নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মন্ত্রক

আমি আমার দেশের জন্যে

মন্ত্রক › বিস্তারিত পোস্টঃ

উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:১৬

ড. আতিউর রহমান: স্বাধীনতার পর চুয়াল্লিশটি বছর পার করেছে বাংলাদেশ। একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য এ সময়কাল খুব একটা কম নয়। বাস্তবে এই সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা আজ উন্নয়নের এক ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সচেষ্ট স্বাধীনতার ফলস্বরূপ হালের গতিময় অর্থনীতির বিশ্লেষণ ও আগামী দিনের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার গ্রহণের এখনই সময়।
স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের পেছনে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণ থেকে মুক্তি, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং আত্মনির্ভরশীলতার অঙ্গীকার। মূলত পাকিস্তানের দুই অংশের চরম আর্থসামাজিক বৈষম্যের কারণেই বেগবান হয়েছিল এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। তখনকার দেশপ্রেমিক অর্থনীতিবিদরাও ‘দুই অর্থনীতির’ চিত্র তুলে ধরেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সুদৃঢ় আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যেসব আন্দোলন দানা বাঁধে, সেগুলোর পেছনে সক্রিয় ভূমিকা ছিল বাঙালির অর্থনৈতিক বঞ্চনার অনুভূতির। পশ্চিম পাকিস্তানের এসব শোষণ-বঞ্চনা প্রতিরোধ করার লক্ষ্যেই ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেছিলেন বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের মূল কথাটিও ছিল সকল ধরনের শোষণ থেকে মুক্তি। শোষণ-বৈষম্য-বঞ্চনা পুঞ্জীভূত হয়ে ক্রমশ রূপ নেয় গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে, যার বহির্প্রকাশ ও সফল সমাপ্তি ঘটে একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের বৈধতা দেয় সত্তরের নির্বাচন। ওই নির্বাচনে বাঙালি নেতৃত্ব নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করার কারণে বিশ্বের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় হতে পেরেছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের পথচলা শুরু হয় আলো-আঁধারের মধ্য দিয়ে। আলোর দিকটি ছিল বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরাধীনতা থেকে মুক্তির অদম্য আকাঙ্ক্ষা। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের মাধ্যমে সেটি পূরণ হয়। আর আঁধারের দিকটি ছিল উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলাদেশকে একটি দারিদ্র্যপীড়িত ও ভঙ্গুর অর্থনীতির হাল ধরতে হয়। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলে। যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রথম কয়েকটি বছরে বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ, বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি অভাব-অনটনের দেশ হিসেবে। তখন দারিদ্র্যপীড়িত সাব-সাহারার কয়েকটি দেশের সঙ্গে উচ্চারিত হতো বাংলাদেশের নাম। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সত্তর দশকের বাংলাদেশকে বিদেশি সাহায্যনির্ভর ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তখন পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশকে উন্নয়নের পরীক্ষার মুখে পড়া এক অসহায় দেশ হিসেবে দেখেছেন।
দেশের অর্থনীতিকে সচল করতে বঙ্গবন্ধু যেসব সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করেন তা শেষ করার মতো যথেষ্ট সময় তিনি পাননি। তবে ওই উদ্যোগগুলো তিনি নিয়েছিলেন বলেই এতদিনে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি মজবুত পাটাতন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সাধারণ মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য স্পৃহা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছে অনেক দূর।
বাংলাদেশের অর্থনীতির গল্প এখন শুধু বাঙালির কাছেই নয়, সারা পৃথিবীতেই এক কৌতূহলের বিষয়। তারা জানতে চায়, কী এমন ঘটেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। যার ফলে বিশ্বমন্দার মধ্যেও দেশটি এক দশক ধরে গড়ে ছয় শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন জিডিপির ভিত্তিতে বিশ্বে ৪৫তম এবং ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে ৩৩তম স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এখন দুইশ’ বিলিয়ন ডলার বা ষোলো লক্ষ কোটি টাকার মতো। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ‘গ্যালপ’-এর মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে আশাবাদী জাতি এখন বাংলাদেশ এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিচারে আমাদের অবস্থান দ্বিতীয়। বিশ্ব আজ জানতে চায়, সামাজিক উন্নয়নের কী এমন ঘটেছে এখানে—যার ফলে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু একাত্তর বছর। এ ক্ষেত্রে আমরা ভারত ও পাকিস্তানকে চার-পাঁচ বছর পেছনে ফেলে দিয়েছি। শিশু মৃত্যুহার কমানোর ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ এরই মধ্যে জাতিসংঘ পুরস্কার অর্জন করেছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের মাতৃসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩০তম। এ ক্ষেত্রেও ভারত (১৪০তম) এবং পাকিস্তান (১৪৯তম) বাংলাদেশের পেছনে। সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জন চোখে পড়ার মতো।
১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে তত্কালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এই বাজেট প্রায় দুই লাখ পঁচানব্বই হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ১৯৭৩-৮০ সময়কালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে ৩.৮ শতাংশ। বর্তমানের বাংলাদেশ বিশ্বের হাতেগোনা তিন-চারটি দেশের একটি, যারা এক দশক ধরে গড়ে ছয় শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। এই মুহূর্তে সারাবিশ্বের প্রবৃদ্ধি যেখানে ৩.৫ শতাংশ, আইএমএফের আশঙ্কা তা ৩.৪ শতাংশের বেশি হবে না, সেখানে গত অর্থবছরে ৬.৫১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার আরও বেশি হবে বলে আমরা আশা করছি। আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসও সেরকমই। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা ‘ব্লুমবার্গ’ আভাস দিয়েছে, চলতি বছর প্রবৃদ্ধির হার অর্জনে বাংলাদেশের অবস্থান হবে বিশ্বে দ্বিতীয়। অবশ্য, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বিশ্বের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপরও এই অর্জন অনেকাংশেই নির্ভরশীল। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৪৭ শতাংশ, এখন তা মাত্র ৬.১৯ শতাংশ। এ হার আরও কমানোর জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি—উভয় সূচকের স্থিতিশীলতার বিচারেও দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অবস্থান প্রথম।
বাংলাদেশে রফতানি খাতে বিশাল রূপান্তর ঘটেছে। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল মাত্র ৩৮৩ মিলিয়ন ডলার। মূলত পাকিস্তান আমলে গড়ে ওঠা রফতানি নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ায় স্বাধীনতার পরপর রফতানি কমে গিয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের রফতানি একাশি গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১.২ বিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে বেড়েছে রফতানিপণ্যের সংখ্যাও। স্বাধীনতার পর রফতানি আয়ের সত্তর ভাগ ছিল পাটের দখলে। বর্তমানে মোট রফতানির ৮২ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতের দখলে। তৈরি পোশাকে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। চল্লিশ লাখের বেশি শ্রমজীবী এ খাতের পেশায় নিয়োজিত রয়েছে—যার আশিভাগই নারী শ্রমিক। আশেপাশের দেশে যখন রফতানি বৃদ্ধির হার নেতিবাচক তখন আমরা আশা করছি এ বছর রফতানি বাড়বে অন্তত আট শতাংশ। আশার কথা, নতুন নতুন দেশ আমাদের তৈরি পোশাকের আমদানিকারক দেশ হিসেবে যুক্ত হচ্ছে। একইভাবে বেড়েছে আমদানি ব্যয়ও।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির অন্যতম ভরসা হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতার পরপর বিশ্ব শ্রমবাজারে আমাদের কর্মীর সংখ্যা ছিল একেবারেই নগণ্য। তখন রেমিট্যান্স আসত মাত্র আট মিলিয়ন ডলার। স্বাধীনতা যেন আমাদের জন্য বিশ্বের কর্মদুয়ার খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ আজ ছড়িয়ে পড়েছে দেশান্তরে। এ দেশের প্রতিটি গ্রামের কিছু না কিছু মানুষ এখন বিদেশে কাজ করছেন। হালে নারী কর্মীরাও ব্যাপকহারে বিদেশে যাচ্ছেন। বর্তমানে বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশে কর্মরত প্রায় এক কোটি প্রবাসী বছরে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন পনের বিলিয়ন ডলারের বেশি। রেমিট্যান্স আহরণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সপ্তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয়। বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে দেশের সাত মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। বৈদেশিক অর্থনৈতিক খাতের এই শক্তির জোরেই আমরা আটাশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছি। এই আশা মনে রেখেই বেশ কিছু অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনসহ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্রিয় রয়েছি।
রেমিট্যান্স আকারে যে অর্থ আসছে তা কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নে ব্যয় হচ্ছে। এরই মধ্যে কৃষিতে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। কৃষিব্যবস্থা আধুনিকায়ন হয়েছে। আশানুরূপভাবে বেড়েছে খাদ্যশস্য উত্পাদন। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে খাদ্যশস্য উত্পাদিত হয়েছিল প্রায় এক লাখ টন। তখন সাত কোটি মানুষের খাদ্যের জন্য বিদেশে হাত পাততে হতো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে। এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। বর্তমানে তিন কোটি চুরাশি লাখ টন খাদ্য উত্পাদন হচ্ছে। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নয়, বরং বাংলাদেশের ওই ঝুড়ি এখন খাদ্য ও বিদেশি মুদ্রায় পরিপূর্ণ হয়ে উপচে পড়ছে। সিডর, আইলা, মহাসেনের মতো দুর্যোগ মোকাবেলা করে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। দুর্যোগ প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ বিশ্বে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। দেশের জনসংখ্যা বেড়ে ষোলো কোটি হয়েছে এবং চাষযোগ্য জমির পরিমাণ অনেক কমেছে। তবুও উত্পাদিত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে প্রথমবারের মতো চাল রফতানির সাহস দেখিয়েছে আয়তনে বিশ্বে ৯৪তম আর জনসংখ্যায় সপ্তম বৃহত্তম আমাদের এই বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পর আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার। এখন তা দশ গুণের বেশি বেড়ে হয়েছে ১৩১৪ ডলার। প্রকৃত মজুরির হার সর্বত্র বেড়েছে। দুই দশক আগেও যে শ্রমিকের দৈনিক আয় একশ’ টাকার নিচে ছিল, তার দৈনিক আয় এখন চারশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকা। সংসারের খরচ মিটিয়ে এখন কিছু না কিছু এদের হাতে থাকে। সেই উদ্বৃত্ত দিয়ে দেশে তৈরি নানা শিল্পপণ্য তারা কিনতে পারছেন। এভাবেই দেশের ভেতরেই একটি শক্তিশালী চাহিদা কাঠামো তৈরি হয়েছে। আর এ কারণেই আমরা অনেক দেশের চেয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিশ্বমন্দা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের এই অভ্যন্তরীণ চাহিদা হতে পারে রফতানির পাশাপাশি আরেকটি ‘গ্রোথ ইঞ্জিন’। এই ইঞ্জিনটিকে আরও শক্তিশালী করার দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। এই দুই ইঞ্জিনের জোরেই আমরা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অনেক দূর নিয়ে যেতে চাই।
দেশের আর্থিক খাতও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও রেসিলিয়েন্ট। এ খাতের সূচকগুলোও দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মাত্র ছয়টি ব্যাংক ছিল। বর্তমানে সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি মিলে মোট ব্যাংক রয়েছে ৫৬টি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ৩২টি। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মোট শাখা বর্তমানে সাড়ে ৯ হাজার, যার বেশিরভাগই পল্লী শাখা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং ও এনজিও লিঙ্কেজ ব্যবস্থা। এ যাবত্ তিন কোটির বেশি মানুষ মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলেছে। নিমেষেই অর্থ লেনদেনের এই ব্যবস্থা সারাদেশের ব্যাংকিং বহির্ভূত জনগোষ্ঠীর জীবনে এক নয়া আশার আলো প্রদান করে চলেছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দৈনিক প্রায় পাঁচশ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে, যার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শহরের টাকা গ্রামে স্থানান্তর হচ্ছে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অভাবনীয় পুনর্জাগরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে সাড়ে সাত কোটির বেশি আমানতকারী ও প্রায় এক কোটি ঋণগ্রহীতা রয়েছে।
আমাদের আর্থিক খাতের আকার এখন দেড়শ’ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ব্যাংকের মূলধন ভিত্তিও শক্তিশালী হয়েছে। মূলধন পর্যাপ্ততার হার এখন ১০.৫৩ শতাংশ, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ৮ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। শ্রেণিকৃত ঋণের হার কমে হয়েছে ৯.৬৭ শতাংশ। আন্তঃব্যাংক কলমানি সুদহার বছর শেষে ছিল ৩.৫ শতাংশ—যা ব্যাংকিং খাতে পর্যাপ্ত তারল্য ও স্থিতিশীল মুদ্রাবাজারের পরিচায়ক। আমানত ও ঋণের সুদহার কমছে। এ দুটি সুদহারের ব্যবধান বা স্প্রেড বর্তমানে ৪.৮১ শতাংশ। তবে এই স্প্রেড আরও কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় নজরদারি ও নৈতিক চাপ অব্যাহত রয়েছে। সুদের হার প্রতিনিয়ত কমে আসছে। সম্প্রতি ঘোষিত মুদ্রানীতিতে আমরা নীতি সুদহারগুলো (রেপো ও রিভার্স রেপো) ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়েছি, যা সুদের হার আরও কমাতে সহায়তা করবে বলে আশা করছি।
আর্থসামাজিক অবস্থার এসব ইতিবাচক সূচকই প্রমাণ করে ‘বিস্ময়কর অগ্রগতি’ হয়েছে বাংলাদেশের। বর্তমানে অর্থনীতি ও আর্থিক খাতে যে গতি এসেছে তাকে যদি আরও বেগবান করার জন্য ব্যাংকিং খাতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারি, তাহলে সহজেই আমরা আজকের দুইশ’ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিকে আগামী দশ বছরের মধ্যে পাঁচশ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে পারব বলে আমাদের বিশ্বাস। সেজন্য জাতীয় সঞ্চয়ের হার আরও বাড়াতে হবে এবং সেই সঞ্চয়কে উত্পাদনশীল খাতে বেশি করে বিনিয়োগ করতে হবে। বিনিয়োগের সময় ধনবানদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জন্যও বাড়তি বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর বিনিয়োগযোগ্য অর্থ রয়েছে। অন্যদিকে, সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বিরাজ করছে। পুরো সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে এখন শান্তি ও স্বস্তির সুবাতাস বইছে। ফলে উত্পাদনশীল খাতে বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধি এখন সময়ের ব্যাপার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের এই বলিষ্ঠ ধারা সামনের দিনগুলোতে আরও বেগবান হবে। আর এ লক্ষ্যে কাজ করতে পারলে নিশ্চয়ই অচিরেই বাংলাদেশ সাত-আট শতাংশের প্রবৃদ্ধির জোনে প্রবেশ করতে পারবে। আমাদের প্রবৃদ্ধির এই প্রত্যাশার জন্য যে ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক কৌশল আমরা গ্রহণ করেছি তা অব্যাহত রাখতে হবে।
স্বাধীনতার পরের ভঙ্গুর অবকাঠামোর বাংলাদেশের প্রধান সড়কগুলো এখন চার লেনে উন্নীত হওয়ার পথে। বিশ্বমানের দামি বাস চলছে এসব মহাসড়কে। নান্দনিক হাতিরঝিল প্রকল্পসহ ঢাকা-চট্টগ্রামে ছয়-সাতটি উড়াল সেতু নির্মিত হয়েছে। সেইসঙ্গে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেলের মতো চোখ ধাঁধানো বড় বড় প্রকল্প বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নকে এক নয়া উচ্চতায় নিয়ে যাবে। যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মিত হয়েছে, যার কারণে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ও চট্টগ্রামের সংযোগ বেড়েছে। ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে এখানকার অর্থনীতিতে। উত্তরাঞ্চলে অতিদারিদ্র্যের মাত্রা কমেছে। ‘মঙ্গা’ এখন উত্তরাঞ্চল থেকে নির্বাসিত হয়ে দক্ষিণাঞ্চলে হানা দিতে শুরু করেছে। স্ব-অর্থায়নে পদ্মা সেতুটি নির্মিত হয়ে গেলে এবং একই সঙ্গে উপকূলীয় এলাকায় কাঙ্ক্ষিত অবকাঠামো গড়ে তোলা গেলে দক্ষিণের দারিদ্র্যও কমে আসবে। এ সেতু দক্ষিণ বাংলার মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটাবে। সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প বাড়বে। মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সেখান থেকে দারিদ্র্যও দূর হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। এই সেতু জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে এক শতাংশের ওপর অবদান রাখবে বলে প্রত্যাশা করছি।
বিদ্যুত্ উত্পাদনে এসেছে অভূতপূর্ব সাফল্য। বর্তমানে বারো হাজার মেগাওয়াট উত্পাদন হচ্ছে। প্রায় পঁচাত্তর ভাগ মানুষ বিদ্যুত্ সুবিধা পাচ্ছে। অচিরেই ঘরে ঘরে বিদ্যুত্ পৌঁছে যাবে। সোলারসহ রিনিউয়েবল জ্বালানি উত্পাদনে এবং অর্থায়নে বাংলাদেশের সাফল্য এরই মধ্যে বিশ্বের নজর কেড়েছে। এক লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর ও পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণের। সমুদ্র বিজয়ে এক লাখের বেশি বর্গকিলোমিটারের বিশাল এলাকায় দেশের নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সমুদ্রসম্পদ আহরণের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তাকে কাজে লাগাতে হবে। সারাদেশে একশ’টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আমি মনে করি। অচিরেই প্রধানমন্ত্রী দশটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের শুভ উদ্বোধন করবেন।
যে পাকিস্তান থেকে আমরা আলাদা হয়েছি, সেই পাকিস্তান এখন অর্থনীতির প্রায় সব ক্ষেত্রেই আমাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। এককালের নেতিবাচক ধারণা পোষণকারী বিদেশি পর্যবেক্ষকরা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে এখন বাংলাদেশকে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। কেউবা তাকে রোল মডেলও বলছেন। নামকরা সব বিশ্ব গণমাধ্যমের চোখে হালের বাংলাদেশের বিস্ময়কর অগ্রগতির ভঙ্গিটি প্রতিনিয়তই ধরা পড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণায় এখনও বাংলাদেশ উন্নয়নের পরীক্ষাগার, তবে ইতিবাচক অর্থে। বাংলাদেশের সঙ্গে কিছু দেশ আরও ভালো করছে। শুধু দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলেই বাংলাদেশ সমমানের অন্য দেশগুলোকে পেছনে ফেলে এগুতে পারবে-এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে সুস্থিতি ও সহনশীলতা নিশ্চিত হলে আমরা নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধির দৌড়ে প্রথম সারিতেই থাকব বলে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা করছি।
উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে এগিয়ে চলেছে অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশ। সকল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আর তাহলেই প্রশস্ত ও মসৃণ হবে লাখো শহিদের স্বপ্নমাখা ও জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ অর্জনের পথ।

লেখক : গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক - See more at: Click This Link

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.