![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মহাকাল নেমে এসোছিল বাংলায় উনিশশ’ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। মহাপ্রাণ সেদিনের পর থেকে আর কথা বলেননি। আরো একটি মহাপ্রাণ কথা বলেনি সেদিনের পর থেকে। বউ কথা কও পাখি ডেকে ডেকে এখনো আকুল হয়Ñ তবুও কথা বলেনি। সেই কবে কচিকালে তার বিয়ে হয়েছিল এক কিশোরের সঙ্গে। বালিকা বধূ বড় অবাক হয়েছিল। তার বিয়ের খবর সেও জানতে পারেনি। কিশোর বালক মজা করে বলতো, বউ কথা কও। বউ কথা বলতো না। স্বাধীনতা যুদ্ধের ন’মাসও তার কথা কেউ শোনেনি। যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে দেশে সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরেছিল। সেদিনও তিনি অঙ্গুলি সংকেতে বঙ্গবন্ধুকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। কথা বলেননি। তবে কথা তিনি বলতেন। শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পেছনে সেই মহীয়সী মহিলার মূল্যবান কথা ছিল। যেমন ছোট একটি উদাহরণ দেয়া যায়। আগরতলা মামলা চলাকালীন রব উঠেছিল বঙ্গবন্ধু নাকি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসে আপোস করবেন। গুজব হোক আর সত্য হোক তিনি লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছিলেন এই মর্মে যে, তিনি বঁটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন, যদি বঙ্গবন্ধু মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে আসেন।
আগস্ট মাসের পনের তারিখ আমরা যখন স্মরণ করি, তখন কেন কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করি? বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহধর্মিণীকে কেন স্মরণ করি না? আমার যতোদূর মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ক্যারিশমা নির্মিত হয়েছিল তার পারিবারিক পরিবেশের শর্তে। রাজনৈতিক পরিবেশ কখনই বঙ্গবন্ধুর অনুকূল ছিল না। তিনি বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করে নিজের রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু একদিনে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা সমাজতন্ত্রী হয়ে ওঠেননি। তার জীবনের শুরুতে ছিলেন মুসলিম লীগের একনিষ্ঠ কর্মী। কোলকাতাতেই তিনি উদারনৈতিক ও সমাজতন্ত্রী কিংবা সাম্যবাদী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক বিশ্বাস ছিল মুসলিম লীগের রাজনৈতিক আদর্শ। বর্ণবাদী হিন্দুদের দ্বারা গরিব হিন্দু-মুসলমানের নিগৃহীত হওয়ার দৃশ্যগুলো তার সারাজীবনই স্মরণে ছিল। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বের কথা। কিন্তু খুব বেশিদিন তিনি ভ্রান্ত বিশ্বাসের মধ্যে থাকেননি। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন প্রকৃত সমস্যা হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব নয়। প্রকৃত সমস্যা শ্রেণী বিভাজন। ধনী মাত্রেই অত্যাচারী। হিন্দু-মুসলিম বিভাজন বড় কথা নয়। গরিবরাই অত্যাচারিত। তিনি সেক্যুলার রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়লেন। তার রাজনৈতিক গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দী সেক্যুলার ছিলেন। তিনি মনেপ্রাণে আধুনিকও ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মুসলিম ঘরানার রাজনীতিকে কৌশল হিসেবে নিয়েছিলেন। শেখ মুজিবকে তিনি ইউরোপীয় সেক্যুলারিজমে দীক্ষাও দিয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর গণতান্ত্রিক ধারণা ছিল সেক্যুলার। কিন্তু মুসলিম লীগ ইসলামী গণতন্ত্রের প্রচারণায় মত্ত ছিল। ইসলামী গণতন্ত্র প্রকৃত অর্থে ধর্মীয় স্বৈরতন্ত্র। যে কারণে মওলানা ভাসানীও ইসলামী গণতন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন এবং মুসলিম লীগ ভেঙে আওয়ামী মুসলিম লীগ করে অনেকটা সেক্যুলার রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে আওয়ামী লীগ করে মুসলিম শব্দটিও বিসর্জন দিয়ে তারই ক্রমধারায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ন্যাপ করেছিলেন। ন্যাপ ছিল একেবারেই সেক্যুলার। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন তারা। সোহরাওয়ার্দী ভাসানী ছাড়াও আরো একজন বঙ্গবন্ধুকে তালিম দিয়েছিলেন। তিনি আবুল হাশিম। আবুল হাশিম মুসলিম লীগের ঘরানার হওয়ার সত্ত্বেও সেক্যুলার ছিলেন। তাকে কেউ কখনই গোঁড়া মুসলমান বলেনি। যদিও তিনি পীর পরিবারের। তার ছেলে বদরউদ্দীন ওমর সেক্যুলার রাজনীতিই করছেন। বঙ্গবন্ধুর সৌভাগ্য হয়েছিল এতো বড় বড় রাজনীতিবিদদের কাছে রাজনীতি শেখার। কিন্তু প্রকৃত সেক্যুলার হয়েছিলেন পারিবারিক কারণে। তার মা এবং সহধর্মিণী জীবনের প্রথম থেকেই সেক্যুলার ছিলেন। অনেকেই বলেন, বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহারিক জীবনে সেক্যুলার করার পেছনে তার সহধর্মিণীর ভূমিকা ছিল।
প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধুর পরিবারই ছিল ঐতিহ্যিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ। শেখ পরিবার আন্তরিকতার সঙ্গেই ধর্মচর্চা করতো। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে ধর্মান্ধতা ছিল না। বঙ্গবন্ধু তার কষ্টকর রাজনৈতিক জীবনে বহু হিন্দু-মুসলমান রাজনীতিবিদদের সাহচর্যে এসেছিলেন। তাদের অনেকের মধ্যেই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। অনেকেই প্রগতিশীল ছিলেন। কিন্তু জেল জীবনে তিনি যেসব হিন্দু রাজনীতিকের সাহচর্যে কষ্টকর জেল জীবন কাটিয়েছেন তারা সবাই সেক্যুলার ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত অর্থে সংশয়মুক্ত সেক্যুলার রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠার পেছনে ঐসব হিন্দু কিন্তু প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা ছিল।
জেল জীবনের পর তিনি যখন আওয়ামী লীগের সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন তখন আওয়ামী লীগ পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। একই সঙ্গে তিনি সমাজতন্ত্রীও হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রী হয়ে ওঠার জন্য যতো না কমিউনিস্ট পার্টির বইপত্রের অবদান ছিল তারচেয়েও বেশি ছিল দেশপ্রেম, দেশের গরিব মানুষের প্রতি ভালোবাসা। তিনি গণচীন ভ্রমণে গিয়ে দেখেছিলেন কতো অল্প সময়ে দরিদ্র চীনারা তাদের দারিদ্র্যমুক্তি ঘটিয়েছে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের দরিদ্র কৃষক-শ্রমিকদের দারিদ্র্যমুক্তি এই ব্যবস্থায় তিনি অসম্ভব মনে করেছিলেন। সমাজতন্ত্রই তার ধারণায় ছিল একমাত্র বিকল্প। কিন্তু দুই মহাগুরু সোহরাওয়ার্দী এবং ভাসানী সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। সোহরাওয়ার্দী একবার বলেছিলেন পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ সমাজতন্ত্র বোঝে না এবং সমাজতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়। গণতন্ত্র এই মুহূর্তে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করবে না সত্য, তবুও এখন গণতন্ত্রই চলুক। ভবিষ্যতে জনগণই ঠিক করে নেবে, তাদের জন্য কোনটা ভালো। সমাজতন্ত্র নাকি গণতন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর মনেও ঐ প্রকার ধারণাই ছিল। তিনিও ভাবতে শুরু করেছিলেন আগে গণতন্ত্র পরে সমাজতন্ত্র। বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার মূলনীতি তাতে গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র দুটিই সমান গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে অনেকেই তাকে হিন্দু-বিদ্বেষী হিসেবে উপস্থাপন করতে চান। যেটি তার বক্তব্যের মর্মসার উপলব্ধির ব্যর্থতার কারণেই হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবনে মুসলিম লীগের রাজনীতি করেছেন। মুসলিম লীগ ছিল ভারতীয় কংগ্রেসের বিপরীতে ভারতীয় মুসলিমদের রাজনৈতিক সংগঠন। সে সময়ে দুটি রাজনৈতিক দলই পরস্পরকে প্রতিপক্ষ মনে করতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ব্যক্তি জীবনে হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন না। ছাত্র জীবনেই তার অসংখ্য হিন্দু বন্ধু ছিল। বঙ্গবন্ধুর পরিবার সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে মুসলিম-হিন্দু পার্থক্য করতো না। হিন্দুদের অনুষ্ঠানাদিতে তার পরিবারের সবাই যেতো এবং আনন্দ অনুভব করতো। তিনি নিজেও পূজা-পার্বণে হিন্দুদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু মুসলিম লীগের কংগ্রেস বিরোধিতার কারণে রাজনৈতিকভাবে তিনি দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। কিন্তু দেশ ও সমাজের মুক্তির প্রশ্ন আসলো, তখন ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে শ্রেণীবৈষম্যকেই প্রাধান্য দিলেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ভালোভাবে পড়লে জানা যায় কিভাবে একজন মুসলিম লীগের একনিষ্ঠ কর্মী ধর্মাশ্রয় পরিত্যাগ করে সেক্যুলার হলেন এবং ধর্মের মোহ যে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে না তা সম্যক উপলব্ধি করলেন। অবশ্য তার এই উপলব্ধির পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচারও ভূমিকা রেখেছিল।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর উপরে অমানুষিক অত্যাচার করেছিল। তাকে বারংবার কারারুদ্ধ করে রেখেছিল। তিনি কারারুদ্ধ অবস্থায় পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে এতো দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেছিলেন যে, তার ছেলেমেয়েদের কাছেই অপরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে একবার তার আপাকে বলেছিলেন, আমি তোমার আব্বাকে আব্বা বলে ডাকবো? বঙ্গবন্ধুর পিতৃহৃদয় অব্যক্ত যন্ত্রণায় কেঁদে উঠেছিলেন সেদিন। এরকম হাজারটা যন্ত্রণায় দগ্ধ-বিদগ্ধ হয়ে তিনি সাধারণ মানুষ থেকে বিশেষ মানুষ হয়েছিল। বাংলাদেশে একটা প্রচলিত কথা আছেÑ পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা। বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলার ও নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। তিনি পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়েছিলেন। রক্তমাংসের সাধারণ মানুষ থেকে সোনার মানুষ হয়েছিলেন।
প্রতিবছর ১৫ আগস্টে আমরা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করি জাতির পিতা হিসেবে। সঙ্গে বেগম ফজিলাতুন্নেছাকেও স্মরণ করা উচিত একই মহিমায়। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিক হয়ে ওঠা, সেক্যুলার হয়ে সোনার মানুষে পরিণত হওয়ার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি সেই বেগম ফজিলাতুন্নেছার কথা হয়তো অনেকেই জানেন না। বঙ্গবন্ধুর একান্ত বন্ধু কেউই ছিলেন না। যাদের সঙ্গে তিনি ঔধার্যচিত্তে রাজনীতি করেছেন তারা সবাই ছিল কোনো না কোনো দিক দিয়ে তার প্রতিপক্ষ। যেমন খোন্দকার মুশতাকের কথাই ধরুন। সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন তিনি। সেই খোন্দকার মুশতাকই তাকে হত্যায় অংশ নিয়েছিল। কেবলমাত্র তার সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছাই তার প্রকৃত বন্ধু ছিলেন। রাজনৈতিক, পারিবারিকই শুধু নয়Ñ আদর্শেরও পক্ষের ছিলেন তিনি। তাদের দুজনের পারস্পরিক সম্পর্ক জানা থাকলে বোঝা যাবে কিভাবে একজন মাটির মানুষ খাঁটি সোনা হয়। কিভাবে তার ক্যারিশমা গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমাটিক লিডার হিসেবে গড়ে ওঠুক তা তার রাজনৈতিক বন্ধুরা চাননি, কিন্তু তার যোগ্য সহধর্মিণী একক নেতৃত্বের বিকাশ কামনা করেছিলেন।
আজ একই সঙ্গে দুজনার নাম উঠলে জাতি বিশেষ অনুপ্রেরণা পাবে। যারা শোক দিবসকে প্রতিজ্ঞা দিবসে পরিণত করতে চান তাদের উচিত হবে দুজনকে একত্রে উপস্থাপন করা। তাদের উভয়ের কর্মজীবনের মহিমান্বিত বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা। যিনি সেই কচিকালে বউ কথা কও বলে ডাকলেও কথা বলেননি, তার কথাই সবাইকে বলতে হবে।
©somewhere in net ltd.
১|
১৪ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ২:৩৫
খাটাস বলেছেন: নতুন কিছু তথ্য জানলাম। কৃতজ্ঞতা শেয়ারের জন্য।