![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের ‘পথে’ অগ্রসর হয়েছিল, সেই পথে ‘উত্তরণে’ ‘পাথেয়’ ছিল ১৯৭১ সালের ২ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে পরিচালিত ‘অসহযোগ আন্দোলন’। এই ধারণাটির বিন্যাস আমরা এভাবেও করতে পারি- লক্ষ্য স্বাধীন বাংলাদেশ, পথ মুক্তিযুদ্ধ, পাথেয় অসহযোগ আন্দোলন। বস্তুতপক্ষে ধর্মীয় উপনিবেশ পাকিস্তানের গর্ভ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে নির্বাচনের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মুক্তিযুদ্ধে উত্তরণে অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটও গড়ে উঠেছে এই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তথা সেনানায়কদের অক্ষমতার মধ্য থেকে। এই নির্বাচনের ফলাফলের মধ্য দিয়ে ধর্মের নামে অত্যাচার, জুলুম ও নির্যাতন থেকে বাঙালিদের মুক্তির আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয়েছিল।
১৯৭১ সালের মার্চে ধর্মীয় উপনিবেশ পাকিস্তানের সামরিক শাসকের স্বেচ্ছাচারী ঘোষণার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সংঘটিত অসহযোগ আন্দোলন এবং এর পঞ্চাশ বছর আগে ব্রিটিশ উপনিবেশের অঙ্গীভূত ভারতে ১৯২০-২১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকলেও অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে একটি মিল লক্ষ্য করা যায়। আর তা হলো এই দুটি অসহযোগ আন্দোলনই হয়েছিল বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে। ১৯২০-২১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের মূল নেতা ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। আর ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে সংঘটিত অসহযোগ আন্দোলনটি হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে এবং তার নেতৃত্বে। ১৯২০ সালের জুলাই মাসে সিন্ধু প্রদেশে আহ‚ত খিলাফত সম্মেলনে মহাত্মা গান্ধী (তৎকালীন) ভারতের ৭ কোটি মুসলমানদের সাহায্যের জন্য ২৩ কোটি হিন্দু জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। ১৯২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং সমবেত সদস্যদের প্রতিশ্রæতি দেন যে, যদি ভারতীয় জনগণ তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেন, তা হলে ভারতবাসী এক বছরের মধ্যেই ‘স্বরাজ’ লাভ করবে। এখানে উল্লেখ্য, বাংলার কতিপয় বিশিষ্ট নেতা এবং মুহম্মদ আলী জিন্নার বিরোধিতা সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে গান্ধীর প্রস্তাব গৃহীত হয়। মুসলিম লীগের সভাপতি জিন্নাহ অবশ্য পরে স্বীকার করেছিলেন যে, সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ নীতি গ্রহণ করা ছাড়া সে সময় আর কোনো পথই খোলা ছিল না। যদিও তিনি গান্ধীর পরিকল্পনার প্রতি বিশেষ আস্থাবান ছিলেন না। কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ১৯২১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার ২৬ বছর পর ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ছেড়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা চলে গিয়েছিল। ফলে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামের একটি কৃত্রিম রাষ্ট্রে বাঙালিরা তাদের অস্তিত্ব হারাতে বসেছিল। কিন্তু এর মধ্যেও অর্থাৎ ১৯২১ থেকে ১৯৪৭ এর মধ্যে বাঙালির রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় অনেক ঘটনা এবং দুর্ঘটনা ঘটেছে।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পদত্যাগের পর জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে ‘লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক অর্ডারে’র ভিত্তিতে সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী প্রথমবারের মতো সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের এবং ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ ৬ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে ৩১৩ আসনবিশিষ্ট পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় ২টি আসন থেকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হন। একটি কেন্দ্রে প্রাদেশিক কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান খাজা খায়েরউদ্দিন এক লাখেরও বেশি ভোটে বঙ্গবন্ধুর কাছে পরাজয়বরণ করেন। প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩০০ আসনবিশিষ্ট পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের ২৮৮টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ, অবশিষ্ট ১২টি পায় অন্যান্য দল। পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমানের পাকিস্তানে) জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি জয়ী হয়। তারা জাতীয় পরিষদের ১৪৪টি আসনের মধ্যে ৮৮টিতে জয়লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও কেউই নিজ অঞ্চল ছাড়া অন্য অঞ্চলে একটি আসনও পায়নি। এ নির্বাচনে বস্তুতপক্ষে পাকিস্তান সৃষ্টির আদর্শিক মতবাদের পরাজয় হয়। বাঙালিরা ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে। কৃত্রিমতার যুক্তি ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি দ্বারা প্রণীত ‘দ্বি-জাতি তত্ত্বের’ ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রটি মানবতার কাছে পরাভূত হয়। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে দলের বিরাট সাফল্য ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর ৯ ডিসেম্বর এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার পর ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭০ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বক্তব্য ও বিবৃতি প্রদান করেন। তিনি এ বিজয়কে ঐতিহাসিক বিজয় হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে জনসভা আহ্বান করা হয়। বিশাল জনসভায় সব জাতীয় পরিষদ সদস্য ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথ করান বঙ্গবন্ধু। এখানে তিনি কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। এ সময় তিনি কড়া ভাষায় ছয় দফার সঙ্গে বেঈমানি না করার জন্য আওয়ামী লীগের সব নির্বাচিত সদস্যদের হুঁশিয়ার করে দেন। বিশাল জনতা তুমুল হর্ষধ্বনি, স্লোগান ও হাত তুলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাকে স্বাগত জানান। ষড়যন্ত্র ঘনীভূত হতে থাকে।
ঢাকায় জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন আহ্বান করা হয়। তবে সব অপকৌশল অবলম্বন করে ভুট্টো ইয়াহিয়াকে বাধ্য করেন শেষ মুহ‚র্তে অধিবেশনে মূলতবী ঘোষণা করার জন্য। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বেলা ১টা ৫ মিনিটে ইয়াহিয়া স্বয়ং রেডিও পাকিস্তানে ঘোষণা করেন- জাতীয় পরিষদের ঢাকা অধিবেশন স্থগিত করা হলো। ইয়াহিয়ার বিবৃতির কার্যকর বিষয়টি ছিল এই যে, ‘জাতীয় পরিষদের বৈঠক পরবর্তী কোনো তারিখ পর্যন্ত স্থগিত করার’ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ওই স্থগিত ছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য। বিবৃতিতে এর কারণ হিসেবে বলা হয় যে, ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের মূল বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কোনো সর্বগ্রাহ্য সাধারণ মত গড়ে ওঠেনি। বেতার ঘোষণাটি যারা শুনছিলেন তাদের প্রতিক্রিয়া হলো নিদারুণভাবে অপমানিতের। সংক্ষিপ্ত বিবৃতিটিতে যা বলা হলো তার চেয়ে বড় প্রকাশ্য অবমাননা বাঙালি জনগণের জন্য আর কিছু হতে পারতো না।
ইয়াহিয়ার ঘোষণা শোনার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ দলীয় সব পরিষদ সদস্যকে বেলা ৩টায় হোটেল পূর্বাণীতে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। বলা হলো- সেখানে তিনি ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার ওপর পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। আওয়ামী লীগের গণপ্রতিনিধিরা বেলা ৩টার মধ্যেই হোটেল পূর্বাণীতে সমবেত হলেন। দলীয় নেতৃবৃন্দ পরিবেষ্টিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এলেন ৩টা ২০ মিনিটে। পরিস্থিতি ছিল তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ। বাইরে জড়ো হয়েছিলেন শত শত বিদেশি সাংবাদিক। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, ‘…কেবল সংখ্যালঘু দলের ভিন্নমতের কারণে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাধা দেয়া হয়েছে এবং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। …আমরা জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের প্রতিনিধি এবং আমরা এটা বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দিতে পারি না।’
বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। পরবর্তী ছয় দিনের জন্য আন্দোলনের কর্মসূচিও ঘোষণা করা হলো। এতে ছিল- পরদিন ঢাকায় হরতাল, ৩রা মার্চ সারা দেশে হরতাল এবং ৭ মার্চ ঢাকায় জনসভা।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ অধিবেশন বসার কথা ছিল। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অধিবেশন বন্ধ করার প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকা শহরে হরতাল পালিত হয়। ৩ মার্চ বুধবার সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ দৈনিক সংবাদে হরতাল পালনের খবর এভাবে দেয়া হয়-
‘সর্বাত্মক হরতাল এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব কর্তৃক সরকারি কর্মচারীদের অফিস-আদালতে যোগদান না করার নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসন সম্পূর্ণরূপে অচল হইয়া পড়িয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান সেক্রেটারিয়েট, হাইকোর্ট, স্টেট ব্যাংকসহ প্রদেশের সব কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারি অফিস বন্ধ থাকে। সব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ থাকে। যোগাযোগের সব মাধ্যম যানবাহন, বিমান সংস্থা, রেলওয়ে, স্টিমার, লঞ্চ, বাস, ট্যাক্সি সবকিছু অচল থাকে। বেলা ২টার পর হরতালের মেয়াদ উত্তীর্ণ হইলে কেবলমাত্র বেসরকারি যানবাহন চলাচলের অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, স্টক এক্সচেঞ্জ ও অন্যান্য অর্থকরী সংস্থার কাজ বন্ধ রহিয়াছে।’
হাসপাতাল, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ প্রতিষ্ঠান, বেতার, টেলিভিশন ও অন্যান্য জরুরি সার্ভিস চালু থাকে। শান্তিপূর্ণ অহিংস অবস্থায় অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য জনসাধারণের প্রতি বঙ্গবন্ধু যে আহ্বান জানিয়েছেন তার পর হতেই সাধারণভাবে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছিল। স্বাধিকার আন্দোলনকে শান্তি ও শৃঙ্খলার সঙ্গে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থে ঢাকা শহরের প্রতিটি মহল্লায়, আবাসিক এলাকা, কলোনি, বস্তি ও বাণিজ্যিক এলাকায় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়েছে। এসব সংগ্রাম কমিটি, বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনী, আনসার বাহিনী, বিভিন্ন সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান, পাঠাগার, ক্লাব প্রভৃতি সম্মিলিতভাবে সর্বক্ষণ বিশেষত সারা রাত্রিব্যাপী নিজ নিজ এলাকায় কড়া প্রহরা চালিয়ে যাচ্ছিল। সচেতন ছাত্র, শ্রমিক, ব্যবসায়ী তথা আপামর জনসাধারণের এই সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণের ফলে সমাজবিরোধী, দুষ্কৃতকারী, গুণ্ডা, বদমায়েশ ও প্রতিক্রিয়ার দালালদের দুষ্কর্মের প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছিল। শহরবাসী জনসাধারণ বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক ঘোষিত প্রতিদিনের কর্মসূচিকে অত্যন্ত শৃঙ্খলার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রতিটি মিছিল, সভা ও সমাবেশ এর ফলে রাজনৈতিকভাবে আরো জঙ্গিরূপ ধারণ করছিল।
৬ই মার্চ ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে লে. জেনারেল টিক্কা খানের নাম ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তর থেকে ৭৪ নম্বর সামরিক আইন বিধি বলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাঁচজন সেনা কমান্ডারকে বিভিন্ন অঞ্চলের সহকারী প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। প্রশাসকরা হলেন- ‘খ’ অঞ্চল- মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা, ‘গ’ অঞ্চল- মেজর জেনারেল এ এ কে নিয়াজী, ‘ঘ’ অঞ্চল- মেজর জেনারেল এম রহিম খান, ‘ঙ’ অঞ্চল- মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ এবং ‘চ’ অঞ্চলে- মেজর জেনারেল মোহাম্মদ জামশেদ।
৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা। এই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খল মুক্তির আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। …এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। …রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’
তিনি (বঙ্গবন্ধু) শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান এবং ইয়াহিয়া খানের সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। প্রকৃত পক্ষে ৭ মার্চ প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা। একদিকে জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশ যেত, অপর দিকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কস্থ বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে তিনি নির্দেশ দিতেন। বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলতেন। অফিস, আদালত, ব্যাংক, বীমা, স্কুল-কলেজ, গাড়ি, শিল্প কারখানা সবই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনেছে। ইয়াহিয়ার সব নির্দেশ অমান্য করে অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া ইতিহাসে বিরল ঘটনা। ব্রিটেনের দৈনিক সংবাদপত্র ইভিনিং স্টান্ডার্ড-এ পরিবেশিত সংবাদটি এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য,
Sheikh Mujibur Rahaman now appears to be the real boss of East Pakistan, with the complete support of the population…Rahaman’s home in Dhanmondi, already known as Number 10 Downing Street in imitation of the British Prime Minister’s residence-has been besieged by bureaucrats, politicians, bankers, industrialists and people from all walks of life.
মূলত ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। ১৬ মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর সন্ধ্যায় ইয়াাহিয়ার ঢাকা ত্যাগ। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার।
বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন :
This may be my last message; from to-day Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.
অর্থাৎ এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।
এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাংলায় নিম্নলিখিত একটি বার্তা পাঠান :
‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করেছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপোস নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’
বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সারা দেশে পাঠানো হয়। সর্বস্তরের জনগণের পাশাপাশি চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি জওয়ান ও অফিসাররা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১.৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। এর তিনদিন পর তাঁকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এক ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করেন। এর বিপরীতে ওই তারিখেই অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশ লাভ করে স্বাধীনতা।
প্রফেসর ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ও পরিচালক, সাউথ এশিয়ান স্টাডি সার্কেল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
©somewhere in net ltd.