![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলাদেশি কিছু পণ্যে দেওয়া অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা বা জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস সংক্ষেপে জিএসপি স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই খবরটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৭ জুন বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এই খবরে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জনগণের জন্য খবরটি থমকে যাওয়ার মতো। কারণ শরীরের রঙের মিল থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতি বাংলাদেশি জনগণের সমর্থন আকাশচুম্বি। বাংলাদেশের মানুষ ওবামাকে নিজেদের লোক বলেই মনে করে। ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য আইন অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা দিতে যে জিএসপি প্রথা চালু হয়, তার সুবিধা ১৯৭৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পেয়ে আসছিল বাংলাদেশ। ১৯৭৬ থেকে ২০১৩ এই ৩৭ বছরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন অনেকে। রোনাল্ড রিগ্যান, সিনিয়র বুশ, জুনিয়র বুশ, ক্লিনটনের মতো শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্টরা যেখানে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের চিন্তাও করেননি সেখানে ওবামা একটি বিবৃতি ও এক কলমের খোঁচায় বাংলাদেশের জনগণকে চরমভাবে বঞ্চিত করলেন এবং নিক্ষেপ করলেন এক চরম অন্ধকারে।
বাংলাদেশের জনগণকে ভাগ্য বিড়ম্বিত করার জন্য ওবামা আশ্রয় নিয়েছেন একটি অজুহাতের। অজুহাতটি হল, বাংলাদেশি কারখানাসমূহে নাকি শ্রমমান উন্নয়নের অভাব রয়েছে। যদি ধরে নেওয়া হয়, শ্রমমান উন্নয়নের আসলেই অভাব রয়েছে, তাহলে প্রশ্ন ওঠে এই অভাব কি ২০১৩ সালের ২৭ জুন এসে হঠাৎ করে সৃষ্টি হল। ‘কারখানার শ্রমমান উন্নয়ন’ যদি অজুহাত হয়ে থাকে তাহলে এ কারণে তো ২০০৬, ২০০৭ কিংবা ২০০৮ সালেই বাংলাদেশের জন্য জিএসপি বাতিল হয়ে যাওয়া উচিত। কারণ ওই সময়ে যেখানে বাংলাদেশের একজন শ্রমিক মজুরি পেত মাসে দেড় হাজার টাকা সেখানে ২০১৩ সালে পায় তার অন্তত আড়াই গুণ বেশি মজুরি।
এই হিসাবে বলা চলে, শ্রমমান উন্নয়নের অজুহাত ওবামা প্রশাসনের একটি খোড়া অজুহাত। তাহলে প্রশ্ন ওঠে আসল অজুহাত কোনটি? অনেকের মতে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের পেছনে কাজ করেছে রাজনীতি। এই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আছে টিকফা চুক্তি না করা, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশে বাধা, গার্মেন্ট শ্রমিক আমিনুল হত্যাকা-ের বিচার ইস্যু, জিএসপি বাতিলে খালেদা জিয়ার অনুরোধ সম্বলিত ওয়াশিংটন টাইমসে প্রকাশিত প্রবন্ধ এবং সর্বোপরি ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যু। অনেকের মতে টিকফাও নয়, রোহিঙ্গা-আমিনুলও নয়, বাংলাদেশের জিএসপি বাতিলের পেছনে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে ইউনূস ইস্যু।
অনেকেরই জানার কথা, ২৮ জুন ড. ইউনূসের জন্মদিন। বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে দিনটি ‘সামাজিক ব্যবসা’ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সেদিন ড. ইউনূস দেশি-বিদেশি অতিথিদের সামনে তাঁর সামাজিক ব্যবসার কনসেপ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। এবারের ২৮ জুনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হোটেল রেডিসনের কনভেনশন সেন্টারে ড. ইউনূস বেশ ফুরফুরে মেজাজে তাঁর সামাজিক ব্যবসা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার গল্প অতিথিদের সঙ্গে বিনিময় করেন। সেই অতিথিদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ড্যান ডাব্লিও মজিনা। মজিনাও ছিলেন সেদিন খোশমেজাজে। তাঁর মেজাজ ভালো থাকার পেছনে কারণ ছিল, তিনি বেশ কিছু দিন ধরে সতর্ক করে আসছিলেন, বাংলাদেশের গার্মেন্ট কারখানাসমূহে শ্রমিকদের শ্রমমানের উন্নতি না ঘটলে জিএসপি বাতিল হয়ে যেতে পারে। মজিনার প্রেসিডেন্ট ওবামা জিএসপি বাতিল করলে বাংলাদেশে অবস্থানকারীদের মধ্যে খুব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি খুশি হন তিনিই। ড. মুহাম্মদ ইউনূস জিএসপি স্থগিতে খুশি হয়েছেন কীনা জানা না গেলেও ওবামা ও মজিনা যে প্রবল খুশি হয়েছেন তা বোঝা যায় ইউনূসের জন্মদিনের ঘন্টা কয়েক আগে বাংলাদেশ সরকারকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য জিএসপি সুবিধা বাতিল করার মধ্য দিয়ে। অনেকের মতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ৭৭তম জন্মদিনের উপহার বারাক ওবামা প্রদান করেন বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে।
আমিনুল হত্যাকা- নয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যুতেই যে জিএসপি বাতিল হবে এমন আশঙ্কা বাংলাদেশের ব্যবসায়ী মহলে অনেকদিন ধরেই আলোচনায় ছিল। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা অবশ্য জিএসপির বদলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত সুবিধা আদায়কেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ, জিএসপির আওতায় বছরে বাংলাদেশের যে পরিমাণ রপ্তানি হয়ে থাকে তা খুব বেশি নয়। এর চেয়ে বরং বাংলাদেশি পোশাক শিল্প যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করার জন্য সে দেশের সরকারকে বেশি হারে শুল্ক দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা গত বছর জিএসপির আওতায় ৩ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের তামাক, ক্রীড়া সরঞ্জাম, সিরামিকস, চশমা ও প্লাস্টিক সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে। এতে ব্যবসায়ীরা শুল্ক ছাড় পেয়েছে ২০ লাখ ডলার। অপরদিকে ৪৯০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে শুল্ক দিয়েছে ৭৩ কোটি ডলার। এইখানে যুক্তরাষ্ট্র নিরব। ২০ লাখ ডলার শুল্ক ছাড় দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেন বাংলাদেশের মুরুব্বী বনে গেছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে ৭৩ কোটি ডলার শুল্ক দিয়েও যেন মহা অপরাধ করে বসে আছে।
এ কথা সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জিএসপি বাতিলের প্রভাব কী হবে তা নিয়ে বড় ধরনের শঙ্কার কারণ না থাকলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষুণœ করেছে। শীর্ষ আমদানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা বাতিল করায় অন্যান্য আমদানিকারক দেশগুলোও বাংলাদেশের পণ্যের ব্যাপারে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র সরকারও অন্যান্য দেশকে চাপ প্রয়োগ করতে পারে। এই প্রয়োগ যে যুক্তরাষ্ট্র ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে খুশি করার জন্য করবেই তা হলফ করেই বলা যায়। আর এই একজন ব্যক্তিকে খুশি করার জন্য বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রপ্তানি বাজার যে হুমকিতে পড়বে তাও নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
ড. ইউনূসকে খুশি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এতো কিছু করছে, এতে বাংলাদেশের আসলে করার কিছু নেই বা বাংলাদেশ কীইÑবা করতে পারে; এমন মনোভাব নিয়ে বাংলাদেশের বসে থাকা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র যে কারণ দেখিয়ে জিএসপি বাতিল করেছে, বাংলাদেশের উচিত সে কারণগুলোর প্রতিকার করা। অবশ্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার শ্রমিকদের মজুরি আরো বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। গার্মেন্টসহ অন্যান্য কারখানার পরিবেশ উন্নয়নে সরকার ও গার্মেন্ট মালিকরা কাজ করছে। সরকার শ্রম আইন সংশোধন করছে। বলতে দ্বিধা নেই, সরকার এ পর্যন্ত কারখানার শ্রমমান উন্নয়নে যতগুলো কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে তার প্রচার দেশেও নেই, বিদেশেও নেই। এর বিপরীতে আছে অপপ্রচার। এখন সময় এসেছে, কারখানার শ্রমমান উন্নয়নে সরকার যেসব ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে, বহির্বিশ্বে তার প্রচার অনিবার্য হয়ে পড়েছে। দুঃখের বিষয় এই অনিবার্য কাজটিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগের চরম অলসতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই অলসতা পরিহার না করলে বাংলাদেশের জন্য তা আগামীতে আরো বড় ধরনের ‘বিপদ’ ডেকে আনতে পারে।
যুক্তরাষ্টের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি স্থগিত করার বিষয়ে দুর্ভাগ্যজনক অবস্থাটি সম্পর্কে জানতে পেরেছে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশেরই কিছু মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যাপারে প্রচারণা চালিয়ে আসছিল।’
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর জিএসপি স্থগিত বিষয়ে দুই দেশের কিছু মানুষের প্রচারণাকে দায়ী করেছে। বাংলাদেশ থেকে এই নেতিবাচক প্রচারণার বীজ রোপিত হয় এ বছরের ৩০ জানুয়ারি। ওই দিন মার্কিন দৈনিক দ্য ওয়াশিংটন টাইমসে বাংলাদেশের বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়ার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি সুবিধা স্থগিতের পর খালেদা জিয়ার নামে প্রকাশিত নিবন্ধটি নতুন করে আলোচনায় আসে।
বিরোধীদলীয় নেতা ওই নিবন্ধ লেখার কথা অস্বীকারের পর এ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের প্রেক্ষাপটে এর সত্যতা যাচাইয়ে বাংলাদেশের অনলাইন গণমাধ্যম বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে ওয়াশিংটন টাইমস তাদের অবস্থান জানায়।
বিডিনিউজের ই-মেইলের উত্তরে ওয়াশিংটন টাইমসের নির্বাহী সম্পাদক ডেভিড এস জ্যাকসন জানান, এজেন্টের মাধ্যমে পাঠানো নিবন্ধটি যে খালেদা জিয়ার তা নিশ্চিত হওয়ার পরই তা ছাপায় ওয়াশিংটন টাইমস। এ বিষয়ে জ্যাকসন আরো বলেন, ‘ওই নিবন্ধটি ওয়াশিংটন টাইমসের কাছে আসে মার্ক পার্সির মাধ্যমে। লন্ডনভিত্তিক এই মধ্যস্থতাকারী খালেদা জিয়ার পক্ষে কাজ করেন। নিবন্ধটি প্রকাশের আগে এবং পরেও আমরা তার সঙ্গে (মার্ক পার্সি) যোগাযোগ রক্ষা করেছি। আমরা এর নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে নিঃসন্দেহ।’ উল্লেখ্য, মার্ক পার্সি লন্ডনের জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান (পিআর ফার্ম) বিটিপির অন্যতম অংশীদার, যারা বিভিন্ন দেশের হয়েও কাজ করেন।
ওই নিবন্ধে জিএসপি সুবিধা বাতিলের জন্য সরাসরি আহ্বান জানানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। অথচ জিএসপি সুবিধা স্থগিতের পর সংসদে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বলা হয়েছে, আমি নাকি চিঠি দিয়ে এই সুবিধা বন্ধ করেছি। কিন্তু আমি কোনো চিঠি পাঠাইনি।’
বিরোধীদলীয় নেতার এই বক্তব্যের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে থাকা ওয়াশিংটন টাইমসে ছাপা ওই নিবন্ধের অনুলিপি তুলে ধরলে খালেদা জিয়া বলেন, ‘এটা আমার নয়। এমন কোনো লেখা আমি পাঠাইনি।’
ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকার ৩০ জানুয়ারি সংখ্যায় ‘এ থ্যাংকলেস রোল ইন সেইভিং ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক যে মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় তাতে লেখার নিচে লেখকের পরিচয়ের স্থানে লেখা হয়, ‘বেগম খালেদা জিয়া ইজ ফরমার প্রাইম মিনিস্টার অব বাংলাদেশ অ্যান্ড কারেন্ট লিডার অব দ্য অপজিশন।’
পাদটিকায় লেখিকার পরিচয়ের কারণে বিশ্বব্যাপী পাঠকেরা এই লেখাটি ব্যক্তি খালেদা জিয়ার একান্ত মতামতের পরিবর্তে বরং বাংলাদেশের রাজনীতির একটি ধারার প্রতিনিধি হিসেবেই দেখেন। সুতরাং এটি জানা জরুরি নয় যে, লেখাটি তিনি নিজেই লিখেছেন কি-না। কিন্তু যেটি জানা জরুরি তা হচ্ছে দেশের পত্রিকায় বাংলা ভাষায়ও লেখার তেমন ইতিহাস নেই যে খালেদা জিয়ার, সেই তারই নামে কীভাবে এবং কেনো হঠাৎ বিদেশি পত্রিকায় ইংরেজি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো। লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর এ নিয়ে দেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। দেশের অনেকেই খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচারের অধীনে আনার দাবিও করেন। সুতরাং লেখাটির রাজনৈতিক তাৎপর্য গভীর।
এগারোটি অনুচ্ছেদে মোট সাড়ে আটশ শব্দে লেখা তার মন্তব্য প্রতিবেদনে খালেদা জিয়া প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের প্রথম স্বীকৃতি দানকারী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে দাবি করে এক ধরনের হিস্টোরিসিজম গড়ে তোলার প্রয়াস পান।
দ্বিতীয়ত, সেই সুবাদে খালেদা জিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নালিশ করেন তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে। নালিশের অংশ হিসেবে খালেদা জিয়া তার নিবন্ধে আনেন পশ্চিমের স্নেহধন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাংলাদেশে নাস্তানাবুদ হওয়ার ঘটনা, পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির কাহিনী, বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিকাশমান অন্য শক্তির দিকে ঝোঁকার প্রবণতা। এর সাথে অভিযোগের রাজনৈতিক মাত্রা দেওয়ার জন্য খালেদা জিয়া আরও উল্লেখ করেন র্যাবের হাতে মানুষ খুন-গুম হওয়ার ঘটনা এবং স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের অনিয়ম প্রসঙ্গ।
তৃতীয়ত, খালেদা জিয়া অনুরোধ করেন যুক্তরাষ্ট্রকে শেখ হাসিনার সরকার তথা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের। সুস্পষ্টভাবে তিনি প্রস্তাব করেন, ‘ইট ইজ টাইম ফর দ্য ওয়ার্ল্ড, লিড বাই আমেরিকা, টু অ্যাক্ট অ্যান্ড এনসিউর দেট ডেমোক্রেসি ইজ সেভড ইন বাংলাদেশ।’ অর্থাৎ ‘এখন সময় এসেছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিশ্চিত করার জন্য তৎপর হওয়ার।’
খালেদা জিয়া ভালোভাবেই জানেন, ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার মিত্র ছিল না শত্রু ছিল। কিন্তু তারপরও, কেনো তিনি মিথ্যা নিবন্ধ লিখে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সাথে মার্কিন সম্পর্কের ইতিহাসকে বিকৃত করলেন? উত্তরটি নিশ্চয়ই খুব সরল নয়। যেভাবে দেখা হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করে ক্ষমতায় আসার জন্য খালেদা জিয়া এই লেখা লিখেছেন, সেটি খুবই সরলিত ব্যাখ্যা। যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করাই যদি খালেদা জিয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হবে, তাহলে নিবন্ধ লেখার পরিবর্তে কূটনৈতিক চ্যানেলে বোঝাপড়া করাই কি সমীচিন ছিল না? বুদ্ধিজীবী ও বিখ্যাত কলামিস্ট গাফফার চৌধুরী কি অতীতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দল বিএনপির নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টিকে মার্কিন পরিকল্পনার ফল বলে ব্যাখ্যা করেননি? তখন তো খালেদা জিয়ার নিবন্ধ লেখার প্রয়োজন হয়নি? তবে এবার কেনো হচ্ছে? শেখ হাসিনা কি তার আগে খালেদা জিয়ার ক্ষমতায় আসাকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গোপন বোঝাপড়ার ফল হিসেবে ইঙ্গিত করেননি? তিনি কি বারবার বলেননি, আগের বারে তাকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হয়নি দেশের শক্তি-সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে রাজি হননি বলে? বর্তমানে যে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন তার ব্যাখ্যা কি এটি হতে পারে না যে, খালেদা জিয়া যা দিতে পারে, শেখ হাসিনা তা পারবে না কেনো জেদের ভিত্তিতে?
এমন কি সম্ভব নয় যে, বিশ্বের সামরিক পরিস্থিতির যখন দ্রুত পরিবর্তন ও মেরুকরণ হচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র উপমহাদেশে তার অধুনা আঞ্চলিক মিত্র ভারতের ওপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারছে না বা চাইছে না?
সম্প্রতি রাশিয়ার সাথে ভারতের সামরিক লেনদেন এবং ভারত-মিত্র আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশকে রাশিয়ার সাথে সামরিক লেনদেনে জড়িত করার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুখের সংবাদ নয়। রাশিয়ায় গিয়ে শেখ হাসিনার অস্ত্র ক্রয় নিশ্চয়ই কোনো তাৎপর্যহীন ঘটনা নয়। মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যাংকের সাথে পদ্মা সেতু নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের টানাপড়েনও সম্পর্কহীন নয়।
স্বদেশের রাজনৈতিক কোন্দলে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ কামনা বাংলাদেশে নতুন নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয়ে নালিশ করে মার্কিন ও পশ্চিমা হস্তক্ষেপ কামনা করার উদাহরণ যদিও এটাই প্রথম নয়, তারপরও যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই এই সত্যটি বুঝে যে, ভারত বনাম মার্কিন অপশনের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা ভারতের প্রতিই বেশি বিশ্বস্ত থাকবেন।
বিশ্বজুড়ে একটা যুদ্ধের সম্ভাবনা যখন ক্রমশ বাড়ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র চাইতেই পারে মায়ানমার ও বাংলাদেশকে যতটা সম্ভব কোনো ভায়া-মিডিয়া ছাড়া একান্ত নিজের মতো করে রাখতে। এটি কি খুব অসম্ভব যে, যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বাংলাদেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপের একটি অনুরোধ দেশটির প্রধান রাজনৈতিক মহল থেকেই আসুক?
আর এটিও কি অসম্ভব যে, সে কাজটিই করিয়ে নেওয়া হচ্ছে খালেদা জিয়াকে দিয়ে ওয়াশিংটন টাইমসে লিখিয়ে। এই লেখার পেছনে নিশ্চয়ই খালেদা জিয়ার স্বার্থ আছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি স্বার্থ থাকতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা স্থগিতের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা হলেও এর বহু নজির রয়েছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে ১৩টি দেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল কিংবা স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসটিআর। তবে তার কোনোটিই স্থায়ী বাতিল বা নিষেধাজ্ঞা নয়। যেসব কারণে জিএসপি সুবিধা স্থগিত করা হয়, তা ঠিকঠাক মতো পরিপালন ও শর্তগুলো মেনে নেওয়া হলে পুনরায় জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জিএসপি সুবিধা বাতিলের তিক্ত অভিজ্ঞতা ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা এবং নাইজেরিয়ার মতো দেশের রয়েছে। এ তালিকায় নতুন যুক্ত হলো বাংলাদেশের নাম। যদিও স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা বরাবরই ডব্লিউটিও থেকে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সমর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা স্থগিতের জন্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ আনা হয়েছে তা হলো- রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চল, চিংড়ি চাষ এবং তৈরি পোশাক শিল্পে উপযুক্ত মজুরি দেওয়া হচ্ছে না। কাজের পরিবেশ নিরাপদ নয় এবং শ্রমিকরা অধিকার আদায়ে সংগঠিত হতে পারছে না।
ইতোপূর্বে এসব বিষয়ে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা এবং অগ্রগতি সম্পর্কে ইউএসটিআরকে লিখিত আকারে মতামত দিয়েছে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া বিজিএমইএ ও এফবিসিসিআই থেকেও মতামত তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে ৭৮তম। আর যুক্তরাষ্ট্রের ৫৭তম বাণিজ্যিক অংশীদার হচ্ছে বাংলাদেশ। দুদেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে বছরে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি করছে ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। যার বেশির ভাগই তৈরি পোশাক। কিন্তু তৈরি পোশাক রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ১৬ ভাগ শুল্ক দিতে হচ্ছে।
জিএসপি সুবিধা স্থগিত হওয়ার কারণে পোশাক শিল্পখাত সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও ভয়াবহ ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে এ খাতটি। বিশেষ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও কানাডা যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাহলে বড় ধরণের সংকটে পড়বে পোশাক শিল্পখাত। পোশাক শিল্পখাতে বিপর্যয় নেমে এলে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল জরুরি হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, যেহেতু ইউএসটিআর জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে তাই সরকারকে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। লড়াই করার স্কোপ রয়েছে। এক্ষেত্রে হোমওয়ার্ক বাড়ানো প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রকে কনভিন্স করাই আসলে মুখ্য বিষয়।
এ কথা এখন বলা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজার সুবিধা পাওয়াটা রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতার ওপর নয়, নির্ভর করে তাদের বাজারে প্রবেশের জন্য রাজনৈতিক সুবিধা দেওয়ার ওপর। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ আফ্রিকান এবং ক্যারিবিয়ান দেশসমূহ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা আদায়ে একেবারে প্রথম সারিতে থাকতে ব্যয়বহুল প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পখাত কখনোই জিএসপি সুবিধা পায়নি।
বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বাংলাদেশের পোশাক শিল্প কখনোই এর বাণিজ্যিক সুবিধা ভোগ করতে পারেনি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি পণ্যের ৯৯ দশমিক ৫০ শতাংশই শুল্ক দিয়ে প্রবেশ করে। আর এ কারণে গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক বাবদ ৭৪৬ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রকে সর্বাজ্ঞে এ বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশের শ্রমিকরা তাদের জন্য পণ্য তৈরি করে বলেই তারা বছরে শুল্ক পায় ৭৪৬ মিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা স্থগিতে সেই শ্রমিক শ্রেণীই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে যুক্তির ভিত্তিতে য্ক্তুরাষ্ট্র জিএসপি স্থগিত করেছে এই সিদ্ধান্তের ফলে শ্রমিকদের কোনো কল্যাণ হবে না। কল্যাণ হবে খালেদা-ইউনূসের।
যুক্তরাষ্ট্রকেই এখন প্রমাণ করতে হবে তারা আসলে বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণীর কল্যাণ চায় না খালেদা-ইউনূসের স্বার্থ বজায় রাখতে চায়।
©somewhere in net ltd.