![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সারারাত ঘুমোতে পারেননি অজিত বাবু। বয়স পঁয়ষট্টি পার করলেও ঘুমের কোন সমস্যা কখনো হয়নি। রোজ রাতে খাবার পর একটু হাঁটাহাঁটি করেন। রুমের মধ্যেই। তারপর বই নিয়ে বসেন। বই পড়তে পড়তেই এমন ঘুম আসে যে এক ঘুমেই রাত পার। এই বয়সে ঘুমের ওষুধ ছাড়া ভালো ঘুম কারো হয় না। কিন্তু অজিত বাবু ব্যতিক্রম।
তবে আজ কিছুতেই ঘুমোতে পারলেন না। ভোর হবো হবো করছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই হয়তো পাখিরা কিচিরমিচির শুরু করবে। কোন ভাবেই ঘুম এলো না। সারা রাত রুমে পায়চারি করে কেটে গেল। আজ হঠাৎ প্রয়াত স্ত্রীর কথা খুব মনে পড়ছে। দু-বার ছাদে গেলেন, লাইব্রেরি রুমটা দেখে আসলেন একবার। বইগুলো যেখানে সেখানে পরে আছে। বউ খুব সুন্দর করে ঘুছিয়ে রাখতো। কাজের লোক দিয়ে এসব হয় না। সবাই কি বইয়ের মর্ম বোঝে!
রান্না ঘরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে জল নিলেন। ডাইনিং টেবিলে বসে জল খেতে খেতে মনে পড়লো এই টেবিল কেনার কথা। খুব শখ করে তার স্ত্রী রত্না কাঠমিস্ত্রী বাড়িতে এনে বানিয়েছিল এই ডাইনিং টেবিল। তারপর হলরুমে এসে বসলেন। সোফাগুলো এখনো ভালো আছে। যদিও অনেক বছর হলো। রত্না একবার অনেক জিদ করেছিল সোফা চেন্জ করার জন্য। অজিত বাবু রাজি হয়নি। দুই দিন রাগ করে ছিল। অনেক কষ্টে তাকে বোঝানো গিয়েছিল এটা অপচয়। তাদের সন্তানের পড়াশোনার জন্য অনেক টাকার দরকার। আর সন্তানের ক্যারিয়ার সোফার থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
*****
অজিত বাবু একটা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বেতন খুব একটা বেশি নয়। তবে তাদের পরিবারের জন্য যথেষ্ট ছিল। সংসারে মাত্র তিন জন। সে তার স্ত্রী রত্না আর একমাত্র সন্তান বিক্রম। স্বামী স্ত্রী বিক্রমের জন্য নিজেদের অনেক শখ আহ্লাদ কুরবানী দিয়ে ছেলেকে বড় করেছেন। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়িয়েছেন। তারপর উচ্চতর পড়াশোনার জন্য ইংল্যান্ড পাঠিয়েছিলেন।
বিক্রম পড়াশোনা শেষ করে সেখানে একটা জব পেয়ে যায়। কিছুদিন পর বিয়েও করে। তার বিয়ের কথা বাড়িতে জানতে পারে অনেক পরে। রত্না খুব জিদ করেছিল বৌমাকে দেখার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার দেখা হয়নি। দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অল্প সময়েই অজিত বাবুকে একলা ছেড়ে পারি দেন না ফেরার দেশে। অসুস্থ অবস্থায় বারবার ছেলেকে দেখার কথা বলতেন। বিক্রম কোনভাবেই ছুটি পাচ্ছে না বলে আসেনি। তারপর মায়ের মৃত্যুর কথা শুনে মুখাগ্নি করতে এসেছিল। রত্না শেষবার সন্তানের মুখটা দেখতে পারেনি বলে অজিত বাবুরও খুব দুঃখ হয়।
তারপর থেকে অজিত বাবু একা। বাড়িতে একটা কাজের লোক ছিল গণেশ। অনেক বছর ধরে থাকে এই বাড়িতে। রান্না, বাজার করা, ঘর পরিষ্কার, ফুলের বাগানের যত্ন সব কাজ করতে পারে। রত্না যাওয়ার পর বাড়িতে দুজন। দুঃখ কষ্ট নিয়ে বেশ চলে যাচ্ছিল দিন। তেমন কোন কাজ নেই। সকালে পেপার পড়া, স্নান খাওয়া, বই পড়া আর ঘুমানো। এই ছিল অজিত বাবুর রুটিন। রাতে ঘুমও ভালো হতো। কোন কোন দিন স্ত্রী রত্নার কথা মনে পড়লে ঘুমে সমস্যা হতো। মনে পড়তো ছেলের বিদেশে থাকা নিয়ে রত্নার অভিমান করে বলা কথাগুলো। কাঁদত আর বলতো। আসলে একটাই মাত্র সন্তানকে ছেড়ে বাবা মার দূরে থাকা খুবই কষ্টকর।
পাখিদের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। একটা কোকিলও সমানে কুহু কুহু করছে। ভোর হবে। পাখিরা নিজেদের বাসা ছেড়ে খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়বে এখন। ফিরে আসবে সন্ধ্যা নামার আগে। জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিল অজিত বাবু। বাইরে দেখলো তাকিয়ে। নানা রঙের ফুল দেখা যাচ্ছে। তার বাগানের শখ ছিল না। স্ত্রী রত্নার কারণেই বাগানটা করা। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন জানালার বাইরে। হাজারো স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে। গণেশ দরজার ঠোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো চা খাবেন বাবু? অজিত বাবু একবার জোরে ‘হু’ বলে আবার দৃষ্টি ফেরালো জানালার বাইরে।
*****
কয়েকদিন হল ছেলে এসেছে বিলেত থেকে। বউকে সঙ্গে নিয়ে। ছেলেকে দেখে খুব খুশি অজিত বাবু। বৌমা বেশ সুন্দরী। রত্না ছেলের বউকে দেখতে পায়নি বলে একটু মন খারাপ হল অজিত বাবুর। অনেক গল্প গুজব করলেন ছেলে আর বৌমার সঙ্গে। ইংল্যান্ডে সব কেমন চলছে জানলেন।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর বই নিয়ে বসেছেন অজিত বাবু। হুমায়ন আহমেদের গল্প সমগ্র। খুব ভালো লাগছে গল্পগুলো পড়তে। ছোট গল্পে হুমায়ন আহমেদের আসলেই কোন তুলনা হয় না। দরজায় ঠোকা শুনে উঠে গিয়ে দরজা খুললেন। বিক্রম কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কোন ভুল করে ফেলেছে তাই ক্ষমা চাইতে এসেছে।
‘বাবা একটা জরুরি কথা ছিল’ - বলে বিক্রম একটা হাত দিয়ে আরেকটা হাত ঘষতে লাগলো।
অজিত বাবু ভেতরে এসে বসতে বললেন। বিক্রম এসে সোফায় বসলো। অজিত বাবু বিছানায় বসলেন। বিক্রমের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সে খুব অস্বস্তি ফিল করছে। বরাবর হাতে হাত ঘসছে।
'কি ব্যাপার বলো বিক্রম' - অজিত বাবু বিক্রমের দিকে তাকিয়ে বললেন।
বিক্রম ধীর আওয়াজে বললো সে ইংল্যান্ডে একটা ফ্লাট কিনবে। কয়েক বছর ধরে টাকা জমিয়েছে। আরো কিছু লাগবে। তাই এই বাড়িটা বিক্রি করতে চাইছে। আরো বললো অজিত বাবুর যেন কোন সমস্যা না হয় তাই এলাকার সবথেকে ভালো বৃদ্ধাশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করেছে। ফ্ল্যাটটা কেনা হলে সে এসে অজিত বাবুকে নিয়ে যাবে।
সব শুনে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অজিত বাবু। এই বাড়িটার সাথে তার অনেক ভালোবাসা। খুব কষ্টে বানিয়েছিলেন। স্ত্রী রত্না একটা একটা আসবাবপত্র খুব যত্নে ভালোবেসে কিনে এনে সাজিয়েছিল। এটা তো শুধু একটা বাড়ি নয়। হাজারো স্মৃতি এই বাড়িকে নিয়ে। স্ত্রী রত্নার ভালোবাসা জড়িয়ে আছে বাড়ির আসবাবপত্রে, বাড়ির কোনায় কোনায়।
মন মস্তিষ্ক যদিও না বলছিল তবুও অজিত বাবু রাজি হয়ে গেলেন। মৃত্যুর আগে ছেলে বৌমার সাথে থাকতে পারবেন এই আশায় তিনি হ্যাঁ বললেন। বৃদ্ধ বয়সে এটাই হয়তো সব থেকে আনন্দের।
বাবা রাজি হয়েছেন শুনে ছেলের সমস্ত অস্বস্তিভাব কেটে গেল। চেহারায় খুশি খুশি ভাব এলো। ঠোঁটের কোনে হাসি খেলে গেল।
রুম ছেড়ে হওয়ার আগে বিক্রম বললো, ‘সবকিছু ঘুছিয়ে নিও। কালকেই বৃদ্ধাশ্রমে তোমাকে রেখে আসবো। কালকে কয়েকটা পার্টি আসবে বাড়ি দেখতে। খুব তাড়াতাড়ি সব কাজ করতে হবে।’
আর ঘুম হলো না অজিত বাবুর। হাজারো কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে সকাল হয়ে গেল। ব্যাগটাও গোছানো হয়নি। গণেশকে বলতে হবে সেই সব গুছিয়ে দেবে। তারপক্ষে আর কিছু সম্ভব নয়।
*****
পাঁচ বছর কেটে গেছে। ছেলে কোনভাবেই আর যোগাযোগ করেনি। বৃদ্ধাশ্রমটাকেই এখন নিজের বাড়ি মনে হয় অজিত বাবুর। তার বয়সী অনেকেই আছেন এখানে। বেশ আড্ডা হয়। কেউ কারো আপন নয় তবুও কেমন একটা সম্পর্ক যেন তৈরি হয়ে গ্যাছে। সবাই যেন খুব আপন। সারাদিন গল্প আড্ডা আর কাজে ব্যস্ত থাকেন। বেশ ভালোই কাটছে দিন। শুধু ঘুমটা হচ্ছে না। রাতটা জেগে জেগেই কেটে যায়। নিস্তব্ধ রাতে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ ছাড়া কিছুই শোনা যায় না। মাঝেমধ্যে কানের কাছে কেউ যেন কিছু বলে। আওয়াজটা খুব চেনা। ঘুমহীন নিরিবিলি রাতে অজিত বাবু শুনতে পান, ‘ফ্ল্যাট কেনা হলেই তোমাকে নিয়ে যাবো আমাদের কাছে। বাকি জীবন একসাথে থাকবো বাবা।’
©somewhere in net ltd.