নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এই রোকো ! পৃথিবীর গাড়িটা থামাও

*

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান › বিস্তারিত পোস্টঃ

গর্ভধারিণী : মুক্তিযোদ্ধার সাহসী মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ সন্ধ্যা ৭:০৫



ছেলের কথা যখন মনে হয় তখন ভাবি, ও রিসেন্টলি মারা গিয়েছে। কলজের ভেতর সবসময় আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে। দিন গেলে যে ওই ব্যথা কমে যাবে তা নয়। কোনো মা ছাড়া এ বিষয়টি আর কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব না।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ লেফটেনান্ট আশফাকুস সামাদ বীর উত্তম সম্পর্কে এভাবেই মন্তব্য করেছিলেন তার মা মিসেস সাদেকা সামাদ। ২০০৩ সালে তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক আলাপচারিতায় তিনি ছেলে ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেছিলেন।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আশফাকের পুরো নাম ছিল আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদ। মুক্তিযুদ্ধের সময় মাত্র ২১ বছরের এই তরুণ তার নামের মতোই লম্বা ছিলেন। ছয় ফিট এক ইঞ্চি লম্বা, ইম্প্রেসিভ ব্যবহার, মা-বাবা ও বন্ধুদের কাছে খুবই প্রিয়। তার ডাকনাম নিশরাত। বাবা-মা ডাকতেন তানি আর বন্ধুরা আশফি নামে।

গাড়ি ড্রাইভ করা, সাতার কাটা, সবাইকে চমৎকার কথায় মুগ্ধ করে সুন্দর জীবন কাটছিল তার। দেশের বাইরে এমআইটি-তে পড়তে যাওয়া ছিল প্রায় চূড়ান্ত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা কাবের সুইমিং পুলে সাতার কাটতে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেন। সেই রাতেই যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্বিচার হত্যা শুরু করলো তার অস্থিরতা চরমে উঠলো।

মাকে প্রায়ই বলতেন, তোমার চার ছেলে। এক ছেলেকে দেশের জন্য দেবে না?

মা সাদেকা সামাদ মৌন সম্মতি জানালেও চোখ দিয়ে তার পানি ঝরতো। রতœগর্ভা এই মায়ের চার ছেলের তিনজনই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। বড় ছেলে আশফাকুস সামাদ যুদ্ধ পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগেই তিন বন্ধুসহ বাড়ি থেকে চলে যান ময়মনসিংহে। ৪ এপৃল ঢাকায় আসেন ছয়টি থৃ নট থৃ রাইফেল, ২৫টি গ্রেনেড ও প্রচুর গোলাবারুদ নিয়ে। তার এই সাহসিকতায় অনেকে বিস্মিত হয়ে পড়েন। দ্বিতীয় ছেলে আরশাদুস সামাদ তৌফিকও যুদ্ধে যান। তৃতীয় ছেলে ইশতিয়াক আজিজ উলফাত দুই নাম্বার সেক্টরের ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম সদস্য। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালসহ ঢাকার অনেক গেরিলা অপারেশনে অংশ নিয়ে তিনি পাকিস্তানি আর্মিদের অস্থির করে তোলেন। এ সময় তার বয়স ছিল ১৭। ছোট ছেলে ইফতিখার আজিজ শওকি তখন বালক আর মেয়ে এমিলি ছিলেন সঙ্গী হিসেবে। সাদেকা সামাদের স্বামী আজিজুস সামাদ ছিলেন চমৎকার স্বভাবের শৌখিন ব্যক্তি। নিজে যেমন ভালো পোশাক পরতেন, তেমনি তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে ছেলেমেয়েদের ভালো কাপড় পরাতেন। ভালো স্কুলে পড়িয়েছেন। এজন্য সব কষ্ট স্বীকার করেছেন তারা। শুধু নিজের ছেলেমেয়েই নয়, আত্মীয়-অনাত্মীয় সবার প্রতিই তাদের আচরণ ছিল অভিন্ন।

বাবা-মা ছেলেদের এমনভাবেই গড়ে তুলেছেন, তাদের অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এমনকি যুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সব ব্যবস্থা থাকলেও তারা দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সবকিছু ত্যাগ করেন। সাদেকা সামাদ যুদ্ধের সময় বদলে গেলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, যুদ্ধের সময় থেকে ফ্যামিলিটি আর নরমাল রইলো না।

সাদেকা সামাদের বিয়ের আগের নাম সাদেকা বানু। তারা ছিলেন ছয় ভাই পাচ বোন। বোনদের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তাদের আদি বাড়ি ছিল বর্তমান মাদারীপুরের শিবচর থানার খানকান্দি গ্রামে। বাবা আবদুল হাফিজ খান ১৯০১ সালে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। এ ধরনের রেজাল্ট পুরো এলাকাকে চমৎকৃত করে। তিনি কাজ করতেন পাটনায় এবং খুবই ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। সাদেকা সামাদের মা সাইদা বানু ছিলেন ফরিদপুরের নগরকান্দা থানার প্রসিদ্ধ গট্টির পীরের মেয়ে।

ধর্মশিক্ষা তাদের বাড়িতে স্বাভাবিক হলেও ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শিক্ষায় তারা উদ্যোগী ছিলেন। তাদের বাড়িতে কমরেড, দি মুসলমান, মোহাম্মদী, সন্দেশ ইত্যাদি পত্রিকা নিয়মিত আসতো। বাড়ির মেয়েদের পড়াশোনা ঘরের ভেতরই হতো। সাদেকা সামাদের বড় তিন বোন স্কুলে যাননি। কিন্তু তাদের মেজ ভাই ফজলুর রহমান তাকে সাইকেলে করে নিয়ে যান পাটনা কনভেন্ট স্কুলে। তখন সাদেকা সামাদের বয়স ছিল ছয়। স্কুলে ভর্তির সময় তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সান মানে কি?

সাদেকা সামাদের চটপট উত্তর, এসওএন সান মানে ছেলে আর এসইউএন সান মানে সূর্য।

সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ভর্তি করিয়ে নেয়া হয়।

ফরিদপুর গার্লস স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে দশ টাকা স্কলারশিপ নিয়ে তিনি ম্যাটৃক পাস করেন। মেধাবী ছাত্রী হিসেবে কলকাতায় লেডি ব্রেবর্ন কলেজে ফৃ পড়ার সুযোগ পান। কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে ইতিহাসে ডিগ্রি নেন। এমএ ডিগ্রি পান ১৯৪৭ সালে। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে এমএড ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি।

তার একাডেমিক ক্যারিয়ার এক কথায় অসাধারণ। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মেও তিনি ধর্মশিক্ষাকে বজায় রেখে ইংরেজিতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। সাদেকা সামাদ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য দেন তার ভাইয়ের ছেলে সাবেক অতিরিক্ত সচিব শাহরিয়ার জেড আর ইকবাল। ফুপু সম্পর্কে তিনি বলেন, একজন বাঙালি মহিলা ওই সময় এতো চমৎকার ইংরেজি বলতেন তা শুনে ছেলেবেলায় বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।

১৯৪৭-এ দেশ ভাগের পর মাদারীপুর ডোনোভান গার্লস স্কুলে শিক্ষক সঙ্কট দেখা দেয়। এ সময় কর্তৃপক্ষ খবর পায়, মাদারীপুরে একজন এমএ পাস করা মহিলা আছে। তাদের বিশেষ অনুরোধে সাদেকা সামাদ স্কুলটির হেড মিসট্রেস হতে রাজি হন। তার স্বামী আজিজুস সামাদ তাকে সর্বাত্মক সাহায্য করেন।

এরপর নারায়ণগঞ্জে মর্গান গার্লস স্কুলের হেড মিসট্রেস ছিলেন বেশ কিছুদিন। কয়েক দিন পড়িয়েছেন ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুলে। তবে সাদেকা সামাদের শিক্ষক জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় কাটে আরমানিটোলায় আনন্দময়ী গার্লস স্কুলের হেড মিসট্রেস হিসেবে। এখানে তার প্রায় সাতাশ-আটাশ বছর কাটে।

১৯৬৪ সালে তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় যান। তার স্কলারশিপের বিষয় ছিল সুপারভিশন অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ সেকেন্ডারি স্কুল। একই বছর ঢাকা সদরের দক্ষিণ মহকুমার অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট মনোনীত হন সাদেকা সামাদ। ১৯৭০ সালে সরকারি ও বেসরকারি স্কুলগুলোর মধ্যে বেস্ট হেড মিসট্রেস নির্বাচিত হন। এছাড়াও ১৯৭০ সালে সোশাল ওয়েলফেয়ার অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলের সদস্য হয়েছিলেন। তামগায়ে কায়েদে আজম পদক ছিল তার আরেকটি বড় প্রাপ্তি।

প্রতি ক্ষেত্রে সময় মেনে চলা ছিল তার জীবনেরই অংশ। স্কুলের সময় শেষ হলেও কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্কুলে থাকতেন। কিন্তু এতো কিছুর পরও স্বামী, সন্তান, পরিবার-পরিজনের প্রতি দায়িত্ব পালনে কোনো অবহেলা ছিল না তার।



গরিব আত্মীয়-স্বজনের যে কোনো বিপদে পাশে দাড়াতেন। গোপনে টাকা, কাপড় নিয়ে যেতেন। বলতেন, অপরিচিত, অভাবী ব্যক্তি কখনো কখনো সাহায্য চায়। কিন্তু অভাবী আত্মীয়-স্বজনরা টাকা চাইতে পারে না। তাদের গিয়ে দিয়ে আসতে হয়।

অনাথ মেয়েদের শিক্ষা, তাদের বিয়ে দেয়া, কারো অসুখ হলে খাবার নিয়ে হসপিটাল বা বাসায় চলে যাওয়া, কারো বাচ্চা হওয়ার সময় হসপিটালে রাতের পর রাত কাটানো ছিল তার জন্য অতি সাধারণ ঘটনা। মানুষের সেবা করাকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন ইবাদত হিসেবে। ধর্মীয় অনুশাসন, পারিবারিক মূল্যবোধ ও ইংরেজি শিক্ষার সমন্বয় তাকে অনন্য করে তুলেছিল।

মানুষকে খাইয়ে আনন্দ পেতেন তিনি। প্রতিবার দেড়শ’ থেকে দুশ’ আচারের বোতল তৈরি করতেন। যখন যার বাসায় যেতেন আচারের বোতল একটি করে উপহার দিয়ে আসতেন। বড় ছেলে নিশরাতের প্রিয় খাবার ছোলার ডালের বরফি, মুরগির রোস্ট, চিতল মাছের কোপ্তা নিজ হাতে তৈরি করতেন।

বাসায় তিনি মমতাময়ী আর স্কুলে তিনি আদর্শ শিক্ষিকা এবং কখনো কখনো কড়া মেজাজের হেড মিসট্রেস। একবার স্কুলের স্পোর্ট অনুষ্ঠানে হঠাৎ করেই ঢাকার ডিসি চলে এলে তিনি মেয়েদের স্কুলে এভাবে ঢুকে পড়ার জন্য সরাসরি তাকে অভিযুক্ত করেন। ডিসি দুঃখ প্রকাশ করে বের হয়ে আসেন।

স্কুল এবং বাড়িতে দুই রূপেই তাকে কাছে থেকে দেখেছেন মিসেস কামরুন নাহার রেনু। তিনি সম্পর্কে সাদেকা সামাদের জা। অর্থাৎ সাদেকা সামাদের দেবর সাংবাদিক আতাউস সামাদের স্ত্রী। একই সঙ্গে তাকে আনন্দময়ী স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়ে যান সাদেকা সামাদ। তার সম্পর্কে জানাতে গিয়ে কামরুন নাহার বলেন, ভাবীর সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য ছিল অনেক। তিনি আমাকে মায়ের মতো আদর করতেন, শাসন করতেন। যেখানে যেতেন সঙ্গে নিয়ে যেতেন। আবার স্কুলের কাজে কোনো ছাড় দিতেন না। প্রতিদিন একজন শিক্ষকের পাচটি করে কাস নিতে হতো। কিন্তু আমার ছেলে তখন খুব ছোট। সে কারণে তিনি কিছুটা ছাড় দিয়েছিলেন সময়ের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ আমাকে একটানা পাচটা কাস করিয়ে তারপর ছুটি দিতেন। তার সঙ্গে রিকশায় ঘুরেছি বহু দিন। রিকশা থামিয়ে ভুট্টা পোড়া খাওয়া ছিল নিয়মিত ঘটনা। ওই সময়গুলো আমার জীবনের অন্যতম সেরা সময়।

সাদেকা সামাদের এ নিয়মতান্ত্রিক জীবনে ঝড় আসে ১৯৭১ সালে। বড় ছেলে আশফাকুস সামাদ যুদ্ধে চলে যান। তৃতীয় ছেলে উলফাতের খোজে পাকিস্তানি আর্মি চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে যায় তাদের পুরো পরিবার। তার স্বামী আজিজুস সামাদের বাবার তৈরি করা ২২, নয়াপল্টনের ওয়েসিস বাড়িটিতে উঠে আসেন তারা। এ বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাটিতে পরিণত হয়। আজিজুস সামাদের ছোট দুই ভাই সাংবাদিক আতাউস সামাদ ও আতিকুস সামাদ দুজনেই যুদ্ধের কাজে জড়িয়ে পড়েন। আতাউস সামাদ সাংবাদিকতার পাশাপাশি ঢাকা চষে বেড়িয়েছেন। প্রাণের ঝুকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনীয় স্পর্শকাতর তথ্য তিনি পাঠিয়েছেন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের কাছে।

সাদেকা সামাদের পরিবার এভাবেই সক্রিয় হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে। তার স্বামী ও তার দুই ভাই এবং নিজের তিন ছেলে সরাসরি নানাভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।

আজিজুস সামাদ নীরবে অপেক্ষায় থাকতেন ছেলেদের ফেরার। উলফাত যখন দেখা করতে আসতেন তখন তিনি ডান হাত বাড়িয়ে দিতেন। ছেলে পকেট থেকে রিভলভার বের করে দিলে বাবা চেক করতেন গুলি ভরা আছে কি না। তারপর আবার হাত বাড়ালে উলফাত নীরবে বের করে দিতেন পটাশিয়াম সায়ানাইড ভর্তি ছোট শিশিটি। পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়লে প্রয়োজনে তা যেন ব্যবহার করেন সে কথাটি ছোট্ট দুটি শব্দে বলতেন আজিজুস সামাদ, ইউজ ইট।

পাকিস্তানি আর্মি উলফাতের খোজে তাদের নয়াপল্টনের বাড়ি ঘেরাও করে। আজিজুস সামাদকে ধরে নিয়ে যায় তারা। অকথ্য নির্যাতন চালায় তার ওপর। ঝুলিয়ে পেটানো থেকে শুরু করে ছেলেকে ধরিয়ে দিতে এমন কোনো অত্যাচার নেই যা তারা করেনি।

এ সময় অন্যরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন সাদেকা সামাদ। স্বামীকে মুক্ত করতে বাড়ি থেকে বের হন তিনি। কখনো একা, কখনো জা কামরুন নাহারকে নিয়ে বের হতেন। যেহেতু খুবই ভালো উর্দু জানতেন, একই সঙ্গে তার পাকিস্তান সরকারের পদক থাকায় পাকিস্তানিদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেতেন তিনি। অসম সাহসে তিনি গেছেন থানায়, কখনো তেজগাও ড্রাম ফ্যাক্টরির বন্দি শিবিরে। খাবার, টাকা, ওষুধ নিয়ে তিনি যেতেন। তার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পর্যন্ত তাকে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে দিতো।

এতো নির্যাতন ও আশঙ্কার মাঝেও কিছু মিষ্টি ঘটনা ঘটতো। আজিজুস সামাদের সঙ্গে বন্দী শিবিরে নির্যাতিত হয়ে বেচে এসেছেন এমন ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, তারা এই জুটিকে সেখানে নাম দিয়েছিলেন লাইলী-মজনু। কারণ স্বামীর সঙ্গে কথা বলে সাদেকা সামাদ যখন ধীরপায়ে ফিরে আসতেন তখন আজিজুস সামাদ পেছন থেকে ডাকতেন, এই শোনো।

ফিরে যেতেন সাদেকা সামাদ।

এভাবে পাচ-সাতবার তারা একে অপরের কাছে আসতেন এবং কথা বলতেন বা নীরবে দাড়িয়ে থাকতেন।

স্বামীর মুক্তির জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে ছোটাছুটি করেন সাদেকা সামাদ। পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে বা প্রভাবশালী মহিলাদের সঙ্গে তার পরিচয় থাকায় বিষয়টি অনেক দূর এগিয়ে যায়। কিন্তু পাকিস্তানি আর্মি তার বড় ছেলের খবর না জানলেও উলফাতকে ধরিয়ে দিতে বলে।

এ সময় তারা বলে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে উলফাতকে ধরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানাতে। এবং এই কাজ করতে হবে সাদেকা সামাদকে।

একদিকে স্বামীর মুক্তি অন্যদিকে ছেলেকে ধরা দিতে বলে বিজ্ঞাপন দেয়াÑ এ ছিল অসহনীয় মানসিক অত্যাচার। সাদেকা সামাদ বিজ্ঞাপন দেন পত্রিকায়। আবার একই সঙ্গে গোপনে খবর পাঠান ছেলে যেন ধরা না দেয়। তবে ছেলে তার খবর পেয়েছে কি না এ নিয়ে উৎকণ্ঠায় ছিলেন তিনি। এ দিনগুলোর দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছিলেন তার সাক্ষাৎকারে।

বন্দী শিবির থেকে স্বামীকে ফিরিয়ে আনার পর বড় ছেলে নিশরাতকে দেখার জন্য বাবা-মা দুজনেই উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে উলফাত তাদের দুজনকে নিতে আসেন। সাদেকা সামাদের পরিকল্পনা ছিল, কলকাতায় গিয়ে বড় ছেলে আশফাকুস সামাদ নিশরাতের সঙ্গে দেখা করার। ঝুকিপূর্ণ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তারা আগরতলা হয়ে কলকাতায় পৌছান।

সেখানে প্রতিদিনই সাদেকা সামাদ অপেক্ষায় থাকতেন, উলফাত ও তার স্বামী মিলে বড় ছেলে নিশরাতকে নিয়ে আসবেন। নিশরাত আসেননি। আসে তার মৃত্যু সংবাদ। তারা যখন কলকাতার পথে তখনই নিশরাত শহীদ হন।

ছেলের মৃত্যু তাকে পাগলের মতো করে তোলে। যুদ্ধের পর দেশে ফিরলেও আমৃত্যু নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। তার জীবনযাপন বদলে যায় পুরোপুরি।

তার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা গণপরিষদের চেয়ারম্যান ইশতিয়াক আজিজ উলফাত আবেগময় কণ্ঠে বলেনÑ আমরা জানি, আকাশে কখনো কখনো তারা জ্বলে ওঠে। তারপর আবার নিভে যায়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ছিল তারার মতো আমাদের জ্বলে ওঠার সময়। আমাদের যতো কৃতিত্ব, বীরত্ব, সমাজে আধিপত্য, আমাদের চলাফেরা, হয়তো ঔদ্ধত্যপনাÑ সবই ওই নয় মাস। কেউ কেউ ওই নয় মাস থেকে ফেরত আসতে পারেনি। কোনো কোনো পরিবার পারেনি। আমাদের পরিবারটাও পারেনি।

মুক্তিযুদ্ধ থেকে সাদেকা সামাদের পরিবার সত্যিই ফিরে আসেনি। তিনি নিজেই তার প্রমাণ দিয়েছেন। ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে কিডনি ফেইলিওরের কারণে যে সময়টায় তিনি মারা যান সেটা ছিল ২০০৩-এ ২৫ মার্চের শেষ রাত।



..............

ছবি: শহীদ আশফাকুস সামাদ



.........................................................

লেখাটি যায়যায়দিনের ঈদ সংখ্যা ২০০৬ - এ প্রকাশিত



মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ সন্ধ্যা ৭:১৮

কালো প্রজাপতি বলেছেন: অপূর্ব

২| ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ সন্ধ্যা ৭:৪৬

মাহবুব মোর্শেদ বলেছেন: ভাল লাগলো।

৩| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ দুপুর ১২:১০

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বলেছেন: ধন্যবাদ কালো প্রজাপতি।
শুভেচ্ছা রইলো মাহবুব মোর্শেদ।

৪| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ রাত ১২:২৪

ফারহান দাউদ বলেছেন: এই দেশরত্ন পরিবারের সবার জন্য শ্রদ্ধা।

৫| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ রাত ১২:৪৮

সিহাব চৌধুরী বলেছেন: মাকে কোটি সালাম আর বাবাটিকেও ।

দুটি শব্দে বলতেন আজিজুস সামাদ, ইউজ ইট ।
-------> আমদের এরকম বাবা ছিল , আমরা অবশ্যই স্বাধীনতা ধরে রাখতে পারব, পারবই ।
৫ ।

৬| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ রাত ১২:৫১

সিহাব চৌধুরী বলেছেন: প্রিয়পোষ্টে । ভাই, আর এরকম কাহিনী জানা থাকলে শেয়ার করুন ।

৭| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ রাত ১২:৫৯

মেহরাব শাহরিয়ার বলেছেন: যায়যায়দিন এ লেখাটা প্রথম পড়ার সময় হৃদয় ছুয়ে গিয়েছিল , আবারও পড়লাম ।
প্রিয় পোস্ট করে নিলাম

৮| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ দুপুর ১:৪৬

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বলেছেন: ফারহান দাউদ
অনেক ধন্যবাদ।

৯| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ দুপুর ২:৪২

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বলেছেন: িসহাব চৌধুরী
প্রিয় পোস্ট করায় ধন্যবাদ । মুক্তিযুদ্ধের বন্দী শিবির নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মিসেস সাদেকা সামাদের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ ঘটেছিল ।

১০| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ দুপুর ২:৫৫

মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান বলেছেন: মেহরাব শাহরিয়ার
অশেষ ধন্যবাদ ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.