ভালোই ছিল। তাই লাখ পাঁচেক টাকা চেয়েছিলাম। যা বাবার সামর্থ্য অনুযায়ী সামান্য। কিন্তু বাবা তা দিলেন না। অনেক আকুতি মিনতি করেছিলাম। আমার হয়ে মা এবং নিশিও অনেক বুঝিয়েছিল। কিন্তু বাবা একটা পয়সাও দিতে রাজি হননি। ঠিক তখনই কানাডার স্কলারশীপটা পেয়েছিলাম। রাগ-ক্ষোভ নিয়ে চলে গিয়েছিলাম কানাডায়। তারপর সেখানেই কর্মজীবন শুরু করি। আজ আমি প্রতিষ্ঠিত হয়েও অন্তরে শান্তি নেই। নেই কোনো ইচ্ছে আকাংখা। আমি যদি দেশে থেকেই কিছু করতে পারতাম তবে হয়তো নিশির স্বপ্ন ভাঙতো না। নিশির মতো অনেক মেয়েই আছে যারা মুখ বুজে নিজের স্বপ্ন মাটি চাপা দেয়। শুধুমাত্র পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে। তারা পরিবারের সুখের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দেয়।
পরেরদিন সকালে আমি গাড়িতে উঠে বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মা এবার আর বাধা দেয়নি। বাবা কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। আমি সেই সুযোগ বা সময় কোনোটাই দেইনি। আসার সময় মায়ের হাতে নিশির লেটারটা দেখেছি। মেয়ের স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট মা ঠিকই বুঝেন। যা মায়ের চোখ দেখে বুঝা যাচ্ছিল। আমি দাঁড়াইনি। পিছুটান চাই না।

সমাপ্ত।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.