![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পেশাদার ও নেশাদার লেখক, মাঝে মাঝে কবি
কোন না কোন সূত্রে বিশ্বের সব কবি সাহিত্যিকই এক এবং একই সঙ্গে আলাদা। দুই দেশের লেখক কবিকে আমার মনে হয় নদী বা সমুদ্রের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন সত্তা। যাদের দিগন্ত আলাদা, সুরটি ভিন্ন কিন্তু তার বাস করেন এক বৃহৎ আকাশ আর নীলের নীচে। এক আকাশের নীচে অন্য দিগন্তের মানুষগুলোর ভিন্ন সুর শোনার আনন্দই আলাদা। সেই আনন্দ ভাগ করার একটা চেষ্টা এই লেখনী গুচ্ছ। বলা দরকার, এখানে বিশ্বের ভিন্ন ভাষা ও অন্য দেশের কবি সাহিত্যিকদের জীবন ও কর্মকে তুলে ধরা হবে খুবই সীমিত আকারে। মূল উদ্দেশ্যটি ভিন্নতার স্বাদ আর অন্যের সঙ্গে পরিচয়। সূচনা পর্বে চিলির নোবেল বিজয়ী নারী কবি গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রালের কথা তুলে ধরা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ যেভাবে চিলির নেরুদাকে চেনেন সেভাবে মিস্ত্রালকে অতোটা চেনেন না, কিন্তু তার ভিন্ন ভাষা, ভাবনা ও জীবন ভঙ্গি আলোচনার দাবী রাখে।
গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রাল
মুম রহমান
পৃথিবীতে খুব কম কবি আছেন যাদের ছবি কোন মূদ্রায় ছাপা হয়েছে। চিলির নোবেল বিজয়ী নারী কবি গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রালের মুখটা দেখা যায় সে দেশের ৫০০০ পেশোর নোটে। নোবেল পুরস্কার কমিটি তার সম্পর্কে বলেছে, ‘‘ তার নামটিই সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকার আদর্শগত অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে উঠেছে।’’ তিনি ল্যাটিন আমেরিকার প্রথম নোবেল বিজয়ী কবি। তিনি আমেরিকার চারটি কলেজে স্প্যানীয় সাহিত্য নিয়ে পড়িয়েছেন। কবি হিসাবেই শুধু নয় চিলির ইতিহাসে তিনি একজন শিক্ষাবিদ, কূটনৈতিক, নীতি নির্ধারক, নারী ও শিশু অধিকার রক্ষায় একাগ্র কর্মী হিসাবে অমর হয়ে আছেন। আজও তার নামে পরিচালিত ফাউন্ডেশন অসহায় ও সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে অকাতরে।
কিন্তু কোন পথই কুসুম বিস্তৃর্ন নয়। চিলির ভিকুনাতে ৭ এপ্রিল ১৮৮৯ সালে চিলির দরিদ্র এক পরিবারে গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রালের জন্ম। জীবনের শুরুটা তার বেদনা বিধুর ও সংগ্রামময়। মাত্র তিন বছর বয়সে তার স্কুল শিক্ষক বাবা তাদেরকে ছেড়ে চলে যায়। মা’র কাছেই সে বড় হয়। গ্রামের এক প্রাথমিক স্কুলে বড় বোন এমিলিনা মলিনার তত্ত্ববধানেই তার পড়ালেখার শুরু হয়। এমিলিনা এই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। গ্যাব্রিয়েল তার সারা জীবনে বড় বোনের প্রতি কৃতজ্ঞা প্রকাশে কোন কুণ্ঠা রাখেনি। তার মায়েল স্কাস্থ ছিলো দূর্বল, ফলে তিনি কোন কাজ করতে পারতেন না। শৈশব, কৈশোর চরম দারিদ্রের মুখোমুখি হয়েছেন মিস্ত্রাল। অবশেষে পরিবারকে সহায়তা করার জন্যই মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি গ্রামের একটি স্কুলের সহকারী শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। এই সময় থেকেই তিনি কাব্য চর্চা শুরু করেন।
১৯০৬ সালে শিক্ষক হিসাবে কাজ করার সময়ই ১৭ বছর বয়সে রোমিও ওরেটা’র সঙ্গে তার পরিচয় ও পরিণয় হয়। কিন্তু এই প্রেম পরিণতি পায়নি। তিন বছর পরই রোমিও আত্মহত্যা করে। আকস্মিক এই বেদনাভার তার উপর তীব্র প্রভাব ফেলে। তার কবিতা ঝীবন ও মৃত্যুর ভাবনা এই সময়ই থেকেই তীব্র হতে থাকে। প্রেমিক হারানো বেদনা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এক ভাতিজাও আত্মহত্যা করে। তার কবিতায় মৃত্যু, বেদনা, ভালবাসা, মায়া ইত্যাদি বিষয়ে স্থায়ীছাপ পড়ে সে সময় থেকেই। পরবর্তী জীবনে তিনি বহু মানুষের সঙ্গে মিলিত হন, ঘনিষ্ট হন, কিন্তু ব্যক্তি জীবন নিয়ে তিনি কোন কথাই বলতেন না। তার সকল গোপনীয়তা যেন তার কবিতাতেই প্রকট হয়ে উঠতো।
অল্প বয়সেই গ্যাব্রিয়েল পরিণত মনস্ক হয়ে উঠেন। জীবনের রুক্ষতা, মৃত্যুর আকস্মিক ও অনিবার্যতা তাকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি সব সময় চিলির দরিদ্র মানুষের উন্নয়নের জন্য ভাবতেন। তিনি কৈশোর ও যৌবনের এক বড় অংশ চিলির দরিদ্র মানুষদের শিক্ষায় নিজেকে নিবেদন করেন। পরবর্তী জীবনে মিস্ত্রাল কলেজে শিক্ষকতা করেনএবং পেশাগত জীবনের শেষপর্যায়ে সংস্কৃতি ও কূটনীতি মন্ত্রণালয়ে কাজ নেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তার কবিতা চর্চা চলতে থাকে। খুব দ্রতই তার কবিতা দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১৪ সালের ২২ ডিসেম্বর তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ মৃত্যুর জন্য সনেট (Sonetros de la muerte) -এর জন্য চিলির হোর্হেস ফ্লোরালেস নামের জাতীয় পুরস্কৃত অর্জন করেন। এই পুরস্কার তাকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। উল্লেখ্য ১৯০৮ সাল থেকেই তিনি গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রাল ছদ্মনামে লিখতে শুরু করেন। গ্যাব্রিয়েল ডি’আনুযিও এবং ফ্যাডিরিক মিস্ত্রাল - প্রিয় এই দুই কবির নামের অংশ নিয়ে লুসিলা গোডি হয়ে উঠেন গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রাল।
১৯২২ সালে ডিজেপিয়ার (Desolación) নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়। কবিতা লেখা ও শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি শিক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করতে থাকেন। কবি ও শিক্ষাবিদ হিসাবে ক্রমশ তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২২ সালেই তাকে ম্যাক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আমন্ত্রণ জানান ম্যাক্সিকোর প্রথম সরকারি বিদ্যালয় পদ্ধতি প্রণয়নের কাজে। এ সময় থেকেই তিনি ইউরোপ আমেরিকা মহাদেশের একাধিক দেশে শিক্ষকতা নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান।
তিনি প্রথম ল্যাটিন আমেরিকার কবি হিসাবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৪৫ সালে। মিস্ত্রাল নোবেল পুরস্কার পান, ‘‘তার প্রবল আবেগ দ্বারা তাড়িত গীতিময় কবিতার জন্য যার জন্য তার নামটিই সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকার আদর্শগত অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে উঠেছে।’’ মাদ্রিদ, লিসবন, নিস, পেট্রোপলিস, লসএঞ্জেলেস, ম্যাক্সিকো, ন্যাপলস, নিউইয়র্ক সহ একাধিক শহরে তিনি শিক্ষা কাউন্সিল গঠন করেন। নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্নার্ড কলেজে পাঠ দান করেন। ম্যাক্সিকো ও চিলি’র সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা ও কাব্য চর্চার পাশাপাশি নারী অধিকার নিয়েও তিনি কাজ করে গেছেন। দরিদ্র শিশুদের জন্য বিশ্বব্যাপী তহবিল গঠনে তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৪৬ সালে জাতিসংঘএগিয়ে আসে। জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়নে তিনি অগ্রগামীভূমিকা রাখেন।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিউইয়র্কের রোজলিন হাইটস কলেজে পাঠ দান করেন। ১৯৫৭ সালে অগ্নাশয় ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ৬৭ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।
গ্যাব্রিয়েলের জীবন ও কর্ম তার দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি নিবেদিত ছিলো, বিশেষ করে শিশু ও দরিদ্রদের প্রতি তার দরদ ছিলো সীমাহীন। গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রাল ফাউন্ডেশন আজও তার প্রিয় মাতৃভূমি চিলির দরিদ্র ও অনুন্নত শিশুদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
তার কবিতায় বিশ্বাস, বিষাদ, ভালবাসা ও মৃত্যু প্রকাশিত হয়েছে বারবার। সমকালের আরেক ল্যাটিন কবি পাবলো নেরুদার সাথে তার একাধিক সাক্ষাৎ হয়। নেরুদার কবিতার মৌলিক বৈশিষ্ট্য নির্মাণে তিনি শুরু থেকেই একজন উৎসাহদাতা হিসাবে কাজ করেছেন।
পুরস্কার
১৯১৪ : হোর্হেস ফ্লোরালেস
১৯৪৫ : সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার
১৯৫১ : সাহিত্যের জন্য চিলির জাতীয় পুরস্কার
কাব্যগ্রন্থ
১৯১৪ : মৃত্যুর জন্য সনেটগুচ্ছ (Sonetos de la muerte )
১৯২২ : নিরুদ্দেশ (Desolación )
১৯২৩ : নারীর জন্য পাঠ (Lecturas para Mujeres )
১৯২৪ : নিষ্পাপ : শিশুর জন্য গান (Ternura: canciones de niños)
১৯৩৪ : সাদা মেঘ ও চিলির গান (Nubes Blancas y Breve Descripción de Chile )
১৯৩৮ : ফসল ফলানো (Tala)
১৯৪১ : সংকল : গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রালের নির্বাচিত কবিতা (Antología: Selección de Gabriela Mistral)
১৯৫২ : মৃত্যু ও অন্যান্য শোকগাথার কবিতা (Los sonetos de la muerte y otros poemas elegíacos)
১৯৫৩ : চোলাইখানা (Lagar)
১৯৫৭ : চিলিকে গণণা ( Contando a Chile)
১৯৫৮ : সমগ্র কবিতা (Poesías completas)
১৯৬৭ : চিলির কবিতা (Poema de Chile )
১৯৯২ : চোলাইখানা ২ (Lagar 2)
গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রালের তিনটি কবিতা
যারা নৃত্য করে না
এক পঙ্গু শিশু
বললো, ‘‘আমিকীকরেনাচবো?’’
তোমার হৃদয়কে নাচতে দাও
আমরা বললাম।
অতঃপর সেই অচল বললো :
‘‘আমি কী করে গাইবো?’’
তোমার হৃদয়কে গাইতে দাও
আমরা বললাম
অতঃপর কথা বললো নিঃস্ব মৃতকাটাগাছ
‘‘কিন্তু আমি, আমি কী করে নাচবো?”
তোমার হৃদয়কে বাতাসে উড়তে দাও
আমরা বললাম।
অতঃপর উর্ধ্ব থেকে ঈশ্বর কথা বললেন
‘‘আমি কেমন করে এই নীল থেকে অবতরণ করবো?’’
আসুন আমাদের জন্য নাচুনএইখানে এই আলোতে
আমরা বললাম।
সকল উপত্যকা নেচে উঠছে
একত্রে এই সূর্যের নীচে
এবং তারহৃদয় যে আমাদের সাথে যোগ দেয়নি
ধুলাতে পরিণত হচ্ছে, ধুলা থেকে ধুলাতে।
বিষন্ন মা
ঘুমাও, ঘুমাও, আমার প্রিয়তম
কোন উদ্বেগ ছাড়া, কোন ভীতি ছাড়া,
যদিও আমার আত্মা ঘুমায়না,
যদিও আমি বিশ্রাম নেই না।
ঘুমাও, ঘুমাও, এবং রাত্রিরে
তোমার ফিসফিসানি কোমল হোক
ঘাসের পাতার চেয়েও,
অথবা রেশমী ভেড়ার লোমের চেয়েও।
আমার এই কায়া তোমার ঘুমে মিলাক,
আমার উদ্বেগ, আমার কম্পন।
তোমার মধ্যে, আমার চোখ বন্ধ হোক
এবং আমার হৃদয় নিদ্রা যাক।
আমি একা নই
[/sb
এই রাত্রি, সে তোজনশূন্য
পাহাড় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত
কিন্তু আমি, যে তোমাকে দোলা দেয়
আমি তো একা নই!
এই আকাশ, সে তো জনশূন্য
চাঁদের ঝরণা থেকে সমুদ্র পর্যন্ত
কিন্তু আমি, যে তোমাকে ধারণকরে
আমি তো একা নই!
এই বিশ্ব, সে তো জনশূন্য
দেখো, সকল জৈবদেহ বিষন্ন
কিন্তু আমি, যে তোমাকে জড়িয়ে ধরে
আমি তোএকা নই!
২| ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৭:৪৭
মামুন রশিদ বলেছেন: খুব ভালো ।
©somewhere in net ltd.
১|
১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৪ বিকাল ৪:৫৪
অরুদ্ধ সকাল বলেছেন: বাহ! দারুন কিছু পেলাম।
জানতামই না এমন কীর্তিমান লেখককের কথা। উনার কবিতাও এর আগে পড়িনি। ভালো লাগলো জীবনী আর কবিতা।