নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বললাম তো কিছু জানিনা দুঃখিত ।

ফুসকা

তেমন কিছু জানিনা আমি । অতি সাধারন একজন মানুষ আমি ।

ফুসকা › বিস্তারিত পোস্টঃ

সকল ভালবাসার উপরে যার বসবাস

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:২৭

হাতে একটু সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ুন কথা দিচ্ছি সময় নষ্ট হবে না !!





“আপা পেটে ব্যাথা করে, তোমার সাথে একটু ঘুরতে যাই?” আমার কথা শুনে আপা কটমট দৃষ্টি নিয়ে আমার

দিকে তাকিয়ে বলে, “তোকে নেয়া যাবেনা।তুই মহাপেটুক।আমার বান্ধবীর বাসায় যেয়ে পরে বলে বসবি, ক্ষিধা লাগছে, বিস্কুট খাবো”।

আমি চোখ ছলছল করে বলি, “আমি কিচ্ছু বলবোনা । প্রমিজ”।

আপা আমার কথা পাত্তা না দিয়ে স্কার্ফটা ঠিক মত মাথায় লাগিয়ে ঘর থেকে বের

হয়ে গেলো। আমার খুব মন খারাপ হলো।

আজকে বাসায় কিছুই রান্না হয়নি দুপুরে। সকালে একটা রুটি খেয়ে আম্মার কাছে অনেক ঘ্যানরঘ্যানর করেছি। আম্মুকে বলেছি যে সে সব খেয়ে ফেলছে, তাই এখন আমাকে আর খেতে দেয়না। আম্মু আমাকে বকা দিয়ে বলছে, আমি নাকি একটা মহা পেটুক। সারাদিন

খালি খাইখাই করি।একবার মনে হলো বাবার কাছে যেয়ে বিচার দেই। কিন্তু পরে মনে হলো লাভ নেই।বাবার কাছে গেলে বাবা কবিতা শুনিয়ে দেয়।ভয়ংকর সব কবিতা।আমি কিছুই বুঝিনা।

আমার আপুর বান্ধবীর আজকে জন্মদিন। বান্ধবীর নাম হোসনা। হোসনা আপুকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। উনি প্রতিবার যখনই বাসায় আসেন, আমার জন্য বেবী লজেন্স নিয়ে আসেন।

মাঝে মাঝে ঝাল চকোলেটও নিয়ে আসেন।আমি একদিন খুব খুশি হয়ে আপুকে বলেছিলাম, “বড় হয়ে আমি তোমাকে বিয়ে করবো, ঠিক আছে?”

হোসনা আপু আমার থুতনী টান দিয়ে বলে, “কেন? আমি অনেক সুন্দর?”

আমি চকোলেট কামড়ে ভেঙ্গে বলি, “নাহ।এই যে আমাকে এত্ত চকোলেট দাও তাই। কোন যৌতুক নিবোনা। একটা সাইকেল শুধু দিতে বলো তোমার আব্বুকে।চার চাকার সাইকেল”।

হোসনা আপু ওইদিন আমাকে কোলে নিয়ে কি হাসি।আমার বাবা মা সবার কাছে যেয়ে বললো, আমি নাকি তার ছোট্ট জামাই। সাইকেল চড়া জামাই।আপুর সাথে আজকে যেতে চাচ্ছিলাম শুধু হোসনা আপুকে দেখার জন্য।আমার অনেক ক্ষুধা লাগলেও আমি একটুও বিস্কিট খেতে চাইতাম না।

আপু যখন সেন্ডেল পড়ে চলে যাচ্ছিলো আমার পুরো চোখে তখন অভিমান ভরা জল। আমি চুপ করে আম্মুর খাটে যেয়ে শুয়ে পড়লাম।

হঠাৎ দেখি আপু এসে আমার জামা ধরে টানাটানি করতে লাগলো। হাসিহাসি মুখে বললো, “বয়স মাত্র ৯, এখনই এতো অভিমান শিখলো কোত্থেকে আমার

ভাইটা?”

আমার তখন আরো কান্না পেলো।আমি বালিশ দিয়ে মুখ ঢেকে কাদতে কাদতে বললাম, “তুমি খারাপ।আম্মু খারাপ, আব্বু খারাপ। আমাকে কেউ কোথাও

ঘুরাতে নিয়ে যায়না”।

আপু আমাকে প্রায় কোলে নিয়ে বিছানা থেকে তুলে তারপর জামা কাপড় পড়িয়ে দিলো।

আমার অভিমান তখনও কাটেনি।একটু পর মা এসে আমার মুখে যখন ক্রিম মেখে দিলো তখন আমার মুখে হাসি এসে গেলো।আমার মনে তখন একটাই চিন্তা হোসনা আপুর জন্মদিনে যাচ্ছি, কি নিয়ে যাওয়া যায়? খালি হাতে গেলে মানুষ

কি বলবে? হোসনা আপুদের বাসাটা এতো সুন্দর! কি সুন্দর সুন্দর ছবি দেয়ালে টাঙ্গানো।আমার খুব কষ্ট

হচ্ছিলো ভেবে যে আমাদের বাসাটা কত্ত পচা।

আমি আপুকে দেখে হাসিমুখে বললাম, “হ্যাপি জন্মদিন।"

আপু আমাকে দেখে আরো খুশি হয়ে বললো, "তোর জন্মদিন আর এক সপ্তাহ পর না?”

আমি হাসিমুখে মাথা নাড়ি। আপুকে বলি, “তোমার কেক কই?কেক দেখাও, কত বড় কেক দেখি!”

জন্মদিন থেকে যখন বাসায় ফিরে আসছিলাম তখন দেখি আপু কাদছে।আমি কিছু বললাম না। সারাটা রাস্তা আপু কাদতে কাদতে বাসায়

ফিরলো।বাসায় এসে আবার দরজা আটকিয়ে কাদলো। আমি নিজেও আপুর

কান্না দেখে চোখ মুছতে মুছতে বাসায় ফিরলাম।রাতে বাসায় এসে আম্মুকে বললাম, “ক্ষুধা লাগছে।ভাত দাও”। আম্মু অগ্নিশর্মা চোখে বললো, “যা তোর

বাবাকে যেয়ে বল! কেবল না একটা দাওয়াত খেয়ে আসলি, খাওয়া ছাড়া কিছু চিনিসনা?” আমি মনে মনে খুব কষ্ট পেলাম।

বড়রা কখনো বুঝতে পারেনা ছোটদের মনেও অনেক কষ্ট লাগে।আমি ঠিক করলাম আর কখনোও আম্মুকে খেতে দিতে বলবোনা।

কয়েকমাস আগেও আম্মু এমন করতোনা।আব্বু যেদিন থেকে আর

অফিসে যায়না, ঘরে বসে বসে কবিতা লিখে সেদিন থেকে আম্মু এমন হয়ে গেছে।

আপু কতদিন নতুন জামা কিনেনা।

আমাদের আত্নীয় স্বজনরাও কেউ এখন ওভাবে বাসায় আসেনা।

আম্মু মাঝে মাঝে মুখ বুজে কাদে। আমি বুঝতে পারি আমরা গরীব হয়ে গেছি। আমাদের কাছে টাকা নাই।সবাই আমাদের অনেক ধার কর্জ দিছে।এখন আর কেউ দেয়না। তাই আম্মুও আমাকে খেতে দেয়না।

আমার খুব ভয় হয়, যদি আমি আর খেতে না পাই তাহলে তো আর বড় হবোনা।এমন ছোট্ট হয়ে থাকবো। আমার

বন্ধুরা সব লম্বা হয়ে যাবে, বড় বড় হয়ে যাবে। আমি মন খারাপ করে আপুর রুমের সামনে গেলাম।আপু তখনও কাদছে।

দরজায় কান লাগিয়ে শুনতে পেলাম আপু বারবার বলছে, “আমরা এত গরীব কেন?”

সকালবেলা স্কুলে যেয়ে দেখি সবাই খুব ভয় নিয়ে বসে আছে।আজকে বার্ষিক

পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে।ফেল করলে একেবারে অক্কা। আমি অবশ্য খুব ভয় টয় পাচ্ছিনা।কারণ আমি প্রতিবারই পরীক্ষায় ফাস্ট হই, এখনও কখনো সেকেন্ড হইনাই।যারা ফাস্ট হয় তাদের ভয় পাইতে হয়না।

আমি অন্তুর পাশে যেয়ে বসলে সে তার পোকা দাত বের করে আমাকে বললো, “শুভ রোজা রাখছিস?”

আমি ভাব নিয়ে মাথা নাড়ি।ওকে বলি, “রাখছি।সেহরীতে শুধু পানি খেয়ে রোজা রাখছি”।

অন্তু মাথা চুলকিয়ে বললো, “পানি কেন

শুধু?ঘুম থেকে উঠতে পারিস নাই?”

আমি সত্যি কথাটা বলতে পারলাম না। আমাদের ঘরে যে সেহেরীতে খাবার ছিলোনা একথাটা কি করে বলা যায়? তাই আবার একটু ভাব নিয়ে বললাম, “নাহ কিছু না খেয়ে ইফতারী করলে আল্লাহ আরো খুশি হয় বুঝছিস?”

অন্তু কি বুঝলো জানিনা। আবার

হাসি দিয়ে বললো, “পরীক্ষা ভালো দিছিলি? সব ১০০ উত্তর করছিস?”

আমি গম্ভীর হয়ে বলি, “অবশ্যই”।

ক্লাস থ্রি এর বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল হাতে নিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমি অপেক্ষা করছি আপুর জন্য।আপুর কলেজ এখন ছুটি হয়ে গেছে। আমাকে সাথে নিয়ে বাসায় যাবে।একটু পর আপু আমার কাছে এসে দাড়ালো এবং অবাক

হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুই কি পরীক্ষায় ফেল করছিস?কাদছিস কেন?”

আমি মাথা নেড়ে বলি, “ফাস্ট হইছি। কিন্তু অনেক পেট কামড়াচ্ছে ক্ষিধায়”।

আপু আমাকে নিয়ে একটা রিকশায় উঠলো। আপুকে ক্ষুধার কথাটা বলা ঠিক হয়নাই। আপু নিশ্চয়ই রাগ করছে,

নাহলে চোখে আবার পানি কেন।

কাল রাতে মা সবাইকে বলেছে যে আমরা সবগুলা রোজা রাখবো। বাবার হাতের অবস্থা ভালো না। এতে টাকাও বাচবে, আল্লাহও খুশি হবে।আমি মুখ

কালো করে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলাম তখন। আম্মুকে কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। আপু বাসার কাছাকাছি রিকশা আসলে বললো, “শুভ শোন। আমরা এখন একটু কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।আমাদের টাকা পয়সা কমে গেছে তাই তোকেও একটু কষ্ট করতে হচ্ছে।মনটাকে শক্ত রাখবি আর প্রার্থনা করবি যেন আমাদের সমস্যাটা কেটে যায়।দেখিস আর কিছুদিন পর তোকে আর এমন কষ্ট করতে হবেনা।

আবার তোকে আম্মু অনেক বই কিনে দেবে। আমি তোকে প্রতিদিন পেস্ট্রি কেক কিনে দেবো”।

আমি মাথা নাড়ি।আমার মনে হচ্ছিলো আমি অনেক বড় হয়ে গেছি।আমার মাথায় অনেক জ্ঞান হয়ে গেছে।

আসলেও তো মনটা শক্ত করা দরকার। তবে মন জিনিসটা কেমন আমি তখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।আমি তবুও বিড়বিড় করতে থাকলাম, “মন শক্ত হতে হবে”।

বাসায় যেয়ে দেখি বাবা একটা পুরনো

পত্রিকা পড়ছে। আমি বাবার কোলে ধপাস করে যেয়ে লাফ দিয়ে বসলাম। বাবা আমাকে কোলে ঠিকমত বসিয়ে আবার পত্রিকা পড়া শুরু করলো। আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, “বাবা মন কিভাবে শক্ত করতে হয়?”

বাবা চশমা ঠিকমত চোখে দিয়ে বললো, “আব্বু,মন তো শক্ত করা যায়না।মন সবসময়ই নরম থাকে।কেউ কেউ নিজের মনটাকে লুকিয়ে রাখে”।

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “এই মন জিনিসটা কি?”

বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “তোমাকে যখন তোমার আম্মু বকা দেয় তখন কোথায় ব্যাথা লাগে?”

আমি একটু চিন্তা করি। তারপর বুকের মাঝখানে একটা জায়গা দেখিয়ে বলি, “এইখানে কেমন যেন কষ্ট কষ্ট লাগে”।

বাবা আমার বুকের ওই জায়গায় হাত

বুলিয়ে বললো, “এইটাই মন আব্বু।মনের ভিতর যখন কষ্ট হয় তখন

এটা লুকিয়ে রাখতে হয়। কাউকে দেখতে দিতে হয়না।তোমার কোন কষ্ট

কি আছে?”

আমি মাথা নাড়ি। আমি আমার মন লুকিয়ে রেখে বললাম, “কোন কষ্ট নাই আব্বু।আর কতক্ষণ পর আজান দিবে?”

বাবা হেসে বললো, “কেন ক্ষুধা হয়? পেটে কষ্ট হচ্ছে?”

আমি আবার কষ্ট লুকিয়ে বললাম, “নাহ তো! তোমাদের কষ্ট হচ্ছে হয়তো তাই

জিজ্ঞাসা করলাম”।

সেদিনের সেই ছোট্ট আমাকে আমার মহান বাবা যে সুমহান শিক্ষা দিয়েছিলেন

নিজের কষ্ট লুকিয়ে রাখার তা উনি নিজেও বুঝেছিলেন কিনা জানিনা।

ইফতারীতে আমি একটা পিয়াজু, একটা বেগুনী আর একটা আলুর চপ খেলাম। মা তেমন কিছুই খেলেন না।আমার খুব খারাপ লাগলো।আমি আমার প্লেট থেকে মুড়ি আর বুট নিয়ে সবটা আম্মুকে দিয়ে দিলাম।

তারপর বললাম, “আমার পেট ভরে গেছে মা। তুমি খাও। তুমিও তো রোজা রাখছো”।

মা আমাকে কোলে নিয়ে মুড়ি আর বুট মাখিয়ে আমার মুখে তুলে দিয়ে বলে, “বাবা অনেক বড় হ জীবনে। আমি দোয়া করি, আল্লাহ যেন তোর এই মনটা এইরকমই শুদ্ধ রাখে, পবিত্র রাখে”।

আম্মু যখন এই কথাগুলো বলছিলো আমার তখন পেটটা আসলেও ভরে গিয়েছিলো।আম্মু মাঝে মাঝেই আমার জন্য এমন করে প্রার্থনা করে।তখন

নিজেকে অনেক ভালো ভালো মনে হয়।

আম্মুর সবচেয়ে যেটা ভালো লাগে তা হলো, সকালবেলা আমি ঘুম থেকে উঠার সময় যখন আমার নাকে আর গালে আদর করে দেয় । ঘুম ভাঙ্গার জন্য তখন একটু কষ্ট হয়না। স্কুলে যাওয়ার আগে আম্মু আমার চুলটা কি সুন্দর করে আচড়িয়ে দেয়।আম্মুর মন খারাপ থাকলে তখন আপু আচড়িয়ে দেয়।

আমার আপুও মায়ের মত।সব আপুরা তার ছোট ভাইকে বকে, মারে।আমার বোন আমাকে সবসময় অনেক আদর করে।রাতে মাঝে মাঝে আমার রুমে এসে আমার মাথা চেপে ধরে কপালে চুমু

দিয়ে যায়।

আমি বুঝতে পারি, আমাকে সবাই কত্ত ভালোবাসে।

কত্ত আদর করে।

আমার মত এত ভাগ্যবান আর কে আছে? আমার স্কুল কালকে রেজাল্ট দিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।স্কুলে যেতে আমার খুব ভালো লাগে। কারণ, আমাদের স্কুলে একটা বিশাল মাঠ আছে। আমার খুব ভালো লাগে স্কুলের মাঠে ক্রিকেট খেলতে।স্কুল আবার খুলবে জানুয়ারী মাসের ১৬ তারিখে।ততদিন আমার ছুটি।

প্রত্যেক ছুটিতে আমার অনেক বই থাকে পড়ার জন্য।এবার বই নেই।তাই একটু মন খারাপ হয়েছে।

ভাবছি আপুর বড়দের বইগুলো নিয়ে পড়বো কিনা। কিন্তু পরে আপু রাগ করলে!! আম্মুর কাছে যেয়ে বললাম, “আম্মু আমি আপুর বইগুলো নিয়ে পড়ি?”

আম্মু তখন রান্না করছিলো।আমার কথা ঠিকমত মনে হয় খেয়ালও করেনি।মুখ দিয়ে শুধু 'হু' শব্দটা বললো।

আমি খুশিতে আটখানা হয়ে আপুর বইয়ের তাক থেকে একটা বই বার করলাম।

বইয়ের নাম 'তেতুল বনে জোসনা।'

লেখকের নাম 'হুমায়ূন আহমেদ'।আমি এই লেখকের আরো একটা বই পড়েছি।ওটার নাম ছিলো 'পিপীলি বেগম'।আমার খুব প্রিয় বই।জোসনা বইটাও বেশ ভালো লাগতে থাকলো, শুধু মানুষগুলো একটু বড় বড়।বড় বড় মানুষদের পাগলামী দেখে অবাক লাগে। ইফতারীর আগে আপু বাসায় এসে পড়লো।

আমাকে বই হাতে দেখে বললো, “ওমা শুভ তুই এই বই পড়ে কিছু বুঝিস নাকি?”

আমি মাথা নেড়ে বলি, “কিচ্ছু বুঝিনা তেমন, কিন্তু খুব হাসি হাসি কথা আছে তো। মজা লাগে।আপু আমি ডাক্তার হই?”

আপু মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “আচ্ছা। তোর যা ইচ্ছা হবি”।

কাল আমার জন্মদিন।

আমি এইজন্য ভিতরে একটা অস্থিরতা নিয়ে আছি। সবার দিকে তাকিয়ে একটু

করে হেসে দিয়ে আবার ভাব নিচ্ছি যে আমি কিছুই মনে রাখি নাই।

আম্মু, আপু সবাই আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বলছিলো।

আপু বললো, “তুই হাসিস কেন একটু পরপর?তোর কোণার দিকের দাতটা এখনও এত ছোট হয়ে আছে কেন রে গুলটু?”

আপু মাঝে মাঝে আমাকে গুলটু বলে ডাকে। আমার খুব মজা লাগে তখন।আমি গম্ভীর ভাব নিয়ে বলি, “হাসলে শরীর ও মন ভালো থাকে তাই”।

রাতে সেহরীর সময় আমাকে ঘুম থেকে ডাক দিয়ে উঠালে আমি প্রতিদিনই কান্নাকাটি করি।আজকে করলাম না।

আম্মু আমাকে দুধ ভাত খাইয়ে দিয়ে কোলে নিয়ে বললো, “বুইড়া বেটা এখনও কোলে না নিলে ঘুম হয়না কেন?”

আমি হালুম হালুম শব্দ করে ঘুমিয়ে পড়ি।

সকালে উঠে নিশ্চয়ই সবাই আমাকে হ্যাপী বার্থডে বলবে।

মা তো অবশ্যই বলবে।

সবার আগে বলবে।

বাবা নতুন একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাবে।

আর আপুটা আমার জন্য একটা পেস্ট্রি কেক ঠিকই নিয়ে আসবে।

সকালবেলা ব্যাপারটা ঠিক তেমন হলোনা। আব্বু দেখলাম খুব মন খারাপ

করে বসে আছে।

আম্মু আব্বুর পাশে বসে বলছে, “তোমার স্যারকে যেয়ে একবার বলোনা চাকরীটা ফিরিয়ে দিতে। আজকে ঘরে কিচ্ছু নাই”।

আব্বু মাথায় হাত দিয়ে বলছিলো, “কালকে সব লজ্জার মাথা খেয়ে স্যারের কাছে যেয়ে বলছিলাম যে আমি টাকাটা নেই নাই।স্যার বলছে আরেকবার অফিসে আসলে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেবে।আমার নামে নাকি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মানুষজন খুব নিষ্ঠুর হয়ে গেছে শুভর মা।খুব নিষ্ঠুর।কেউ কারও কষ্ট

দেখতে পায়না”।

আমার এসব শুনে খুব কান্না পাচ্ছিলো। আমি প্রতিদিন আশা করেছি, বাবা আগের মত আবার সুন্দর জামা কাপড় পড়ে অফিস যাবে। মাসের সাত তারিখে আমার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসবে। প্রতি সপ্তাহে আমাকে চকোলেট বক্স কিনে দেবে।

ইশ! এগুলো তাহলে বোধহয় আর কিছুই হবেনা।

আপু বাসায় এসে আমাকে বললো, “শুভ জন্মদিন আমার গুলটু মানিক।তোর জন্য আমি কেক নিয়ে আসছি”।

আমি খুশি হয়ে বললাম, “চকোলেট ক্রিম

আছে তো?”

আপু চোখ বড় বড় করে মাথা নাড়ে।আমার একটু মনটা ভালো হলো।মা আজকে একবারও রান্নাঘরে যায় নাই।সারাদিন নামাজে বসে কান্নাকাটি করছিলো। আমি মাঝে মাঝে আম্মুর কোলে যেয়ে শুয়ে ছিলাম।আম্মু আমাকে আদর করে দুপুরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিজেও আমার পাশে শুয়ে ঘুমিয়েছিলো।মার দিকে তাকালে খুব কষ্ট হয়।কেমন মুখটা শুকিয়ে থাকে সবসময়। চুলগুলো আলুথালু হয়ে থাকে, কেউ যেন যত্ন নেয়ার নাই।

মা আজকে ঘুমিয়ে গেলে আমি মার কপালে একটা ছোট্ট চুমু খেয়ে বললাম, “আমার আম্মু”।

আমার খুব মায়া লাগে মা যখন ঘুমিয়ে থাকে। আমার মনে হয় তখন মার মুখ দিয়ে আলো বের হয়। এই আলো সূর্যের আলোর থেকেও পবিত্র।

ইফতারীর সময় মা দেখলাম খুব গম্ভীর হয়ে আছে। বাবা আজকে বাসায় নেই। বিকালবেলা বাবা আমাকে হঠাৎ করে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন।

তারপর বললেন, “আব্বু , তোর জন্মদিনে তো এইবার কিছুই দিতে পারলাম না। পরের জন্মদিনে তোকে অনেক গিফট দেবো, ঠিক আছে?”

আমি ফিক করে হেসে দিয়ে বলি, “আমাকে একটা আকাশে ওড়ে ওইরকম একটা প্লেন কিনে দিও, রিমোট কন্ট্রোল প্লেন”।

আব্বু হাসে, আমার দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন হাসে।আমার কেন যেন

সেইসময় আব্বুকে খুব আপন লাগছিল।

মনে হলো তার বুকে যেন অনেক কষ্ট।কিন্তু মন শক্ত করার জন্য সব কষ্ট নিয়ে মনটা লুকিয়ে রেখেছে।

একটু পর বাবা বাসা থেকে বের হয়ে যায়।

যাওয়ার আগে মাকে বললো, “আমাদের ছেলেটা মাশাল্লাহ খুব সুন্দর হয়েছে না?”

মা আমার দিকে মমতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে।শত দুঃখেও তার মুখে কেমন

একটা মায়াবী হাসি। মাকেও এখন খুব মায়া লাগছিলো। মা তার পড়নের বেগুনী ওড়নাটা দিয়ে আমার মুখ মুছিয়ে বললো, “সারাদিন ঘামিস কেন এত? কালো হয়ে যাবি তো! যা ফ্যানের নিচে গিয়ে শুয়ে থাক”।

ইফতারীর ঠিক আগ মুহূর্তে আমি বুঝতে পারলাম, আজকে ইফতারী নেই।অথচ আজকেই বেশি রোজায় ধরেছে।আযান যখন দিলো আমি মার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম, “মা একটা পিয়াজু দিবা?আর কিছু লাগবেনা”।

মা আমার দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে বললো, “একটু অপেক্ষা কর। ভাত

রান্না হয়ে যাবে একটু পর”।

তখন হঠাৎ করে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো।আমি মার হাত ধরে টেনে এনে আপুর রুমে বসালাম। আপুকে বললাম, “আপু আমার জন্য না একটা কেক আনছো, ওইট্যা দাও”।

আপু মন খারাপ করে বললো, “বাবা আসলে ভাবছিলাম বের করবো। বাবা তোকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতো”।

আমি বললাম, “সমস্যা নাই।বাবার জন্য আমি এক কামড় রেখে দিবো। তুমি কেকটা দাও”।

আপু চার ইঞ্চির কেকটা একটা কাগজের প্যাকেট থেকে বের করলো।

আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “এটা সুন্দর করে খেয়ে নে।আজকে এইটাই তোর ইফতারী”।

আমি কেকটা এক কামড় দিয়ে আম্মুর

হাতে দিয়ে বললাম, “এখন তুমি এইখান

থেকে একটা কামড় দাও, তারপর আপুকে এক কামড় দাও।আমার পেট ভরে গেছে”।

মা চুপ করে কেকটা হাতে নিয়ে বসে পড়লো। তারপর আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কি ভয়ংকর কান্না। আপুও মাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে থাকলো।

আমারও তখন কান্না পাচ্ছিলো খুব। মা হাত তুলে বললো, “হে খোদা এই রোজার মাসে কত মানুষ খাবার নষ্ট করে, আধা খেয়ে ফেলে দেয়।আমার বাচ্চাগুলো কি দোষ করছিলো যে আজকে ওদের সামান্য ইফতারীটাও

খেতে দিতে পারিনা। তারপরও তোমার কাছে হাত তুললাম, ওদের রোজা তুমি কবুল করো। এই অসহায় বাচ্চাগুলোর

সেহরী না খেতে পাওয়ার অপরাধ, ইফতারী না খেতে পাওয়ার অপরাধ তুমি ক্ষমা করো”।

আমিও কিছু না বুঝে হাত তুললাম। সেদিন সেক্ষণে আমাদের দুই কামরার

জরাজীর্ণ আধাপাকা বাসার ভেতর খোদার রহমত হয়তো আসেনি।

সেদিনটা আমাদের জন্য খুব ভয়ংকর একটা দিন ছিলো।কারণ, ইফতারীর ঠিক এক ঘন্টা পর পাশের বাসার মকবুল চাচা আমাদের খবর দিয়ে যায়, আমার বাবা হারিয়ে গেছেন।

রাস্তায় বাবার রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিলাম।

তার নিষ্প্রাণ হাতে তখন একটা ফেবার ক্যাসেলের রংপেন্সিল বাক্স যার অর্ধেকটা দুমড়িয়ে গেছে।

আমি বাবার পাশে বসে বাবার মাথায় বারবার হাত বুলিয়ে বলছিলাম, “আম্মু বাবার কি হয়েছে?

এত রক্ত কেন? বাবা কি মারা গেছে? বাবা নাই? বাবা নাই?”

মা কোন কথা বলেনি সেদিন।

এর পরেও বলেনি।

কোনদিন বলেনি।

মা নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন।

চিরতরে হারিয়ে ফেলেছিলেন।

এর অনেক বছর পর আরেকটা রমজান এলো। আমি তখন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র, চোখে একটা বিশাল চশমা লাগিয়ে ঘুরি।

আপু পাচ বছর আগে এম.বি.বি.এস পাশ করে বছর তিন হলো বিয়ে করেছে। আপুর একটা ছোট্ট বাবুও আছে।

ওর নামটা আমার দেয়া – মিতু।

নাম দেয়ার সময় আপু খুব রাগ করে আমাকে বলেছিলো, “এমন কমন একটা নাম দিলি? শুনেই মনে হয় এই মেয়ে কলেজে উঠে এক ধড়িবাজ ছেলের হাতে ছ্যাকা খেয়ে গলা ধরে কাদবে”।

আজকে মিতুর দ্বিতীয় জন্মদিন।আপু ঠিক করেছে ইফতারীর পর মিতুর জন্য কেক কাটবে। আমি নিজেই কেক কিনে আনার উদ্যোগ নিয়েছি।

মিতু আমার কোলে উঠে বললো, “মামানী, কেক খাবোনা”।

আমি ওকে আদর করে বলি, “কেনরে মা, কেক খাবিনা কেন?”

ও কপাল কুচকিয়ে বলে, “কেক মজা না। কোকা কোকা খাবো”।

মিতু সবকিছুকে খুব অদ্ভুত নামে ডাকে। ওর নানুকে ডাকে নানীমা, আমাকে মামানী আর আপুকে মিমি।

দুলাভাইকে ডাকে সবচেয়ে অদ্ভুত ভাষায় – ডাব্বু।

কেন এমন অদ্ভুত ভাষায় ডাকে তার রহস্য আমরা জানিনা।ওর প্রিয় খাবার বা পানীয় কোকা কোকা যাকে আমরা কোকা কোলা বলে থাকি। ইফতারীর পর যখন কেক কাটা হবে তখন আমাদের সবার চোখ ভরা পানি। মা চুপ করে বসে ছিলো বিছানায়। আমি আর আপু মিতুকে কেক কেটে খাইয়ে দেয়ার পর একটা চার ইঞ্চির কেকের

টুকরো কাটলাম।

তারপর আপু আমাকে চোখ মুছতে মুছতে কেক খাইয়ে দিলো এক কামড়।

তারপর মাকে এক কামড়

খাইয়ে নিজে এক কামড় খেলো।

আমি আমার চশমা খুলে ভেজা চোখটা মুছে আপুকে বললাম, “তোর মনে আছে আমারও এমন জন্মদিন ছিলো। আপু তুই আমার জন্য রিকশা ভাড়া বাচিয়ে একটা পেস্ট্রি কেক নিয়ে আসছিলি, মনে আছে?”

আপু মাথা নাড়ে, মুখে কিছু বলেনা।

আমি আপুর দিকে তাকিয়ে বলি, “বাবা যদি দেখে যেতে পারতো তার দুই বাচ্চা এখন ভরপেট ইফতারী করে, সেহেরী করে খুব খুশি হতো তাই না? বাবার

জন্য জানিস আমার প্রতি জন্মদিনে আলাদা করে একটা কেক রেখে দেই”।

আমি আর আপু মার পাশে যেয়ে বসি। মা নির্বাক হয়ে আমাদের দিকে চেয়ে থাকে, আজও কারো সাথেই কথা বলেন না। আমরা দুইজনই একসময় মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কাদতে থাকি। আমি নিশ্চিত বাবা তখন আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন দূর আকাশ থেকে।

হয়তো মনে মনে প্রার্থনা করেন, পরম করুণাময় যেন আমাদের এই প্রচন্ড দুঃখী আত্নাগুলোর মনটাকে শক্ত করার

সামর্থ্য দেন, তার করুণার পবিত্র

জলে আমাদেরকে সিক্ত করেন।



লিখা : হাসানুল ফেরদৌস সাদিদ

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৩৭

নীল জোসনা বলেছেন: কি লিখবো কথা খুজে পাচ্ছিনা ।তবে বুকের মাঝখান টায় খুব কষ্ট হচ্ছে ।

২| ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৪:৪৯

ফুসকা বলেছেন: ভালবাসার অনুভূতি গুলো এমন তাই হয় !!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.